সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

ডিসেম্বর ১, ২০২৪

“অনেক কিছুই তবু বিশুদ্ধ গণিত শাস্ত্র নয়”

বিগত কয়েক দশক ধরে ‘বৈদিক গণিত’ নামে একটি বিষয়ের উদ্ভব ও প্রচলন ঘটেছে, যার সঙ্গে বেদ বা গণিত কারও কোনও সম্পর্ক নেই। ‘বৈদিক গণিত’ বিষয়ক যে বইগুলি দেখতে পাওয়া যায়, তা পাঠ করলে একে দ্রুত সংখ্যাগণনা পদ্ধতি ছাড়া আর কিছু বলা সম্ভব নয়। যাঁরা বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাঁরা জানেন এর সঙ্গে বৈদিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত গণিত বিষয়ক রচনার দূরতম মিল নেই। তবে, ভারতের গণিত চর্চার প্রকৃত ইতিহাস সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের জ্ঞানের অপ্রতুলতার কারণে, তাঁদের বিভ্রান্ত করে ‘বৈদিক গণিত’-এর শিক্ষাক্রমগুলি যথেষ্ট বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করেছে। এই বিভ্রান্তি দূর করতে হলে ভারতীয় উপমহাদেশে গণিত চর্চার দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাসকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার। ডিসেম্বর মাস আধুনিক ভারতের বরেণ্য গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজনের জন্মের মাস, তাই গণিত চর্চায় ভারতের অবদানকে স্মরণ করারও উপযুক্ত সময়।

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের নগরনির্মাণ ও বাণিজ্যের জন্য যথেষ্ট গণিত চর্চার প্রয়োজন হয়েছিল, কিন্তু সেই চর্চার সম্পূর্ণ স্বরূপ জানা আজও সম্ভব হয়নি। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে গণিত নিয়ে বিশেষ কোনও উল্লেখ না থাকলেও, যজ্ঞবেদি নির্মাণের জন্য গণিতের জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি থেকে সূত্রের আকারে যে সব গ্রন্থ পুরোহিতদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান সুচারু রূপে পরিচালনার জন্য রচিত হয়, তারই একটি পর্যায়ের নাম শুল্বসূত্র। পরবর্তীকালে বেদাঙ্গ বলে পরিচিত কল্পসূত্রের অন্তর্গত শুল্বসূত্রগুলিতে তৎকালীন জ্যামিতি নিয়ে চর্চার পরিচয় পাওয়া যায়। সাধারণাব্দের গোড়ার দিক থেকেই ভারতে গণিত চর্চা যে ব্যাপকতা লাভ করেছিল, তার উদাহরণ বখশালি পাণ্ডুলিপিতে বিদ্যমান। আর্যভট, ব্রহ্মগুপ্ত, বরাহমিহির, প্রথম ও দ্বিতীয় ভাস্কর বা মাধবের মতো দিকপালরা ছাড়াও আরও অনেক ভারতীয় বিদ্বান গণিতের বিভিন্ন দিক নিয়ে যে চর্চা করেছেন, তার ফলে সারা পৃথিবী উপকৃত হয়েছে। সংখ্যাতত্ত্ব, বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, কলনবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁদের গবেষণার গুরুত্ব অবিস্মরণীয়। ভারতের প্রাচীন ও মধ্যযুগের স্থাপত্য ও সেতুনির্মাণের ক্ষেত্রে গণিত চর্চার প্রয়োগের নিদর্শন দৃশ্যমান।       

ভারতীয় উপমহাদেশে গণিত চর্চার ইতিহাস নিয়ে বাংলায় এখনও পর্যন্ত খুব বেশি কিছু লেখা হয়েছে বলে মনে হয় না। এই বিষয়ে আগামী দিনে ইতিহাস তথ্য ও তর্ক গোষ্ঠী অবশ্যই মনোযোগ দেবে। ভারতীয় গণিতবিদদের আবিষ্কারগুলিকে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মূল্যায়নের চেষ্টা করবে। ভারতে গণিত চর্চা যে আদৌ ‘বৈদিক গণিত’ নামে প্রচারিত কোনও দ্রুত গণনাপদ্ধতির মধ্যে সীমায়িত ছিল না, এই মহাদেশে গণিতের প্রত্যেক শাখায় দীর্ঘ মৌলিক গবেষণা হয়েছে, সেই ইতিহাস সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে ‘ইতিহাস আড্ডা’ বছরের সমাপ্তির দিকে অগ্রসর হতে চায়।