সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

এপ্রিল ১, ২০২৪

ইতিহাস চর্চার দায়

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক ফেসবুক গ্রুপ তৈরি হয় ২০১৮ সালে এবং ইতিহাস আড্ডা পোর্টাল প্রথম জনসমক্ষে আসে ২০২০ সালে। বলে রাখা ভালো, গ্ৰুপ এবং পোর্টালটি যারা পরিচালনা করেন তাদের এক বড়ো অংশ পেশাদার ইতিহাসবিদ নয়। অধিকন্তু কিছু ইতিহাসের শিক্ষক, গবেষক এই গোষ্ঠীর পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। দুইয়ে মিলিয়ে চলে চালনার কাজ। আবার লেখক ও পাঠকদের মধ্যেও এই দুই’ অংশের মানুষের অংশগ্রহণ ও অবদান দেখা যায়। বর্তমানে ফেসবুক গ্রুপের সদস্য সংখ্যা লক্ষাধিক। পোর্টালেও নিয়মিত পাঠকের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।

এই গ্ৰুপের একটি প্রধান উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরের আলোচনাকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসা। ইতিহাসবিদ ও আমজনতার মাঝে একটা সেতু রচনা করা। আবার ব্যক্তির নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে অনুশীলন গভীরতর ইতিহাস চর্চার দিকে, নতুন সত্যের দিকে লেখককে নিয়ে যেতে পারে। ইতিহাসে আকৃষ্ট বাঙালিদের মধ্যে ইতিহাস নিয়ে চর্চাকারী এই গ্রুপ ও পোর্টাল ইতিমধ্যেই একটা বিশেষ জায়গা নিয়ে নিয়েছে।

তবুও এই চর্চার সঙ্গে কিছু অবধারিত প্রশ্নও আসে।

ইতিহাস কি আমজনতার বিষয়? ইতিহাস নিয়ে কি যে কেউ পড়াশোনা করে, গবেষণা করে (অথবা সঠিকভাবে না করে) লেখালিখি করতে পারেন? ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলে কি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাদির বিচার, হিস্টিরিওগ্রাফি অনুসরণ করতে হবে না? আছে, নিশ্চয়ই আছে। এবং তাদের সকলকেই নির্দিষ্ট কিছু ইতিহাস লিখবার পদ্ধতিও অনুসরণ করতে হবে।

কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বাংলার ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণের ইতিহাস নিয়ে বিনয় ঘোষ যে গ্রন্থগুলো লিখেছেন সেই গ্রন্থগুলোকে আজও সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিনয় ঘোষ ছিলেন সাংবাদিক এবং লেখক; এবং গবেষক। তিনি তাঁর নির্দিষ্ট পেশার বাইরে গিয়ে এই গবেষণা করেছেন। তিনি ইতিহাস লিখবার পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। ভাবতে বসলে দেখা যায়, নবজাগরণের সময়কাল নিয়ে যারা বাংলায় লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষাগত যোগ্যতায় বা পেশায় ইতিহাসবিদ ছিলেন না।

এই গ্রুপে ইতিহাস চর্চার সঙ্গে প্রাগিতিহাস ও বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়েও চর্চা করা হয়। সেই চর্চা করতে বিজ্ঞানের নতুন শাখার সঙ্গে পরিচয় করা দরকার। প্রাগিতিহাস ও প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে হলে জিনবিদ্যার গবেষক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ-এর (প্রাচীন ইতিহাসের ক্ষেত্রে) একত্রিত হওয়া দরকার। সম্ভব হলে প্রত্ন-উদ্ভিদবিদ, ভূতত্ত্ববিদ ইত্যাদির সঙ্গেও সংযোগ রেখে কাজ করা দরকার। বাংলায় বিভিন্ন পরিযান, তার সময়কাল, তাদের মিশ্রণ, জাতিগোষ্ঠী গঠন ইত্যাদি নিয়ে কাজ হয়? সত্যি কথা বলতে এখন স্যার হারবার্ট রিজলে, বিরজাশঙ্কর গুহ ইত্যাদি নৃতত্ববিদদের অ্যানথ্রোপোমেট্রি, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদির গ্রন্থের দ্রাবিড় সম্পর্কিত বহু তথ্য তামাদি হয়ে গেছে। এরপরে প্রাগিতিহাস তো বটেই প্রাচীন ইতিহাসের ক্ষেত্রে (হয়তো মধ্য যুগের ইতিহাসেও) জিনবিদ্যার চর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।

এই গ্রুপ একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, যেখানে উৎসুকরা পড়াশোনা করছেন, অনুশীলন ও আলোচনা করছেন ও লিখছেন। আমাদের কাজ একটা শূন্যস্থানকে ভরাট করবার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র। মানুষের কাছে ইতিহাসকে তুলে ধরার প্রয়াস। ইতিহাস চর্চার পরিধি বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা।

এক্ষেত্রে ইতিহাসবিদদের একটা শঙ্কা থাকে। যে কেউ দুই-একটি বই পড়ে যদি কিছু বই লিখে ফেলতে পারেন বা সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করতে পারেন তবে হয়তো তারা অনেককে ভুল পথে চালিত করতে পারেন। আজকে সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষমতাকে ছোট করা যায় না। আলোচনা চলা কালে ভ্রান্তি (ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়) তো বাঞ্ছনীয় নয়। ইন্দো-ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষেরই মানুষ, তারা মোটে বিদেশ থেকে আসেনি, এই যুক্তিতে (আসলে এই বিশ্বাসে ) দু পাতা লিখে দিয়ে কিছু পাঠককে কিছু দিনের জন্য ভুল পথে হয়তো চালানো যায়। এই শঙ্কা অমূলক নয়।

বরং বলা যায় সেই ভ্রান্তি দূর করতে অন্য অনেকের মতো এই গ্রুপ একটা ভূমিকা নেয়। যে বিশ্লেষণ কালের বিচারে গ্রহণযোগ্য তা টিকে থাকবে। বেনোজলে মাছ ধরতে নামবে কিছু প্রতারক। সেই বিষয়ে আমাদের সকলেরই সতর্ক থাকা দরকার।

টিকে আছে বিংশ শতকের কিছু ইতিহাসবিদ যারা এসেছেন ইতিহাস শিক্ষাক্রমের বাইরে থেকে।পদার্থবিদ হয়ে গেছেন পৃথিবীখ্যাত ইতিহাসবিদ। ইতিহাসপাঠ তাতে আরও পূর্ণ হয়েছে।

পেশাদার বা অপেশাদার, আমরা হয়তো হারিয়ে যাব, তবু লিখে যাব। যা জানছি তা জানাতে। তা ভাবছি তার শরিক করতে। এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে।