সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বাংলার ইতিহাস

ভারতীয় উপমহাদেশের ভাস্কর্য শিল্পে, বিশেষত শৈব ভাস্কর্যগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিগ্রহ হল উমা-মহেশ্বরের মূর্তি। মূর্তিশাস্ত্রের পরিভাষায় উমা-মহেশ্বরের ভাস্কর্যটি হল, দেবী উমা এবং দেবাদিদেব মহাদেবের (মহেশ্বর বা শিব) ঐশ্বরিক দাম্পত্য জীবনের অলোকসামান্য রূপের একটি ক্লাসিক প্রতিচ্ছবি। মৎস্যপুরাণ, ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণুধর্মোত্তর উপপুরাণ, অপরাজিতপৃচ্ছা, রূপমণ্ডন প্রভৃতি শিল্পশাস্ত্রের লিখিত বিধিকে মান্যতা দিয়ে ভারতীয় শিল্পীরা উমা-মহেশ্বরের মূর্তি সৃজনের জন্য অনন্ত যৌবনের অধিকারী এক দম্পতির উষ্ণ আলিঙ্গনকে অপরূপভাবে চিত্রায়িত করেছেন কঠিন প্রস্তর ও ধাতুতে অথবা গুহার কন্দরে-কন্দরে। প্রকৃতপক্ষে উমা-মহেশ্বর ভাস্কর্যের মধ্যে জগৎ-মাতা উমার সাথে বিশ্বপিতা শিবের মিলনের এক অপূর্ব মণিকাঞ্চনযোগ দৃশ্যমান। প্রখ্যাত গবেষক ড. এ.এল. শ্রীবাস্তব এই প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, পুরুষ ও প্রকৃতির এই মিলন ক্রমশ বংশবৃদ্ধির অভিমুখে নিয়ে যায় এবং সৃষ্টির চক্রকে তার সঠিক আবর্তনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।১ সেই কারণে ভারতীয় ঐতিহ্যে উমা এবং শিবকে সার্বজনীন পিতামাতা হিসাবে গণ্য করা হয়, যার অবিস্মরণীয় অভিব্যক্তি ঘটেছে মহাকবি কালিদাসের রঘুবংশম্ নাটকের (১.১) অসামান্য সূচনায়: “জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরৌ।”
মহাস্থানগড়ের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল হল গোবিন্দ ভিটা। পুণ্ড্রনগরের উত্তরদিকের সুরক্ষা প্রাচীরের বাহিরে জাহাজঘাটা থেকে কয়েকশো গজ দূরে এটি অবস্থিত। প্রত্নস্থলটির উত্তর কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে শীর্ণকায়া করতোয়ার একটি ধারা। করতোয়ার ধারাটি এখন শীর্ণকায়া হলেও একসময়ের বিশাল প্রমত্তা এই নদীর বুকে বণিকদের বাণিজ্যতরী বয়ে যেত দূরদেশে। গোবিন্দ ভিটার আরেকটি স্থানীয় নাম ‘গোবিন্দের দ্বীপ’, অর্থাৎ বিষ্ণুর দ্বীপ/আবাসস্থল। মূলত ভূপৃষ্ঠ থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচু নদীতীরবর্তী স্থানকে বরেন্দ্র অঞ্চলে দ্বীপ নামে ডাকা হয়। এই গোবিন্দ ভিটা পুণ্ড্রের ধর্মেতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক গৌরবের একটি বিরাট অধ্যায় ধারণ করে আছে।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে উঠে আসে গঙ্গাঋদ্ধি সভ্যতার কথা। সেই সভ্যতার কেন্দ্র গঙ্গারাজ্যের সঠিক অবস্থান আজও নির্ণীত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার চন্দ্রকেতুগড় এবং বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নস্থান দুটি এক্ষেত্রে খুব উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। গ্রিক দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার পঞ্চনদ অঞ্চলের বিপাশা নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে গঙ্গাঋদ্ধি জাতি বা রাজ্যের শক্তিশালী সামরিক শক্তির কথা শুনে আর না এগিয়ে ফিরে যান। হয়তো আজকের উয়ারী-বটেশ্বরেই ছিল সেই গঙ্গাঋদ্ধি জাতি বা রাজ্যের রাজধানী। উয়ারী-বটেশ্বরের দ্বিস্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষা প্রাচীর, সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত প্রাচীন বসতি, আড়াই হাজার বছর সময়কাল ও পূর্ব ভারতে এর ভৌগোলিক অবস্থান একে গঙ্গারিডি বা গঙ্গাঋদ্ধি বলে শনাক্ত করতে ভূমিকা রাখে।