সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

প্রবন্ধ

বৃহত্তর তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে ভারতের নারীরা জাতীয় আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাদের স্বাধিকারের লড়াই শুরু করেন। জাতীয় পর্যায়ের আন্দোলনের সূত্র ধরেই বাংলা প্রদেশের অন্যতম জেলা বর্ধমানের নারী সমাজ অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনে শামিল হন। অহিংস আন্দোলনের এই পরিসর ছাড়িয়ে বিপ্লবী আন্দোলনেও বর্ধমানের নারীরা অগ্রসর হন। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারার এই আন্দোলন উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলাদের গণ্ডি অতিক্রম করে কখনওই নিম্নবিত্ত, গরিব কৃষক রমণী থেকে নারী শ্রমিককে স্পর্শ করেনি। অথচ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সব থেকে শোষিত অংশ রূপে নারীরা ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম শোচনীয় শিকার। রুশ বিপ্লব সঞ্জাত সমাজতন্ত্রের আদর্শ যে নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার দিক নির্দেশ করছিল ও ভবিষ্যতে শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বিশ্বাস তৈরি করেছিল তার ভিত্তিতে বর্ধমানেও বাম রাজনীতির বিকাশ হয়।
স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ইতিহাসে আরো অনেক ব্যক্তিত্বের নাম পাওয়া যায়। তাঁদের কয়েকজনকে আমরা ভুলে গেছি, কয়েকজনকে হয়তো মনে রেখেছি। তাঁরা সবাই কিন্তু ভুলে যাওয়ার মতো মানুষ নন। এ কথা অনস্বীকার্য যে রামন, মেঘনাদ বা সত্যেন্দ্রনাথের মতো মৌলিক অবদান তাঁরা বিজ্ঞানে রাখেননি; কিন্তু আজকে দেশের প্রায় যে কোনো বিজ্ঞানীর থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁদের পরিচিতি মোটেই কম ছিল না। সব থেকে বড় কথা হল এঁদের প্রত্যেককেই নিজেদের গবেষণাগার একেবারে গোড়া থেকে তৈরি করতে হয়েছিল, দেশে তাঁদের পথ দেখানোর মতো বিজ্ঞানী বিশেষ কেউ ছিলেন না। আমাদের লেখাতে আগে বিভাগের এই সমস্ত ব্যক্তিত্বের নাম এসেছে, এই পর্বে আমরা তাঁদের কাজের খুব সংক্ষিপ্ত পরিচয় রাখব। তবে শুরু করব এমন একজনের কথা দিয়ে যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো পড়ানোর সুযোগ পাননি।
৩০ জুন কাছে এলেই হুল দিবসের কথা মনে আসে। ‘হুল’ শব্দের অর্থ বিদ্রোহ। এই কথাটা আমরা প্রথম জানতে পারি বিদ্রোহের সমসময়কার ইতিহাসকার দিগম্বর চক্রবর্তীর লেখায়। তিনিই সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে প্রথম ভারতীয় ইতিহাসকার। দিগম্বর চক্রবর্তী (১৮৪৯-১৯১৩) লিখেছেন, 'হিস্ট্রি অব দি সান্থাল হুল'। রচনাকাল ১৮৯৫-৯৬। এই ব‌ইটি প্রথম মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। দিগম্বর চক্রবর্তী ছিলেন পাকুড় কোর্টের আইনজীবী। বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর না থাকলেও যাদের ওই অভিজ্ঞতা ছিল তাদের মুখে তিনি ঘটনা শুনেছিলেন। যেমন সিধু কানুর বাবা চুনু মুর্মুর মুখে তিনি শুনেছেন। যে পাকুড়ের সুদখোর মহাজন দীনদয়াল রায়কে শ্মশান কালীতলায় বলি দিয়েছিল সেই জগন্নাথ সর্দারের মুখ থেকে শুনেছেন। শুনেছেন দীনদয়ালের বলির ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শিনী ভগিনী বিমলা দেবীর মুখে। প্রচলিত অর্থে দিগম্বর চক্রবর্তী ঐতিহাসিক ছিলেন না। কিন্তু তাঁর বর্ণনা ইতিহাসের উপাদান। তিনি তাঁর গ্রন্থে 'হুল' শব্দের ব্যবহার‌ও করেছেন ঐতিহাসিক ভাবে। বিদ্রোহীদের প্রতি তাঁর ছিল সহানুভূতির স্পর্শ। 'হুল' শব্দের এমন মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার এবং স্বীকৃতি তাঁর আগে কেউ করেননি।
১৯৪৭-এর দেশভাগ ও তার সহগামী বর্বর ও ভয়ঙ্কর দাঙ্গা সত্ত্বেও ভারতের মানুষ সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে মৌলিক মূল্য রূপে গ্রহণ করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজ স্থাপনের পথে যাত্রা শুরু করেছিল। গান্ধিজির আত্মবলিদান, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি নেহরুর অখণ্ড আনুগত্য এবং মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহ্যের প্রভাবে ১৯৫০–এর দশকে সাম্প্রদায়িকতা সুপ্ত শয়ানে ছিল; কিন্তু সাম্প্রদায়িক তাত্ত্বিকরা তাদের কাজ করে যাচ্ছিল১। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক একটি রাষ্ট্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থাপিত হওয়ার পর ও নানা কারণে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্মীয় গণ্ডিকে কেন্দ্র করে সম্প্রদায়গত স্বাতন্ত্র্যবোধকে প্রকট করে তুলেছে, তাতে অসহিষ্ণুতা ক্রমবর্ধমান হয়ে কোন কোন স্থানে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের রূপ ধারণ করেছে, সংবিধানের মৌল আদর্শ বিপর্যস্ত হচ্ছে২।