সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

নেলসন ম্যাণ্ডেলা

নেলসন ম্যাণ্ডেলা

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

ডিসেম্বর ৫, ২০২১ ৫৫২ 0

রুড গুলিট ও নেলসন ম্যাণ্ডেলা


ডাচ ফুটবল খেলোয়াড় রুড গুলিটকে মনে আছে? গুলিটকে বলা হত ব্ল্যাক টিউলিপ। সমকালীন পৃথিবীর অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। তবে শুধু খেলোয়াড় নয়, তিনি ছিলেন এক কণ্ঠস্বর, লাখো মানুষের আওয়াজ তৈরি হত তাঁর নেতৃত্বে।

১৯৮৭ সালে রুড গুলিট ব্যালন ডি’অর ট্রফি জিতে সেই সময় কারাগারে বন্দি নেলসন ম্যাণ্ডেলার উদ্দেশ্যে ট্রফি উত্সর্গ করেছিলেন।  তখন কিছু মানুষ রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের জন্য তাকে সমালোচনা করেছিল, তিনি বলেছিলেন, ‘এটা রাজনীতি নয়, এ কেবল এক মানবিক সিদ্ধান্ত।’

নিপীড়িত মানুষের কথা সকলের সামনে তুলে ধরলে তাকে রাজনীতি বলে না, তাকে বলে মানবিকতা, মানুষের কথা।  আন্তর্জাতিকতাবাদী মানুষ সারা পৃথিবীর নিপীড়িতদের পক্ষে দাঁড়ায়- ইউরোপের ফুটবল মাঠ বা বাংলার মিছিল একই আওয়াজ তুলতে পারে।

তখনও বর্ণবাদ নিয়ে পৃথিবী জুড়ে আন্দোলন ছিল না।  ইউরোপের খেলার মাঠ থেকে গুলিট একটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে গুলিটকে ম্যাণ্ডেলা বলেছিলেন, ‘আজ আমার অনেক বন্ধু, তবে যখন আমি ভেতরে (কারাগারের) ছিলাম, সামান্য যে ক’জন বন্ধু ছিল তুমি তার মধ্যে একজন।’

দক্ষিণ আফ্রিকা ও বর্ণবাদ

আজকে অনেকেই আশ্চর্য হয়ে যাবেন জেনে যে, আশির দশকেও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ নেলসন ম্যাণ্ডেলা সম্পর্কে কতটা সংশয়ী, নির্বিবেক এবং সমালোচক ছিল। ম্যাণ্ডেলা ও তাঁর বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনকে উন্নত দেশের মানুষ, ইউরোপ ও আমেরিকা, সন্দেহের চোখে দেখত।  ওদের কাছে ম্যাণ্ডেলা ছিলেন এক কমিউনিস্ট। আর এসবই কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র।  কমিউনিস্ট বিরোধিতার গঙ্গাজলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইন করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য মান্যতা পেয়ে যায়।

১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাতে বর্ণবাদ চালু হয়। অবশ্য তার আগে থেকেই ওই অঞ্চলে জাতিগত বৈষম্য চালু ছিল।  তবে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকাতে (বর্তমানে নামিবিয়া) জাতিগত পৃথকীকরণের আইন চালু করা হয়। বর্ণবাদী পৃথকীকরণ দাঁড়িয়ে আছে শ্বেত আধিপত্যবাদের তত্ত্বের ওপরে।

শ্বেতাঙ্গ ক্ষমতাশালীরা দেশের মানুষকে কয়েকটি নরগোষ্ঠীতে ভাগ করে সেই মত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ দেবার আইন তৈরি করে নিয়েছিল। নিগ্রয়েডরা ছিল সংখ্যায় সবচাইতে বেশি আর তাদের ক্ষমতা ছিল সবচাইতে কম।  ককেশিয়রা সংখ্যায় ছিল কম আর ক্ষমতা ছিল সবচাইতে বেশি। মাঝের বিভিন্ন স্তরে ছিল মিশ্র মানুষ ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা। ১৯৪৮ সালের আইন শ্বেতাঙ্গদের ওই দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের ওপরে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য দেবার বন্দোবস্ত পাকা করে দেয়।  এই আইনের ফলে সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকতে হয় দেশীয় কালো মানুষদের।

বর্ণবাদ তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় সর্বব্যাপী। ব্যক্তি মানুষের বাসস্থান, চাকরি পাবার অধিকার থেকে আরম্ভ করে তার বিবাহ, পার্ক বা ট্রেনে ওঠার অধিকার, সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হত রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে বর্ণবাদী আইনের প্রয়োগে।

এই আইনের ফলে ১৯৬০ এবং ১৯৮৩ সালের মধ্যে ৩৫ লক্ষ কালো আফ্রিকানকে তাদের নিজের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে পার্শ্ববর্তী কোন অঞ্চলে জোর করে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। কারণ সাদা, ভারতীয় ও কালোরা একত্রিতভাবে, এক পাড়ায় থাকতে পারবে না।

মূলতঃ ব্রিটেন এবং আমেরিকার মদতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, হলোকস্ট পরবর্তী পৃথিবীতেও, মানব ইতিহাসের চূড়ান্ত বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে রমরমিয়ে চলেছে। সেই সময়ে ইউনাইটেড নেশন্স মাঝে মধ্যে মৃদু হুঙ্কার দিয়েছে।  জাতিসংঘের বেশিরভাগ দেশ চোখ বন্ধ করে বসে থেকেছে; যুক্তি দিয়েছে, বর্ণবাদ দক্ষিণ আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ বিষয়, জাতিসংঘের এখতিয়ারের বাইরে। আবার ওই একই সময়ে আমেরিকা গুয়াতেমালা থেকে কঙ্গো, ইন্দোনেশিয়া থেকে ভিয়েতনাম, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বাম ও কমিউনিস্ট বিরোধী শক্তিগুলিকে মদত দিয়ে সামরিক শক্তির সাহায্যে সংখ্যাগুরু শক্তিকে উচ্ছেদ করতে চেষ্টা করেছে।  অধিকাংশ সময়ে সফলও হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করতে হবে নেলসন ম্যাণ্ডেলার জীবন।

নেলসন ম্যাণ্ডেলার জীবন ও সংগ্রাম

ম্যাণ্ডেলা এক উপজাতি প্রধানের ঘরে ১৯১৮ সালে ১৮ই জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। জোহানেসবার্গে আইন পড়বার সময়ে তিনি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৯৪৪ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন।

বর্ণবাদী সরকারকে উচ্ছেদ করা ছিল তখন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের মূল কর্মসূচি। ওই সময়ে ম্যাণ্ডেলা অন্যান্য সতীর্থদের সাথে বহুবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। আবার জেল থেকে বেরিয়ে এসে রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যেই মার্কসবাদ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি নিষিদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টিতে (এসএসিপি) পঞ্চাশের দশকে গোপনে যোগ দেন।

১৯৬০ সালের ২১ মার্চ পাশ বই রাখার আইনের প্রতিবাদে ৭০০০ মানুষ শার্পভিলের পুলিশ স্টেশনে যখন প্রতিবাদ জানাচ্ছে তখন পুলিশের গুলিতে ৬৯ জন পুরুষ, নারী ও শিশু নিহত হয়। এরপরে দেশে জরুরি অবস্থা চালু করে ১৮,০০০ আন্দোলনকারীকে বন্দি করা হয়। শার্পভিল হত্যাকাণ্ডের পরে পৃথিবীর কাছে পরিষ্কার বার্তা যায়, নিজের দেশের মানুষকে হিংস্রভাবে দমন করে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ টিকে আছে।

শার্পভিল ঘটনার প্রতিবাদে দেশের মানুষ উত্তাল হয়ে ওঠে। উল্টো দিকে পুলিশি দমনপীড়ন বাড়তে থাকে।  আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস নিষিদ্ধ হয়। ম্যাণ্ডেলা তার কমরেডদের সাথে গুপ্ত জায়গা থেকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এএনসি  নিষিদ্ধ হওয়ার পরে ম্যাণ্ডেলা এএনসি-র মধ্যে সামরিক শাখা তৈরি করতে চাইলেন। ১৯৬১ সালের জুনে, এএনসি-র কার্যনির্বাহী কমিটি সশস্ত্র যুদ্ধ কৌশল ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, কোন সদস্য ম্যাণ্ডেলার সাথে যুক্ত হতে চাইলে এএনসি-র পক্ষ থেকে তাকে বাধা দেওয়া হবে না। যদিও প্রথম দিকে তিনি অহিংস প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তবে ১৯৬১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জোটবদ্ধ ভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত অভিযানের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬২ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাবন্দী করা হয় এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। সেই সময়ে রিভোনিয়া ট্রায়ালে কোর্টে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘I Am Prepared to Die’

তাঁর সেই দীর্ঘ বক্তৃতা ইতিহাস হয়ে গেছে, “The time comes in the life of any nation when there remain only two choices – submit or fight.  That time has now come to South Africa.  We shall not submit and we have no choice but to hit back by all means in our power in defence of our people, our future, and our freedom… Our march to freedom is irreversible.  We must not allow fear to stand in our way.  Universal suffrage on a common voters’ role in a united democratic and non-racial South Africa is the only way to peace and racial harmony….

ম্যাণ্ডেলাকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ দেওয়া হয়। তিনি ২৭ বছর বিভিন্ন দ্বীপে কারাদণ্ড ভোগ করেন।

শেষপর্যন্ত জাতিগত গৃহযুদ্ধের ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ সঙ্কট এবং আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতজানু হয়ে রাষ্ট্রপতি ডি ক্লার্ক ১৯৯০ সালে তাঁকে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯৪ সালে সব বর্ণের মানুষের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে ম্যাণ্ডেলা রাষ্ট্রপতি হন।  তখন দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবৈষম্য, জাতি ঘৃণা ও তীব্র শোষণে ক্ষতবিক্ষত। এই প্রেক্ষাপটে ম্যাণ্ডেলা চেয়েছিলেন বর্ণবাদী গোষ্ঠীগুলির সাথে কিছুটা সহাবস্থান। অবশ্য একই সাথে অতীতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলির তদন্তের জন্য কমিশন গঠন করেছিলেন। আবার সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতিতে পূর্বসূরীর উদার কাঠামো ধরে রেখেও ভূমি সংস্কার, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই ও স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

প্রেম, পরিবার ও আফ্রিকার মুক্তিযুদ্ধ

তাঁর জীবনে প্রেম এসেছে, সেই প্রেম দুর্বিষহ হয়ে গেছে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আবার প্রেমে পড়েছেন। উইনি মাদিকিজেল। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে সেই প্রেমও টেঁকেনি। বহু সন্তান এসেছে।  অনেকে মারাও গেছে। কারাগারে বসে খবর পেয়েছেন প্রথম সন্তানের গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর।  পুত্রের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে লিখেছেন, “I returned to my cell and lay on my bed.  I do not know how long I stayed there … Finally Walter [Sisulu] came to me and knelt beside my bed, and I handed him the telegram.  He said nothing, but only held my hand.  I do not know how long he remained with me.  There is nothing one man can say to another at such a time.”

সন্তান ও পরিবারকে সময় না দিতে পারার অপরাধ বোধ থেকেছে। আর ছিল উইনিকে নিয়ে আবেগ, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা। বিভিন্ন সন্দেহজনক অপরাধে, বিশেষ করে ১৪ বছরের এক এক্টিভিস্টের খুনের ঘটনায় উইনির জড়িয়ে পড়ার কথা জেলে বসে শুনেছেন। তাঁর অন্তর্বেদনা ধরা পড়ে কিছু চিঠিতে।

কারাগারে বন্দি অবস্থায় প্রথমে বছরে মাত্র দুটি চিঠি দিতে পারতেন। শেষে ১৯৮১ সাল থেকে তা দাঁড়ায় মাসে দুটি। উইনিকে লেখা দুটি চিঠির অংশ দেই। ১৯৭৯ সালে ১৫ বছর জেলে থাকবার পরে উইনিকে লেখেন, At my age, I would have expected all the urges of youth to have faded away.  But it does not appear to be so.  The mere sight of you, even the thought about you, kindles a thousand fires in me.”

তার তিন বছর পরে লেখেন, “I have been fairly successful in putting on a mask behind which I have pined for the family alone, never rushing for the post when it comes until someone calls out my name.  I also never linger after visits, although sometimes the urge to do so becomes quite terrible.  I am struggling to suppress my emotions as I write this letter.”

ম্যাণ্ডেলা ১৯৯০ সালে ছাড়া পেলেন। ওই সময়ে সেই ১৪ বছরের কিশোরের খুনের মামলায় উইনির শাস্তি হয় ছয় বছরের জেল, পরে অবশ্য শাস্তি কমে গিয়ে শুধু অর্থ দণ্ড হয়। সেই সময়ে ম্যাণ্ডেলার মানসিক অবস্থা কেউ জানতে পারেনি। তবে ১৯৯৬ সালে ডিভোর্সের পিটিশনে জানা যায় ১৯৯২ থেকেই তাঁরা আলাদা থাকতেন। প্রেম মুছে যায়, উইনির প্রতি প্রেম মুছে গেছে। না প্রেম মুছে যায় না। স্থানান্তরিত হয়। পরে মোজাম্বিকের প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের বিধবা গ্রাস মাসেলকে তিনি বিয়ে করেন।  ম্যাণ্ডেলার বয়স তখন ৮০ বছর।

তিনি দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি পদ প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাঁর সহকারী থাবো মেবেকি পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

ম্যাণ্ডেলা ও গণেশ ঘোষ

ম্যাণ্ডেলা তাঁর জীবনকে এক স্টোইসিজমে আবৃত করে রেখেছিলেন। ১৯৩৯ সালে স্থানীয় রাগবি দলের সাথে যখন নিজের বাড়ির বাগানে কথা বলছিলেন, তখন খবর আসে তাঁর প্রিয় বন্ধু, কমিউনিস্ট পার্টির অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ক্রিস হানি শ্বেত বর্ণবাদীদের দ্বারা নিহত হয়েছেন।  খবর শুনে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে একইভাবে কথা বলে গেলেন প্রিয় রাগবি দলের সাথে।

ধৈর্য, নিরাবেগ অবস্থান, মুখোশে ঢাকা এক মানুষ। সেই মুখোশ তাকে জেলের মধ্যে নিজের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে সাহায্য করেছে। এই প্রসঙ্গে মনে আসে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী গণেশ ঘোষ, সুবোধ রায় ইত্যাদিদের কথা। এঁরাও আন্দামান জেলে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। গণেশ ঘোষ বা নেলসন ম্যাণ্ডেলা এক জায়গায় মিলে যান। সমাজ জীবন থেকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার সময়ে তাঁরা কী ভাবতেন? ম্যাণ্ডেলা জেলে ছিলেন ২৭ বছর, গণেশ ঘোষ ১৪ বছর।  বেরিয়ে এসে নতুন পৃথিবীতে তাঁরা কেমনভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন জানতে ইচ্ছে করে! গণেশ ঘোষ আন্দামানের কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। সারা জীবন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন।

ম্যাণ্ডেলা ও কমিউনিজম

ম্যাণ্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টির গুপ্ত সদস্য ছিলেন। তবে এই বিষয়ে তিনি বিশেষ আলোচনা করতেন না। কেন? সম্ভবত তিনি মনে করতেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আবেদন সাধারণ মানুষের কাছে ছিল অনেক বেশি। সেই কারণে হয়তো তিনি বৃহত্তর মানুষের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন। একটা সময়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সদস্য শুধু কালো মানুষ হতে পারতো, আর যেকোন জাতি বর্ণের মানুষের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে বাধা ছিল না।  সম্ভবত ম্যাণ্ডেলা মনে করতেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম দুর্বল হয়ে যাবে সকল মানুষের জন্য এএনসি-র সদস্য পদ খুলে দিলে। সম্ভবত তিনি মনে করতেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঠিক প্ল্যাটফর্ম আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস। তখন অবশ্য এএনসি  ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যোগাযোগের সীমানা নির্ধারণ সহজ ছিল না। যেমন ১৯৫৫ এর  ফ্রিডম চার্টার  কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করেছিল, আর তা গ্রহণ করেছিল এএনসি । এতে বর্ণবাদ বিরোধিতা ছাড়াও ছিল খনি, ব্যাঙ্ক, এবং মনোপলি শিল্পের জাতীয়করণ। ছিল ভূমি সংস্কার, জমি বন্টন ইত্যাদির অঙ্গীকার।
এই সমস্ত বিষয়ে ম্যাণ্ডেলার অবস্থান নিয়ে অবশ্য বিতর্ক হয়েছে। তিনি দক্ষিণপন্থীদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছেন কমিউনিস্ট সন্ত্রাসবাদী হিসেবে। আর বামপন্থীদের একটা অংশ তাঁকে বর্ণবাদীদের সঙ্গে সমঝোতাকারী বলে মনে করে। তাঁর মধ্যে দ্বিধা ছিল। আবার কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব তাঁর জীবনে ছিল।

মার্ক্স্  তাঁর দ্য  পভার্টি অফ ফিলোজফিতে বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের দারিদ্র নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে বলেছেন, “When the economists say that present-day relations – the relations of bourgeois production – are natural, they imply that these are the relations in which wealth is created and productive forces developed in conformity with the laws of nature.  These relations therefore are themselves natural laws independent of the influence of time.  They are eternal laws which must always govern society.  Thus, there has been history, but there is no longer any.”

ওদের চোখে আজকের দারিদ্র সমাজ ব্যবস্থার স্বাভাবিক উপাদান।

এই প্রসঙ্গে ম্যান্ডেলা কী বলেছেন? “Overcoming poverty is not a task of charity; it is an act of justice.  Like Slavery and Apartheid, poverty is not natural.  It is man-made and it can be overcome and eradicated by the actions of human beings.  Sometimes it falls on a generation to be great.  You can be that great generation.  Let your greatness blossom.”

দারিদ্র সমাজের স্বাভাবিক উপাদান নয়। দারিদ্র কৃত্রিম। আরোপিত ব্যবস্থার উপজাত হল দারিদ্র।  আর তাকে উচ্ছেদ করা সমাজ থেকে দাস প্রথা বা বর্ণবাদ দূর করার মতোই মহৎ কাজ।
এমন নয় যে, তিনি ছিলেন সমালোচনার উর্ধ্বে। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর কিছু কাজ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার ধনীদের বাড়িতে অতিথি থাকা, তাদের প্লেনে চড়ে দেশে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে বিতর্ক হয়েছে।

তবে ইতিহাসের যে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তির চেয়ে ম্যাণ্ডেলা তাঁর জীবদ্দশায় সবচাইতে বেশি মানুষের শ্রদ্ধা, অভিনন্দন পেয়েছেন। এক হতভাগ্য দেশকে শেষপর্যন্ত রক্তাক্ত পতনের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছেন। সব ঝড় ঝাপ্টা কাঁধে নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। আবার নির্জন সেল থেকে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে রাষ্ট্রশক্তির ওপরে চাপ বাড়িয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে রক্তপাত এড়াতে সকলকে নিয়ে চলবার প্রচেষ্টা নিয়েছেন।

আজ তাঁর মৃত্যুদিন। ম্যাণ্ডেলা এক কিংবদন্তির নাম। আসুন আজ ম্যান্ডেলার প্রয়াণদিবসে একবার তাঁকে স্মরণ করি ।

বর্ণবাদ ও বিজ্ঞান

ইতিহাসের আয়রনি হল বর্ণবাদ। আজ প্রমাণিত আফ্রিকার বাইরে প্রতিটি মানুষ আফ্রিকা থেকে ৭০ হাজার বছর আগে যে দল বেরিয়ে এসেছিল তাদের সন্তান। ককেশীয়, মঙ্গোলয়েড আর নিগ্রয়েডের বিভাজন বিজ্ঞান অস্বীকার করে।

বর্ণবাদী বোথা সরকারের প্রতিটি পুলিশ, প্রতিটি কারাগার রক্ষী, প্রতিটি মন্ত্রী আসলে আফ্রিকা মায়ের সন্তান। আর তাদের একদিন স্যালুট দিতে হয়েছে ডায়াসে দাঁড়ানো প্রেসিডেন্ট ম্যাণ্ডেলাকে। মানুষ মূলতঃ আন্তর্জাতিক। রক্তে, প্রেরণায়, জ্ঞানে।

তথ্যসূত্র

1. Nelson Mandela International Day, 18 July, United Nations

2. Speaking Out For Justice, Key Statements & Speeches by Nelson Mandela

1961 — 2008, United Nations

3. Nelson Mandela Biographical, The Noble Prize

4. Mandela and the South African Communist Party, South African History online

5. https://www.dispatchlive.co.za/…/2013-11-19-comrade…/

6. Nelson Mandela, No easy walk to Freedom, First published by Heinemann Educational Books 1965,

লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা। প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।