সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ছেচল্লিশের কলকাতা দাঙ্গা ও কমিউনিস্ট পার্টি

ছেচল্লিশের কলকাতা দাঙ্গা ও কমিউনিস্ট পার্টি

রাজকুমার চক্রবর্তী

আগস্ট ২২, ২০২১ ১২৯৩ 7

এক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ‘জনযুদ্ধ’-এর নীতি গ্রহণ করে কমিউনিস্ট পার্টি (সি-পি-আই) ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম সাময়িকভাবে মুলতুবি রেখেছিল। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে গণসংগ্রাম ও গণ-আন্দোলনের ব্যাপারে পুনরায় তারা আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু ইতিমধ্যে জাতীয় কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুতর রূপান্তর ঘটে গিয়েছিল। জাতীয় কংগ্রেস আর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণ-আন্দোলনে উৎসাহী নয়। বরঞ্চ তাদের লক্ষ্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে যত-দ্রুত-সম্ভব ‘ক্ষমতা হস্তান্তর’। তবে গণ-আবেগ বিপরীত কথা বলছিল এবং তা ফেটে পড়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দিদের বিচারকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৫-এর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ছিল এই আন্দোলনের তুঙ্গবিন্দু। কলকাতার ছাত্রসমাজ ও শ্রমিকশ্রেণির একাংশ এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল। হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল কলকাতার রাস্তায়। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী এই জাতীয় আবেগ যে অনতিবিলম্বে সাম্প্রদায়িক হানাহানির পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জিত হবে তখনও তা ছিল কল্পনার অতীত।

       অবশ্য ব্রিটিশ-বিরোধী গণ-আবেগের বিস্ফোরণ কিংবা কলে-কারখানায় মালিকশ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের উজ্জ্বল ছবিটার আড়ালে ‘বিভাজনের রাজনীতি’ যে নিঃশব্দে বাংলায় শিকড় বিস্তার করেছিল, তা অস্বীকার করা যায় না। প্রবণতাটি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছিল ১৯৪৬ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনের ফলাফলে। মুসলিম লিগ সভাপতি মুহম্মদ আলি জিন্না এই নির্বাচনকে ‘পাকিস্তানের পক্ষে ভারতীয় মুসলমানদের গণভোট’ রূপে ঘোষণা করেছিলেন। অন্যদিকে কংগ্রেসের নির্বাচনী স্লোগান ছিল ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ভারত। ভোটের ফলাফলে ফুটে উঠল সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। বাংলা থেকে কেন্দ্রীয় আইনসভার ৬ টি মুসলমান আসনই পায় মুসলিম লিগ। বাংলার বিধানসভার ১২১ টি মুসলমান আসনের মধ্যে লিগ পেয়েছিল ১১৩ টি (বাকি ৮-টির ৫ টি পেয়েছিল ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি, ২ টি নির্দল মুসলিম, ১ টি মুসলমান শ্রমিক প্রতিনিধি)। সাধারণ আসনগুলিতে কংগ্রেসও ভালো ফল করে। বঙ্গীয় আইন পরিষদে কংগ্রেসের (তপশিলি ফেডারেশনের সঙ্গে যৌথভাবে) মোট আসন ছিল ৮৬। হিন্দু মহাসভা ১ টি আসনে ও কমিউনিস্ট পার্টি ৩ টি আসনে বিজয়ী হয়। তিন বিজয়ী কমিউনিস্ট প্রার্থী ছিলেন জ্যোতি বসু, রতনলাল ব্রাহ্মণ ও রূপনারায়ণ রায়। এই নির্বাচন কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই প্রথম ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সি-পি-আই) তাদের নিজস্ব পতাকা ও কর্মসূচি নিয়ে লড়াই করেছিল।

       কমিউনিস্টদের ফলাফল আশাব্যঞ্জক হয়নি। এর একটি কারণ হল সীমাবদ্ধ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন, যার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির মূল গণভিত্তি যে সাধারণ মানুষ তারাই ছিল ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। কিন্তু এটিই একমাত্র কারণ ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টি তাদের নির্বাচনী ফলাফলের পর্যালোচনায় পার্টির নানা ভুল ও দুর্বলতা চিহ্নিত করার পাশাপাশি জনগণের মধ্যে মেরুকরণ প্রবণতাকে তাদের খারাপ ফলাফলের একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল—মুসলমান জনগণ তাদের স্বাধীনতালাভের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেছে নিয়েছিল মুসলিম লিগকে, আর হিন্দু জনসাধারণ আস্থা রেখেছিল জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি। পার্টির দলিলের ভাষায়,

এই ভোট শুধু স্বাধীনতার পক্ষে ভোট নয়, পরস্পরের বিপক্ষেও বটে। … লীগ ও কংগ্রেসকে ভোট দিয়া তাহারা লীগ-কংগ্রেসের নেতৃত্বে আস্থা ঘোষণা করিয়াছে। তাহারা জানাইয়াছে যে লীগ ও কংগ্রেসের নেতারা যে পথে লইয়া যাইতেছেন তাহাই স্বাধীনতার পথ।

এই ‘পথ’ যে বিপদসংকুল তা-ও কমিউনিস্ট পার্টি চিহ্নিত করেছিল। দলিলের ভাষায়,

কংগ্রেস-লীগ ঝগড়া না মিটাইলে দেশময় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হইবে। যাহারা হইতে পারিত স্বাধীনতার সৈনিক তাহারা হইবে দাঙ্গাবাজের দল, শত্রুকে ভুলিয়া তারা ভাইয়ের বুকে ছুরি বসাইবে। (মজুমদার ও দত্ত, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ৩০৪-৩০৮)

       কমিউনিস্ট পার্টির এই মূল্যায়ন গৃহীত হয় ১৯৪৬-এর এপ্রিল মাসে। মাত্র চার মাসের মধ্যে মেরুকরণের পরিণতি মর্মান্তিকভাবে প্রতিফলিত হল কলকাতার দাঙ্গায়!

দুই

নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে শহীদ সোহরাবর্দির নেতৃত্বে বাংলায় লিগ মন্ত্রীসভা তৈরি হল (২৪ এপ্রিল)। ইতিমধ্যে ভারতে এসেছে ক্যাবিনেট মিশন, যা ছিল ব্রিটিশদের তরফে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ ও অখন্ড রেখে একটি বন্দোবস্তে আসার শেষ প্রচেষ্টা। কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে শর্তসাপেক্ষে সম্মতি দিলেও ১০ জুলাই নেহরু হঠাৎ জানালেন, তাঁরা সংবিধানসভায় যোগ দিতে সম্মত হলেও ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব ভবিষ্যতে তাঁর দল ইচ্ছামতো বদলে নিতে পারে। এতে মহম্মদ আলি জিন্না বিরক্ত হন (মনে করেন, ক্যাবিনেট মিশনের বিকেন্দ্রীকৃত ও দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রী্য ব্যবস্থায় কংগ্রেসের সায় নেই) এবং ২৭ জুলাই তিনি ক্যাবিনেট মিশনের অখন্ড ভারতের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ক’রে দেশভাগের পক্ষে দ্ব‍্যর্থহীন অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবসের ডাক দিয়ে তিনি বললেন, সাংবিধানিক পথে নয়, প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমেই অর্জিত হবে পাকিস্তান। বঙ্গীয় আইনসভায় সোহরাবর্দি জানালেন, ব্রিটিশ দাসত্ব ও বর্ণ-হিন্দু আধিপত্য থেকে মুক্তির দাবিতে মুসলিম লিগের এই ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’।

       হিন্দু জনগণ স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম লিগের এই আহ্বান ভালো চোখে দেখেনি। হিন্দু মহাসভা বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রচেষ্টায় ওইদিন পালটা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। অধ্যাপক সুরঞ্জন দাস লিখেছেন, বাংলার কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ পুরোদস্তুর হিন্দু সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছিলেন না। কিন্তু যেহেতু কংগ্রেসের মূল সমর্থনভিত্তি ছিল হিন্দু জনগণের মধ্যে, ফলে হিন্দু পরিচিতি-সত্তার সপক্ষে তাদের মধ্যে প্রতিরোধের মানসিকতা জেগে ওঠে (সুরঞ্জন দাস, পৃষ্ঠা ১৬৭)। এই ভাবে, একদিকে মুসলিম লিগের সমর্থক-বাহিনী, অন্যদিকে কংগ্রেস-হিন্দু মহাসভার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা হিন্দু জনগণ—যুযুধান দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছিল ‘প্রত্যক্ষ দিবস’-এর অব্যবহিত পূর্বের রাজনৈতিক পরিবেশ।

সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের অশনিসংকেত আঁচ করতে পেরেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। ১৪ আগস্ট একটি প্রেস বিবৃতিতে জ্যোতি বসু মানুষকে সতর্ক করে বলেন, ‘আমার কাছে সুনির্দিষ্ট খবর আছে যে কলকাতা মুসলিম লীগের একাংশ হিন্দু জনগণকে বলপূর্বক ১৬ তারিখের ধর্মঘটে শামিল করতে চাইছে, যার অনিবার্য পরিণতি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা।‘ (অনুবাদ লেখকের) তিনি মুসলমান জনসাধারণকে তাদের বিগত দিনগুলির বীরত্বপূর্ণ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে মুসলিম লিগের এই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার পরিকল্পনা সম্পর্কে সজাগ থাকতে বলেন। শান্তিরক্ষায় এবং শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্যরক্ষায় কমিউনিস্ট কর্মীদেরও শ্রীবসু দৃঢ়চিত্ত হবার আবেদন রাখেন (মজুমদার ও দত্ত, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৬৭-৬৮)।

       কমিউনিস্ট কর্মীরা শান্তিরক্ষায় সজাগ ছিল নিশ্চয়, কিন্তু বিপদের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা আঁচ করতে পারেননি। কমিউনিস্ট নেত্রী মণিকুন্তলা সেন তাঁর স্মৃতিকথা সেদিনের কথা -য় লিখেছেন,

কলকাতায় ’৪৬-এর ১৬ অগস্ট সুরাবর্দি সরকার ছুটি ঘোষণা করল এবং মুসলিম লিগ একটা মিছিলে যোগ দিতে আহ্বান জানাল মুসলিম জনতাকে। এই মিছিল থেকে কিছু একটা যে অঘটন ঘটবে এটা সবাই অনুমান করেছিল। সুতরাং হিন্দুরাও বিভিন্ন পাড়ায় তৈরি হল। আমাদের পার্টি ওই মিছিলে সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। উদ্দেশ্য, যদি কিছু গোলমালের চেষ্টা হয় তবে পার্টি তা থামাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু এটা তো প্ল্যান করেই করা হচ্ছে, প্রতিরোধ করা পার্টির সাধ্য ছিল না। মিছিল ধর্মতলায় গেলে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। ছোরাছুরিতে হতাহত হয় বেশ কিছু লোক। তারপর চলে দোকানে লুঠপাট। … দুপক্ষের তৈরি লোকেরাই রাস্তায় নেমেছিল। সাজানো মিছিল শেষ পর্যন্ত উধাও হল, সারা কলকাতায় জ্বলল দাঙ্গার আগুন। (মণিকুন্তলা সেন, পৃষ্ঠা ১৫৭)

        ‘দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে পরিচিত এই দাঙ্গা ১৬ থেকে ১৯-২০ আগস্ট পর্যন্ত চলেছিল এবং অন্ততপক্ষে ৪০০০ মানুষ নিহত ও ১০,০০০ মানুষ আহত হয়েছিল। ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছিল আরও অগণিত মানুষকে। সমকালীন সংবাদপত্রগুলির প্রতিবেদনে ও নানা জনের স্মৃতিকথায় উল্লিখিত হয়েছে সেই বীভৎস দিনগুলির বিবরণ। তবে এই দাঙ্গার সময়কালে কমিউনিস্ট কর্মীদের সাহসী ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা কিছুটা উপেক্ষিত থেকেছে ঐতিহাসিকদের আলোচনায়। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র স্বাধীনতা-তে ‘কলিকাতায় গৃহযুদ্ধ ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিরোধ প্রচেষ্টা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ কয়েক কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল (সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬), যা দাঙ্গার দিনগুলিতে কমিউনিস্ট কর্মীদের ভূমিকার একটি মূল্যবান দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ক্ষুদ্র পরিসরের প্রবন্ধে এই বিবরণের খুঁটিনাটি উপস্থাপনা সম্ভব নয়, নির্বাচিত সামান্য অংশই উল্লেখ করি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজাবাজার এলাকায় কমরেড ইসমাইলের নেতৃত্বে শ্রমিকেরা দাঙ্গার প্রতিরোধে সচেষ্ট হন। ‘কমরেড ইসমাইল এবং স্থানীয় শ্রমিক কর্মীদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদের কর্ডন ভেঙ্গে উত্তেজিত জনতা সাড়ে এগারোটার সময় মানিকতলার দিকে যায়। আমাদের কর্মীরা তাদের বিরত করার জন্য পিছনে পিছনে দৌড়ান।‘ কমরেড ইসমাইল মহল্লার বয়োজ্যেষ্ঠদের শান্তিরক্ষার জন্যে অগ্রণী হতে অনুরোধ করলে তাঁরা তাঁদের অসহায়তা প্রকাশ করেন। ‘তখন আমাদের স্থানীয় কর্মীরাই এই উত্তেজনার হাত থেকে ট্রাম শ্রমিকদের এবং গ্যাস শ্রমিকদের মুক্ত রাখার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। শেষপর্যন্ত তারা এদের দাঙ্গার বাইরে রাখেন এবং শান্তিরক্ষা ও বিপন্নদের উদ্ধারের কাজে এঁদের সমর্থন পান।‘ ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘মুসলমান ট্রাম শ্রমিকরাই উত্তেজিত জনতার হাত থেকে ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনের হিন্দু মেয়েদের রক্ষা করেন।‘

       মির্জাপুর স্ট্রিট এবং সার্কুলার রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত ছিল টাওয়ার লজ। সেখানে ৮ জন মুসলমান ও ৪০ জন হিন্দু বাস করতেন। এটা ছিল মুসলমান এলাকা। বিবেকানন্দ রোডে মুসলিম ছাত্রীদের উপর ধর্ষণ হয়েছে অভিযোগ তুলে ১৬ তারিখ সন্ধেবেলায় আক্রান্ত হয় টাওয়ার লজ। এখানে প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেন পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ছাত্র-কমরেড সালে আহমদ, যিনি রশিদ আলি দিবসের আন্দোলনের অন্যতম নেতাও বটেন। আক্রমণকারীরা সালের মাথা লক্ষ করে শাবল ছুঁড়ে মারলেও অল্পের জন্যে তা লক্ষভ্রষ্ট হয়। সালে ও আরও কয়েকজন মুসলমান বোর্ডার প্রতিরোধ গড়ে তুললে দাঙ্গাকারীরা ফিরে যায় এবং সেই অবসরে হিন্দু বোর্ডারদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে কমরেড সালে রক্ষা পাননি। শান্তিরক্ষার জন্যে লরিতে চড়ে বের হলে তিনি আক্রান্ত হন এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।

       আহিরীটোলা ও বাগবাজারের মধ্যে চিৎপুর রোডের দুই পাশে দাঙ্গা ভয়াবহ আকার নিয়েছিল। স্বাধীনতা-র প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘এই এলাকায় আমাদের কর্ম্মীরা সংখ্যায় খুব অল্প। তাঁরা ওয়ার্ডের কংগ্রেস নেতাদের কাছে বার বার শান্তিরক্ষায় অগ্রণী হবার আবেদন জানান—নেতারা কিন্তু উদাসীন থাকেন। আমাদের কর্ম্মীরা এবং একজন ফরোয়ার্ড ব্লক কর্ম্মী সাধ্যমতো শান্তিপ্রচেষ্টার চেষ্টা করেন।‘ তবে এই প্রচেষ্টা সর্বাংশে সফল হয়নি। ‘বাগবাজারের নিকারীপাড়ার বস্তি উচ্ছেদের জন্য জমিদার অনেক দিন থেকেই চেষ্টা করছিল, — এই বার দাঙ্গায় তারা উচ্ছেদ হয়ে গেল।‘ উক্ত প্রতিবেদনে একই সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এই উন্মত্ত তান্ডবের মধ্যে সব মানুষ চেতনা হারিয়ে ফেলেনি। আমাদের কর্ম্মী ছাড়া সাধারণ লোক মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং এর জন্য শেষ পর্য্যন্ত এই এলাকা থেকে ১০০-১৫০ জন মুসলমানকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা যায়।‘

       এই রকম নানা অঞ্চলে ও পাড়ায় পাড়ায় কমিউনিস্ট কর্মীদের উদ্যোগে শান্তিরক্ষার প্রয়াসের বিবরণ পাওয়া যায়। কোথাও তাঁরা সফল হয়েছিলেন, কোথাও আংশিক সফল, আবার কোথাও পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে তাঁরা পুরোপুরি ব্যর্থ হন। সাধারণভাবে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে যে-সব অঞ্চলে কমিউনিস্ট কর্মী ও ইউনিয়নের ভালো প্রভাব ছিল সেখানে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রিত ছিল। স্বাধীনতা-র প্রতিবেদনটিতে উল্লিখিত হয়েছে, ‘সাধারণভাবে নারকেলডাঙ্গা, চিৎপুর, বেলেঘাটা, শিয়ালদা ও সাউথ সেকসনের সব রেলশ্রমিকরা নিজেদের মধ্যে শান্তি বজায় রাখতে পেরেছে। তবে বাইরে থেকে অনেক জায়গায় তাদের উপর আক্রমণ হয়েছে।‘ ১৯ আগস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নানাপ্রকার গুজব ছড়ানো সত্ত্বেও টিটাগড়, আলমবাজার, পানিহাটি, বেলঘরিয়া, বজবজ, মেটিয়াবুরুজ [?] প্রভৃতি এলাকায় হিন্দু ও মুসলমান শ্রমিকরা যথাসম্ভব শান্তিরক্ষা করিতে সমর্থ হয়। জগদ্দল, নৈহাটি, হাওড়া, হুগলী অঞ্চল হইতে কিছু কিছু দাঙ্গা হাঙ্গামার খবর আসে। কিন্তু উহা বেশী ছড়াইতে পারে না।‘ 

       কলকাতা ট্রামকর্মীদের মধ্যে কমিউনিস্টরা দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় ছিল। তৎসত্ত্বেও, ‘প্রত্যক্ষ দিবস’-এর কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলমান ট্রামকর্মীদের মধ্যে মতবিরোধ আত্মপ্রকাশ করেছিল। ১৪ আগস্ট ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে ‘চার ঘন্টা ধরে’ সভা চলেছিল এই মতপার্থক্যের নিরসনে। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন সোমনাথ লাহিড়ী, মহম্মদ ইসমাইল ও ধীরেন মজুমদারের মতো সি-পি-আই নেতা। অনেক বাদানুবাদের পরে এই সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ‘আমরা ভারত বিভাগ সমর্থন করি না, কারণ, তাহা ক্ষতিকর ও অবাঞ্ছনীয়। সেজন্য উক্ত দিবসের প্রতি [প্রত্যক্ষ দিবস] আমাদের সহানুভূতি নাই, কিন্তু শ্রমিকদের ঐক্য ও দৃঢ়তা বজায় রাখিবার জন্য এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অভিযান আগাইবার জন্য আমরা ওইদিন ধর্ম্মঘট করিতে প্রস্তুত আছি…’। ট্রাম-কর্মীরা কলকাতা দাঙ্গার সময় শান্তিরক্ষার প্রয়াসে সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট থাকেন। রণেন সেন লিখেছেন, ‘ট্রাম শ্রমিক নিজস্ব ইউনিয়নের নেতৃত্বে শুধু নিজেদের ঐক্য নজায় রাখেননি, তাঁরা আশেপাসের এলাকায় দাঙ্গা থামাতে ও দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের সম্ভাব্য সব সাহায্য করেছিলেন।‘ (রণেন সেন, পৃষ্ঠা ১০১)

       তবে শ্রমিক ইউনিয়নুভুক্ত সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে কোথাও হিন্দু-মুসলমান বৈরিতা ও দাঙ্গার বর্বরতা লক্ষ্য করা যায়নি, এমন কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ মেটিয়াবুরুজের কেশোরাম কটন মিল, যেখানে অন্তত পঞ্চাশজন বস্তিবাসী ওড়িয়া শ্রমিক (হিন্দু) তাদেরই মুসলমান সহকর্মীদের (বেশিরভাগ নোয়াখালি থেকে আগত) হাতে দাঙ্গায় নিহত হন। ‘শ্রমিকের শ্রেণী-চরিত্রে মেটিয়াবুরুজের দিগ্‌ভ্রান্ত শ্রমিক লেপে [দিয়েছিল] কলঙ্কের কালি’—স্বাধীনতা-র প্রতিবেদনে (৩/৯/১৯৪৬) এমনটাই লেখা হয়েছিল। তবে সামগ্রিকভাবে চিত্রটা ছিল ইতিবাচক। কলকাতা ও শহরতলির ‘লাখ লাখ শ্রমিক’ দাঙ্গার বীভৎসতায় মেতে উঠলে দাঙ্গার ব্যাপ্তি ও ক্ষয়ক্ষতি আরও ব্যাপক হতে পারত। ২ সেপ্টেম্বর কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে শ্রমিকশ্রেণিকে অভিনন্দন জানিয়ে এক বার্তায় বলা হয়েছিল, ‘বাহাদুর ট্রাম মজুর, রেলওয়ে, চটকল, বিড়ি ও ইঞ্জিনিয়ারিং’ শিল্পের হিন্দু ও মুসলমান মজুর ‘লাল ঝান্ডার ইজ্জত’ রক্ষা করেছেন—‘তাঁহাদের পা টলে নাই, শ্রমিকের ভ্রাতৃসম্পর্ক তাঁহারা ভোলে নাই’। (মজুমদার ও দত্ত, পৃষ্ঠা ৩৭৯, চতুর্থ খন্ড)।               

তিন

নানা কারণে কলকাতার ছেচল্লিশের দাঙ্গা পূর্ববর্তী দাঙ্গাগুলির ধরন ও চরিত্রের থেকে আলাদা। এটি পুরোপুরি ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’। হিন্দু ও মুসলমান দাঙ্গাকারীরা একে অপরকে আক্রমণ করেছে, এক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়ের দোকান লুঠ করেছে, কিন্তু আশ্চর্জনকভাবে সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ প্রতিষ্ঠানগুলি আক্রান্ত হয়নি। দাঙ্গাকীর্ণ শহরে সাহেবদের গাড়িগুলি অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই দাঙ্গা স্বতঃস্ফূর্ত জনতার হঠাৎ ‘বিস্ফোরণ’ ছিল না। সুরঞ্জন দাস তাঁর গবেষণায় লিখেছেন, এই দাঙ্গা ‘অত্যন্ত সংগঠিত’ এবং ‘প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত’। মুসলমান জনতাকে নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলিম লিগ; হিন্দু জনগণকে হিন্দু মহাসভা, এবং বেশ কিছু জায়গায় কংগ্রেস। বড়োলাট ওয়াভেল ক্যাবিনেট মিশনের সদস্য পেথিক লরেন্স-কে ২৮ আগস্ট লিখেছিলেন, ‘’স্পষ্টতই… দুই পক্ষ প্রস্তুতি নিয়েছিল। তা আত্মরক্ষার্থে হতে পারে, আবার নাও পারে‘ (সুরঞ্জন দাস, পৃষ্ঠা ১৭৬)। দি স্টেটসম্যান কাগজে লেখা হয়েছিল (২০ আগস্ট), ‘এটা দাঙ্গা নয়। এর জন্যে মধ্যযুগের ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত একটি শব্দ – ‘a fury’ – ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার, ‘fury’ বা উন্মত্ততা বললে তা স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার বলে মনে হয়, কিন্তু এখানে, এই উন্মত্ততার পিছনে, অবশ্যই সচেতন উদ্যোগ ও সংগঠনের প্রস্তুতি ছিল।‘ (অনুবাদ লেখকের)। সত্যি কথা বলতে কী, তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও যুযুধান দলীয় ও সাংগঠনিক শক্তিসংহতির বাইরে বোধহয় থাকতে পেরেছিল কেবল গুটিকয় বামপন্থী ও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা। তবে কমিউনিস্ট কর্মীরা পরে আত্মসমালোচনা ক’রে স্বীকার করে নিয়েছেন যে তাঁরাও দাঙ্গার সম্ভাব্য ব্যাপ্তি ও তীব্রতা আঁচ করতে পারেনি এবং কিছুটা ‘অপ্রস্তুত’ ভাবেই দাঙ্গার মোকাবিলায় সচেষ্ট হয়েছিলেন। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর তরী হতে তীর গ্রন্থে লিখেছেন,

আবার ভাবি, কেমন করে যখন ’৪৬ সালের ২৯ জুলাই যে শহর উত্তাল হল গণঅভ্যুত্থানের গরিমায়, সেখানেই তিন সপ্তাহ কাটার আগে ঘটল এমন অমানুষিক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ যা অকল্পনীয়, যা সবকিছু হিসাবকে ভেস্তে দিয়েছিল। আমাদের আন্দোলনে নিশ্চয়ই আছে এমন কিছু দুর্বলতা যা এই গোড়ার গলদকে আজও পর্যন্ত কেটে বার করে দিতে পারেনি। (হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৫১৫)

       এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, সুরঞ্জন দাসের গবেষণা দেখিয়েছে, আজাদ হিন্দ ফৌজের বহু প্রাক্তন সদস্য, যাঁরা ১৮ আগস্ট আজাদ হিন্দ দিবস উদযাপন করতে শহরে এসেছিলেন, তাঁরাও দাঙ্গায় যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এঁদের স্পষ্ট সহানুভূতি ছিল হিন্দু দাঙ্গাবাজদের পক্ষে। অধ্যাপক দাস মন্তব্য করেছেন, আজাদ হিন্দ ফৌজের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র এবং তাদের মধ্যেকার আন্তর্সাম্প্রদায়িক সংহতির সুদৃঢ় অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্নের অবকাশ নেই। কিন্তু ছেচল্লিশের দাঙ্গায় তাদেরও অংশগ্রহণ প্রমাণ করে সমাজের সর্বস্তরে সেদিন কতটা সাম্প্রদায়িক সচেতনতা প্রসারলাভ করেছিল (সুরঞ্জন দাস, পৃষ্টা ১৮৪)। আসলে, দাঙ্গা এমন এক অনুভূতিহীন হিংসার প্রকাশ যে যখন সেই উন্মত্ততা ফনা মেলে তখন বহু শান্ত ও পরিশীলিত মানুষও তার সক্রিয় অংশীদার হয়ে ওঠে। মণিকুন্তলা সেন লিখে গেছেন কিভাবে সেদিন বাড়ির মহিলারাও দাঙ্গাকারী পুরুষ সদস্যদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল:

…আমার একটা ধারণা ছিল—মেয়েরা এর মধ্যে নেই। … কিন্তু বালিগঞ্জ পাড়া আমার এ ধারণা পালটে দিয়েছিল। … ফার্ন রোড থেকে রাসবিহারীর ট্রাম লাইনে আসতে দুপুরবেলা … হেঁটে আসছি। দেখলাম সেখানে একটা চাঞ্চল্য। বাড়িগুলোর উপরতলা থেকে মহিলারা রাস্তায় দাঁড়ানো পুরুষদের হাতে লাঠি ফেলে দিচ্ছে। কি ব্যাপার? না, মুসলমান আসছে। আমি ভাবলাম বোধহয় মুসলমানরা দলবেঁধে আক্রমণ করতে এসেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটু ভয়ও পেলাম। ও হরি, শুনলাম একটা লুঙ্গি পরা লোককে মুসলমান ভেবে পাড়াময় এই উত্তেজনা। পরে লোকটির পরিচয় পেয়ে সবাই আশ্বস্ত হল। আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। একটা মাত্র লোককে নিকেশ করতে তো কয়েক শো বীরপুরুষ দাঁড়িয়ে গেছেন। কিন্তু মেয়েরা এই ব্যাপারে স্বামী-পুত্রদের ঠেকানোর চেষ্টা না করে উলটে কী করে লাঠি এগিয়ে দিচ্ছেন? দাঙ্গার মত্ততা মানুষকে এতখানি নীচুতে টেনে নামায়? নারী-হৃদয়ের স্বাভাবিক কোমলতাও উধাও হয়ে যায়? এ শুধু কি আমাদের পাড়ায় ঘটেছে? খোঁজ নিলে জানা যেত মুসলিম পাড়াতেও চিত্রটা হয়তো একই। পাশবিক বৃত্তিটা জাগিয়ে দিতে পারলে এরকমই ঘটে বোধ হয়। (মণিকুন্তলা সেন, পৃষ্ঠা ১৬১)

চার

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অনিবার্য নেতিবাচক অভিঘাত পড়েছিল হিন্দু-মুসলমান মেহনতী শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে। স্বাধীনতা পত্রিকায় ৪ সেপ্টেম্বরের সম্পাদকীয়তে বলা হয়,

আজ হিন্দু, মুসলমান এবং ব্রিটিশ তিনশ্রেণীর মালিকই এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উত্তেজনাকে আনন্দের সহিত নিজেদের কাজে লাগাইতেছে।… দাঙ্গা শেষ হবার পরই পটারী কারখানায় ৮০০ শ্রমিক ছাঁটাই হইয়াছে, কিন্তু অতীতে পটারী মালিকের এ সাহস ছিল না। মেটাল বক্সে ৬৩ জন শ্রমিক ছাঁটাই হইয়াছে, মহালক্ষ্মী ব্যাংকে ৩২ জন কেরাণী ছাঁটাই হইয়াছেন। …মালিক আর ধর্মঘট ভয় করে না, কারণ সে জানে হিন্দু-মুসলিম শ্রমিক এখন সহজে এক হইতে পারিবে না।

       কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এতদিন পর্যন্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি যতটা না ছিল জাতীয় কংগ্রেসের সমালোচক, ততটা মুসলিম লিগের ছিল না (অমলেন্দু সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা ২১৮)। কিন্তু ছেচল্লিশের দাঙ্গার অভিজ্ঞতায় এবং মুসলিম লিগের পরিবর্তিত কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে তাদের মনোভাব ক্রমে পরিবর্তিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি এতকাল মুসলিম লিগকে মুসলমানদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবং কংগ্রেস-লিগ সমঝোতার উপর গুরুত্ব আরোপ করছিল। অতঃপর তারা সাধারণ মুসলমান ও মুসলিম লিগের বিপরীতমুখী স্বার্থের উপর জোর দিতে শুরু করে। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ কমিউনিস্ট পার্টির তরফে শ্রমিকশ্রেণির প্রতি ইস্তাহার প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, ‘মুসলিম লীগ নেতৃত্ব তাহার সমর্থকদের হিন্দুদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া ক্ষমতা আদায়ের জন্য সম্মিলিত সংগ্রামকে ইচ্ছাপূর্বক অস্বীকার করিয়া এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংঘর্ষের আহ্বান জানাইয়া সাম্রাজ্যবাদের গৃহযুদ্ধের চক্রান্তকে সফল করিবার সহায়তাই করিয়াছেন।‘ এই ইস্তাহারে মুসলিম লিগকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছিল মুসলমান জনসাধারণের সঙ্গে ‘প্রতারণা’র দায়ে। সেই সঙ্গে কংগ্রেসের আপোসমূলক নীতিকে দায়ি করে বলা হয়েছিল, ‘হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত সংগ্রামে নেতৃত্বের পরিবর্তে কগ্রেস নেতৃত্ব যখনই আপসের পথ গ্রহণ করিলেন, তখনি লীগকে পরাভূত করিবার জন্য তাঁহারা সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভর করিতে বাধ্য হইলেন এবং গৃহযুদ্ধকে আরও তীব্রতর করিলেন।‘ (মঞ্জু কুমার মজুমদার ও ভানুদেব দত্ত, পৃষ্ঠা ৩৭৬-৩৭৭)

       দাঙ্গার ও দেশভাগের রাজনীতির বিকল্প হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক ‘উত্তর’ ছিল তেভাগা আন্দোলন (ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের অধিকারের দাবিতে)। ১৯৪৬-এর সেপ্টেম্বর মাসে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন কৃষকসভা তেভাগা আন্দোলনের ডাক দেয়। এই আন্দোলনের সূচনার সঙ্গে যদিও কলকাতার দাঙ্গার কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি বা কৃষকসভার উচ্চস্তরীয় নেতাদের মাথা থেকে এই আন্দোলন উদ্ভূতও হয়নি। তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তুতি তৃণমূল স্তরে বহুদিন থেকে চলছিল এবং ভাগচাষী ও বর্গাদার কৃষকদের ‘নিচের থেকে চাপ’-ই কৃষকসভা্র ওই আহ্বানে্র মধ্যে মূর্ত হয়েছিল। রঙপুর, দিনাজপুর, যশোর, জলপাইগুড়ি, চব্বিশ পরগনা ও মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল এই কৃষক সংগ্রাম। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে যখন শহরাঞ্চল ও মফসসলের ব্যাপক সংখ্যক মধ্যবিত্ত্ব মানুষ আক্রান্ত তখন সংগ্রামী কৃষকেরা উচ্চে তুলে ধরেছিল হিন্দু-মুসলমানের যৌথসংগ্রামের আদর্শ।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, তেভাগা আন্দোলন কংগ্রেস বা মুসলিম লিগের সমর্থন পায়নি। বাংলার গ্রামাঞ্চলে যখন কৃষকেরা তেভাগার সংগ্রাম করছে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ মেতে আছে স্বাধীনতা ও দেশবিভাগের পর স্ব স্ব রাষ্ট্রে ‘শাসক’ হয়ে ওঠার অভিপ্রায়ে। দেশের বিভিন্ন অংশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভূতপূর্ব প্রসার ও রক্তক্ষয়ের প্রেক্ষিতে কংগ্রেস নেতৃত্বের একটা বড়ো অংশ দেশভাগের অবশ্যম্ভাবিতা মেনে নিয়েছিলেন—সাতাত্তর বছরের গান্ধী কেবল হাল না ছেড়ে অশক্ত শরীর নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছিলেন দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চলে, মানুষের হৃদয় পরিবর্তনের আশায়। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার লিখেছেন, গান্ধীজির এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে মহৎ, কিন্তু তা সফল হবার সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে সত্যিকারের বিকল্প হতে পারত সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহযোগী ভারতীয় শক্তিগুলির বিরুদ্ধে  সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ গণসংগ্রাম, যে-লড়াই অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তেভাগার দাবিতে গ্রামবাংলায়, তেলেঙ্গানায়, পুন্নাপ্রা-ভায়লারে, কিংবা কলে-কারখানায় শ্রমিকদের মজুরি-বৃদ্ধির আন্দোলনে, যা ১৯৪৭-এর গোড়ায় তুঙ্গে উঠেছিল, অথবা ২১ জানুয়ারি (১৯৪৭) কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামের সপক্ষে ছাত্র-যুব বিক্ষোভে। এই সব আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিন্দুমাত্র ছায়াপাত ছিল না। যদি এই সব বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন গণ-আন্দোলনকে সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ করে শীর্ষবিন্দুতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত, তাহলে বিভাজনের রাজনীতির একটা যোগ্য প্রত্যুত্তর দেওয়া যেত। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস সেই সম্ভাবনার পথে হাঁটেনি। কমিউনিস্ট পার্টিও একক শক্তিতে এই কাজ করতে অপারাগ ছিল। সর্বভারতীয় প্রেক্ষিত বাদ দিয়ে যদি শুধু বাংলার রাজনীতিও ধরা যায়, তাহলেও দেখা যাবে কমিউনিস্টদের প্রভাব কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের চেয়ে ছিল অনেক কম, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে। ফলে যা হবার তাই হল। স্বাধীনতাকে ঈপ্সিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে কমিউনিস্টরা ব্যর্থ হয়। তবে আরও বেশ কিছুদিন ‘ঐক্যবদ্ধ বাংলা’-র সম্ভাবনাটি কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের স্লোগানে ও ইস্তাহারে জিইয়ে রেখেছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ ১৯৫০ সালের ২২ মার্চ বাস্তুহারাদের উদ্দেশে জারি করা ইস্তাহারটির কথা বলতে হয়। এই ইস্তাহারে কমিউনিস্ট পার্টি বলেছে, ‘ময়মনসিংহের হাজং এলাকায়, কালসিরা, নাচোল, জয়দেবপুর প্রভৃতি কৃষক এলাকায়, পশ্চিমবঙ্গের কাকদ্বীপ ও মেদিনীপুরে’ ‘মুক্তি সংগ্রাম’ এগিয়ে চলেছে। এই সংগ্রাম আরও জোরদার হলে এবং পশ্চিমবাংলায় বিধান রায়ের মন্ত্রীসভাকে ‘তাড়িয়ে’ দেওয়া সম্ভব হলে, উভয় বাংলার আবারও ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব। ‘বাংলাকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধঘাঁটি হতে দেবো না, টাটা-বিড়লা-ইস্পাহানীর স্বার্থে ধ্বংস হতে দেবো না, দুই বাংলাকে স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ করব [ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে]।‘ (মজুমদার ও দত্ত, ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৬-৮৭)।

তথ্যসূত্র ও গ্রন্থপঞ্জি

মঞ্জু কুমার মজুমদার, ভানুদেব দত্ত (সম্পাদিত), বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস অনুসন্ধান, চতুর্থ খন্ড (২০০৯) ও ষষ্ঠ খন্ড (২০১০), মনীষা: কলকাতা

রণেন সেন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিবৃত্ত, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৯৬

মণিকুন্তলা সেন জনজাগরণে নারীজাগরণে, মণিকুন্তলা সেন শতবার্ষিকী কমিটি, থীমা, কলকাতা ২০২০ (প্রথম সংস্করণ ২০১০)

হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যা, তরী হতে তীর, পরিবেশ প্রত্যক্ষ প্রত্যয়ের বৃত্তান্ত, মনীষা, কলকাতা, ১৯৭৪

সত্যব্রত দত্ত, বাংলার বিধানসভা সংসদীয় রাজনীতি ১৮৬২১৯৫১ অধীনতা: সযোগিতা: সংঘাত, বুক সিন্ডিকেট, কলকাতা, ১৯৯৫

সব্যসাচী ভট্টাচার্য, বাংলার সন্ধিক্ষণ ইতিহাসের ধারা ১৯২0—১৯৪৭, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নয়া দিল্লি, ২০১৪

অমলেন্দু সেনগুপ্ত, উত্তাল চল্লিশ অসমাপ্ত বিপ্লব, পার্ল পাবলিশার্স, কলকাতা, প্রকাশ সাল অনুল্লিখিত

Suranjan Das, Communal Riots in Bengal 1905-1947, OUP, 1993

Sarkar, Tanika and Bandyopadhyay (Ed) Calcutta the Stormy Decades, Social Science Press: Delhi: 2015

Sumit Sarkar, Modern India, Pearson: Delhi, 2014

সংবাদপত্র

স্বাধীনতা  

The Statesman

সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ওয়েস্ট বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিস। গবেষণার বিষয় ‘বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন’। প্রাবন্ধিক। একাধিক গ্রন্থ ও সম্পাদিত গ্রন্থের প্রণেতা।

মন্তব্য তালিকা - “ছেচল্লিশের কলকাতা দাঙ্গা ও কমিউনিস্ট পার্টি”

  1. খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসকথন। প্রকৃতই তখন কমিউনিস্ট পার্টির সেই সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল না।
    একটি তথ্যে জানা যায়, হিন্দু মহাসভা ও আরএসএসের সংগঠিত হিন্দু সেনা বাহিনী, যারা ব্রিটিশ সেনায় অন্তর্ভূক্তির প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল, ব্রিটিশের পরাজয়ের পর তাদের ব্যবহার করা হয় ১৯৪৬-এ মুসলিম নিধনে।
    আর, পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপোয় বিপুল সংখ্যক হিন্দুকে আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করেছিলেন মুসলিম ট্রাম শ্রমিকরা।
    ইন্দ্রজিত গুপ্ত নিজে ট্রামের ড্রাইভের কেবিনে চড়ে ট্রাম লাইন থেকে লাশ সরিয়ে ট্রাম চালানোয় নেতৃত্ব দেন। ট্রাম চলাচল শুরু হওয়ায় দাঙ্গার প্রভাব কমে।

  2. সময়োপযোগী আলোচনা। বিশেষত, লেখকের বর্ণনায় রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা প্রশংসনীয়।

  3. একটা গুরুত্বপুর্ন বিষয় নিবন্ধটি প্রকাশের মাধ‍্যমে উপস্থাপিত করার জন‍্য ধন্যবাদ। নিবন্ধটি পরে মনে হয়, কংগ্রেস উপায়ান্তর না থাকায় হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক পথ নিয়েছিল। তা ঠিক নয়। বাংলা ভাগের প্রাককালে উত্তরের দিনাজপুর ও গঙ্গানদীর পশ্চিমপারের অনেক জেলার কংগ্রেস কমিটিগুলি লিখিত সিদ্ধান্তমতো দাবি জানিয়েছিল প্রদেশভাগ করতে হবে। সে সমস্ত নথি আমরা জয়া চ‍্যাটার্জির Bengal divided…ও যার বাংলা সংস্করণ বাংলা ভাগ হলো। আমাদের বক্তব্য, বহুযুগ লালিত হিন্দুত্ববাদী মনোভাবের এটা উৎকট প্রকাশ। আরেকটা বিষয় তেভাগা নিয়ে। ১৯৪২ পাজিয়া সম্মেলনে ও তার পরের বছর নলিতাবাড়ি সম্মেলন থেকে তেভাগা নিয়ে আলোচনা হয়। যুদ্ধ, ত্রাণ ইত‍্যাদির জন‍্য তা সংঘটিত হতে পারে নি। ১৯৪৬ সালে নিজের চাপে নয়, কৃষক নেতারা যেহেতু মূলত গ্রামবাসী তাই তারাই বলেন, এবার তেভাগা শুরু করা যাক। ঐ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তেভাগার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। বাংলার গ্রাম বারুদ হয়েইছিল। বিপুল আবেগে লড়াই শুরু হলো। সাম্প্রদায়িক আবহাওয়াকে কোথাও কোথাও তা প্রতিরোধ করলো। যেমন, রংপুরের ডিমলা, ডোমার, নীলফামারী থানা। কিন্তু অনে আগে থেকেই যে এলাকাগুলোতে কৃ:সভার আন্দোলন ও কাজকর্ম ছিল, সেখানে দাঙ্গা কোন দাত ফোটাতে পারে নি। এখানে বলার তখনকার বাংলার উত্তরের কয়েকটি জেলার তেভাগার অগ্রজ আধি আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। আর যশোরে তেভাগা লড়াই ১৯৪৫ সালেই শুরু হয়।

  4. 1) কমিউনিজম এবং ইসলাম উভয়ই হল “Ideology”।
    2) কোন ইসলামিক দেশেই কমিউনিজম বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি বা প্রথমে উপস্থিতি থাকলেও পরে বিলুপ্তির দিকে গেছে।
    3) ইসলামিক Ideology’র স্থাপনার পরে(মাত্রই খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকে) কত দ্রুত সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছিল এবং কি ভাবে করেছিল তা ইতিহাসের একনিষ্ঠ ও নির্মোহ পাঠক মাত্রেই জানেন।
    4) কমিউনিষ্ট Ideology’র আত্মপ্রকাশের পরে ও রাশিয়াতে 2017’র নভেম্বর বিপ্লবের সৌজন্যে তার ফলিত প্রয়োগের সাফল্য হেতু সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তারলাভ ঘটে। যদিও পরবর্তিতে (বিশেষতঃ গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের দরুন) তা অনেকাংশেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
    5) একজন ইসলামিক Ideologyতে বিশ্বাসী ব্যক্তি সর্বদা তাঁর ইসলামিক Identityকেই সর্বোপরি রাখে এবং সংখ্যা বাড়িয়ে নিজেদের Identity’র দাবির সপক্ষে সর্বদা আন্তরিক ভাবে, তথা “যেন তেন প্রকারেণ” চেষ্টা করে চলে।
    6) কমিউনিষ্টদের ক্ষেত্রে তাঁদের Ideology’র অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে সর্বদা “ঐতিহাসিক ভুল” সিদ্ধান্তগুলো গৃহীত হতে থাকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।