‘ঈশ্বরের পরিকল্পনা’ ও ‘পবিত্র ইতিহাস’ – ইউরোপে খ্রিস্টীয় ইতিহাস চর্চার উত্থানের গোড়ার কথা
সময়টা সাধারণাব্দের চতুর্থ শতকের শেষ, পঞ্চম শতকের শুরু। ইউরোপীয় ইতিহাসচর্চায় তখনও গ্রিকো-রোমান ধারারই রমরমা। প্রায় হাজার বছর আগে হেরোডোটাস চিন্তার যে নতুন রাজপথ খুলে দিয়েছিলেন, তাতে ইতিহাসের রথ চালিয়ে চলে গেছেন গ্রিকদের মধ্যে থুকিডিডিস, পলিবিয়াস আর রোমানদের মধ্যে লিভি, প্লুটার্ক আর তাসিতুসদের মতো রথী মহারথী। প্রায় হাজার বছর ধরে ইউরোপীয় ইতিহাস চিন্তার জগতে একাধিপত্য করে চলেছে গ্রিকো-রোমান ইতিহাস চর্চার এই রথ। হঠাৎ এই রথের পথরোধ করে দাঁড়ালেন কয়েকজন। এতদিন ইতিহাস আলোচনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ ও তার কাহিনী। সময়ের ধারণা ছিল চক্রাকার। মনে করা হত ইতিহাসের ঘটনাগুলি পূর্বেও ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। গ্রিকো-রোমান ধারায় ইতিহাস লেখার উদ্দেশ্যই তো ছিল ভবিষ্যতে যখন একই ঘটনা আবার ঘটবে, তখন মানুষ যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে আর ভুল সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকে তা নিশ্চিত করা। নতুন এই ইতিহাস লেখকরা মানুষের হাত থেকে ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণের রশি কেড়ে নিতে চাইলেন। তাঁদের ভাবনায় চক্রাকার ইতিহাস, চিরন্তন পতন-অভ্যুদয়ের উপাখ্যান থেকে বদলে হয়ে গেল সরলরৈখিক এক কালানুক্রমিক ঘটনাবলী, যা দ্রুত ধাবিত আসন্ন জগতের অবসানের দিকে। দ্রুত বদলে যেতে থাকা ইউরোপীয় সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্ম সহায়ক হল এই নতুন ভাবনার। এই চিন্তকদের সম্মিলিত আক্রমণে মানুষের মন জগতে দ্রুত জমি হারালো গ্রিকো-রোমান ধারা। ইতিহাস ভাবনার রাজপথে গড়াতে শুরু করল নতুন চাকা।
কারা ছিলেন এই ইতিহাস লেখকরা, যাঁরা সর্বশক্তিমান গ্রিকো-রোমান ইতিহাস চর্চার দুর্গকে এত সাফল্যের সঙ্গে আক্রমণ করলেন? এঁরা হলেন বেথলেহেমে জন্ম নেওয়া এক সূত্রধর প্রবর্তিত নতুন বিপ্লবী ধর্মমতের মতাদর্শিক সৈনিক। এঁরা খ্রিস্টান যাজক। যীশু খ্রিস্টের মৃত্যু পরবর্তী এক সুদীর্ঘ কাল খ্রিস্টান ধর্ম সম্প্রদায় ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামানোর বিশেষ প্রয়োজন বোধ করেনি। এর কারণ ছিল দ্বি-মুখী। একটি কারণ হল, সেই সময়ে খ্রিস্টধর্ম সমাজের একেবারে নিম্ন শ্রেণির মধ্যেই শুধু সহানুভূতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল, তাই আদি খ্রিস্টীয় চার্চের মধ্যে এমন মানুষ খুব কম-ই ছিলেন যাঁদের ইতিহাস রচনার প্রচেষ্টা করার মতো কোনও সুযোগ ছিল।
অপর কারণ ছিল ধর্মবিশ্বাস সংক্রান্ত। আদি খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করতেন যীশু খ্রিস্ট নিকট ভবিষ্যতেই আবার মর্তে ফিরে আসবেন এবং শেষ বিচার অনুষ্ঠিত হবে। পৃথিবীর ও মানব সভ্যতার অন্তিম অধ্যায় যখন এত নিকট, তখন ইতিহাস লেখার কাজ নেহাতই পণ্ডশ্রম। অকাট্য যুক্তি। প্রায় সাড়ে তিন শতক খ্রিস্টান চার্চের মধ্যে এই প্রকার ধারণা ইতিহাস লেখার কাজ থেকে চার্চের পন্ডিত ও শিক্ষিত সদস্যদেরও দূরে রেখেছিল। আদি চার্চ সম্পর্কে ঠিক এই কারণেই ধর্মপুস্তকের বাইরে আজও আমাদের জানার উৎস হল অ-খ্রিস্টান গ্রিকো-রোমান ধারার অনুসারী ইতিহাসবিদদের রচনা।
এই পরিস্থিতির ক্রমশঃ পরিবর্তন হতে থাকল চতুর্থ শতক থেকে। খ্রিস্টান ধর্মের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার ফলে তা আর নিম্নবর্গের ধর্ম রইল না। রোমান সাম্রাজ্যের অভিজাত ও উচ্চবর্গীয় জনতার মধ্যেও তা জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করল। ৩১২ সাধারণাব্দে স্বয়ং রোমান সম্রাট কনস্টান্টিন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলেন। যে খ্রিস্টধর্মকে এতকাল রোমের শাসকদের তরফ থেকে নানা ভাবে দমন-পীড়ন সহ্য করতে হয়েছে, মিলান অধ্যাদেশের মাধ্যমে সাম্রাজ্য সেই ধর্মের প্রতি সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করে। এরপর রোমান চিরায়ত বহুঈশ্বরবাদী ধর্মবিশ্বাস খুব দ্রুত জমি হারাতে শুরু করল। সম্রাট জুলিয়ানের মতো মানুষও চেষ্টা করে পারলেন না ইতিহাসের গতি উল্টে দিতে। ৩৮০ সাধারণাব্দে সম্রাট থিয়োডোসিয়াসের শাসনকালে যে খ্রিস্টধর্মকে রোমান সাম্রাজ্য একদা সমূলে উৎপাটন করতে সচেষ্ট হয়েছিল, তা-ই ঘোষিত হল সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে।
খ্রিস্টধর্মের রাজনৈতিক ভাগ্যের এই দ্রুত পরিবর্তন এবং ধর্মের অনুগামীদের সামাজিক অবস্থানের বদল এক নতুন ধরনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করল। ৩৮০ সাধারণাব্দে খ্রিস্টধর্ম আর মধ্য প্রাচ্যের কিছু হাতে গোনা জেলে, গণিকা বা দাস-দের ধর্ম ছিল না। এটি ছিল লক্ষ লক্ষ অনুগামী সম্বলিত এমন একটি ধর্ম যা মহাপ্রতাপশালী রোম সাম্রজ্যের রাষ্ট্রধর্মও বটে। তাই চার্চের নেতারা উপলব্ধি করেন যীশুর প্রত্যাবর্তন এবং জগতের অবসান নিকট ভবিষ্যতেই হোক বা সুদূর ভবিষ্যতে, চার্চকে যদি তার নব্য প্রাপ্ত প্রতিপত্তি ধরে রাখতে হয়, তাহলে ইতিহাসের রণক্ষেত্রে পদার্পণ করতেই হবে। ইতিহাসের বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্ম বিরোধী ধ্রুপদী গ্রিকো-রোমান ধারায় শিক্ষিত চিন্তাবিদদের বিচরণ যদি অবাধ হয়, তাহলে এই নতুন ধর্ম সাম্রাজ্যের জনতার মনোজগতে কোনওদিনই সুগভীর ও দীর্ঘস্থায়ী শিকড় চারিয়ে দিতে পারবে না।
চার্চের এই নতুন কলমের সৈনিকদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন কাইজারিয়ার অধিবাসী ইউসেবিয়াস। তাঁর ‘Chronicles and Ecclesiastical History’-তে ইউসেবিয়াস জগতের সূচনালগ্ন থেকে ৩১৫ সাধারণাব্দে সম্রাট কন্সটান্টাইনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ পর্যন্ত কালপর্বের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে প্রয়াসী হন। তাঁর রচনা গ্রিকো-রোমান ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইতিহাস লেখার ধারা থেকে একেবারে মুক্ত ছিল না। খ্রিস্টীয় ধর্ম প্রচারকদের তিনি নানা কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ দেন, যাতে অতিরঞ্জনের ছড়াছড়ি। তবে তা কিছুটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই। ইউসেবিয়াস মনে করতেন ইতিহাসের উদ্দেশ্য হল যুদ্ধের কাহিনী, শাসকদের কাহিনী বলা নয়। এর উদ্দেশ্য হল এমন আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডের কাহিনী তুলে ধরা যার ভাষ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ তার আত্মাকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয় এবং স্বর্গের দরজার চাবিকাঠি লাভ করার উপযোগী জীবন সংগ্রামের অনুপ্রেরণা লাভ করে। তাঁর মতে, ইতিহাস দুই প্রকার, ‘Sacred’ (পবিত্র) ও ‘Profane’ (অপবিত্র)। খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস, তার সন্তদের কীর্তি, তার চার্চের বিকাশের ইতিবৃত্ত— এগুলি হল ‘পবিত্র ইতিহাস’ (‘Sacred History’); আর এর বাইরে যে রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে এতকাল গ্রিক, রোমান আর ইহুদিরা চর্চা করেছে তা হল ‘অপবিত্র ইতিহাস’ (‘Profane History’)। প্রথম প্রকার ইতিহাস পাঠ করে মানুষের আত্মা সুরক্ষিত হয় আর দ্বিতীয় প্রকার ইতিহাস চর্চা পাপ ও অনাচারকে প্রশ্রয় প্রদান করে। এই প্রকার দ্বৈত ইতিহাসের ধারণা ইউসেবিয়াসের পূর্বে আমরা ইউরোপীয় ইতিহাসচর্চার ধারায় আর কোথাও দেখতে পাই না। বলাই বাহুল্য এইপ্রকার আদ্য-প্রান্ত ধর্ম প্রভাবিত কট্টরপন্থী ইতিহাস রচনা ইউসেবিয়াস-কে আধুনিক ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে বিশেষ সম্মানের আসন প্রদান করেনি।
সন্ত ইউসেবিয়াস
ইউসেবিয়াসের অপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল তাঁর ‘Chronicon’। এতে তিনি ধ্রুপদী গ্রিকো-রোমান ইতিহাস এবং ধ্রুপদী ইহুদি ইতিহাসচর্চার নানা উপাদান ব্যবহার করে একটি নতুন কালানুক্রমিক কাঠামো নির্মানে প্রয়াসী হন। পূর্বতন খ্রিস্টান ঐতিহাসিক সেক্সটাস জুলিয়াস আফ্রিকানাস-এর কাজ এক্ষেত্রে তাঁর সহায়ক হয়েছিল। এই কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল খ্রিস্টের জন্ম। সময়কে তিনি দুই ভাগে ভাগ করেন— খ্রিস্টের জন্মের পূর্ববর্তী সময়, যা খ্রিস্টের জন্মের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্ব অবধি বিস্তৃত ছিল (তাঁর মতে ওই সময়েই ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন) এবং খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী সময়, যা খ্রিস্টের প্রত্যাবর্তন, শেষ বিচার এবং সৃষ্টির ধ্বংস অবধি বিস্তৃত থাকবে। এই ব্যবস্থা বা তার কিঞ্চিৎ ধর্মনিরপেক্ষ পোশাক পরিহিত রকমফের (B.C/A.D -এর পরিবর্তে B.C.E/C.E বা সাধারণ পূর্বাব্দ ও সাধারণাব্দ) আমরা আজও ইতিহাসের সাধারণ সাল তারিখের হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। তাই শুধু এর জন্যই ইউসিবিয়াসের নাম ইতিহাসের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকতে বাধ্য। যদিও এটাও মনে রাখা দরকার, মধ্যযুগের পূর্বে তাঁর এই কালানুক্রমিক কাঠামো মূলধারার স্বীকৃতি লাভ করেনি।
ইউসেবিয়াস ইতিহাসকে দেখেছেন ঈশ্বর পরিকল্পিত ও পূর্বনির্ধারিত ঘটনাক্রম হিসেবে। তাঁর ধর্মপ্রভাবিত দৃষ্টিতে প্রত্যেক ঘটনাই খ্রিস্টধর্মের অন্তিম বিজয় ও শ্রেষ্ঠত্বর সাক্ষ্য বহন করে। রোমান বহুঈশ্বরবাদী-দের অত্যাচার, গ্রিকো-রোমান মেধাজীবীদের খ্রিস্টধর্মের উপর প্রবল বৌদ্ধিক আক্রমণ সবই তাঁর চোখে ছিল ঈশ্বরের বৃহত্তর পরিকল্পনার-ই অংশ। তাঁর এই ‘ঈশ্বরের পরিকল্পনা’ রূপে ইতিহাসকে দেখার প্রবণতাকে আরও দৃঢ় ভিত্তির উপর এক প্রজন্ম পরেই প্রতিষ্ঠা করলেন তৎকালীন খ্রিস্টান চার্চের সর্বাপেক্ষা তুখড় বৌদ্ধিক যোদ্ধা। তিনি, সেন্ট অগাস্টিন। অগাস্টিন মূলতঃ খ্যাতি লাভ করেছেন দার্শনিক হিসেবেই। কিন্তু ইতিহাস চিন্তাতেও তাঁর গভীর প্রভাব রয়েছে। হেরোডোটাস যদি গ্রিকো-রোমান ইতিহাস চর্চার ধারার গঙ্গোত্রি হন, অগাস্টিন ছিলেন খ্রিস্টীয় ইতিহাস চর্চার ভগীরথ। ৪১৩ থেকে ৪২৬ সাধারণাব্দের মধ্যে বাইশ খন্ডে রচিত তাঁর মহা গ্রন্থ ‘De Civitat Dei’ (‘City of God’)-এ আমরা তাঁর ইতিহাসচিন্তার প্রধান সূত্রগুলির সন্ধান পাই। অগাস্টিন যে সময়ে লিখছিলেন, তা ছিল খ্রিস্টীয় চার্চের জন্য প্রতিকূল। অ্যালারিকের নেতৃত্বে ভিসিগথরা ৪১০ সাধারণাব্দে রোম দখল ও লুন্ঠন করে। সমগ্র ভূ-মধ্যসাগরীয় বিশ্ব ‘চিরন্তন নগর’-এর এই অভাবনীয় পরিণতিতে কেঁপে ওঠে। ধ্রুপদী রোমান ধর্মের অনুগামীরা প্রচার করতে থাকেন, প্রায় হাজার বছর রোম নগরীতে কোনও বিদেশী শত্রু পদার্পণ করতে পারেনি। এই কাজকে সারা বিশ্ব অসম্ভব মনে করে এসেছে এতকাল। অথচ খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করার তিন দশকের মধ্যেই সেই অসম্ভব অ্যালারিকের নেতৃত্বে বর্বর ভিসিগথরা সম্ভব করে দেখালো। এখনও সময় আছে এই বিজাতীয় ধর্মকে ভূ-মধ্যসাগরে নিক্ষেপ করার, নতুবা রোমের পতন অনিবার্য।
এই অভিযোগের নারায়ণী সেনার বিরুদ্ধে একক অর্জুন রূপে অবতীর্ণ হলেন অগাস্টিন। তিনি বললেন এইপ্রকার বিপর্যয় রোমের উপর নেমে এসেছে খ্রিস্টধর্মের জন্য নয়, বরং বিপরীত। খ্রিস্টধর্ম রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পরেও রোমের নাগরিকদের অ-খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাস এবং রীতি রেওয়াজের ঐশ্বরিক শাস্তি রোমের পতন ও লুন্ঠন। ইউসেবিয়াসের ‘Sacred’ এবং ‘Profane’ ইতিহাসের ধারণার খেই ধরে অগাস্টিন বলেন নগর আদতে দুই প্রকার— ‘Civitat Terrena’ বা ‘জাগতিক নগরী’ আর ‘Civitat Dei’ বা ‘ঈশ্বরিক নগরী’। উন্নাসিকতা, হিংসা, ক্রোধ প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত, সকল প্রকার ঈশ্বর বিমুখ আমোদ-প্রমোদ আর বিলাসের নগর হল প্রথমটি। দয়া, করুণা, ক্ষমা, ভালোবাসা প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত ঈশ্বরমুখী আধ্যাত্মিকতার নগর হল দ্বিতীয়টি। বিশুদ্ধ ‘Civitat Terrena’-এর উদাহরণ হল প্রাচীন ব্যাবিলন, আর বিশুদ্ধ ‘Civitat Dei’ এই পাপে নিমগ্ন পৃথিবীতে থাকা সম্ভব না হলেও আদর্শের কাছাকাছি রয়েছে জেরুজালেম। ঈশ্বরের করুণায় ঈশ্বরিক নগরের চিরায়ত কিছু মূল্যবোধ জাগতিক নগরের মাটিতেও নেমে আসে, তাই ভালো-খারাপ মিলে মিশে একটা বাসযোগ্য নগর গড়ে ওঠে। তবুও মনে রাখা উচিৎ, জাগতিক নগরের মূল্যবোধ যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন তার পতন হয়ে ওঠে অনিবার্য। সে যত শক্তিশালী সভ্যতা হোক, শক্তিশালী নগর হোক তার পতন ঘটবেই, তার চরিত্র-ই অনিত্য। একমাত্র চিরন্তন ‘ঈশ্বরের নগরী’, যার মূল্যবোধের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হল খ্রিস্টান চার্চ।
সন্ত অগাস্টিন
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ইউসেবিয়াস ইতিহাসের যে দ্বৈততার ধারণা এনেছিলেন, অগাস্টিন তাকে বেঁধে দিতে চাইলেন আরও কয়েক ঘাট উঁচু তারে। ইতিহাসের মধ্যে পবিত্র-অপবিত্র, পাপ-পুণ্য, জাগতিক-ঈশ্বরিক— এই দ্বৈততাগুলিকে অগাস্টিন জোরালো ভাবে তুলে ধরলেন। তাঁর ভাষায়, ‘I distinguish two branches of mankind; one made up of those who live according to man, the other of those who live according to God. I speak of these branches also allegorically as two cities, that is, two societies of human beings, of which one is predestined to reign eternally with God and the other to undergo eternal punishment with the devil….’ ।
ইতিহাসের মধ্যমণি – পৃথিবীর অধিপতি ঈশ্বর
কালানুক্রমের ক্ষেত্রেও অগাস্টিন গুরুত্বপূর্ণ ভাবে পূর্বতন গ্রিকো-রোমান ইতিহাসচর্চার রীতি ভঙ্গ করেন। ইউসেবিয়াস সরলরৈখিক কালের ধারণা ইউরোপীয় ইতিহাসচর্চায় ইতিমধ্যেই নিয়ে এলেও খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরাই অনেকে তা ব্যবহার করতেন না, যেমন পলাস ওরোসিয়াস অগাস্টিনের সমসাময়িক খ্যাতনামা খ্রিস্টান ঐতিহাসিক হয়েও ইতিহাসকে দেখেছেন এক চক্রাকার ঘটনা হিসেবেই, যেখানে পাপ ও পুণ্যময় সময় পালা করে আবর্তিত হতে থাকে। অগাস্টিন কিন্তু মনে করতেন একমাত্র সরলরৈখিক ইতিহাসের ধারণাই খ্রিস্টধর্মের পরমকারণমূলক বিশ্ববীক্ষা (Teleological Worldview)-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ইতিহাস বিক্ষিপ্ত কতগুলি সভ্যতার উত্থানপতন বা রাজা এবং সম্রাটদের কাহিনীমাত্র নয়। ইতিহাস হল শেষবিচারের দিকে ধাবমান মানবজাতির ঈশ্বর নির্ধারিত পরিকল্পনা। ইতিহাস থেকে ‘শিক্ষা’ নেওয়া যায়, এই বিষয়েও তিনি দ্বিমত হন। ঈশ্বরের পরিকল্পনা বোঝার ক্ষমতা মর্তবাসীর পক্ষে সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন না। আর যা বোধের অগম্য, তা থেকে শিক্ষা নেওয়ারও কিছু নেই। তিনি এই সরলরৈখিক ইতিহাসকে ছয় ভাগে ভাগ করেন— অ্যাডাম থেকে মহাপ্রলয়, মহাপ্রলয় থেকে অ্যাব্রাহাম, অ্যাব্রাহাম থেকে ডেভিড, ডেভিড থেকে ব্যাবিলনে ইহুদিদের নির্বাসন, নির্বাসন থেকে খ্রিস্টের জন্ম আর খ্রিস্টের জন্ম থেকে তাঁর প্রত্যাবর্তন। এখন মানবজাতি রয়েছে এই ষষ্ঠ পর্যায়ে, ইতিহাসের শেষ ধাপে। খ্রিস্টের প্রত্যাবর্তনের পর সূচনা হবে এক নতুন ঈশ্বরিক যুগের, যা এর পূর্ববর্তী যুগের থেকে গুণগত ভাবে আলাদা।
ইউরোপের ইতিহাস দর্শনের ইতিহাসে সেন্ট অগাস্টিন আর তাঁর ‘De Civitat Dei’-এর গুরুত্ব ছিল বিপুল। তিনি সম্পূর্ণ এক নতুন যুগের সূচনার শঙ্খে ফুঁ দিয়েছিলেন। উইল ডুরান্ট যথার্থ ভাবেই এই গ্রন্থ সম্পর্কে বলেছেন, ‘With this book, paganism as a philosophy ceased to be amd Christinianity as a philosophy began. It was the first definitive formulation of the medieval mind.’
ইতিহাসের চালক – ঈশ্বরের হস্ত
থমসন এবং হোল্ম-এর ‘History of Historical Writing’-এ এই নতুন খ্রিস্টীয় ইতিহাসচর্চার ধারা, যা অগাস্টিনের পরবর্তী সময় থেকে ক্রমশ শক্তি অর্জন করতে শুরু করে, তাকে দেখা হয়েছে নেতিবাচক দৃষ্টিতে। বলা হয়েছে, ‘The displacement of classical Greco-Roman culture with a Christian way of life in the West had a dempening effect on historiography….Why be interested in history, when all history would terminate shortly in a new heaven and new earth ?’ খ্রিস্টীয় ঐতিহাসিকরা এই যে ইতিহাসকে ‘Sacred’ আর ‘Profane’-এর দ্বৈততার কাঁচ চোখে লাগিয়ে দেখতে শুরু করলেন, এর ফলাফলও ভালো হয়নি। ‘Profane’ ইতিহাস চর্চা করতে সর্বদাই বাধাপ্রদান করা হত চার্চের তরফ থেকে। এই বিষয়ে খ্রিস্টান চার্চের ধারাবাহিকতা সত্যিই আশ্চর্য হওয়ার মতো। ‘What does thou miss in God’s word that thou does plunge into these pagan histories?’, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে ‘Didascalia Apostolorum’-এর উক্তি যে মনোভাবের সমর্থন করে, তারই আমরা প্রতিধ্বনি দেখি উনবিংশ শতকে, যখন কার্ডিনাল ম্যানিং ইতিহাসের দোহাই দেওয়াকে অভিহিত করেন, ‘Treason to the Church’ হিসেবে। ইতিহাসে তথ্য-প্রমাণের প্রয়োজনীয়তা, যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ, বাস্তব ইতিহাস ও দৈব-অলৌকিক ঘটনার পৃথকীকরণ ইত্যাদি যে বৈশিষ্ট্যগুলি গ্রিকো-রোমান ঘরানায় কম বেশি দেখা যেত, নতুন এই খ্রিস্টীয় ইতিহাসের ধারণা তার সলিল সমাধি ঘটিয়ে এমন এক ইতিহাস দর্শন এনে হাজির করে যেখানে যুক্তি নয়, তথ্য-প্রমাণ নয়— বিশ্বাস ও ভক্তিই হল ইতিহাস রচনার পূর্ব শর্ত। সন্দেহের কোনও স্থান এই ইতিহাসচর্চায় নেই। তবে এই ইতিহাসচর্চার পুরোটিই নেতিবাচক ছিল, এমন বলা চলে না। ঐতিহাসিক আর. জি. কলিংউড দুটি বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। একটি হল, খ্রিস্টান ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিশ্বজনীন। খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা যত সীমাবদ্ধ পরিসরেই হোক, বিশ্ব ইতিহাস লিখতে সচেষ্ট হয়েছেন, কারণ খ্রিস্টধর্ম কোনও বিশেষ সাম্রাজ্য বা জনজাতির সঙ্গে জড়িয়ে নেই। এই ধর্ম সমগ্র মানবতার ধর্ম হিসেবেই একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে বলে চার্চের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। এই বিশ্বাস-ই গ্রিকো-রোমান ঐতিহাসিকদের মতো তাঁদের গ্রিস বা রোমের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়নি। কলিংউড এও মনে করেন, ‘মানুষ ইতিহাস চালনা করে না, ঈশ্বর চালনা করেন’, খ্রিস্টীয় ঐতিহাসিকদের এই ভাবনা একদিক দিয়ে শাপে বর হয়েছিল। তাঁরা ‘মহান মানব ও তাঁদের কীর্তি হল ইতিহাস’ গ্রিকো-রোমান ইতিহাসচর্চার এক গাড্ডায় হোঁচট খাননি। ইতিহাসে বহু ঘটনাই যে মানুষ না চাইলেও ঘটে, ইতিহাস যে মানুষ সচেতন ভাবে পরিচালনা করতে পারে না— এই ভাবনা, ইতিহাসের গতির সামনে মানুষের অসহায়তার বোধ ও তা থেকে জন্ম নেওয়া বিনম্র মানসিকতা খ্রিস্টান ইতিহাসচর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে কলিংউড তুলে ধরেছেন। এই ইতিবাচক দিকগুলি স্বীকার করেও মনে হয়, লাভ ক্ষতির তুল্যমূল্য বিচারে ক্ষতির পরিমাণই ছিল বেশি। নতুন এই খ্রিস্টীয় ইতিহাস লেখকরা মানুষের হাত থেকে ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণের রশি নিলেন কেড়ে। সেই রশি তুলে দিলেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের হাতে। প্রায় হাজার বছর ইউরোপীয় ইতিহাস চর্চার কেন্দ্রে স্থান করে নিলেন ঈশ্বর, মানুষ গেল আড়ালে। ইউরোপীয় বৌদ্ধিক জগতে ইতিহাসের রাশ আবার হাতে ফিরে আসতে তাকে অপেক্ষা করতে হবে নবজাগরণ আর জ্ঞানদীপ্তির যুগ অবধি।
তথ্যসূত্র –
১) E. Sreedharan, A Textbook of Historiography (500 BC to AD 2000), Orient BlackSwan, 2017
২) Shashi Bhushan Upadhyay, Historiography in the Modern World – Western and Indian Perspectives, Oxford University Press, 2016
৩) R.G. Collingwood, The Idea of History, Lume Books, 2018
৪) Will Durant, The Age of Faith: The Story of Civilization, Volume IV, Simon & Schuster, 2011
৫) James Westfall Thompson, Bernard J. Holm, A History of Historical Writing, Volume I, MacMillan and Co., 1950 ৬) সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক – গ্রিকো-রোমান ইতিহাসচর্চা থেকে উ
রেনেসাঁ আবার ইতিহাস এর রাশ মানুষের হাতে তুলে দিল। কিন্তু তা তো একদিনে বা কোনো একক প্রচেষ্টায়ও হয়নি।
সেই বিষয়ে আর একটি নিবন্ধ লেখার অনুরোধ রইলো। সেই সঙ্গে রইলো এই ব্যতিক্রমী লেখাটির জন্য অভিনন্দন!!
অবশ্যই প্রচেষ্টা করব ভবিষ্যতে কোনও সময়ে সেই কাহিনীও তুলে ধরার। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
একেবারে নতুন বিষয় আমার কাছে। জানলাম । বুঝতে চেষ্টা করেছি । আরো লিখুন । ধন্যবাদ আপনাকে ।
স্বাদু গদ্যে চমৎকার নিবন্ধ।
খুবই তথ্যবহুল অথচ অনাড়ষ্ট রচনা। কিন্তু যে সূত্র ধরে ফের ইতিহাস মানবমুখি হল তা নিয়েও পরবর্তী লেখা লিখুন ভাই। শুভেচ্ছা রইল আপনার এই সমৃদ্ধ আলোচনার জন্য।
অসাধারণ একটি আলোচনা! ভীষণভাবে সমৃদ্ধ হলাম! অল্পসংখ্যক নিম্নবর্গীয় শ্রেনীর ছোট্ট একটা ধর্ম থেকে রোমান পারম্পরিক ধর্মকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে খ্রীষ্টধর্ম কীভাবে রাস্ট্রধর্মে পরিনত হল এবং অসভ্য বা অর্ধসভ্য জার্মান জাতি এবং পরবর্তীকালে ভাইকিং বা ম্যাগিয়াররাও কীভাবে খ্রীষ্টধর্মের কনভার্টেড হল তা মনে বিস্ময় জাগায়! এই বিষয়ে বিস্তারিত লেখার অনুরোধ রাখলাম। ধন্যবাদ নেবেন।
অসাধারন একটি ইতিহাস বর্ণনা। অল্পসংখ্যক নিম্ন শ্রেণীর মানুষের ধর্ম এক সময় রাজধর্ম হয়ে ওঠার গল্প। অজানা তথ্য জানতে পেরে অনেক সমৃদ্ধ হলাম। লেখক কে অসংখ্য ধন্যবাদ।