সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ইতিহাসচিন্তা

লিওপোল্ড ফন র‍্যাঙ্কে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জার্মানির স্যাক্সনি প্রদেশের থুরিঞ্জিয়ায় উইহা শহরে। তাঁর পরিবার বহু প্রজন্ম ধরে এই প্রদেশে নিয়োজিত ছিলেন লুথারিয়ান যাজক হিসেবে। এই ঐতিহ্য ভঙ্গ করেছিলেন র‍্যাঙ্কের পিতা, গটলব র‍্যাঙ্কে। তিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন আইন। পরবর্তীকালে এই কাজে গটলব যাজকবৃত্তির মানসিক শান্তি খুঁজে না পেলেও র‍্যাঙ্কে পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতে প্রভূত উন্নতি হয়। গটলব এবং ফ্রিডরিকে র‍্যাঙ্কের প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করেন ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর। স্যাক্সনিতে তখন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে তার পূর্বের প্রভাব অনেকটাই হারিয়েছে। একদা স্যাক্সনির রাজবংশ পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথের রাজপদে প্রতিষ্ঠিত ছিল, পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে তাঁদের আলাদা মর্যাদা ছিল। সেই দিন তখন আর ছিল না। প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়া পোল্যান্ডের ভাগাভাগি করে নেওয়ার সময় থেকেই স্যাক্সনির পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা আলগা হতে শুরু করে। তবুও তা তখনও সাধারণ মানুষের মন থেকে একেবারে মুছে যায় নি। সেই কারণেই তৎকালীন পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় লিওপোল্ড-এর নামে গটলব তাঁর প্রথম পুত্রের নাম রাখেন লিওপোল্ড।
বিপ্লবী সাহিত্যিক নিকোলাই চেরনিশেভস্কির ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ নামের উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালে, যা পরে লেনিনকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। এই বইটি লেনিনের এতই পছন্দের ছিল যে তিনি অন্তত পাঁচবার এটি পড়েছিলেন, আর তাঁর এক বিখ্যাত বইয়ের নাম দিয়েছিলেন এই বইয়ের নামে। চেরনিশেভস্কির লেখালেখি ও সম্পাদনাকর্ম সমৃদ্ধ সোভ্রেমেনিক (এই রুশ শব্দটির অর্থ সমসাময়িক) নামের জার্নালটি এ সময়ে প্রগতিশীল মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এটির লেখক ও সহ সম্পাদক হবার কারণে চেরনিশেভস্কিকে কারাবাসও করতে হয়েছিল। উপন্যাস শিল্পের নিরিখে না হলেও সামাজিক প্রভাবের দিক থেকে দেখতে গেলে এই উপন্যাস ও তার প্রতিক্রিয়া সমূহও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে করা হয় চেরনিশেভস্কি এই উপন্যাস লিখেছিলেন তুর্গেনিভ এর ‘ফাদার্স অ্যান্ড সনস’ এর প্রতিক্রিয়ায়, আবার চেরনিশেভস্কির এই ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ এর প্রতিক্রিয়াতেই দস্তয়েভস্কি লেখেন তাঁর অতি বিখ্যাত আখ্যান ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’।
গত দুই দশকে ইউরোপ ও আমেরিকায় (বিশেষত ইংরেজি ভাষায়) বইয়ের ইতিহাস নিয়ে যে ধরণের গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, সেই আলোচনাই হয়তো পরবর্তী কোন এককালের ইতিহাসের বিষয়বস্তু হবে। অতীতের বইকে আমরা দেখছি নানান দৃষ্টিকোণ থেকে, আমার আজকের যে ইতিহাস নির্মাণের প্রক্রিয়া সেও ক্রমশ ভিন্ন রূপ নিচ্ছে। যেহেতু বইয়ের বিষয়বস্তুর উপর সাহিত্যের সরাসরি দখল, তাই এতদিনের বইয়ের মূল্যায়ন বলতে ছিল মূলত সাহিত্যকেন্দ্রিক। বর্তমানে কাগজ, হরফ, ছাপা, বাঁধাই, বিপণন, এমনকি ছাপা যন্ত্রেরও ইতিহাস খুঁজে দেখা হচ্ছে। কোডিকোলজি বা গ্রন্থবিদ্যা নিয়ে এই সময়ের অনুসন্ধান আমাদের আগ্রহী করে। তেমন কাজে সারা ওয়ার্নার আজ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একটি নাম। এই প্রবন্ধে মূলত তার লেখাকে কেন্দ্র করেই বইয়ের ইতিহাসের আলোচনা হবে।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন যুগে ইতিহাস লেখকদের যখন প্রায় কোন সন্ধানই পাওয়া যায় না, তখন মধ্যযুগের কাশ্মীরের চার সংস্কৃত ইতিবৃত্তকার – কল্হণ (দ্বাদশ শতাব্দী সাধারণাব্দ), জোনরাজ (১৩৮৯? - ১৪৫৯ সাধারণাব্দ), শ্রীবর (পঞ্চদশ - ষোড়শ শতাব্দী সাধারণাব্দ) ও শুকের (ষোড়শ শতাব্দী সাধারণাব্দ) লেখা ‘রাজতরঙ্গিণী’ নামে পরিচিত অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত গ্রন্থমালা আমাদের বিস্মিত করে। শুধু তাই নয়, এই চার ইতিবৃত্তকারদের জীবন মধ্যযুগের কাশ্মীরের রাজশক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার কারণে তাঁদের লেখা ইতিবৃত্ত প্রামাণিকতার নিরিখেও মূল্যবান। সপ্তদশ শতকে লিপিবদ্ধ ‘রাজতরঙ্গিণী’ গ্রন্থমালার শারদা পাণ্ডুলিপিগুলি আজও মধ্যযুগের কাশ্মীরের চার প্রতিভাশালী সংস্কৃত কবির ইতিবৃত্ত রচনার দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।১