সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

রাজা দেবপালের সমাধির খোঁজে

রাজা দেবপালের সমাধির খোঁজে

শাহরিয়ার কবির

মে ২০, ২০২৩ ৩৮৮ 1

মহারাজাধিরাজ দেবপাল। পরম পরাক্রমশালী পালবংশের তৃতীয় রাজা। মুঙ্গের তাম্রশাসনে দেবপাল নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে: “সমুদ্রের শুক্তি যেমন মুক্তারত্ন প্রসব করিয়া থাকে, সেইরূপ প্রশংসনীয়া পতিব্রতা সেই রণ্ণাদেবীও প্রসন্নবদন দেবপালদেবকে প্রসব করিয়াছিলেন।”

বাদাল শিলালেখ এর ৫ম শ্লোকে দেবপালদেবের পরাক্রমের পরিচয় পাই: “সেই দর্ভপাণির নীতি-কৌশলে শ্রীদেবপাল [নামক] নৃপতি মতঙ্গজ-মদাভিষিক্ত-শিলা-সংহতিপূর্ণ রেবা [নর্ম্মদা] নদীর জনক [উৎপত্তিস্থান বিন্ধ্যপর্ব্বত] হইতে [আরম্ভ করিয়া] মহেশ-ললাট-শোভি-ইন্দু-কিরণ-শ্বেতায়মান গৌরীজনক [হিমালয়] পর্ব্বত পর্য্যন্ত, সূর্য্যোদয়াস্তকালে অরুণরাগ-রঞ্জিত [উভয়] জল-রাশির আধার পূর্ব্ব-সমুদ্র এবং পশ্চিম-সমুদ্র [মধ্যবর্ত্তী] সমগ্র ভূভাগ কর-প্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।”

সহজ কথায় বলতে গেলে, দেবপালদেব তাঁর মন্ত্রী দর্ভপাণির সুপরামর্শ গ্রহন করায় বিন্ধ্যপর্বত থেকে হিমালয় এবং পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রের মধ্যবর্তী সমগ্র অঞ্চলের অধিপতি হয়ে যান। অপরাপর পরাক্রমশালী রাজন্যদের মতোই দেবপালদেবের শেষ জীবন ও মৃত্যুকালের বিষয়ে ইতিহাস নীরব; যেন ক্ষমতা হাতবদলের সাথে সাথেই তাঁদের কথা আর সেভাবে কেউ মনে রাখেনি। উত্তরসূরীরা তাদের তাম্রশাসনে কেবলমাত্র পূর্বজ রাজন্যদের স্মরণ করেই দায় সেরেছেন। ইতিহাসের পালাবদল এমনই।

                                                                            বাদাল শিলালেখ

দেবপালদেবের সমাধিস্থল

রাজা দেবপালের কথা তাঁর পিতামহ গোপালদেবের মতোই বরেন্দ্রভূমির বুকে অম্লান হয়ে জেগে ছিল হাজারো বছর ধরে। পিতামহ ও পৌত্রের শেষ ঠিকানার মাঝে দূরত্বও মাত্র ২৫ কিলোমিটারের মতো।

বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার আমইড় ইউনিয়নের এক নিভৃত পল্লীতে দেবপালদেবের সমাধিস্থল আজ লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছে। এখানে সমাধিক্ষেত্র বলতে চিতাভস্মের উপর নির্মিত চৈত্য বুঝানো হচ্ছে।

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে নাথধর্মের যে চারটি ধর্মীয় কেন্দ্র রয়েছে, নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার অবস্থিত যোগীর ঘোপা তার মধ্যে অন্যতম। এ ধর্মীয় স্থাপনাটি ঘিরে এখনো বেশ কয়েক ঘর যোগী সম্প্রদায় এখানে বাস করেন। এই যোগীর ঘোপাতে দেবপালদেবের সমাধিস্থল রয়েছে বলে পূর্বতন ঐতিহাসিকগণ মত দিয়েছেন। বিষয়টি যদিও তাঁরা ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে পেয়েছিলেন এবং স্বাভাবিকভাবে কোনো পাথুরে প্রমাণ দিতে পারেননি। সর্বপ্রথম আমরা এ বিষয়ে জানতে পারি স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের ১৮৭৯–৮০ সালের রিপোর্ট থেকে:   The Jabuna Temple stands on a large low mound of bricks ruins, which is said to have been “the house” of Raja Deva Pala, according to Buchanan. But the name given to it by the people is Raja Deva Pala ki Chhatri, which is the usual term of a mausoleum built over the ashes of a person of consequence. I think, therefore, that this must be the place where Raja Deva Pala dies, and where his body was burned.

কানিংহাম স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে শুনে বিষয়টি লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

কানিংহামের রিপোর্টের অনেক বছর শ্রদ্ধেয় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় এ অঞ্চলে পরিভ্রমণ করেন। ইনিও দেবপালের সমাধির বিষয়টি লিপিবদ্ধ করেন: “পাহাড়পুরের চারি ক্রোশ মাত্র দূরে আর একটি “ভিটা” দেখিতে পাওয়া যায়। তথায় এখনও প্রতি বর্ষের বৈশাখ মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে দেবপাল রাজার নামে পূজা হইয়া থাকে। কানিংহামের নিকট লোকে “দেবপাল রাজাকা ছত্রী” বলিয়া এই স্থানের পরিচয় প্রদান করিয়াছিল। তজ্জন্য তিনি তাহাকে দেবপালদেবের চৈত্যাবশেষ, বলিয়াই বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন।“

আমি নিজে যোগীর ঘোপায় গিয়ে দেবপালের সমাধির খোঁজ করি। বর্তমানের যোগী সম্প্রদায়ের মানুষজন এ বিষয়টি অনেকটাই ভুলে গিয়েছে। তবে অনুসন্ধান করে কয়েকটি বিষয় নজরে এলো। যোগীর ঘোপা মন্দিরটি দুটি আলাদা চত্বরে বিভক্ত। সামনের দিকটায় ভগ্ন মন্দির, যোগীদের আবাসস্থল, ধ্যানের জায়গা প্রভৃতি অংশ নিয়ে গঠিত। এ অংশের ঠিক পেছনেই একটি সুউচ্চ বেদীর উপর একটি মন্দির এবং তার সম্মুখভাগে অসংখ্য সমাধি। এ অংশটি পেরিয়ে গেলে পেছনের দিকে জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা ও তারও পেছনে জলাভূমি। দেখে প্রতীয়মান হয় যে, প্রাচীন কোনো মরা নদীর খাত।

সুউচ্চ বেদীর উপর অবস্থিত এ মন্দিরটির গর্ভগৃহে বিগ্রহ রয়েছে, দুটি শিবলিঙ্গ, নানা আভরণে ভূষিত। ঠিক এর সামনের অসংখ্য সমাধি চিন্তার উদ্রেক করে। বর্তমান পুরোহিত মন্টু রাজভর বললেন, সবগুলো প্রাচীন যোগীদের সমাধি। বর্তমান মন্দিরটি সাড়ে তিনশ বছরের বেশি পুরোনো হওয়ার কথা নয়। পুরোনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপরে নতুন মন্দিরটি স্থাপিত। পুরোনো স্থাপত্যের নির্মাণ উপকরণ নতুন মন্দিরে ব্যবহৃত হয়েছে। মন্দিরের সিঁড়িতে পাথরের খণ্ডগুলোর অনিয়মিত ব্যবহার এ ধারণার সমর্থন দেয়। দেবপালের সমাধিটি তাহলে কি অসংখ্য যোগীদের সমাধির ভিড়ে মিশে গিয়েছে? নাকি মন্দিরটির জায়গায় আগে সমাধি ছিল, যেটি অজ্ঞতাবশতঃ পরে মন্দিরে রূপ নিয়েছে। নইলে সম্মুখদিকের মন্দির দালানের পেছনের আঙ্গিনায় সারি সারি সমাধি আর একটিমাত্র মন্দির কেন? ইতিহাসের অমীমাংসিত প্রশ্ন হয়ে থেকে যাবে কি এগুলো? হয়তো তাই।

দেবপাল রাজার বাড়ি

মন্দিরের পুরোহিত ও আশেপাশের মানুষদের সাথে কথা বলে আরেকটি জায়গার সন্ধান পেলাম। যোগীর ঘোপা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে “দেওপাল কা টিকা” বা “দেবপাল রাজার বাড়ি”। কৃষি জমির মাঝে বেশ বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে এই প্রাচীন ঢিবিটি, জঙ্গলাকীর্ণ ও প্রায় অপ্রবেশ্য। বাহির থেকে দেখে ফিরে আসতে হলো। সন্ধ্যাকর নন্দীর “রামচরিত” থেকে জানা যায়, রামপাল কৈবর্তরাজ ভীমকে পরাস্ত করে রামাবতী নগরে রাজধানী (জয়স্কন্ধাবার) স্থাপন করেন। আমইড়ে অবস্থিত অসংখ্য ধ্বংসস্তুপেই মাটিচাপা রয়েছে সেই রামাবতী। এ নিয়ে আগেও লিখেছি। “দেওপাল কা টিকা” নামের ঢিবিটিও আমইড় ইউনিয়নে অবস্থিত। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, রামাবতী নগরী আগেও ছিল, রামপাল সেখানে নতুনকরে জয়স্কন্ধাবার স্থাপন করেছিলেন। যুদ্ধ ও কৈবর্ত বিদ্রোহে পর্যুদস্ত পালরাজের পক্ষে নতুন নগরী স্থাপন করার মতো স্ফীত রাজকোষ ছিল কিনা সে প্রশ্ন থেকে যায়। যদি রামপালের আগেও রামাবতী নগর থেকেই থাকে, সে নগরী দেবপালের সাথে সম্পর্কিত হতে বাধা নেই; কেননা এ অঞ্চলে পালরাজগণ বিপুলসংখ্যক নগরীর পত্তন করেছিলেন।

                                                          সম্ভাব্য রামাবতীর ধ্বংসাবশেষে দেওপাল কা টিকা

এখন দেবপালের সমাধি যোগীর ঘোপায় কেন রয়েছে সে বিষয়ে আলোকপাত করা যায়। পালরাজগণের সাথে সিদ্ধাচার্য, নাথগণ ও বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের নিবিড় যোগাযোগ বিদ্যমান ছিল। বিশেষত সিদ্ধাচার্য চৌরঙ্গীনাথের সাথে দেবপালের সম্পর্ক তিব্বতী গ্রন্থ “চতুরশীতি-সিদ্ধ-প্রবৃত্তি”তে রয়েছে, যার উৎকৃষ্ট বঙ্গানুবাদ করেছেন অলকা চট্টোপাধ্যায়। এ বইয়ে পূর্ব ভারতের রাজা দেবপালের পুত্র হিসেবে চৌরঙ্গীনাথকে অভিহিত করা হয়েছে। বিমাতার ষড়যন্ত্রে ব্যভিচারের অপবাদে দেবপাল চৌরঙ্গীনাথকে হাত-পা কেটে জঙ্গলে নির্বাসিত করেছিলেন। মহাযোগী অচিন্ত্য-এর নির্দেশে গোরক্ষনাথ চৌরঙ্গীনাথের সেবা শুশ্রূষা করেন। পরবর্তীতে সাধনায় সিদ্ধ হয়ে চৌরঙ্গীনাথ তাঁর হাত-পা ফিরে পান। তিব্বতী গ্রন্থের কাহিনিটি অলৌকিক বলে পরিগণিত হয় ইতিহাসবিদদের বিচারে। তবুও যদি সত্যই দেবপালের কোনো পুত্র পিতা দ্বারা নির্বাসিত হয়ে থাকেন এবং পরবর্তীতে সিদ্ধাচার্য হয়ে যান, সেক্ষেত্রে দেবপালের অপত্যস্নেহ কি তাঁকে সিদ্ধাচার্যদের সাথে যোগাযোগ ঘটিয়েছিল? তারই ফলশ্রুতিতে দেহত্যাগের পর দেবপালের চিতাভস্ম যোগীদের সাথে সমাধিস্থ হয়েছিল কি? আরও গভীর অনুসন্ধানই কেবল ইতিহাসের এ সমস্ত অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব দিতে পারে, যদিও সমস্ত বিষয়টি গভীর কুয়াশাচ্ছন্ন।

তথ্যসূত্র:

১. অলকা চট্টোপাধ্যায়, চুরাশি সিদ্ধর কাহিনী, প্যাপিরাস, ২ গণেন্দ্র মিত্র লেন, কলকাতা-৪

২. অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, উত্তরবঙ্গের পুরাকীর্তি, প্রবাসী, কার্তিক ১৩১৫

৩., অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, গৌড়লেখমালা, রাজশাহী বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি থেকে শ্রীসুরেশ্বর বিদ্যাবিনোদ কর্তৃক প্রকাশিত

৪. Alexander Cunningham, Report of a Tour in Bihar and Bengal 1879 – 80, Vol XV

৫. ব্যক্তিগত ক্ষেত্রসমীক্ষা

পেশায় ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট ও এক্সিকিউটিভ কোচ, শাহরিয়ার কবির সাহিত্য ও ইতিহাসের একজন একনিষ্ঠ ছাত্র। বিভিন্ন প্রত্নস্থল ঘুরে দেখতে ভালবাসেন। ইতিহাস চর্চায় তাঁর প্রধান বিষয়বস্তু প্রাচীন যুগ এবং পুণ্ড্র-বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়েই তাঁর প্রধান বিচরণ কেন্দ্র।

মন্তব্য তালিকা - “রাজা দেবপালের সমাধির খোঁজে”

  1. একটা নতুন এবং আগ্রহ উদ্রেককারী বিষয়ে জানতে পারলাম। আপনার ক্ষেত্রসমীক্ষামূলক লেখাগুলো অসাধারণ। বহু অজানা বা ভুলে যাওয়া ইতিহাস উঠে আসে এখানে।
    তবে আমার একটা প্রশ্ন বা সন্দেহ আছে, পাল রাজাদের মূল রাজধানী যা বর্তমান বিহার রাজ‍্যে ছিল সেখান থেকে অতোদূরে দেবপালের মতো পরাক্রমশালী রাজার সমাধি বা স্মৃতিমন্দির তৈরি হলো আর তাঁর রাজধানীর কাছাকাছি কোথাও হলো না?
    চিতাভস্ম নিয়ে গিয়ে ঐ মন্দির তার ওপর বানানো হয়েছিল না কি ওটা আসলে পরে মানে অনেক পরে কোনো বংশধর বানিয়েছিলেন?
    এ ব‍্যাপারে ঠিকঠাক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।