সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

নিয়েন্ডারথল, কবর দেবার প্রথা ও ধর্ম ধারণা

নিয়েন্ডারথল, কবর দেবার প্রথা ও ধর্ম ধারণা

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

এপ্রিল ১৩, ২০২৪ ৫৭৩ 1

মৃত্যু ও পরবর্তী জীবন

আজ থেকে ২ লক্ষ বছর আগে যে মানব প্রজাতিগুলো জন্মেছে তারাও জানত, একদিন আমাদের মৃত্যু হবে। তারা কীভাবে নিয়েছে মৃত্যুকে? কোন বিবর্তনীয় সময় সেপিয়েন্স বা আরও ব্যাপকার্থে হোমিনিন গণের সদস্যদের মৃত্যুর ‘অনুভূতি’ তৈরি হতে শুরু করে? এক সময় মানব প্রজাতিগুলো, বিশেষ করে নিয়েন্ডারথল এবং হোমো সেপিয়েন্স কি ভাবতে থাকে মৃত্যুর পরেও আছে জীবনের ধারাবাহিকতা? একথা অনস্বীকার্য এই ভাবনা আমাদের একটি স্বাচ্ছন্দ্য দেয়। নইলে, ‘আমি নেই ভাবতেও ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে যায়’। তবে এই ভাবনার জন্য জ্ঞানীয় চিন্তার একটি স্তরও পার হতে হয়।

হোমো সেপিয়েন্স তাদের মৃতদেহ সমাধি দিতে জানত। মৃতদের কবরস্থ করা কি হোমো সেপিয়েন্স-এর অনন্য অভ্যাস? নাকি অন্যান্য জ্ঞাতি মানব প্রজাতিও তাদের প্রিয়জনকে পৃথিবীর নিচে বিশ্রামের জন্য রেখে দিত? এটি প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী এক বিতর্কের বিষয়। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আচরণের প্রমাণ নিয়েন্ডারথলদের জ্ঞানীয় বিকাশ ও ক্ষমতা এবং সামাজিক রীতিনীতির ওপরে আলোকপাত করতে পারে।

এই বিষয়ে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মেলে যে, মধ্যপ্রস্তর যুগ (মোটামুটি ২ লক্ষ বছর আগে থেকে ৫০ হাজার বছর আগে) থেকেই নিয়েন্ডারথল এবং হোমো সেপিয়েন্স তাদের মৃতদেহকে সময় বিশেষে মাটির নিচে রাখতে (সমাধি দিতে) জানত। তারা সবসময় সমাধি দিত এমন দাবি করা হচ্ছে না, কারণ তা প্রমাণ করবার মতো তথ্য নেই। এই বিষয়ে প্রমাণ যা পাওয়া যায় তা সবসময় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমাদের বুঝে নিতে হবে যে, মধ্যপ্রস্তর যুগের শেষভাগের রেকর্ড, বিশেষ করে মৃতদেহ সৎকার বিষয়ক তথ্য, ক্রমান্বয়ে ও সুসংবদ্ধভাবে পাওয়া যায় না। তারপরে হোমো গণের মৃতদেহ বিষয়ক কার্যকলাপের বিকাশ— অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো আঞ্চলিকভাবে পরিবর্তনশীল। তবে প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন গবেষক, যে মৃতদেহগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক-স্থানে আবিষ্কার করেছেন ও তার থেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা আমরা আলোচনা করতে পারি।

হোমো সেপিয়েন্স এবং নিয়েন্ডারথল উভয়েরই মধ্যপ্রস্তর যুগের জীবনযাত্রাতে মৃত পশুর থেকে খাদ্যযোগ্য দ্রব্য খুঁটে নেওয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল, তবে তারা তার পাশাপাশি শিকার এবং সংগ্রহও করত। এই সময়েও হাত কুঠার ব্যবহার করা হতো তবে নিয়েন্ডারথলরা ‘মাউস্টেরিয়ান’ নামে এক নতুন ধরনের পাথরের হাতিয়ার তৈরি করেছিল। আফ্রিকাতে হেপিয়েন্স যেরকম অ্যাশিউলিয়ান হাতিয়ার ব্যবহার করত, এটি অনেকটা সেই ধরনের। ৬০-৫০ হাজার বছর আগে, প্রাচীন মানবেরা তাদের বয়স্কদের যত্ন করত, যেমন উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তানে ‘শানিদার’-এর মতো সাইটে প্রমাণিত।

নিয়েন্ডারথল সমাধি

মূলত ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন কঙ্কাল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, নিয়েন্ডারথলরা অনেক সময়ই মরদেহকে কিছুটা পরিবর্তন করে সমাধি দিয়েছে। যে কারণেই হোক না কেন, দেহের কিছু অংশকে টুকরো করা, আঘাত করা বা দাগ কাটার স্পষ্ট চিহ্ন কিছু মরদেহে পাওয়া গেছে। মৃতদেহ থেকে মাংস তুলে ফেলার বা মরদেহ বিকৃত করবার পিছনে মূল দুটো কারণ থাকতে পারে:

১) সমাধি দেবার প্রস্তুতি পর্বের অংশ হিসাবে হাড় পরিষ্কার করা হয়েছে— এটা এক ধরনের আচার যার সঙ্গে প্রাথমিক ধর্ম ও শামানবাদ যুক্ত থাকতে পারে। এই প্রথার সঙ্গে যুক্ত করা যায় মৃতদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে শরীরের প্রক্রিয়াকরণ যেমন মাথার চামড়া তুলে ফেলা, দাগ কাটা এবং সময় বিশেষে টুকরো করা। এই ধরনের শারীরিক পরিবর্তন করা হতে পারে ধর্মীয় রীতির জন্য।

২) পুষ্টির জন্য। একটি ধারণা আছে যে, এই আঘাতের সঙ্গে পুষ্টি এবং আচারিক নরখাদক প্রবৃত্তির সংযোগ আছে।

অনেক সময় মৃতদেহের ওপরে শিলাস্তুপ বা পাথরের টুকরো দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত সমাধি দেওয়া স্থানও পাওয়া গেছে। আবার অনেক সময় মৃতদেহ স্রেফ ফেলে রাখা হয়েছে।

সমাধি দেবার পদ্ধতিতে প্রথমে একটি কৃত্রিম গর্ত খোঁড়া হতো। তারপরে তাতে মৃতদেহ স্থাপন করা হতো। শেষে মৃতদেহটি মাটি ও পাথরের টুকরো দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। আবার অনেক সময় পাশাপাশি একাধিক মরদেহকে সমাধি দেওয়া হতো। সাধারণত, ১২-৬টি দেহ এই কবরস্থানগুলোতে পাওয়া যায়। এইভাবে মৃতদেহ সমাধিস্ত করার সময় পাশের মৃতদেহটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হতো না। বসতির মধ্যেও তাদের সমাধি দেবার প্রথা ছিল। অনেক সময় বসতির জন্য বাতিল করা গুহাতেও কবর দেওয়া হয়েছে। মৃতরা জীবিতদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়, এই বিশ্বাস সম্ভবত এদের কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে ছিল।

১৫০ বছর ধরে ইউরোপ এবং এশিয়ার কিছু অংশে বেশ কয়েক ডজন সমাহিত নিয়েন্ডারথল কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ কবরস্থান বিশ শতকের শুরুতে পাওয়া গিয়েছিল— দুঃখের বিষয় তখন তাদের আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে খনন করা হয়নি। এর জন্যই পূর্ববর্তী কবরগুলোর ক্ষেত্রে নিয়েন্ডারথল কবর প্রথা ইচ্ছাকৃত ছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। আর যেহেতু নিয়েন্ডারথল কবরস্থানগুলো বেশিরভাগ পাওয়া গেছে ইউরোপ অথবা ইজরায়েলে, তাদের খনন করাও তাই হয়েছে মূলত গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে। সেখানেই এই বিষয়ে প্রথম গবেষণা শুরু হয়েছিল কিনা।  

লা শ্যাপেল সান (La Chapelle-aux-Saints)

প্রথম নিয়েন্ডারথল গুহা কোথায় পাওয়া গেছে?

সোর্ডোয়ার উপত্যকার সীমান্তবর্তী ‘লা শ্যাপেল সান’ গুহাটিতে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, ১৯০৮ সালে সেখানেই মিলেছে প্রথম নিয়েন্ডারথল সমাধি।1 ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত গুহায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে ১,০০০ এরও বেশি পাথরের টুকরো (প্রধানত চকমকি), রেইনডিয়ার, বোভিড (গবাদি পশু পরিবারের এক স্তন্যপায়ী প্রাণী), এমনকি একটি গণ্ডারের দাঁত সহ প্রাণীজগতের বিভিন্ন পশুর হাড় আবিষ্কার করা হয়েছে।

ইউরোপের এই সমাধি অন্ততপক্ষে ৬০ হাজার বছর আগের।

নৃতত্ত্বের ইতিহাসে এই কঙ্কালটিকে বলা হয়, লা শ্যাপেলের বৃদ্ধ মানুষ। একটি ছোটো গুহার মধ্যে চুনাপাথরের শয্যায় সমাহিত এই কঙ্কালটিতে মাথার খুলি, চোয়াল, বেশিরভাগ কশেরুকা, তার হাত ও পায়ের বেশিরভাগ হাড় পাওয়া গেছে। তার মৃতদেহ রাখা ছিল অর্ধ শায়িত অবস্থায় মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে, সে মারা যাওয়ার সময় বেশ বৃদ্ধ হয়েছিল। পুরুষটির বয়স মৃত্যুকালে ছিল ৪০ বছর। তখন ৪০ বছরে নিয়েন্ডারথল বা হোমো সেপিয়েন্স উভয়েই বৃদ্ধ হয়ে যেত। একটি সাম্প্রতিক মূল্যায়নে দেখা গেছে যে, ‘লা শ্যাপেল’-এর বৃদ্ধ নিয়েন্ডারথল-মানব গাঁটের অবক্ষয়জনিত রোগে ভুগছিল। সম্ভবত মৃত্যুর কয়েক দশক আগে সে বেশ কয়েকটি দাঁত হারিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, তার দাঁতের অভাব এত বেশি ছিল যে, সে সম্ভবত খাবার গুঁড়ো করে খেত। নিঃসন্দেহে তার গোষ্ঠীর অন্যান্য নিয়েন্ডারথল-রা শেষ বছরগুলোতে তাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে।

প্রাপ্তবয়স্ক নিয়েন্ডারথল মানবের খুব ভালভাবে সংরক্ষিত কঙ্কালটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে ৩০ সেন্টিমিটার গভীরে, ১.৪৫ মিটার লম্বা এবং ১ মিটার আয়তক্ষেত্রাকার গর্তে কবর দেবার হয়েছিল বলে মনে হয়।1 এটি সম্ভাব্য নিয়েন্ডারথল ইচ্ছাকৃত কবরের এক বিশ্বাসযোগ্য উদাহরণ।

লা শ্যাপেলের বৃদ্ধ মানুষ

শানিদার (Shanidar Cave)

স্থান– মনে মনে উড়ে গিয়ে চলে যান উত্তর ইরাকের কুর্দিস্থলে। সেই অঞ্চলের নাম হলো শানিদার।2

৫০-৪৫ হাজার বছর আগের নিয়েন্ডারথলদের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে এই অঞ্চলে। বিজ্ঞানীরা তাদের কঙ্কালের অবশেষ খুঁজে পেয়েছেন সেখানকার শানিদার গুহায়। তখন ইউরোপে আছে নিয়েন্ডারথলরা। খেয়াল রাখতে হবে ইউরোপে হোমো সেপিয়েন্স প্রবেশ করে প্রায় এই সময় এবং তার কিছু পরেই, ৪০–৩৮ হাজার বছর আগে নিয়েন্ডারথলরা পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়।

এখানকার সমস্ত কঙ্কালের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো ‘শানিদার ১’ নামে পরিচিত এক দেহাবশেষ। তার মাথার খুলির ক্ষত এবং তার পা ও বাহুতে বিকৃতির কারণে যত্ন নিয়ে তাকে খুঁড়ে বের করে অধ্যবসায়ের সঙ্গে অধ্যয়ন করা হয়েছিল। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৫০-৪০ বছর। তখনকার দিনের তুলনায় এই বয়স যথেষ্ট। তার মাথায় খুলি, পা এবং বাহুতে ছিল ক্ষত। সেই ক্ষত মৃত্যুর আগে আংশিকভাবে নিরাময় হয়েছিল এবং তার মৃত্যুতে এর কোনও ভূমিকা ছিল না বলে মনে করা হয়েছে।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন যে, ‘শানিদার ১ ‘আগে থেকেই আহত ছিল। তার গোষ্ঠীর অন্যান্য নিয়েন্ডারথলরা তার যত্ন নিয়েছে। অন্যদের সাহায্য ছাড়া তার পক্ষে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা কঠিন ছিল। ২০১৪-২০১৫ সালে ‘কুর্দিস্তান ডিরেক্টরেট অফ অ্যান্টিকুইটিস’-এর পৃষ্ঠপোষকতায় শানিদার গুহায় পাওয়া দেহাবশেষগুলোর আবার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। মৃত্যুর পরে দেহাবশেষের সঙ্গে বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের চিহ্ন পাওয়া গেছে। শানিদার ১ এর মাথার খুলি এবং ম্যান্ডিবলের অবস্থান স্বাভাবিক ছিল না। এখানকার অনেক দেহাবশেষে কাটা দাগ ছিল, সেগুলো চকমকি পাথর দিয়ে কাটা হয়েছে মনে করা হচ্ছে। সম্ভবত এইসব কাটা দাগ কোনও বিশেষ প্রথার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।3

শানিদার ৪- ১৯৬০ সালে, এখানে একটি সম্পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক নিয়েন্ডারথল কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছিল। এই কঙ্কাল আগের নমুনার তুলনায় যথেষ্ট ভঙ্গুর ছিল। ‘শানিদার ৪’-এর কঙ্কাল ছিল ৪৫–৩০ বছর বয়সী এক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের।3

‘শানিদার ৪’-কে নিয়েন্ডারথল সমাধি অনুষ্ঠানের শক্তিশালী প্রমাণ বলে মনে করা হয়েছিল। সমাধির ভিতরে শরীরের চারপাশের মাটির নমুনা থেকে প্রত্নস্থলটির প্রাচীন জলবায়ু এবং উদ্ভিদের ইতিহাস পুনর্গঠন করা হয়। দেখা যায় সেখানে অনেক ফুলের রেণু আছে, যা থেকে তখন মনে করা হয় যে ফুলের গাছ (বা অন্ততপক্ষে গাছের মাথা) কবরের অংশ ছিল। উপরন্তু, একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ফুলগুলো সম্ভবত তাদের নির্দিষ্ট ঔষধি গুণাবলীর জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল।4 সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, নিয়েন্ডারথলটির সম্ভবত শামানিক ক্ষমতা ছিল— সে ছিল ওই গোষ্ঠীর চিকিৎসক ও পুরোহিত।

অবশ্য এই দাবি এখনকার গবেষকরা খারিজ করে দিয়েছেন, তাঁরা মনে করেন ধেড়ে ইঁদুরের উৎপাত এই অঞ্চলে আছে। তারাই এই ফুলের রেণু চারিদিকে ছড়িয়েছে।3, 1

প্রাগিতিহাস বড়োই জটিল, কোথায় এযুগের খ্রিস্টানদের প্রিয়জনের কবরে ফুল দেওয়ার অনুকরণে নিয়েন্ডারথালদের নিজ প্রিয়জনের কবরে লতা পাতা ছড়িয়ে দেওয়া, আর কোথায় ধেড়ে ইঁদুরের ফুল পাতা নিয়ে খেলা করা। এর থেকে বোঝা যায় যে, প্রতিটি প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুর বিশ্লেষণে কতটা সাবধানতা নিতে হয়। এখানে বিষয়টা একটু হাস্যরসাত্মক নাটক হয়ে গেল, এই যা।

লা ফেরাসি (La Ferrassie)

‘৭০-এর দশকে লা ফেরাসি রক শেল্টারে প্রাপ্তবয়স্ক, শিশু এবং দুটি শিশু ভ্রূণ সহ আটটি নিয়েন্ডারথল ব্যক্তির কঙ্কাল পাওয়া গেছে। লা ফেরাসি-তে পাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেহাবশেষের মধ্যে একটি হলো ‘লা ফেরাসি ১’, একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের কঙ্কাল। তার মাথার খুলি, সবচেয়ে বড়ো এবং সম্পূর্ণ নিয়ান্ডারথাল মাথার খুলি যা ১৯০৯ সালে পাওয়া গেছে। এর অনেকগুলির নিয়েন্ডারথল বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেমন নিচু ঢালু কপাল এবং বড়ো নাকের ফুটো। তার দাঁত, যা সবই সংরক্ষিত আছে, বেশ ক্ষয়প্রাপ্ত । অর্থাৎ মৃত্যুর সময় তার বয়স বেশ বেশি ছিল।

একটি ফরাসি গুহায় পাওয়া নিয়েন্ডারথল শিশুর ৪১ হাজার বছরের পুরোনো কঙ্কালের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ নতুন প্রমাণ দেয় যে, মধ্যপ্রস্তর যুগের নিয়েন্ডারথলরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের মৃতদের কবর দিয়েছিল। ফরাসি এবং স্প্যানিশ গবেষকরা আধুনিক প্রযুক্তি পদ্ধতি ব্যবহার করে অবশিষ্টাংশগুলো পুনরায় পরীক্ষা করেছেন, দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের ‘লা ফেরাসি’-তে যেখানে হাড়গুলো পাওয়া গিয়েছিল সেখানে মূল প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি পুনরায় খনন করেছেন এবং মূল খনন থেকে নোটবুক এবং ফিল্ড ডায়েরিগুলো পর্যালোচনা করেছেন।

তাদের উপসংহার? একটি ২ বছর বয়সী নিয়েন্ডার্থলের মৃতদেহ ইচ্ছাকৃতভাবে পলির মধ্যে খনন করা একটি গর্তে শুইয়ে দেবার হয়েছিল।5

মৃতদেহটিতে মাংসাশী প্রাণীদের থেকে আক্রমণের চিহ্ন নেই। হাড়গুলো আবহাওয়ার জন্য বিক্ষিপ্ত ছিল না; এটা ইঙ্গিত দেয় যে শরীরটি দ্রুত মাটিতে ঢেকে গেছিল।

ক্র্যাপিনা (Krapina) নিয়েন্ডারথল প্রত্নস্থল

ক্র্যাপিনা নিয়েন্ডারথল প্রত্নস্থল; উত্তর ক্রোয়েশিয়ায় অবস্থিত মধ্য প্রস্তর যুগের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। প্রত্নস্থলটি প্রথম আবিষ্কার করেন ভূতাত্ত্বিক ‘ড্রাগুটিন গর্জানোভিচ-ক্র্যামবার্গার’, তিনি ১৮৯৯ এবং ১৯০৫ সালের মধ্যে সাইটটি খনন করেছিলেন। তিনি প্রাণীদের অবশেষ, ঈগল পাখির নখর, পাথরের হাতিয়ার এবং নিয়েন্ডারথল হাড় ও দাঁতের সঙ্গে আদিম মানবের দেহাবশেষের টুকরোগুলো খনন করে উদ্ধার করেছিলেন।

এখানে পাওয়া গেছে ৯০০টিরও বেশি ভাঙা হাড়ের টুকরো, যার মধ্যে বিভিন্ন বয়সের পুরুষ এবং মহিলার হাড় ছিল। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী এখনও বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ১৬টি সাইটের গোরের মধ্যে সবচাইতে রক্ষণশীল হিসেবেও ৩৬-৩২টি মরদেহ গোরের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। ক্র্যাপিনার দেহাবশেষের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে কিছু হাড়ের খণ্ডে কাটা দাগ এবং আঘাতের চিহ্ন ছিল। কিছু হাড় উদ্দেশ্যমূলকভাবে খণ্ড করা হয়েছে এবং কিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এছাড়াও, কয়েকটিতে হোমিনিনের দাঁতের দাগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি নির্ধারিত হয়েছে যে প্রত্নস্থলটি প্রায় ১ লক্ষ ৩০ থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার বছরের পুরোনো।

বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিকের ক্র্যাপিনা অবশেষের ব্যাখ্যা বেশ বিচিত্র। কিছু গবেষক এই দাগগুলোকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসাবে দেখেন। কেউ মনে করেন এসব হলো স্বজাতি ভক্ষণের দৃষ্টান্ত। আবার কেউ বলতে চেয়েছেন এগুলো হলো কোনও প্রাগৈতিহাসিক আচারের প্রতিফলন।

ক্র্যাপিনা নিয়েন্ডারথলরা কি নরখাদক ছিল?

তারা কি ক্যানিবাল? স্বজাতি ভক্ষন করত?6

স্বজাতি ভক্ষনের ধারণা আসে কারণ ১) বিভিন্ন পশু এবং নিয়েন্ডারথল কঙ্কালের অবশেষ মেশানো ছিল, ২) লম্বা হাড়গুলো ভাঙ্গা ছিল (মজ্জা বার করার জন্য!), এবং ৩) একটি খুলিও না ভাঙ্গা অবস্থায় পাওয়া যায়নি।

গর্জানোভিচ-ক্র্যামবার্গারই প্রথম ১৯০১ সালে ‘ক্র্যাপিনা’ নিয়েন্ডারথল-দের মধ্যে স্বজাতি ভক্ষণের সম্ভাব্য অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন। সম্ভাব্য নরখাদকের ধারণাটি পরবর্তীকালের অনেক বিজ্ঞানী সমর্থন করেছেন। হাড়ের ছোটো ছোটো টুকরো, মাঝে মাঝে পোড়া হাড়ের চিহ্ন এবং মস্তিষ্কের টুকরোগুলো সন্দেহ জাগায় যে ‘ক্র্যাপিনা’ নিয়েন্ডারথল-রা নরখাদক ছিল।

তবে ১৯৮৫ সালে, নৃতাত্ত্বিক ট্রিঙ্কাউস অনুমান করেছিলেন যে, পলির চাপ এবং নড়াচড়ার কারণে মাথার খুলি ভেঙ্গে গেছে এবং টুকরোগুলো পরে আলাদা করা হয়েছিল।7 ক্র্যাপিনাতে নিয়েন্ডারথল-এর দেহাবশেষ কবর দেবার প্রস্তুতির জন্য বিকৃত করা হয়েছিল। তবে প্রাকৃতিক কোনও ভয়ঙ্কর দুর্যোগের কারণে এই দাগ হয়েছে এমন সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করা যায় না।

এখানে মৃতদেহগুলোতে কিছু কাটা দাগ পাওয়া গেছে। তবে পুষ্টির জন্য মাংস খাবার অভীপ্সা হয়তো বিবেচিত হয়নি; রাসেল মনে করেছেন, এই কাটা দাগগুলো এসেছে সমাধি দেবার জন্য প্রয়োজনীয় আচার পালনের কারণে।8

আজকের দিনেও পাথরের গুহা কাটা কষ্টদায়ক আর বিশেষ করে সোয়া লক্ষ বছর আগে তা আরও কষ্টদায়ক ছিল। কবর দেবার বিশেষ কারণ ছাড়া সেই গুহাকে বিভিন্ন জায়গায় কেটে মৃতদেহ রাখা সময় ও শ্রম সাপেক্ষ। সমাধি দেবার জন্য বিশেষ কারণ ছাড়া এই শ্রমসাধ্য কাজ তাদের করার প্রয়োজন ছিল না।

অনেকেই অন্যান্য ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের ফলে হাড় ভাঙা হয়েছিল বলে মনে করেছেন। ভাঙা হাড়ের টুকরো নিয়েন্ডারথল আচারের অংশ হিসাবে প্রতীকী চিহ্নিতকরণের ফলাফল হতে পারে। সেই হিসাবে, ‘ক্র্যাপিনা’ নিয়েন্ডারথল-রা নরখাদকতায় জড়িত ছিল নাকি ধর্মীয় কাজে মৃতদেহ ব্যবহার করত তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।

ক্রমশ মনে হচ্ছে এই দাগ ধর্মীয় শামানিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। অথবা যদি ক্যানিবালিজমই আঘাতের কারণ হয় তখন প্রশ্ন আসে, সেটা কি ধর্মীয় প্রথার অংশ ছিল?

ইউরেশিয়ায় কয়েক ডজন সমাধিস্থ নিয়েন্ডারথল কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছে, ফলে আজ অনেক বিজ্ঞানী অনুমান করেন যে, নিয়েন্ডারথলরা তাদের মৃতদের কবর দিয়েছে। অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। দুঃখের বিষয়, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পাওয়া সংরক্ষিত কঙ্কালগুলো আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক কৌশল ব্যবহার করে খনন করা হয়নি। আর তখনই সবচাইতে বেশি কঙ্কাল পাওয়া গেছে।

ধর্ম ধারণা

নিয়েন্ডারথল-রা সম্ভবত প্রিয়জনকে কবর দিত। তবে তা ধর্মীয় কারণে কিনা তা বলা সহজ নয়। তাদের কবরে কবর-মধ্যস্ত প্রত্নবস্তু বিশেষ পাওয়া যায়নি। তারা কবর দিয়েছে, এই বিষয় নিয়ে প্রত্নতাত্বিকদের মধ্যে মতবিরোধিতা কমে এসেছে। তবে তা ধর্মের কারণে কিনা সেই বিষয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

ধর্ম ধারণা বহু পুরোনো। তা বুঝতে শুধু আজকের বৃহৎ মনোলিথিক ‘বিশ্ব ধর্ম’-গুলোতে মনোযোগ দিলে বোঝা যাবে না তার উৎস কোথায়, ‘বিশ্বাস ব্যবস্থা’ কত পুরোনো। ধর্মেরও বিবর্তন হয়েছে। আদি, অপরিস্ফুট প্রাথমিক প্রোটো-ধর্মের থেকে আজকের ‘বিশ্ব ধর্ম’-গুলোর সূত্রপাত হয়েছে। তা একমাত্র মানুষের মধ্যেই হয়েছে কিনা তা নিয়ে গবেষণা চলছে। জ্ঞাতি ভাই নিয়েন্ডারথল-দের মধ্যেও কি  ছিল মৃত্যুর পরের আবছা ধারণা? তাই কি তারা মৃতদেহ যত্ন করে কবর দেবার এই প্রয়াস নিতে? 

তথ্যসূত্র

  1. Paul B. Pettitt, ‘The Palaeolithic Origins of Human Burial,’ Routledge, October 15, (2011)
  2. Douglas V. Campana, Pam Crabtree, ‘Evidence for skinning and craft activities from the Middle Paleolithic of Shanidar Cave,’ Iraq, Journal of Archaeological Science Reports, Volume 25, (2019):7-14
  3. Emma Pomeroy, et. al., ‘Issues of theory and method in the analysis of Paleolithic mortuary behavior: A view from Shanidar Cave,’ Volume 29, Issue5, Evolutionary Anthropology, September/October (2020):263-279
  4. Ralph S. Solecki, ‘Shanidar IV, a Neanderthal Flower Burial in Northern Iraq,’ Science, 190, (1975):880-81
  5. A. Balzeau, et al., ‘Pluridisciplinary evidence for burial for the La Ferrassie 8 Neandertal child,’ Sci Rep 10, 21230 (2020)
  6. Tony Phifer and Joshua Zaffos, ‘Cannibalism, Ritual, or Both: The Neanderthal Debate Continues at Krapina Cave,’ Colorado State University, Winter (2019)-Spring (2020)
  7. Erik Trinkaus, Cannibalism and burial at Krapina, Journal of Human Evolution, Volume 14, Issue 2, (1985):203-216
  8. Paul B Pettitt, ‘The Neanderthal dead: exploring mortuary variability in Middle Palaeolithic Eurasia,’ Before Farming, (4), 2002/1
লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা। প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য তালিকা - “নিয়েন্ডারথল, কবর দেবার প্রথা ও ধর্ম ধারণা”

  1. সুদূর অতীতের প্রাচীন মানবগোষ্ঠীগুলোকে যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম। অনুভব করতে পারলাম তাদের জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা।
    বয়স্কদের তারা যত্ন করত ঠিক আজকের দিনের মতোই। পাথরের গুহা কেটে কবর দিত সম্ভবত আজকের মতোই এ কথা ভেবে যে মৃত্যুর পরেও কোন এক জীবনে তারা শান্তি পাবে।
    যারা এই কবর দিয়েছিল, তাদের কী হলো? তারা যখন বয়স্ক হলো কেউ কি ছিল তাদের যত্ন করার মতো? মৃত্যুর পর কেউ কি তাদের দেহ এমন যত্নসহকারে কবর দিয়েছিল? নাকি গোষ্ঠীর শেষ প্রতিনিধি রূপে একা কোনো অজানা প্রান্তরে অসহায়ভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল সে মানুষগুলো? তাদের দেহ শকুন হায়নাদের খাদ্য রূপে ব‍্যবহৃত হয়েছিল? আজ জানার উপায় নেই।

    কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত, তারা জীবনযাপনের এক বিশিষ্ট পদ্ধতি আবিষ্কার ও অবলম্বন করেছিল বলেই আজ আমাদের অস্তিত্ব আছে। তারা একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা অনুশীলন করেছিল। মানুষ আজ মানুষ হয়ে উঠেছে এই গুণটির জন‍্যই। আমাদের দেখতে হবে যেন একে আমরা ধরে রাখতে পারি।

    পরিশেষে একটা টেকনিক্যাল কথা। নিবন্ধটির মধ্যে কয়েকটা বানান ও বাক‍্যের ভুল চোখে পড়ল। একটু দেখবেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।