সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ভারতের সামাজিক ইতিহাসে বর্ণ ব্যবস্থার সূচনা বিষয়ে কিছু অনুসন্ধান

ভারতের সামাজিক ইতিহাসে বর্ণ ব্যবস্থার সূচনা বিষয়ে কিছু অনুসন্ধান

সৌভিক ঘোষাল

এপ্রিল ২০, ২০২৪ ২৯২ 0

ভারতে বর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভব কবে হয়েছিল? বর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভব প্রসঙ্গে কেউ কেউ ইঙ্গিত করেন ঋগ্বেদের পুরুষ সূক্তের দিকে। যেখানে বলা হয়েছে – যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে বা হবে সকলেই সেই পুরুষ থেকে উদ্ভূত। এই পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, দুই বাহু থেকে রাজন্য, ঊরু থেকে বৈশ্য এবং দুই পা থেকে শূদ্রের উৎপত্তি হয়েছে। পুরুষসূক্তের উল্লেখ পাওয়া যায় অথর্ববেদ (১৯।৬), সামবেদ (৬।৪), যজুর্বেদ (বাজসনেয়ী সংহিতা ৩১।১-৬) ও তৈত্তিরীয় আরণ্যকের (৩।১২,১৩) মতো বৈদিক গ্রন্থে। বাজসনেয়ী সংহিতা (৩১।১-৬), সামবেদ সংহিতা (৬।৪) ও অথর্ববেদ সংহিতায় (১৯।৬) এই সূক্তের অর্থব্যাখ্যা সহ উল্লেখ পাওয়া যায়। পৌরাণিক সাহিত্যের মধ্যে ভাগবত পুরাণ (২।৫।৩৫ থেকে ২।৬।১-২৯) ও মহাভারতে (মোক্ষধর্মপর্ব ৩৫১ ও ৩৫২) এই শ্লোকের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তবে এই পুরুষসূক্তটি যে ঋগ্‌বৈদিক যুগের অনেক পরবর্তীকালের রচনা এবং ঋগ্বেদের সবচেয়ে অর্বাচীন দশম মণ্ডলে পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত, সে সম্পর্কে পণ্ডিতেরা প্রায় নিশ্চিত। ঋগ্বেদের অন্য কোনও অংশে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র – এই চার বর্ণের উল্লেখ নেই, এই শব্দগুলি কোনও স্থানে শ্রেণি বিশেষ বোঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয় নি। ঋগ্বেদ রচনা কালে ভারতীয় সমাজের মধ্যে যে জাতি বিভাগ ছিল না, সেকথা আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে পরে বোঝার চেষ্টা করব। এও দেখার চেষ্টা করব যে জাতিভেদ এর উৎপত্তি ঠিক কোন সময়ে। কিন্তু বৈদিক ও পরবর্তী পর্বের এই আলোচনায় ঢোকার আগে প্রাক বৈদিক ভারত ইতিহাসের বিভিন্ন পরিযান ও প্রত্নসভ্যতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা দরকার।

পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে ‘হোমো সেপিয়েন্স’-এর দলগুলি ভারতে এসে ছড়িয়ে পড়া ও বংশবৃদ্ধি করার পর্বটা চলতে থাকে। প্রায় পঞ্চান্ন হাজার বছর ধরে আর সেরকম কোনও উল্লেখযোগ্য পরিযান এর মধ্যে ভারতে হয়নি। পরিযানের নতুন অধ্যায় শুরু হলো আজ থেকে ন হাজার বছর আগে। খ্রিস্টপূর্ব সাত হাজার বছর আগে থেকে একটানা কয়েক হাজার বছর ধরে ইরানের জাগরোস অঞ্চল থেকে একটি পরিযান শুরু হয় দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। ভারতে প্রবেশ করে তারা অন্তত ৪৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তাদের বংশধারা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছিল বলে জিন গবেষকরা মনে করেছেন। এরা কৃষিকাজ জানতো। এদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের সংমিশ্রণে দ্রাবিড় জাতি তৈরি হয়েছে এবং তারাই সিন্ধু সভ্যতার পত্তনকারী – এরকম একটি অভিমত অনেকেই প্রকাশ করেছেন।

হরপ্পা অঞ্চলে জনবসতির প্রাথমিক বিকাশ ঘটছিল আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে। অবশ্য তাম্র ব্রোঞ্জ যুগের যে সিন্ধু সভ্যতার কথা আমরা জানি এটি সেই পর্যায়ের কথা নয়। এই পরিণত হরপ্পা সভ্যতা ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ বিকশিত হয়েছিল এবং তা মোটামুটি ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ স্থায়ী ছিল। এর আগেই বর্তমান ভারতের অন্তর্গত কালিবঙ্গান ও রাখিগরি এবং পাকিস্থানের বানোয়ালি ও রহমান ডেহরিতে খানিকটা সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে ওঠার প্রমাণ ছিল। ক্রমশ নতুন নতুন শহরে সভ্যতার প্রসার ও বিকাশ ঘটে। ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়। উন্নত নগর পরিকল্পনা দেখা যায়। হরপ্পা সভ্যতার সবকটি অঞ্চল একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অধীনে আসে। একই ধরনের সিল, লিপি, চিহ্ন ও পরিমাপক সব জায়গায় ব্যবহৃত হতে থাকে। হরপ্পা সভ্যতার প্রধান শহরগুলোর মধ্যে ছিল হরপ্পা, মহেনঞ্জোদাড়ো, কালিবঙ্গান, ধোলাবীরা, লোথাল, রাখিগড়ি, সুক্তাজেনদার, আলমগীরপুর, কোট ডিজি, চানহুদারো, সুরকোতদা প্রভৃতি। সিন্ধু এবং পাঞ্জাব এই সভ্যতার কেন্দ্রস্থল হলেও এর চারপাশে এই সভ্যতা ছড়িয়েছিল। সিন্ধু এবং তার শাখানদী উপনদীগুলো ছাড়াও ঘর্ঘর হকরার মতো নদী এই সভ্যতার বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।

হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক গড়ন প্রসঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ পুরাতত্ত্ববিদ শিরিন রত্নাগর জানিয়েছেন যে অপরিণত হলেও হরপ্পার সময়ে তর্কাতীতভাবেই রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহের অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন অংশে সুসংহত নকশায় একটার পর একটা বসতি গড়ে ওঠার যে প্রমাণ মিলেছে তা তখনই কেবল গড়ে ওঠা সম্ভব, যখন উন্মেষপর্বেই এর ধারণা ও নকশাটি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মর্টিমার হুইলার হরপ্পা সভ্যতার একাংশে সেনানিবাশ বা ব্যারাকের অস্তিস্ত্ব ছিল বলে মনে করেছেন। তবে শিরিন রত্নাগরের মতে এটা খুবই ছোট একটা দলের থাকার মতো বসতি। পেশাদার বা স্থায়ী সৈন্যবাহিনী সেকালে ছিল না বলেই তাঁর অভিমত। মেসোপটেমিয়ার মতো বড় রাজার প্রাসাদ এখানে পাওয়া না গেলেও মহেঞ্জোদাড়োতে যে প্রতিরক্ষা দুর্গ পাওয়া গেছে তা প্রাসাদোপম একটি স্থাপত্য ছিল বলেই তিনি মনে করেছেন। হরপ্পা সভ্যতার বিশাল এলাকা জুড়ে ওজন মাপার ক্ষেত্রে এমন একটি সমরূপ পদ্ধতির জন্ম হয়েছিল, যা কিছুতেই ব্যাপক বাণিজ্যের আপন স্বকীয়তায় গড়ে উঠতে পারে না, যদি না কোনও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ তা বাধ্যতামূলকভাবে চালু করে। কেবল রাষ্ট্রীয় সংহতিই বাণিজ্যের বিনিময় মানদণ্ডকে এভাবে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে। মেসোপটেমিয়ার সমগ্র এলাকাটি উর রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে আসার আগে সেখানে অঞ্চলভেদে ওজন মাপার নানান পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, এটাও এই প্রসঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। তবে হরপ্পার রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে এটা মনে রাখা জরুরী এই কাঠামো একটি আদিম জনজীবনের ভিতের ওপর গড়ে উঠেছিল। হরপ্পা সভ্যতার সময়কালেও অনেক আদিম প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে টিকে ছিল। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী সম্ভবত তাদের গোত্র ও কুলের স্বাতন্ত্র্যকে তখন স্বীকৃতি দিত। সমাজে কর্মভিত্তিক শ্রেণি বিভাজন অবশ্যই ছিল। তবে শিরিন রত্নাগরের এই মন্তব্যটি বর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভবের ইতিহাস খোঁজার সময় আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, “মহেঞ্জোদাড়োতে বর্ণবিভাজনের চিহ্ন খুঁজে বেড়ানো সে যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন”। আমরা পরে দেখব ঋকবৈদিক কাল পর্যন্তও ভারতে বর্ণবাদের অস্তিত্ব ছিল না।

হরপ্পা সভ্যতার প্রায় সমসাময়িক আমুদরিয়া নদীর ধারে গড়ে ওঠা বিখ্যাত ব্যাকট্রিয়া–মার্জিয়ানা প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার সভ্যতা, যার সময়কাল ২৩০০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলে চিহ্নিত হয়েছে। হরপ্পা সভ্যতার সমসাময়িক এই প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার সঙ্গে হরপ্পার ব্যবসা বাণিজ্যর অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের নানা জায়গায় কৃষিকাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। পূর্ব রাজস্থান, দক্ষিণ ভারত, মধ্য ভারতের বিন্ধ্য অঞ্চল, পূর্ব ভারত এবং কাশ্মীরের সোয়াত উপত্যকায় কৃষিকাজ ছড়িয়ে পড়ার অনেক প্রমাণ আছে।

২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কাল জুড়ে কাজাখ তৃণভূমি অঞ্চল থেকে পশুপালকদের কয়েকটি দল মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্থান, উজবেকিস্থান, কাজাকিস্থান হয়ে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ায় চলে আসে। একই সময়ে কৃষ্ণসাগরের আশেপাশের তৃণভূমি অঞ্চল থেকেও শুরু হয় ধারাবাহিক পরিযান। তারাই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাটি বয়ে নিয়ে আসে, যার প্রচলিত নাম আর্য ভাষা।

খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে যখন উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এই পরিযায়ীরা আসছিলেন সেই সময়েই চিনা উৎস থেকে জন্ম নেওয়া পরিযায়ীদের দুটি তরঙ্গ পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতে চলে আসে। এদের একটি ধারা নিয়ে আসে অস্ট্রো এশিয়াটিক ভাষাগুলির প্রত্নরূপ, বিশেষ কয়েক ধরনের গাছগাছালি ও ধানের এক নতুন প্রজাতি। এরা এক ধরনের কৃষিবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল এবং তার ফলে তাদের জনসংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। গোটা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জনবিন্যাস তারা অনেকটা বদলে দেয়।

উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব ভারতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে নানা উৎসের এই ধারাবাহিক পরিযানগুলি যখন চলছিল তখন হরপ্পা সভ্যতার অন্তিম পর্ব। যার শুরু ১৯০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এবং ১৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্যে হরপ্পা সভ্যতা বিলুপ্ত হয়।

আর্যভাষীদের সমাজ ব্যবস্থা বা ঋকবৈদিক যুগের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে কথা শুরু করার সময় আমরা কয়েকটি শব্দের দিকে প্রথমে নজর দিতে চাইবো। শব্দগুলি আজকের সমাজ কাঠামোয় জাতিবাচক কোনও শব্দ নয়, কিন্তু ভারতের সমাজ ব্যবস্থায় গোত্র বিভাজনের আদি পর্ব বৈদিক যুগকে বুঝতে এই শব্দগুলি অপরিহার্য। আর্য, দাস, দস্যু, অসুর, নিষাদ, পণি এই শব্দগুলির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করা যাক।

প্রথমেই আসা যাক আর্য শব্দটি প্রসঙ্গে। আর্য শব্দ ও প্রসঙ্গটি নিয়ে যে প্রবল আলোড়ন সমাজ রাজনীতি ইতিহাসের জগতে হয়েছে, তার তুলনা কমই পাওয়া যাবে। এই শব্দটির তাৎপর্য, অর্থ, ব্যবহার নিয়ে তর্ক বিতর্ক, তাকে ঘিরে রাজনীতি বিশ শতকের তিন ও চারের দশকের ইউরোপে চরমে উঠেছিল। হিটলারের নাজিবাদ, তৃতীয় রাইখ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই শব্দটির ভূমিকার কথা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। ভারত ও ভারতবিদ্যা সম্পর্কিত চর্চাতেও এই শব্দটি নিয়ে অষ্টাদশ শতক থেকে আলোচনা কম হয় নি। বিশ একুশ শতকের সন্ধিলগ্ন থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে শব্দটি আবার নতুন করে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। জ্ঞানচর্চার জগৎটিও রাজনীতি ও বিতর্ক নিরপেক্ষ নেই। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রচুর বইপত্র ও প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে এবং এই গবেষণা ও তার উপাত্তগুলিও প্রায়শই নিরপেক্ষ জ্ঞানচর্চার বদলে নির্দিষ্ট শিবিরের মতাদর্শের প্রতিফলন বলে ব্যাখ্যাত হচ্ছে।

আর্য ভাষা সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাতের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ তথা এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোন্স-এর নামই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর আগেও কোনও কোনও বণিক ভারতীয় ও ইউরোপীয় ভাষার সম্পর্ক নিয়ে কিছু ইঙ্গিত করেছিলেন, কিন্তু জোন্স এর আগে বিষয়টি নিয়ে কেউ বিধিবদ্ধ আলোচনা করেননি। এই বিধিবদ্ধ আলোচনা শুরু হয়, যখন জোন্স ১৭৮৬ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর তৃতীয় বার্ষিক বক্তৃতাটি প্রদান করেন (The Third Anniversary Discourse)। ঐ বক্তৃতায় তিনি প্রমাণাদিসহ দাবি করেন যে, ইউরোপীয় ভাষা এবং সংস্কৃতের তুলনামূলক আলোচনায় তিনি লক্ষ করেছেন যে, গ্রিক, ল্যাটিন, গথিক ও কেলটিক এবং সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষার উৎস একই। আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর পণ্ডিতগণ একমত হন যে, স্যার উইলিয়াম জোনস-এর ধারণা সঠিক। জোনস বিশ্ব ভাষাবিজ্ঞানের জনকের মর্যাদা লাভ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ও সাংস্কৃতিক ভাষাতত্ত্ব বা ফিললজির মতো বিষয়গুলি। ইংরেজদের ভারত শাসনের সূত্র ধরে ভারতবিদ্যা বা ইন্ডোলজির গুরুত্বও অপরিসীম হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে প্রচুর গবেষণা ও লেখালেখি প্রকাশিত হতে থাকে। বিভিন্ন ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারততত্ত্ব ও সংস্কৃত বিষয়ে গবেষণা অধ্যাপণার জন্য আকর্ষণীয় চেয়ার প্রফেসর পদ তৈরি হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এই চেয়ার অধ্যাপকের পদে বৃত হন জার্মান অধ্যাপক ম্যাক্সমুলার এবং তিনি ভাষাতত্ত্বের এলাকা ছাড়িয়ে একটি আর্য জাতির ধারণাকে সামনে নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে ম্যাক্সমুলার স্বয়ং আর্যদের কোনও নির্দিষ্ট জাতি নয়, একটি ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে সংশোধিত মত প্রকাশ করলেও আর্য জাতির ধারণাটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয় এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পণ্ডিত মহলে আর্য জাতির ধারণা অনেকদিন আগেই বাতিল হয়ে গেলেও সাধারণ জনসমাজে তো বটেই এমনকি বইপত্র বা প্রবন্ধ নিবন্ধে এই আর্য জাতির ধারণাটি এখনো অনেকাংশে বলবৎ আছে। আর্য শব্দটিকে জাতি হিসেবে নয়, ভাষাভাষী হিসেবে ব্যাখ্যা করেও অবশ্য অনেক বইপত্র লেখা হচ্ছে জনসমাজের জন্য, জনমনের দীর্ঘলালিত ভুলকে মোছার চেষ্টা হচ্ছে।

১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় এইচ ডব্লু বেইলির ‘ইরানিয়ান আরিয়া অ্যান্ড দহ’ নামের একটি প্রবন্ধ। সেখানে তিনি দেখান ঋগ্বেদের যে সব জায়গায় আর্য শব্দটির ব্যবহার হয়েছে, সেগুলো থেকে একই ধরনের জাতিগত অর্থ বের করা যায় না। ব্যুৎপত্তিগতভাবে শব্দটি অর্‌ ধাতু নিষ্পন্ন হতে পারে, যার অর্থ পাওয়া। ইরানীয় উল্লেখে আর্য শব্দটির অর্থ অভিজাত। বেদোত্তর সংস্কৃত এবং বৌদ্ধ ও জৈন রচনাতেও শব্দটি অভিজাত বা সভ্য অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। ঋগ্বেদে যে আর্যভাষী জনগোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে, তারা হয়তো একই নৃকুল ভুক্ত ছিলেন না, একটি জাতি ছিলেন না। তবে একই ভাষা ও জীবনযাত্রার ধরন তাদের একটি নিজস্ব পরিচয় দিয়েছিল।

এবার আসা যাক দাস ও দস্যু শব্দ দুটি প্রসঙ্গে। ঋগ্‌বেদে এই শব্দ দুটি ঘুরে ফিরে এসেছে। কিন্তু এই শব্দ দুটি সমার্থক নয় এবং একই ধরনের লোককে এই শব্দ দুটি দ্বারা বোঝানো হয় নি। দাসরা অন আর্য ভাষী ছিলেন না, কিন্তু দস্যুদের ভাষা ছিল আলাদা। আর্য হিসেবে যে অভিজাতরা উল্লিখিত হয়েছেন, তারা যেমন ‘বিশ’ নামের জনগোষ্ঠীতে সংঘবদ্ধ ছিলেন, দাসেরাও তাই ছিলেন। আর্য এবং দাসদের মধ্যেকার যে সব সংঘাতের কথা ঋগ্বেদে রয়েছে, তা সম্ভবত একই ভাষা ও জনগোষ্ঠীর দুই আলাদা দলের আভ্যন্তরীণ সংঘাত। আর্য গোষ্ঠীর প্রধান দেবতা ইন্দ্র দাস ও দস্যু উভয়ের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছেন। বিভিন্ন স্তোত্রে এইসব যুদ্ধের কথা রয়েছে। কিন্তু স্তোত্রগুলি দাস ও দস্যুদের সমান শত্রু হিসেবে দেখেনি। ঋগ্‌বেদের অনেক সূক্ত অথর্ববেদেও এসেছে। এই সমস্ত সূত্রগুলি থেকে মনে হয়, ইন্দ্র দাসদের বশ্যতা স্বীকার করিয়েছেন আর দস্যুদের সমস্ত গুণ কেড়ে নিয়েছেন। দাসদের চেয়ে দস্যুদের ধ্বংস করা ও বশ্যতা স্বীকার করানোর সংখ্যা ঋগ্বেদে বেশি। দস্যুহত্যার অন্তত বারোটি উল্লেখ ঋগ্বেদে রয়েছে কিন্তু দাসদের হত্যার কথা থাকলেও শব্দবন্ধ হিসেবে দাসহত্যা শব্দটির উল্লেখ কোথাও নেই বলে অধ্যাপক রামশরণ শর্মা তাঁর ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন (পৃ. ১০)। তাঁর মতে “দস্যুদের ক্ষেত্রে আর্যরা নির্মমভাবে বিলুপ্ত করে দেওয়ার নীতি মেনে চলতেন, কিন্তু দাসদের ক্ষেত্রে তাঁর আচরণ ছিল অনেকটা সংযত”। (এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য পাঠক দেখতে পারেন: দেব রাজ চানানা, ‘প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথা’)

দস্যুদের জীবনযাত্রার ধরন আর্যদের চেয়ে অনেকটা আলাদা ছিল। আর্যরা যাগযজ্ঞের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন, কিন্তু যজ্ঞের সঙ্গে দস্যুদের কোনও সম্পর্কই ছিল না। ঋগ্‌বেদের সপ্তম মণ্ডলের ৬ নং সূক্ততে দস্যুদের সম্পর্কে ‘অক্রতূন’, ‘অযজ্ঞান’ ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। অথর্ববেদে দস্যুদের ‘মায়াবান’ বা অশুভ জাদুর চর্চাকারী বলা হয়েছে। আর্যরা বিভিন্ন ব্রত মানত, কিন্তু দস্যুরা মানত না বলে তাদের ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূক্তে ‘অব্রত’, ‘অন্যব্রত’ ইত্যাদি বলা হয়েছে। দাসদের প্রতি কিন্তু এই ধরনের কোনও বিশেষণ প্রয়োগ করা হয় নি। আর্যদের সঙ্গে দস্যুদের গায়ের রঙের পার্থক্যের কথাও ঋগ্‌বেদে এসেছে। সপ্তম মণ্ডলের পঞ্চম সূক্ততে বলা হয়েছে আর্যরা অনেক সময় কালো মানুষদের বসতিতে আগুন লাগিয়ে দিতেন। কালোরা তাদের যাবতীয় সম্বল ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হতেন। নবম মণ্ডলের একচল্লিশ নং সূক্তে বলা হয়েছে আর্যদেবতা সোম হলেন কৃষ্ণচর্ম লোকেদের ঘাতক। দস্যুদেরই সম্ভবত কালো মানুষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদের চতুর্থ মণ্ডলের ১৬ নং সূক্তের ১৩ নং ঋকে ইন্দ্র কর্তৃক পঞ্চাশ হাজার ‘কৃষ্ণ’ নিধনের কথা আছে। ঋগ্বেদের অষ্টম মণ্ডলের ৯৬ নং সূক্তে কৃষ্ণ নামক জনৈক বীরের সঙ্গে ইন্দ্রের যুদ্ধের কথা রয়েছে। সূক্তটি বলেছে, কৃষ্ণ যখন অংশুমতি বা যমুনা নদীর তীরে দশ হাজার সৈন্য নিয়ে শিবির গড়েন, ইন্দ্র তখন আর্য বিশ বা গোষ্ঠীদের সংগঠিত করেন। সায়ণভাষ্য অনুযায়ী এই কৃষ্ণবর্ণ প্রতিপক্ষরা হলেন কালো রঙের অসুর (কৃষ্ণরূপাঃ অসুরসেনাঃ)। দস্যুদের সম্পর্কে ‘অনাস’ বিশেষণটি প্রযুক্ত হয়েছে। একালের পণ্ডিতেরা মনে করেছেন এই শব্দটি দিয়ে খর্ব নাসা বোঝানো হয়েছে। ঋগ্‌বেদের বিভিন্ন জায়গায় ‘মৃধ্রবাক’ শব্দটি রয়েছে। দুটি জায়গায় (৫/২৯/১০; ও ৮/৬/৩ – মণ্ডল/সূক্ত/ঋক এই ক্রমে) শব্দটিকে দস্যুদের বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর্য ও দস্যুদের বাক্‌রীতির পার্থক্যর কথা এখানে আছে বলে মনে হয়। আর্যদের সঙ্গে দস্যুদের লড়াইয়ের ছবি ঋগ্বেদ জুড়ে রয়েছে। দস্যুদের অনেক পুর বা পাঁচিল ঘেরা বসতি বা দুর্গ ছিল। বিভিন্ন সূক্ততে এই পুরের কথা এসেছে। যেমন প্রথম মণ্ডলের ১০৩ নং সূক্তের ৩ নং ঋক, দ্বিতীয় মণ্ডলের ১৯ নং সূক্তের ৬ নং ঋক, চতুর্থ মণ্ডলের ৩০ নং সূক্তের ২০ নং ঋক, ষষ্ঠ মণ্ডলের ২০ নং সূক্তের ১০ নং ঋক। যুদ্ধের সময় আর্যেরা এই দুর্গ আর পাঁচিল ঘেরা বসতি ভেঙে দিতেন। হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের সঙ্গে আর্যদের গণ সংঘর্ষের কোনও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। কারণ হরপ্পা সভ্যতার পতনের কয়েকশো বছর পরে হয়ত ভারতে তাদের আবির্ভাব। তবে হরপ্পা সভ্যতা যে জনগোষ্ঠীর সভ্যতা তাঁরা পরে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েন এবং হরপ্পার মতো পুর বা পাঁচিল ঘেরা বসতি ও দুর্গ তাদেরও ছিল, এই অনুমান করা অসঙ্গত নয়।

এটা মাথায় রাখা দরকার আর্যরা প্রাক আর্য জনগোষ্ঠীর সাথে যেমন সংঘাতে জড়িয়েছিল, ঠিক তেমনই আর্যদের নিজেদের মধ্যেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অনেক প্রমাণ ঋগ্বেদে রয়েছে। ঋগ্‌বেদে আর্য শব্দটি মোট ৩৬ বার এসেছে, তার মধ্যে নয় জায়গায় আর্যদের নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ের উল্লেখ রয়েছে। আর্যদের অন্তর্দ্বন্দ্বে একাংশ দাসদের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন এবং দাস ও আর্যদের একাংশের মধ্যে পারস্পরিক মিলন প্রক্রিয়া এগিয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। ঋগ্‌বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলের ২২ নং সূক্তের ১০ নং ঋক-এ বলা হয়েছে ইন্দ্র দাসদের আর্যে পরিণত করেছিলেন। পূর্বতন অধিবাসীদের অনেককে, বিশেষত তুলনায় অগ্রসর লোকেদের যে নতুন আর্য মিশ্র সমাজে অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া হয়েছিল এবং উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, এরকম অনুমান অনেকে করেছেন। আদি অধিবাসীদের অনগ্রসর অংশ, যারা আর্যদের আধিপত্য মেনে নিয়েছিল, তাদের সম্ভবত দাস হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। আর চরম বিরোধী, যাদের বশ্যতা স্বীকার করানো সম্ভব হয়নি, সেই প্রবলতর শত্রুরাই সম্ভবত গণ্য হয়েছিল দস্যু হিসেবে। অন্য একটি মত অনুসারে দাসরা সম্ভবত ছিলেন মিশ্র ইন্দো আর্যভাষাগোষ্ঠীর এক অগ্রবাহিনী। কাসাইটরা যখন ব্যাবিলোনিয়ায় আসেন, খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দ নাগাদ, সেই সময়েই তারা ভারতে আসেন। দাসরা ছিলেন ঋগ্বেদীয় মানবগোষ্ঠীর ভাষা ও অন্যান্য কিছু সাংস্কৃতিক উপাদানের অংশভাগ, তাই তাদের সঙ্গে যতদূর সম্ভব মানিয়ে চলাই ছিল ঋগ্বেদীয় মানবগোষ্ঠীর নীতি। দিবোদাস, বল্‌বূথ, তরুক্ষের মতো দাস অধিপতিদের তাঁরা সহজেই নিজেদের সমাজের অঙ্গীভূত করে নিয়েছিলেন।

আর্যদের মধ্যেকার অন্তর্দ্বন্দ্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ রয়েছে ঋগ্‌বেদের সপ্তম মণ্ডলের ৩৩ নং সূক্তে উল্লিখিত দশ রাজার যুদ্ধের ঘটনাটিতে। এটিকে একটি ঐতিহাসিক বিবরণ বলেই গ্রহণ করা হয়, যদিও এর সন তারিখ সুনির্দিষ্ট নয়। এই দশ রাজার যুদ্ধ মূলত ঋগ্বেদীয় আর্যদের দুটি প্রধান শাখা পুরু এবং ভারতের মধ্যে সংগ্রাম। অনার্যরাও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে সূক্তটি থেকে মনে হয়। ভারতের নেতা ছিলেন ঋগ্‌বেদের বিখ্যাত নায়ক সুদাস ও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন পুরোহিত বশিষ্ঠ। এদের বিপরীতে ছিলেন দশজন রাজা। অনু, দ্রুহ্যু, যদু, তুর্বশ, পুরু – এই পাঁচ বিখ্যাত জনগোষ্ঠীর রাজাদের সঙ্গে এসে মিশেছিলেন অলিন, পক্‌থ, ভলান, শিব, বিষাণী নামক পাঁচ স্বল্পপরিচিত জনগোষ্ঠীর রাজারা। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পুরুরা আর সাহায্য করেছিলেন পুরোহিত বিশ্বামিত্র। এই যুদ্ধে সুদাসের নেতৃত্বে ভারতেরা পুরুর নেতৃত্বাধীন জনগোষ্ঠীগুলিকে পরাজিত করেন।

ঋগ্বেদে আর্যদেরই মধ্যেকার একাংশ সম্পর্কে নিন্দাবাদ রয়েছে। মিউঅর ঋগ্বেদ থেকে আটান্নটি অংশ উদ্ধৃত করে তার ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, যারা ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন ছিল, তাদের সেখানে নিন্দাবাদ করা হয়েছে। ধনী কৃপণ লোকেদের পণি বলে আখ্যাত করা হয়েছে এবং তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। ধনী হওয়া সত্ত্বেও দেবতাদের কিছু উৎসর্গ না করা বা পুরোহিতদের দক্ষিণা না দেওয়ার কারণেই এই বিরূপ মনোভাব এসেছিল। রামশরণ শর্মা মনে করেছেন কালক্রমে আর্যদের অধিকাংশই অন–অভিজাত ও অর্ধ–দাসের পর্যায়ে পরিণত হয়েছিলেন, কিন্তু তা মূলত ঋক পরবর্তী বৈদিক যুগের পর্বের বিষয়। (রামশরণ শর্মা, ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’ পৃ. ২৭)।

আর্য জনগোষ্ঠীদের নিজেদের মধ্যেকার নানা ধরনের দ্বন্দ্ব এবং বাইরের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাত ও আদান প্রদানের মধ্যে দিয়ে কীভাবে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি গড়ে উঠল – সেই আলোচনার দিকে এবার এগোনো যেতে পারে। ঋগ্‌বেদে ‘বর্ণ’ শব্দটি প্রয়োগ করা হলেও তা কোনও শ্রম বিভাজনের ইঙ্গিত দেয় না। পরবর্তীকালে সামাজিক শ্রেণি বিভাজনের ভিত্তি কিন্তু হয়ে ওঠে শ্রম বিভাজন।

ঋকবৈদিক যুগে পেশা বিভাজন অবশ্যই ছিল, মর্যাদাভেদও ছিল অনুমান করা যায়, কিন্তু তার ভিত্তিতে আলাদা আলাদা সামাজিক শ্রেণি তখন তৈরি হয়ে যায়নি। বায়ু পুরাণ (১/৮/৬০) বা দীঘ নিকায় এর সাক্ষ্য থেকে মনে হয় ত্রেতা যুগের আগে অবধি কোনও বর্ণাশ্রম ছিল না। তন্তুবায়, চর্মকার, সূত্রধর ও চিত্রকরের জন্য একই সাধারণ শব্দের ব্যবহার থেকে তাদের ইন্দো-ইউরোপীয় উৎপত্তির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। (কার্ল ডারলিং, ‘আ ডিকশনারি অব সিলেকটেড সিনোনিমস ইন দ্য প্রিন্সিপাল ইন্দো ইউরোপিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস’)। রথশিল্পী বা ধাতুশিল্পীরা সমাজে যথেষ্ট মর্যাদা পেতেন, আর্যগোষ্ঠী বিশ-এর সদস্যরাই এই সব কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১০৫ নং সূক্তের ১৮ নং ঋক-এ আমরা জনৈক সূত্রধরের কথা পাই, যিনি ‘পিঠে ব্যথা না হওয়া পর্যন্ত ঝুঁকে কাজ করেন’। সূত্রধরের কাজ কঠিন এটা বোঝানো হলেও কাজটি সম্পর্কে ঘৃণা বা এমনকি তাচ্ছিল্যেরও কোনও ভাব নেই। সূত্রধর সহ কারিগরেরা যে বৈদিক যুগে নিচু জাত বা আলাদা শ্রেণির লোক ছিলেন না, তা বোঝা যায়। ঋগ্বেদের সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় কামার, ছুতোর, মুচি, তাঁতি ইত্যাদি কারিগরি বৃত্তি ছিল যথেষ্ট মর্যাদার, আর্য সমাজ বিশ-এর সম্মানীয় সদস্যরাই তাতে যুক্ত থাকতেন। তাদের শূদ্রদের পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অনেক পরবর্তী সময়কালের ব্যাপার। চতুর্বর্ণের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রাচীনতম অনুমানটি আছে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পুরুষ সূক্তে। কিন্তু এটিকে প্রক্ষেপ বলেই মনে করা সঙ্গত। জনগোষ্ঠীমূলক সমাজ ভেঙে শ্রেণিসমাজে পরিণত হওয়ার সপক্ষে একটি যুক্তি হিসেবে পরবর্তীকালে এই প্রক্ষেপ হয়ে থাকবে। ঋগ্বেদের যুগে শ্রম বিভাজন অনেকদূর এগিয়েছিল কিন্তু একই পরিবারের লোকে কবি, চিকিৎসক, শস্য পেষাইকর ইত্যাদি নানারকম পেশায় নিযুক্ত থাকত এটা বোঝা যায় ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলের ১১২নং সূক্তের ৩ নং ঋক থেকে। (রামশরণ শর্মা, ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’ পৃ. ৩০, ৩১)

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর লেখক দিওদেরাস তাঁর একটি লেখায় আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময়কার (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দ) জনৈক লেখকের একটি অংশ উদ্ধৃত করেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে আলেকজান্ডারকে রাজা পুরু জানাচ্ছেন যে গঙ্গারিডাই এর রাজার বিরুদ্ধে প্রজাদের অনেক ক্ষোভ এবং প্রজারা তাঁকে সম্মানও করে না, কারণ তিনি ‘চর্মকারের সন্তান’। এই উল্লেখটি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সে সময় চর্মকারবৃত্তিকে যথেষ্ট নিচু চোখে দেখা শুরু হয়েছিল। এই উদ্ধৃতির সঙ্গে ঋগ্বেদের অষ্টম মণ্ডলের পঞ্চম সূক্তের ৩৮ নং ঋকটির যদি তুলনা করে দেখি, তাহলে দেখব সেখানে মুচির পেশাটিকে মর্যাদার চোখেই দেখা হচ্ছে। ঋকবৈদিক পরিস্থিতি থেকে সরে এসে আলেকজান্ডারের সময়কালের মাঝের হাজার বছরের মধ্যে এই পরিবর্তন কবে কীভাবে হতে থাকল, সেটি একটি জরুরী অনুসন্ধানের বিষয়।  

অথর্ববেদ পর্বের শেষ দিক থেকেই কর্ম বিভাজন ক্রমে সামাজিক স্তর বিভাজন হয়ে উঠতে থাকল, জনগোষ্ঠী ও পরিবারগোষ্ঠী ক্রমশ সামাজিক শ্রেণিতে বিভাজিত হয়ে গেল, এমন অনুমানের সঙ্গত কারণ রয়েছে। অথর্ববেদের উনিশতম কাণ্ডের ৬ নং সূক্তের ৬ নং ঋকটি সেই পুরুষসূক্ত, যা সম্ভবত পরে ঋগ্বেদে প্রক্ষিপ্ত হয়। অথর্ববেদের উনিশ সংখ্যক কাণ্ডেই আরো দু জায়গায় চতুর্বর্ণের উল্লেখ রয়েছে। ৩২ নং সূক্তের ৮ নং ঋকে ঘাসের কাছে প্রার্থনা জানানো হয়েছে যে তিনি যেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, আর্য (বৈশ্য?) ও শূদ্রদের কাছে প্রিয় করে তোলেন। যদি মনে রাখি যে অথর্ববেদের উনিশ ও বিশ কাণ্ড দুটি মূল অথর্ববেদে পরে প্রক্ষিপ্ত, তবে এটিকে বৈদিক সংহিতা যুগের শেষতম পর্বের, খ্রিস্টপূর্ব দশম থেকে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের মধ্যবর্তী সময়কালের রচনা বলে ধরে নেওয়া যায়।

অধ্যাপক রামশরণ শর্মা তাঁর ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’ বইতে বিভিন্ন প্রমাণ সহযোগে অনুমান করেছেন সামাজিক শ্রেণি হিসেবে অথর্ববেদের আদি পর্বটিতেও শূদ্রদের উপস্থিতি ছিল না। যেমন অথর্ববেদের পঞ্চম কাণ্ডের ১৭ নং সূক্তের ৯ নং ঋক এ ব্রাহ্মণ, রাজন্য ও বৈশ্যের কথা আছে কিন্তু শূদ্রের উল্লেখ নেই।

১০

শূদ্ররা কি আর্যভাষী সমাজের ভেতর থেকে উদ্ভূত না তারা এই সমাজের বাইরের কোনও গোষ্ঠী? খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে শূদ্র নামে যে একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। দিওদেরাস লিখেছেন আলেকজান্ডার সোদ্রাই নামের এক জনগোষ্ঠীকে আক্রমণ করেছিলেন। মহাভারতেও আভীরদের সঙ্গে যুক্তভাবে শূদ্রদের এক জনগোষ্ঠী হিসেবে বারবার অভিহিত করা হয়েছে। এতে শূদ্রকুল ও শূদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যও করা হয়েছে। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের কুলের সঙ্গে শূদ্রকুলের উল্লেখ করা হয়েছে আবার আভীর, দরদ, তুখার, পল্লব এইসব জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি শূদ্র জনগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে। ভেবার তাঁর বইতে মনে করেছিলেন যে শূদ্ররা আর্যভাষীদেরই বেদবাহী তরঙ্গের আগেকার এক তরঙ্গ। পরবর্তীকালে এই মতটি পরিত্যক্ত হয়েছে। ফিক, কিথ, লাসেন, প্রমুখের গবেষণা (রামশরণ শর্মা ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’, পৃ. ৩৫) প্রমাণ করেছে শূদ্ররা প্রাক আর্য জনগোষ্ঠীরই এক শাখা। তবে শূদ্ররা প্রায় সর্বত্র আভীরীদের সঙ্গে একযোগে উল্লিখিত হয়েছেন, যে আভীরীরা একটি আর্য উপভাষাতে কথা বলতেন। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে আভীরোক্তির উল্লেখ আছে। ব্রাহ্মণের যুগের বিভিন্ন সাহিত্য থেকে অনুমান করা যায় শূদ্ররা আর্যদের ভাষা বুঝতে পারতেন। সম্ভবত ভারতে শূদ্ররা আসেন খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের শেষদিকে। পরবর্তীকালে বৈদিক আর্যভাষীদের কাছে তারা পরাজিত হয়ে বর্ণে বিভক্ত বৈদিক সমাজের নিম্নতম অংশ হিসেবে আর্যভাষী সমাজে অন্তর্ভুক্ত হন। (রামশরণ শর্মা, ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’ পৃ. ৩৭)

ডক্টর বি আর আম্বেদকর অবশ্য এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর মতে দীর্ঘকাল ধরে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সংঘাতের ফলে ক্ষত্রিয়দের অবনমিত করা হয় শূদ্রদের পর্যায়ে। এমনকি ব্রাহ্মণেরা তাঁদের প্রতিপক্ষদের উপনয়নের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেন। আম্বেদকর এক্ষেত্রে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থিত করেছেন মহাভারতের শান্তিপর্বে উল্লিখিত রাজা পৈজিবনের কাহিনি। সেখানে তাঁকে শূদ্ররাজা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে ভারত জনগোষ্ঠীর প্রধান সুদাসের সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে ঋগ্বেদে উল্লিখিত দশরাজার যুদ্ধের এই বিখ্যাত নায়ক ছিলেন শূদ্র। (আম্বেদকর, ‘হু ওয়্যার দ্য শূদ্রস?’) রামশরণ শর্মা অবশ্য মনে করেছেন বিভিন্ন আর্য জনগোষ্ঠীর মতো শূদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকে সামরিক ভূমিকা পালন করতেন। মহাভারতে অম্বষ্ঠ, শিবি, সূরসেন ইত্যাদিদের সঙ্গে শূদ্র সেনাবাহিনীরও উল্লেখ আছে। (মহাভারত ৭/৬/৬) শূদ্ররা উৎসগতভাবে বৈদিক সমাজের ভেতরের মানুষই হোন বা বাইরের, রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই থেকেই যে ভারতীয় সমাজের ভেতরের বর্ণবাদের উদ্ভব ও তাদের নিম্নতম বর্ণে রূপান্তরিত হওয়া, সেকথা আমরা বলতে পারি।

১১

ঋগ্বেদীয় সমাজে পরিচয়ভিত্তিক কোনও শূদ্র বর্গ ছিল না। এই সমাজ ছিল মুখ্যত পশুপালক ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক। বৈদিক সমাজের পুরোহিত ও সমরনায়কদের পক্ষে এ কারণেই নিজেদের সমাজের ভেতর থেকে এত বেশি সম্ভব উদ্বৃত্ত উৎপন্ন ও শ্রম আদায় সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না, যাতে কোনও অংশের অবস্থান্তর ঘটিয়ে দাসের পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়। অবৈদিক জনগোষ্ঠীদের থেকে যুদ্ধ ও লুন্ঠনের মধ্যে দিয়ে যা কিছু সম্পদ আদায় করা হতো, বৈদিক সমাজের জ্ঞাতিদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হতো। সমাজপতিরা যে অশ্ব, রথ এবং দাসদের অধিকারী হতেন, তা তাঁদের পদমর্যাদার সঙ্গে যুক্ত ছিল, সামাজিক শ্রেণির সঙ্গে নয়। পরবর্তী বৈদিক যুগে, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী পর্বে, পশুপালন থেকে যখন চাষবাসের ও আধা যাযাবর বৃত্তির জায়গায় স্থায়ী বসতি স্থাপনের পর্ব এল, তখনই বৈদিক সমাজের ভেতরে সামাজিক শ্রেণিভিত্তিক বর্ণ ব্যবস্থার আবির্ভাব হলো।

১২

বেদোত্তর কালে শূদ্র জাতিকে মূলত সেবক হিসেবেই দেখা যায়। কিন্তু ঋগ্বেদ পরবর্তী বৈদিক যুগে শূদ্রেরা যে স্বাধীনভাবে গো ধনের অধিকারী ছিলেন, তেমন অনেক উল্লেখ আছে। মৈত্রায়ণী সংহিতাতে বলা হয়েছে (৪/২/৭ ও ৪/২/১০) শূদ্রদের গবাদি পশু ছিল এবং উচ্চবর্ণের লোকেরা যজ্ঞের জন্য সেগুলো নিয়ে যেতে পারতেন। পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে শূদ্ররা কোনও দেবতা বা যজ্ঞ ছাড়াই জন্মেছেন, কিন্তু তাঁদের অনেক পশু সম্পত্তি আছে। (৬/১১/১১)। কিন্তু সম্পত্তি থাকলেও তাদের অধস্তন ভূমিকা ও অবমানিত অবস্থানটি বেশ স্পষ্ট। জৈমিনীয় ব্রাহ্মণে বলা হচ্ছে (১/৬৮) কোনওরকম দেবতা ছাড়াই শূদ্রদের উৎপত্তি হয়েছিল প্রজাপতির পা থেকে, তাই গৃহস্বামীই তাদের দেবতা ও তাঁর পা ধুয়েই তাঁদের জীবিকা অর্জন করতে হবে। শ্রৌতসূত্রে বলা হয়েছে (২৬/ ১-৭) উচ্চবর্ণের শুশ্রূষা করেই তাঁদের বাঁচতে হবে। জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ আমাদের জানিয়েছে অশ্বমেধের মধ্যে দিয়ে বৈশ্যদের ধনী হয়ে ওঠার কথা।

শূদ্ররা প্রভুর জমিতে ভূমিদাস হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁরা প্রভুর ক্ষেতে কাজ করে দিতেন। তবে তার নিজের জন্যও একটুকরো জমি থাকত। যতদিন তিনি ভূস্বামীর জমিতে কাজ করে দিতেন, ততদিন তিনি সেই জমি রাখতে পারতেন। পরবর্তী বৈদিক যুগ পর্যন্ত করযোগ্য ছোটো ভূমি সম্পত্তি শূদ্রদের ছিল কিন্তু বেদোত্তর কালে তারা করপ্রদান ও সম্পত্তির আওতার বাইরে চলে যান।

শূদ্রদের সেবক ভূমিকার পাশাপাশি বিভিন্ন সূত্র শূদ্রদের শ্রমজীবী শক্তি হিসেবেও উল্লেখ করেছে। বাজসনেয়ী সংহিতা (৩০/৬/২১) ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে (৩/৪/২/১৭) নানারকম বৃত্তির উল্লেখ আছে, যেমন – রথকার, সূত্রধর, কুম্ভকার, কর্মকার, মণিকার, পশুপালক, পশুচারক, শৌণ্ডিক, ধীবর ও ব্যাধ। কৃষিতে কাজের কথাও রয়েছে। মনে করা হতো শূদ্ররা হলেন কঠোর শ্রমের প্রতিভূ। নিষাদ, কিরাত, পর্ণক, পৌল্কস, বৈন্দ ইত্যাদি অবৈদিক অন-আর্য মানবগোষ্ঠীর কথাও এই প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। ‘বেদিক ইনডেক্স’ নামক বিখ্যাত আকরগ্রন্থ ইঙ্গিত করেছে যে শূদ্র গোত্রের মধ্যে এরাও অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলেন। হস্তশিল্পের সংখ্যা পরবর্তী বৈদিক যুগে অনেক বাড়ে কিন্তু বৈদিক সমাজের বিশ-এর সদস্যরা সেইসব শ্রমসাধ্য কাজ যে আর করতেন না, তেমন ইঙ্গিত এখানে রয়েছে। সেই কাজ শূদ্ররা করতেন।

বর্ণ ব্যবস্থা থেকে জীবিকানির্ভর হাজারও বিভাজনভিত্তিক জটিল ভারতীয় জাত ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ আরও পরের ঘটনা, যে জাত ব্যবস্থার কাঠামো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলভেদে আবার অনেকখানি স্থানীয় পরিচিতি ও চরিত্র লাভ করল। সেই সংক্রান্ত কথাবার্তা এক পৃথক পর্যালোচনা দাবি করে।

জিনভিত্তিক গবেষণার সাহায্যে সাম্প্রতিককালে ভারতে জাতের অন্তর্গত বিবাহ ও জাতের শুদ্ধতা রক্ষার সময়ক্রম সম্পর্কে কিছু বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মিলেছে। তা জানাচ্ছে কবে থেকে বিভিন্ন বর্ণগুলির মধ্যে সামাজিক সংমিশ্রণ বন্ধ হয়ে গেল। ২০১৩ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের বিশ্বখ্যাত জিনতত্ত্ববিদ ডেভিড রাইখের তত্ত্বাবধানে প্রিয়া মুরজানী, কুমারস্বামী থঙ্গরাজ সহ অনেক বিজ্ঞানী এক যৌথ গবেষণা করেন। লক্ষ্য ছিল দেশীয় বিভিন্ন জাতের উৎস সন্ধান। এই গবেষণায় উপমহাদেশের ৭৩টি (৭১ ভারতীয় ও ২টি পাকিস্তানী) জাতিগত ও ভাষাগত ভিন্ন গোষ্ঠীর ৫৭১ জন মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতির মানুষ, আদিবাসী মানুষ, আন্দামানের বিভিন্ন আদিবাসী মানুষকে এই পরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। এই গবেষণার লক্ষ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জাতি ও ভাষা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে মিশ্রণগুলির সময়কাল নির্ণয় করা। দেখা গেছে, এই ৭৩টি গোষ্ঠীর মিশ্রণের সময়কাল আজ থেকে ৪২০০ থেকে ১৯০০ বছরের মধ্যে হয়েছে। এমনকি ভিল, চামার ও কল্লারের মতো প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীও এই মিশ্রণ থেকে রেহাই পায়নি। এদের সকলের মধ্যে পাওয়া গেছে ইন্দো-ইউরোপীয় জিন। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে এই মিশ্রণটি এতটাই বিস্তৃত ছিল যে ভারতের প্রায় প্রতিটি গোষ্ঠীই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এই গবেষণা বলছে, আজ থেকে ৪,২০০ বছর আগে থেকে ১,৯০০ বছর আগে পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় পূর্বপুরুষদের মধ্যে মিশ্রণ হয়েছে। কিন্তু তারপর এই মিশ্রণ আর সেভাবে দেখা যায় না।

১০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে অন্তর্বিবাহ বা একই বর্ণের মধ্যে বিবাহ নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। মনুস্মৃতির রচনাকাল আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। মনুস্মৃতি আন্তঃবর্ণ বিবাহের পক্ষে জোরালো নিদান দিয়েছে। এই বৈজ্ঞানিক গবেষণাতেও দেখা যাচ্ছে এই সময় থেকেই বহির্বিবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মৌর্য শাসনের অবসানে শুঙ্গ শাসনের যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির ক্ষমতা দখলের সময়ের সঙ্গে এই সময়কাল মিলে যায়। অর্থাৎ তখন থেকে নিজের বর্ণের মধ্যে বিবাহ বাধ্যতামূলক হয়। কর্মভিত্তিক বর্ণপ্রথার উদ্ভব খ্রিস্টপূর্ব দশম থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে হয়ে থাকলেও বংশানুক্রমিক কঠোর বর্ণব্যবস্থা যে মৌর্যোত্তর যুগে গড়ে ওঠে তা বলাই যেতে পারে। মৌর্য সমাজ ব্যবস্থাটি শুঙ্গ যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ক্ষমতা দখলের মধ্যে দিয়ে ভেঙে যায় এবং কঠোর বর্ণব্যবস্থার জন্ম দেয়, এই অনুমানকে আধুনিক জিনভিত্তিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাও মান্যতা দিচ্ছে

আকর

১. রামশরণ শর্মা, ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’।

২. ডি ডি কোসাম্বী, ‘ভারত ইতিহাস চর্চার ভূমিকা’।

৩. রোমিলা থাপার, ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’।

৪. রণবীর চক্রবর্তী, ‘ভারতের ইতিহাসের আদিপর্ব’।

৫. দেব রাজ চানানা, ‘প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথা’, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী। 

৬. সুকুমারী ভট্টাচার্য, ‘ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য’।

৭. সুকুমার সেন, ‘ভারতীয় আর্য সাহিত্যের ইতিহাস’

৮. বি আর আম্বেদকর, ‘নির্বাচিত রচনা সংকলন’

৯. ইরফান হাবিব, ‘ভারতবর্ষের মানুষের ইতিহাস (১ – প্রাক ইতিহাস, ২ – সিন্ধু সভ্যতা)’

১০. শিরিন রত্নাগর, ‘হরপ্পা সভ্যতার সন্ধানে’।

১১. দিলীপকুমার চক্রবর্তী, ‘ভারতবর্ষের প্রাগিতিহাস’।

১২. R C Majumder edited, ‘The History and Culture of Indian People (Vol 1)’.

১৩. S V Ketkar, ‘History of Caste in India’.

১৪. Tony Joseph, ‘Early Indians’.  

১৫. Upinder Singh, ‘A History of Ancient and Early Medieval India’.   

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।