সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ভারত মহাসাগর এবং ভারতীয়দের সমুদ্র বাণিজ্য

ভারত মহাসাগর এবং ভারতীয়দের সমুদ্র বাণিজ্য

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

ডিসেম্বর ৯, ২০২৩ ৩৯৭ 7

একটা পুরো মহাসাগরের নাম ভারতের নামে হয়ে গেছে। পৃথিবীতে যুগে যুগে বহু ক্ষমতাধরেরা এসেছেন, সেসব দেশের পাশেও মহাসাগর আছে, কিন্তু তবু অন্য কোনো দেশ এই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়নি, তাদের নামে একটা মহাসাগরের নাম হয়নি।

ভারতের সঙ্গে এই মহাসাগর, তার নিকটবর্তী অন্যান্য সাগরগুলির সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। অতি প্রাচীন যুগ থেকে, প্রথমে পশ্চিম ও পরে পূর্ব উপকূল ধরে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এই উপমহাদেশের মানুষ সমুদ্রপথে বাণিজ্য করেছে। সেই ইতিহাস আজ হারিয়ে গেছে। ভারতবর্ষের মানুষের সেই গৌরবের কথা, সম্পদের স্মৃতিও আর নেই। তবে সেই ইতিহাস তার প্রতি বিদেশি বণিকের আকর্ষণ গড়ে তুলেছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে সেই বাণিজ্য ও তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক দেনাপাওনার স্মৃতি রয়ে গেছে।

হরপ্পীয় ব্যবসা বাণিজ্য

শুরু করা যাক সিন্ধু তীরের বাণিজ্য ইতিহাস দিয়ে। প্রায় সারে চার-পাঁচ হাজার বছর আগের কথা। সে ছিল এক সুবিশাল, আধুনিক সভ্যতা। সিন্ধু ও ঘাগগর-হড়কা নদীর তীরে গ্রাম ও নগর থেকে শুরু হয় এই বাণিজ্য। ছড়িয়ে পরে উত্তরে হরিয়ানা থেকে দক্ষিণে গুজরাত, পশ্চিমে বালুচিস্তান থেকে পূর্বে আজকের পশ্চিম-উত্তরপ্রদেশ অঞ্চলে। হরপ্পীয় সভ্যতার ভিত্তি ছিল শিল্প ও বাণিজ্য। কেউ কেউ দাবি করেন এই সভ্যতার অন্তর্গত গুজরাটের লোথালে পৃথিবীর প্রথম জাহাজ-ঘাটা তৈরি হয়েছিল। সেই বন্দরে ছিল জলদ্বার (স্লুইস গেট)। জাহাজ ঘাটার পাশে ছিল পণ্য রাখার বিভিন্ন গুদাম ঘর। আজকে লোথাল বা ধোলাভিরা ঠিক সমুদ্রের পাশে নেই, কিন্তু তখন লোথাল থেকে ধোলাভিরা হয়ে তটরেখা ধরে জাহাজে করে সমুদ্রে যাওয়া সম্ভব ছিল। ব্যবসায়ীরা সমুদ্র পথে পারস্য উপসাগর ধরে বড়ো নৌকায় বেসাতি নিয়ে বাণিজ্য করতে যেতেন মূলত মেসোপটেমিয়া, পারস্য, আফগানিস্তান আজকের বাহরিন্, সুমেরিয়াতে। স্থলপথেও সিন্ধু তীরবর্তী শহরগুলি থেকে তারা আফগানিস্তান ও পারস্য যেতেন। দীর্ঘ এই পথ ছিল প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম লম্বা ও প্রাচীন ট্রেড রুট (চিত্র ১)।

অনেক সিন্ধু বণিক কাজের সুবিধার জন্য পশ্চিম এশিয়াতে থাকত। সেখানে প্রাপ্ত বিভিন্ন মাপের মানসম্মত বাটখারা বিস্তৃত ব্যবসা বাণিজ্যের প্রমাণ দেয়। নিজেরা তৈরি করতেন মিহি সুতিবস্ত্র, পাথরের গয়না, ছোটোদের খেলনা, গজদন্তের দ্রব্য। পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তারা বিক্রি করতে যেতেন সুতিবস্ত্র, গজদন্তের শিল্প কাজ, হারের চিরুনি, বিভিন্ন ধরনের কাঠ, কর্ণেলিয়ান, পুঁতি। তবে তারা ওই অঞ্চল থেকে ঠিক কী আমদানি করতেন তা পরিষ্কার নয়। হয়তো রূপা ও পশমী বস্ত্র আমদানি করা হত। মিশরের সঙ্গে কি তাদের ব্যবসা ছিল? জানা যায় না। তবে মিশরের কিছু মমির নাকের ফুটোয় আস্ত গোলমরিচ ভরা থাকত। আর গোলমরিচ পাওয়া যেত একমাত্র ভারতে।

চিত্র-১ সিন্ধু তীরবর্তী শহরগুলি থেকে আফগানিস্তান ও পারস্যের বাণিজ্য পথ

এশিয়া জুড়ে হরপ্পীয় সভ্যতার সিল পাওয়া গেছে। নির্ভুল পরিমাপ করবার যন্ত্র মিলেছে। তবে আলাদা করে মুদ্রা কিন্তু মেলেনি। খুব সম্ভবত সরাসরি পণ্যবিনিময় দ্বারা বাণিজ্য চলত।

এক সময়ে হরপ্পীয় সভ্যতাও অস্তমিত হল। হয়তো ভৌগোলিক বিন্যাসের পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, পণ্য রপ্তানিকৃত দেশগুলির অর্থনৈতিক অধোগতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব ইত্যাদি এক বা একাধিক কারণ তাদের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। একদিন এই সভ্যতা গেল হারিয়ে। লোথাল বন্দরের কথা আমরা গেলাম ভুলে, আজ তা এক ধংসস্তূপ।

মৌর্য যুগ ও পূর্ব ভারতের বাণিজ্য সভ্যতা

বৈদিক যুগের নৌবাণিজ্য নিয়ে বিশেষ কিছু তথ্য পাওয়া না গেলেও, মৌর্য যুগে (৩২২- ১৮০ সাধারণ পূর্বাব্দ) বিন্দুসার ও অশোকের সময়ে দেশের মধ্যে ও বিদেশের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য ছিল দেশের অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এই সময়ের বাণিজ্যের তথ্য পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে, বৌদ্ধ শাস্ত্রে, গ্রিকদের গ্রন্থতে।

তখন জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ভারত ছিল চৌখস। গ্রিক লেখক স্ট্র্যাবোর গ্রন্থে তার উল্লেখ আছে। সড়কপথে ও জলপথে বাণিজ্য চলত রমরমিয়ে। বাণিজ্য করতে লাগত সরকারি অনুমোদন। রাষ্ট্রের কঠোর নিয়মকানুন ছিল অসৎ ব্যবসায়ীদের হাত থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করার। দেশ ও বিদেশের পণ্যের গুণমান ঠিক রাখতে, ব্যবসায়ীদের ডাকাতির হাত থেকে রক্ষা করতে ও সরকারি কোষাগার ভরাতেও বিভিন্ন আইন ছিল। গ্রিকরা লিখে গেছেন ভারতের ‘রাজপথ’-এর কথা, উত্তরে পুষ্কলাবতী (খাইবার পাসের কাছে) থেকে দক্ষিণে পাটলিপুত্র হয়ে তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত দীর্ঘ ছিল উত্তরের এই সড়ক। এছাড়াও দক্ষিণাপথ ছিল বারাণসী হয়ে উজ্জয়িনী পর্যন্ত। এ যেন আজকের জাতীয় সড়ক। ন্যাশনাল হাইওয়ে।

সমুদ্র পথে বহির্বাণিজ্যের উল্লেখ করতে হলে আসবে তাম্রলিপ্তির কথা। আজকের মেদিনীপুরে অবস্থিত তমলুক হল তখনকার বিখ্যাত বন্দর, তাম্রলিপ্তি। ঘাটশিলার কাছে তামার খনি থেকে তামা তুলে এই বন্দর দিয়েই রপ্তানি হত। তাই নাম তাম্রলিপ্তি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, আজও ভারত সরকারের হিন্দুস্তান কপার এই অঞ্চলের খনিগুলি থেকে তামা খনন করে। যে সব জাহাজ মূলত ভারতের দক্ষিণ বা পুবের দিকে যেত তাদের প্রধান বন্দর ছিল তাম্রলিপ্তি (চিত্র ২)।

চিত্র-২ জাহাজ মূলত ভারতের দক্ষিণ বা পুবের দিকে যেত তাদের প্রধান বন্দর ছিল তাম্রলিপ্তি

রোমিলা থাপার উল্লেখ করেছেন, তাম্রলিপ্তি ও অমরাবতী থেকে জাহাজ যেত আজকের মায়ানমার, মার্তাবান, জাভা, সুমাত্রায়। তাম্রলিপ্তির অধিকার কিন্তু আগে ছিল কলিঙ্গ রাজার হাতে, সেই সময়ে মেদিনীপুর অঞ্চল ছিল কলিঙ্গের অধীনে। সড়কপথে পণ্য প্রথমে পাটলিপুত্র থেকে তাম্রলিপ্তিতে যেত, সেখান থেকে নদী বন্দর থেকে জাহাজে করে রূপনারায়ণ নদ ধরে সমুদ্রে। শুধু বাণিজ্য নয়, পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে এই বন্দরের বিশেষ ভূমিকা ছিল। অশোকের পুত্র ও কন্যা, যথাক্রমে, মাহিন্দ্র ও সংঘমিত্রা এই তাম্রলিপ্তি থেকেই সিংহলে গিয়েছেন পিতা অশোকের ‘সামন্তপাসাদিকা’ বা দূত হিসেবে। অনেক ইতিহাসবিদ অনুমান করেন আসলে অশোকের কলিঙ্গ জয়ের অনুপ্রেরণা ছিল তাম্রলিপ্তি দখল ও বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ। বৌদ্ধ সাহিত্যেও তাম্রলিপ্তি থেকে সুবর্ণভূমিতে বাণিজ্যের কথা উল্লেখ আছে। জাতকের গল্পে মহাজনকের কথা মনে পরে? তিনিও নৌকা নিয়ে গিয়েছিলেন সুবর্ণভূমি। এই সুবর্ণভূমি সম্ভবত দক্ষিণ মায়ানমার ও তাইল্যান্ড অঞ্চল। তখনকার জাহাজের আয়তন ছিল যথেষ্ট বড়ো, শত মানুষের স্থান হয়ে যেত তার কোটরে।

কৌটিল্য যদিও অর্থশাস্ত্রে সতর্ক করেছেন সমুদ্র বাণিজ্য ও তার বিপদ নিয়ে (samruddhagati vipadi sarvatoniruddhagamanah) তবু মানুষ বেশি লাভের আশায় সমুদ্র বাণিজ্যে বৃহৎ জাহাজে অনেক পণ্য নিয়ে সিংহল ও দূরে ইন্দোনেশিয়াতে যেতেন। ভারত থেকে রপ্তানি হত সুতিবস্ত্র, রেশমবস্ত্র, পাথর লাগানো জমকালো বস্ত্র, হাতির দাঁতের বিলাসদ্রব্য, সুগন্ধি, ওষুধ, তামা, লোহা, ভারতের আনাচ-কানাচ থেকে সংগ্রহ করা হীরা ও অন্যান্য জহরত, পশু চর্ম, তুলোট কম্বল।

তাম্রলিপ্তির এই জাঁকজমক হর্ষের আমল পর্যন্ত চলেছে। বিখ্যাত দুই চৈনিক পর্যটক ফা হিয়েন (৩৯৯ – ৪১৪ সাধারণাব্দ) এবং হিউয়েন সাং (৬২৯ – ৬৪৫ সাধারণাব্দ) এই বন্দরের জমকালো বর্ণনা দিয়েছেন। ফা হিয়েন এই অঞ্চলে বহু বৌদ্ধ স্তূপ দেখেছিলেন।

তারপরে একদিন তাম্রলিপ্তির দিন ফুরোল। কেন তাম্রলিপ্তি একদিন পরিত্যক্ত হল? সম্ভবত নদীর খাতের পরিবর্তন, অথবা নদী বন্দরের পলি জাহাজ চলাচলকে অসাধ্য করে তুলেছিল। ইতিহাসের প্রতি অকরুণ ভারতীয়দের দীর্ঘ হাজার বছরের এই বন্দর ও বাণিজ্য নগরীকে ভুলতে বিশেষ সময় লাগল না।

দাক্ষিণাত্যের সমুদ্র বাণিজ্য

সেই যুগে শুধু তাম্রলিপ্তি নয়; কলিঙ্গ, অন্ধ্র এবং তামিলনাড়ুর বিভিন্ন বন্দর থেকে কার্তিক মাসে উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুর সাহায্য নিয়ে সমুদ্র যাত্রা শুরু হত। এই জাহাজগুলির যাত্রাপথ ছিল পূর্বঘাটের পাশ ধরে সিংহল পর্যন্ত। সেখানে বিশ্রাম নিয়ে, জল ও খাবার ভরে আবার সমুদ্রপথে সুমাত্রা, যবদ্বীপ, মালয় হয়ে দূর চম্পা, ভিয়েতনামের পথে বাণিজ্যতরী যেত। অন্য পথ ছিল তাম্রলিপ্তি থেকে তটরেখা ধরে মায়ানমার পর্যন্ত, সেখান থেকে লম্বা পাড়ি— চম্পা, ভিয়েতনামের পথে। ফেরার পথে জাহাজ বোঝাই করে সুমাত্রা ও যবদ্বীপের লবঙ্গ, জায়ফল, জয়িত্রি, কর্পূর আসত; ভিয়েতনাম থেকে আসত চীনা সিল্ক (চিত্র ২)।

এই সব মশলা আবার মালাবার উপকূল থেকে যেত গ্রিস, রোম ও আরব দেশে। তারা মনে করতেন লবঙ্গ, জায়ফল, জয়িত্রি ইত্যাদি ভারতীয় মশলা। প্রথম শতাব্দীতে এক গ্রিকের লেখা গ্রন্থ ‘দ্য পেরিপ্লাস অফ দ্য ইরিথ্রিয়ান সি’-তে ভারত মহাসাগর ধরে বাণিজ্যের বিস্তৃত বর্ণনা আছে।

তবে শুধু বাণিজ্য নয়, দীর্ঘদিন ধরে বাংলা, কলিঙ্গ, তামিলনাড়ু থেকে অভিবাসীরা সিংহল ও অন্যান্য দেশে বাসা বেঁধেছেন। বিভিন্ন সাহিত্যে ও শাস্ত্রে, বিশেষত তামিল, ইন্দোনেশীয় ও সিংহলী সাহিত্যে এবিষয়ে তথ্য আছে।

অশোকের সময়ে তিন প্রাচীন তামিল রাজবংশ— চের, চোল ও পাণ্ড্য, দক্ষিণ ভারতের উপদ্বীপে রাজত্ব করছেন। সেই সময়ে দাক্ষিণাত্য শিল্প, সাহিত্যে, বাণিজ্যে উন্নতির শিখরে উঠেছিল। কেরালা ও তামিলনাড়ুতে বর্তমানে পুরাতাত্ত্বিক খননের ফলে অজস্র রোমক ও গ্রিক সোনা ও রূপার মুদ্রা পাওয়া গেছে। ভারত থেকে রোমে যেত মূলত বিলাস দ্রব্য— সুতিবস্ত্র, হাতির দাঁতের দ্রব্য, মশলা, পশু ও পাখি। সেই সময় থেকে গোলমরিচের ব্যবহার উত্তরোত্তর ইউরোপে বেড়েছে। কারণ মাংস সংরক্ষণ ও সুগন্ধযুক্ত করার জন্য এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। সেই সময়ে ইউরোপীয়দের সঙ্গে বাণিজ্য ছিল ভারতের অনুকূলে। রোমক ঐতিহাসিক প্লিনি বারবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন যে, পুবের সঙ্গে বাণিজ্যে তাদের প্রচুর ধন নিঃশেষিত হচ্ছে— পুবের মূল শক্তি তখন ভারত।

চোলরা রাজত্ব করতেন কাবেরির ব-দ্বীপে। পাণ্ড্যরা আরও দক্ষিণে মাদুরাই অঞ্চলে এবং চেররা মূলত মালাবার উপকূলে। তবে রাজত্বের পরিসর বৃদ্ধির জন্য এরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বিবাদ করত, আবার সহাবস্থানও ছিল। সেই ৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে ১২০০ সাধারণাব্দ পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় পনেরশ বছর ধরে এই তিন বংশ দাক্ষিণাত্যে নিজেদের প্রভাব অক্ষুন্ন রেখেছিল।

পাণ্ড্যরা এক অতি প্রাচীন তামিল রাজবংশ। মাদুরাই ছিল এদের শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। মাদুরাই পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধারাবাহিকভাবে মনুষ্য অধ্যুষিত শহর। গ্রিক ও রোমক ঐতিহাসিক স্ট্র্যাবো, প্লিনি ও টলেমি এই শহরের উল্লেখ করেছেন। পাণ্ড্যরা নিয়ন্ত্রণ করতেন মুক্তা উৎপাদন ও তার ব্যবসা। ভারতের মুক্তা এই সময়ে তার গুণমানের জন্য খ্যাত ছিল।

চের রাজারা মূলত উত্তর মালাবার অঞ্চলে তাদের শক্তি ধরে রেখেছিল। এরা মধ্য এশিয়া ও রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে ফলাও ব্যবসা চালাত। রপ্তানি হত মূলত হাতির দাঁত, চন্দন কাঠ ও মশলা। পরবর্তীকালে এমনকি চীনের সঙ্গেও এদের সরাসরি বাণিজ্য চলেছে।

চোলরা ছিল এদের মধ্যে সবচাইতে ক্ষমতাসম্পন্ন। তাঞ্জোর অঞ্চল এদের শক্তির কেন্দ্র ছিল, এমনকি একসময়ে সিংহল এদের প্রত্যক্ষ অধিকারে ছিল। পরবর্তীকালে পাণ্ড্যদের হাত থেকে এরা মাদুরাই দখল করে নেয়। এছাড়াও সুমাত্রা, যবদ্বীপ অঞ্চলে এদের আধিপত্য ও প্রভাব ছিল যথেষ্ট।

উত্তর ভারতে গুপ্তদের সময়ে (৩১৯ থেকে ৫৫০ সাধারণাব্দ) ভারত বহির্বাণিজ্যে অগ্রণী ছিল। গুপ্তদের অর্থাগমের এক মস্ত রাস্তা ছিল ব্যবসায়ী ও কারবারীদের সমবায় সংঘের ওপর শুল্ক। ওই সময়ে ভারত, সমুদ্র ও স্থল বাণিজ্য, উভয়েই গণনীয় ছিল। স্থল বাণিজ্যে সিল্ক রুট ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। সমুদ্র বাণিজ্য চলত একদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অন্যদিকে পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে। কার্যত দীর্ঘদিন ধরে ভারত পশ্চিম ও পুবের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছে। পশ্চিমে সুদূর রোম ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য, পারস্য, আরবদের সঙ্গে যেমন ব্যবসা চলত, তেমনি পুবে সিংহল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ও চীনের সঙ্গেও সমুদ্র-বাণিজ্য ছিল শক্তিশালী। তবে সেই সময়ের চীনা পর্যটক ফা হিয়েন সমুদ্র বাণিজ্যের বিপদ নিয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি নিজে এসেছিলেন হাঁটা পথে।

তখন ভারতীয় বিলাসদ্রব্যের পৃথিবীজোড়া খ্যাতি ছিল। ভারতীয় সুতিবস্ত্র, সুগন্ধি, ওষুধ, মশলা, গোলমরিচ, চাল, নীল, বার্ণিশ, রং, মুক্তা, রত্ন (নীলকান্তমণি, জ্যাসপার, স্ফটিক), হাতির দাঁত ও চন্দন কাঠের পণ্যের চাহিদা ছিল পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে। পশ্চিম ও আরব দেশ থেকে আমদানি করা হত ঘোড়া, সোনা ও রূপার গহনা, মদ। চীন থেকে আসতো চীনা সিল্ক (চীনাংশুক)। সম্ভবত পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গেও বাণিজ্য চলত।

দাক্ষিণাত্যের ক্ষমতায়ন

চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে রোমক সাম্রাজ্যের ক্রমাবনতি ও পতনের পরে পশ্চিমের বাণিজ্য ঘাটতি পুবের বাণিজ্য দিয়ে পুরণ করবার চেষ্টা হয়। ষষ্ঠ শতকে গুপ্ত সম্রাজ্যের পতনের পরে সামগ্রিক ভাবে উত্তর ভারতে পণ্য তৈরির নৈপুণ্য ধীরে ধীরে হ্রাস পায়, এর ফলে এইসময়ে মধ্য ও পূর্ব ভারতের বহু নগরের অবক্ষয় হয়।

সেই সুযোগে দক্ষিণাপথে দুই রাজবংশ নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে নেয়। সে সময়ে আজকের মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও অন্ধ্রের একাংশ নিয়ে চালুক্যবংশ ও কাঞ্চিপুরমের পাশে পল্লব রাজবংশর ক্ষমতায় প্রায় তুল্যমূল্য ছিল। সুদূর দক্ষিণের চোল, চের ও পাণ্ড্যদের সঙ্গে এই দুই গোষ্ঠীর নিজেদের রাজত্বের সীমানা নিয়ে নিরন্তর বিবাদ হয়েছে। সমুদ্র পথে দক্ষিণ-পূর্ব দেশগুলির সঙ্গে এরাও বহির্বাণিজ্য অংশ গ্রহণ করেছে।

সমুদ্র বাণিজ্য সার্বিক ভাবে দক্ষিণ ভারতের উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা নেয়। পল্লবদের সময়ে মামল্লপুরম (ওই অঞ্চলের সমুদ্র কূলবর্তী শোর টেম্পলগুলো এখনও বিখ্যাত) ও পুম্পুহার বন্দরনগরী থেকে জাহাজ ছাড়ত।

চোলদের প্রধান বন্দর ছিল নাগপত্তনম। পরবর্তীকালে চোলরা আবার পল্লবদের থেকে কাঞ্চিপুরমের ক্ষমতা দখল করে নেয় ও তামিলভূমিতে একাধিপত্য চালায়।

দক্ষিণ ভারতের ভৌগোলিক সুবিধা ও প্রাকৃতিক সম্পদের বাড়বাড়ন্তের ফলে ওই অঞ্চলের সমুদ্র-বাণিজ্যের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময়। ভারত মহাসাগরকে গ্রিক রোমক সভ্যতার সময়কাল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে ব্যবহারের ফলে তাদের  কাছেও ভারতীয় বাণিজ্যের গুরুত্ব ও কদর ছিল যথেষ্ট।

চিত্র-৩ চোলদের সমুদ্র বাণিজ্য পথ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সমুদ্র বাণিজ্যের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব অবশ্যম্ভাবীভাবে পড়েছিল ওই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশগুলিতে (চিত্র ৩)। এই প্রভাব উপনিবেশায়ন নয়। তৎকালীন সিংহল, সুমাত্রা, যবদ্বীপ, বলিদ্বীপ, চম্পা, কাম্বোজ বা ফুনান ভারতের উপনিবেশ ছিল না। এ ছিল ভারতীয় সংস্কৃতির স্থানীয়করণ। এই সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ভিত্তি ছিল বাণিজ্য, দর্শন, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা। বিভিন্ন ভাস্কর্যে দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্যবিদ্যার প্রভাব আজও দৃশ্যমান। সেই সময়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যগুলিও জনপ্রিয় হয়েছিল দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়াতে।

বিভিন্ন কারণে বঙ্গের ও দক্ষিণ ভারতের এই গৌরবময় ইতিহাস সঠিক ভাবে লেখা হয়নি। যদিও দেশের বাইরে, বিশেষত শ্রীলংকা ও ইন্দোনেশিয়াতে, সেই গৌরবময় যুগের কথা লোকে জানে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস মূলত পাটলিপুত্র কেন্দ্রিক, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারত কেন্দ্রিক। দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস একটা দীর্ঘ সময় ধরে উত্তর ভারতের সমান্তরাল ভাবে চলেছে। সামগ্রিকভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের এই বিভিন্নতা আমাদের ইতিহাস বইগুলিতে বিবৃত হয় না।

তেরশ শতকে দাক্ষিণাত্যের চোল রাজবংশের পতন ভারতের সমুদ্র বাণিজ্যের উপরে এক তীব্র আঘাত। শেষ পাঁচশ বছর ধরে দেশের বাইরে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে, যেসব বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি তারা তৈরি করেছিল, সেসবের ওপরেও নেমে এল আঘাত।

মুঘল আমলে সমুদ্র বাণিজ্য

এইসময়ে পৃথিবীর রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে পট পরিবর্তন হয়, তার প্রভাব ভারতেও পরে। দিল্লিতে প্রথমে সুলতানরা, পরে মুঘলরা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। দিল্লির সুলতানরা প্রথম দিকে নিজেদের শাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে বলবন ও আলাউদ্দিন খলজি বাণিজ্য প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। যদিও আরবদের সঙ্গে তাদের পাল্লা দিতে হয়েছে, তবুও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সেই সময়েও ভারতের প্রভাব ছিল। মার্কো পোলো বর্ণনা দিয়েছেন, তখনও দাক্ষিণাত্যে ঘোড়ার ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে। তবে মুক্তার ব্যবসা ধীরে ধীরে চলে গেছে আরবদের দখলে।

দাক্ষিণাত্যের পতনের পরে পশ্চিম ভারতের বন্দরগুলো বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তখন বাণিজ্যে উদ্যোগ নিয়েছেন মারওয়াড়ি ও গুজরাটিরা। এদের অনেকেই ছিলেন জৈন। হিন্দু ও মুসলমানরাও, বিশেষত বোহরা মুসলিমরা সমুদ্র বাণিজ্যে অংশ নিয়েছেন। স্থল বাণিজ্য মূলত মুলতানি হিন্দু ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল। আল-বিরুনী এই ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের সম্পদের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে। ইউরোপীয়রা ভারতে ব্যবসা করতে এসে যদিও লক্ষ্য করেছে যে তামিল চেট্টিয়াররা তখনও দেশের ব্যবসাতে অন্যতম অগ্রণী। কোচিন তখন দাক্ষিণাত্যের প্রধান বন্দর ।

মুঘল আমলের বৈশিষ্ট্য হল এই প্রথম দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় সম্পূর্ণ উপমহাদেশ দিল্লি থেকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। দেশে নতুন নতুন বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠে। লাহোর, আগ্রা, ফতেপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বর্ধমান, বেনারস ছিল বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। মুঘল যুগে সমুদ্র তীরবর্তী বন্দরের সংখ্যা ছিল প্রায় তিনশ। ভারত ব্যবসা করত পারস্য, মধ্য এশিয়া, আরব দেশ, চীন, জাপান, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, পর্তুগালের সঙ্গে। চিরদিন ভারতের পণ্যদ্রব্য খাতির পেয়েছে তার গুণমানের জন্য। ঢাকার মসলিন, বেনারসের সিল্ক, সুরাট, আহমেদাবাদ ও মাদুরাই-এর সুতি বস্ত্রর চাহিদা ছিল ইউরোপে। সেই হরপ্পীয়দের সময় থেকে মুঘল যুগ পর্যন্ত পৃথিবীতে ভারতীয় সুতি বস্ত্রের উৎকর্ষতা ও চাহিদা একেবারে প্রথম পছন্দের ছিল। মুঘল যুগে সারা পৃথিবীর সুতি বস্ত্রের ৩০ শতাংশ ভারত থেকে রপ্তানি হত। আমদানি হত মদ, বন্দুক, বারুদ, ভেলভেট, ঘর সাজানোর অলংকার। পারস্য থেকে কার্পেট, আরব থেকে ঘোড়া আসত।

চিত্র-৪ ১৫০০ শতকে পৃথিবীর ট্রেড রুট

সমুদ্রপথে নতুন যুগের নতুন বণিকের আগমন

পনের শতকে কনস্টান্টিনোপলের পতন ও তুর্কিদের ক্ষমতা দখলের পরে ইউরোপীয়রা পৃথিবীব্যাপী বাজার ধরতে বেরিয়ে পরে। পৃথিবীর নতুন নতুন দেশের আবিষ্কার ও ইউরোপীয় নৌবাণিজ্য শক্তির অভ্যুদয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যত্ন লালিত বাণিজ্য সম্পর্কগুলি ধাক্কা খায়। মুঘল, সাফাভিদ ও অটোমান সাম্রাজ্যের ভিতরের দ্বন্দ্ব, ক্রমাগত নিজেদের শক্তি ক্ষয়, ইউরোপীয়দের সুবিধা করে দিয়েছিল। এর ফলে ইউরোপীয়রা ভারত ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে নিজেদের ক্ষমতা বাড়াতে পারে। পনের শতকের পরে সামগ্রিক ভাবে পৃথিবীব্যাপী এশিয়ার পরাক্রম অস্তগামী হয়।

ভাস্কো দ্য গামার ভারত আগমন, তার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি, আরবদের বিতারণ, ভারতের ব্যবসায়ীদের এক নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায়। সরাসরি সমুদ্র বাণিজ্য অপেক্ষা পর্তুগিজদের হাত ফেরত হয়ে ভারতীয় বাণিজ্য শুরু হয়। এই ব্যবস্থা চলে ষোল শতকের শেষ পর্যন্ত।

চিত্র-৫  ১৭ শতকে পৃথিবীর সমুদ্র বাণিজ্য পথ

এরপরে আসে অন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলি— ওলন্দাজ, ফরাসি ও ব্রিটিশরা (চিত্র ৫)।

যেভাবে ইংরেজরা ভারতীয় সুতি ও রেশম কারখানাগুলোকে ধ্বংস করেছিল, ঠিক একই উপায়ে ভারতীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্প ও সমুদ্র বাণিজ্যকে তারা ধ্বংস করে। মাদ্রাজ অঞ্চলে ১৬৪৬ ও ১৬৫১-র ব্যবসা নিয়ন্ত্রক আইনের ফলে ভারতীয়দের জাহাজ ইউরোপে যাওয়ার অধিকার হারায়। পবর্তীকালে, ১৮১৪-তে এই নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ হয় প্রথমে কলকাতা ও পরে অন্য সব বন্দরে শুল্ক বৈষম্য নীতির কারণে। এই আইনের বলে ভারতীয়রা ব্রিটিশ অধীনস্থ হলেও তাদের নিজ দেশের বাণিজ্য নীতিতে ব্রিটিশ নাবিকদের সমানাধিকারী ছিল না। ধীরে ধীরে সামগ্রিক ভাবে ভারতীয় উপকূলবর্তী সমুদ্র বাণিজ্য চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। যে মুঘল আমলে পৃথিবীর ৩০ শতাংশ সুতি বস্ত্র যোগাত ভারত, তা নেমে আসে ২ শতাংশে। তার জায়গা নেয় ল্যাঙ্কাশায়ার। যে ব্রিটিশদের মানুষের ইতিহাসে সমুদ্র বাণিজ্যে কোনো অবদান ছিল না, তারা এরপরে অন্য ইউরোপীয়দের সঙ্গে ভাগ বাটোয়ারা করে ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ করে দুশ বছর ধরে।

সেই হরপ্পীয় সভ্যতার যুগ থেকে, পাঁচ হাজার বছর ধরে ভারত মহাসাগর ও তার পাশের সাগরগুলি ব্যবহৃত হয়েছে বাণিজ্যের প্রয়োজনে। ভারতীয়রা জাহাজে পণ্য নিয়ে হরপ্পীয় সভ্যতার যুগে গেছে আফগানিস্তান, পারস্য (ইরান), মেসোপটেমিয়ায় (ইরাক)। পরবর্তীকালে বাণিজ্য চলেছে আরব দেশ, দূরের ভূমধ্য সাগর অঞ্চল, রোমক সাম্রাজ্য, গ্রিস, পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে।

অন্যদিকে সিংহল, ব্রহ্ম দেশ, চম্পা (ভিয়েতনাম), ফুনান (দক্ষিণ কম্বোডিয়া, লাওস), সুমাত্রা, যবদ্বীপ, (জাভা), বলিদ্বীপ (বালি), চীন, জাপানের সঙ্গে এই বাণিজ্য চলেছে মৌর্য যুগ থেকে। বাণিজ্যের পাশাপাশি, এই সমস্ত দেশের সঙ্গে গড়ে উঠেছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক বন্ধন।

বিভিন্ন দেশে সেই নৌ বাণিজ্যের স্মৃতিস্বরূপ এখন কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া যায়, কিন্তু কীভাবে জাহাজে পণ্য যেত তার খোঁজ পাওয়া কঠিন। ভারতীয় বিবরণ নেই, সেই জাহাজের কিছু মাত্র অবশেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিছু বিদেশী ঐতিহাসিকের বিবরণে দেখা যায় ভারতীয় তরীতে ৭০০ মানুষ একসঙ্গে যেতে পারত। এই দীর্ঘ সময়কাল ধরে মহাসমুদ্রের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভারতীয় বাণিজ্যতরী পণ্য নিয়ে গেছে, অন্যরাও ভারতে এসেছে ব্যবসার প্রয়োজনে। সমুদ্র বাণিজ্য ছিল স্থলবাণিজ্যের থেকে তুলনামূকভাবে বহুগুন বেশি লাভজনক। মাঝ সমুদ্রের বাণিজ্যের থেকে উপকূল ধরে বাণিজ্য অনেক বেশি নিরাপদ। ভারত মহাসাগরের মৌসুমী বায়ুর সঠিক ব্যবহার এই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা নিয়েছে (চিত্র ৬ )।

এই বাণিজ্য ইতিহাসে দাক্ষিণাত্য, গুজরাট, বঙ্গ ও কলিঙ্গের ভূমিকা ছিল গৌরবময়।

চিত্র-৬ মৌসুমী বায়ুর প্রভাব 

এই যে হাজার হাজার বছর ধরে সমুদ্রের দুদিকে নির্দিষ্ট পথে ব্যবসা চলেছে তাকে বলা যায় ‘স্পাইস রুট’ (চিত্র ৭)। সিল্ক রুটের মত তার কথা কিন্তু লোকের মনে নেই। যে পরিমাণ পণ্য ঐ সময়ে তিনটি মহাদেশ জুড়ে ব্যবসা করেছে তার গুরুত্ব সিল্ক রুটের থেকে কম ছিল না।

চিত্র-৭ সিল্ক রুট ও স্পাইস রুট

অন্য কোনও মহাসাগরের পৃথিবীর ইতিহাসে এই গৌরবময় ভূমিকা নেই। শুধু তো ভারত নয়, সুদূর আফ্রিকা থেকে বলিদ্বীপ, এই বিশাল অংশব্যাপী বিভিন্ন দেশ ভারত মহাসাগরকে ব্যবহার করেছে ব্যবসা, সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের প্রয়োজনে। তবে ভারত ছিল তার কেন্দ্রভূমি। এই তিন মহাদেশকে যুক্ত করত ভারত। হয়তো সেই স্মৃতি ইউরোপীয়দের মাথা থেকেও বিস্মৃত হয়নি। সেকারণেই একটা পুরো মহাসমুদ্রের নাম হয়ে গেল

ভারতের নামে। ভারত মহাসাগর। ইন্ডিয়ান ওশেন।

কিছু রেফারেন্স

  1. Romila Thapar, ‘Early India: From the Origins to AD 1300’; Indian Penguin, 2004.
  • Rupendra Kumar Chattopadhyay, ‘The Archaeology of Coastal Bengal’; Oxford University Press, 2018.
  • K. N. Chaudhuri, ‘Trade and Civilisation in the Indian Ocean’; Cambridge University Press, 1985.
  • Shinu A. Abraham, “Chera, Chola, Pandya: Using Archaeological Evidence to Identify the Tamil Kingdoms of Early Historic South India”

(https://scholarspace.manoa.hawaii.edu/server/api/core/bitstreams/776f8b6e-0f5b-484d-a537-0879d83d4068/content).

  • P.K. Gautam, “The Cholas Some Enduring Issues of Statecraft, Military Matters and International Relations”, ‘Journal of Defence Studies, Vol. 7, No. 4, October–December 2013’; pp. 47–62.
  • রোমিলা থাপার, ‘অশোক ও মৌর্যদের পতন’; কে পি বাগচী, জানুয়ারি, ২০০০।
  • Sanjeev Sanyal, ‘The Ocean of Churn’; Indian Penguin, 2015.
  • John S. Strong, ‘The Legend of King Aśoka, A Study and Translation of the Aśokāvadāna’; 1989.

Bimal Duari, ‘Geography of Purba Medinipur’; 2019, p. 18.

লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা। প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য তালিকা - “ভারত মহাসাগর এবং ভারতীয়দের সমুদ্র বাণিজ্য”

  1. ভেবেছিলাম পরে পড়বো, কিন্তু শুরু করে শেষ পর্যন্ত না পড়ে থামতে পারলাম না। এমনি-ই ইতিহাস আমার কাছে ভীষণ আকর্ষণীয় আর সেটা যদি এমন সুললিত, সর্বজনবোধ্য ভাষায় লেখা হয়।
    পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল সত্যিই –
    ‘আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে,
    দৈবে হতেম দশম রত্ন নবরত্নের মালে—‘

  2. ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে আমার আগ্রহ সবসময়ই একটু বেশি। ভারতবর্ষের ইতিহাস গ্রন্থ আমাদের দেশে খুব বেশি পাওয়া যায় না। ইতিহাস তথ্য ও তর্ক আমার ইতিহাস জানার সুযোগ করে দিয়েছে। ভারতবর্ষের সমুদ্র পথের বানিজ্য ও সমুদ্র বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি রপ্তানি বিষয়ে জানতে পারলাম এই প্রবন্ধে। বৃটিশ আমাদের শাসন শোষণ করার পাশাপাশি আমাদের দেশের সমুদ্র বানিজ্য কেড়ে নিয়েছে, আমাদের দেশের পন্য উৎপাদন ব্যাবস্থাকে ধঙশ করেছে। লেখক মধুশ্রী দিদিকে অসঙখ্য ধন্যবাদ জানাই ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ওনার লেখনী অব্যাহত থাকবে এই কামনা করি।

  3. এক নি:শ্বাসে পড়ে ফেললাম। হরপ্পা যুগ থেকে ইংরেজ উপনিবেশবাদীদের যুগ, সাড়ে পাচ হাজার বৎসরের বহির্বানিজ‍্য বিষয়ে পরিক্রমা করা গেল। বোঝা গেল ভারত মহাসাগরের গরিমা।

  4. খুবই সুন্দর, তথ্য সমৃদ্ধ, টানটান লেখা। দারুণ ভালো লাগলো।সঙ্গের সুচিন্তিত এবং বিরল ম্যাপ আর রেফারেন্স বইয়ের তালিকার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সঞ্জীব সান্যালের ocean of churn ছাড়া আর কোনটাই পড়া নেই আমার।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।