সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ইতিহাসচিন্তা

ইউরোপ, এমনকি মহাসাগরের ওপারে ইউরোপীয় সভ্যতারই সম্প্রসারিত রূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কল্পনা ও মননে রোমের পতনের দীর্ঘ ছায়া আজও বিদ্যমান। আজও ‘পশ্চিম’-এর পতন সংক্রান্ত যে কোনও বিতর্কে হামেশাই রোমের পতনের সঙ্গে তুলনা টেনে আনা হয়। বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেন রোমান সাম্রাজ্যের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও কোনও একদিন পতন হবে কিনা, ইউরোপের অতি-দক্ষিণপন্থীরা বর্বর আক্রমণের সঙ্গে তুলনা টানেন অভিবাসনের। মোট কথা, ‘পতন’ বলতেই ইউরোপীয়দের (এবং আমেরিকানদের) মননে প্রথম যে চিত্রটি ভেসে ওঠে, তা প্রাচীন রোম-সংক্রান্ত। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো, রোমের পতন বলতে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের শেষের দশকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কথা আমরা বলছি। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য, যা ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ অবধি বজায় ছিল, তার সম্পর্কে ইউরোপের ঐতিহাসিক স্মৃতি ও ধারণা অন্যপ্রকার, সে এই আলোচনার বিষয় নয়। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য, আধুনিক ইউরোপের বদলাতে থাকা ঘটনাবলী রোমের পতন সংক্রান্ত ঐতিহাসিক আলোচনাকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা প্রদান করা।
অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য ছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের অসামান্য পণ্ডিত এবং বিশিষ্ট ঐতিহাসিক। তাঁর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বৈদিক যুগ ও তৎপরবর্তী সময়ের ভারতীয় সাহিত্য। বিশেষভাবে বৈদিক যুগে বিভিন্ন পেশার মানুষের সামাজিক অবস্থান, সেই সময়ে সমাজে নারীর স্থান, ধীরে ধীরে বর্ণ প্রথার প্রবর্তন, পরবর্তীকালে বেদবিরোধী ধর্মগুলির উন্মেষ নিয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্যের চর্চা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বৈদিক যুগকে দেখতে বাধ্য করে। তাঁর লেখায় শুধু তথ্য পরিবেশিত হয়নি, সেই তথ্যের বিশ্লেষণের ফলে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত বা পুরাণ নিয়ে ইতিহাসভিত্তিক গবেষণায় যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। তাঁর গবেষণাধর্মী রচনা বেদ ও বৈদিক সমাজ, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ ইত্যাদি নিয়ে বহু গুণীজন আলোচনা করেছেন। ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরও চর্চা হবে। আর্যভাষীদের ভারতে আগমন, এই দেশে এসে তখনকার দেশজদের সাথে তাদের মিশ্রণ ও তাঁর ফলে জাত মিশ্রসংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে অধ্যাপিকা ভট্টাচার্যের গবেষণাধর্মী লেখা পাঠককে আজও মগ্ন করে।
প্রয়াণের অর্ধ শতক পেরিয়ে যাওয়া টেরাকোটা মন্দির গবেষক অধ্যাপক ডেভিড ম্যাককাচন ছিলেন বাংলার টেরাকোটা মন্দিরশিল্প চর্চায় এক অন্যতম পথিকৃত। এই ইংরেজ সাহেব তাঁর করা কঠোর পরিশ্রম ও প্রবল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে বাঙালীদের বাংলার শ্রেষ্ঠ এক শিল্প সম্পদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এই অদ্ভুতকর্মা মানুষটি তাঁর গবেষণামূলক কাজের প্রধান ক্ষেত্র পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পেরিয়ে প্রবল ঝুঁকি নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষার প্রয়োজনে গিয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ তার পাকিস্তান আমলে ভারত থেকে যাওয়া একজন মানুষের পক্ষে মোটেও নিরাপদ স্থান ছিল না।
লিওপোল্ড ফন র‍্যাঙ্কে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জার্মানির স্যাক্সনি প্রদেশের থুরিঞ্জিয়ায় উইহা শহরে। তাঁর পরিবার বহু প্রজন্ম ধরে এই প্রদেশে নিয়োজিত ছিলেন লুথারিয়ান যাজক হিসেবে। এই ঐতিহ্য ভঙ্গ করেছিলেন র‍্যাঙ্কের পিতা, গটলব র‍্যাঙ্কে। তিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন আইন। পরবর্তীকালে এই কাজে গটলব যাজকবৃত্তির মানসিক শান্তি খুঁজে না পেলেও র‍্যাঙ্কে পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতে প্রভূত উন্নতি হয়। গটলব এবং ফ্রিডরিকে র‍্যাঙ্কের প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করেন ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর। স্যাক্সনিতে তখন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে তার পূর্বের প্রভাব অনেকটাই হারিয়েছে। একদা স্যাক্সনির রাজবংশ পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথের রাজপদে প্রতিষ্ঠিত ছিল, পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে তাঁদের আলাদা মর্যাদা ছিল। সেই দিন তখন আর ছিল না। প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়া পোল্যান্ডের ভাগাভাগি করে নেওয়ার সময় থেকেই স্যাক্সনির পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা আলগা হতে শুরু করে। তবুও তা তখনও সাধারণ মানুষের মন থেকে একেবারে মুছে যায় নি। সেই কারণেই তৎকালীন পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় লিওপোল্ড-এর নামে গটলব তাঁর প্রথম পুত্রের নাম রাখেন লিওপোল্ড।
বিপ্লবী সাহিত্যিক নিকোলাই চেরনিশেভস্কির ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ নামের উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালে, যা পরে লেনিনকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। এই বইটি লেনিনের এতই পছন্দের ছিল যে তিনি অন্তত পাঁচবার এটি পড়েছিলেন, আর তাঁর এক বিখ্যাত বইয়ের নাম দিয়েছিলেন এই বইয়ের নামে। চেরনিশেভস্কির লেখালেখি ও সম্পাদনাকর্ম সমৃদ্ধ সোভ্রেমেনিক (এই রুশ শব্দটির অর্থ সমসাময়িক) নামের জার্নালটি এ সময়ে প্রগতিশীল মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এটির লেখক ও সহ সম্পাদক হবার কারণে চেরনিশেভস্কিকে কারাবাসও করতে হয়েছিল। উপন্যাস শিল্পের নিরিখে না হলেও সামাজিক প্রভাবের দিক থেকে দেখতে গেলে এই উপন্যাস ও তার প্রতিক্রিয়া সমূহও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে করা হয় চেরনিশেভস্কি এই উপন্যাস লিখেছিলেন তুর্গেনিভ এর ‘ফাদার্স অ্যান্ড সনস’ এর প্রতিক্রিয়ায়, আবার চেরনিশেভস্কির এই ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ এর প্রতিক্রিয়াতেই দস্তয়েভস্কি লেখেন তাঁর অতি বিখ্যাত আখ্যান ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’।