সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

প্রবন্ধ

ভারতের স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে—বিশেষত শিক্ষার উপরে তার প্রভাব নিয়ে অনেক কিছু লিখেছেন বহু জ্ঞানী গুণী। আমি একটি বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্ভব কেমন করে স্বদেশী যুগের প্রভাবে হল, সে বিষয়ে দু চার কথা বলতে উদ্যোগী হয়েছি। এই ধৃষ্টতা যে ঐতিহসিক না হয়েও আমি করেছি, তার কারণ হল, এর জন্মসূত্র থেকে এর সঙ্গে আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগ। সেই পরিবার হল অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহের আচার্য্য পরিবার। তিন পুরুষ ধরে এই পরিবারের সদস্য বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ এবং পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে প্রত্যক্ষভাবে ব্রতী হয়েছিলেন—বর্তমান প্রজন্মেও আমরা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছি।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী জন্মসূত্রে পরিযায়ী। বাধ্যত বাস্তুহারা হওয়া মেয়েদের জন্য অপেক্ষা করে মানবাধিকারের প্রতিটি প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চনা। বিশ্বব্যাপী নারী অভিবাসনের ঘটনা ঘটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পরিবেশ সঙ্কট, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার বাতাবরণে এবং অপহৃতা ,নির্যাতিতা হয়ে নারী এক পুরুষ হতে অন্য পুরুষের হাত বদল হয় পণ্যের ন্যায়। তাদের শরীর পুরুষের আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হতে বাধ্য হয়।১ সাম্প্রতিক টালমাটাল বিশ্বে সমগ্র উৎপাটিত মানুষের অর্ধেকেরও বেশি নারী সম্প্রদায়। ২০০১ এর জনগণনা মতে, ৩০৯ মিলিয়ন অভিবাসনকারীর মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ২১৮ মিলিয়ন ও পুরুষ ৯১ মিলিয়ন। সারা বিশ্বে বাস্তুহারা রমণীদের ক্রমশ সংখ্যাবৃদ্ধি জাতিসংঘের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে।২ উল্লেখ্য ১৯৭৫ সালে উদ্বাস্তু মেয়েদের সামগ্রিক উন্নতি বিধানে প্রথম আন্তর্জাতিক মহিলা বিশ্ব-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় মেক্সিকোতে। এবং সালটিকে আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ রূপে চিহ্নিত করা হয় ও সমগ্র বিশ্বের নারী সমতার ওপর গুরুত্ব আরোপিত হয়। আর এক্ষেত্রে উদ্বাস্তু মেয়েদের বিষয়টি সর্বাধিক প্রাধান্য পায়।৩
উনিশশো ত্রিশের দশকের সূচনা থেকেই অবিভক্ত বাঙলায় মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীগণ শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কমিউনিজমের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে থাকে। ইতোপূর্বে বিশের দশক থেকেই প্রধানত রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের প্রেরণায় কাজী নজরুল ইসলাম (যাঁর নিজস্ব মনন-সমৃদ্ধ সাম্যবাদে আস্থা বিষয়ে নতুন করে বলার নেই) নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (যিনি বাংলাভাষায় প্রথম ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস অনুবাদ করেন), শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (বাংলা কথাসাহিত্যে শ্রমিক শ্রেণী যার জন্য প্রথম সম্মানজনক স্থান করে নিতে পেরেছিল) প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকগণ সাম্যবাদ বা মার্কসবাদী মতাদর্শের মূল নির্যাসকে তাদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ‘জনযুদ্ধ’-এর নীতি গ্রহণ করে কমিউনিস্ট পার্টি (সি-পি-আই) ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম সাময়িকভাবে মুলতুবি রেখেছিল। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে গণসংগ্রাম ও গণ-আন্দোলনের ব্যাপারে পুনরায় তারা আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু ইতিমধ্যে জাতীয় কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুতর রূপান্তর ঘটে গিয়েছিল। জাতীয় কংগ্রেস আর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণ-আন্দোলনে উৎসাহী নয়। বরঞ্চ তাদের লক্ষ্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে যত-দ্রুত-সম্ভব ‘ক্ষমতা হস্তান্তর’। তবে গণ-আবেগ বিপরীত কথা বলছিল এবং তা ফেটে পড়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দিদের বিচারকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৫-এর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ছিল এই আন্দোলনের তুঙ্গবিন্দু। কলকাতার ছাত্রসমাজ ও শ্রমিকশ্রেণির একাংশ এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল। হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল কলকাতার রাস্তায়। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী এই জাতীয় আবেগ যে অনতিবিলম্বে সাম্প্রদায়িক হানাহানির পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জিত হবে তখনও তা ছিল কল্পনার অতীত।