সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

শ্রীচৈতন্যদেবের সময়কার বাংলা ভাষার সন্ধানে

শ্রীচৈতন্যদেবের সময়কার বাংলা ভাষার সন্ধানে

সৌভিক ঘোষাল

সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৪ ১২০ 0

বাংলা ভাষা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের দীর্ঘ সময়টাকে আমরা দুটো বড়ো উপবিভাগে বিভক্ত করে থাকি। প্রথম অংশটাকে বলি আদি-মধ্যযুগ আর পরের অংশটাকে অন্ত-মধ্যযুগ। এই দুই যুগের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন মধ্যযুগের বাংলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব শ্রীচৈতন্যদেব। চৈতন্যদেবের জন্ম ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে আর প্রয়াণ ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে। সাধারণভাবে ১৩৫০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে আমরা আদি-মধ্যযুগ এবং ১৫০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে অন্ত-মধ্যযুগ বলে থাকি। ১২০০ থেকে ১৩৫০ – এই সময়কালের বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের তেমন কোনও নিদর্শন আমাদের কাছে নেই। ফলে বাংলা ভাষা সাহিত্যের আদিযুগ যখন ১২০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শেষ হয়ে গেল, তখনই আদি-মধ্যযুগের শুরু এমনটা বললেন না ভাষা সাহিত্যের ইতিহাসকাররা। তাঁদের মনে হল ১২০০ – ১৩৫০ কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে মতো আকর বা আলো যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন একে অন্ধকার যুগ হিসেবেই আপাতত চিহ্নিত করা বাঞ্ছনীয়। এই ধরনের যুগবিভাগ অবশ্যই পালটে যেতে পারে যদি এই পর্বে লেখা ভাষা সাহিত্যের কোনও গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন আমরা খুঁজে পাই।

একটা কথা মাথায় রাখা ভালো বাংলা সাহিত্যে আদি যুগের শেষ ও মধ্যযুগের আরম্ভের সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা সম্পর্ক আছে। ১২০০ খ্রিস্টাব্দের আগের কয়েকশো বছর বাংলায় পাল ও সেন শাসকেরা রাজত্ব করেছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে, ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দিল্লি থেকে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণ ঘটে বাংলায়। বখতিয়ারের আক্রমণে সেই সময়কার বাংলার সেন রাজা লক্ষণ সেন পিছু হটেছিলেন। বখতিয়ারের আক্রমণে লক্ষণ সেন তাঁর রাজ্যের কতটা অংশ হারিয়েছিলেন সেই নিয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। সাধারণভাবে মনে করা হয় পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশের বেশ খানিকটা অংশ লক্ষণ সেনের হাতছাড়া হলেও পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশে তখনো সেন রাজাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিদ্যমান ছিল। ত্রয়োদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও লক্ষণ সেন পরবর্তী সেন রাজাদের জারি করা মুদ্রা ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। তবে চতুর্দশ শতক শুরু হবার কিছু আগেই সম্ভবত সেন রাজারা বাংলার অধিকাংশ জায়গায় তাঁদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই সময়ের ভাষা সাহিত্য সম্পর্কে যেমন আমরা বিশেষ কিছু জানতে পারি নি, তেমনি জানতে পারি নি লক্ষণ সেনের শেষজীবন ও লক্ষণ সেন পরবর্তী সেন রাজাদের সম্পর্কেও।

ইতিহাসের জটিলতা আমাদের বর্তমান আলোচনার বিষয় নয়। আমরা এখানে খোঁজখবর করতে চাইছি বাংলা ভাষা চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের সময়ে কেমন ছিল, তার অন্তত এক দেড় শতাব্দী আগে কেমন ছিল, সেই সব বিষয়ে। বলাই বাহুল্য সেই সময়ে মুখের বাংলা ভাষা কেমন ছিল, অঞ্চলভেদে ভাষার আলাদা আলাদা উপবিভাগ কতটা বা কীরকম ছিল, সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের ভাষাছাঁদ কতটা আলাদা ছিল – এই সব বিষয়ে প্রত্যক্ষ তথ্য পাওয়ার কোনও উপায় নেই। আমাদের নির্ভর করতে হয় পরোক্ষ তথ্যের ওপর। সাহিত্যের ভাষার ওপর। কিন্তু চৈতন্যদেবের আগে আদি মধ্যযুগের বাংলা ভাষায় যে সব সাহিত্য লেখা হয়েছে তার অধিকাংশর ভাষা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে লিপিকর ও গায়েনদের হাত ধরে। কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালী বা চণ্ডীদাসের পদাবলীকে যে চেহারায় আমরা আজ পাই, তা কতটা তাঁদের নিজস্ব ভাষাছাঁদ আর কতটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাওয়া তার নিখুঁত বিশ্লেষণ কঠিন। কয়েকটি বই এর ভাষা নানা কারণে ততটা বদলায় নি বলে মনে করা হয়। তার অন্যতম হল বড়ু চণ্ডীদাসের লেখা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। কিন্তু এই বইটি কবে লেখা, এটি কোন সময়ের ভাষাচিহ্নকে ধারণ করে আছে তাই নিয়ে পণ্ডিত বিশেষজ্ঞ মহলে বিস্তর বিবাদ আছে। যদিও আমরা ভাষা সংক্রান্ত আলোচনা করতে এসেছি এই লেখায়, কিন্তু সময়কালের বিতর্ককে এড়িয়ে সেই আলোচনা করা সম্ভব নয়।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন : সময়কাল সংক্রান্ত বিতর্ক

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বলে যে বইটিকে আমরা জানি, বড়ু চণ্ডীদাসের লেখা সেই বইটির নাম আসলে কী ছিল তাই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিতর্ক রয়েছে বড়ু চণ্ডীদাসের পরিচয় নিয়ে, যাকে অনেক সময়েই ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’ নামে অভিহিত করা হয়। বিতর্ক রয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের এখনও অবধি যে একমাত্র পুথিটি পাওয়া গেছে তার লিপিকাল নিয়ে। পুথিটি কবে অনুলিখিত আর মূল বইটিই বা কবে লেখা তা নিয়েও বিস্তর মতভেদ রয়েছে খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞদের নিজেদের মধ্যেই। এত বিতর্কের কথা মাথায় রেখেই সত্যব্রত দে তাঁর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সংক্রান্ত আলোচনা গ্রন্থটির নাম রেখেছিলেন ‘বিতর্কিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। সেই বই প্রকাশের পর আরও চারটি দশক কেটে গেছে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সংক্রান্ত বিতর্কগুলির নিরসন হয়নি।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের এখনও অবধি পাওয়া একমাত্র পুথিটির খবর একালের মানুষজন জানতে পেরেছেন পুরোনো বাংলা সাহিত্যের এক জহুরির দৌলতে। তাঁর নাম বসন্তরঞ্জন রায়। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের কাছের কাঁকিল্যা গ্রামে থাকতেন চৈতন্য পরিকর শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্রের বংশধরেরা। সেই পরিবারের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক এই কাহিনিকাব্যের পুথিটি ছিল, যার গুরুত্ব বাইরের কেউ তো বটেই পরিবারের লোকেদেরও জানা ছিল না। এক গোয়ালঘরের মাচায় অবহেলায় সেটি পড়ে ছিল। বসন্তরঞ্জন পুথিটি সংগ্রহ করেন। সেটা ১৩১৬ বঙ্গবাদ অর্থাৎ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ। পুথিটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগেই এটি সম্পর্কে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় বেশ কিছু লেখালিখি প্রকাশিত হতে থাকে। আবিষ্কারের দু বছর পর ১৯১১ সালে বসন্তরঞ্জন একটি নিবন্ধে পুথিটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলেন। আরও চার বছর পর ১৯১৫ সালে বসন্তরঞ্জন ও লিপিবিদ তথা ইতিহাসকার রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় একটি যৌথ নিবন্ধে পুথিটির লিপিবিচার করে একে অতিশয় পুরাতন বলে ঘোষণা করলেন। পরের বছর, ১৯১৬ সালে (১৩২৩ বঙ্গাব্দে) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে আবিষ্কারক বসন্তরঞ্জনের সম্পাদনায় পুথিটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল। এর কিছুদিন আগে সাহিত্য পরিষৎ থেকেই আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় বেরিয়েছিল আরেক আলোড়ন তোলা বই চর্যাপদ, যাকে হরপ্রসাদ বলেছিলেন হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষায় রচিত। সেই নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলতে চলতেই এসে গেল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে এক প্রবল আলোড়ন ও বিতর্কের উত্তপ্ত পরিবেশ তৈরি হল।

১৯১৯ সালে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় লেখা এক নিবন্ধে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি এই কাব্যের প্রাচীনতা মানতে পারেননি। ষোল বছর পরে লেখা এক প্রবন্ধে এই যোগেশচন্দ্রই আবার নিজের পূর্বমত থেকে সরে এলেন ও নতুন বিচারের আলোয় একে যথেষ্ট প্রাচীন বলে স্বীকার করে নিলেন।  কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার, ভাষাবিদ তথা বিশিষ্ট পণ্ডিত আচার্য সুকুমার সেন মহাশয় তাঁর সাহিত্যবিচারের দীর্ঘ পর্ব জুড়ে সব সময়েই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের প্রাচীনতা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে এসেছেন। বাংলা সাহিত্যের অপর বিখ্যাত ইতিহাসকার অধ্যাপক অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বা ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কিন্তু সুকুমার সেনের মতের বিপরীতে অবস্থান করেন। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে যথেষ্ট প্রাচীন গ্রন্থ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ঠিক কোন সময়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন লেখা হয়েছিল, তা নিশ্চিত করে বলার মতো তথ্যপ্রমাণ নেই। পঞ্চদশ শতকের মধ্যেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচিত হয়েছিল, এমন একটি সিদ্ধান্তই পণ্ডিত গবেষক মহলে সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা

ধ্বনিতত্ত্ব

১) এখনকার বাংলায় হলন্ত উচ্চারণের প্রবণতা বেশি। শব্দান্তে আমরা এখন স্বরান্ত উচ্চারণ খুব কম করি। চর্যাপদের সময় বাংলায় স্বরান্ত উচ্চারণ ছিল। সেই ধারা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও বজায় আছে। পয়ারের অন্ত্যমিল দেখে এটা বোঝা যায়। কাহ্ন/দান এই অন্ত্যমিল থেকে বোঝা যায় এখন আমরা দান শব্দটির যে হলন্ত উচ্চারণ করি (দান্‌) তখন সে রকম নয়, স্বরান্ত (দানো) উচ্চারণ ছিল। চাপ/ সন্তাপ, ধর/ভিতর, শুন/আলিঙ্গন ইত্যাদি অন্ত্যমিলের উদাহরণগুলিও স্বরান্ত উচ্চারণের ইঙ্গিত দেয়।

২) শব্দের আদিতে যে অ কার ব্যবহৃত হত, তার বিবৃত উচ্চারণ ছিল বলে মনে হয়। কারণ লিপিকরেরা অ এর জায়গায় অনেক সময়েই আ লিপিচিহ্ন ব্যবহার করেছেন। আকারণ, আচেতন, আতিশয়, আতী (অতি) ইত্যাদি বানান শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুথিতে পাওয়া গেছে।

৩) আধুনিক বাংলায় বিশেষত রাঢ়িতে অ কারের ও কার হিসেবে উচ্চারণ প্রক্রিয়া খুব বেশি দেখা যায়, যেমন অতুল> ওতুল, অগ্নি > ওগ্নি ইত্যাদি। আদি মধ্য বাংলাতেই এই প্রবণতা এসে গিয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে নন্দবালা কে ‘নান্দোবালা’ লিখতে দেখা যায়, যা একই সঙ্গে শব্দের আদিতে অ এর দীর্ঘ ও শব্দের মাঝে অ এর ও হিসেবে উচ্চারণকে নির্দেশ করছে। নন্দঘরে বোঝাতে ‘নান্দোঘরে’ শব্দের প্রয়োগও দেখা যায়।

৪) হ্রস্ব দীর্ঘ উচ্চারণে পার্থক্য যে ছিল না তা বোঝা যায় বানানে হ্রস্ব দীর্ঘ প্রয়োগের যথেচ্ছাচার থেকে। উজল/ ঊজল, দুতি/দূতী, বড়ু/বড়ূ, উত্তর/ঊত্তর ইত্যাদি।

৫) ই/এ এর মধ্যে উচ্চারণ পার্থক্য কম ছিল বলে অনুমান করা যায় এই ধরনের বানান দেখে – কিমনে/কেমনে, ছিনারী/ছেনারী, নিবারিল/নেবারিল, বিয়াকুল/বেয়াকুল।

৬) ঋ ধ্বনিকে আমরা এখন যেমন রি ধ্বনি হিসেবে উচ্চারণ করি, আদি মধ্যে বাংলাতেও তেমনভাবেই উচ্চারণ করা হয়। তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুথিতে ঋ কে রি বানানে লেখা হয়েছে। প্রিয় > পৃয়, কৃপাণ > কিরিপান।

৭) ন ও ণ ধ্বনির উচ্চারণ পার্থক্য আদি মধ্য বাংলাতে সাধারণভাবে ছিল না। যেমন ণাল/ নাল, ণাম্বায়িল/ নাম্বায়িল। তবে পরেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেছেন চরণান্ত মিলের ক্ষেত্রে অল্প কয়েকটি জায়গায় এই উচ্চারণ পার্থক্য রক্ষিত ছিল। সে সব ক্ষেত্রে ণ এর বানানটি যথাযথভাবে প্রযুক্ত। যেমন বাণী/ পাণী।

৮) য ও জ ধ্বনির উচ্চারণ পার্থক্য ছিল না। জাণ/ যান, জাণি/ যানি, যখন/ যখন,জত/ যত ইত্যাদি।

৯) স, ষ ধ্বনি তালব্য শ বা তালব্য ধ্বনি চ/ছ হিসেবে উচ্চারিত হত। যেমন – শীতা (সীতা), শাপ (সাপ), সাণ্ড (ষণ্ড)। মাগধী প্রাকৃত থেকেই এই উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য চলে আসছে।

১০) স্বরমধ্যগত হ ধ্বনির উচ্চারণ রক্ষিত হয়েছে। আহ্মার, তোহ্মার, কাহ্নাই কাহ্ন, তেহ্ন, চিহ্নিল ইত্যাদি প্রয়োগ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।

১১) যৌগিক স্বরের উপস্থিতি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে দেখা যায়। অ ও ই কখনো যৌগিক স্বর, আবার কখনো দ্বিস্বর হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে উপস্থিত। যেমন – দৃঢ় ভুজযুগে ধরি কৈল আলিঙ্গনে/ রাধার বদনে কাহ্নাঞিঁ কইল চুম্বনে। এখানে প্রথম পংক্তির কৈল তে অ ই যৌগিক স্বর হিসেবে এবং দ্বিতীয় পংক্তির কইল তে অ ই দ্বিস্বর রূপে উপস্থিত।

১২) স্বরসংযোগের প্রক্রিয়াটি মাগধী প্রাকৃত থেকে আধুনিক বাংলার দিকে ক্রমশ এগিয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে পাশাপাশি দুটি স্বরধ্বনি অনেক জায়গাতেই রক্ষিত। যেমন অ অ – নির্মল্কমল বঅনে, আ অ – আঅর সন্দেশ লওঁ বাহুর কঙ্কণে, ই অ – তবেঁ হিঅ হিঅ বুলী কাহ্ন কহে নাএ। আবার অনেক জায়গায় এর বিপরীতে স্বরসংকোচও দেখা যায়। যেমন – অ ই > অ – বৈশোঁ/ বসিলোঁ, আ ই > আ – পাইলি/ পালি।

১৩) শ্রুতিধ্বনির উপস্থিতি ছিল আদি মধ্য বাংলায়। যেমন য় শ্রুতি – তিঅজ/ তিয়জ, ব শ্রুতি – ছাওয়াল/ ছাওআল।

১৪) স্বরসংগতির উদাহরণ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে দেখা যায়। এখণী / এখুনী, আপনে/ আপুণী, ভেড়ি/ ভিড়ি, তোলী/তুলি।

১৫) চর্যায় সবসময়ে আদি অক্ষরে শ্বাসাঘাত পড়তো না। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে শ্বাসাঘাত সবসময়েই আদি অক্ষরের ওপর দেখা যায়। এজন্য আদি অক্ষরে অ ধ্বনি অনেক সময়ে আ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন – অকারণ > আকারণ, অনুকূল > আনুকূল, অসুখ > আসুখ ইত্যাদি।

১৬) দীর্ঘ স্বরের উচ্চারণ আদি মধ্য বাংলাতেও পুরোপুরি একমাত্রিক হয়ে ওঠে নি। কোথাও হয়েছে, কোথাও আবার দীর্ঘস্বরে দু মাত্রার উচ্চারণ বজায় থেকেছে।

রূপতত্ত্ব

১) চর্যাপদে শব্দপ্রয়োগে লিঙ্গভেদ ছিল, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও আমরা শব্দপ্রয়োগে লিঙ্গভেদ দেখতে পাই। তবে চর্যাপদ আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের লিঙ্গভেদ একরকমের নয়। চর্যাপদে গুণবাচক শব্দ এবং বস্তুবাচক শব্দে লিঙ্গভেদের ভাবনা আমরা পাই এবং সেই অনুযায়ী সম্বন্ধবাচক পদ, বিধেয় বিশেষণ, সর্বনাম বিশেষণে ঈ প্রত্যয় যোগে স্ত্রী লিঙ্গর প্রয়োগ দেখা যায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পর্যায়ে এসে মূলত প্রাণীবাচক শব্দের ক্ষেত্রেই লিঙ্গভেদ দেখা যায়। এছাড়াও কৃদন্ত অতীতের ক্রিয়াপদে স্ত্রীলিঙ্গ বাচক প্রত্যয় যুক্ত হয়। যেমন – গেলী রাহী, বড়ায়ি চলিলী আনপথে।

২) চর্যাপদের মতো শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও একবচন ও বহুবচনের বিভক্তিগত পার্থক্য সাধারণভাবে নেই। দু একটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে বহুবচনের প্রাচীন বিভক্তির সংরক্ষণ দেখা যায়।

৩) শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সাধারণভাবে সমষ্টিবাচক শব্দের প্রয়োগে বহুবচন বোঝানো হয়েছে। যেমন – তোহ্মে সব।

৪) সংখ্যাবাচক শব্দপ্রয়োগেও বহুবচন বোঝানো হত। যেমন – বত্তীস রাজলক্ষণ।

৫) শব্দের দ্বিত্বপ্রয়োগ দ্বারা বহুবচন বোঝানোর নিদর্শন রয়েছে। যেমন – বনে বনে পালাইয়াঁ।

৬) রা বিভক্তিকে বাংলাভাষার নিজস্ব এক বহুবচন প্রকাশক বিভক্তি বলে ভাষাবিদরা মনে করেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেই প্রথম রা বিভক্তি প্রয়োগে বহুবচন দেখা গেল। যেমন – আহ্মারা মরিব শুণিলেঁ কাঁশে।

৭) শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কর্তৃকারকে শূন্য এবং এ বিভক্তি, মুখ্য কর্মে শূন্য, এ, কে, রে বিভক্তি, গৌণকর্মে শূন্য, এ, কে, রে, তে বিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। করণ কারকে শূন্য, এবং তে বিভক্তি, অপাদান কারকে এ এবং তে বিভক্তি, অধিকরণ কারকে শূন্য, এ, ক, তে, ই বিভক্তি দেখা যায়।

৮) অনুসর্গ প্রয়োগে নানা বৈচিত্র্য আছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে। য়াগক, আন্তর, ডায়ি, উপর, পাশে, পাণেবিণি, সহিতবহী,  থানে, ভিত, মাঝে, সনে, হাথে – ইত্যাদি নানা ধরনের অনুসর্গ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

৯) বর্তমান কালের বিভক্তি হিসেবে উত্তম পুরুষে ও, ই এ, মধ্যম পুরুষে অ,হা,সি,ঈ, প্রথম পুরুষে ই, এ, অ এর প্রয়োগ দেখা যায়।

১০) অতীতকালে ল, লা, লি ইত্যাদি এবং ভবিষ্যৎকালে বোঁ, ব, মো, বেঁ, বি, ইত্যাদি বিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায়।

আদি মধ্যযুগের অন্যান্য রচনার ভাষা প্রসঙ্গে

আদি মধ্যযুগের বাংলা ভাষার আরও বেশ কিছু নিদর্শন আমরা পেয়েছি। তার মধ্যে আছে চণ্ডীদাসের পদাবলী, কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালী বা বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলের মতো সেকাল থেকে একাল – বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ কিছু সাহিত্য। কিন্তু প্রবল জনপ্রিয়তাই এইসব রচনার ভাষাকে সময়ের সঙ্গে পুনরাবৃত্ত হওয়ার মুহূর্তগুলোতে কিছুটা করে বদলে বদলে নিয়েছে। ফলে এখন আমরা এইসব বইকে যে চেহারায় পাই, তার ভাষারূপটি পঞ্চদশ শতকের বলে কোনওভাবেই মনে হয় না। এই বইগুলির বিদ্যমান ভাষারূপকে অবলম্বন করে তাই পঞ্চদশ শতকে বাংলা ভাষা কেমন ছিল তা আন্দাজ করা সম্ভবপর নয়। এই সময়কালে লেখা অন্যান্য কিছু বইপত্র, যেমন মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ বা কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দীর মহাভারত অনুবাদ সম্পর্কেও খানিকটা একই কথা প্রযোজ্য। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন জনপ্রিয়তা হারিয়ে নিভৃতে চলে গিয়েছিল বলে তাতে ভাষাবদলের ছাপ পড়ে নি। সে কারণেই একালের ভাষাবিদরা পঞ্চদশ শতকের ভাষার ছাঁদটি খুঁজতে অন্য বইগুলি এড়িয়ে মূলত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ওপরেই নির্ভর করেন

আকর

১. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ১ম খণ্ড’; মর্ডান বুক এজেন্সি, ১৯৫৯।

২. অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, ‘বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’; দেজ, ১৯৬৬।

৩. অভিজিৎ মজুমদার, ‘আধুনিক ধ্বনিতত্ত্ব’; দেজ, ২০১৯।

৪. পরেশচন্দ্র মজুমদার, ‘সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ’; দেজ,  ১৯৯২ (প্রথম সংস্করণ ১৯৭১)।

৫. পরেশচন্দ্র মজুমদার, ‘বাঙলা ভাষা পরিক্রমা (১,২)’; দেজ, ১৯৯২।

৬. বসন্তরঞ্জন রায়, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’; বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৯১৬।

৭. রামেশ্বর শ, ‘সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা’; পুস্তক বিপণি, ২০১২ (৪র্থ সংস্করণ)।

৮. সত্যব্রত দে, ‘বিতর্কিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’; বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৫।

৯. সুকুমার সেন, ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’; আনন্দ, ১৯৯৩ (প্রথম আনন্দ সংস্করণ)।

১০. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘বাঙ্গালা ভাষা প্রসঙ্গে’; জিজ্ঞাসা, ১৯৭৫।

১১. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’; কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬২।

১২. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’; কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২৬।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।