সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

একটি বহুচর্চিত বিতর্ক: নিখাদ তথ্যের আলোকে

একটি বহুচর্চিত বিতর্ক: নিখাদ তথ্যের আলোকে

শিবাশীষ বসু

অক্টোবর ২৫, ২০২৫ ২৩৮ 13

প্রাক কথা

একটা বক্তব্য যদি বারবার বলা হয়, হাজারবার বলা হয়, তাহলে কালক্রমে সেই বক্তব্য সাধারণের মনে হয়ে ওঠে বিশ্বাসযোগ্য। এই ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে একটি মিথ্যে অথবা ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রহীন মন্তব্য কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির মুখে বসিয়ে অবিরাম প্রচার করে যান; দেখবেন কিছুদিনের মধ্যেই জনমানসে তা পরম সত্য বলে গৃহীত হয়ে গিয়েছে। ইংরেজিতে একে বলে ‘Illusory Truth Effect’ অর্থাৎ ‘the tendency to believe false information to be correct after repeated exposure.’ আর কে না জানে, সংখ্যাগুরুর মতামতই নাকি প্রকৃত সত্যি! বস্তুত ২০১৫ সালের এক অনুসন্ধানে, গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, ‘familiarity can overpower rationality and that repetitively hearing that a certain statement is wrong can paradoxically cause it to feel right.’

২০২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় ‘প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দ’ শীর্ষক প্রবন্ধে উভয়ের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক বিধান মুখোপাধ্যায় জাপানী কবি ওকাকুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে লিখেছিলেন, ‘ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু পরামর্শ চাইলে কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন— “ভারতকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন। If you want to know India, study Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negative’.” ’

              মন্তব্যটির তথ্যসূত্র হিসেবে বিধানবাবু স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত ‘চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ’ গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছিলেন।

              ‘যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও তাহলে বিবেকানন্দকে জানো। তাঁর মধ্যে সবটুকুই ইতিবাচক, নেতিবাচক কিছুই নেই।’

              দীর্ঘদিন ধরে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য বলে এই উদ্ধৃতিটির প্রচার চলেছে। যতদূর জানা আছে, রবীন্দ্রনাথের নামে এই বক্তব্যটি প্রথমবার প্রকাশ পায় ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার ৪৩তম বর্ষের ভাদ্র ১৩৪৮ সংখ্যায়; রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ঠিক একমাস পরে। ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার ওই বিশেষ সংখ্যাটি আমার চোখে দেখবার সুযোগ হয়নি, কিন্তু ওই পত্রিকারই অপর দুটি সংখ্যায় এই তথ্যসূত্রটি পেয়েছি। সেই প্রসঙ্গে এবার আসছি। ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার আশ্বিন ১৩৯৩ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধের পাদটীকায় স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ মন্তব্য করেছেন, ‘রোলাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথের স্বামীজী সম্পর্কিত ঐ উক্তি সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যও জানা গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের (২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮) পর ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় (ভাদ্র, ১০৪৮ সংখ্যায়) যে বিশেষ সংবাদ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয় তাতে লেখা হয় ‘মনীষী রোমাঁ রোলাঁ যখন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের চরিতের উপাদান সংগ্রহ করিতেছিলেন, তখন শান্তিনিকেতনে একদিন আমাদের জনৈক সন্ন্যাসীর নিকট এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন, ‘রোমা রোলাঁর সহিত আমার কথা হয়েছিল। আমি তাঁকে বলেছিলাম, ‘If you want to know India, study Vivekananda. In him there is nothing negative, everything positive’, (পৃ ৪৪২-৪৩)।’

ওই একই পাদটীকায় স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ আরও জানিয়েছেন, ‘রোমাঁ রোলাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্যারিসে যখন প্রথম দেখা হয় (এপ্রিল, ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ) শোনা যায় তখন রোমাঁ রোলাঁ ভারতবর্ষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কাছে জানতে চান। রবীন্দ্রনাথকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, কোন বই পড়লে তিনি ভারতবর্ষকে জানতে পারবেন। উত্তরে রোমাঁ রোলাঁকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, If you want to know India, study Vivekananda. In him there is nothing negative, everything positive, (যদি ভারতবর্ষ’কে আপনি জানতে চান তাহলে বিবেকানন্দের রচনাবলী পড়ুন। তাঁর মধ্যে নেতিবাচক কোনো কথা নেই, সব কিছুই ইতিবাচক।) মঠের প্রাচীনতম সন্ন্যাসী স্বামী অভয়ানন্দজীর (ভরত মহারাজের) কাছে পুনেছি রোমাঁ রোলাঁ স্বয়ং এ তথ্য স্বামী অশোকানন্দজীকে জানিয়েছিলেন।’ লক্ষ্য করবেন, স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ কিন্ত কোনো চিঠির কথা উল্লেখ করেননি।

বছর দুইয়েক পর পুনরায় ‘উদ্বোধন’ পত্রিকারই আশ্বিন ১৩৯৫ সংখ্যায় ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। লেখক জ্যোতির্ময় বসু রায়। পাদটিকায় লেখক জানালেন, ‘এই প্রসঙ্গে এখানে স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি বহু-উদ্ধৃত উক্তির কথা তোলা যেতে পারে, যা তিনি নাকি একদা রোমাঁ রোলাঁর কাছে করেছিলেন। শোনা যায় ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রোলাঁর যখন প্রথম দেখা হয়, কবি তখন ঐ ফরাসী মনীষীকে বলেছিলেন, ‘If you want to know India, study Vivekananda. In him there is nothing negative, everything positive.’ দুঃখের বিষয় রোলাঁর ডায়েরিতে উক্ত সাক্ষাৎকারের যে-বিবরণ আছে সেখানে রবীন্দ্রনাথের ঐ উক্তির কোনো উল্লেখ নেই। (দ্রষ্টব্য: ভারতবর্ষ দিনপঞ্জী —রোমাঁ রোলাঁ, অবস্তীকুমার সান্যাল অনুদিত, পৃ ১০-১৮) রোলাঁ অথবা রবীন্দ্রনাথ কারও কোনো প্রকাশিত রচনায় ঐ উক্তিটি পাওয়া যায় না।’

এর পর লেখক ভাদ্র ১৩৪৮ এবং আশ্বিন ১৩৯৩ সংখ্যার স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ লিখিত পাদটীকাদুটির উল্লেখ করেছেন (যা আগেই আমরা আলোচনা করেছি) এবং আপশোসের সঙ্গে জানিয়েছেন, ‘দেখা যাচ্ছে উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের নির্ভর করতে হয় শ্রুতি আর স্মৃতির উপর। নির্ভরযোগ্য দলিলের অভাবে তথ্যটির প্রামাণিকতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। একথা অবশ্য স্বীকার্য যে, শ্রুত বচনকে উপেক্ষা করা চলে না। কিন্তু এক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি করেছে দেশ পত্রিকার ১৯৮৬, ২৭ ডিসেম্বরের সংখ্যায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের একটি পত্রের অংশবিশেষ।’ মনে রাখবেন, এখানেও কিন্তু লেখক জ্যোতির্ময়বাবু কোনো চিঠির কথা উল্লেখ করেননি।

কিন্তু তিনি যে অসুবিধার কথাটি উল্লেখ করেছেন, আমরা এবার তা দেখবো। কী সেই চিঠি যা লিখে রবীন্দ্রনাথ সংশ্লিষ্ট সকলকে অসুবিধায় ফেলে দিয়েছিলেন?

উল্লিখিত চিঠিটি হল ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত আমেরিকার বস্টন থেকে ১৯২১ সালে ক্ষিতিমোহন সেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোনো উপলক্ষ্যে একবার পশ্চিমসাগরকূল ঘুরিয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছা আমার মনে জাগ্রত আছে। সেইজন্যে আর্বানা থেকে বেরিয়ে অবধি এই চেষ্টা করচি কিন্তু এ পর্য্যন্ত যাঁকেই বলেছি কেউ কর্ণপাত করেননি। তার প্রধান কারণ এই বুঝচি যে বিবেকানন্দের চেলারা এদেশে বেদান্ত প্রভৃতি সম্বন্ধে বক্তৃতা করে বেদান্ত এবং ভারতবর্ষের বিদ্যাবুদ্ধির উপর এদের শ্রদ্ধা একেবারে ঘুচিয়ে দিয়েছে। অবশেষে আমি আশা ছেড়ে দিয়েছিলুম। তারপরে আমি হার্ভার্ডে চারটে বক্তৃতা পাঠ করবার সুযোগ পেয়েছিলুম। তাতে উপনিষৎ অবলম্বন করে আমার মনের কথা কিছু কিছু ব্যক্ত করেছি। আমার এই বক্তৃতা নিষ্ফল হয়নি।’

এইখানে চিঠির সময়কালটি নিয়ে একটু আলোচনা করে নিতে চাই। প্রণতি মুখোপাধ্যায় ‘ক্ষিতিমোহন সেন ও অর্ধশতাব্দীর শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, ‘দেশ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ-ক্ষিতিমোহন পত্রাবলীতে চিঠিটি ১৯২১ সালে লেখা বলে অনুমান করা হয়েছে, সেটা স্পষ্টতই ভুল। এ চিঠি রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে Felton Hall Cambridge Mass, Boston থেকে লিখেছিলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি শিকাগো ফিরে যাওয়া পর্যন্ত এটাই তাঁর বস্টনের ঠিকানা ছিল। … এ খবরটাও পাওয়া যাচ্ছে যে পরের দিন সকালে তাঁরা শিকাগো ফিরে যাবেন। সেজন্য অনুমান হয় চিঠিটা ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯১৩ সালে লেখা। … আর-এক অতি সহজবোধ্য কারণে এ চিঠি ১৯২১ সালে লেখা হতে পারে না। আমেরিকায় গিয়ে ক্ষিতিমোহনের সেখানে কাজ করবার এক বৃহৎ সম্ভাবনা আছে এ-কথা জানানোর সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ এ কথাও লিখেছিলেন, ‘আমার খুব ইচ্ছা ছিল এই সঙ্গে অজিতকেও এখানে টেনে নিই’ … অজিতকুমার চক্রবর্তীর অকালমৃত্যু ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে, সুতরাং ১৯২১ সালে লেখা চিঠিতে তাঁর প্রসঙ্গ তো আসতেই পারে না।’

যাইহোক, প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার পাতায় ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ’ প্রবন্ধের লেখক জ্যোতির্ময় বসুরায় প্রশ্ন তুলেছেন, ‘১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে রোলাঁকে যিনি বললেন, ভারতবর্ষকে জানতে হলে বিবেকানন্দকে জানতে হবে, তিনিই সেই ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দেই ‘বিবেকানন্দের চেলাদের’ সম্পকে’ করলেন এই ঘোর অশ্রদ্ধাসূচক মন্তব্য! রবীন্দ্রনাথের কি ধারণা, স্বামীজীর অনুগামীরা বেদান্ত প্রভৃতি বিষয়ে যা বলতেন তা স্বামীজীর ধ্যানধারণার পরিপন্থী? অথবা তিনি কি মনে করতেন, বিবেকানন্দ নিজেও বেদান্ত বুঝতেন না, বিদেশীদের বোঝাতেও পারতেন না? যাই হোক, রোলাঁর নিকট ঐ উক্তি আর ক্ষিতিমোহন সেনকে লেখা চিঠির উক্ত অংশ—এই দুই বস্তুকে মেলাতে গিয়ে বিভ্রান্ত বোধ করতে হয়। কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে কি?’

এইখানে দুটি কথা বলা যেতেই পারে যে, যদি ধরে নেওয়া হয় চিঠিটি ১৯১৩ সালে লিখিত তাহলে তার আট বছর পর একজন মানুষের সম্বন্ধে ধারণার পরিবর্তন আসতেই পারে। তাছাড়া এখানে রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের শিষ্যদের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেছেন; বিবেকানন্দ সম্বন্ধে তাঁর ব্যক্তিগত অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়নি। আমরা মোটামুটি একই সময় একাধিকবার দেখতে পাব যে, বিবেকানন্দকে রবীন্দ্রনাথ শ্রদ্ধা করতেন ঠিকই কিন্তু তাঁর অনুরাগীদের বাড়াবাড়ি তিনি বরদাস্ত করেননি।

আমেরিকায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতীয় ধর্মতত্ত্ব ফেরি করার পক্ষে আমেরিকা অত্যন্ত লাভজনক প্রমাণিত হওয়ায় অনেক চতুর ও সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি সেখানে গিয়ে ধর্মের নামে রীতিমত ব্যবসা খুলে বসেছেন। ২৩ অগ্রহায়ণ ১৩১৯ (৮ ডিসেম্বর ১৯১২) আরবানা থেকে রবীন্দ্রনাথ অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লেখেন, ‘এখানকার পশ্চিম আমেরিকা আমাদের অনেক ছেলেকে মাটি করে দিচ্ছে—কত শিক্ষিত ছেলে স্বামী উপাধি ধারণ করে যা তা কথা বলে আসর গরম করে বেড়াচ্ছে ইংলণ্ড প্রভৃতি জায়গায় এরা এক মুহুর্ত দাঁড়াতে পারত না।’ আরও মাসখানেক পরে ৩ ফাল্গুন (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯‍১৩) কেমব্রিজ থেকে রবীন্দ্রনাথ অজিতকুমারকে পুনরায় লেখেন, ‘Prof Woods এখানকার ভারতীয় দর্শন-শাস্ত্রের অধ্যাপক … বলছিলেন আজকাল বিস্তর স্বামী উপাধিধারী অযোগ্য লোক এসে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে যা তা বক্তৃতা করাতে ভারতবর্ষের প্রতি এ অঞ্চলের লোকের শ্রদ্ধা একেবারে চলে গেছে। … বিবেকানন্দের পরবর্তীরা এসে এখানে ভারতবর্ষকে অত্যন্ত নামিয়ে দিয়েছে। … মুষ্কিল হয়েছে এখানে মেয়েদের মধ্যে একদল আছে যারা আধ্যাত্মিক সাধনার নামে যা তা বুজরুগির কথা শোনবার জন্য প্রস্তুত, সেইখানে আমাদের দেশের যে সকল পুরুষেরা মায়াজাল বিস্তার করে তাদের প্রতি এদেশের শিক্ষিত মণ্ডলীর একান্ত অশ্রদ্ধা জন্মেছে। তারা আমাদের শাস্ত্র ও দর্শন কিছুই পড়েনি কেবলমাত্র বিবেকানন্দের বুলি উল্টোপাল্টা করে আবৃত্তি করে কোনোমতে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে।’১০

এই চিঠিটি লেখার কিছুদিন আগেই ১ ফেব্রুয়ারি ১৯১৩, রবীন্দ্রনাথ বস্টন থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে মোটামুটিভাবে একই কথা লিখেছিলেন, চিঠির অংশটি অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী তাঁর একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘… দেখছি এখানে নিতান্ত শস্তা জিনিষও উচ্চমূল্যে বিকিয়ে যায়। আমাদের দেশের কত অযোগ্য লোক এখানে বক্তৃতা করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাদের দ্বারা দেশের গুরুতর অনিষ্ট হচ্ছে। বিবেকানন্দ এখানে যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন তা তাঁর চেলার দল এসে একেবারে ধুয়ে মুছে নিঃশেষ করে দিলে।’১১

এই মাসেই আর কিছুদিন পরে রামানন্দ বাবুকে রবীন্দ্রনাথ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি আবার লেখেন, ‘এখানকার ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক Dr. Woods আমাকে বলিতেছিলেন যে, ভারতবর্ষ হইতে অনেক অযোগ্য লোক আসিয়া ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এখানে বক্তৃতা করিয়া থাকে—ইহাতে এমন অবস্থা হইয়াছে যে ভারতবর্ষের কেহ বক্তৃতা করিবে শুনিলে শ্রোতা দুর্লভ হইয়া ওঠে। একদা ভারতবর্ষের প্রতি এ দেশের লোকের বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল এখন ঠিক তাহার বিপরীত অবস্থা ঘটিবার উপক্রম হইয়াছে। … ইঁহারা স্বদেশহিতৈষী বলিয়া বিখ্যাত কিন্তু এ দেশের নিকট ইঁহারা আমাদের দেশকে অপমানিত করিতেছেন।’১২

বিবেকানন্দকে নিয়ে মঠ ও মিশনের বাড়াবাড়িও রবীন্দ্রনাথের পছন্দ ছিল না। শান্তিনিকেতন থেকে ১০ জানুয়ারি, ১৯৩০ সালে ইন্দিরা দেবীকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘আয়ু শেষ হলেও মানুষ বিদায় দিতে চায় না, এইজন্য বিস্তর প্রয়াস করতে হয় অথচ পরিণামে ব্যর্থতাই ঘটে। মৃতের ভার বহন করতে আমি উৎসাহ পাইনে—অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা উচিত কিন্তু সে যেন অতীত নয় তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করাটা অসঙ্গত। বেলুড়মঠে শুনেছি বিবেকানন্দের ছবির সামনে রোজ অম্বুরি তামাকের ভোগ দেওয়া হয়—এই খরচটা বাঁচালে বিবেকানন্দের অসম্মান হোত না।’১৩

শুধু তাই নয়, ১৯০২ সালে ‘সমালোচনী’ পত্রিকায় ‘অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর’ ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথের ‘অনুস্বর ও বিসর্গ’ শীর্ষক একটি ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যাতে রামকৃষ্ণ সংঘের ধর্মপ্রচারকদের তিনি তীব্র শ্লেষে বিদ্ধ করে লিখেছিলেন, ‘ঐ যে আর একদল দেখিতেছ, যাঁহার‍া ধর্মপ্রচারের জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছেন—হিন্দুধর্ম মহান, জাগ্রত, শাশ্বত বলিয়া চারিদিকে ছুটোছুটি করিতেছেন, উহাদের কি ভাবিতেছ? ধর্মের জন্য প্রাণ আকুল হইয়া উঠিয়াছে মনে করিতেছ? … মুর্খ আর কাকে বলে? ইঁহারাও ঐ—কেশবচন্দ্র ও বিবেকানন্দের অনুস্বর ও বিসর্গমাত্র।’১৪

এই প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনা বলতে হয়, ১৩২৪ সনের ১৩ বৈশাখ (২৬ এপ্রিল ১৯১৭) ডা. নীলরতন সরকারের হ্যারিসন রোডের বাড়িতে আড্ডা বসেছে। ওই প্রসঙ্গে সীতা দেবী লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মসমাজের কাজ, রামকৃষ্ণ মিশনের কাজ, এই-সব বিষয়ে কথা হইতে লাগিল। হিন্দুসমাজ মানুষের মনের স্বাধীনতার উপরে যে বিভীষিকা বিস্তার করিয়া আছে, এবং মানুষকে যে মিথ্যাচরণে প্রবৃত্ত করিতেছে, তাহাকে কোনোরকমে এবং কোনো কারণেই সমর্থন করা যে অনুচিত, ইহাই জোর দিয়া বলিলেন। অনেক প্রসিদ্ধ নেতার নাম উঠিল এই সম্পর্কে।’১৫

‘উদ্বোধন’ পত্রিকার পাতায় লেখক জ্যোতির্ময় বসুরায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে কি?’ গণ্ডগোল যে একটা ভালোরকমই আছে এবং তার যে সহজে সমাধান হবে না তা বোঝা গেল যখন ইতিমধ্যে প্রখ্যাত রবীন্দ্র গবেষক অমিতাভ চৌধুরী ১৯৬০ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘একত্রে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘কবি ও সন্ন্যাসী’ প্রবন্ধে আমাদের জানালেন, ‘জাপানী মনীষী ওকাকুরা এসেছিলেন ভারতবর্ষকে বুঝতে, ভারতবর্ষকে জানতে। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছে এই বিষয়ে পরামর্শ চাইলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ভারতবর্ষকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন’; If you want to know India, study Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negative. এর চেয়ে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য আর কী হতে পারে।’১৬

এই উদ্ধৃতির কোনো তথ্যসূত্র অমিতাভবাবু দেননি, এমনকি রোলাঁ যে কি করে হঠাৎ করে পালটে ওকাকুরা হয়ে গেলেন, সে হদিসও তিনি আমাদের জানাননি!

প্রবন্ধের গোড়ায় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় প্রকাশিত যে নিবন্ধটির উল্লেখ আমরা করেছিলাম তাতেও দেখেছি লেখক রোলাঁ নয়; ওকাকুরার নাম দিয়েছেন। এবার মজার কথা হল, তথ্যসূত্র হিসেবে লেখক বিধান মুখোপাধ্যায় যে বইটির উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত ‘চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ’ বইয়ের বাংলা অনুবাদের ৯৭৪ পৃষ্ঠায় ঠিকই লেখা আছে যে, ‘যদি তুমি ভারতকে জানতে চাও, বিবেকানন্দকে জানো। তাঁর মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক, নেতিবাচক কিছুই নেই’, কিন্তু তথ্যসূত্র হিসেবে ফুটনোটে উল্লিখিত আছে, ‘এই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোঁমা রোঁলাকে বলেছিলেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী অশোকানন্দকে লেখা একটি চিঠিতে রোঁমা রোঁলা এই তথ্যটি জানান। স্বামী অশোকানন্দের সূত্রে আমরা এই তথ্যটি জেনেছি।’১৭

জানি না, আনন্দবাজার পত্রিকার উল্লিখিত প্রবন্ধের লেখক ওকাকুরার নাম কিভাবে পেলেন। আদৌ কি তিনি স্বামী লোকেশ্বরানন্দের বইটি পড়েছেন? এইখানে আর একটি লক্ষ্যনীয় তথ্য হল—এখানেই প্রথমবার চিঠির কথা উল্লিখিত হয়েছে। মজার কথা হল, স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে মিশনের সন্ন্যাসীরা এবং অসংখ্য বিবেকানন্দ বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের এই তথাকথিত মন্তব্যটি বারংবার ব্যবহার করেছেন কিন্তু স্বামী অশোকানন্দকে লেখা রোঁমা রোঁলার ওই বিশেষ চিঠিটি আজ পর্যন্ত কেউ ছেপেছেন কি?

আরও একটি মজার কথা হল, ভারতবর্ষের সঙ্গে রোলাঁর সম্পৃক্ততার উপর আলোকপাত করে এবং তাঁর সমকালীন বেশ কিছু প্রখ্যাত ভারতীয় ব্যক্তিত্বের উপর তাঁর পর্যবেক্ষণ এবং মতবিনিময়ের বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জার্নাল থেকে কিছু অংশ সংগ্রহ করে ‘Inde: Journal (1915-1943)’ গ্রন্থটি লেখা হয়। বাংলায় এর অনুবাদ করেন অবন্তীকুমার সান্যাল, নাম দেন, ‘ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি: ১৯১৫-১৯৪৩’। প্রকাশকাল ১৯৬০। এরও ১৪ বছর আগে ১৯৪৬ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক থাকাকালীন সরোজ দত্ত অনুবাদ করেন ১৮৬৬ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত রোমাঁ রোলাঁর প্রবন্ধ ও বক্তৃতার সংকলন, ‘I will not rest’। নাম দেন ‘শিল্পীর নবজন্ম’।

ইতিমধ্যে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে ঋষি দাস অনুদিত ‘The Life Of Vivekananda And The Universal Gospel’-এর বাংলা অনুবাদ, ‘বিবেকানন্দের জীবন ও বিশ্ববাণী’। এই তিনটি বইয়ের কোনোটিতেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ওই বহুচর্চিত বিশেষ মন্তব্যটি নেই। আমরা জানি, স্বামী বিবেকানন্দের বেশ ভক্ত ছিলেন রোলাঁ। ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি বইটিতে রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। বিবেকানন্দের জীবনীতেও বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের নাম এসেছে। তাই অবাক লাগে, রবীন্দ্রনাথের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য তিনি লিখতে বেমালুম ভুলে গেলেন?

ওই বিশেষ মন্তব্যটি না থাকলেও, রোমাঁ রোলাঁর ‘ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি’ বইতে তার পরিবর্তে যা আছে তাই এবার লিখছি।

১৯৩০ সালের ২৮ আগস্ট জেনেভায় ফরাসি চিন্তানায়ক রোঁমা রোঁলার সঙ্গে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেই মত বিনিময়ের স্মরণীয় বর্ণনা দিতে গিয়ে রোলাঁ লিখেছেন, ‘সেখান থেকে তিনি (রবীন্দ্রনাথ) চলে এলেন হিন্দু বহুদেববাদের, বিশেষ করে কালী-উপাসনার বিরুদ্ধে সোজাসুজি আক্রমণে। সে সম্পর্কে তিনি বলে গেলেন আবেগদীপ্ত ঘৃণার এক তীব্রতা নিয়ে (এমনটি তাঁর মধ্যে আর কখনও দেখিনি)। অত্যাধিক ভাবপ্রবণ মানসিক গতিশক্তির এই মানুষটির কাছে শৈশবের কোনো ছাপ সারাজীবনের চিন্তাধারাকে নির্দিষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট। তিনি যখন বলছিলেন, তাঁর শৈশবের সেই শিহরণ অনুভব করছিলাম; বলছিলেন সেই দিনটির কথা, যেদিন কলকাতার বড় কালীমন্দিরের সামনে দিয়ে যাবার সময়ে দেখতে পেয়েছিলেন রক্তের একটা স্রোত চৌকাঠের নিচে উপচে পড়ছে, আর পথচলতি একটি নিম্নশ্রেণীর স্ত্রীলোক নিচু হয়ে রক্তে আঙুল ডুবিয়ে নিচ্ছে, তার শিশুর কপালে তিলক দিয়ে দিচ্ছে। পূর্বের মতোই ক্রোধ ও বিতৃষ্ণায় কাঁপতে কাঁপতে রবীন্দ্রনাথ বললেন, এই হতভাগা পুরোহিত একটা বাচ্চা ছাগের পা মুচড়ে ধরে গলায় কোপ বসাবার আগে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, এবং বললেন, এই ধরনের রক্তমাখা নিম্নস্তর থেকেই চিরকাল মানুষের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে খুনীর হিংস্রতা, যুদ্ধ ও হত্যাকারী দেশের উপাসনা, রক্তপানের রুচি। এমনকি অধিবিদ্যা বা প্রতীকের স্তরে নিয়ে গিয়েও এর সঙ্গে কোনো আপস তিনি মানেন না। (এটা স্পষ্টই বোঝা গেল, তাঁর চোখের সামনে এই মুহূর্তে আছেন বিবেকানন্দ।) তিনি এমন কথা পর্যন্ত বললেন, কালীর উপাসনা যারা টিকিয়ে রাখে, তারা সুস্থ, সঠিক ও সৎ মানসিকতার লোক হতে পারে না।’১৮

প্রসঙ্গত, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মতোই কালীভক্ত ছিলেন এবং মঠে কালীপূজো করা নিয়ে অন্যান্য গুরুভাইদের সঙ্গে তাঁর সামান্য মতান্তরও হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে রামকৃষ্ণের শিষ্য রাখাল তথা স্বামী ব্রহ্মানন্দকে বলা বিবেকানন্দের বিখ্যাত উক্তিটির কথা যা শোনা যাবে তাঁর ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের জবানীতে, ‘অজাতশত্রু শ্রীমৎ স্বামী ব্রহ্মানন্দ মহারাজের অনুধ্যান’ গ্রন্থে: ‘বরানগরের মঠে নরেন্দ্রনাথ একবার কী এক পূজা করিয়াছিল। পূজা উপলক্ষে একটী পাঁঠাবলির ব্যবস্থা করিল এবং আর সকলেই তাহাতে যোগ দিল, কিন্তু রাখাল মনঃক্ষুন্ন হইয়া একটু বিষন্নভাবে রহিল, বলি দেওয়ায় তাহার ইচ্ছা ছিল না। নরেন্দ্রনাথ রাখালের এই ভাব দেখিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, ‘আরে একটা পাঁঠা বলি কী, যদি একটা মানুষ বলি দিয়ে ভগবান লাভ হয় তাতেও আমি সঙ্কোচ করি না!’ রাখাল নরেন্দ্রনাথের কথার প্রত্যুত্তর করিল না, নিজে বিষন্নভাবে রহিল। বেলুড় মঠে কালীপূজাতে একটী করিয়া পাঁঠাবলি দেওয়া হইত। এইরূপ কয়েক বৎসর হইয়াছিল। কিন্তু রাখাল, টাইফয়েড অসুখ হইবার পর যখন মঠে ফিরিয়া আসিল, তখন সারদানন্দ অনেকবার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল যে, কালীপূজায় পাঁঠাবলি দেওয়া হইবে কী না। রাখাল যদিও মুখে স্পষ্ট কিছু বলিল না, কিন্তু বিষন্ন ও বিরক্তভাবে মৌন হইয়া রহিল, কাজটি যেন তাহার নিজের অভিপ্রেত নহে। তদবধি মঠে পাঁঠাবলি দেওয়া উঠিয়া গেল।’১৯

বলি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের তীব্র অসহিষ্ণুতার নিদর্শন পাওয়া যায় রানী চন্দের ‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থেও, ‘ভগবানকে না হয় বাতাসা, লবাত মানত করতে রাজি আছি; কিন্তু প‍াঁঠা মানত করতে রাজি নই। আচ্ছা দেখ কি নিষ্ঠুরতা; ‘আমার অমুক করো মা, তোমায় পাঁঠা দেব।‘ মানুষের এই মনোভাব, কি করে যে আসে, নিজের স্বার্থের জন্য একটা প্রাণ বিনষ্ট করা। আমি একবার কালীঘাটের ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলুম; দেখি, একটা লম্বা মতো বামুন, গলায় পৈতা, যেখানে একটা বেড়া দেওয়া সীমানার মধ্যে পাঁঠাগুলি থাকে, সেখান থেকে একটা পাঁঠার একটা পা ধরে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে গেল। বলি দিতে দিতে সে এমনি কঠিন হয়ে গেছে যে, একটা প্রাণীকে একটা যে-কোনো জিনিসের সামিল করে ফেলল। এই বর্বরতা আমাদের এখনো ঘুচল না।’২০

এই প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হওয়া ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের কথা। রাজর্ষি উপন্যাসের ভুমিকায় লেখা আছে, দেওঘর যাত্রার পথে ট্রেনে রবীন্দ্রনাথ ঘুমের ভেতর এ-উপন্যাসের প্লট পেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘স্বপ্নে দেখলুম — একটা পাথরের মন্দির। ছোটো মেয়েকে নিয়ে বাপ এসেছেন পুজো দিতে। সাদা পাথরের সিঁড়ির উপর দিয়ে বলির রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। দেখে মেয়েটির মুখে কী ভয়! কী বেদনা! বাপকে সে বারবার করুণস্বরে বলতে লাগল, বাবা, এত রক্ত কেন! বাপ কোনোমতে মেয়ের মুখ চাপা দিতে চায়, মেয়ে তখন নিজের আঁচল দিয়ে রক্ত মুছতে লাগল। জেগে উঠেই বললুম, গল্প পাওয়া গেল। এই স্বপ্নের বিবরণ ‘জীবনস্মৃতি’তে পূর্বেই লিখেছি, পুনরুক্তি করতে হল। আসল গল্পটা ছিল প্রেমের অহিংস পূজার সঙ্গে হিংস্র শক্তিপূজার বিরোধ।’২১ পরবর্তীকালে এই উপন্যাসের প্রথম অংশ অবলম্বন করেই রবীন্দ্রনাথ ‘বিসর্জন’ নাটকটি রচনা করেছিলেন। স্পষ্টতই, স্রেফ সাকার নিরাকার দ্বন্দের জন্য নয়, ব্যক্তিগত সূক্ষ্ম অনুভবজনিত কারণেও রবীন্দ্রনাথ কালীপূজা বিদ্বেষী ছিলেন।

এবার আলোচনাটি গুটিয়ে আনা যাক। দেখা যাচ্ছে, একই উক্তি রবীন্দ্রনাথের নামে প্রচারিত হয়েছে অথচ স্থান-কাল-পাত্র আলাদা। এমনটাও হতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথ রোলাঁ ও ওকাকুরা দুজন বিদেশীকেই এই উপদেশ দিয়েছিলেন। আবার পুরোটাই স্রেফ ভিত্তিহীন প্রচারও হতে পারে। এখানে দেখা যাচ্ছে, ওকাকুরার ক্ষেত্রে পুরোটাই শ্রুতি হলেও রোলাঁর ক্ষেত্রে কেউ কেউ একটি তথাকথিত চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও সেই চিঠি কস্মিনকালেও কেউ চোখে দেখেছেন বলে আমরা খবর পাইনি। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা দাঁড়ালো এইরকম,

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন রোলাঁকে বা ওকাকুরাকে, সেটা অন্য কেউ শোনেননি। রোলাঁ লিখেছেন স্বামী অশোকানন্দকে, সেই চিঠি কেউ দেখেনেনি। স্বামী অশোকানন্দ আবার বলেছেন স্বামী পূর্ণাত্মানন্দকে অথবা স্বামী অভয়ানন্দকে, কিন্তু সেটাও আবার অন্য কেউই শোনেননি। তিনি স্বামী লোকেশ্বরানন্দকে কিছু বলেছিলেন কিনা, সে বিষয়েও কেউ কিছু জানেন না!

এইবার চোখ থেকে ভক্তির চশমাটা খুলে যদি আপনি যুক্তিসম্মত ইতিহাসচর্চা করতে বসেন তাহলে কি কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসা কি স্বাভাবিক নয়?

  • উদ্বোধন পত্রিকা ও চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ বইতে রোলাঁর নাম অথচ একত্রে রবীন্দ্রনাথ বইতে ওকাকুরার নাম কেন? অর্থাৎ দুই ঘরাণার লেখকরা সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য দিয়েছেন কেন? 
  • রোলাঁ সত্যিই যদি স্বামী অশোকানন্দকে কোনো চিঠি লিখে রাখেন তাহলে সেই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটি মিশন আজ অবধি প্রকাশ করেনি কেন?
  • রোলাঁ অথবা ওকাকুরা কিংবা রবীন্দ্রনাথ কেউই তাঁদের কোনো রচনায় এই উক্তিটির কথা স্বীকার করেননি কেন?
  • উদ্বোধন পত্রিকা ১৮৯৯ সালে আত্মপ্রকাশ করে এবং ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ নাকি ওই বিশেষ মন্তব্যটি করেছিলেন। এরপরেও রবীন্দ্রনাথ আরও কুড়ি বছর বেঁচেছিলেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় মিশন কোনোদিন এই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যটি তাদের পত্রিকায় ছাপেনি কেন?
  • রবীন্দ্রনাথ আসলে কাকে কথাটা বলেছিলেন? অথবা আদৌ কি বলেছিলেন?

যাঁরা এই লেখার মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অপমান বা তাঁদের হেয় করার প্রচেষ্টা ইত্যাদি দেখতে পাচ্ছেন তাঁদেরকে বলে রাখি, রোলাঁ বা ওকাকুরার কাছে রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন অথবা আদৌ কিছু বলেছিলেন কিনা; সে কথার প্রচার স্বামী বিবেকানন্দ নিজে করতে যাননি। যদি কথাটা সত্যি হয় তাহলে তো ব্যাপারটা মিটে গেল। আর যদি সত্যি না হয়, তাহলে তার দায় আদৌ বিবেকানন্দের নয়; যাঁরা এই প্রচার করেছেন, তাঁদের। সত‍্য উদ্ঘাটিত হলে বরং স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উভয়েই মিথ্যার আবরণ থেকে মুক্ত হবেন। বস্তুতঃ পূর্বে আলোচিত উদ্বোধন পত্রিকার প্রবন্ধটিতে লেখক জ্যোতির্ময় বসুরায় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন, ‘নির্ভরযোগ্য দলিলের অভাবে তথ্যটির প্রামাণিকতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন।’ 

তথ্যসূত্র

১) বিধান মুখোপাধ্যায়, প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দ, আনন্দবাজার পত্রিকা, (৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০)৷

২) স্বামী নির্জরানন্দ সম্পাদিত, উদ্বোধন পত্রিকা আশ্বিন ১৩৯৩ সংখ্যা, ৫৬৪ (১৯৮৬)৷

৩) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৬৩

৪) স্বামী নির্জরানন্দ সম্পাদিত, উদ্বোধন পত্রিকা আশ্বিন ১৩৯৫ সংখ্যা, ৫৮১ (১৯৮৮)৷

৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৮১

৬) সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত, দেশ পত্রিকা, ২৩ (২৭ ডিসেম্বর ১৯৮৬)৷

৭) প্রণতি মুখোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন ও অর্ধশতাব্দীর শান্তিনিকেতন, ১১৩-১১৪ (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাদেমি, ১৯৯৯)৷

৮) স্বামী নির্জরানন্দ সম্পাদিত, উদ্বোধন পত্রিকা আশ্বিন ১৩৯৫ সংখ্যা, ৫৮১ (১৯৮৮)৷

৯) প্রশান্তকুমার পাল, রবি জীবনী ষষ্ঠ খণ্ড : ১৩১৫-১৩২০, ৩৬১ (আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৮)৷

১০) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৬১

১১) অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী, বিবেকানন্দ ও তাঁর অনুগামীদের বেদান্তপ্রচার : ব্রাহ্মসমাজ ও রবীন্দ্রনাথের চোখে, (ঋতবাক, জানুয়ারি ২০১৮)৷

১২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র দ্বাদশ খণ্ড, ৩৬ (বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, ১৯৮৬)৷

১৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র পঞ্চম খণ্ড, ৭২ (বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৪৬)৷

১৪) অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী, রবীন্দ্রবীক্ষণে তিন স্বদেশী নায়ক : বিবেকানন্দ ব্রহ্মবান্ধব অরবিন্দ, ৩৫ (ঋতাক্ষর, ২০১৯)৷

১৫) সীতা দেবী, পুণ্যস্মৃতি, ৭২  (বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ২০০১)৷

১৬) অমিতাভ চৌধুরী, একত্রে রবীন্দ্রনাথ, ৩২০ (দেজ পাবলিশিং, ১৯৬০)৷

১৭) স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত, চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ, ৯৭৪-৯৭৫ (রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, ২০০৪)৷

১৮) অবন্তীকুমার সান্যাল অনূদিত, রম্যাঁ রঁলা ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি : ১৯১৫-১৯৪৩, ২৭৮ (১৯৬০)৷

১৯) মহেন্দ্রনাথ দত্ত, অজাতশত্রু শ্রীমৎ স্বামী ব্রহ্মানন্দ মহারাজের অনুধ্যান, ৫০ (মহেন্দ্রে পাবলিশিং কমিটি, ১৯৩৯)৷

২০) রানী চন্দ, আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ, ৫৬ (বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৪২)৷

২১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, ৩৭৩ (বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৪১)৷

মন্তব্য তালিকা - “একটি বহুচর্চিত বিতর্ক: নিখাদ তথ্যের আলোকে”

  1. লেখাটি বেশ যুক্তিসঙ্গত। এখানে আমার কয়েকটি প্রশ্ন আছে –
    ১. রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের বলতে কাদেরকে বুঝিয়েছেন ? রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে যুক্ত যেসব সন্ন্যাসী এবং বিবেকানন্দের যে সমস্ত গুরুভাই ভাই এদেরকে ? কারণ হচ্ছে স্বামী বিবেকানন্দ যখন Thousand Islands Park এ ছিলেন তখন তিনি একজনকে দীক্ষা দিয়ে নামকরণ করেন স্বামী স্বরূপানন্দ। তিনি ছিলেন একজন বিদেশী ।পরবর্তীকালে কিন্তু ইনি আর রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে কোন যোগাযোগ রাখেননি। রবীন্দ্রনাথ কি এদেরকে বুঝিয়েছেন ?
    ২. রবীন্দ্রনাথ এবং ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্মসমাজের অনুগামী ছিলেন। স্বামীজি তার যৌবনকালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করতেন। এরপর পরবর্তীকালে তিনি রামকৃষ্ণের অনুগামী হন। ব্রাহ্মরা যেহেতু নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনায় বিশ্বাসী ছিলেন, অপরদিকে রামকৃষ্ণ শাক্ত মতে উপাসনা করেছিলেন। তাই নরেন্দ্রনাথ এর মত একজন প্রতিভাবান যুবকের একজন ‘তথাকথিত অশিক্ষিত’ কালী মূর্তি উপাসকের দিকে ঝুঁকে যাওয়াটাকে তারা মানতে পারেননি। তাই রবীন্দ্রনাথ স্বামী বিবেকানন্দ এবং রামকৃষ্ণ মিশনকে সম্পূর্ণভাবে মানতে পারেননি।
    ৩. বেশ কয়েকটি এখানে প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে এখানে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে মূল প্রশ্ন হল একটি সেটি হল – স্বামী অশোকনন্দকে লিখিত রোমা রলার যে চিঠির কথা স্বামী লোকেশ্বরানন্দ উল্লেখ করেছেন, সেটির অস্তিত্ব আছে কিনা বা সেটি এখনো মুদ্রিত হয়নি কেন ?
    ধন্যবাদ।

  2. আপনার দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
    রবীন্দ্রনাথ যদিও কোনো ব্যক্তির নাম করেননি তবুও আন্দাজ করা যেতে পারে যে তিনি স্বামী অভয়ানন্দের কথা বলে থাকতে পারেন।
    ব্রাহ্ম ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে মতবিরোধ একটা কারণ বৈকি।

    1. রবীন্দ্রনাথের উল্লিখিত ‘বিবেকানন্দের চেলারা’ কারা হতে পারেন, সেই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে দুটি প্রবন্ধে। সেখানে সম্ভাব্য নানা ব্যক্তির উল্লেখ সহ এ ব্যাপারটি দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল যে, ১৯১০-১২ সাল নাগাদ আমেরিকায় বেদান্তপ্রচারে ব্যাপৃত নানা প্রচারকদের মধ্যে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের দীক্ষিত কয়েকজন (সকলে নন) শিষ্যের থাকার সম্ভাবনা কোনমতেই বাদ দেওয়া যায় না। বিস্তৃত আলোচনার জন্য আমার এই দুটি প্রবন্ধ দেখা যেতে পারে ;-
      (১) ‘বিবেকানন্দের বেদান্তপ্রচার, রবীন্দ্রনাথের তিনটি চিঠি ও কিছু প্রশ্ন’ / জিজ্ঞাসা, বৈশাখ আষাঢ় ১৩৯৭ অথবা ঐ – পুনর্মুদ্রণ ‘মানবমন’ অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০১৪,
      (২) প্রসঙ্গ : বিবেকানন্দ – পাভলভ ইনস্টিটিউট সংকলন, ২০১৫।
      সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্য বর্তমান প্রবন্ধের ১৪ নং তথ্যসূত্রে উল্লিখিত আমার বইটির প্রথম অধ্যায়টি দেখা যেতে পারে। এছাড়া আমার পরবর্তী একটি বইয়ে এই প্রসঙ্গটি নিয়ে বিস্তারিত একটি অধ্যায় থাকবে এরকম পরিকল্পনা রয়েছে।

  3. রবীন্দ্রনাথের উল্লিখিত ‘বিবেকানন্দের চেলারা’ কারা হতে পারেন, সেই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে দুটি প্রবন্ধে। সেখানে সম্ভাব্য নানা ব্যক্তির উল্লেখ সহ এ ব্যাপারটি দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল যে, ১৯১০-১২ সাল নাগাদ আমেরিকায় বেদান্তপ্রচারে ব্যাপৃত নানা প্রচারকদের মধ্যে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের দীক্ষিত কয়েকজন (সকলে নন) শিষ্যের থাকার সম্ভাবনা কোনমতেই বাদ দেওয়া যায় না। বিস্তৃত আলোচনার জন্য আমার এই দুটি প্রবন্ধ দেখা যেতে পারে ;-
    (১) ‘বিবেকানন্দের বেদান্তপ্রচার, রবীন্দ্রনাথের তিনটি চিঠি ও কিছু প্রশ্ন’ / জিজ্ঞাসা, বৈশাখ আষাঢ় ১৩৯৭ অথবা ঐ – পুনর্মুদ্রণ ‘মানবমন’ অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০১৪,
    (২) প্রসঙ্গ : বিবেকানন্দ – পাভলভ ইনস্টিটিউট সংকলন, ২০১৫।
    সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্য বর্তমান প্রবন্ধের ১৪ নং তথ্যসূত্রে উল্লিখিত আমার বইটির প্রথম অধ্যায়টি দেখা যেতে পারে। এছাড়া আমার পরবর্তী একটি বইয়ে এই প্রসঙ্গটি নিয়ে বিস্তারিত একটি অধ্যায় থাকবে এরকম পরিকল্পনা রয়েছে।

  4. খুব ভাল লাগল। আগেও লিখেছ ছোট করে, এখন বিস্তারিত আলোচনা পেলাম। আমাদের শ্রদ্ধেয় বাবাজি-মাতাজিদের দল যে কোথায় কবে কত মিথ্যে বানিয়ে রেখেছে, ভাবলেও ভয় করে। যাই হোক, এইসব আলোচনার মধ্যে দিয়েই সে সব উন্মোচিত হতে পারে, সবাই সে সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। কাজেই, এই প্রক্রিয়া ও উদ্যোগটি খুবই জরুরি!

  5. খুব ভাল লেখা। যিনি নাকি “জীবে প্রেম করে যেই জন …” বলেছেন তিনিই আবার বেলুড় মঠে পশুবলি করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, আবার তিনিই মাটন বিরিয়ানি খেতে ও রেঁধে খাওয়াতে ভালবাসতেন। এই বিষয়গুলো জানার পরে ভদ্রলোকের প্রতি শ্রদ্ধা উবে গিয়েছিল। আর কিছু নতুন বিষয় জানা গেল।

    রবীন্দ্রনাথের পশুবলি সম্পর্কে লেখাগুলি বেশ চর্চিত। এই প্রসঙ্গে রজনিকান্ত সেনের ডায়েরি থেকে দুটো উক্তি উদ্ধৃত না করে পারছি না।
    My Idea all along is, that we ought not to sacrifice an innocent animal at the altar of the Goddess, whose grace we are going to invoke. My father was of the same opinion. Specially we are going to celebrate a ceremony – ধর্মের নামে অধর্ম করতে চাই না. For a long time their family is offering sacrifices to the Goddess. But of what earthly benefit has taht been upto date?

    I would advise you therefore, to offer my Puja without Sacrifice. Let see, if that would do some good to teh family. We have been short-lived. The whole family is ruined so to speak. What good has Sacrifice has done to us? Before the motehr of all living beings we kill an innocent animal. Does this propitiate teh Goddess?

    1. বেশীর ভাগ প্রাণীর প্রাকৃতিক পরিণতি অতি নিষ্করুণ-অনাহারে, চিকিৎসা বিহীন অসুস্হতায় বা অন্য পশুদের দ্বারা ভক্ষিত হওয়া।
      চাষ আবাদের জমি তৈরি করতে জঙ্গল কাটতে হয়। তাতে গৃহহীন, ক্ষুধার্ত অবস্হায় বাদুড়, বানর, পাখী, পিঁপড়ে মারা যায়। তথাকথিত নিরামিষ জলে ফোটালে তাদের গায়ে আঁকড়ে থাকা অসংখ্য জীব-অণু মারা যায়। কাঁচা ফল খেলে তারা পেটের অ্যাসিডে ঝলসে মরে। পশুভক্ষণ তার চেয়ে নিষ্ঠুর কিছু নয়। শুধু যথাসম্ভব যন্ত্রণাহীন ভাবে তাদের মারা যায়।

      1. আমিষ নিরামিষ খাবার বিষয়টা আনেক বেশি জটিল। এতে বাস্তুতন্ত্র থেকে জলবায়ু সব জরিয়ে আছে। সেকথা এখানে হচ্ছে না। প্রচারের ঠেলায় প্রায় ভাগবান হয়ে যাওয়া এক মানুষের চিন্তা ভাবনার মধ্যে যে আসামঞ্জস্য রয়েছে, তাই নিয়েই আমার বক্তব্য । রবীন্দ্রনাথ, রজনিকান্ত সেন এবং বিবেকানন্দ সমসাময়িক । পূজার নামে পশুবলি যে খুব একটা প্রয়োজনীয় কাজ নয়, এবং ভাল কাজও নয় সেটা দুই কবি ভালই উপলব্ধি করেছিলেন। তৃতীয় জনের কথা এবং কাজে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

    2. বলিদান নিয়ে আপত্তি যথাযথ।কিন্ত কেউ আমিষ খেলে তাকে অশ্রদ্ধা করা,নিতান্ত ই বালখিল্যসুলভ।নিরামিষ গ্ৰহণেও হত্যা হয়।জীবনবধ ছাড়া জীবনরক্ষা হয় না।প্রকৃতির নিয়ম।

      1. আমিষ নিরামিষ খাবার বিষয়টা আনেক বেশি জটিল। এতে বাস্তুতন্ত্র থেকে জলবায়ু সব জড়িয়ে আছে। সেকথা এখানে হচ্ছে না। প্রচারের ঠেলায় প্রায় ভাগবান হয়ে যাওয়া এক মানুষের চিন্তা ভাবনার মধ্যে যে আসামঞ্জস্য রয়েছে, তাই নিয়েই আমার বক্তব্য । রবীন্দ্রনাথ, রজনিকান্ত সেন এবং বিবেকানন্দ সমসাময়িক । পূজার নামে পশুবলি যে খুব একটা প্রয়োজনীয় কাজ নয়, এবং ভাল কাজও নয় সেটা দুই কবি ভালই উপলব্ধি করেছিলেন। তৃতীয় জন পশুবলি শুধু সমর্থন করলেও চলত, কিন্তু তিনি আবার “জীবে প্রেম” ইত্যাদি বলে কথা এবং কাজে যে অসঙ্গতি দেখিয়েছেন তার কথা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।