সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

জাহাঙ্গিরের সোনার মোহর

জাহাঙ্গিরের সোনার মোহর

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

অক্টোবর ৮, ২০২২ ৮৯৩ 4

প্রাককথন

“জাহাঙ্গীরের আমলের স্বর্ণমুদ্রা”, বললেন শঙ্করবাবু। “দেখুন, প্রত্যেকটিতে একটি করে রাশির ছবি খোদাই করা। এই জিনিস একেবারেই দুষ্প্রাপ্য।”

আমাদের অনেকেই বোধ হয় জাহাঙ্গিরের অতি দুর্লভ সোনার মোহরের কথা প্রথম জেনেছি ছোটবেলায় সত্যজিৎ রায়ের এই ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’ কাহিনির সূত্রে। ভারতের চতুর্থ মোগল বাদশাহ নূরউদ্দিন মুহাম্মদ জাহাঙ্গির (রাজত্বকাল ১৬০৫-১৬২৭ সাধারণাব্দ) তাঁর বৈচিত্র্যময় স্বর্ণমুদ্রার প্রচলনের কারণে শুধু ভারতে নয় সারা পৃথিবীতে আজও বহুল চর্চিত। জাহাঙ্গিরের সমকালীন ভারতে তাঁর প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রার উপর উত্কীর্ণ চিত্র ও লেখের বিষয়বস্তু জন্ম দিয়েছিল বহু বিতর্ক ও বিরোধের। আধুনিক বিশ্বে মুদ্রা সংগ্রাহকদের জাহাঙ্গিরের স্বর্ণমুদ্রার প্রতি আকর্ষণের কারণ তাদের বৈচিত্র্যময় শিল্পসুষমা ও দুষ্প্রাপ্যতা। আবার, মুদ্রাতত্ত্ববিদদের এই স্বর্ণমুদ্রাগুলি সম্পর্কে আগ্রহের কারণ নিপুণ নির্মাণশৈলী, শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং অভিনবত্ব। 

জাহাঙ্গিরের স্বর্ণমুদ্রার প্রসঙ্গে আলোচনার আগে মোগল আমলের ভারতে মুদ্রা ও মুদ্রাব্যবস্থার স্বরূপ দেখে নেওয়া যাক। ভারতের প্রথম দুই মোগল বাদশাহ, বাবর ও হুমায়ুনের রাজত্বকালে তামার মুদ্রা ‘ফালুস’, পাতলা রূপোর মুদ্রা ‘শাহরুখি’ (বা ‘দিরহাম’) ও সোনার মুদ্রা ‘আশরফি’ (বা ‘দিনার’) প্রচলিত ছিল। কিন্তু, সেই সময় ভারতের মুখ্য বিনিময়ের মাধ্যম ছিল সুলতানি আমলের খাদ মেশান রূপোর মুদ্রা ‘টংকা’। এই ‘টংকা’ থেকেই বাংলায় টাকা শব্দের উত্পত্তি। উত্তর ভারতে সুলতানি আমলে বিভিন্ন সময়ে অবশ্য সোনা ও তামার মুদ্রাকেও ‘টংকা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। সুলতানি আমলের কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা ‘আশরফি’ বা ‘দিনার’ নামেও পরিচিত ছিল। দক্ষিণ ভারতে এই সময় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের স্বর্ণমুদ্রা ‘বরাহ’ বা ‘হোণ’ যথেষ্ট প্রচলিত ছিল। ১৫৪২ সাধারণাব্দে শের শাহ সুরি ভারতে প্রথম নতুন বিশুদ্ধ রূপোর মুদ্রা ‘রূপয়া’র প্রচলন করেন। তিনি নতুন তামার মুদ্রা ‘দাম’-এরও (‘পয়সা’ নামেও পরিচিত) প্রচলন করেন। মোগল বাদশাহ আকবরের সময় থেকে মোগল সাম্রাজ্যের অবসান পর্যন্ত মূলত তিনটি ধাতুর মুদ্রা প্রচলিত ছিল – তামার মুদ্রা ‘দাম’, রূপোর মুদ্রা ‘রূপয়া’ এবং সোনার মুদ্রা ‘মুহর’ (‘মোহর’)। এই তিনটি ধাতব মুদ্রার পারস্পরিক বিনিময় মূল্য কখনওই স্থির ছিল না, সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে। আকবরের সময়ে ১ তোলা ওজনের মান ছিল প্রায় ১২ গ্রাম। সাধারণভাবে মোগল বাদশাহদের প্রচলিত রূপয়া ও মোহরের ওজন ১ তোলার থেকে কিছুটা কম হত। রূপোর মুদ্রা প্রধানত ১১.৫ গ্রাম ও সোনার মুদ্রা মুখ্যত ১১.০ গ্রাম ওজনের হত। মোগল টাঁকশালগুলিতে মুদ্রার ওজন এবং ধাতুর শুদ্ধতার প্রতি কড়া নজর রাখা হত। আবুল ফজল, তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’ (আনুমানিক ১৫৯৫ সাধারণাব্দ) গ্রন্থে লিখেছেন আকবর স্বর্ণমুদ্রার শুদ্ধতার মান দক্ষিণ ভারতের ‘হোণ’ বা আলাউদ্দিন খলজির ‘দিনার’ মুদ্রার চাইতেও বেশি রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই কারণে, মোগল আমলে ‘সিক্কা’ অর্থাৎ টাঁকশাল থেকে সদ্য নির্মিত মুদ্রার মূল্য একই রাজ্যাঙ্কে নির্মিত ‘চালানি’ অর্থাৎ পুরোনো ঘষে যাওয়া মুদ্রার চেয়ে কিছুটা বেশি হত কিন্তু, মোগল আমলে বাজারে কত পরিমাণ মুদ্রার প্রচলন থাকবে, তার উপর কোনও শাসকীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যে কোনও ব্যক্তি মোগল টাঁকশালে যে কোনও পরিমাণ রূপোর তাল বা পুরোনো রূপোর মুদ্রা নিয়ে গিয়ে নির্ধারিত মূল্য প্রদান করে নতুন মুদ্রা নির্মাণ করিয়ে আনতে পারতেন। মুদ্রাব্যবস্থার উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাব মোগল সাম্রাজ্যের পতনের একটি কারণ বলে কোনও কোনও আধুনিক বিদ্বান মনে করেন।

সাধারণত মোগল সম্রাটদের মুদ্রার এক পিঠে বাদশাহের নাম ও উপাধি ও অন্য পিঠে নির্মাণের সাল ও রাজত্বকালের বর্ষের উল্লেখ করা হত। প্রায় সব মোগল বাদশাহের মুদ্রায় নির্মাণের হিজরি সনের উল্লেখ রয়েছে। আকবর তাঁর রাজত্বকালের প্রথম দিকে হিজরি সন ব্যবহার করলেও, ১৫৮৪ সাধারণাব্দে সৌর পঞ্জিকা তারিখ-ই-ইলাহি প্রচলন করার পর নিজের মুদ্রায় ঐ নতুন পঞ্জিকা অনুযায়ী সন লেখাতে শুরু করেন। জাহাঙ্গিরের রাজ্যাভিষেকের পর এই রীতি বন্ধ হয় এবং তাঁর মুদ্রায় আবার হিজরি সনের উল্লেখ শুরু হয়। কিন্তু, তিনি রাজত্বকালের বর্ষ ও মাস গণনার জন্য ইলাহি সৌর পঞ্জিকার ব্যবহার চালু রাখেন। শাহজাহান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইলাহি সৌর পঞ্জিকার ব্যবহার বন্ধ করে দেন।

জাহাঙ্গিরের প্রচলিত মুদ্রাগুলি অন্যান্য মোগল বাদশাহদের তুলনায় অনেক অর্থেই ব্যতিক্রমী। জাহাঙ্গির প্রচলিত অধিকাংশ স্বর্ণমুদ্রার একটি উল্লেখনীয় বৈশিষ্ট্য মুদ্রার দুই পিঠে ফার্সি ভাষায় নাস্তালিক লিপিতে লেখা দ্বিপদী কবিতার পংক্তির মাধ্যমে মুদ্রার পরিচয়জ্ঞাপন। আকবরের মুদ্রায় এই রীতির সূত্রপাত হলেও, জাহাঙ্গিরের মুদ্রায় এই রীতির প্রয়োগ অত্যন্ত ব্যাপক। জাহাঙ্গির তাঁর সুবর্ণমুদ্রার ওজন নিয়েও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। জাহাঙ্গিরের রাজ্যাভিষেকের অব্যবহিত পর, তাঁর নির্দেশে প্রথমে স্বর্ণমুদ্রার ওজন ২০% বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং তারপর রাজত্বকালের চতুর্থ বর্ষে স্বর্ণমুদ্রার ওজন আরও ৫% (অর্থাৎ মোট ২৫%) বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু, রাজত্বকালের ষষ্ঠ বর্ষে অভিজাত প্রজাদের অনুরোধে আবার আকবরের আমলের ওজন ফিরিয়ে আনা হয় এবং রাজত্বকালের শেষ পর্যন্ত স্বর্ণমুদ্রার ওজনের আর কোন পরিবর্তন করা হয় নি। জাহাঙ্গিরের প্রায় সব স্বর্ণমুদ্রাই গোলাকার, এবং সোনার শুদ্ধতা অতি উচ্চমানের (প্রায় ১০০%)। তাঁর আমলে স্বর্ণমুদ্রায় সোনার শুদ্ধতার মানের প্রতি নজর রাখার জন্য প্রত্যেক রাজকীয় টাঁকশালে একজন দারোগা নিযুক্ত করা হয়েছিল।

প্রথম প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রা

চিত্র ১: জাহাঙ্গিরের নিজের নামে মুদ্রিত প্রথম স্বর্ণমুদ্রা

আকবরের জীবনাবসনের অব্যবহিত পর আগ্রা টাঁকশাল থেকে প্রচলিত এক মোহরের স্বর্ণমুদ্রায় ইলাহি সন ৫১ (১৬০৫ সাধারণাব্দ) এবং আকবর ও জাহাঙ্গির, উভয়েরই নাম খোদিত হয়। এই স্বর্ণমুদ্রার উপর খোদিত হয় একটি ফার্সি বয়েৎ:

“জ়দ অস্ত অজ় মুহর আকবর বাদশাহ নূর।

বরিন জ়র নাম শাহ নূর আলা নূর।”

অর্থাৎ, ‘বাদশাহ আকবরের রাজকীয় মুদ্রার সংযোগে স্বর্ণ উজ্জ্বল হয়; শাহ নূরের (অর্থাৎ জাহাঙ্গিরের) নামের সংযোগে এই স্বর্ণ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।‘

এর কয়েক মাস পর জাহাঙ্গিরের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। রাজ্যভিষেক সম্পন্ন হবার পর, কাব্যানুরাগী জাহাঙ্গির তাঁর নিজের নামে মুদ্রিত প্রথম স্বর্ণমুদ্রার উপর তাঁর আমীর-উল-উমরাহ শরীফ খানের লেখা একটি ফার্সি বয়েৎ (দ্বিপদী) খোদাই করতে নির্দেশ দিলেন:

“রুই জ়র রা সখ্ত্ নূরানী বরং মিহর-ও-মাহ।

শাহ নূর-উদ্দীন জাহাঁগীর ইবন আকবর বাদশাহ।”

অর্থাৎ, ‘সূর্য আর চন্দ্রের কিরণের মতন এই মুদ্রার মুখমণ্ডলকে উজ্জ্বল করেছেন বাদশাহ আকবরের পুত্র শাহ নূর-উদ্দিন জাহাঙ্গির।‘

জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের প্রথম তিন বছর ধরে এই বয়েৎ সমন্বিত স্বর্ণমুদ্রা দিল্লি, আগ্রা, লাহোর, আকবরনগর (রাজমহল), কাশ্মীর (শ্রীনগর) ও কান্দাহারের মোগল টাঁকশালে নির্মাণ করা হয়েছিল।    

বৃহদাকার স্বর্ণমুদ্রা

চিত্র ২: জাহাঙ্গিরের ১০০০ তোলার সোনার মোহর

মোগল বাদশাহদের মধ্যে জাহাঙ্গিরই প্রথম ব্যাপক সংখ্যায় বৃহদাকার সোনার মোহর নির্মাণ করতে শুরু করেন। আকবরের রাজত্বকাল থেকেই মোগল কোষাগারে সোনা মূলত বৃহদাকার স্বর্ণমুদ্রার আকারে সঞ্চয় করা হত। এই বৃহদাকার স্বর্ণমুদ্রাগুলি কেবল উপহার দেবার প্রয়োজনে ব্যবহার করা হত। জাহাঙ্গিরের আগে আকবরের রাজত্বকালের আগ্রার টাঁকশালে নির্মিত একটি ৫ মোহরের স্বর্ণমুদ্রা ছাড়া এই রকম আর কোন বৃহদাকার স্বর্ণমুদ্রা নির্মাণের নিদর্শন এখনও পাওয়া যায় নি। ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে আকবরের রাজত্বকালে প্রচলিত ‘শানশা’, ‘বিন্সত’, ‘রহস’, ‘আত্মাহ্’ প্রমুখ নামের ভারী স্বর্ণমুদ্রার উল্লেখ আছে, কিন্তু এই মুদ্রাগুলিকে আজও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। 

জাহাঙ্গিরই প্রথম বৃহদাকার ২, ৩, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০ ও ১০০০ মোহরের স্বর্ণমুদ্রা নির্মাণ করান। এর অধিকাংশ নির্মিত হয়েছিল তাঁর আগ্রার টাঁকশালে। জাহাঙ্গির, রাজ্যাভিষেকের অব্যবহিত পরেই তাঁর প্রচলিত প্রত্যেকটি স্বর্ণমুদ্রার একটি বিশেষ নামকরণ করা শুরু করেন। আত্মজীবনীমূলক ‘তুজুক-ই-জাহাঁগীরী’ বা ‘জাহাঁগীরনামা’ গ্রন্থে তিনি এই নামকরণের কথা উল্লেখ করেছেন। ১ মোহরের স্বর্ণমুদ্রা নূরজাহানি, ৫ মোহরের স্বর্ণমুদ্রা নূরমিহর, ১০ মোহরের স্বর্ণমুদ্রা নূরকরম, ২০ মোহরের স্বর্ণমুদ্রা নূরদৌলত, ৫০ মোহরের স্বর্ণমুদ্রা নূরসুলতানি এবং ১০০ মোহরের স্বর্ণমুদ্রাকে নূরশাহি নামে অভিহিত করা হয়। ১/২ মোহরের স্বর্ণমুদ্রা নূরানী ও ১/৪ মোহরের স্বর্ণমুদ্রা ‘রওয়াজি’ নামে অভিহিত হয়। জাহাঙ্গিরের নির্দেশে, তাঁর প্রচলিত বৃহদাকার ১০, ২০, ৫০ ও ১০০ মোহরের স্বর্ণমুদ্রাগুলির উপর লেখা হয় তাঁর সভাসদ আসফ খানের রচিত একটি ফার্সি বয়েৎ, যার অর্থ, “এই স্বর্ণের উপর অদৃষ্টের কলম আলোকের অক্ষরে লিখেছে শাহ নূর-উদ্দিন জাহাঙ্গির।” 

১৬২০ সাধারণাব্দের জানুয়ারি মাসে পারস্যের সুলতান শাহ আব্বাসের দূত জয়নুল বেগ জাহাঙ্গিরের রাজসভায় আসেন। ‘তুজুক-ই-জাহাঁগীরী’ গ্রন্থে জাহাঙ্গির তাঁকে ১০০ ও ২০০ তোলার মোহর উপহার দেবার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। মারাঠি সেনানায়ক উদাজীরামকে একটি ১০০ তোলার মোহর উপহার দেবার কথাও ‘তুজুক-ই-জাহাঁগীরী’তে উল্লেখ রয়েছে। সমসাময়িক ওলন্দাজ ভৌগোলিক ও লেখক ইয়োহানেস দেলায়েত, তাঁর ১৬৩১ সাধারণাব্দে লেখা মোগল সাম্রাজ্য বিষয়ক গ্রন্থে জাহাঙ্গিরের প্রচলিত ১০০ ও ৫০ তোলার সোনার মোহরের উল্লেখ করেছেন।

জাহাঙ্গিরের প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রাগুলির মধ্যে বৃহত্তম, ১০০০ মোহরের (অর্থাৎ ১০০০ তোলার) একটি মোহর আজও সবার বিস্ময় সৃষ্টি করে চলেছে। জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের অষ্টম বর্ষে (১০২২ হিজরি সন = ১৬১৩ সাধারণাব্দ) আগ্রার টাঁকশালে নির্মিত ১১.৯৩৫ কিলোগ্রাম ওজনের ও ২০.৩ সেমি. ব্যাসের এই স্বর্ণমুদ্রাটি সম্ভবত পৃথিবীর এখনও পর্যন্ত নির্মিত সর্ববৃহৎ স্বর্ণমুদ্রা। ‘তুজুক-ই-জাহাঁগীরী’ গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, জাহাঙ্গির ২৮ মার্চ, ১৬১৩ সাধারণাব্দে এই মুদ্রাটি ইরানের রাজদূত ইয়াদগার আলিকে দান করেন। ‘ইকবালনামা-ই-জাহাঁগীরী’ গ্রন্থেও এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।

দীর্ঘদিন যাবৎ এই বৃহত্তম মুদ্রাটির অস্তিত্বের আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। অবশেষে, ১৯৮৭ সালের  ৯ নভেম্বর, সুইজারল্যান্ডের জেনিভায় এই মুদ্রার তৎকালীন অজ্ঞাতপরিচয় অধিকারী একটি নিলামে বিক্রয়ের জন্য দেওয়ার পর এই অসামান্য মুদ্রাটি সাময়িকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ঐ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি মুদ্রাটি নিলামের সর্বোচ্চ ডাকের মূল্যে বিক্রয় করতে রাজি না হওয়ায়, মুদ্রাটি ঐ নিলামসংস্থা বিক্রেতার কাছে ফিরিয়ে দেয় এবং মুদ্রাটি কোন একটি সুইস ব্যাঙ্কের ভল্টে রাখা হয়। এরপর এই মুদ্রাটি আর কখনও প্রকাশ্যে আসে নি। জাহাঙ্গিরের এই বৃহত্তম স্বর্ণমুদ্রার বর্তমান অবস্থান রহস্যাবৃত। অনুমান করা হয়, বর্তমানে কুয়েতের একটি শিল্প সংগ্রহশালায় এই স্বর্ণমুদ্রাটি সংরক্ষিত রয়েছে।  

রাশিচক্র স্বর্ণমুদ্রা

চিত্র ৩: রাশিচক্র স্বর্ণমুদ্রা

আকবর প্রচলিত তারিখ-ই-ইলাহি সৌর পঞ্জিকার ১২টি সৌর মাস সূর্যের রাশিচক্রের ১২টি রাশিতে অবস্থানের ভিত্তিতে গণনা করা হত। জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের প্রথম দিকের মুদ্রায় হিজরি সনের সঙ্গে তারিখ-ই-ইলাহি পঞ্জিকার সৌর মাসের ফার্সি নামও উল্লেখ করা থাকত। রাজত্বকালের ত্রয়োদশতম বর্ষে (১০২৭ হিজরি সন = ১৬১৮ সাধারণাব্দ) জাহাঙ্গির এক নতুন ধরনের মুদ্রার প্রচলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি সৌরমাসের নামের পরিবর্তে ঐ মাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাশির চিত্র খোদিত স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রচলন করেন। রাশিচক্র মুদ্রাগুলির অধিকাংশই আগ্রার রাজকীয় টাঁকশালে নির্মিত। ‘তুজুক-ই-জাহাঁগীরী’র একটি চিত্রিত পাণ্ডুলিপিতে যেখানে জাহাঙ্গিরের রাশিচক্র মুদ্রা প্রচলনের সিদ্ধান্তের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, সেখানে রাশিচক্র স্বর্ণমুদ্রাগুলির প্রতিকৃতি সম্বলিত একটি অনন্য অণুচিত্রও সন্নিবিষ্ট। রাশিচক্র স্বর্ণমুদ্রা জাহাঙ্গিরের জীবনাবসানের স্বল্পদিনের মধ্যেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছিল। দুর্লভ রাশিচক্র স্বর্ণমুদ্রাগুলির প্রতি সংগ্রাহকদের আকর্ষণের কারণে পরবর্তীকালে বহু নকল মুদ্রা নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রতিকৃতি স্বর্ণমুদ্রা

চিত্র ৪: প্রতিকৃতি স্বর্ণমুদ্রা

জাহাঙ্গির সম্ভবত ভারতের মধ্যযুগের ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকদের মধ্যে বিরলতম ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর স্বর্ণমুদ্রায় নিজের প্রতিকৃতি খোদাই করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সেই প্রতিকৃতিতে তাঁর হাতে ধরা রয়েছে পানপাত্র। ১৬০৫ সাধারণাব্দে সিংহাসনে আরোহণের পর প্রথম তিনি তাঁর পিতা আকবরের প্রতিকৃতি খোদাই করে এক মোহরের স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেন। এরপর, তিনি রাজত্বকালের ষষ্ঠ বর্ষে (১০২০ হিজরি সন = ১৬১১ সাধারণাব্দ) নিজের প্রতিকৃতিযুক্ত স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন। এই মুদ্রাগুলির এক পিঠে জাহাঙ্গিরের আবক্ষ প্রতিকৃতি ও অন্য পিঠে মোগলদের রাজকীয় প্রতীক একটি সিংহের উপর অবস্থিত সূর্য খোদিত। এই মুদ্রাগুলিতে জাহাঙ্গিরের মাথার পিছনে একটি জ্যোতির্বলয় প্রদর্শিত হয়। জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের নবম বর্ষ পর্যন্ত এই প্রতিকৃতি স্বর্ণমুদ্রা নির্মিত হয়। জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম বর্ষ পর্যন্ত নির্মিত প্রতিকৃতি স্বর্ণমুদ্রাগুলি কোন টাঁকশালে নির্মিত হয়েছিল জানা যায় নি, কারণ মুদ্রার উপর কোনও টাঁকশালের নাম খোদিত নেই। এই স্বর্ণমুদ্রাগুলিতে জাহাঙ্গিরের প্রতিকৃতিকে ঘিরে খোদিত রয়েছে একটি সুন্দর ফার্সি বয়েৎ:

“ক়জ়া বর সিক্কা জ়র কর্দ তসবির।

শবীহ্ হজ়রত শাহ জাহাঁগীর।” 

অর্থাৎ, ‘অদৃষ্ট এই স্বর্ণের উপর শাহ জাহাঙ্গিরের প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছে।’

জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের নবম বর্ষে (১০২৩ হিজরি সন = ১৬১৫ সাধারণাব্দ) প্রচলিত প্রতিকৃতি স্বর্ণমুদ্রা আজমের টাঁকশালে নির্মিত হয়েছিল। নবম বর্ষে প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রার এক পিঠে জাহাঙ্গিরের ডান হাতে পানপাত্র নিয়ে সিংহাসনে উপবিষ্ট প্রতিকৃতি ও অন্য পিঠের কেন্দ্রে একটি চতুষ্কোণের মধ্যে সূর্যের চিত্র খোদাই করা হয়, এবং যুক্ত হয় আর একটি নতুন অর্থবহ ফার্সি বয়েৎ:

“হরুফ় ‘জাহাঁগীর’ ওয়া ‘আল্লাহু আকবর’।

জ় রোজ় অজ়ল দর অদদ্ শুদ বরাবর।” 

অর্থাৎ, ‘সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই ‘জাহাঙ্গির’ ও ‘আল্লাহু আকবর’ উভয় শব্দেরই অক্ষরগুলির সংখ্যাগত মান একই।’

এই প্রতিকৃতিযুক্ত স্বর্ণমুদ্রাগুলি সম্ভবত মোগল সাম্রাজ্যের অভিজাতবর্গকে উপহার দেবার জন্য নির্মিত হত।

নূরজাহানি স্বর্ণমুদ্রা

চিত্র ৫: নূরজাহানি স্বর্ণমুদ্রা

জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের ঊনবিংশতম বর্ষে (১০৩৩ হিজরি সন = ১৬২৩-১৬২৪ সাধারণাব্দ) মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান কার্যত সমস্ত ক্ষমতা অধিকার করে নেন। এই সন থেকে নূরজাহান বাদশা বেগমের নাম খোদিত স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। আগ্রা, আহমদাবাদ, আকবরনগর (রাজমহল), ইলাহাবাদ, কাশ্মীর (শ্রীনগর), লাহোর, পাটনা ও সুরতের মোগল টাঁকশালে এই স্বর্ণমুদ্রাগুলি নির্মিত হয়েছিল। এই মুদ্রার উপর লেখা হয় একটি আকর্ষণীয় ফার্সি বয়েৎ:

“ব হুকম শাহ জাহাঁগীর ইয়াফ়ত সদ জ়েবর।

ব নাম নূরজাহাঁ বাদশাহ বেগম জ়র।”

অর্থাৎ, ‘শাহ জাহাঙ্গিরের আদেশে স্বর্ণ শতগুণ সৌন্দর্য পেল, যখন, নূরজাহান বাদশাহ বেগমের নাম তার উপর লেখা হল।’

নূরজাহানের নামাঙ্কিত রাশিচক্র স্বর্ণমুদ্রাও সেই সময় প্রচলিত হয়েছিল। ১৬২৭ সালের ৬ নভেম্বর জাহাঙ্গিরের শাসনের অবসান পর্যন্ত নূরজাহানি স্বর্ণমুদ্রা নির্মিত হয়েছিল। আজ অবশ্য এই নূরজাহানি স্বর্ণমুদ্রা অত্যন্ত দুস্প্রাপ্য। তার কারণ, শাহজাহান ক্ষমতাসীন হয়েই নূরজাহানি স্বর্ণমুদ্রা বাতিল করে দিয়ে সমস্ত মুদ্রা গলিয়ে ফেলতে নির্দেশ দেন। এমনকি কেউ এই স্বর্ণমুদ্রা বিনিময় করলে তার প্রাণদণ্ড হবে বলে তিনি ফরমান জারি করেন।

শেষকথন

মোগল আমলে, বিশেষ করে জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে, ভারতে যে পরিমাণ সোনা বা রূপো খনি থেকে উত্তোলিত হত, তার পরিমাণ নগণ্য। ভারতে মুদ্রার জন্য ব্যবহৃত সোনা বা রূপো মূলত বিদেশ থেকে আমদানি করা হত বা বৈদেশিক বাণিজ্যের সূত্রে ভারতে আসত। ভারতীয় বণিকরা বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সাধারণত কাপড় বা মশলার বিনিময়ে সোনা বা রূপোই গ্রহণ করতেন। জাহাঙ্গিরের আমলে মোগল টাঁকশালে মুদ্রিত স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার সংখ্যার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি তৎকালীন ভারতের উচ্চবর্গের উদ্বৃত্ত বাণিজ্যের দৌলতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করে। পাশাপাশি, মুদ্রাস্ফীতির ফলে নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক দুরবস্থার বৃদ্ধির দিকেও ইঙ্গিত করে।

এই আমলে বিনিময়ের মুখ্য মাধ্যম ছিল রৌপ্যমুদ্রা ‘রূপয়া’। অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ লেনদেনের জন্য মুদ্রার পরিবর্তে কাগজে লেখা হুন্ডিও ব্যবহার করা হত। সাধারণ প্রজাদের ক্ষেত্রে বিনিময় বা বেতনের জন্য তামার মুদ্রা ‘দাম’ ব্যবহার হত। এই সময় আরও কম মূল্যের তামার মুদ্রা, যেমন ‘আধেলা’ (= ১/২ ‘দাম’), ‘পৌলা’ (= ১/৪ ‘দাম’) বা ‘দামরি’ও (= ১/৮ ‘দাম’) প্রচলিত ছিল। বাংলা বা পূর্ব ভারতের অন্যত্র বিনিময় মাধ্যম হিসাবে কড়িরও প্রচলন ছিল। জাহাঙ্গিরের প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রা কেবল তাঁর দরবারের অভিজাতবর্গ এবং বিদেশি রাজদূতদের উপহারের জন্যই নির্মিত হত, এবং মূলত উচ্চবর্গের সঞ্চয়ের কাজে লাগত। সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থানের কারণে এই অপ্রতিম সোনার মোহরগুলি তখনকার মতোই আজও সমানভাবে আকর্ষণীয় রয়ে গেছে।

তথ্যসূত্র

১. C.R. Bruce, J.S. Deyell, N. Rhodes, and W.F. Spengler edited, The Standard Guide to South Asian Coins and Paper Money since 1556 AD; Iola: Krause Publications, 1981.

২. D. Devdas, B. Khindaria, and A.K. Menon, “Rare Mughal coins put up for auction in Switzerland, Indian Government tries to get back” in India Today, December 15, 1987.

৩. Parameshwari Lal Gupta, Coins; New Delhi: National Book Trust, 1969, pp. 119-122.

৪. S.H. Hodiwala, Historical Studies in Mughal Numismatics; Bombay: The Numismatic Society of India, 1976 (1923).

৫. S. Lane-Poole, The Coins of the Moghul Emperors of Hindustan in the British Museum. London: Trustees of the British Museum, 1892.

৬. Dilip Rajgor, Collector’s Guide to Mughal Coins. Mumbai: University of Mumbai, Dinesh Mody Numismatic Museum, 2002.

৭. C.J. Rodgers, “Couplets or ‘Baits’ on the coins of Sháh Nuru-d-dín Jáhángír, the son of Akbar” in Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. LVII, Part I; Calcutta: Asiatic Society, 1889, pp. 18-26.

৮. W.M. Thackston edited and translated, The Jahangirnama: Memoirs of Jahangir, Emperor of India; New York: Oxford University Press, 1999.

৯. R.B. Whitehead, Catalogue of Coins in the Panjab Museum, Lahore, Vol. II, Coins of the Mughal Emperors; Oxford: Clarendon Press, 1914.

১০. R.B. Whitehead, “The Portrait Medals and Zodiacal Coins of the Emperor Jāhāngīr, Part I: The Portrait Medals” in The Numismatic Chronicle and Journal of the Royal Numismatic Society, Fifth Series, Vol. IX; London: Bernard Quaritch, 1929, pp. 1-25.

১১. R.B. Whitehead, “The Portrait Medals and Zodiacal Coins of the Emperor Jāhāngīr, Part II: The Zodiacal Coins” in The Numismatic Chronicle and Journal of the Royal Numismatic Society, Fifth Series, Vol. XI; London: Bernard Quaritch, 1931, pp. 91-130.

১২. H.N. Wright, Catalogue of the Coins in the Indian Museum, Calcutta, Vol. 3, Mughal Emperors of India; Oxford: Clarendon Press, 1908.

১৩. A. Liddle, Coins of Jahangir: Creations of a Numismatist; New Delhi: Manohar Publishers and Distributors, 2013.

১৪. A.S. Thakur, Coins of Jahangir; Nagpur: Indian Coin Society, 2006.

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক এবং বিগত তিন দশক ধরে বিমান প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত। ইতিহাসের আগ্রহী পাঠক। ইতিহাস নিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত সাম্প্রতিক।

মন্তব্য তালিকা - “জাহাঙ্গিরের সোনার মোহর”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।