সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ইহুদি উপাসনালয়ে ইসলামী শৈলী

ইহুদি উপাসনালয়ে ইসলামী শৈলী

জ্যোতির্ময় পাল

ডিসেম্বর ২, ২০২৩ ১৪৩ 0

সিনাগগ হল ইহুদিদের উপাসনা ক্ষেত্র। ঊনবিংশ শতকে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে যখন বড়ো বড়ো সিনাগগ তৈরি হয়, তাদের স্থাপত্য খ্রীষ্টান চার্চের থেকে স্বকীয়ভাবে গড়ে ওঠে। এরকম এক প্রাচীন সিনাগগ দেখতে চললাম প্রাগ শহরে। প্রাগ মধ্য ইউরোপে, কিন্তু প্রাগের সব থেকে পুরোনো সিনাগগের নাম “স্প্যানিশ সিনাগগ”! প্রাগে কীকরে এল স্পেনের সিনাগগ? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দেখা গেল শিল্পের মেলবন্ধন কীভাবে গৌণ করে দেয় ধর্মের বিভাজন!

হার্ট অফ ইউরোপ

ভৌগোলিকভাবে ইউরোপের কেন্দ্রে অবস্থান করছে চেক রিপাব্লিকের রাজধানী প্রাগ, যার স্থানীয় নাম প্রাহা। সম্ভবত ইউরোপের সব থেকে প্রাণবন্ত শহর প্রাহা। মাঝখান দিয়ে বয়ে যায় ভল্টভা নদী, ডানদিকে প্রাচীন শহরের প্রাণকেন্দ্র, বামদিকে পাহাড়ে প্রাহার দুর্গ। প্রায় ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝিতে নদীর দুই পার সংযোগ করা হয়। বর্তমানে এই ঐতিহ্য মণ্ডিত ব্রিজটির নাম চার্লস ব্রিজ।

কোনো এক শীতের বিকেলবেলা ভল্টভার ওপর সূর্যাস্ত হয়, মৃদু বরফে সাদা হয়ে থাকে চার্লস ব্রিজের পাথুরে রাস্তা, প্রাচীন শহরের গোথিক চার্চের মাথা জেগে থাকে সবার ওপরে। আজ থেকে হাজার বছর আগে, এই রকম সন্ধেবেলা হয়তো কোনো রাজদূত একাকী ঘোড়ায় চড়ে চার্লস ব্রিজ পেরিয়ে যেত টিমটিমে আলোয় ঘেরা পথে। চোখ বন্ধ করলেই যেন ভেসে ওঠে সেই প্রাচীন বোহেমিয়ার দৃশ্য। প্রাহা এমনি মায়াবী।

প্রাগের ঐতিহাসিক সিটি সেন্টারের কোলাহল পেরিয়ে সেন্ট নিকোলাস চার্চের পাশ দিয়ে গেলেই ইহুদি পাড়া। প্রায় দশম শতক থেকে এখানে ইহুদি জনগোষ্ঠীর লোকজন বসবাস শুরু করে। ছয়শো বছর ধরে নিপীড়িত হবার পরে নবজাগরণের প্রভাবে উদ্বুদ্ধ হয় প্রাহার ইহুদি পাড়া। তৈরি হয় সিনাগগ, স্কুল, হাসপাতাল। এই সব অলিগলির মধ্যেই হেঁটে বেড়াতেন ফ্রান্জ কাফকা, ক্যারেল পোলাচেকের মতো বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা। বর্তমানে সেই ইতিহাস বিজরিত ইহুদিপাড়ার সব থেকে আকর্ষণীয় যে স্থাপত্যটি চোখে পড়বে তার নাম স্প্যানিশ সিনাগগ। মধ্য ইউরোপের প্রাহায় একটা ইহুদি উপাসনা গৃহের নাম “স্প্যানিশ” কেন হতে যাবে? এই প্রশ্ন নিয়েই সিনাগগের ভিতর ঢুকে ছিলাম। সাথে ছিল অডিও গাইড।

১৮৩৭ সালে ইহুদি পাড়ার পুরোনো সিনাগগের সংস্কার শুরু হয়। কিন্তু ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ১৮৬৭ সালে পুরোনো সিনাগগটিকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে নতুন একটা সিনাগগ তৈরি করা হয়। এটাই আজকের স্প্যানিশ সিনাগগ। সিনাগগের ভিতরে এখনও উপাসনা করা হয় প্রতি শনিবার করে, বাকি দিনগুলো সাধারণ মানুষের জন্য খোলা থাকে। ভিতরটা পুরোটাই মিউজিয়াম, আর চোখ ধাঁধানো কারুকার্য। সাধারণত সিনাগগের ভিতর বিশেষ কিছু থাকে না, ভীষণ ছিমছাম উপাসনালয়। তবে এই সিনাগগের ভিতরে ঢুকে দেখলে চোখ কপালে উঠে যাবে। স্বর্গরাজ্যের মধ্যে হাঁটাচলা করছি বলে অনুভব করলাম। ইতিমধ্যে অডিও গাইড আর মিউজিয়ামের পুস্তিকা পড়ে জেনে ফেলেছি এই সিনাগগ স্পেনের মুরিশ স্থাপত্যের আদলে তৈরি। তাই এর নাম স্প্যানিশ সিনাগগ। মুরিশ স্থাপত্য নিয়ে তখনই বিশেষ কিছু মাথায় ছিল না, স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের ইসলামিক কিছু স্থাপত্যের সাথে জড়িত, তা জানতাম। ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি সিনাগগ, বড়ো অদ্ভুত লেগেছিল। মিউজিয়ামের মধ্যে থাকা বিভিন্ন সংগ্রহগুলো সম্পর্কে টীকা নিয়ে, ছবি তুলে চলে এলাম। বিভিন্ন বইপত্র, জার্নাল খুঁজতে লাগলাম কীকরে এই সাংস্কৃতিক আদান প্রদান হল সেই বিষয়ে। স্থাপত্য নিজের বিষয় নয়, তবুও শিল্পের এই অভাবনীয় বিবর্তন বারবারই আমাকে মুগ্ধ করেছে। শুরু করলাম কিছু শখের গবেষণা।

মুরিশ স্থাপত্য

স্পেনের আল-আন্দালুসের আইবেরিয়ান উপদ্বীপ এবং সংলগ্ন উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার (মাগরেব) উপকূলবর্তী দেশগুলোর (মরক্কো, টিউনিসিয়া, আলজেরিয়া) মধ্যে প্রচলিত ইসলামিক স্থাপত্যের একটা অংশ হল মুরিশ শৈলী। কোনো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক এই শৈলীকে “মহামেডান”, “আরাবিক”, “মুরিশ-ইসলামিক”, “সারাসিন”, বা সাধারণভাবে “ইসলামিক” বলে অভিহিত করেছেন। কানাডিয়ান নৃতাত্ত্বিক ইভান কলমার মুরিশ স্থাপত্যের কিছু বৈশিষ্ট আলোচনা করেছেন তাঁর প্রবন্ধে। তাঁর মতে এই সমস্ত বৈশিষ্টগুলির মধ্যে কোনো এক বা একাধিক উপাদান থাকলে সেই স্থাপত্যকে মুরিশ বলা যেতে পারে। এদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল:

১. অশ্বক্ষুরাকৃতি জানালা

২. এক বা একাধিক গম্বুজ, যেমন দেখা যায় তাজমহলের স্থাপত্যে

৩. উঁচু মিনার

৪. সম্মুখভাগে অষ্টভুজ জ্যামিতির স্থান

৫. পর্যায়ক্রমিক রঙের ব্যান্ড

৬. ভিতরে একাধিক রঙের মিশ্রণে তৈরি আলহামরা অনুপ্রাণিত মোটিফ

৭. বিভিন্ন আকারের ধনুকাকৃতি, অশ্বক্ষুরাকৃতি কাঠামো

৮. পাতলা স্তম্ভের গায়ে আলহামরা অনুপ্রাণিত মোটিফ

এই বৈশিষ্টগুলো পড়তে পড়তে যখন আবার ফিরে গেলাম আমার তোলা কিছু ছবি আর নোটস-এ, বেশ কিছু সামঞ্জস্য খুঁজে পেলাম। বিশেষ করে দোতলার অশ্বক্ষুরাকৃতি জানালা, সিনাগগের ভিতরের রঙিন কারুকার্য, ধনুকাকৃতি বৈশিষ্টগুলোর ছবি দেখে বুঝতে বাকি থাকলো না কেন এই সিনাগগ মুরিশ শৈলীর জলজ্যান্ত উদাহরণ। সাথে সাথে মনে পড়ছে জামা মসজিদ, হুমায়ূনের সমাধির স্থাপত্যগুলো। সারা পৃথিবী জুড়ে সবাই কীভাবে একে ওপরের সাথে যোগ হয়ে আছে।

আর্চ বিম, সরু থামের ওপর আলহামরা অনুপ্রাণিত মোটিফ

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, ইহুদি উপাসনালয় বানাবার জন্য ইসলামিক শৈলীকে কেন বেছে নিল সেসময়ের শিল্পীরা? তার জন্য খুঁজতে হল আরও একটু ইতিহাস!

অশ্বক্ষুরাকৃতি জানালা

১৮ শতকে ইহুদি সমাজের অবস্থা

অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে শুরু হয় ইহুদি মুক্তির চিন্তা ভাবনা, বা জিউস এমানসিপশন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা বাকিদের মতো সমান অধিকার দাবি করতে শুরু করে, সাথে নাগরিকত্বের আবেদন করে। অনেকটা ইহুদি সমাজের নবজাগরণের মতো (হাসকালা)। এই সময় মধ্যবিত্ত ইহুদিরা (বিশেষ করে আশকেনাজি ইহুদি) নিজেদের ধর্মীয় চাহিদা পূরণ করার জন্য সিনাগগ তৈরি করার কথা ভাবতে থাকে। দীর্ঘকাল সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় নিপীড়ন সহ্য করার পর, একটা সামগ্ৰিক জাতীয়তাবাদের জন্ম শুরু হতে থাকে এই সময় থেকে। এদিকে ১৮১৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ১ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ করে নতুন করে বৃহদাকার কিছু চার্চ তৈরি করার জন্য। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও আধুনিক নগরায়নের সাথে সাথে বড়ো বড়ো চার্চ তৈরি হবার প্রকল্প শুরু হয়। ইহুদিরা চার্চের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেদের জন্যও সুদর্শন উপাসনালয় বানাবার চেষ্টা করে। কিন্তু এই বড়ো বড়ো সিনাগগ বানাবার স্থাপত্য কী হবে?

ক্যারেল পোলচেকের পাসপোর্ট (মিউজিয়ামের সংগ্রহ)

রোমান্টিসিজমের প্রভাব

ক্লাসিকাল গ্রিক-রোমান সময় প্যাগান উপাসনালয় হিসাবে নির্দিষ্ট কিছু স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল। পরবর্তী কালে খ্রীষ্টান চার্চের জন্য গোথিক, রোমান্সক ধরনের স্থাপত্য বহুল প্রচলিত ছিল। গোথিক এবং রোমান্সক শৈলীর সিনাগগ ছিল না এমনটা নয়, তবে অনেকেই মনে করতেন সিনাগগের জন্য এই শৈলী খাপ খায় না। ১৭৯৮ সালে জার্মানির কার্লস্রুহে শহরে ক্লাসিকাল স্থাপত্যের আদলে একটি সিনাগগ বানানো হয়। ১৮২০ সালে বুদাপেস্টের কাছে ওবুদাতে আরও একটি এই শৈলীর সিনাগগ তৈরি করা হয়। দুটোতেই ক্লাসিকাল স্থাপত্যের সাথে মিশ্রণ হয়েছিল ইজিপ্সিয়ান ওবেলিস্কের। এই দুটো সিনাগগ ইউরোপের মধ্যে প্রথম স্থাপত্য যার মধ্যে “ওরিয়েন্টাল” প্রভাব লক্ষ করা যায়। ওবেলিস্ক বা অন্যান্য ইজিপ্সিয়ান স্থাপত্যগুলো জ্যামিতিক ভাবে ভীষণ ধারালো, অর্থাৎ স্থাপত্যের ধারগুলো তীক্ষ্ণ, ছুঁচালো। আঠারো শতকের শেষ দিকে ইউরোপিয়ান আর্ট আবার গতি পরিবর্তন করে। সংগীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য—সব কিছুতেই আসে রোমান্টিসিমের ছোঁয়া। শিল্পের মধ্যে তীক্ষ্ণ, ঋজু জ্যামিতিক বস্তুগুলো কোমল স্পর্শ অনুভব করতে শুরু করে। স্বাভাবিক ভাবেই মিশরীয় ঋজুতা পরিবর্তিত হল ধনুকাকৃতি জ্যামিতিক আকারে। আর্চ, অশ্বক্ষুর, গম্বুজ নিয়ে আইবেরিয়া আর মাগরেবের শিল্পীরা অনেক আগেই এই কোমলতাকে আপন করেছিলেন নিজেদের স্থাপত্যের মধ্যে। ঊনবিংশ শতকে রোমান্টিসিজমের জ্বরে আক্রান্ত ইউরোপের বুকে যদি কোনো “ওরিয়েন্টাল” স্থাপত্যকে গ্রহণ করতে হয়, তা স্বাভাবিক ভাবেই আইবেরিয়ার মুরিশ শৈলী। প্রাহার সিনাগগ তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। ধর্মে ধর্মে যা বিভেদ বিভাজন হয়, শিল্প তাকে মিশিয়ে একাকার করে দেয়। প্রাহার এই সিনাগগ ছাড়াও, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি হয় মুরিশ শৈলীর ইহুদি উপাসনালয়।

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ইতিহাসের পটপরিবর্তন হতে থাকে। কেবলমাত্র পাঁচটা সিনাগগ বাদে সমস্ত ইহুদি পাড়া ধ্বংস করে ফেলা হয় পুনর্গঠনের জন্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্বালে প্রায় ৯২,০০০ ইহুদি মানুষ বসবাস করতেন এই অঞ্চলে, যা প্রাহার জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। ১৯৪৬ সালে যুদ্ধের পর জনসংখ্যা দাঁড়ায় দশ হাজারের কাছে। অধিকাংশ মানুষকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল কুখ্যাত টেরেজিন ঘেটোতে। ১৯৯৮ সালে স্প্যানিশ সিনাগগকে আবার সংস্কার করা হয় এবং পুরোনো চেহারায় ফিরিয়ে আনা হয়। সাধারণ মানুষের জন্য মিউজিয়াম বানানো হয়। মিউজিয়ামে রাখা আছে প্রাগের ইহুদি পাড়ার ইতিহাসের টুকরো। তার কিছু ছবি থাকল পাঠকদের জন্য।

শীর্ষক চিত্র পরিচিতি: সিনাগগের ভিতরে রঙিন কারুকার্য এবং মোটিফ

তথ্যসূত্র

1. Bloom, J.M., 2020. Architecture of the Islamic West: North Africa and the Iberian Peninsula, 700-1800. Yale University Press.

2. Kalmar, I.D., 2001. Moorish Style: Orientalism, the Jews, and Synagogue Architecture. Jewish Social Studies, 7(3), pp.68-100.

3. Hübsch, H., 1828. In welchem Style sollen wir bauen?.

4. Moorish Revival Synagogues: When Jews Embraced Islamic Architecture, https://mogulesque.com/architecture/moorish-revival-synagogues/

5. Jewish Museum audio guide and guide books

ভূপদার্থবিদ্যার গবেষক। বিজ্ঞান বাদে সমাজ, সংগীত, সিনেমা চর্চায় আগ্রহী। ভ্রমণ বিলাসী এবং বইপোকা।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।