সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

লেখক: কুন্তল রায়

লেখক পেশায় শিক্ষক, তবে ইতিহাসের চিরন্তন ছাত্র। আগ্রহের বিষয় মধ্যযুগের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিনির্ভর ইতিহাস পাঠে ও চর্চায় আগ্রহী।
ভাবতে অবাক লাগে গোটা একটা বই লেখা হলো (সিংগিং দ্য নিউজ অফ ডেথ: এক্সিকিউশন ব্যালাডস ইন ইউরোপ ১৫০০-১৯০০) ইউরোপের গত চার শতকের শিরচ্ছেদের ব্যালাড নিয়ে, আর এই গবেষণাপত্রটিকে একটা পূর্ণাঙ্গ বইয়ের রূপ দিতে উনা ম্যাকিলভেন্না সময় নিলেন দশটা বছর! ২০২২ সালের ৫ জুলাই বইটি ছাপা আকারে প্রকাশিত হয়। দু’টো পর্বের এই বইটির প্রথম অংশের বিষয়বস্তু হল ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণে ইউরোপে সংগঠিত শিরচ্ছেদের সময়ে বা পরে রচিত ব্যালাডগুলিতে ঘটনার সত্যতা ও রচনার কাব্যিক অতিকথন নিয়ে। দ্বিতীয় অংশের বিষয় বিবিধ - সমাজ ও সংস্কৃতিতে (বিশেষত অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে) ভালো-মন্দের হিসেব, হত্যা ও নৃশংসতা সম্পর্কে লেখক ও পাঠক বা শ্রোতা-মনের প্রতিক্রিয়া এবং ব্যালাড যুগের অন্তকাল নিয়ে।১
সভ্যতার কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লক্ষণ জাতিগত সৌকর্য এবং নান্দনিকতার চিহ্ন হিসেবে কাজ করে। বই তাদের মধ্যে অন্যতম একটা সৃষ্টিশীল নিদর্শন। যাদের আমরা সভ্যজাতি বলি তাদের বৈশিষ্ট্যের অনেকগুলি মানদণ্ডের মধ্যে একটি নিশ্চিত ভাবে বই। তাই বই সমাজের উন্নতির একটি আলাদা গুরুত্ব বহন করে। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রতিদিন কমবেশি প্রায় পাঁচ হাজার বই প্রকাশিত হয়। এমনকি বাংলা ভাষাতেই প্রতিবছর ৫০ হাজারের বেশি বই লেখা হয়। ঠিকভাবে কাকে বই বলা যাবে জাতিপুঞ্জ সেই সংজ্ঞা বেধে দিয়েছে।১ তবে বইয়ের সংজ্ঞায়নের আইন, রীতিনীতি এবং বিতর্কগুলি থেকেও অন্য একটি আকর্ষণীয় দিক আছে। সুনীল চট্টোপাধ্যায় তাঁর একটি বইয়ের শুরুর লাইনটিতেই লিখেছিলেন ‘এটি গ্রন্থ নয়, বই’। হয়তো পাঠ্যপুস্তক লিখতে গিয়ে তাঁর এই ধরনের স্যাটায়ারের ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু তিনি একথা বলে যাননি বই থেকে গ্রন্থ হয়ে উঠতে গেলে কী প্রয়োজন। আমরা কেবল তার ধারণা করে নিতে পারি এইমাত্র।
ইউরোপে সস্তা বই নিয়ে জোরদার চর্চা শুরু হয় গত শতকের সত্তরের সময় থেকে। পিটার বার্কের লেখা ‘পপুলার কালচার অফ আর্লি মডার্ন ইউরোপ’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৭৮) সেখানকার সংস্কৃতি চর্চার জগতে মৌলিক পরিবর্তন এনেছিল, এতে কোন সংশয় নেই। প্রায় একই সময়ে চলতে থাকে ফরাসি বিপ্লব নিয়ে নতুন ভাবনাচিন্তা;১ আমেরিকার গবেষকরাও তখন অনেকটা আগ্রহী হয়েছিলেন সাধারণের সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে। কারণ নয়া বাজার অর্থনীতিতে সংস্কৃতি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করছিল। স্বাভাবিকভাবেই এতদিনের প্রচলিত ইতিহাস চর্চার বাইরের বিভিন্ন দিকগুলি একে একে ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে আসতে থাকে। এদের মধ্যে একটি বিষয় ছিল ‘জনপ্রিয় ছাপা’ চর্চা। এখন প্রশ্ন হল ‘জনপ্রিয় ছাপা’ কথাটির অর্থ কী? আমরা দুইভাবে এর উত্তর পেতে পারি। প্রথমত, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ছাপার যুগের প্রায় শুরুর থেকেই এমন ধরনের বই প্রকাশিত হয়, তাকে ঠিক বই বলা কঠিন — বরং আমরা অনুপুস্তিকা বলতে পারি। বাংলার ক্ষেত্রে যেমন তার নাম বললে আমরা সহজেই বুঝি – ‘বটতলার ছাপা’।
২০২০ সালে ডোনাল্ড ব্লক্সহামের দুটো বই প্রকাশ হয়, যার একটি বেশ বিতর্ক তৈরি করে।১ ‘হোয়াই হিস্ট্রি? আ হিস্ট্রি’ গ্রন্থে তিনি দেখাতে চেয়েছেন একবিংশ শতকে আমাদের সাধারণের ইতিহাসের আলোচনার দিকগুলি কিভাবে ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। এই পাল্টে যাওয়াকে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন ড্যানিয়েল উলফের মত বিখ্যাত ঐতিহাসিকরা।২ আমরা যারা অপেশাদার ইতিহাসচর্চা করি, তারা অতীতকে নির্দিষ্টভাবে দেখার বা বর্ণনা করার যে সমস্ত দিকগুলিতে আগ্রহ পাই তা ধীরে ধীরে পেশাদার ঐতিহাসিকের বিষয় নির্বাচনে কতটা প্রভাব বিস্তার করবে - তা অবশ্যই একটি গবেষণার বিষয়। আগামী সময়ের যে ধরনের আগাম লক্ষণ দেখা যায়, তাতে মনে হয় ইতিহাস একটা মৌলিক পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। উলফ আমাদের সেসব পছন্দের বিষয়গুলোকে আট ভাগ করে উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল- বিনোদন, স্মৃতিচারণ, নৈতিক (জাতীয়তাবাদী) শিক্ষা, অনুমানমূলক দর্শন, ভ্রমণ, আলাপচারিতা, মেথড বা পদ্ধতি এবং পরিচিতি।