সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

লেখক: সৌভিক ঘোষাল

সৌভিক ঘোষাল
লেখক সাহিত্যের শিক্ষক। আগ্রহের বিষয় ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব।
বাংলা ভাষা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের দীর্ঘ সময়টাকে আমরা দুটো বড়ো উপবিভাগে বিভক্ত করে থাকি। প্রথম অংশটাকে বলি আদি-মধ্যযুগ আর পরের অংশটাকে অন্ত-মধ্যযুগ। এই দুই যুগের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন মধ্যযুগের বাংলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব শ্রীচৈতন্যদেব। চৈতন্যদেবের জন্ম ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে আর প্রয়াণ ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে। সাধারণভাবে ১৩৫০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে আমরা আদি-মধ্যযুগ এবং ১৫০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে অন্ত-মধ্যযুগ বলে থাকি। ১২০০ থেকে ১৩৫০ – এই সময়কালের বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের তেমন কোনও নিদর্শন আমাদের কাছে নেই। ফলে বাংলা ভাষা সাহিত্যের আদিযুগ যখন ১২০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শেষ হয়ে গেল, তখনই আদি-মধ্যযুগের শুরু এমনটা বললেন না ভাষা সাহিত্যের ইতিহাসকাররা। তাঁদের মনে হল ১২০০ – ১৩৫০ কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে মতো আকর বা আলো যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন একে অন্ধকার যুগ হিসেবেই আপাতত চিহ্নিত করা বাঞ্ছনীয়। এই ধরনের যুগবিভাগ অবশ্যই পালটে যেতে পারে যদি এই পর্বে লেখা ভাষা সাহিত্যের কোনও গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন আমরা খুঁজে পাই।
১৯২০ সালে রাশিয়ার বলশেভিকরা তিন বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর শ্বেতরক্ষীদের নির্ণায়কভাবে পরাস্ত করতে সক্ষম হলেও দেশের অর্থনীতি ও পরিকাঠামো ভেঙে চুরে যায়। রাশিয়ার পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে খানিকটা পেছনে সরে এসে নেওয়া হয় নয়া আর্থিক নীতি বা নেপ। এতে গ্রামাঞ্চলে ধনী কৃষক ও কুলাকদের অনেকটা ছাড় দেওয়া হয়, যাতে রাশিয়ায় কৃষি উৎপাদন বাড়ে এবং সেনাবাহিনী ও শহরে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ বরাদ্দ থাকে। ভারী শিল্প ও কলকারখানা এরপরেও বেশ কয়েক বছর বেশ সঙ্কটগ্রস্থ অবস্থায় থাকলেও কৃষি উৎপাদন ক্রমশ বাড়তে থাকে। ১৯২৪ এ লেনিনের মৃত্যুর পর রাশিয়ায় শুরু হয় নেপ নিয়ে এক মহাবিতর্ক।
১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের পুঁথিশালা থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কার করলেন চর্যাপদ সমূহের একটি সংকলন। আবিষ্কারের দশ বছরের মাথায় তাঁর সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে সেগুলি প্রকাশিত হল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে। তারপর থেকে এর ভাষা ও বিষয়বস্তু নিয়ে, চর্যার পদকর্তাদের নিয়ে অনেক গবেষণা হল। আলাপ আলোচনা ও বিতর্কের দীর্ঘ ইতিহাস পেরিয়ে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার প্রায় একমাত্র এই নিদর্শনের নানাদিক আমাদের কাছে এখন অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বৌদ্ধধর্মের বিশেষজ্ঞ আচার্য বিধুশেখর শাস্ত্রী, চর্যাপদের তিব্বতী টীকার আবিষ্কর্তা প্রবোদ চন্দ্র বাগচী ছাড়াও যে সমস্ত ভাষাতাত্ত্বিকের গবেষণা এই কাজে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মহম্মদ শহীদুল্লাহ, আচার্য সুকুমার সেন, অধ্যাপক পরেশচন্দ্র মজুমদার, অধ্যাপক রামেশ্বর শ, অধ্যাপক নির্মল দাশ প্রমুখ।
১০৫৪ সাধারণ অব্দে তিব্বতের লাসার কাছে প্রায় ৭৩ বছর বয়সে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বা অতীশ মারা যান। তিনি ছিলেন ভারত তথা বিশ্বের সেকালের অন্যতম প্রধান পণ্ডিত। পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারত ও তিব্বতে বৌদ্ধমতের চর্চায় তাঁর প্রভাব অতুলনীয়। দেশে নানাজনের কাছে ও নানা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তিনি গিয়েছিলেন সুমাত্রায়, সেখানকার বিখ্যাত পণ্ডিত ধর্মকীর্তির কাছে বৌদ্ধ দর্শন অধ্যয়নের জন্য। ভারতে ফিরে এসে অতীশ তখনকার কয়েকটি প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এগুলির মধ্যে ছিল বিক্রমশীল, ওদন্তপুরী, সোমপুরী, নালন্দা প্রভৃতি। এরপর তিব্বতের রাজা ও জনগণের আমন্ত্রণে সে দেশে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধশিক্ষার সংস্কার ও বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি কঠিন পথ পরিক্রমা করে তিব্বতে যান। একদিকে শিক্ষক, অন্যদিকে লেখক ও সংগঠক হিসেবে অতীশ অসামান্য অবদান রাখেন। নিজের এবং অন্যান্যদের লেখা নানা বৌদ্ধ গ্রন্থের তিব্বতী অনুবাদেও তাঁর বিরাট ভূমিকা ছিল।