সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

লেখক: জয়ন্ত ভট্টাচার্য

জয়ন্ত ভট্টাচার্য
লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক এবং বিগত তিন দশক ধরে বিমান প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত। ইতিহাস, বিশেষতঃ সামাজিক ইতিহাস ও মুদ্রাতত্ত্ব নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী পাঠক। ইতিহাস নিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত সাম্প্রতিক।
আধুনিক ভারতের ইতিহাস চর্চার পরিমণ্ডলে স্বাধীনতা-পূর্ব পশ্চিম ভারতের ভিল ও গরাসিয়া আদিবাসীদের একী আন্দোলন সম্বন্ধে খুবই কমই উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।১ ‘একী’ কথাটির অর্থ একতা। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে বর্তমান রাজস্থান ও গুজরাতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের আদিবাসীরা দীর্ঘদিনের নির্যাতনের প্রতিবাদে মোতিলাল তেজাবতের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের শপথ নিয়েছিলেন বলে নিজেদের আন্দোলনকে তাঁরা ‘একী’ নামে অভিহিত করেছিলেন। তৎকালীন রাজপুতানা এজেন্সির মেবাড় ও তার পার্শ্ববর্তী দেশীয় রাজ্যগুলির শাসকদের সাধারণ প্রজাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া অমানবিক করের বোঝা থেকে মুক্তি, বেগার শ্রমের অবসান ও অরণ্যের জমি থেকে উপজাত দ্রব্যের উপর অধিকার ছিল এই আন্দোলনের মুখ্য দাবি। এই সময় বর্তমান রাজস্থান ও গুজরাতে অবস্থিত মেবাড়, সিরোহি, দুঙ্গরপর, দাঁতা, পালনপুর, ইডর প্রমুখ দেশীয় রাজ্যগুলিতে পৃথক পৃথক কর ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। একী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অন্যতম দাবি ছিল একই কর ব্যবস্থার প্রচলন। পশ্চিম ভারতের ভিল আদিবাসীরা মূলত উদয়পুর শহরের দক্ষিণে অবস্থিত ভোমট ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মগরা নামের দুটি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করতেন। সেই কারণে এই আন্দোলন ‘ভোমট ভিল’ আন্দোলন নামেও পরিচিত।
অন্ত মধ্যযুগ থেকে যে ভূভাগ বাঙ্গালা বা বাংলা নামে পরিচিত, আদি মধ্যযুগ থেকেই সেই ভূখণ্ডের ভৌগোলিক অঞ্চলগুলির ক্রমশ একটি রাজ্যতন্ত্রের অধীনে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সাধারণাব্দের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতকের মধ্যবর্তী কোনও সময় রচিত আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থে (৫৩.৬৮৭) উল্লিখিত ‘গৌড়তন্ত্র’১ সম্ভবত এই পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। আদি মধ্যযুগে বাংলা বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণাব্দের অষ্টম শতকে কাশ্মীরের শাসক ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় এবং একাদশ শতকে তামিল ভূমির শাসক রাজেন্দ্র চোলের সেনার আক্রমণে। আশ্চর্যজনকভাবে বাংলার অভ্যন্তরীণ কোনও উত্স থেকে আদি মধ্যযুগের এই দুই বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও আক্রমণের ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে প্রায় কোনও তথ্যই পাওয়া যায়নি।
বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাগীরথী নদীর পুরোনো গতিপথের ধারে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার এক সমৃদ্ধ জনপদ রক্তমৃত্তিকার নাম আজ প্রায় বিস্মৃত। আদি মধ্যযুগে এই জনপদ যে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল, রক্তমৃত্তিকার প্রত্নক্ষেত্র থেকে আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তুসমূহের অধ্যয়নে পাওয়া গেছে তার অসংশয়িত প্রমাণ। এই জনপদে স্থাপিত বৌদ্ধ মহাবিহার যে প্রাচীন বাংলায় শাস্ত্রচর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, চিনা পরিব্রাজক জুয়ানজ্যাং-এর বর্ণনায় তার প্রমাণও লিপিবদ্ধ। সম্ভবত বাংলায় গুপ্ত অধিকারের সময় রক্তমৃত্তিকার মহাবিহার প্রতিষ্ঠার কাল। সেই সময় থেকে অন্ত মধ্যযুগে ভাগীরথীর গতিপথ পরিবর্তনের আগে পর্যন্ত রক্তমৃত্তিকা জনপদের গুরুত্ব সম্ভবত কখনও একেবারে বিলুপ্ত হয়নি। আজও প্রাচীন রক্তমৃত্তিকা জনপদের স্মৃতি বহন করে চলেছে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর ব্লকের অন্তর্গত রাঙামাটি নামের একটি গ্রাম। এই নিবন্ধের চর্চার বিষয় এই প্রাচীন জনপদের গৌরবময় ইতিহাস।
ভারতীয় উপমহাদেশে বৈদিক জনগোষ্ঠীদের বিবাহের ধারণা সম্পর্কে প্রাচীনতম উল্লেখ রয়েছে ঋগ্বেদের বিবাহ সূক্তে (১০.৮৫)। সাধারণপূর্বাব্দের প্রথম সহস্রাব্দ জুড়ে রচিত বৈদিক সাহিত্য থেকে তৎকালীন বৈদিক জনগোষ্ঠীদের মধ্যে বিবাহ সম্পর্কিত ধারণার ক্রমিক বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই সহস্রাব্দের শুরুর দিকে রচিত কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখার সংহিতায় (৬.১.৬.৬) উল্লেখ করা হয়েছে পিতা তাঁর কন্যাকে অন্য একটি পরিবারকে দান করেন (অর্থাৎ, কোন ব্যক্তিকে নয়)। এর বেশ কয়েক শতাব্দী পর, এই প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতিধ্বনি শোনা যায় এই তৈত্তিরীয় শাখারই আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে (২.১০.২৭.৩), যেখানে বলা হয়েছে, নারীদের অন্য একটি কুলে দান করা হয় (কোন ব্যক্তিকে নয়)। আদি মধ্যযুগে লেখা স্মৃতিচন্দ্রিকা গ্রন্থে অধুনালুপ্ত বৃহস্পতির ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃত শ্লোকেও এই রীতির উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতে উল্লিখিত দ্রৌপদীর সঙ্গে পঞ্চ পাণ্ডব ভ্রাতাদের বিবাহও এই প্রাচীন প্রথার স্মারক। সংস্কৃতে ‘দেবর’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থও এই প্রাচীন বিবাহ প্রথারই ইঙ্গিতবাহক।