সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সাংস্কৃতিক ইতিহাস

আমার জন্ম বেলারুশে, ডাক্তারদের একটি পরিবারে। আমার বাবা-মা আমাদের রেখে যেতেন একজন আয়ার যত্নে, যিনি বেলারুশের গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলেন। আয়া বেলারুশের রূপকথার গল্প বলতেন, তাকে বিরক্ত করলে চিৎকার করতেন ‘পেরুন তোকে ধরে নিয়ে যাবে’! পেরুনকে (প্রাক-খ্রিস্টিয় পাগান স্লাভদের মূল দেবতা) তিনি স্বর্গে বসবাসকারী এবং ঝড়, বজ্রপাত আর বজ্রপাতের নিয়ন্ত্রক বলতেন। বিজ্ঞান পেরুন সম্পর্কে আমার ছেলেবেলার আয়ার চেয়ে সামান্য বেশি জানে। এমনকি আমরা যে কয়েকটি তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি তা পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং তাঁর সঙ্গে যুক্ত পৌত্তলিক দেবতাদের সম্পর্কিত; যেমন বলি, মূর্তি, শপথ, নাম সংকীর্তন ইত্যাদি। (‘পেরুনের পুনরুত্থান, পূর্ব স্লাভিক পৌত্তলিকতার পুনর্গঠনের জন্য’ বইটির১ ভূমিকা, ২০০৪)
সময়টা সাধারণাব্দের চতুর্থ শতকের শেষ, পঞ্চম শতকের শুরু। ইউরোপীয় ইতিহাসচর্চায় তখনও গ্রিকো-রোমান ধারারই রমরমা। প্রায় হাজার বছর আগে হেরোডোটাস চিন্তার যে নতুন রাজপথ খুলে দিয়েছিলেন, তাতে ইতিহাসের রথ চালিয়ে চলে গেছেন গ্রিকদের মধ্যে থুকিডিডিস, পলিবিয়াস আর রোমানদের মধ্যে লিভি, প্লুটার্ক আর তাসিতুসদের মতো রথী মহারথী। প্রায় হাজার বছর ধরে ইউরোপীয় ইতিহাস চিন্তার জগতে একাধিপত্য করে চলেছে গ্রিকো-রোমান ইতিহাস চর্চার এই রথ। হঠাৎ এই রথের পথরোধ করে দাঁড়ালেন কয়েকজন। এতদিন ইতিহাস আলোচনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ ও তার কাহিনী। সময়ের ধারণা ছিল চক্রাকার। মনে করা হত ইতিহাসের ঘটনাগুলি পূর্বেও ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। গ্রিকো-রোমান ধারায় ইতিহাস লেখার উদ্দেশ্যই তো ছিল ভবিষ্যতে যখন একই ঘটনা আবার ঘটবে, তখন মানুষ যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে আর ভুল সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকে তা নিশ্চিত করা।
বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের অধিকাংশ, পাঞ্জাব প্রদেশের কিছু অংশ এবং পূর্ব আফগানিস্তানের একটি অংশ বহু প্রাচীনকাল থেকে গান্ধার নামে পরিচিত ছিল, ঋগ্বেদেও (১.১২৬.৭) গান্ধারের উল্লেখ আছে। ষষ্ঠ শতক সাধারণপূর্বাব্দের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে চতুর্থ শতক সাধারণপূর্বাব্দের শেষার্ধে আলেকজান্ডারের অভিযান পর্যন্ত গান্ধার (প্রাচীন পারসিক ভাষায় গন্দার) অঞ্চল আকিমিনীয় সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল। চতুর্থ শতক সাধারণপূর্বাব্দের শেষে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এই এলাকাকে তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রথম সহস্রাব্দ সাধারণপূর্বাব্দের মাঝামাঝি থেকে প্রাচীন গান্ধারের দুটি মুখ্য নগর ছিল পুষ্কলাবতী (বর্তমান চারসদ্দা) ও তক্ষশিলা।
বাংলা গান। বাঙালির এক অপরিমেয় অহংকার। তার নিজস্ব রত্নভাণ্ডার। বাঙালির হাজারও দোষের চর্চা হলেও ভারত জুড়ে আজও তার কোকিলকন্ঠের প্রশংসা করার লোকের অভাব হয় না। চর্যাপদের গায়েন থেকে শুরু করে আজকের স্বনামধন্য গায়ক গায়িকা পর্যন্ত সংগীতের এক স্বপ্নিল উত্তরাধিকারের ধারক বাঙালির সংগীতপ্রেমের জুড়ি মেলা ভার। শুরুর সেদিন থেকে বাঙালির সংগীত বহু ধারা উপধারায় বহমান। সমস্ত ধারাকে একসাথে এই ছোট্ট পরিসরে ধরা এক সুকঠিন কাজ। কারণ, বাঙালির সংগীতের সূচনালগ্ন থেকেই তাতে সমান্তরাল দুটি ধারা পরিপুষ্ট হয়ে চলেছে —লোকসংগীত ও শাস্ত্রীয় সংগীত। আর গান মানে তাতে বিভিন্ন রাগ রাগিণীর ব্যবহার থাকবেই। বঙ্গাল, ভাটিয়ালি, গৌড় মল্লার, গৌড় সারঙ্গ ইত্যাদি রাগিণী যে এই পোড়া দেশের ছাই উড়িয়ে পাওয়া অমূল্য রতন তা তো ‘নাম দিয়ে যায় চেনা’। সূচনালগ্নের চর্যাগান থেকে কীর্তন ও ঢপ কীর্তন পর্যন্ত পারস্পরিক আত্মীয় সম্পর্কে বাঁধা কয়েকটি গানের ধারা কেবল আমরা এই প্রবন্ধে আলোচনা করব। তবে শুরুরও একটা শুরু থাকে।