সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

১৯০৫ খৃষ্টাব্দ বা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন

১৯০৫ খৃষ্টাব্দ বা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন

মলয় তেওয়ারী

সেপ্টেম্বর ৫, ২০২১ ৭৯৫ 4

এই আন্দোলনকালে ঘটে যে ঘটনা, নমঃশূদ্র জাতি পক্ষে করিব বর্ণনা

১৯০৫ খৃষ্টাব্দ চির স্মরণীয়। বিশেষত বাঙালীর কাছে, বরণীয়। শুধু বাঙালীর কাছেই নয়, সারা ভারতে সবার কাছেই এই বছরটা মনে রাখার মত। এই বছরই প্রথম ঢেউ উঠেছিল ভারতের জাতীয় জীবনে—মরা গাঙে বান ডেকেছে, জয় মা! বলে ভাসা তরী—গেয়ে উঠেছিল বাঙালী। ধন্য সে ইতিহাস, লেখা আছে সোনার অক্ষরে। সেই বৃত্তান্তই আদ্যোপান্ত বলতে চাই আপনাদের।

সেই সময় ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। লর্ড কার্জন এলেন ব্রিটিশ শাসনকর্তা হয়ে। তিনি বঙ্গভঙ্গের বিধান আনলেন। বাংলার বুকের ওপর বসে তিনি বাংলাকে কেটে দু’টুকরো করলেন। পূর্ব ও পশ্চিম—দু’ভাগে ভাগ করে দিলেন বাংলাকে। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ।

কিন্তু বাঙালী তো এক জাতি। এক দেশ, এক ভাষা, মনে এক আশা। বিভাজনের সর্বনাশ কেন মেনে নেবে বাঙালী? কার এত শক্তি যে, বাঙালীকে বাঙালীর থেকে পৃথক করে? আন্দোলনের ঝড় বয়ে যায়, জেগে ওঠে বাঙালী। সমস্ত বঙ্গ জুড়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় বার্তা। ঘরে ঘরে জনে জনে আলোড়িত। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী অগ্রণী ভূমিকা নিলেন। তাঁর আহ্বানে ব্যাপক সাড়া দিল জাতি। মাতৃ পূজা, মাতৃ ব্রত, মাতৃ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, স্বাধীন জাতি হওয়ার আশায় বুক বেঁধে, মহাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ল সমস্ত বঙ্গবাসী। মাতৃ-পূজার বেদীতলে কত প্রাণ গেল। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল, অরবিন্দ, উল্লাসকর, বারীন—কেউ গেল দ্বীপান্তর, কারও বা ফাঁসি হল। সকলে জগতে খ্যাত হলেন ‘স্বদেশী’ নামে।

ফরিদপুরে বাস, ওকালতি ব্যবসা, অম্বিকাচরণের। তিনিও সামিল আন্দোলনে। তিনি সকলকে সামিল হতে বলেন। বলেন, ‘পিছে পড়ে থাক না’ক কেহ’। প্রকাশ্য ও গোপন—দুরকম কায়দাতেই সংগ্রাম চলে। বোম মেরে লুট করা, টাকা পয়সা কেড়ে নেওয়া, লাটসাহেবের গাড়ির নীচে বোমা রেখে দেওয়া—সবই চলতে থাকে। ক্ষুদিরামকে ফাঁসিকাঠে যেতে হয় এরকমই এক ঘটনায়। আলিপুর-বোমা-কেস বিখ্যাত। এই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এই মামলায় স্বদেশীদের পক্ষে আদালতে উকিল হিসেবে সওয়াল করে বাকপটুতার অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করেন। অরবিন্দ সহ কয়েকজনের ফাঁসি রদ হয়ে দ্বীপান্তর হয়।

এইভাবে কয়েক বছর ধরে আন্দোলন চলার পর ব্রিটেনের রাজ দরবারে খবর পৌঁছায়। শ্রী পঞ্চম জর্জ তখন রাজা হয়েছেন। তাঁর নির্দেশে দিল্লিতে দরবার বসে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দুই বাংলা আবার জোরা লাগে।

রাজদ্রোহ করে কত মানুষ শাস্তি পেল। রাজার সহযোগিতা করায় কত লোক পুরস্কার পেল। কত মানুষ পূজ্য হল। এইসব স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়। এই আন্দোলনের সময় যেসব ঘটনা ঘটেছিল সেইসব ঘটনার বর্ণনা নমঃশূদ্র জাতির পক্ষ থেকে আপনাদের শোনাব।

অম্বিকাচরণের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ফরিদপুর জেলায় সকলে তাঁকে নেতা বলে মান্যগণ্য করে। তিনি নমঃশূদ্রদের চেনেন। জানেন যে নমঃশূদ্র জাতি যথেষ্ট শক্তিশালী। মনে মনে তিনি ভাবেন, এদের যদি আন্দোলনে নামানো যেত তাহলে বাহিনী হিসেবে কাজে লাগত, বিদ্রোহ মহাবলে বলীয়ান হয়ে উঠত। নমঃশূদ্রদের আন্দোলনে ভিড়িয়ে দিতে তিনি সক্রিয় হয়ে উঠলেন। বিভিন্ন মানুষের সাথে আলোচনা করে ক্রমে তিনি জানতে পারেন যে, নমঃশূদ্রদের সর্বোচ্চ নেতা হলেন গুরুচাঁদ নামে এক ব্যক্তি। গুরুচাঁদ সম্পর্কে জানলেন তিনি। জানলেন যে গুরুচাঁদ সায় দিলে তবেই নমঃশূদ্র জাতি সায় দেবে। তাঁর সাথে বসে কথা বলে নিলেই হবে। কিন্তু কীভাবে কথা বলবেন, তাঁর সাথে তো আলাপ পরিচয় নাই। ওড়াকান্দী গ্রামে থাকেন গুরুচাঁদ, সেখানে যেতে হবে। ওড়াকান্দীর নিকটস্থ ঘৃতকান্দী গ্রামের কায়স্থ ও ব্রাহ্মণদের সাথে যোগাযোগ করেন তিনি। ঠিক হয় ওখানেই একটি সভার আয়োজন করে নমঃশূদ্রদের ডেকে নেওয়া যাবে। সেই মত সভা হয়। নমঃশূদ্রদের ডেকে এনে অনেক কিছু বোঝান হয়।

দেশমাতা স্বর্গের থেকেও গরীয়ান। দেশমাতার জন্য অনায়াসে প্রাণ দেওয়া যায়। প্রাণ দিয়ে মাতৃসেবা না করলে সে, শাস্ত্রমতে, কুলাঙ্গার হিসেবে চিহ্নিত হবে। তাই সকলে এক ভাব, এক মতে এক হও, সকলে একই কথা কও। বহুক্ষণ ধরে এইসব কথা সবিস্তারে বক্তৃতা করলেন অম্বিকাচরণ। ভাষণ শুনে সকলে মোহিত হল। সবাই বলতে লাগল, আমরা সবাই স্বদেশী হব। অম্বিকাচরণ উল্লসিত হলেন। তিনি নমঃশূদ্রদের ডেকে বললেন, “হে নমঃশূদ্র ভাইয়েরা, আমি জানি এই দেশে তোমাদের নেতা ওড়াকান্দীর গুরুচাঁদ। তাঁর অসীম ক্ষমতা। আমার দেরী করার উপায় নাই, বাড়ি ফিরতে হবে। কিছুদিন পর আবার আসব। তত দিন সকলে মিলে কাজ কর। ওড়াকান্দী গিয়ে সবাই মিলে গুরুচাঁদকে ধর। তাঁকে জানাও কেন তোমরা স্বদেশী হলে। তোমরা বললে তিনি বুঝতে পারবেন এবং তিনিও স্বদেশী সাজবেন”।

অম্বিকাচরণ চলে গেলেন। নমঃশূদ্রগণ হাতে পতাকা নিয়ে স্বদেশী গান গাইতে গাইতে দলে দলে এসে হাজির হল ওড়াকান্দীতে গুরুচাঁদের বাড়ি।

বিস্তৃত উঠোনের শেষে ঘর। গুরুচাঁদ তাঁর আসনে বসে আছেন। হেনকালে মহাকলরব শুনতে পেলেন। কয়েক হাজার মানুষ। গুরুচাঁদ জিজ্ঞাসা করলেন, এ কিসের শব্দ? বলতে বলতে সবাই উঠোনে এসে হাজির। গুরুচাঁদ জোরে হেঁকে বললেন, “গণ্ডগোল থামাও”। বজ্রধ্বনির মত সে আওয়াজে জনতা মুহূর্তে স্তব্ধ হল, মাস্টার শ্রেণীকক্ষে ঢুকে হুঙ্কার ছাড়তেই পোড়োদের কলরব যেমন নিমেষে থেমে যায়। ক্রুদ্ধ ভঙ্গীতে তিনি বললেন, “তোমরা কারা বাপু! কী চাও তোমরা! আমার উঠোনে এসে চীৎকার করছ কী কারণে? তোমাদের হাতে নিশান দেখছি! নিশান তো ভালো। দলে দলে গান গেয়ে কী বলতে চাইছ বল।” গুরুচাঁদের ক্রুদ্ধভঙ্গীতে সকলে আড়ষ্ট, কেউ কথা বলেনা। কিছুটা শান্ত ভঙ্গীতে গুরুচাঁদ বলেন, “বুঝেছি। তোমরা সবাই স্বদেশী সেজেছ। স্বদেশী সেজেছ সে তো ভালো কথা। কিন্তু আমি তো বিদেশী। স্বদেশীর সাথে আমার মিশামিশি নাই। বিদেশীর কাছে কেন এসেছ? তোমরা সবাই স্বদেশী হও, আমি বরং পিছিয়েই থাকি। বাপু, বল তো, দেশ কাকে বলে? মাটি না মানুষ? এবিষয়ে হুঁশ আছে কি? সব বাক্যবীরেরা এখানে আসে আর চোখের নিমেষে লক্ষ কথা বলে যায়। সরল সাদাসিধা মানুষ অত গভীরে বোঝে না, যে যা বলে তাই শুনে মজে যায়। যা শোনে তাকেই ভালো ভাবে। এভাবেই তো চিরটা জনম কেটে গেল। মনে কি একবার ভেবেও দেখ না, এই জাতির এরকম হীন অবস্থা কেন? হায় রে! শত্রু মিত্র চেন না তোমরা? ‘দেশ’ ‘দেশ’ বলে আজ যারা হাজির হচ্ছে তারাই কি তাদের সুদিনে আমাদের কেবল ঘৃণাই করে নি! আজ ওরা কেন আসছে বুঝতে পারছ না! ওরা নিজেদের স্বার্থটা ভালো বোঝে। নিজেদের স্বার্থের খাতিরেই ওরা তোমাদের কাছে এসেছে। শিক্ষিত বিদ্বান সব ধনী জমিদার, ‘স্বদেশী’ ‘স্বদেশী’ বলে করে চিৎকার। আমি বাপু অশিক্ষিত। আমার অর্থকড়িও নাই। আমি তাই স্বদেশীর অর্থ কিছু বুঝি না। আমাদের শশী লেখাপড়া করেছে। তোমরা বরং তার কাছে যাও। আমি যে বিদেশী তা আমি মনে মনে জানি। এদেশে শুধুমাত্র বাবার কারণে এসেছি। দেশ যে এত বড় দাবা তা আগে জানতাম না। এসে পড়েছি, এখন বেকুবের মত তার জের টেনে চলেছি। যাও, দেখ শশী কোথায় আছে, শশীকে গিয়ে বল সব কথা”।

অন্তরাল থেকে গুরুচাঁদের পুত্র শশীভূষণ বেরিয়ে এসে ইঙ্গিতে সকলকে সাইডে ডেকে নেয়। বাইরে জমির ওপর গিয়ে জমা হয় সবাই। সবাই শশীকে ঘিরে ধরে দাঁড়ায়। সবাই তার কাছে মন খুলে কথা বলতে চায়। তারা বলে যে, গুরুচাঁদের কাছে সব কথা খুলে বলার সাহস তাঁদের নেই। কিন্তু অম্বিকাচরণ যা বলেছে তাতে তো মনে হয় স্বদেশীতে মরণ হলেও তা ভাল। বেঁচে থেকেই বা কী লাভ হচ্ছে। স্বদেশী রাজত্ব হলে আর দুঃখ থাকবে না। ভালো হবে মনে হয়েছে বলেই তো স্বদেশী সেজেছি। ভালো মন্দ বুঝতে জানতেই তো এসেছি এখানে। কর্ত্তাকে না জানিয়ে তো কিছু করি না আমরা। ঠিক ভুল যা করি তাঁকে জানিয়েই করি। তিনি ছাড়া আর বন্ধু কেউ তো নাই। তুমি এবার বোঝাও আমাদের। আমরা শুনি, তারপর যা ভালো বুঝব করব। স্বদেশীরা তো স্বার্থহীনভাবে কাজ করে চলেছে। ধন মান অর্থ ত্যাগ করছে দেশের জন্য। তারা তো মহৎ প্রাণ, উদার। আমাদের সাথে বসে জলপান করে। কর্ত্তার কথায় মনে সন্দেহ জাগছে। বড় কাজ করে কেউ কি ছোট হয়! আমরা জ্ঞানহীন, অত বুঝি না। তাই কর্ত্তার কাছে এসেছি। হরিচাঁদের পুত্র গুরুচাঁদকে আমরা মান্য করি, তিনি যে পথে চলবেন আমরাও সেই পথে চলব। কিন্তু স্বদেশীরা আমাদের মনপ্রাণ হরণ করেছে। আমাদের মন উতলা করেছে ওরা। তাই ওরা যেরকম বলেছে সেরকম করেছি। ভেবেছি স্বদেশীর কাজ কত না ভালো। কাস্তে ফেলে ওদের নিশান ধরে কর্ত্তার কাছে ছুটে এসেছি যাতে তিনিও তাই করেন। কিন্তু তাঁর ক্রোধ দেখে আমাদের সেই উল্লাস আর নাই। আমরা যেন আকুল পাথারে পড়েছি। এক ঢেউয়ের ধাক্কায় একদিকে যাই, আবার অন্যদিক থেকে ঢেউ এসে উল্টোদিকে ছিটকে দেয়। একবার মনে হয় স্বদেশীরা মধুর কথা বলেছে। আবার মনে হয় কর্ত্তাই তো ঠিক বলছে। দোটানায় কুল না পেয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা। আপনিই এদেশে আদি শিক্ষাগুরু, আপনি সুযুক্তি দিয়ে বলুন আমরা কী করব। আপনি যা বলবেন তাই করব।

শ্রীশশীভূষণ বললেন, বেশ, তাহলে বন্ধুরা সকলে স্থিরচিত্ত হয়ে শোন স্বদেশীতে ভালো হবে না মন্দ। দেশ তো কেবল মাটি নয়, দেশ মানে দেশবাসী। যে কাজে দেশের সকলে সুখে থাকে সেই কাজই শ্রেষ্ঠ দেশ সেবা। পুঁজিবাদী স্বার্থরক্ষাকারি কোনও দল নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। দেশের গরিবদুঃখী মানুষের দিকে তারা কোন দিন চেয়েও দেখে না। নিজেরা বিপদে পড়লে তখন দরদী সেজে আসে। গরিবগুর্বো মানুষেরা দরদ দেখে ভুলে যায়। একে তো শিক্ষার সাথে এইসব গরিব মানুষের কোনও সম্পর্ক নাই, তাতে দারিদ্র্যের বোঝা বইতে বইতে মেরুদণ্ডও বেঁকে গেছে। চিরকাল যারা কেবল লাঞ্ছনাই পেয়ে এসেছে, তারা ক্ষণিকের মিষ্টি কথায় সন্তুষ্ট হয়ে যায়। জীবনে কোনওদিন সুখের মুখ দেখেনি যারা, তারা একটু মধুর কথা শুনলেই গলে যায়, বক্তার পদপ্রান্তে ঢলে পড়ে। স্বদেশী আন্দোলনেরও এটাই সার কথা। নিজেদের বিপদের সময় ভালো ভালো কথা বলবে, বিপদ কেটে গেলে সব ভুলে যাবে। উচিৎ কথা শুনতে কটু লাগতে পারে, কিন্তু সত্য কথা হল শিক্ষিতরা তোষামোদবাক্যে বিশেষ পটু। বিপদের সময় চাটুকারি করে, গরিবরা মরে, আর ওরা মাহাকীর্ত্তি লাভ করে।

শশীর কথায় সকলে যেন সম্বিত ফিরে পায়। গুরুচাঁদের নামে জয়ধ্বনি দেয়। নীরবে গিয়ে গুরুচাঁদের কাছে বসে। গুরুচাঁদ হেসে বলেন, ‘কিগো, স্বদেশীরা, শশী তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছে তো?’ নমঃশূদ্র প্রধানেরা করজোড়ে বলেন যে তাঁরা মিষ্টি কথা শুনে ভুল করেছিল। গুরুচাঁদ তখন তাঁদের বলেন অকারণে হুড়াহুড়ি না করতে। পাঠ্যপুস্তকের ঈগল ও কাকের নীতিগল্প শুনিয়ে নিজের সাধ্য বুঝে কাজ করার নীতিশিক্ষা দেন। সকলের পক্ষে সব কাজ ঠিক নয়। যারা দেশ চেনে, দেশের খবর জানে তারা স্বদেশী সাজুক গিয়ে। আমাদের তো ঘরে অন্ন নাই, দেনার দায়ে চিরটা কাল অবসন্ন আমরা। দেশ ভাগ হল না জুড়ল তাতে আমাদের কী? ভাগ হোক বা জুড়ে যাক তাতে আমাদের কপালে তো ঘি নাই। শশী নিশ্চয় এসব বলেছে তোমাদের। আমি আরও কিছু কথা বলি শোন।

দরিদ্র ও ধনীতে কি বন্ধুত্ব ভাব হয়? এক সঙ্গে এই দুজন পথ চললে ধনী সর্বদা তার বোঝা দরিদ্রের মাথায় চাপিয়ে দেয়। তাকে কেবল বোঝা বইবার জন্য সাথে নিয়ে চলে। দায়ে পড়ে গরিবকে তোষামোদ করছে। দায় চুকে গেলে আবার তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ আমোদ করবে। দীন জনের পরিতোষও ওদের উপহাস। ধনী কখনও দরিদ্র-বন্ধু হয় না। সমানে সমানে ঐক্য হয়, বৈষম্যে সখ্য হয় না। আমরা দরিদ্র কাঙ্গাল জাতি, আমাদের বন্ধু কেউ নাই, রাজার বিরুদ্ধে কেন যাব আমরা। দেশ-মাতা দেশ-মাতা বলে যারা দলে দলে গ্রামে গ্রামে আসছে তাদের কি এতদিন পরে মনে পড়ল আমাদের কথা। গ্রামে তো ওদেরও কিছু আত্মীয় স্বজন আছে, সেখানে এসে মহাসুখে রাজভোগ খায় যখন, তখন তো কই কাঙ্গালের মুখ মনে পড়ে না একবারও। হঠাৎ এখন দরদ উথলে উঠেছে কেন? দায়ে পড়ে এই যে এখন গাঁয়েগঞ্জে হাঁটাহাঁটি করে বেড়াচ্ছে, এই ভাব খাঁটি হওয়ার সম্ভাবনা নাই। স্বার্থের ব্যাঘাত কিছু ঘটেছে নিশ্চয়, তাই এখন ওদের গাঁয়ে যাতায়াত। বিদ্যা, জ্ঞান, ধন, মান, জমিদারী, মহাজনী—অতুল বৈভব ওদের। ধন মান যেদিন হবে আমাদের সেদিন আমরাও দেশ সেবা করব। বিশেষত ইংরেজ রাজা সাম্যের সাধক, তাদের বিচারে সবাই সমান। তার ফলে আমরা টিকে আছি, নইলে এদেশে বেঁচে থাকতেই কি পারতাম? যারা দেশ দেশ করে বাড়াচ্ছে তারা সব দেশেই মান্যতা পায়, আর আমাদেরকে দেশের কেউ বলেই গণ্য করে না। এই যে জমিদাররা এত অত্যাচার করে, কেউ কি কখনও তাদের বাধা দিয়েছে? ব্রাহ্মণ কায়স্থরা যে ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না’ বলে অবমাননা করে, কেউ কি তাদের হৃদয় প্রশস্ত করার জন্য কিছু করেছে? আমাদের তো ওরা পশুর থেকেও অধম মনে করে। সত্যিই ওরা যদি আমাদের ভাই, তাহলে এসব করে কী করে? তাই বলি, স্বদেশীতে কাজ নাই। তা সে দেশে আমাদের ঠাঁই হোক বা না হোক। যেদিন বুঝব সত্যিই আমাদের দেশ, সেদিন প্রাণ দিয়ে দেশের দুঃখ ঘোচাব।

শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর এরপর উপস্থিত সকলকে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে বলেন। বলেন যে মানুষের প্রতি এরকম হীন-দৃষ্টি সমাজে বেশীদিন চলতে পারে না। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর এক অমোঘ অব্যর্থ শক্তি দিয়ে গেছেন। বেশি নয়, পঞ্চাশ বছরের মধ্যে জগতে পতিত-পরাণী জাগবে, সাম্য মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হবে।

শেষে গুরুচাঁদ বলেন, স্বদেশীর মূল গুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। অম্বিকাচরণ তার শিষ্য। সেই সুরেন্দ্র ব্যানার্জি স্বয়ং তাঁকে চিঠি লিখে আবেদন জানিয়েছেন নমঃশূদ্রদের স্বদেশীতে মাতা’বার জন্য। তিনি সেই চিঠির উত্তরও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শশী লিখেছে। চিঠিতে তিনি উত্তর দিয়েছেন, এ-জাতি অতি দরিদ্র। বিলাস ব্যাসন তাদের ঘরে কিছু নাই। বিলাতি দ্রব্য বলতে তারা ওই কাপড়টুকুই কেনেন মাত্র। ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য শিক্ষিতরা তো বিলাতী ভাবে মত্ত। বস্ত্র, অস্ত্র, শাস্ত্র, তেল, জল, ফল, চুড়ি, ছুরি—কী না কেনে তারা। এ-জাতির তো ওসবের বালাই নাই। স্বদেশী সাজতে হলে ওরা সাজুক, দেশে ওরা পাঞ্চজন্য-শঙ্খ বাজালে বাজাক। কিন্তু বঙ্গদেশে যত নিপীড়িত জাতি আছে, চিরদিন দারিদ্রে দিন কাটে যাদের, তাদের তো রাষ্ট্রক্ষেত্রে কোনও অধিকারই নাই। সব অধিকার উচ্চবর্ণদের। এযাবৎ কালে কোনওদিনই তো উচ্চবর্ণরা অনুন্নত জনতাকে ভ্রাতৃভাবে দেখেনি। সকলকে দাস বানিয়ে পিছনে রেখেছে। তাই এইসব মানুষের মনে ঘোর অবিশ্বাস। আজ অতটা অন্ধও নয় তারা। মনের অন্ধকার কিছুটা হলেও কেটেছে। যদি সত্যিই উচ্চবর্ণরা তাদের চায় তাহলে একটাই উপায় আছে। কেবল মুখে নয়, কাজেও তাদের সমান হিসাবে দিতে হবে। সম্পদ বিপদ সুখ সমভাবে ভাগ করে দিতে হবে। এই কাজ যদি সর্বাগ্রে করা যায় তাহলে হবে, নচেৎ ব্যর্থ হবে সব আন্দোলন।

ইতি, মহানন্দ হালদার প্রণীত ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’ গ্রন্থের ‘১৯০৫ খৃষ্টাব্দ বা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন’ পদ্যস্তবকের ঈষৎ সংক্ষিপ্ত গদ্যানুবাদ। গদ্যানুবাদ: মলয় তেওয়ারি, এপ্রিল ২০২১, কলকাতা।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। গবেষণা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এ। বর্তমানে সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী। ‘আজকের দেশব্রতী’ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য। বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের নানা বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন।

মন্তব্য তালিকা - “১৯০৫ খৃষ্টাব্দ বা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন”

  1. যেমন গুরুত্বপূর্ণ মূল রচনা, তেমনই সুললিত গদ্য রূপান্তর। মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের ‘অপমানিত’ কবিতা। মলয়ের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।