সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

অক্টোবর ১, ২০২৪

দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী

পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে শারীরিক ভিন্নতা আছে তাকে অস্বীকার করা যায় না। অস্বীকার করার প্রয়োজনও নেই। একই বয়সের পুরুষ সমবয়সী নারীদের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেশি লম্বা। পুরুষদের পেশি বেশি এবং হাড় তুলনায় ভারি। মাংস পেশির জন্য পুরুষ নারীদের তুলনায় বেশি শক্তিশালী। আবার নারীর শরীরে চর্বির শতাংশ বেশি। পুরুষদের কোমর তাদের নিতম্বের তুলনায় বড়ো হয়। উল্টো দিকে নারীর শরীর বালিঘড়ির মতো হবে এমনই পুরুষের পক্ষ থেকে আশা করা হয়।

আরও কিছু পার্থক্য আছে—জিনগত তফাৎ। স্কুলের বালিকাও আজ জানে জীব দেহ কোষ দিয়ে গঠিত, আর কোষের মধ্যে থাকে ক্রোমোজোম। মানুষের শরীরে প্রতিটি কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম আছে। এর মধ্যে ২২ জোড়াকে বলে অটোজোম—পুরুষ ও নারীর অটোজোমে পার্থক্য নেই। ২৩-তম জোড়ার ক্রোমোজোম দুটিকে বলে সেক্স ক্রোমোজোম। নারীর ক্ষেত্রে এই জোড়ে ক্রোমোজোম দুটি একই রকম—‘এক্স-ক্রোমোজোম’। আর পুরুষের ক্ষেত্রে ক্রোমোজোম দুটি আলাদা—‘এক্স-ক্রোমোজোম’ ও ‘ওয়াই ক্রোমোজোম’। নিষেকের সময়ে নারী সবসময়ে ‘এক্স-ক্রোমোজোম’ দেয়, পুরুষ দিতে পারে ‘এক্স-ক্রোমোজোম’ বা ‘ওয়াই ক্রোমোজোম’। পুরুষের শুক্রাণু থেকে কোন ক্রোমোজোম আসবে তার উপরে নির্ধারিত হয় ভ্রূণের যৌনতা। অথচ সেই মধ্য যুগ থেকে নারীকে অভিযুক্ত করা হল, প্রহার করা হল, এমনকী সন্তানসহ পুড়িয়ে মারার চল উঠল স্ত্রী সন্তান প্রসবের অপরাধে।

বিনা অপরাধের সেই প্রহার এখনো চলেছে—শহরের বসতিতে, গ্রামের কুঁড়েতে।

অথচ এক সময়ে নারীকে ঈশ্বরী (মাদার গডেস) হিসেবে পুজো করার চল ছিল। প্রাণিজগতে, এমনকি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যেও, ঋতুস্রাব বিরল। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে রহস্যময় নারী-রক্ত ও নারীর উর্বরতাশক্তি পুরুষদের বিস্ময় উদ্রেক করেছে। যৌনমিলনের সঙ্গে সন্তান ধারণকে যুক্ত করা তখন সম্ভব হয়নি। নারীর সন্তান ধারণ ছিল এক বিস্ময়।

তখন মানুষের পেশা ছিল শিকার ও সংগ্রহ করা। হাঁটত আর কুড়িয়ে নিত কন্দ, গাছের ফল, পাখির ডিম। দলবদ্ধ ভাবে শিকার করত পশু। খেত মাছ, মাংস, মজ্জা। শিকারি-সংগ্রাহক সমাজে নারী ছিল মূল সংগ্রাহক এবং শিকারেও তার ভূমিকা ছিল। চিকিৎসা ছিল অভিজ্ঞতানির্ভর লতাপাতার ব্যবহার অথবা ম্যাজিক-নির্ভর তুকতাক। সেই সমাজে নিরাময়কারী হিসেবে নারীর ভূমিকা ছিল।

প্রাগৈতিহাসিক কালের অতিপ্রাকৃত চিন্তাভাবনাতেও নারীর স্থান ছিল। মরজগৎ ও পরাজগতের মধ্যে মধ্যস্থতাকারিকে শামান (পুরোহিত) বলা হয়—শামানবাদ সমস্ত জনজাতির মধ্যে বিদ্যমান। ৩০ হাজার বছরেরও বেশি আগে পাওয়া প্রাচীনতম প্রমাণ ইঙ্গিত দেয়, শামান একজন নারী হতে পারে। বর্তমানের শিকারি সংগ্রাহক সমাজেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

প্রাগৈতিহাসিক যে নারী মূর্তিগুলো পাওয়া গেছে তাদের আকৃতি মোটেই আজকের সুন্দর নারীর দেহের মতো ছিল না। সেই সব মূর্তি উদ্ধারের পরে অবশ্য তাদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভেনাস’—আজকের ইউরোপীয় নারী সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি অনুযায়ী। ৪০-৩৫ হাজার বছর আগের হুহলে ফেলসের ভেনাস, ২৪-২২ হাজার বছর আগের উইলেনডর্ফের ভেনাস।

বালি ঘড়ির মতো নারীর শারীরিক গঠন আসলে ইতিহাসকালে পুরুষ পছন্দের ঠেলায় হয়েছে।

মানুষের উদ্ভবকাল ৩.৩৫ লক্ষ বছর আগে, আর কৃষিকাজ শুরু হয়েছে ১২-১০ হাজার বছর আগে। ৯৭ শতাংশ সময় কৃষিকাজ না করে কাটিয়েছে। কৃষিকাজে সাফল্য জনগোষ্ঠীকে এক জায়গায় স্থিত হতে বাধ্য করে, বুনো পশুকে আটকে রেখে ধারাবাহিকভাবে মাংসের যোগানের ব্যবস্থা করে। কৃষির সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা ও জনবিন্যাস পাল্টে গিয়ে ঘন জনবসতি তৈরি হয়, সামান্য জমি থেকে মানুষ সারা বছরের খাদ্য জোগাড় করতে শিখল। কৃষিতে হাল চাষের প্রচলনের পরে পুরুষরা পশু টানা লাঙ্গলে চাষ, জমিতে জল সেচ করার সঙ্গে যুক্ত হল। সঙ্গে এল যুদ্ধ, রাজনীতি, পুরোহিততন্ত্র ।

নারীর ভূমিকা রয়ে গেল নিবিড় কাজের জন্য—শস্য রোপণ ও পেষা, ফসলের আগাছা তোলা। সন্তান পালন ও গৃহকাজের দায়িত্ব থাকে নারীর ওপরে।

সমাজ অবশ্য সেই কাজের মূল্য দিল না। উৎপাদন ব্যবস্থায় নারী ভূমিকা হল গৌণ।

পুরোহিত তন্ত্র আসলে পুরুষতন্ত্রের প্রতীক হয়ে গেল।

তারপরে দিন কেটেছে, যুগের পরিবর্তন হয়েছে। আজ থেকে দেড়শ বছর আগে থেকে নারী তার প্রাপ্য অধিকার দাবি করল।

সে চায়

  • শারীরিক ন্যায়বিচারের অধিকার—সহিংসতা থেকে রক্ষা পাওয়া, নিজের পছন্দ অনুযায়ী চলা।
  • সামাজিক অধিকার—স্কুলে যাওয়া এবং জনজীবনে অংশগ্রহণ;
  • অর্থনৈতিক অধিকার—সম্পত্তির মালিক হওয়া, নিজের পছন্দের কাজ করা এবং সমান অর্থ পাওয়া;
  • রাজনৈতিক অধিকার—ভোট দেওয়া এবং নির্বাচিত পদে থাকা।

হায়, এদেশে, এরাজ্যে সহিংসতা থেকে এখনো নারী রক্ষা পায়নি। আর আফগানিস্তানে বিদ্যালয়ে যাবার অধিকারও নারীর নেই।

পথ চলা বাকি আছে।