সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বিশ শতকের প্রায় বিস্মৃত আদিবাসী একী আন্দোলন

বিশ শতকের প্রায় বিস্মৃত আদিবাসী একী আন্দোলন

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

জুলাই ৮, ২০২৩ ৪০২ 0

আধুনিক ভারতের ইতিহাস চর্চার পরিমণ্ডলে স্বাধীনতা-পূর্ব পশ্চিম ভারতের ভিল ও গরাসিয়া আদিবাসীদের একী আন্দোলন সম্বন্ধে খুবই কমই উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। ‘একী’ কথাটির অর্থ একতা। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে বর্তমান রাজস্থান ও গুজরাতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের আদিবাসীরা দীর্ঘদিনের নির্যাতনের প্রতিবাদে মোতিলাল তেজাবতের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের শপথ নিয়েছিলেন বলে নিজেদের আন্দোলনকে তাঁরা ‘একী’ নামে অভিহিত করেছিলেন। তৎকালীন রাজপুতানা এজেন্সির মেবাড় ও তার পার্শ্ববর্তী দেশীয় রাজ্যগুলির শাসকদের সাধারণ প্রজাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া অমানবিক করের বোঝা থেকে মুক্তি, বেগার শ্রমের অবসান ও অরণ্যের জমি থেকে উপজাত দ্রব্যের উপর অধিকার ছিল এই আন্দোলনের মুখ্য দাবি। এই সময় বর্তমান রাজস্থান ও গুজরাতে অবস্থিত মেবাড়, সিরোহি, দুঙ্গরপর, দাঁতা, পালনপুর, ইডর প্রমুখ দেশীয় রাজ্যগুলিতে পৃথক পৃথক কর ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। একী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অন্যতম দাবি ছিল একই কর ব্যবস্থার প্রচলন। পশ্চিম ভারতের ভিল আদিবাসীরা মূলত উদয়পুর শহরের দক্ষিণে অবস্থিত ভোমট ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মগরা নামের দুটি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করতেন। সেই কারণে এই আন্দোলন ‘ভোমট ভিল’ আন্দোলন নামেও পরিচিত।

একী আন্দোলনের নেতা মোতিলাল তেজাবত ১৮৮৬ সালে মেবাড় রাজ্যের কোত্যারি গ্রামের এক ওসবাল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম নন্দলাল ও মার নাম কেসরবাই। ১৯১২ সাল থেকে তিনি মেবাড় রাজ্যের ঝাড়োল ঠিকানার (ঠিকানা = দেশীয় রাজ্যের অধীনস্থ রাজ্যসমূহ) ঠাকুরের (অর্থাৎ ভূস্বামীর) দপ্তরে কামদারের (অর্থাৎ মুনশির) কাজ করতে শুরু করেন। বিশ শতকের গোড়ায় মেবাড় (উদয়পুর) রাজ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ছিল। দেশীয় রাজ্যের সরকার প্রায় কোনও জনহিতকর কাজে অর্থ ব্যয় করত না। কৃষকরা বার বার আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে বাধ্য হতেন। চাকরির প্রয়োজনে মোতিলাল মেবাড় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানের সময় ঠাকুর অর্থাৎ জমিদারদের দ্বারা আদিবাসীদের ভয়ঙ্কর শোষণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করে এই শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করার কথা চিন্তা করতে শুরু করেন। ১৯২০ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভিল আদিবাসীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। এই সময় মেবাড় রাজ্যে বিজয় সিংহ পথিকের নেতৃত্বে বিজোলিয়া কৃষক আন্দোলন চলছিল। মোতিলাল ঝাড়োলে এই আন্দোলনের প্রচার পুস্তিকা বিলি করেন।

১৯২১ সালের গ্রীষ্মকালে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে দরিদ্র আদিবাসীদের কাছে করের বোঝা দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মে মাসে মোতিলাল তাঁর আদিবাসী সমর্থকদের নিয়ে চিতোরের কাছে মাতৃকুণ্ডিয়ার বার্ষিক কৃষক মেলায় উপস্থিত হন। এই মেলায় উপস্থিত আদিবাসীদের মধ্যে ঠিক কী আলোচনা হয়েছিল জানা যায়নি, তবে মেলার শেষে আদিবাসী আন্দোলনের নেতৃত্ব তাঁদের দাবি নিয়ে উদয়পুরে গিয়ে মহারাণার কাছে উপস্থিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২১ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে কয়েক হাজার আদিবাসী উদয়পুরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে ঠিক করা ২১টি দাবি ‘মেবাড় পুকার’ নামে একটি দলিলে লিপিবদ্ধ করে মহারাণা ফতেহ সিংহের সঙ্গে দেখা করে পেশ করেন। মহারাণা তাঁদের ১৮টি দাবি মেনে নিলেও তিনটি মূল দাবি – জঙ্গলের জমিতে উপজাত দ্রব্যের উপর আদিবাসীদের অধিকার, বেগার শ্রমের অবসান এবং রাজকীয় শিকারের সময় আদিবাসীদের জোর করে ধরে এনে সমস্ত কাজ করিয়ে নেওয়ার প্রথা সমাপ্ত করার দাবি মেনে নিতে রাজি হলেন না। মোতিলাল তাঁর সমর্থকদের নিয়ে উদয়পুর থেকে ভিল আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় ফিরে গিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। অন্যদিকে ব্রিটিশদের চাপে ২৮ জুলাই ফতেহ সিংহ শাসনভার তাঁর পুত্রকে হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। ১৯ আগস্ট ঝাড়োলের ঠাকুর কুবের সিংহ মোতিলালকে গ্রেপ্তার করেন। কিন্তু, কয়েক হাজার আদিবাসী ঝাড়োল দুর্গ অভিযানের জন্য জমায়েত হলে মোতিলালকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এই আন্দোলন মেবাড় থেকে রাজপুতানা এজেন্সির পার্শ্ববর্তী দেশীয় রাজ্যগুলিতে ও বর্তমান গুজরাত রাজ্যের রাজস্থানের সীমান্তবর্তী মহীকাণ্ঠা এজেন্সির ছোট ছোট দেশীয় রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু আদিবাসী নয়, অন্যান্য দরিদ্র প্রজারাও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। কর দেওয়া বন্ধ করার জন্য প্রচার শুরু হয়। আজমের থেকে প্রকাশিত বিজয় সিংহ পথিক সম্পাদিত সংবাদপত্র ‘নবীন রাজস্থান’ এই আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন করার কাজে যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। ‘প্রজা সেবক’ ও ‘লোকবাণী’ সংবাদপত্রেও এই আন্দোলনের খবর ছাপা হয়। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ৪০০০ গমেতি (ভিল আদিবাসী গ্রামপ্রধান) ব্রিটিশ সরকারের কাছে বেগার শ্রমের অবসান ও কর হ্রাসের আবেদন জানান। এদিকে মোতিলাল তেজাবত ভোমট অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে ভিলদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানাতে শুরু করেন। ডিসেম্বর মাসের ২৪ ও ২৫ তারিখে গ্রামে গ্রামে চুড়ি আর তির পাঠানো শুরু হয়; বহু সংখ্যক আদিবাসী তির গ্রহণ করে, আন্দোলনে অংশগ্রহণে সম্মতি জানান।

১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে মেবাড়ের সীমান্তবর্তী ইডর রাজ্যের (বর্তমান গুজরাতের সাবরকণ্ঠা জেলার) পোশিনা গ্রামে মোতিলালের সঙ্গে প্রায় ৫০০০ ভিল আদিবাসী জমায়েত হন। এর মধ্যে ১৮০০ আদিবাসী বন্দুক নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। মোতিলাল জনৈক ভিল আদিবাসীকে ফৌজদার অর্থাৎ সেনানায়ক বলে ঘোষণা করেন। এই সময় মোতিলাল নিজেকে মহাত্মা গান্ধির শিষ্য বলে উল্লেখ করতেন, আদিবাসীদের বলতেন, ‘গান্ধি রাজ’ স্থাপিত হলে উপার্জন করা প্রতি টাকায় মাত্র এক আনা কর দিতে হবে। অন্যদিকে, মহাত্মা গান্ধি, সিরোহি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রমাকান্ত মালব্যের তারবার্তা পাওয়ার পর, ১৯২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় ‘ডেঞ্জার অফ মাস মুভমেন্ট’ শীর্ষক এক নিবন্ধে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তিনি খবর পেয়েছেন মোতিলালকে সশস্ত্র অনুগামীরা ঘিরে থাকে এবং তিনি কোনও এক রাজ স্থাপন করতে চান। মোতিলাল তাঁর শিষ্য নন বা এই ধরণের সহিংস আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। এই নিবন্ধে মহাত্মা গান্ধি আরও লেখেন, তিনি জানতে পেরেছেন সাহসী অথচ সরল গ্রামবাসীদের কর দেওয়া বন্ধ করার জন্য প্ররোচিত করা হয়েছে। এমনকি তাঁদের এও বলা হয়েছে, তিনি নির্দেশ দিয়েছেন কেবল এক টাকা চার আনার বেশি কর না দিতে। কিন্তু, এ বিষয়ে কেউ তাঁর সঙ্গে কোনও পরামর্শ করেনি। রমাকান্ত মালব্য তাঁকে জানিয়েছেন, তাঁর নাম ব্যবহার করে বড় অপকর্ম চলছে। ৫ ফেব্রুয়ারি ইডর রাজ্যের দরবার ভিলদের জমায়েত ও মোতিলালের ঐ রাজ্যে প্রবেশ বা তাঁকে আশ্রয়দান অপরাধ বলে ঘোষণা করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি মহাত্মা গান্ধির গুজরাতি ভাষায় ‘নবজীবন’ পত্রিকায় লেখা আর একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায়, তিনি মোতিলালকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ত্যাগ করে দেশীয় রাজ্যের শাসকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের কথা বোঝাবার জন্য মণিলাল কোঠারিকে পাঠিয়েছিলেন। মোতিলাল মহাত্মা গান্ধির পরামর্শ অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর আহ্বানে কয়েক হাজার আদিবাসী উদয়পুরে মহারাণার সঙ্গে দেখা করার জন্য যাত্রা শুরু করে। ৭ই মার্চ এই আদিবাসীরা উপস্থিত হন ইডর রাজ্যের (সাবরকাণ্ঠা জেলার বিজয়নগর তালুকায়) মেবাড় সীমান্তবর্তী পলচিতরিয়া (বর্তমান নাম ডঢ়বাও) গ্রামে। এখানে মোতিলাল ও তাঁর সমর্থকদের শান্তিপূর্ণ জমায়েতের উপর ‘মেবাড় ভিল কর্প্স’-এর সেনারা মেজর হাটনের নির্দেশে বর্বর আক্রমণ চালায়। ব্রিটিশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী এই আক্রমণে মাত্র ২২ জন ভিল আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয় ও ২৯ জন আহত হন। কিন্তু, স্থানীয় ভিল অধিবাসীদের মতে এই আক্রমণে মৃত ভিল আন্দোলনকারীর সংখ্যা ১২০০ থেকে ১৫০০ মধ্যে। এই হত্যাকাণ্ড জালিয়ানওয়ালাবাগের চেয়েও অনেক বেশী মর্মান্তিক। কিন্তু এই গণহত্যার পরও কিন্তু আদিবাসী একী আন্দোলন বন্ধ হয় নি। মোতিলাল ইডর রাজ্যের পোশিনা গ্রামে আত্মগোপন করে আন্দোলন চালিয়ে যান।

১৯২২ সালের এপ্রিল মাস থেকে সিরোহি রাজ্যের কয়েকটি গ্রামের ভিল ও গরাসিয়া আদিবাসীরা কর দেওয়া বন্ধ করে দেন। তাঁরা শপথ নেন, এখন থেকে কেবল ১ টাকা ৪ আনা ও লাঙল প্রতি ৫ মণ ভুট্টা রাজকোষে জমা করবেন। রমাকান্ত মালব্য ও মেজর প্রিটচার্ড সিরোহি রাজ্যের সেনাদের সঙ্গে নিয়ে কর আদায় করতে সিয়াবা গ্রামে উপস্থিত হন। ১৯২২ সালের ৮ এপ্রিল সিয়াবা গ্রামের ভিল ও গরাসিয়া আদিবাসীদের সঙ্গে সিরোহি রাজ্যের সেনাদের সংঘর্ষ হয়। এর বদলা নিতে ১২ এপ্রিল সিরোহি রাজ্যের সেনা সিয়াবা গ্রামের ১০০টি কুটির জ্বালিয়ে দেয় ও বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। ‘তরুণ রাজস্থান’ সংবাদপত্রে এই অত্যাচারের খবর বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়। এরপর, সিরোহি রাজ্যের সেনা ৫ মে আদিবাসী গ্রাম বলোরিয়ায় এবং তার পরের দিন আরও দুটি আদিবাসী গ্রাম ভুলা ও নবাবাসে গ্রামবাসীদের উপর স্বয়ংক্রিয় বন্দুক থেকে গুলি চালায় ও তাঁদের কুটিরে আগুন লাগিয়ে দেয়। সরকারিভাবে এই হত্যাকাণ্ডে মাত্র ২৯ জনের মৃত্যু স্বীকার করা হয়। ৯ মে আদিবাসীরা আজমেরে অবস্থিত বিজয় সিংহ পথিক স্থাপিত ‘রাজস্থান সেবা সংঘে’র কাছে এই নরসংহারের সংবাদ পৌঁছালে, ঐ সংগঠন থেকে সত্য ভক্ত ও রাম নারায়ণ চৌধরি সিরোহি আসেন সত্য অনুসন্ধানের জন্য। ১৫ মে তাঁরা বলোরিয়া গ্রামে পৌঁছান, পরে বলোরিয়া থেকে ভুলা গ্রামে যান। সত্য ভক্ত ও রাম নারায়ণ চৌধরি গ্রামবাসীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে জানান, এই দুই গ্রামের ৩২৫টি পরিবারের ১৮০০ পুরুষ ও নারী এই আক্রমণে নিহত হয়েছে, ৬৪০টি কুটির জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, ৭০৮৫ মণ ফসল নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, ৬০০টি গরুর গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ১০৮টি গবাদি পশুকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বা কেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ১০ মে ‘তরুণ রাজস্থান’ সংবাদপত্রে এই গণহত্যার খবর প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর, বিভিন্ন ইংরেজি ও স্থানীয় সংবাদপত্রেও এই গণহত্যার খবর  প্রকাশিত হয়। সমালোচনায় বিব্রত সিরোহি রাজ্যের দরবার জুন মাসে আদিবাসীদের দাবি শোনার জন্য একটি কমিটি গঠন করে ও একী আন্দোলনের কিছু দাবি মেনে নেয়। অল্প দিনের মধ্যেই সিরোহিতে একী আন্দোলন প্রায় সমাপ্ত হয়ে যায়।

মোতিলাল এই সময় ভিলদের ঐতিহ্যগত বেশভূষা গ্রহণ করেন এবং ১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি আবার ভিলদের একত্র করে একী আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। মোতিলাল এবার ইডর রাজ্যের প্রজা মণ্ডলের কাছে সাহায্য করার জন্য আবেদন জানান। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার ও দেশীয় রাজ্যের শাসকরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। দীর্ঘ ৭ বছর আত্মগোপন করে থাকার পর, ১৯২৯ সালের ৪ জুন মোতিলাল তত্কালীন ইডর রাজ্যের খেড়ব্রহ্মা গ্রামের ব্রহ্মা মন্দিরে একটি ভিল সমাবেশে যোগ দিতে এসে গ্রেপ্তার হন। জুলাই মাসে তাঁকে মেবাড় রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া হয়। মেবাড় সরকার তাঁকে উদয়পুরের কেন্দ্রীয় কারাগারে বিনা বিচারে আটক করে রাখে। ১৯৩৫ সালের ৩ নভেম্বর মণিলাল কোঠারি উদয়পুর পৌঁছে মোতিলালের মুক্তির জন্য প্রশাসনের সঙ্গে কয়েকদিন ধরে কথা বলেন। ১৯৩৬ সালের ১৬ এপ্রিল তাঁকে একটি ৬ দফা অঙ্গীকারপত্র লিখতে বাধ্য করা হয় এবং ঐ অঙ্গীকারপত্রের ভিত্তিতে তাঁকে ১৯৩৬ সালের ২৩ এপ্রিল তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু উদয়পুর শহরের সীমার বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৩৮ সালে তাঁকে একবার কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং তিনি প্রায় দেড় বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পর, মেবাড় রাজ্যের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মোতিলাল ভোমট ও মগরা অঞ্চলে গিয়ে আদিবাসীদের পঞ্চায়েত গঠন করে নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রচার শুরু করলে ১৯৪৬ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি আবারও কারারুদ্ধ হন। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি কারামুক্ত হন। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তাঁর জীবনাবসান হয়।

একী আন্দোলন যে প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে বর্তমান রাজস্থান ও গুজরাতের ভিল ও গরাসিয়া আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মাধ্যমে অনিচ্ছুক দেশীয় রাজ্যের শাসকদের কাছ দাবি আদায় করার এক নতুন পন্থার সন্ধান দিয়েছিল, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এর সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, মোতিলাল তেজাবতের নেতৃত্ব ছাড়া এই আন্দোলন সম্ভবত আদৌ কোনও সাফল্য অর্জন করতে পারতো না। ভিল লোকসঙ্গীতে মোতিলালের সশ্রদ্ধ স্মরণ আজও তার সাক্ষ্য বহন করছে।

স্বাধীনতার পর দেশীয় রাজ্যগুলির বিলয় ঘটেছে, পরাধীন ভারতের অনেক বৈষম্যমূলক আইনই বাতিল হয়েছে, ২০০৬ সালের বনাধিকার স্বীকৃতি আইনও বেশ কিছুদিন যাবৎ কার্যকর হয়েছে। কিন্তু বিশ শতকের পরাধীন ভারতে আদিবাসী আন্দোলনের নেতারা যে জল-জঙ্গল-জমিনের উপর অধিকারের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন স্বাধীনতার সাত দশক পার হওয়ার পরও অধরা রয়ে গেছে। আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে আজও ভারতের আদিবাসীরা সবচেয়ে পশ্চাৎপদ রয়ে গেছেন। একুশ শতকে উন্নয়নের নামে ভারতের অরণ্যের জমি প্রতিদিন সংকুচিত হয়ে চলেছে, অরণ্যের সম্পদ ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিবর্তিত হচ্ছে আর ছিন্নমূল, দরিদ্র আদিবাসীরা শহরে এসে ভিড় করছেন কাজের প্রত্যাশায়। স্বাধীনতার পরবর্তী কালে ভারতের আদিবাসীদের বারবার জল-জঙ্গল-জমিনের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশ নিতে দেখা গেছে। এই কারণেই, একী আন্দোলনের গুরুত্ব আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না।  

পাদটীকা

১. সুমিত সরকারের ‘মডার্ন ইন্ডিয়া ১৮৮৫-১৯৪৭’ গ্রন্থে মাত্র তিনটি বাক্যে মোতিলাল তেজাবতের নেতৃত্বে ভিল আন্দোলন নিয়ে উল্লেখ রয়েছে; দেখুন, Sumit Sarkar, ‘Modern India 1885-1947’; Delhi: Pearson, pp. 173, 182, 207।

২. Prakash Chandra Jain, ‘Tribal Agrarian Movement (A Case Study of the Bhil Movement of Rajasthan)’; Udaipur: Himanshu Publications, 1989, p. 69.

৩. M.K. Gandhi, “Danger of Mass Movement in Young India, 2.2. 1922” in ‘The Collected Works of Mahatma Gandhi, Vol. 22”; The Publications Division, Government of India, 1966. p. 315.

৪. ibid, pp. 476-477.

৫. Hari Shankar Sharma, “Social and Political Awakening Among the Bhils of Mewar State During 1938-48 A.D.” in G.N. Sharma edited ‘Social and Political Awakening Among the Tribals of Rajasthan’; Centre for Rajasthan Studies, University of Rajasthan, 1947, p. 20.

৬. Prakash Chandra Jain, ‘Tribal Agrarian Movement (A Case Study of the Bhil Movement of Rajasthan)’, p. 74.

৭. Hari Sen, “The Maharana and the Bhils: The ‘Eki’ Movement in Mewar, 1921-22.” in E. Waltraud and B, Pati edited ‘India’s Princely States: People, Princes and Colonialism’; London: Routledge, 2007, p. 159.

তথ্যসূত্র

১. Alf Gunvald Nilsen, “Subalterns and the State in the Longue Durée: Notes from “The Rebellious Century”” in the Bhil Heartland” in ‘Journal of Contemporary Asia’; Vol. 45, No.4; 2015, pp. 574-595.

২. Alf Gunvald Nilsen, ‘Adivasis and the State: Subalternity and Citizenship in India’s Bhil Heartland’; Cambridge: Cambridge University Press, 2018, pp. 113-117.

৩. ভগবানদাস কেলা, ‘দেশী রাজ্য কা জন-জাগৃতি’; ইলাহাবাদ: ভারতীয় গ্রন্থমালা, ১৯৪৮, পৃ. ৭২-৭৪।

৪. বৃজ কিশোর শর্মা, ‘রাজস্থান মেঁ কিসান এবং আদিবাসী আন্দোলন’; জয়পুর: রাজস্থান হিন্দী গ্রন্থ অকাদমী, ২০০১, পৃ. ৭২-৮৪।

৫. B.L. Meharda, “The Girasia ‘Ekki’ Movement” in G.N. Sharma edited ‘Social and Political Awakening Among the Tribals of Rajasthan’; Centre for Rajasthan Studies, University of Rajasthan, 1947, pp. 51-60.

৬. C.S.K. Singh, “Bhils’ Participation in Politics in Rajasthan in the 1920’s” in ‘Social Scientist’, Vol. 13, No. 4; April 1985, pp. 31-43.

৭. Denis Vidal, ‘Violence and Truth: A Rajasthani Kingdom Confronts Colonial Authority’; New Delhi: Oxford University Press, 1997, pp. 117-156.

৮. Hari Sen, “The Maharana and the Bhils: The ‘Eki’ Movement in Mewar, 1921-22.” in E. Waltraud and B, Pati edited ‘India’s Princely States: People, Princes and Colonialism’; London: Routledge, 2007, pp. 157–172.

৯. K.S Saxena, ‘The Political Movements and Awakening in Rajasthan (1857 to 1947)’; New Delhi: S. Chand & Co., 1971, pp. 179-184.

১০. Rajat K. Ray, “Mewar: The Breakdown of the Princely Order” in Robin Jeffrey edited ‘People, Princes and Paramount Power: Society and Politics in the Indian Princely States’; Delhi: Oxford University Press, 1978, pp. 205-237.

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক এবং বিগত তিন দশক ধরে বিমান প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত। ইতিহাসের আগ্রহী পাঠক। ইতিহাস নিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত সাম্প্রতিক।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।