সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

লেখক: গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। গবেষণার বিষয় নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা। বর্তমানে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব। বিজ্ঞানের ইতিহাস দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহী। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আছে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর দুটি ছোট জীবনী, নিউক্লিয় বিজ্ঞানে নারীদের অবদান নিয়ে লেখা 'তেজস্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ' এবং একটি প্রবন্ধ সংকলন 'বিজ্ঞানীর বিবেক'।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় একজন বহুমাত্রিক মানুষ। একাধারে বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক, শিক্ষক, শিল্পোদ্যোগী, সাহিত্যিক ও সাহিত্যবোদ্ধা — তাঁর জীবনের প্রত্যেক দিক নিয়েই দীর্ঘ আলোচনা সম্ভব। তাঁর প্রথম পরিচয় অবশ্যই শিক্ষক ও বিজ্ঞানী, একই সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে তিনি দীর্ঘদিন অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্রের সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা তাঁর গবেষণাকে কোন চোখে দেখতেন, রাজিন্দর সিং ও অর্ণব রায়চৌধুরির এক প্রবন্ধে তার পরিচয় পাওয়া যাবে। রসায়নে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের গবেষণা সম্পর্কে লেখার যোগ্যতা আমার নেই, এই লেখাতে আমরা শুধুমাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাব্রতী প্রশাসক প্রফুল্লচন্দ্রকে সংক্ষেপে চেনার চেষ্টা করব; হয়তো তার সঙ্গে তাঁর চরিত্রের অন্য দিকগুলিরও কিছু পরিচয় পাওয়া যাবে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিদ্যা বিভাগের সব থেকে পরিচিত ত্রয়ীর অন্যতম হলেন সত্যেন্দ্রনাথ। রামন বা ডি এম বোস শিক্ষক হিসাবেই যোগ দিয়েছিলেন; কিন্তু ক্লাস যখন শুরু হয় তখন তাঁদের দুজনের কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন না। তখন শিক্ষক হিসাবে ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ ও যোগেশচন্দ্র মুখার্জির পাশাপাশি কয়েকজন গবেষক ছাত্রকেও ক্লাস নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ, শিশিরকুমার মিত্র ও অবিনাশচন্দ্র সাহা। প্রথম তিনজনকে স্যার আশুতোষ নিজে ডেকে পড়ানোর দায়িত্বও দিয়েছিলেন। শৈলেন্দ্রনাথ অবশ্য পড়ানোর সুযোগ পাননি, আগেই বলেছি যে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে তাঁকে দেশত্যাগ করতে হয়। এই পর্বে আমরা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব। প্রথম পর্বে ১৯১৬ থেকে ১৯২১ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, এরপর চলে যান ঢাকাতে। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ফেরেন ১৯৪৫ সালে। সত্যেন্দ্রনাথের বিশ্বখ্যাতি যে বিশেষ গবেষণাটির জন্য, তা কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে করা নয়।
আগের দু’পর্বে আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান কলেজ, এবং পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাকস্বাধীনতা যুগ নিয়ে কিছু কথা বলেছি। বিভাগের প্রথম তিরিশ বছরকে যদি মোটামুটি সমান দু ভাগে ভাগ করি, তার প্রথমার্ধকে (১৯৩৩ পর্যন্ত) রামন যুগ নাম দিলে অন্যায় হয় না। এই সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ, মেঘনাদ, দেবেন্দ্রমোহন, শিশির মিত্র সকলেই পড়িয়েছেন, ভারতে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এঁদের প্রত্যেকের নামই নিজের প্রতিভায় ভাস্বর, কিন্তু তা হলেও বিভাগের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন রামন। আগেই বলেছি, রামন ১৯১৪ সালেই পালিত অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু সরকারী চাকরি ছেড়ে যোগ দিতে দিতে ১৯১৭ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৩৩ সালে কলকাতা ছেড়ে রামন বাঙ্গালোর চলে যান, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের অধিকর্তা হয়ে। এই ষোলো বছর রামন পালিত অধ্যাপক এবং সেই সুবাদে বিভাগীয় প্রধান ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অফ সায়েন্সে নিজের চারদিকে তরুণ গবেষকদের গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন, এবং নিয়মিত প্রথম শ্রেণীর পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি এশিয়ার প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান, ভারতে রবীন্দ্রনাথের পর দ্বিতীয়।