সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

প্রবন্ধ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিদ্যা বিভাগের সব থেকে পরিচিত ত্রয়ীর অন্যতম হলেন সত্যেন্দ্রনাথ। রামন বা ডি এম বোস শিক্ষক হিসাবেই যোগ দিয়েছিলেন; কিন্তু ক্লাস যখন শুরু হয় তখন তাঁদের দুজনের কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন না। তখন শিক্ষক হিসাবে ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ ও যোগেশচন্দ্র মুখার্জির পাশাপাশি কয়েকজন গবেষক ছাত্রকেও ক্লাস নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ, শিশিরকুমার মিত্র ও অবিনাশচন্দ্র সাহা। প্রথম তিনজনকে স্যার আশুতোষ নিজে ডেকে পড়ানোর দায়িত্বও দিয়েছিলেন। শৈলেন্দ্রনাথ অবশ্য পড়ানোর সুযোগ পাননি, আগেই বলেছি যে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে তাঁকে দেশত্যাগ করতে হয়। এই পর্বে আমরা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব। প্রথম পর্বে ১৯১৬ থেকে ১৯২১ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, এরপর চলে যান ঢাকাতে। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ফেরেন ১৯৪৫ সালে। সত্যেন্দ্রনাথের বিশ্বখ্যাতি যে বিশেষ গবেষণাটির জন্য, তা কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে করা নয়।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতি অন্যতম চর্চিত বিষয়। সমাজের একটা অংশের মানুষ, ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়ে কট্টর বিরোধী। তাদের মতে ছাত্রদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকাটা অপ্রয়োজনীয়। সরকার বা প্রশাসনের উচিত ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। আর একাংশের মানুষ ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতিকে ছাত্রদের অধিকারস্বরূপ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ছাত্র রাজনীতিকে শুধু অধিকার হিসাবে দেখলে তা নিতান্তই ক্ষুদ্র দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় হবে। অপরদিকে ছাত্র আন্দোলন নিষ্প্রোয়জন বা ছাত্রদের রাজনীতির বাইরে রাখার তত্বটাও কোনওভাবে গ্রহণ যোগ্য হতে পারে না। এই দুটি অংশের বাইরে আর একটি অংশ আছে, যে অংশটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে থেকে স্বাধীনতার কয়েক বছর পর পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনকে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছাত্র রাজনীতিকে আর প্রাসঙ্গিক হিসাবে দেখেন না। কারণ হিসাবে, ছাত্র রাজনীতি ও আন্দোলনের ধারার পরিবর্তনকে দায়ী করার চেষ্টা করেন।
আগের দু’পর্বে আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান কলেজ, এবং পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাকস্বাধীনতা যুগ নিয়ে কিছু কথা বলেছি। বিভাগের প্রথম তিরিশ বছরকে যদি মোটামুটি সমান দু ভাগে ভাগ করি, তার প্রথমার্ধকে (১৯৩৩ পর্যন্ত) রামন যুগ নাম দিলে অন্যায় হয় না। এই সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ, মেঘনাদ, দেবেন্দ্রমোহন, শিশির মিত্র সকলেই পড়িয়েছেন, ভারতে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এঁদের প্রত্যেকের নামই নিজের প্রতিভায় ভাস্বর, কিন্তু তা হলেও বিভাগের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন রামন। আগেই বলেছি, রামন ১৯১৪ সালেই পালিত অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু সরকারী চাকরি ছেড়ে যোগ দিতে দিতে ১৯১৭ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৩৩ সালে কলকাতা ছেড়ে রামন বাঙ্গালোর চলে যান, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের অধিকর্তা হয়ে। এই ষোলো বছর রামন পালিত অধ্যাপক এবং সেই সুবাদে বিভাগীয় প্রধান ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অফ সায়েন্সে নিজের চারদিকে তরুণ গবেষকদের গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন, এবং নিয়মিত প্রথম শ্রেণীর পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি এশিয়ার প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান, ভারতে রবীন্দ্রনাথের পর দ্বিতীয়।
আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের দেশে এসেছে পশ্চিমি দুনিয়া থেকে, আজও দেশের মাটিতে তার শিকড় খুব দৃঢ় নয়। তাই ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তার ইতিহাস সাধারণত কয়েকজন বিজ্ঞানীর জীবন ও কাজ এবং বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। জগদীশচন্দ্র বসু, সি ভি রামন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, হোমি ভাবার মতো শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের উপর লিখিত বইয়ের সংখ্যা কম নয়। আধুনিক যুগে বিস্মৃতপ্রায় হলেও নিজেদের সময়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুপরিচিত বিজ্ঞানীদের নিয়েও কাজ শুরু হয়েছে, এঁদের মধ্যে পড়বেন কে এস কৃষ্ণন, দেবেন্দ্রমোহন বসু, শিশিরকুমার মিত্র, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ডি ডি কোসাম্বি, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের মতো বিজ্ঞানীরা। এঁরা সবাই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অনেকেই আবার নিজের প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন।