সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫ : প্রশাসনিক মুখোশের আড়ালে রাজনৈতিক মুখ?

বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫ : প্রশাসনিক মুখোশের আড়ালে রাজনৈতিক মুখ?

শিবাশীষ বসু

অক্টোবর ১, ২০২২ ৫৮৯ 4

বিশ শতকের শুরুতে জাতীয় কংগ্রেস সম্বন্ধে মোহভঙ্গের বেদনা যখন রাজনীতি সচেতন বাঙালী তরুণ-যুবসমাজকে হতোদ্যম করে তুলছে ঠিক সেই সময় কয়েকটি আন্তর্জাতিক ঘটনা হতাশ যুবসমাজের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। প্রথম ঘটনাটি হল, প্রবল পরাক্রান্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বোয়ার যুদ্ধে বারংবার অশিক্ষিত কৃষকদের কাছে পর্যুদস্ত হওয়া। দ্বিতীয়টি — ১৯০২ সালে জাপানের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সন্ধি স্থাপন এবং ১৯০৩-০৪ সালের রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের অবিশ্বাস্য জয়। এবং তৃতীয় ঘটনাটি, ১৯০৫ সালের জানুয়ারী মাসে রাশিয়ার শ্রমিক বিপ্লব, যা দমন করতে জারের পুলিশ ‘ব্লাডি সানডে’র মত ঘটনা ঘটিয়েও থামাতে পারে নি, জার বাধ্য হন ডুমা বা সংসদীয় ব্যবস্থার প্রচলন করতে। স্বশাসনের পক্ষে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিপক্ষে যে আওয়াজগুলি এতদিন অস্ফুটে শোনা যাচ্ছিল, তা যেন হঠাৎ করে কলরোলে পরিবর্তিত হয়ে উঠলো। ইতিমধ্যেই একদিকে দীর্ঘ বিশ বছর ধরে কংগ্রেসের নরমপন্থী ব্যর্থ রাজনীতি এবং অন্যদিকে ব্রিটিশদের ভারতীয় জনসাধারণের উপর ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষ — সব মিলিয়ে ভারতের যুবসমাজের মনে ইংরেজবিরোধী এক তীব্র ঘৃণার সঞ্চার হয়ে উঠেছিল। এমনই এক টালমাটাল সময়ে ১৮৯৯ সালে, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে লর্ড কার্জন ভারতবর্ষের সর্বকনিষ্ঠ ভাইসরয় রূপে নিযুক্ত হলেন, যাঁর সন্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ভার্নি লোভেট মন্তব্য করেছিলেন, “No viceroy has ever played a part larger than the part played by Lord Curzon.”

লর্ড কার্জনের অন্যতম জীবনীকার লোভাট ফ্রেজার লিখেছেন, ভারতবর্ষের ভাইসরয় হয়ে আসবার পর কার্জন যে কয়টি সদর্থক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে সেরা হচ্ছে বঙ্গবিভাগ — “I unhesitatingly place the partition of Bengal first, because I believe it to have been fraught with the largest and most tangible benefit to many millions of people. The systematic neglect of the vast trans-Gangetic areas of Bengal was the greatest blot upon our administration of India. Crime was rife, the peasantry was crushed beneath the exactions of absentee landlords, the police system was feeble, education a mere shadow, and internal communications disgracefully inadequate. The old Bengal Government was engrossed with Calcutta and the districts near its headquarters. Eastern Bengal was less known, and less thought of, than the Punjab and the frontier. A single district with an area of 6000 square miles and a population of four million was sometimes left in charge of a solitary English officer.”

সত্যি কথা বলতে কি, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে গেলে লোভাট সাহেবের পর্যবেক্ষণে কোনও ভুল ছিল না, বস্তুত, বঙ্গভঙ্গের প্রয়োজনীয়তা হিসেবে সরকারি তরফ থেকে প্রথমে বলা হয়েছিল, ছোটনাগপুর এবং ওড়িশা সহ সমগ্র বঙ্গদেশের সুবিশাল অঞ্চল একজন শাসকের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যা-ই বলে থাকুন না কেন, বঙ্গভঙ্গের কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকরা যা আলোচনা করেছেন তাতে মুলত দুটি বিষয়ই প্রধান হয়ে উঠে এসেছে — এক, প্রশাসনিক কারন এবং দুই, রাজনৈতিক কারণ। অমিতাভ চক্রবর্তীর মতে, “তিনটে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে লর্ড কার্জন এই কাজটি করেছিলেন। এক, বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজের ক্রমবর্ধমান আন্দোলন-প্রবণতার মুলে বাধা সৃষ্টি করা। কারণ এতে একটা আলাদা মুসলিম প্রধান প্রদেশ (পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ) সৃষ্টি হবে এবং হিন্দু অধ্যুষিত প্রদেশে (পশ্চিমবঙ্গ, ছোটনাগপুর ও ওড়িশা) বাঙালি শিক্ষিত হিন্দুসমাজ সংখ্যালঘুতে পরিণত হবেন — যাঁরা এখন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটা বিরাট হুমকি স্বরূপ। দুই, হিন্দু-মুসলমানের ভেতর স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করে পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এতে অন্য অর্থে ইংরেজ শাসনতান্ত্রিক সুবিধা পেতে পারে। তিন, আসামের চা-প্রধান অঞ্চল এবং পূর্ববঙ্গের পাট-প্রধান অঞ্চলকে একই শাসনকাঠামোর অন্তর্ভূক্ত করা।” বিষয়টা শেষ পর্যন্ত এমনটা দাঁড়ালেও, বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের সূচনাটি কিন্তু অন্যরকম কারণে হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বামপন্থী ঐতিহাসিক সুমিত সরকার লিখেছেন, “১৯০৩ অবধি সরকারি মহলে অবশ্য প্রশাসনিক বিবেচনাই ছিল সর্বপ্রধান।” জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠীও এই বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁর মতে, “এ সিদ্ধান্ত আজ বোধহয় তর্কাতীত যে ‘রাজদ্রোহী’ কংগ্রেসকে ধ্বংস করার কোনও উদগ্র বাসনা থেকে বঙ্গ-ভঙ্গ পরিকল্পনার জন্ম হয় নি। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে ইংরেজ আমলাদের প্রচণ্ড বাঙালী-বিদ্বেষ, আর বাংলার ভৌগোলিক এবং জনসংখ্যাবৃদ্ধি-জাত অতি জরুরী সমস্যা সমাধানের চেষ্টা থেকেই এর উদ্ভব। চরমপন্থী আন্দোলন জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাতে কংগ্রেসবিরোধী ভাবধারা যুক্ত হয়। কার্জন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কর্মকুশলতার দ্বারা তা কাজে পরিণত করতে পেরেছিলেন এবং সেই সঙ্গে মুমূর্ষূ কংগ্রেসের ধমনীতে সঞ্জীবনী রস সঞ্চার করেছিলেন।” ঘটনার পরম্পরাগুলি দেখলে আপাতদৃষ্টিতে তাই-ই মনে হয়। এই বিষয়টা বুঝতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কয়েকটি বছর।

১৯০২ সালে লর্ড কার্জন বলেছিলেন, “Bengal is ungovernably too large a charge for any single man.” কথাটা বোধহয় একদম অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তখন বাংলা প্রেসিডেন্সী বলতে বোঝাত, সমস্ত বঙ্গ ছাড়াও বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুরের কিছু অংশ ও আসাম। মেহবুব উল্লাহ জানিয়েছেন, উনিশ শতকের শেষভাগেই এই সুবিশাল অঞ্চলের আয়তন ছিল এক লক্ষ ঊননব্বই হাজার বর্গমাইল। বাস্তবিকই, লর্ড কার্জন এদেশে আসবার বহু আগে থেকেই এই প্রদেশের বিরাট আয়তন এবং বিশাল জনসংখ্যা প্রশাসকদের নিকট একটি জটিল সমস্যারূপে দেখা দিয়েছিল। অমলেশ ত্রিপাঠী জানিয়েছেন, ১৮৫৪ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সী যখন একটি স্বতন্ত্র প্রদেশে  পরিণত হয়, তখন তার আয়তন ছিল দুই লক্ষ তিপান্ন হাজার বর্গমাইল, জনসংখ্যা চার কোটি ষাট লক্ষ। ১৮৫৪ সালে প্রশাসনিক কারণেই এই প্রদেশে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের পদ সৃষ্টি করা হয়। উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষের সময়েই প্রশ্ন উঠেছিল প্রদেশের আয়তন নিয়ে। স্যার জন লরেন্স তখন বড়লাট। ‘১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগ : একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ’ প্রবন্ধে এমাজউদ্দিন আহমদ দেখিয়েছেন, ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যার প্রবল দুর্ভিক্ষের পর লেঃ গভর্নর উইলিয়াম গ্রে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “বর্তমান বাংলা সরকারের মতো এমন অস্বাভাবিক ব্যবস্থা ভারতে আর আছে বলে আমি জানি না। ভারতে আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তম প্রশাসনিক ব্যবস্থা আর গুরুত্বের দিক থেকে সর্বপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও বাংলা সরকারের কর্মক্ষমতা বোম্বাই ও মাদ্রাজ সরকার অপেক্ষা অনেক কম ও শ্লথ।” পরবর্তীকালে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্নর স্যার অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের বক্তব্যে। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছিলেন, “In Bengal, as it was constituted before the partition, there was an area of nearly two hundred thousand square miles, with seventy-eight and a half millions of people. It had been growing increasingly difficult, until it had become practically impossible, to conduct efficiently the administration of this great Province. It was not a matter only of the burden of work laid on the Lieutenant-Governor, but rather the impossibility of efficient working of the various departments of the Government. No head of a department was able efficiently to deal with the great charge committed to him. The result of this was that many of the Districts of Eastern Bengal had been practically neglected.” ‘ইন্ডিয়া আন্ডার কার্জন এ্যাণ্ড আফটার’ গ্রন্থে সমস্যাটি যথাযোগ্যভাবে তুলে ধরেছেন লোভাট ফ্রেজারঃ “A further drawback to good government in Bengal is that the province is overweighted by the City of Calcutta, which absorbs the attention of the Administration even in the hot season, destroys its sense of balance, … in Calcutta the fault has been on the other side. The capital has drawn all the strength out of the provincial authorities. Nowhere were the consequences of the defective administration of Bengal more visible than in the eastern districts. … In the permanently settled districts there was no Record of Rights; the cultivators were bullied and harassed by the agents of the absentee zamindars, … Very little was spent upon education, or on any branch of the Administration. While money was poured out upon Calcutta and its environs. Eastern Bengal was financially starved. The whole province suffered because its rulers were immersed in the preoccupations of Calcutta. The very railways were constructed, not to serve the needs of these millions of people, but to meet the requirements of the city on the Hooghly.”

বস্তুতপক্ষে পূর্ববঙ্গের পশ্চাৎমুখীনতার শুরু মুর্শিদকুলী খাঁর সময় থেকেই, ১৭০৪ সালে যখন তিনি ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নিয়ে যান। শুধুমাত্র রাজধানীই নয়, প্রশাসনিক প্রয়োজনে মুর্শিদকুলী খান ঢাকা থেকে সমস্ত উচ্চ ও নিম্নপদস্থ রাজকর্মচারীদেরও মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। নবাবকে সন্তুষ্ট রাখতে এবং নিজেদের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে সম্পদশালী ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিরাও দলে দলে ঢাকার পাট চুকিয়ে রাজধানীতে এসে আস্তানা গাড়েন। স্বভাবতই, এই ব্যাপক স্থানান্তর পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে ইংরেজদের দ্বারা কলকাতায় রাজধানী স্থাপন এবং কলকাতা কেন্দ্রীক অগ্রগতির ফলে পূর্ববঙ্গের জেলাগুলি অবহেলিত হতে থাকে। কে এম মোহাসীন ‘বঙ্গভঙ্গ’ শীর্ষক প্রবন্ধে জানিয়েছেন, “পূর্ব বাংলার প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল দুর্বল, অদক্ষ এবং স্বাভাবিকভাবেই কার্যকর ও সক্রিয় ছিল না। … শিক্ষা ছিল অবহেলিত ; যোগাযোগ ও উৎপাদন ব্যবস্থা অনুন্নত। কৃষকরা সাধারণতঃ কলকাতায় বসবাসকারী জমিদারদের এজেন্ট ও কর্মচারীদের হাতে অত্যাচারিত হত। ব্যবসা বাণিজ্যের দিক থেকেও এই অঞ্চল দারুণভাবে পশ্চাৎপদ হয়ে পড়ে। একথা অনস্বীকার্য যে, অবিভক্ত বাংলাদেশে বিশেষত পূর্ববঙ্গের জমিদারদের অধিকাংশই ছিলেন ‘অ্যাবসেন্টি ল্যান্ডলর্ড’, অর্থাৎ তাঁরা থাকতেন কলকাতা বা তার সন্নিহিত অঞ্চলে এবং তাঁদের হয়ে জমিদারি দেখাশোনা করতেন নায়েব ও গোমোস্তারা। এলাকাগুলির উন্নতির দিকে নজর ছিল না উভয়ের করোরই। সন্দীপন সেন অখণ্ড বাংলাদেশের নগরায়নের যে চিত্র দিয়েছেন তাতে দেখা যায় — প্রেসিডেন্সি বিভাগ ও বর্ধমান বিভাগে যেখানে শহরের সংখ্যা যথাক্রমে ৪৮ এবং ২৮ ; রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে সেখানে শহরের সংখ্যা মাত্র ২০, ১৭ এবং ৬। পক্ষান্তরে পশ্চিমবঙ্গের দুটি বিভাগে যেখানে গ্রামের সংখ্যা যথাক্রমে ২৭৮ ও ৮৬১ ; পূর্ববঙ্গের তিনটি বিভাগে গ্রামের সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমের বেশি — যথাক্রমে ১৯৫৪, ১৮৬৯ এবং ১৯০৪। স্পষ্টতই, নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় পূর্ববঙ্গের অঞ্চলগুলি অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। লোভাট ফ্রেজার আরও জানিয়েছেন, “The very landlords were absentees, squandering upon the delights of Calcutta the substance which their agents wrung from the peasantry. To the officials of the Bengal Government the province was a place of banishment, a land of strange waters to which troublesome or incompetent juniors could be consigned. Good administration stopped short at the Ganges. Beyond was a place where millions lived and worked and fought and committed crime almost unheeded. This is no fancy picture; it is a mild description of the luckless condition into which Eastern Bengal had fallen.”

১৮৬৬ সালে ওড়িশার দুর্ভিক্ষের পর এই প্রদেশের সুবিশাল আয়তন নিয়ে প্রশাসনিক মহলে একটা চিন্তাভাবনা আরম্ভ হয়। ১৮৬৭ সালে ভারত সচিব স্যার স্ট্যাফোর্ড নর্থকোট সুপারিশ করেন, প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বঙ্গপ্রদেশের আয়তন হ্রাসের। নর্থকোটের সুপারিশ অনুসারে ১৮৭৪ সালে আসাম পরিণত হল একটি পৃথক প্রদেশে, বাঙালী অধ্যুষিত সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়াকে সঙ্গে নিয়ে। ১৮৯২ সালে লুসাই উপজাতিদের বিদ্রোহের কারণে পুনরায় বাংলার সীমানা পূনর্গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সাথে চট্টগ্রাম ডিভিশনকেও আসামে সংযুক্ত করবার প্রস্তাবও এসেছিল, যদিও শেষপর্যন্ত সেইসব প্রস্তাব কার্যকর করা হয় নি। ১৮৯৬ সালে আবার প্রস্তাব আসে, পূর্ববঙ্গের একাধিক জেলা এবং আসাম মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রদেশ তৈরির। সুমিত সরকার লিখেছেন, “William Word, the chief commissioner of Assam, for the first time put forward the idea that the Dacca and the Mymensingh districts should go along with Chittagong division into Assam, thus making of that province a unit big enough for a separate administrative cadre.” অবশ্য আসামের পরবর্তী চিফ কমিশনার হেনরি কটন ঢাকা ও ময়মনসিংহের সংযুক্তিকরণের এই প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিলেন। ওই প্রস্তার সেই মুহুর্তে কার্যকর করা না হলেও ১৮৯৮ সালে দক্ষিণ লুসাই-কে আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হল। ১৯০১ সালে আবার বাংলার সীমানা নিয়ে প্রশ্ন উঠলো। এবার প্রস্তাবটি দিলেন অ্যানড্রু ফ্রেজার, সেন্ট্রাল প্রভিন্সের চিফ কমিশনার। তাঁর প্রস্তাব ছিল, প্রশাসনিক সুবিধার জন্য সীমানা অদলবদল করে হিন্দীভাষী সেন্ট্রাল প্রভিন্সের মধ্যে থাকা ওড়িয়া অধ্যুষিত সম্বলপুরকে বাংলা প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত করা। যদিও এই প্রস্তাবের মধ্যে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব নিহিত ছিল না। লোভাট ফ্রেজারের ভাষায়, “When Sir Andrew Fraser sat down in February 1901 to write an innocent letter about a linguistic question, he can never have dreamed that he was setting in motion a sequence of events which was to lead several years later to a widespread agitation in the Province of Bengal ; yet such was the case.”

ফ্রেজারের প্রস্তাবটি নিয়ে সরকারি স্তরে প্রায় দেড় বছর ধরে পর্যালোচনা চলল। অবশেষে ১৯০২ সালের ২৪শে মে নথিটি লর্ড কার্জনের টেবিলে পৌঁছালে, কার্জন আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা সম্বন্ধে কয়েকটি বিস্ফোরক মন্তব্য করেন — “For 14 months it never occurred to a single human being in the departments to mention the matter, or to suggest that it should be mentioned. Round and round like the diurnal revolution of the earth went the file, stately, solemn, sure, and slow ;” লর্ড কার্জনের এই বিশেষ মন্তব্যটি আজও ‘দ্য রাউন্ড এ্যাণ্ড রাউন্ড নোট’ নামে বিখ্যাত। এই সময়েই হায়দ্রাবাদের নিজামের কাছ থেকে বেরার অঞ্চলটি অধিগ্রহণ করেন কার্জন এবং প্রস্তাব করেন বেরার অঞ্চলকে বোম্বাইয়ের সঙ্গে এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলকে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার। অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে, “তখনও বৈজ্ঞানিক সীমানা বিন্যাসের প্রশ্নটা বড় ছিল, রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি যুক্ত হয়নি। যাইহোক, বিষয়টা তখনও আলোচনার স্তরেই সীমাবদ্ধ, এমন পরিস্থিতিতে ২৮শে মার্চ, ১৯০৩ সালে এক নোটে উইলিয়াম ওয়ার্ডের পূর্বতন প্রস্তাবই আরও ব্যাপক আকারে পেশ করলেন স্যার এ্যানড্রু ফ্রেজার, তিনি তখন বাংলার ছোটলাট। ফ্রেজার, অবিভক্ত বাংলা প্রেসিডেন্সির শেষ লেফটেন্যান্ট গভর্নর, বঙ্গবিভাগের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন এই বলে যে, “It had been growing increasingly difficult, until it had become practically impossible, to conduct efficiently the administration of this great Province. It was not a matter only of the burden of work laid on the Lieutenant-Governor, but rather the impossibility of efficient working of the various departments of the Government. No head of a department was able efficiently to deal with the great charge committed to him. The result of this was that many of the districts of Eastern Bengal had been practically neglected.” ভারতের আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাস বিষয়ক একটি কমিটির মিনিটস-এ ১লা জুন, ১৯০৩ কার্জন ব্যাপারটি মেনে নিয়ে পরিকল্পনাটি ত্বরান্বিত করবার হুকুম দিলেন। আসন্ন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবটিকে ৯ই অক্টোবর ‘দি বেঙ্গলী’ পত্রিকা ‘A Retrograde Measure’ নামে অভিহিত করে তীব্র প্রতিবাদ জানালো। সরকারিভাবে সর্বপ্রথম বিষয়টি ঘোষণা হল, ৩রা ডিসেম্বর ১৯০৩-এ স্বরাষ্ট্রসচিব হারবার্ট হোপ রিজলির একটি চিঠিতে — আসামের সঙ্গে ঢাকা, ময়মনসিংহ, পার্বত্য ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম জুড়ে একটি আলাদা প্রদেশের সৃষ্টি হবে, ছোটনাগপুর যাবে মধ্যপ্রদেশে, বাংলা পাবে সম্বলপুর ও গঞ্জাম। পরিকল্পনার সমর্থনে রিজলি দুটি যুক্তি হাজির করলেন — বাংলার ভার লাঘব ও আসামের উন্নতি। সুমিত সরকার জানিয়েছেন, “এটা অবশ্য উল্লেখ করা দরকার যে, ‘প্রশাসনিক সুবিধে’ কোনো বিমূর্ত বা নিষ্পক্ষ ব্যাপার ছিল না। বরং প্রায়শই তা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল ব্রিটিশ বড়কর্তা ও ব্রিটিশ ব্যবসাদারদের সুবিধের সঙ্গে। রিজলির যুক্তি ছিল, আসামের প্রসার হওয়া দরকার, ‘যাতে এখানকার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের আরও বিস্তৃত ও আরও আকর্ষনীয় কর্মক্ষেত্র দেওয়া যায়’, এবং ‘এর চা, তেল ও কয়লাশিল্পের বিকাশের উদ্দেশ্যে একটি সামুদ্রিক নির্গম পথের ব্যবস্থা হয়’। (এর সঙ্গে যোগ করা যায়, এই সব শিল্পই ছিল শ্বেতাঙ্গপ্রধান)।”

এলাহাবাদের ‘দি পায়োনিয়র’ পত্রিকায় মুদ্রিত একটি প্রবন্ধ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে ‘দি বেঙ্গলী’ প্রথম প্রতিবাদ-মূলক সম্পাদকীয় প্রকাশ করলো ১০ই ডিসেম্বর। এরপর ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ রিজেলের পত্রটি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করে দিলে তুমুল বিক্ষোভ আরম্ভ হল। এইসব প্রতিবাদে বিরক্ত হয়ে ৭ই ফেব্রুয়ারি রিজলে একটি নোটে লিখলেন, “Bengal united is a power; Bengal divided will pull in several different ways. That is perfectly true and is one of the merits of the scheme.” এইসব বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের খবর কার্জনের কাছেও পৌঁছেছিল। ভারতসচিব ব্রডরিককে ৩১শে ডিসেম্বরের লেখা একটি চিঠিতে কার্জনের বক্তব্যটাই ছিল এইরকম — “The turmoil over redistribution of boundaries he pooh poohed as ‘artificial description’. The whole question, had been kept boiling for a long time but as soon as he attempted a rational solution, ‘at once a prodigious outcry is raised by all the parties whom it is proposed to take away from Bengal, that they are being torn from the bosom of their ancestral mother, and that the act of spoliation is both a blunder and a crime. Dacca and Mymensingh, which it was proposed to incorporate with Assam, are rending the air with piteous outcries. … So far, in the hundreds of articles and letters that I have read upon the subject, at any rate of the partition of Eastern Bengal, I have not found one single line of argument ; there is nothing but rhetoric and declamation ; and one almost begins to weary of attempting anything in the nature of a positive administrative reform in a country where so few people will ever look ahead, where public opinion is so unstable and ill-informed and where sentiment overrides almost every other consideration.’ Why should he have to listen to ‘a stale rehash of belated cries and obsolete platitudes” coming from “untaught and unteachable’ Congress leaders? Moreover, the very hysteria of the Congress and the Bengali leaders was proof that his bureaucracy was on the right track, that the partition of Bengal was politically desirable.” পরবর্তীকালে ১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯০৪, আরও খোলাখুলিভাবে ব্রডরিককে লিখেছিলেন কার্জন, “বাঙলীরা নিজেদের একটা মহা জাতি মনে করে এবং তার‍া এমন একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যখন দেশ থেকে ইংরেজরা বিতাড়িত হয়েছে এবং জনৈক ‘বাবু’ কলকাতার লাট-প্রাসাদে অধিষ্ঠিত! এই সুখ-স্বপ্নের প্রতিকূল যে-কোনও ব্যবস্থা তারা নিশ্চয়ই ভীষণভাবে অপছন্দ করবে। আমরা যদি দুর্বলতা বশতঃ তাদের হট্টগোলের কাছে নতি স্বীকার করি তবে কোনও দিনই আর বাংলার আয়তন হ্রাস বা বাংলা ব্যবচ্ছেদ সম্ভব হবে না। (এ পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে) আপনি ভারতবর্ষের পূর্ব-সীমান্তে এমন একটা শক্তিকে সংহত ও সুদৃঢ় করবেন যা এখনই প্রচণ্ড, এবং অদূর ভবিষ্যতে যা সুনিশ্চিতভাবেই ক্রমবর্ধমান অশান্তির উৎস হয়ে উঠবে।”

প্রকাশ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অস্বীকার করা হলেও গোপন সরকারি মন্তব্য এবং ব্যক্তিগত কাগজপত্রে বঙ্গভঙ্গের পিছনে ব্রিটিশ প্রশাসনের আসল উদ্দেশ্য ধরা পড়ে গেল। ব্রিটিশ চেয়েছিল, ক্রমেই শিক্ষা সংস্কৃতিতে ইংরেজদের সমতুল্য হয়ে ওঠা হিন্দুদের একটু টাইট দিতে। বঙ্গভাগের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকা খোলাখুলিই লিখেছিল, “To foster in Eastern Bengal the growth of a Mohammedan power, which it is hoped, will have the effect of keeping in check the rapidly going strength of the educated Hindu community.” প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, তৎকালীন ভারতসচিব জন ব্রডরিক বাংলার প্রশাসনকে ভারমুক্ত করবার উদ্দেশ্যে আর একটি প্রস্তাব করেছিলেন — ভাষাগতভাবে পৃথক বিহার ও ওড়িশাকে আলাদা করে দেওয়া, যা কার্জন বাতিল করেন রাজনৈতিক কারণে। এক টেলিগ্রামে কার্জন তাঁকে বলেন, “এতে বাইরের সব উপাদান থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে বাঙালি অংশটিকে সংহত করার প্রবণতা দেখা দেবে, এবং আমরা যে পরিনাম এড়াতে চাই তারই সৃষ্টি করবে। আমাদের প্রস্তাবের রাজনৈতিক সুবিধার সব সেরা গ্যারান্টি এই যে, কংগ্রেস দল এটি অপছন্দ করছে।” সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদীরা অভিযোগ করেছিলেন যে, ব্রিটিশ পদাধিকারীদের বিভিন্ন মন্তব্যে হিন্দু-মুসলমান বিরোধকে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী জানিয়েছেন, “নুতন দুটো কারণ দেখানো হল — (১) কলকাতার বিপজ্জনক প্রভাব থেকে পূর্ববঙ্গ মুক্ত হবে, (২) মুসলিম অধিবাসীদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা সম্ভব হবে।” এই প্রথম ব্রিটিশ প্রশাসনের মুখে সাম্প্রদায়িকতার সুর শোনা গেল, এবং তা যার তার মুখে নয় ; স্বয়ং বড়লাট লর্ড কার্জনের মুখে ১৯০৪ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি ঢাকাতে আয়োজিত একটি সভায়। ওই সভায় তিনি এমন এক পরিস্থিতির সম্ভাবনার কথা শোনালেন যা পূর্ববঙ্গের প্রজারা নবাবি আমলের পর আর ভোগ করেন নি। “When then a proposal is put forward which would make Dacca the centre, and possibly the capital, of a new and self-sufficing administration which must give to the people of these districts by reason of their numerical strength and their superior culture the preponderating voice in the province so created, which would invest the Mahomedans in Eastern Bengal with a unity which they have not enjoyed since the days of the old Mussulman Viceroys and Kings, which must develop local interests and trade to a degree that is impossible so long as you remain, to use your own words, the appanage of another administration, and which would go far to revive the traditions which the historical students assure us once attached to the Kingdom of Eastern Bengal — can it be that the people of these districts are to be advised by their leaders to sacrifice all these great and incontestable advantages, from fear of being tied on to the tail of the humble and backward Assam? It is not transparent, Gentlemen, that you must be the head and heart of any such new organism, instead of the extremities, and do you really meant to be so blind to your own future as to repudiate the offer?”

এই পর্যায়ে যে নামটি সবচেয়ে বেশি উঠে আসে তা হল ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ। তিনি মনে করতেন, বঙ্গদেশে বিশেষত পূর্ববাংলায় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হওয়া সত্ত্বেও বিহার ও উড়িষ্যার সঙ্গে বাংলাকে যুক্ত রেখে তাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত করে রাখা হয়েছে। এমন অবস্থায় তাদের পক্ষে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করা সম্ভব নয়। তাই যখন ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক স্বার্থে, পরবর্তীকালে যা রাজনৈতিক স্বার্থে পরিণত হয়েছিল, বাংলাকে বিভক্ত করে পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ তৈরি করবার কথা চিন্তাভবনা করছিল, নবাব সলিমুল্লাহ তা দুহাত বাড়িয়ে লুফে নিলেন। মোহাম্মদ শেরেজ্জামান লিখেছেন, “১৯০৪ সালের ১১ই জানুয়ারি তিনি পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দসহ স্থানীয় কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে এক বৈঠকে আহ্বান করে সরকারের বঙ্গ বিভাগ পরিকল্পনার কিছু বিষয়ে বিরোধিতা করেন। তিনি পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের সুবিধার্থে ঢাকায় রাজধানী করে বৃহত্তর প্রদেশ গঠনের এক বিকল্প প্রস্তাব পেশ করলেন।” ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের প্রতি ঢাকার নবাবের সমর্থন আদায় করতে লর্ড কার্জন সেই কুখ্যাত সফরে পূর্ববঙ্গে এসে সলিমুল্লাহের আতিথ্য গ্রহণ করলেন। বঙ্গ বিভাগ নিয়ে উভয় পক্ষের বিশদ আলোচনা হল। অভিযোগ ওঠে, এই সফরেই সলিমুল্লাহকে কার্জন নাম মাত্র সুদে এক লক্ষ পাউন্ড ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বশীভূত করেছিলেন যার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলমান বিরোধ জাগিয়ে তুলে প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সৃষ্টি হওয়া নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধকে দুর্বল করা। হেনরী নেভিনসন লিখেছেন, “Shortly after the Partition the Government of India advanced a loan to relieve the Nawab’s private munificence from bankruptcy — a loan amounting to about 1 00,000, at what was, for India, a very low rate of interest. This benevolent action, combined with certain privileges granted to Mohammedans, was supposed by many Hindus to have encouraged the Nawab and his co-religionists in taking a still more favourable view of the Partition itself.” এইখানে মুনতাসীর মামুন প্রশ্ন তুলেছেন যে, বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ পাওয়ার জন্যই নবাব সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গের সমর্থন করেছিলেন — এই মন্তব্যটি আংশিকভাবে সত্য, কারণ ঋণ দেওয়া হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের বেশ খানিকটা পরে। বরং তাঁর মতে, “পূর্ববঙ্গ আলাদা প্রদেশ এবং ঢাকা রাজধানী হলে নবাবের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পাবে, এধরণের মনোগত ইচ্ছা যে তাঁর ছিল না এমন কথা বোধহয় বলা যায় না।” মামুন সাহেব ভুল কিছু বলেন নি কিন্তু তিনি এটাও প্রমাণ করতে পারেন নি যে, ঋণের প্রস্তাবটি বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার আগে দেওয়া হয় নি। সলিমুল্লাহ সম্পর্কে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছেন ঐতিহাসিক মোজহারুল ইসলাম — “লর্ড কার্জন ১৯০২ সাধারণ অব্দে সলিমুল্লাহ সাহেবকে ‘নবাব’ খেতাব দিয়েছিলেন। ১৯০৩ সাধারণ অব্দে পুনরায় তাঁকে কে.সি.আই.ই (নাইট কমান্ডার অফ ইন্ডিয়ান এম্পায়ার) খেতাবে ভুষিত করলেন।” সেই কৃতজ্ঞতাবোধেই কি কার্জনের বঙ্গভঙ্গ প্রোজেক্ট সফল করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ? কারণটা যাই-ই হোক না কেন, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ইত্যাদি জেলায় একাধিক দাঙ্গা করানো হল। রবি জীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে — “বলা চলে, এর দ্বারাই পাকিস্থানের বীজ রোপিত হল।”

১৯০৪ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বাংলা ভাগের ব্যাপারটা ঠাণ্ডাঘরেই থাকে। আসলে ৩০শে এপ্রিল কার্জন ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন ছুটি কাটাতে এবং তাঁর পরিবর্তে সাময়িকভাবে কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন অ্যাম্পট হিল। পুনরায় আলোড়ন দেখা দিল নভেম্বর মাসে ‘পাইওনিয়ার’ পত্রিকা যখন প্রচার করলো, সমস্ত পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ ও আসাম মিলে নুতন এক প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব ভারত সরকার গ্রহণ করেছেন।  ইতিমধ্যে প্রস্তাবিত নুতন প্রদেশে রাজশাহী এবং মালদহ বিভাগও যোগ করেছেন রিজলে। সরকারের অভিপ্রায় জানবার জন্য ব্যবস্থাপক সভায় ভারতীয় সদস্যরা প্রশ্ন করলেও সরকারপক্ষ থেকে কোনও সঠিক উত্তর দেওয়া হল না। ১৯০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেসের বোম্বে অধিবেশনে প্রতিনিধিরা হেনরী কটনের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রস্তাব পাশ করলেন। ১৯০৫ সালের ১০ই জানুয়ারি কলকাতার টাউন হলের সভায় সরকারি প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করা হল। ইতিমধ্যে লর্ড কার্জন ইংল্যান্ডে গিয়ে নিজ কার্যকাল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গভঙ্গেরও প্রস্তাব পাকা করে এসেছিলেন। মে মাসে বিলেতের ‘স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকা প্রকাশ করলো যে ভারতসচিব বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন। যদিও পার্লামেন্টের সভ্য হার্বাট রবার্টসের প্রশ্নের জবাবে ভারতসচিব জানালেন, প্রস্তাব এখনও বিচারাধীন আছে। ইন্ডিয়া কাউন্সিলে যেটুকু বিরোধিতা ছিল তা কাটিয়ে ভারতসচিব ব্রডরিক ৪ঠা জুলাই ১৯০৫, পার্লামেন্টে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। ইতিমধ্যে, অর্থাৎ ডিসেম্বর ১৯০৩ এবং জুলাই ১৯০৫ এর অন্তর্বর্তীকালীন সময়টুকুতে ফ্রেজার-রিজলি-কার্জন জোট পর্দার আড়ালে প্রস্তাবটি রূপান্তরিত করলেন পুরোদস্তুর এক ব্যবচ্ছেদে। যা নিয়ে পরবর্তীকালে লর্ড হার্ডিঞ্জ কার্জনকে লিখেছিলেন — “বাংলা বিভাগ ছিল একটা বিরাট প্রশাসনিক সংস্কার, প্রয়োজনীয় ও যুক্তিসঙ্গত আর এর জন্য কৃতিত্বের একমাত্র দাবিদার আপনিই।” আসাম, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগ, পার্বত্য ত্রিপুরা এবং মালদহ প্রস্তাবিত নুতন প্রদেশ ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’এর অন্তর্ভূক্ত হল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “The revised scheme was conceived in secret, and settled in secret, without the slightest hint to the public. The idea of submitting it to a representative conference was no longer followed. ‘The final scheme’, said Lord Morley from his place in Parliament, ‘was never submitted to the judgement of anybody in Bengal’.” ৯ই জুলাই ভারতসচিবের ডিসপ্যাচ প্রকাশিত হল। অবশ্য তার আগেই ৬ই জুলাই ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় ‘বঙ্গের সর্ব্বনাশ’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই খবর প্রচারিত হয়ে যায়। ৮ই জুলাই বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের অধিবেশনে অম্বিকাচরণ মজুমদার বললেন, “Sir, even the worst criminal has a right to be furnished with a copy of his indictment before he is condemned ; but the Government have decided the fate of over 30 million of His Majesty’s innocent subjects even without a hearing.”

১৯শে জুলাই সিমলা থেকে বিশেষ গেজেটে সরকারি রেজিলিউশন ঘোষণা করা হল। পরের দিন সমস্ত সংবাদপত্রে সরকারি সিদ্ধান্তের খবর প্রকাশিত হওয়া মাত্রই আগুনে ঘৃতাহুতি পড়লো। বঙ্গনিবাসীর একটা ক্ষীণ আশা ছিল, বোধহয় শেষপর্যন্ত সরকার পিছিয়ে যাবে। কিন্তু ১৯শে জুলাই সিমলার অধিবেশনে ব্রিটিশ সরকার ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের দিন ধার্য করে ঘোষণা করতেই বাঙালীর মাথায় যেন বজ্রপাত হল। সুরেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “The announcement fell like a bomb-shell upon an astonished public. … We felt that we had been insulted, humiliated and tricked. We felt that the whole of our future at stake, and that it was a deliberate blow aimed at the growing solidarity and self-consciousness of the Bengalee-speaking population.”

বঙ্গ-ব্যবচ্ছেদ প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছিলেন বাংলার প্রাক্তন মুখ্য সচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিব এবং আসামের প্রাক্তন কমিশনার হেনরী জন স্টেডম্যান কটন। তিনি কিন্তু আগাগোড়াই ছিলেন বঙ্গভঙ্গ প্রশ্নে বাঙালী জনমতের উপর শ্রদ্ধাশীল এবং বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল। আগেও তিনি আসাম ও পূর্ববঙ্গের সংযুক্তিকরণকে অবিবেচনার ফল বলেছিলেন। ১৯০৪ সালের ৫ই এপ্রিল ‘ম্যাঞ্চেষ্টার গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় তিনি প্রকাশ্যভাবে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের সমালোচনা করে লিখলেন, “The idea of the severance of the oldest and most populous and wealthy portion of Bengal and the division of its people into two arbitrary sections has given such a shock to the Bengalee race, and has roused such a feeling amongst them as was never known before. The idea of being severed from their brethren, friends and relations and thrown in with a backward provinces like Assam, which is administrative, linguistic, social and ethological features widely differs from Bengal, is so intolerable to the people of the affected tracts that public meetings have been hold in almost every town and market-place in East Bengal, and the separation scheme has been universally and unanimously condemned.” ১৯০৪ সালে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের বিংশতিতম অধিবেশনের সভাপতি কটন আশা ব্যক্ত করেছিলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে ভারতবর্ষে স্বাধীন রাজ্যসমূহের সমন্বয়ে সৃষ্টি হবে একটি ফেডারেশন যা পরিচিত হবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে। কটন খুব একটা ভুল আশা করেন নি বোধহয়।

তথ্যসূত্র :

১) ভার্নি লোভেট, এ হিস্ট্রি অফ দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট, ফ্রেডারিক এ স্টোকস কোম্পানী পাবলিশার্স, ১৯২০

২) লোভাট ফ্রেজার, ইন্ডিয়া আন্ডার কার্জন এ্যাণ্ড আফটার, উইলিয়াম হেইনম্যান, ১৯১১

৩) অমিতাভ চক্রবর্তী, বাঙালি মনন : সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িকতা, উবুদশ, ২০০০

৪) সুমিত সরকার, আধুনিক ভারত : ১৮৮৫-১৯৪৭, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, ১৯৬০

৫) অমলেশ ত্রিপাঠী, ভারতের মু্ক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১২

৬) মাহবুব উল্লাহ, বঙ্গভঙ্গ : তৎপরবর্তী সমাজ ও রাজনীতি, বঙ্গভঙ্গ শতবর্ষ উদযাপন কমিটি, ২০০৭

৭) মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, বঙ্গভঙ্গ, সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র, ২০০২

৮) অ্যান্ড্রু ফ্রেজার, এ্যামং ইন্ডিয়ান রাজা’স এ্যান্ড রায়ত’স, শেলি এ্যান্ড কোং লিমিটেড, ১৯১১

৯) সুমিত সরকার, দ্য স্বদেশী মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল, পিপল’স পাবলিশিং হাউস, ১৯৭৩

১০) অমলেশ ত্রিপাঠী, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস : ১৮৮৫-১৯৪৭,

আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮৫

১১) অমলেশ ত্রিপাঠী, দ্য এক্সট্রিমিস্ট চ্যালেঞ্জ : ইন্ডিয়া বিটুইন ১৮৯০ এ্যান্ড ১৯১০, ওরিয়েন্ট লঙম্যানস, ১৯৬৭

১২) বিমলানন্দ শাসমল, স্বাধীনতার ফাঁকি, আল ইত্তেহাদ পাবলিকেশন্স, ১৯৯১

১৩) স্পিচেস বাই লর্ড কার্জন অফ কেডলেস্টন তৃতীয় খণ্ড, গভর্নমেন্ট পেপারস, সুপারেন্টেনডেন্ট অফ গভর্নমেন্ট প্রিন্টিং, ১৯০৫

১৪) অনিরুদ্ধ রায় সম্পাদিত, ইতিহাস অনুসন্ধান উনবিংশ বর্ষ, ফার্মা কে এল এম লিমিটেড, ২০০৫

১৫) হেনরী নেভিনসন, দ্য নিউ স্পিরিট অফ ইন্ডিয়া, হারপার অ্যান্ড ব্রাদার্স, ১৯০৮

১৬) মুনতাসীর মামুন, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে প্রতিক্রিয়া, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯

১৭) মোজহারুল ইসলাম, আমি স্মৃতি আমি ইতিহাস, বুক সোসাইটি, ১৯৮৭

১৮) প্রশান্তকুমার পাল, রবি জীবনী পঞ্চম খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৫

১৯) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, এ নেশন ইন মেকিং, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৩

২০) হরিদাস মুখোপাধ্যায় উমা মুখোপাধ্যায়, স্বদেশী আন্দোলন ও বাংলার নবযুগ, সারস্বত লাইব্রেরী, ১৯৬১

মন্তব্য তালিকা - “বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫ : প্রশাসনিক মুখোশের আড়ালে রাজনৈতিক মুখ?”

  1. খুব তথ্যনিষ্ঠ লেখা। একটা অনুরোধ – আরো একটা লেখা ওনার কাছে চাইছি – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এবং তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা।

  2. অমূল্য তথ্য নির্ভর বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। সমৃদ্ধ হয়েছি । আর‌ও কিছু তথ্য জানার আশায় রইলাম। তবে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন বারেবারে ঘুরে ফিরে আসছে, সেই সময় কংগ্রেস নেতা নেত্রীদের ভূমিকা কি ছিল ?

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।