সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

লেখক: মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা, পরবর্তীতে তথ্য ও প্রযুক্তি শিল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন। ইতিহাসের তন্নিষ্ঠ ছাত্রী। প্রাবন্ধিক। ওনার গ্রন্থ 'প্রাগিতিহাস - ভারতবর্ষে পরিযান ও জাতিগোষ্ঠী গঠন' মুজাফ্ফর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ওনার লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ ধর্ম সংস্কৃতি ও রাজনীতি - ছিন্ন চিন্তার ককটেল।
একটা পুরো মহাসাগরের নাম আমাদের দেশের নামে হয়ে গেছে। পৃথিবীতে যুগে যুগে বহু ক্ষমতাধরেরা এসেছেন, সেসব দেশের পাশেও মহাসাগর আছে, কিন্তু তবু অন্য কোনো দেশ এই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়নি, তাদের নামে একটা মহাসাগরের নাম হয়নি। ভারতের সঙ্গে এই মহাসাগর, তার নিকটবর্তী অন্যান্য সাগরগুলির সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। অতি প্রাচীন যুগ থেকে, প্রথমে পশ্চিম ও পরে পূর্ব উপকূল ধরে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এই উপমহাদেশের মানুষ সমুদ্রপথে বাণিজ্য করেছে। সেই ইতিহাস আজ হারিয়ে গেছে। ভারতবর্ষের মানুষের সেই গৌরবের কথা, সম্পদের স্মৃতিও আর নেই। তবে সেই ইতিহাস তার প্রতি বিদেশি বণিকের আকর্ষণ গড়ে তুলেছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে সেই বাণিজ্য ও তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক দেনাপাওনার স্মৃতি রয়ে গেছে।
অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য ছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের অসামান্য পণ্ডিত এবং বিশিষ্ট ঐতিহাসিক। তাঁর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বৈদিক যুগ ও তৎপরবর্তী সময়ের ভারতীয় সাহিত্য। বিশেষভাবে বৈদিক যুগে বিভিন্ন পেশার মানুষের সামাজিক অবস্থান, সেই সময়ে সমাজে নারীর স্থান, ধীরে ধীরে বর্ণ প্রথার প্রবর্তন, পরবর্তীকালে বেদবিরোধী ধর্মগুলির উন্মেষ নিয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্যের চর্চা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বৈদিক যুগকে দেখতে বাধ্য করে। তাঁর লেখায় শুধু তথ্য পরিবেশিত হয়নি, সেই তথ্যের বিশ্লেষণের ফলে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত বা পুরাণ নিয়ে ইতিহাসভিত্তিক গবেষণায় যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। তাঁর গবেষণাধর্মী রচনা বেদ ও বৈদিক সমাজ, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ ইত্যাদি নিয়ে বহু গুণীজন আলোচনা করেছেন। ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরও চর্চা হবে। আর্যভাষীদের ভারতে আগমন, এই দেশে এসে তখনকার দেশজদের সাথে তাদের মিশ্রণ ও তাঁর ফলে জাত মিশ্রসংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে অধ্যাপিকা ভট্টাচার্যের গবেষণাধর্মী লেখা পাঠককে আজও মগ্ন করে।
হরপ্পীয় সমাজে নারীর স্থান কেমন ছিল? হরপ্পীয় সভ্যতার অধিবাসীরা ছিল মিশ্র মানুষ। এই দেশের প্রথম জনগোষ্ঠী আফ্রিকা থেকে আগত ‘আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহরা। দীর্ঘদিন ওই শিকারী-সংগ্রাহকরা দক্ষিণ এশিয়াতে নিরঙ্কুশভাবে থেকেছে। এরাই আদি ভারতীয়। পরে প্রায় ১২ হাজার বছর আগে আসে প্রাচীন ইরান থেকে আরেক শিকারী-সংগ্রাহক জনগোষ্ঠী। দেশের আদি শিকারী-সংগ্রাহকদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে এরা পরে শুরু করে কৃষি ও পশুপালন। গড়ে তোলে হরপ্পীয় সভ্যতা। ভারতবর্ষে সেই প্রথম তৈরি হয়েছে শহর, জেটি, বাঁধানো সোজা রাস্তা, বলদে টানা গাড়ি। গড়ে উঠেছে পুরোদস্তুর নগরসভ্যতা। সিন্ধু নদের তীরে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ইঁট-বাঁধানো শস্যাগারে মানুষ চাষবাস করে ফসল তুলে রেখেছে। মহিষ, ষাঁড়, ছাগলকে গৃহপালিত করেছে। তখন মানুষ চাষের কাজে হালের ব্যবহার হয়েছে। হাল বা লাঙল ভারতীয় আদিম কৃষিযন্ত্র।
১৬ই মার্চ, ১৯৬৮-এর সকাল বেলায় আমেরিকান ডিভিশনের ১১তম পদাতিক ব্রিগেডের একটা ইউনিট চার্লি কোম্পানির সৈন্যরা দক্ষিণ ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলে মাই লাই গ্রামে পৌঁছেছিল। তাদের ৪৮তম ভিয়েতকং ব্যাটালিয়নকে এলাকা থেকে নির্মূল করার জন্য ‘অনুসন্ধান এবং ধ্বংস’ মিশনে পাঠানো হয়েছিল। তারা মাই লাইতে কোনো প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়নি, তবে সেখানে তখনও প্রায় ৭০০ বাসিন্দা ছিল। অবশ্য সেখানে যুদ্ধ করার উপযোগী ও বয়সী কোনো পুরুষ ছিল না। সেই সকালে গ্রামবাসীরা জলখাবার খেতে বসেছে। তা সত্ত্বেও, পরবর্তী তিন ঘণ্টায় সৈন্যরা ৫০৪ জন ভিয়েতনামী নাগরিককে হত্যা করে। ড্রেনের খাদে সারিবদ্ধ করে রেখে অনেককে গুলিবিদ্ধ করা হয়। মৃত বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে ৩ বছর বা তার কম বয়সী ৫০ জন, ৪ থেকে ৭ বছরের মধ্যে ৬৯ জন এবং ৭০ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে ২৭ জন ছিলেন।