সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

লেখক: অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত

অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
এম.ফিল গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
সৃষ্টি যেদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, সেই দিন কেমন হবে? এর বর্ণনা বিভিন্ন ধর্ম দিয়েছে বিভিন্ন ভাবে। অনেক সময়, এক-ই ধর্মের মধ্যেই পাওয়া যায় এই সৃষ্টি শেষের মহাপ্রলয়ের ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ। খ্রিস্ট ধর্মের ঐতিহ্যেও শেষের সে দিন কেমন, তার বিবিধ বর্ণনা মেলে। তবে এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত প্রলয়ের ভাষ্যের হদিশ সম্ভবতঃ রয়েছে বাইবেলের ‘বুক অফ রিভিলেশন’-এ। বলা হয়েছে প্রলয়কালে ধরায় অবতীর্ণ হবেন চার অশ্বারোহী। এই প্রলয়ের অশ্বারোহীদের পরিচয় কী ও তাঁরা ঠিক কীসের প্রতিক, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে সর্বাপেক্ষা প্রচলিত মত অনুসারে এই চার সওয়ার হলেন যথাক্রমে পেস্টিলেন্স বা মহামারী, ওয়ার বা যুদ্ধ, ফেমিন বা দুর্ভিক্ষ এবং সর্বোপরি ডেথ বা মৃত্যুর প্রতীক। ঠিক এই কারণেই, আপনি যদি সপ্তদশ শতকের ইউরোপের বাসিন্দা কোনও ধার্মিক খ্রিস্টান হতেন, তাহলে এ’কথা আপনার মনে হওয়া অতি স্বাভাবিক ছিল যে, মহাপ্রলয়ের কাল সমাগত।
ইউরোপ, এমনকি মহাসাগরের ওপারে ইউরোপীয় সভ্যতারই সম্প্রসারিত রূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কল্পনা ও মননে রোমের পতনের দীর্ঘ ছায়া আজও বিদ্যমান। আজও ‘পশ্চিম’-এর পতন সংক্রান্ত যে কোনও বিতর্কে হামেশাই রোমের পতনের সঙ্গে তুলনা টেনে আনা হয়। বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেন রোমান সাম্রাজ্যের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও কোনও একদিন পতন হবে কিনা, ইউরোপের অতি-দক্ষিণপন্থীরা বর্বর আক্রমণের সঙ্গে তুলনা টানেন অভিবাসনের। মোট কথা, ‘পতন’ বলতেই ইউরোপীয়দের (এবং আমেরিকানদের) মননে প্রথম যে চিত্রটি ভেসে ওঠে, তা প্রাচীন রোম-সংক্রান্ত। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো, রোমের পতন বলতে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের শেষের দশকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কথা আমরা বলছি। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য, যা ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ অবধি বজায় ছিল, তার সম্পর্কে ইউরোপের ঐতিহাসিক স্মৃতি ও ধারণা অন্যপ্রকার, সে এই আলোচনার বিষয় নয়। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য, আধুনিক ইউরোপের বদলাতে থাকা ঘটনাবলী রোমের পতন সংক্রান্ত ঐতিহাসিক আলোচনাকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা প্রদান করা।
সময়টা সাধারণাব্দের চতুর্থ শতকের শেষ, পঞ্চম শতকের শুরু। ইউরোপীয় ইতিহাসচর্চায় তখনও গ্রিকো-রোমান ধারারই রমরমা। প্রায় হাজার বছর আগে হেরোডোটাস চিন্তার যে নতুন রাজপথ খুলে দিয়েছিলেন, তাতে ইতিহাসের রথ চালিয়ে চলে গেছেন গ্রিকদের মধ্যে থুকিডিডিস, পলিবিয়াস আর রোমানদের মধ্যে লিভি, প্লুটার্ক আর তাসিতুসদের মতো রথী মহারথী। প্রায় হাজার বছর ধরে ইউরোপীয় ইতিহাস চিন্তার জগতে একাধিপত্য করে চলেছে গ্রিকো-রোমান ইতিহাস চর্চার এই রথ। হঠাৎ এই রথের পথরোধ করে দাঁড়ালেন কয়েকজন। এতদিন ইতিহাস আলোচনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ ও তার কাহিনী। সময়ের ধারণা ছিল চক্রাকার। মনে করা হত ইতিহাসের ঘটনাগুলি পূর্বেও ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। গ্রিকো-রোমান ধারায় ইতিহাস লেখার উদ্দেশ্যই তো ছিল ভবিষ্যতে যখন একই ঘটনা আবার ঘটবে, তখন মানুষ যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে আর ভুল সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকে তা নিশ্চিত করা।
জীবনে প্রথম রেলগাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা এইভাবেই তাঁর সুনিপুন অক্ষরের নকশায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন রাস্কিন বন্ড। সেই বয়সেই তাঁর দেখার চোখ ছিল। পরিতাপের বিষয়, এই ঈশ্বরপ্রদত্ত দৃষ্টি, বর্তমান লেখকের কস্মিনকালেও ছিল না। তবুও এইটুকু মনে আছে, ছোটবেলায় পুজোর সময় ভোরবেলার আকাশ যখন আস্তে আস্তে গোলাপী হয়ে উঠত, তখন হ্যামলিনে বাঁশির মতো রেলগাড়ির হর্নের মায়াবী সুরের টানে বাবা মা-এর হাত ধরে দাঁড়াতাম শেয়ালদার কোনও প্ল্যাটফর্মে। আরব্য রজনী থেকে উঠে আসা এক আশ্চর্য যান প্রবল বেগে ছুটে চলত গন্তব্যের দিকে। জানলা দিয়ে অবাক হয়ে দেখতাম গাছ, বাড়ি, পুকুর, মানুষ, ধানক্ষেত – সবেরই পেছন দিকে দৌড়। আর যখন জুবিলি সেতু আসত, রেলগাড়ি তার উর্ধ্বশ্বাস দৌড় থামিয়ে, ধীর শ্বাস ফেলতে ফেলতে, সকালের সোনাগলানো রোদে চিকচিক করতে থাকা গঙ্গা পার হতো, তখন রাস্কিনের মতোই, পুরো ব্যাপারটাই মনে হতো রূপকথার বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা।
কাকে বলে ইতিহাস? প্রশ্ন অতি সহজ এবং প্রাথমিক। কিন্তু উত্তর? না, এর উত্তর প্রদান করা সহজ নয় মোটেই। যুগে যুগে দেবী ক্লিও-এর সেবকরা প্রচেষ্টা করেছেন এই মোক্ষম প্রশ্নের একটি সর্বজনগ্রাহ্য সরল উত্তর খোঁজা। যে বিষয়ের জন্য তাঁরা পুরো জীবন উৎসর্গ করছেন, তার মূলগত চরিত্র কী, সন্ধান করেছেন বহু ঐতিহাসিক। বোঝার প্রচেষ্টা করেছেন তার বৃহত্তর উদ্দেশ্য। নির্ণয় করতে প্রয়াসী হয়েছেন, তা কি ব্যক্তির কাহিনী বলে, না সমাজের? তাতে নৈতিক বিচারের স্থান আছে না নেই? তার কি কোনো বৃহত্তর অর্থ আর ছন্দ আছে না তা একেবারেই খামখেয়ালী এক প্রবাহ যার ‘নাইকো মানে নাইকো সুর’? গত শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবেত্তা অধ্যাপক ই.এইচ. কার-এর ‘হোয়াট ইজ হিস্ট্রি?’ (‘What is History?’) ছিল এইপ্রকারই এক উত্তর সন্ধানের প্রচেষ্টা।