সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

অবিভক্ত বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন ও বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ — যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম

অবিভক্ত বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন ও বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ — যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম

বিজয়া গোস্বামী

সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১ ৯০৯ 4

ভারতের স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে—বিশেষত শিক্ষার উপরে তার প্রভাব নিয়ে অনেক কিছু লিখেছেন বহু জ্ঞানী গুণী। আমি একটি বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্ভব কেমন করে স্বদেশী যুগের প্রভাবে হল, সে বিষয়ে দু চার কথা বলতে উদ্যোগী হয়েছি। এই ধৃষ্টতা যে ঐতিহসিক না হয়েও আমি করেছি, তার কারণ হল, এর জন্মসূত্র থেকে এর সঙ্গে আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগ। সেই পরিবার হল অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহের আচার্য্য পরিবার। তিন পুরুষ ধরে এই পরিবারের সদস্য বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ এবং পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে প্রত্যক্ষভাবে ব্রতী হয়েছিলেন—বর্তমান প্রজন্মেও আমরা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছি।

বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বা The National Council of Education, Bengal নামক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল বিশেষ এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতে। ব্রিটিশ শাসনের দীর্ঘ কালের নানা অবিচার অত্যাচার উৎপীড়নে সারা দেশ যেন একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় এসে পড়েছিল। স্বাধীনভাবে চিন্তা করা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, শুধু নিজের নয়, সমগ্র দেশবাসীর মঙ্গলামঙ্গল বিবেচনা করা, এগুলির যেন কোনো স্থান ছিল না। কিন্তু এটাই ভুল ধারণা। মানুষ জেগেই ছিল, কিন্তু মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছিল না! তাই একদিন দেখা গেল, দেশ যেন হঠাৎ জেগে উঠল, কিন্তু এই জাগরণ আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার সংযোগ, যুক্তিবাদ, চিন্তার মুক্তি, নিজস্বতা বজায় রাখার আন্তরিক কামনা—এই ভাবধারা নতুন যুগের উন্মেষ ঘটিয়েছিল। চিন্তার মুক্তি থেকে অবিচ্ছিন্নভাবে ছিল রাজনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। এই সব ভাবনার পরিণতি ঘটল শিক্ষার মুক্তির বাসনায়। শুধুমাত্র ব্রিটিশ সরকারের অন্নদাস সেবক তৈরি করার জন্য যে শিক্ষা নয়, শিক্ষার যে বৃহত্তর ব্যাপকতর ভূমিকা আছে, দেশনেতারা সেটি ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, এবং দেশবাসীদের মধ্যে যে স্বাতন্ত্র‍্যের কথা, মুক্তির কথা তাঁরা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তা নিষ্ফলা হয় নি। সারাদেশে গড়ে উঠেছিল একতাবদ্ধ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক জাতীয় আন্দোলন। তার পরের ঘটনা সবাই জানেন। 

১৯শ শতাব্দীর শেষভাগে এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় শিক্ষার ভাবনা দানা বাঁধছিল। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮৬৫-১৯৪৮)। তাঁরই উদ্যোগে The Dawn Society তৈরি হয় ১৯০২ সালে। সতীশচন্দ্র ছিলেন তার সম্পাদক। এই প্রতিষ্ঠান থেকে জাতীয় ঐতিহ্য, জাতীয় স্বার্থ এবং শাশ্বত শিক্ষাবিষয়ক মূল্যবোধ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে অধিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। এই সোসাইটি যে শুধুমাত্র ভাববাদী জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় কাল কাটাত তা নয়। বিশুদ্ধ জ্ঞান, নিঃস্বার্থ জনসেবা, উন্নত চরিত্র গড়ে তোলা এবং মাতৃভূমির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার যে ধর্ম তা ছাত্রদের শিক্ষা দেবার জন্য সবরকম সক্রিয় চেষ্টা এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছিল। এই উদ্দেশ্যে ছাত্রদের সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি নিয়ে পঠন পাঠনে যুক্ত করা হয়। 

এই সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। দেশের মানুষ স্বদেশী চেতনায় উদবুদ্ধ হয়ে উঠছে। আগুনের একটি ফুলকি থেকেই দাউ দাউ করে দাবানল জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় আছে। সেই সন্ধিকালে সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যোগালেন তৎকালীন ভাইসরয়, লর্ড কার্জন! তিনি বাংলাকে দুভাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন—একভাগে হিন্দু, অন্যভাগে মুসলমান ! সাধারণভাবে ভারতবাসী এবং এখানে বিশেষত বঙ্গবাসী এই বিভেদসৃষ্টির অত্যাচার মেনে নেয় নি। সারা দেশ গর্জন করে উঠেছিল। জাতীয় আত্মসম্মানে এই আঘাতে স্বদেশী আন্দোলন বিশেষভাবে গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ যা কিছু পণ্যদ্রব্য, সবকিছু পরিহার বা ‘বয়কট’ করার ডাক দেন নেতৃবৃন্দ। সব পণ্যদ্রব্যের সঙ্গে ব্রিটিশ শিক্ষাও পরিহার করার প্রস্তাব আসে। অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি, যেখানে শুধু ব্রিটিশ সরকারের দাসই গড়া হয়, সেই সব প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে নতুন কিছু জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রবল উদ্যম দেখা যায়। সে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা জাতীয় ভাবনায় ভাবিত হবে, এই ছিল নেতাদের লক্ষ্য। এই বিষয়টি এখন  আর বিচার- বিতর্ক, আলাপ-আলোচনার পর্যায়ে রইল না, বাস্তবে রূপায়িত হবার পথেই গেল। The Dawn Society থেকে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্ভব এই বিবর্তনের ফল। পরিষদ গঠনের পর সোসাইটি পরিষদের মধ্যেই লীন হয়ে গেল, তার আর পৃথক অস্তিত্ব রইল না। দার্শনিকের পরিবর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে এলেন কর্মবীর।

এই বয়কটের ডাক সারা দেশ জুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায়। বিশেষত ছাত্র-যুব সম্প্রদায় জাতীয় ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে দলে দলে সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসেন। সরকার নানা দমনমূলক প্রক্রিয়ায় এঁদের আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করেও বিফল হন। বরং এই দমনের ফলে আগুন আরও প্রবলভাবে ছড়াতে থাকে। ব্যারিস্টার স্যার আশুতোষ চৌধুরী বাংলার সমস্ত চিন্তাশীল মানুষের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে তাঁদের একটি সাধারণ সভায় মিলিত হবার আমন্ত্রণ জানান। এই সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৬ই নভেম্বর, ১৯০৫, Bengal Landholders’ Association এর পার্ক স্ট্রীটের সভাঘরে। বাংলার বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি ও সমাজ সচেতন মানুষেরা এই সভায় যোগ দেন। এই সভায় সাব্যস্ত হয় যে একটি জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হবে, যার পরিচালনায় সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা এবং বিশেষত প্রযুক্তিবিষয়ক পাঠক্রম প্রস্তুত  করা হবে, জাতীয় ভাবনায় ভাবিত হয়ে। এ বিষয়ে অবিলম্বেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, সেই সব কাজের ধারা কি হবে, তা স্থির করতে একটি প্রভিশনাল কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্য যাঁরা ছিলেন তাঁদের সেযুগের সমাজে জ্যোতিষ্ক বললে ভুল হবে না। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ডা রাসবিহারী ঘোষ, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, তারকনাথ পালিত, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, রাজা পিয়ারীমোহন মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র মল্লিক, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ডা আর জি কর, বিপিনচন্দ্র পাল পরমুখ। সিদ্ধান্ত হয় যে এই কমিটি তিন সপ্তাহের মধ্যে কার্যপদ্ধতি নিয়ে রিপোর্ট জমা দেবে। শুরুতেই বলেছি, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগ প্রথম থেকেই। এই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী—আমার বাবার মাতামহ। এই সভায় ট্রাস্টি হিসাবে নাম ছিল রাজা পিয়ারীমোহন মুখোপাধ্যায়, তারকনাথ পালিত, সুবোধচন্দ্র মল্লিক, গণেশচন্দ্র চন্দ্র এবং কালীনাথ মিত্রের।

৯ই নভেম্বর একটি বিশাল জনসভা হয় অন্তত ১৫০০০ মানুষের—এঁদের অধিকাংশই ছাত্র। এই সভা হয় কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে ফিল্ড এন্ড একাডেমি ক্লাবের মাঠে (পান্তির মাঠ)—যেখানে পরে বিদ্যাসাগর কলেজের হস্টেল হয়েছিল। পূর্বসভার প্রস্তাব এখানে সাগ্রহে অনুমোদিত হয়। এই সভাতে সুবোধচন্দ্র মল্লিক ঘোষণা করেন, তিনি জাতীয় শিক্ষা পরিষদকে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য এক লাখ টাকা দান করবেন। এই ঘোষণায় ছাত্রেরা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং এই দানবীরকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁর গাড়ির ঘোড়া খুলে নিয়ে নিজেরাই তাঁর গাড়ি ওয়েলিংটন স্কোয়ারে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। সাধারণের  ভালোবাসার ও শ্রদ্ধার দান এই ‘রাজা’ উপাধি চিরদিনের মতোই তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ! এর পরে ময়মনসিংহের গৌরীপুরের ভূম্যধিকারী ব্রজেন্দ্রনাথ রায়চোধুরী ৫ লাখ টাকা এই কাজের জন্য দান করেন, এবং ময়মনসিংহের মহারাজা সূর্য্যকান্ত আচার্য্য (আমার প্রপিতামহ) আড়াই লাখ টাকা দান করেন। 

প্রভিশনাল কমিটি প্রভূত পর্যালোচনার পর একটি প্রভিশনাল স্কীম তৈরি করেন। ১০ই ডিসেম্বর সভার সামনে এই স্কীম পেশ করা হয়। সেখানে এই স্কীম অনুযায়ী কাজ করতে হলে যে সব পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে তা ঠিক করতে একটি Committee of Ways and Means গঠন করা হয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে এই কমিটি প্রায় প্রত্যহ একত্র হয় আলোচনার ফলে যে রিপোর্ট তৈরি হয়, তা পেশ করা হয় প্রভিশনাল কমিটির কাছে। ১৯০৬ সালের ১১ই মার্চ এই রিপোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, বেঙ্গল ল্যাণ্ডহোল্ডার্স এসোসিয়েশনের সভাকক্ষে। এটিই ছিল সভার তৃতীয় এবং অন্তিম অধিবেশন। এই দিনেই National Council of Education, Bengal অথবা বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের জন্ম হয়। এই দিনটি তাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর একটি সংক্ষিপ্ত ও ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে উদ্‌যাপন করা হত। অবশ্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে কি হয় আমার ঠিক জানা নেই। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, স্বদেশী আন্দোলনের এটিই প্রথম মহান গঠনমূলক প্রচেষ্টা , দেশের রাজনৈতিক গুরুত্ব লাঘব করার উদ্দেশ্যে দেশভাগ রূপ প্রয়াসের প্রথম ফলশ্রুতি এবং স্বদেশী ভাবনার প্রথম সন্তান। তিনি স্পষ্টই বলেন, এভাবেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত গভীর ভাবে ও ব্যাপক ভাবে গঠিত হল। 

সেযুগে বাংলার যত মনীষী সবাই এই পরিষদের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। ১লা জুন, ১৯০৬, এই পরিষদকে রেজিস্টার করা হয় (Act XXI of 1906 অনুযায়ী)। পরবর্তীকালে এই পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেবে, এই পরিকল্পনা করেই এর পাঠক্রম নির্দিষ্ট হয়। পরিষদের প্রথম পরিচালনা সমিতিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন – রাসবিহারী ঘোষ (সভাপতি), ডা. পি কে রায় ( সহ সভাপতি), রায় যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী (কোষাধ্যক্ষ), আশুতোষ চৌধুরী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, আব্‌দুল রসুল, দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী, ডা. নীলরতন সরকার, অরবিন্দ ঘোষ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, মনোমোহন ভট্টাচার্য, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। 

এই প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক জাতীয় স্কুল গড়ে ওঠে। সেগুলি সম্বন্ধে এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত বলছি না। তবে কলকাতায় স্কুল এবং কলেজ দুইয়েরই সমন্বয় ছিল। এই পাঠক্রমের তিনটি ভাগ ছিল – ১। সাহিত্যমূলক, যার মধ্যে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি উপাদান অন্তর্ভুক্ত ছিল; ২। বিজ্ঞানমূলক, যার মধ্যে ছিল অঙ্ক, ভৌতবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি ; এবং ৩। প্রযুক্তিমূলক, যেখানে হাতে কলমে বিদ্যাচর্চা এবং চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতি পেশাগত শিক্ষার সুযোগ ছিল। পাঠ্যক্রমের স্তরও ছিল তিনটি—প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজিয়েট, যথাক্রমে ৬—৯ বছরের, ৯—১৬ বছরের এবং ১৬—২০ বছরের ছাত্রদের জন্য। 

পাঠক্রম নিয়ে পরিষদের প্রধান নেতৃবৃন্দের মধ্যে এক সময়ে বিবাদ দেখা দেয়। মনীষীদের মধ্যে এক অংশ মনে করতেন এই পাঠক্রমে প্রযুক্তির দিকটা অবহেলিত হবে, এবং এই ধরণের জাতীয় প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিকেই গুরুত্ব দেওয়া অবশ্যকর্তব্য। স্যার তারকনাথ পালিত, ডা. নীলরতন সরকার, রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও ভূপেন্দ্রনাথ বসু বিশেষ করে এই মতের সপক্ষে ছিলেন। অপর পক্ষ মনে করতেন, সব রকম শিক্ষাই সমান মান্যতা পাওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত তারকনাথ পালিতের উদ্যোগে তাঁর বাড়িতে ৯২ নং আপার সার্কুলার রোডে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে স্থায়ী কোনো তিক্ততা সৃষ্টি হয়নি, বিভেদও হয়নি। ১৯০৬ সালের অগাস্ট বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এবং পরিষদ একত্র কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৪ই অগাস্ট টাউন হলে একটি সাধারণ সভায় বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫ই অগাস্ট এই প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে, ১৯১/১ বৌবাজার স্ট্রীটে। অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন এর প্রথম অধ্যক্ষ, এবং সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন সুপারিনটেনডেন্ট। চারটি বিভাগ নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান শুরু হয়—সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিক পাঠ্যক্রম। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানের অর্থাভাবের কারণে অধিকাংশ শিক্ষক কেউ বিনা পারিশ্রমিকে, কেউ অতি সামান্য পারিশ্রমিকে কাজ করতেন। শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন অরবিন্দ স্বয়ং, সখারাম গণেশ দেউস্কর, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, ভিক্ষু পূর্ণানন্দ, বিনয়কুমার সরকার প্রমুখ। অবৈতনিক শিক্ষকদের মধ্যে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ইন্দুমাধব মল্লিক, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের নাম করা যায়। প্রায়ই ‘এক্সটেন্সন লেকচার’ দেবার জন্য যাঁদের আমন্ত্রন করা হত, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আনন্দ কে কুমারস্বামী, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। 

বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট পরিচালনার জন্য একটি সোসাইটি করা হয়েছিল। এর মূল কাজ ছিল প্রযুক্তি শিক্ষার প্রসার। ১৯১০ সালের ১০ই মার্চ এই সোসাইটি জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এক হয়ে যায়, যুগ্ম শাখার নাম হয় সেন্ট্রাল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন। সেখানে দুটি শাখার দুটি ভিন্ন পরিচালন কমিটি হয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তির শাখাটিই দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। এই কলেজের ডিপ্লোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। 

এর দীর্ঘদিন পরে ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডা বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে বিধানসভায় এই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ে উন্নীত হয় এবং ‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে স্বীকৃতি পায়। তিনি পরিষদের সভাপতি এবং  বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রথম সভাপতি। শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক ত্রিগুণা সেন ছিলেন বিশ্ববিদ্যাল্যের প্রথম উপাচার্য। আজ এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবীতে প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়। আজও কিন্তু জাতীয় শিক্ষা পরিষদ সমানভাবে তার প্রাপ্য সম্মান পেয়ে থাকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়  শুরু হয় শুধু প্রযুক্তি নয়, তিনটি ফ্যাকাল্টি বা অনুষদ নিয়ে—কলা, বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রযুক্তি। অবশ্য আরও একাধিক অনুষদ একে একে যোগ হচ্ছে।

আরম্ভেই বলেছি, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা থেকে আমাদের পরিবার এই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।  আমার প্রপিতামহ মহারাজা সূর্য্যকান্তের অনুদানে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সূতিকা গৃহ গড়ে উঠেছিল। দীর্ঘকাল পর্যন্ত এই তিনটি পরিবার—ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সূর্য্যকান্ত আচার্য্য ও সুবোধচন্দ্র মল্লিকের পরিবার থেকে একজন করে প্রতিনিধি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতিতে ছিল। এখন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন ঘটায় এই নিয়ম বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু যতদিন এই নিয়ম ছিল, এই তিন পরিবারের প্রতিনিধি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, এবং শুধু আলংকারিক অস্তিত্ব তাঁদের ছিল না, দস্তুরমতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালোমন্দ নিয়ে তাঁদের ভাবনা ছিল, এবং অন্যান্য সদস্যদের ওপরে ‘ছড়ি ঘোরাবার’ কোনো ইতিহাস কানে আসেনি। 

আমার ঠাকুরদা– মহারাজা শশীকান্ত আচার্য্য

সূর্য্যকান্ত ১৯০৬—১৯০৮ সাল পর্যন্ত এখানে ট্রাস্টি ছিলেন, তাঁর অকালমৃত্যুর পর সে দায়িত্ব নেন আমার পিতামহ, মহারাজা শশীকান্ত আচার্য্য (১৯০৯—১৯৪৪)। তাঁর মৃত্যুর পার আমার বাবা, আইনজ্ঞ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্নেহাংশুকান্ত আচার্য্য ট্রাস্টি ছিলেন ১৯৪৫ থেকে। ১৯৭৭-এ নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আইন হবার পর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব আসে কোর্ট এবং এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল, এই দুটি ভাগে পরিচালনার কাজ চলে। কোর্টে বরাবর তিন পরিবারের প্রতিনিধির উপস্থিতি অবিচ্ছিন্নভাবে বজায় ছিল, তবে বাবা সময়াভাবের কারণে আর এই দায়িত্ব রাখেননি, তখন প্রতিনিধি  নিযুক্ত করা হয় আমার জ্যাঠতুতো দাদা, ডা. শুভ্রাংশুকান্ত আচার্য্যকে। তিনিও নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিচিত, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার ডিরেক্টর জেনেরাল পদে উন্নীত হয়ে তারপর অবসর নেন। এখন অবশ্য এই ব্যবস্থা নেই, আগেই বলেছি। আমার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর সময় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার কাজে ডা. ত্রিগুণা সেনের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছেন, এবং তার পরেও অন্যান্য উপাচার্যদের সঙ্গে মিলে কাজ করেছিলেন। সেই প্রথম যুগে রেজিস্ট্রার ছিলেন প্রবীরচন্দ্র বসু মল্লিক, তাঁকে এই পদে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আগের যে পরিচালন সমিতি ছিল, সেখানে সূর্য্যকান্ত সহ-সভাপতি ছিলেন ১৯০৬—১৯০৮। বাবা ১৯৪৭—১৯৪৮ সম্পাদক ও ১৯৫০—১৯৫৩ কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। খুব ছোটবেলা থেকে দেখেছি, বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিটিঙের কাগজপত্র নিয়ে বসেছেন, মিটিং সেরে ফিরে সেখানকার গল্প করেছেন। ৭০-এর দশকে সেই ভয়াবহ সময়েও দেখেছি, বাবা যাদবপুরের মিটিং বা জরুরি অবস্থাতে শত কাজের মধ্যেও ছুটে গেছেন। বিশেষত মনে পড়ে, উপাচার্য অধ্যাপক গোপালচন্দ্র সেনের বীভৎস হত্যাকাণ্ড ! 

আমি যাদবপুরের প্রাক্তন ছাত্রী, গবেষিকা ও অধ্যাপিকা – তিন ভূমিকা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কিছুর মধ্যেই একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। আমরা শিখেছিলাম, এবং শেখাবার চেষ্টা করেছিলাম, জীবনে শুধু অর্থ উপার্জন নয়, বৃহত্তর আদর্শ নিয়ে চলতে হবে। এই আদর্শ সবার জন্য, দেশবাসীর জন্য, বিশ্ববাসীর জন্য কিছু করে যাওয়া। এখন তো নতুন জমানা এসেছে, আদর্শ এখন হাসির খোরাক যোগায়, জানি না, আমাদের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বদেশী যুগের পুরাতন আদর্শের স্থান আজও আছে কি না! 

গ্রন্থপঞ্জী

এই প্রবন্ধে ব্যবহৃত তথ্যসামগ্রী সংগৃহীত হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের বিষয়ে প্রকাশিত পুস্তিকার মধ্যে থেকে । এছাড়াও দেখা যেতে পারে The National Council of Education, Bengal 1906—66 – Published by Jadavpur University, 1966.

মন্তব্য তালিকা - “অবিভক্ত বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন ও বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ — যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম”

  1. I am proud to have served Jadavpur University as a teacher of Engineering faculty for 39 years. Sri P C BasuMallik was the Registrar and Prof. Gopal Chandra Sen was the caretaker HOD of the newly established Metallurgical Engg. Department . the building of which was under construction at that time.

  2. বামফ্রন্ট সরকার কৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়. বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের গনতান্ত্রিককরন করা হয়. সর্ব স্তরের প্রতিনিধি নিয়ে দি কোর্ট গঠিত হয়. কোর্ট প্রতিনিধি মধ্যে দিয়ে কাউন্সিল গঠিত হয়. বামফ্রন্ট সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে গনতান্ত্রিক আইনের পতন ঘটে.

  3. পড়ে ভালো লাগলো।গর্ব বোধ হল জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে দুটি প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাওয়ায়।যাদবপুর বিদ্যাপীঠ,এবং পরবর্তীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।🙏

  4. যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জেনে সমৃদ্ধ হলাম। কৃতজ্ঞতা জানাই এই নিবন্ধের লেখক কে।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।