সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

জুলাই ২, ২০২৫

জনজাতি অধিকার

জনজাতিদের নেতৃত্বে পরিচালিত এক ঐতিহাসিক তদন্তে দেখা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশে জনজাতি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা এক সময়ে গণহত্যা চালিয়েছিল। ইয়ুরুক জাস্টিস কমিশন দেখেছে যে, ১৮৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে রাজ্যটিতে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ২০ বছর ধরে অমানবিক হিংসা এবং সেই সময়ে ইউরোপীয়দের উপস্থিতিতে বিভিন্ন রোগের কারণে স্থানীয় জনজাতি জনসংখ্যা তিন-চতুর্থাংশ কমে গেছিল। ২০২১ সালে কমিশনটি অস্ট্রেলিয়ার প্রথম আনুষ্ঠানিক ‘সত্য-কথন’ তদন্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং রাজ্যের জনজাতিদের অতীত এবং চলমান ‘পদ্ধতিগত অবিচার’ পরীক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

অবশ্য একটি প্রদেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষের মৃত্যুতে অবাক হবার কিছু নেই। জনজাতিদের গণহত্যা হল উপনিবেশবাদী প্রক্রিয়ার অংশ। রাফায়েল লেমকিন সহ কিছু গণহত্যা বিশেষজ্ঞের মতে, উপনিবেশবাদ গণহত্যার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত—বিশ্বব্যাপী প্রত্যক্ষ সহিংসতা, জনজাতিদের বাসস্থান থেকে উৎখাত করা এবং এমন রোগের প্রবর্তন করা যার বিরুদ্ধে তাদের কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল না।

কাদের বলে জনজাতি মানুষ? ব্যক্তিগত স্তরে জনজাতি হিসেবে আত্ম-পরিচয় দিতে যারা ইচ্ছুক এবং যদি তাদের সম্প্রদায় এই আত্ম-পরিচয় মেনে নেয়, তারাই জনজাতি।

  • তারা ধারাবাহিকভাবে কোনো অঞ্চলে, পরবর্তীকালে আগত গোষ্ঠীর থেকে আগে, জনবসতি তৈরি করে আছেন,
  • অঞ্চল এবং আশেপাশের প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে শক্তিশালী সংযোগ রেখেছেন,
  • স্বতন্ত্র সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে চলেন,
  • স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস বজায় রেখেছেন,
  • তারা স্বাভাবিকভাবেই সমাজের অ-প্রভাবশালী গোষ্ঠী, এবং
  • তারা পূর্বপুরুষের পরিবেশ এবং ব্যবস্থা বজায় রাখতে চান।

ঔপনিবেশিকরা শুধু গণহত্যা করেনি, পরের সম্পদ গ্রাসের লোলুপতাকে ঢাকতে তারা জনজাতিদের সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম সব কিছুকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেছে। জনজাতিদের সংস্কৃতি উপনিবেশবাদীদের চোখে ছিল নিকৃষ্ট। ১৭শ সাধারণাব্দে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা দক্ষিণ আফ্রিকাতে গিয়ে ‘খোই–সান’ জনজাতিদের মধ্যে কোনো আধ্যাত্মিকতার হদিস পাননি। কারণ তারা খুঁজেছিলেন নৈতিক ‘সর্বোচ্চ সত্তা ঈশ্বর’কে (High God)। চাঁদের আলোতে সন্মোহন নাচ তাদের আত্মাদের জগতের সন্ধান দেয়নি। তাই তারা বলেছিলেন ‘খোই–সান’-দের কোনো ধর্ম নেই, কোনো ‘বিশ্বাস ব্যবস্থা’ নেই। ‘সান’-দের বলা হত ‘বুশমেন’—ঝোপের মধ্যে মানুষ—এসব নাম দিয়েছিল বহিরাগত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা। ‘খোই–সান’ জনগোষ্ঠীগুলির মানুষেরা ‘ক্লিক’ ধ্বনিভাষায় অর্থাৎ জিভের বিভিন্ন মোচড়ের সাহায্যে কথা বলেন। ঔপনিবেশিক ইউরোপীয়রা একে মানুষের ভাষা বলে মানতে রাজি ছিলেন না। তাদের মনে হয়েছিল এই শব্দসমূহ আসলে পশুর ধ্বনির সঙ্গে সম্পর্কিত। পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও তাদের সংস্কৃতিকে ইউরোপীয় ধর্মপ্রচারকদের মনে হত মনুষ্যেতর।

এত অত্যাচারের পরেও, এত গণহত্যার পরেও পৃথিবীতে প্রায় ৪৭ কোটি জনজাতি মানুষ আজও টিকে আছেন। অধিকাংশই অবশ্য আছেন চীন ও ভারতে—১০.৪ কোটি আছেন ভারতে।

জনজাতিরা কীভাবে আজকে জীবন যাপন করবেন সে সিদ্ধান্ত তাদের। প্রাকৃতিক সংরক্ষণে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সত্ত্বেও, তারা অসম দারিদ্র্যের সম্মুখীন। তারা বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র ৬.২ শতাংশ, তবুও বিশ্বব্যাপী চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী ১৮.২ শতাংশ হল জনজাতি মানুষ। জনজাতিদের আয়ুষ্কাল অন্যান্য জনসংখ্যার তুলনায় ২০ বছর কম।

১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ভগনাডিহির প্রান্তরে প্রায় সাঁওতাল দুই ভাই সিধু এবং কানু মুর্মুর নেতৃত্বে দশ হাজার সাঁওতাল ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দেবার শপথ নিয়েছিলেন। সেটাই ছিল ভারতে সংঘটিত ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম কৃষক বিদ্রোহ। ‘ইতিহাস আড্ডা’ সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে। আশা করে স্বাধীন ভারতে তথাকথিত অ-জনজাতিদের দ্বারা জনজাতিদের জমি দখল করা আর চলবে না। তাদের অরণ্যের অধিকার রাষ্ট্র একতরফাভাবে কেড়ে নেবে না।