সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ক্যাপাডোসিয়ার যিশু

ক্যাপাডোসিয়ার যিশু

জয়ন্ত দাস

ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৩ ২৮৫ 2

(৫৮-৬৩ অব্দে আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রোমান সাম্রাজ্য এবং পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যে লড়াই হয়েছিল, দুটি রাজ্যের মধ্যে এই অঞ্চল ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সম্রাট অগাস্টাসের সময় থেকে আর্মেনিয়া রোমক করদ রাজ্য ছিল, কিন্তু ৫২-৫৩ সালে, পার্থিয়ানরা তাদের নিজস্ব প্রার্থী, টিরিডেটসকে আর্মেনিয়ার সিংহাসনে বসাতে সফল হয়েছিল সেই প্রেক্ষাপটে এই গল্প। স্থান – ক্যাপাডোসিয়া, মধ্য তুরস্কের একটি আধা-শুষ্ক অঞ্চল, ক্যাপাডোসিয়ার ল্যান্ডস্কেপে নরম আগ্নেয় শিলায় আছে  টাওয়ার, শঙ্কু, উপত্যকা এবং গুহা।)

গল্পের সময়কার সাম্রাজ্যগুলোর অবস্থান

ছুটতে ছুটতে দারিয়ানাসু তার থেকে দরজার দূরত্ব আরেকবার মনে মনে মেপে নেয়, আর মুখে ফুটে ওঠে মৃদু হাসি। নিশ্চিন্ত হবার হাসি, পেছনে ছোটা ঘোড়সওয়ারদের বোকা বানানোর হাসি। আরও পিছনে হৈহৈ করতে থাকা লোকগুলোকে এখন দেখা যাচ্ছে না, টিলার আড়ালে হারিয়ে গেছে। ঘোড়সওয়ারদেরও আগেই সে বোকা বানিয়ে দিতে পারত। হরিণের মতো ছুটতে পারে সে, কিন্তু পিঠের বোঝাটা ফেলে দিতে চায়নি। অবশ্য তাতে কিছু ক্ষতি হয়নি, আর দশবার শ্বাস নিতে-না-নিতেই সে পৌঁছে যাবে গোল দরজার পাশের ফাঁকটায়। ব্যাস, তারপর একটা ছোট্ট লাফ, তারপর দু’পলকে দরজার ফাঁকটুকু বুজে যাবে। হাঃ হাঃ হাঃ, ঘোড়সওয়ারগুলো বুঝতেই পারবে না কোথায় ভ্যানিস হল তাদের শিকার, ছাউনিতে গিয়ে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদবে অন্যদের কাছে, বলবে ভুতুড়ে মানুষের কথা, যাদের দেখা যায় কিন্তু ধরতে গেলেই হাওয়া হয়ে যায়।

হঠাৎ পরিচিত ঘড়ঘড় শব্দ কানে আসে দারিয়ানাসু-র। ঠিক যেন একটা পাথরে চাকাকে গড়িয়ে দিচ্ছে পাথরের ওপর দিয়ে। অবিশ্বাসে আতঙ্কে তার দুচোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়, ফুসফুসের শেষ দমটুকু দিয়ে সে চিৎকার করে, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমি এসে গেছি, একটুখানি মাত্র। আর একটুখানি, হে আকাশের অধীশ্বর অশ্বারোহী সাবাজিওস, আর একটুখানি, হে পাহাড়ের শস্যদায়ী মা কুবেলিয়া, আর একটু… দাঁ-ড়া-ও-ও-ও-ও-ও-ও!!!

ঘড়ঘড়ঘড়…

বর্তমানের রাষ্ট্র

সূর্যদেবতা সল আকাশ থেকে বিদায় নেন। সারাদিন ধরে চলা যুদ্ধদেবতা মার্স-এর পুজোর বিরাম পড়ে, পাহাড় আর লাল কাঁকরের ধূ-ধূ প্রান্তরের অন্ধকারে তাঁবুর আলো মিটমিট করে জ্বলে, আর মাঝেমধ্যে ঘুরে বেড়ায় অপদেবতার দল। থালার মতো চাঁদ যেদিন আকাশে ওঠে, সেদিন দিব্যি দেখা যায় তাদের, পাহাড়ের গায়ে ইঁদুরের মতো নড়েচড়ে। রোমান সৈন্যরা শিউরে উঠে জুপিটার আর সমস্ত দেবদেবীদের ডাকে।

সেই কবে মার্স-এর নামাঙ্কিত মাসে যুদ্ধে বেরিয়েছিল তারা, পার্থিয়ান-দের সঙ্গে শেষ যুদ্ধ হবে। মার্স আর জুপিটারের আশীর্বাদ-ধন্য রোম আর তার মহান সম্রাট যুদ্ধে জিতে দু’শ বছরের শত্রুর নিপাত করবেন। সম্রাট ট্রাজান বলেছেন আর্মেনিয়াতে রাজার পদে বসানো ওই লোকটা বড্ড বেশি পার্থিয়ান-ঘেঁষা। মহান ট্রাজান বহু শত্রু নিপাত করে রোমান সাম্রাজ্যকে এতাবৎ কালে সবথেকে বড় করেছেন, তিনি শান্তি পাচ্ছেন না পার্থিয়ানদের জন্য। অতএব সেনা অভিযান।

জয় রোমের জয়, জয় সম্রাট ট্রাজানের জয়। পৃথিবী জয় করবে রোম। এক তুড়িতেই জয় হয়ে গেছে আর্মেনিয়া, বন্দী হয়েছে তার বেয়াদব রাজা। এখন আর্মেনিয়া থেকে দক্ষিণ দিকে পার্থিয়ানদের আক্রমণ করবে মহান রোমের অজেয় সেনাবাহিনী।

স্থলপথে রোম থেকে আর্মেনিয়ার পথে পড়েছে আনাতোলিয়া। উত্তরে কৃষ্ণসাগর, দক্ষিণে আর পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, উত্তর-পশ্চিম কোণে মর্মর সাগর – গ্রিস থেকে আলাদা হয়ে থাকে  আনাতোলিয়া উপদ্বীপ (আজকের তুরস্ক-লেখক)। কিছু সমভূমি, বাকিটা পাহাড়ী ঊষর এলাকা। অনেকদিন রোমান সেনাবাহিনীর দেখা না-পাবার ফলে আনাতোলিয়ার নানা অঞ্চল কিঞ্চিৎ বেয়াড়া হয়েছিল, সেনা আসার সঙ্গে সঙ্গে দশদিক উজাড় করে সমস্ত খাদ্য আর পানীয় এনে দেয়নি। সেনাপতি কোমলমনা, তিনি মাত্র কয়েকটি গাঁ জ্বালিয়ে দিয়েছেন, আর তাতেই এখন সেনাবাহিনীতে খিদমত খাটার লোকের অভাব নেই। খিদমতগাররা সেনাবাহিনীর সেবায় এতই প্রাণ ঢেলে দিয়েছে যে তাদের অনেকে খাবার সময়ও পায়নি, খাটতে খাটতে মরেই গেছে। মহান রোমান সম্রাটের সেবায় মরেছে, জুপিটার তুষ্ট হয়ে পরের জন্মে হয়তো খোদ রোমের নাগরিক করেই পাঠাবেন তাদের—এমন সৌভাগ্য দেখলেও ঈর্ষা হয়।

গ্রিস আর থ্রেসিয়া হয়ে আনাতোলিয়ায় ঢুকেছে রোমান বাহিনী। কিন্তু আর্মেনিয়ার প্রায় গাঁ-ঘেঁষে দাঁড়ানো একটা বিদিকিচ্ছিরি জায়গা আছে, ক্যাপাডোকিয়া। আনাতোলিয়ার মধ্যে ক্যাপাডোকিয়া একেবারে অখাদ্য অঞ্চল। জনবিরল, পাহাড়ে ভর্তি, পাথুরে লালমাটির দেশ, অধিকাংশ জমিতে ছিটেফোঁটা ঘাসও জন্মায় না। এখানে মানুষ কেমন করে থাকে তাই বুঝে পান না রোমান সেনানায়ক ফাবিয়াস। মাত্র হাজার পাঁচেক সৈন্য আছে তাঁর অধীনে। ওপরওয়ালার নির্দেশ, আর্মেনিয়ায় যুদ্ধ ঢের করেছ, এখন একটু পশ্চিমে গিয়ে হতভাগা ক্যাপাডোকিয়া অঞ্চল থেকে খানিক রসদ নিয়মমতো জোগাড় করার ব্যবস্থা করতে হবে।

এলাকাটাকে না জেনে যুদ্ধ করাটা কাজের কথা নয়। তাঁরই বাহিনীতে আছে এক ছোট সেনাপতি লুসিয়াস, ছোকরা নাকি নানা এলাকার হরেক খবর রাখে-টাখে। লুসিয়াস আদতে গ্রিক, কিন্তু কয়েক পুরুষ ধরে রোমান নাগরিক। তাজ্জব করে দেবার মতো জানাশোনা নাকি ছোকরার। দুনিয়ার কোথায় কারা থাকে, তাদের স্বভাব কী, তাদের পূর্বপুরুষ কারা—সব গড়গড় করে বলে দেয় এক নিঃশ্বাসে। ছোকরা যখন হাতের কাছেই আছে, আর ওই পাহাড়ী রুক্ষ ক্যাপাডোকিয়াতেই তাঁকে যখন সেনাবাহিনীর রাক্ষুসে রসদ জোগাড় করতে হবে, ছোকরার কাছ থেকে ঘাঁতঘোঁত জেনে নেওয়াটা প্রয়োজন। ফাবিয়াস এত্তেলা পাঠালেন লুসিয়াস-কে।

সর্দার দারিয়ানরিও-র মুখ আলোআঁধারিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তেলের পিদিমটা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। তবে  গলা শোনা যাচ্ছে সব জায়গা থেকে। ঘর আর তার সামনে গুঁড়ি মেরে হাঁটার সুঁড়িপথ পেরিয়ে শব্দ যাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে দুটো তলার প্রায় সমস্ত লোক। অবশ্য গোটা জায়গাটাই ঢাকা, ছোট ছোট ঘরগুলো সুড়ঙ্গ দিয়ে জোড়া একে অন্যের সঙ্গে, আর সকলেই নিস্তব্ধ। আড়াই মাসে এই অভ্যাসটা তাদের রপ্ত হয়ে গেছে। আরও অনেক কিছুই রপ্ত হয়েছে, বেড়ালের মতো অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে চলা, ইঁদুরের মতো যে যার কুঠুরিতে ঢুকে পড়া, ফিসফিস করে কথা বলা। জোরে কথা বললে সুড়ঙ্গপথে আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর, এমনকি ওপরতলার ছাগলছানাগুলো পর্যন্ত কান খাড়া করে শোনে তাদের খেতে দেবার মানুষের গলার স্বর।

দারিয়ানরিও বলে, তার গলার স্বরের তালে তালে পেছনের দেয়ালে তার ছায়াটা ভূতের মতন নাচতে থাকে, আবার কখনওবা মানুষটা আবছা হয়ে যায়। কিন্তু কথাগুলো কাটা কাটা, শুনতে ভুল হবার জো নেই, “ঝরনাটা শুকিয়ে এসেছে, আমাদের গর্তে জল বড় কম। জালা করে রাতের বেলা জল আনাও খুব শক্ত, ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে, দেখে ফেলবে গর্তের মুখ।”

গর্তই বটে, মনে মনে ভাবে দারিয়ানাসু। সতের বছরের জীবনে অনেক ইঁদুর আর খরগোশের গর্ত দেখেছে সে, গর্ত থেকে বের হতেই খুঁচিয়ে শিকার করেছে তাদের। কিন্তু নিজেরা গর্তে থাকার কথা ভাবেনি কখনও, ভাবেনি তাদের শিকার করার জন্য ওত পেতে থাকবে গর্তের ওপরে কিছু লোক। তার বুড়িদাদি ওকোমাহীসা, উটের লেজের ঝালরের মতো খসখসে চুলে ভর্তি মাথা তার, সেই মাথার উকুন মারতে মারতে ছোটবেলাতে বলত অবশ্য এই গর্তের কথা। কিন্তু দারিয়ানাসু ভাবত গর্ত বোধহয় অন্য কোনোখানে, ছাগল চরাতে আসার পথে দেখা এই যে রুখু মাঠটাকে সে গাল পাড়ত আপন মনে একটা ঘাসও জন্মাতে দেয় না বলে, তার তলাতেই যে এই গর্ত, সে-কথা বড়রা কেউ দারিয়ানাসু-কে ঘুণাক্ষরে জানতে দেয়নি।

বুড়িদাদি এখন বসে আছে দারিয়ানরিও-র কাছটাতে, তার খসখসে চুলভর্তি মাথাটা নড়ছে তালে তালে। বুড়ি শুধু সর্দারের মা নয়, তার মতো পুরোনো দিনের কথা আর কেউ জানে না। গর্তের আট হাজার মানুষের প্রায় সকলকে সে নামে চেনে, এখনও অনেকের মুখ দেখেই গ্রাম-গোত্র-বাপ-মা সবার কথা বলতে পারে। ফোকলা দাঁতের ফাঁকে ওকোমাহীসা বলে ওঠে,“আরেকটা তলা তোরা খুঁড়ে পরিষ্কার করতে পারলি না? যত্তসব কুঁড়ের দল! এগারো তলা খুঁড়লেই আরেকটা জলের গর্ত পাবি, তার জল আসে পশ্চিমের ওই নীচু পাহাড়ের ঝরনা থেকে। আমার দাদিমা বলত…” কী যে বলত তা জানা হয় না, কাশির দমক সামলাতে সামলাতে ওকোমাহীসা ছুটে যায় লম্বা-চিমনির দিকে, লোকে সরে সরে পথ করে দেয় তাকে, আর সে চিমনি দিয়ে নেমে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া খাবি খেতে-খেতে বুকে ভরে, ঠিক যেন ডাঙায়-তোলা মাছ।

মাটির নিচে ঘর

সর্দার দারিয়ানরিও নীচু স্বরে বলে, “আরেকটা তলা খুঁড়ব। খুঁড়তেই হবে। কিন্তু তার আগেই তো জল ফুরিয়ে যাবে আমাদের…।”

কথাটা যে সত্যি সেটা সকলে ভালভাবেই জানে। কেউ ভাবতে পারেনি তাদের এই পুরোনো গর্তগুলোতে এতদিন ধরে থাকতে হবে। ওকোমাহীসা-র বুড়ি দাদিমাও নাকি দুমাসের বেশি গর্তে থাকার দিনের কথা গল্প করে বলেনি কখনও, আর সেই বুড়ি মরেছে দারিয়ানাসু-র বাপ দারিয়ানওস-এর জন্মের সময়।

সর্দার দারিয়ানরিওর গলা শোনা যায় আবার, জোরদার দ্বিধাহীন উঁচুগলার স্বর। “সমস্ত জোয়ান ছেলের দল, তোমরা যাবে ওপরে, জালা নিয়ে। জল আনবে উত্তরের ঝোরা থেকে, আর দেখে আসবে পশ্চিমের ওই নীচু পাহাড়ের ঝরনা এখন কেমন আছে। আর মাঝবয়সী সবাই! আমরা যাব নিচতলায়, খুঁড়ব আরেকটু, দেখি এগারতলায় নেমে যদি জলের গর্তটা পাই…।”

কথা শেষ হতে-না-হতেই ওকোমাহীসা বলে, “পাহাড় থেকে শেষ আগুন বেরিয়েছিল তোর জন্মের আগে। মাটি কেঁপেছিল, আর পূবের পাহাড়ের ঝরনাটা গেছিল হারিয়ে। এবার কোনো…” বলতে বলতে কাশির দমকে কথা বন্ধ হয়ে যায় তার, কিন্তু কারও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে পশ্চিমের নীচু পাহাড়ের ঝরনা হারিয়ে যাবার কোনও কারণ নেই। আশায় মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, প্রদীপের আলোয় চোখগুলো চকচক করে।

মানুষজন সব চলে যায়, যে যার কোটরে ফিরে শুকনো রুটি আর একটুকরো নোনা মাংস খেয়ে শুয়ে পড়বার আগে গলা ভিজিয়ে নেবে এক আঁজলা আঙ্গুরের মদে। মদের বদলে যদি একটুখানি জল পাওয়া যেত!

সেনাপতির তাঁবুতে নীচু হয়ে ঢোকেন লুসিয়াস। ফাবিয়াসের এত্তেলা নিয়ে লোকজন অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়েছে তাকে। লোকদের দোষ নেই, লুসিয়াস একা একা কথা বলছিলেন হপ্তাকয়েক আগে ধরা-পড়া লোকগুলোর সঙ্গে। আজব চিড়িয়া এই লোকগুলো।কথা বলে ইহুদিদের ভাষায়। ইহুদিরা এমনিতে রোমান সাম্রাজ্যেরই প্রজা, কিন্তু রোমান দেবদেবীদের বদলে আকাশে থাকা কোন এক ঈশ্বরের পুজো করে এরা। সদাশয় রোমের সম্রাট তাদের ধর্মাচরণে বাধা দেন না। গত কয়েক দশক ধরে মহান সম্রাটদের বিব্রত করার চেষ্টা করেছে ইহুদিরা, যখন তখন বিদ্রোহ করেছে, আর কচুকাটা হয়েছে দলে দলে। ইহুদিদের কচুকাটা হতে দেখলেও তাদের ঈশ্বর কিছু করেন না, তবু ইহুদিরা সেই ঈশ্বরকে ছাড়বে না, নিজেদের একলষেঁড়ে স্বভাবও ছাড়বে না।

জুডিয়া-তে তাদের নিজেদের রাজত্বই ছিল বলা যায়, তা ছাড়াও সারা রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিব্যি ছিল তারা। কিন্তু সম্রাটের সামান্য কয়েকটা হুকুমের জন্য বিদ্রোহ করে জুডিয়া খুইয়েছে। কিছু ইহুদি সম্রাটের অনুগত রয়েছে ঠিকই, আবার অনেকেই পালিয়েছে। কিছু ইহুদি হয়তো তেমনি ছিটকে এসে পড়েছে ক্যাপাডোকিয়া-তে। লুসিয়াস জানেন এখানে লাল নরম পাথরের পাহাড়ের গায়ে গুহা আছে অনেকদিন ধরেই, তারই দু-একটাতে আশ্রয় নিয়েছে এই ইহুদিরা, হয়তো নরম পাথর খুঁড়ে বানিয়ে নিয়েছে নতুন গুহা। কিন্তু লুসিয়াসকে অবাক করে এই ইহুদিদের গলায় ঝোলানো কাঠের টুকরোটা, দেখতে অনেকটা ক্রসের মতো। সেই কাঠের টুকরোটাকে যেন পারলে পুজোই করে এরা। বলে, এটা ঈশ্বরের পুত্র। দেয়ালেও ঝুলিয়ে রাখে পুজোর জন্য।

বয়স অল্প হলেও লুসিয়াস সাম্রাজ্যের ভেতরে আর বাইরে শ’খানেক ধরনের মানুষের হাড়হদ্দ জানেন তিনি। কিন্তু কাঠের টুকরোকে ঈশ্বরপুত্র বলে পুজো করার মতো কোনো ইহুদি দলের কথা তাঁর জানা ছিল না। এরা এল কোথা থেকে, এই ঈশ্বরপুত্র ব্যাপারটাই বা কী। এটুকু বুঝেছেন যে ইহুদিদের কোনো এক রাব্বিকে নাকি ক্রুশে ঝুলিয়েছিল কোনো রোমান শাসক, এরা সেই রাব্বিরই শিষ্য।

দ্রুতপায়ে সেনাপতির তাঁবুতে আসেন তিনি, অভিবাদন করে সামনে আসেন ফাবিয়াসের। ফাবিয়াস হাত নেড়ে গা-মালিশ করা বালকটিকে বাইরে যেতে বলেন।

“লুসিয়াস, তুমি তো অনেক দেশের অনেক খবর রাখ। এ দেশের মানুষজন সম্পর্কে কিছু বল তো। এই যে লোকগুলোর আঙ্গুরক্ষেত বানিয়েছে, গ্রাম বানিয়েছে, এরা গেল কোথায়? আমার সৈন্যরা রাত্রে যে ভূত দেখে, দিনের বেলা দূর পাহাড়ের গায়ে যেসব ছাগল আর ঘোড়া চরতে দেখে, তারাই বা আসে কোত্থেকে, আর উবে যায় কেমন করে? কারা থাকে এখানে?

“মহামহিম সেনাপতি, সৈন্যরা তাদের কয়েকজনকে ধরেছে, আমি তাদের সঙ্গেই কথা বলছিলাম এখন। তার ইহুদি, তবে আজব এক নতুন সাধু র্যা ব্বির উপাসক।”

মহামহিম সম্বোধনে খুশি হন ফাবিয়াস। সামনের পাত্রে একটা বড় চুমুক দেন। বলেন, “দেখ লুসিয়াস, এই ইহুদিগুলো এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসা লোক। পাহাড়ে গুহাগুলো আগে থেকেই ছিল, ওরা এসে বাসা করেছে বেশিদিন নয়। কিন্তু ওই গুহাগুলো করল কে? আর, আমার লোকেরা সব গুহা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে, মানুষ বলতে ওই ক’টা ইহুদি? উঁহু, এখানে আরও কিছু রহস্য আছে। আমাকে শোনাও তো সব কথা।”

লুসিয়াস বোঝেন, সেনাপতির আসল প্রশ্নের উত্তর তিনি জানেন না। কিন্তু সরাসরি সেকথাটা বলা যাবে না, সেনাপতি তাঁকে হতচ্ছেদা করবেন, পদমর্যাদার হানি হওয়া অসম্ভব নয়। লুসিয়াস সতর্কভাবে শুরু করেন, “অনেকদিন আগেকার কথা, সব কথা সত্যি কিনা কেউ জানে না। তবু পণ্ডিতেরা যেমন বলেন, আমি তাঁদের কথা শুনে বলছি, মহামহিম। অনেকদিন আগে এখানে রাজত্ব করত হাট্টি-র লোক। এদের নাম হয়ে যায় হিট্টাইট। তাদের মধ্যে যেমন মানুষ ছিল, তেমন ছিল দৈত্যরা। তারা তৈরি করেছিল বিরাট সব পাথরের দুর্গ। এখানকার মাটি থেকেই নাকি তামা আর টিন তৈরি করতে পারত দৈত্যরা, আর তা থেকেই বানাত ব্রোঞ্জ, পরে শিখিয়েছিল লোহার অস্ত্র বানাতে। ঘোড়ায় টানা রথে চড়ে যুদ্ধ করত এরা। ট্রয়ের পতনের পড়ে সেখান থেকে আসে ট্রোজানরা। তারপর আসে হেলেন-বংশীয়রা। দিগ্বিজয়ী আলেক্সান্দার আসার আগেই এখানকার মানুষজন হেলেনীয় সভ্যতা কিছুটা গ্রহণ করে। শাহেনশাহ সাইরাস আর দারায়ুসের আমলে এখানে পারসিকদের রাজত্ব হলেও, পারসিক ধর্ম এখানে তেমন ছড়াতে পারেনি। বরং হেলেনিক ধর্ম এখানকার স্থানীয় ধর্মের সঙ্গে খানিকটা মিশে একধরণের নতুন হেলেনিক সভ্যতা তৈরি করেছে।”

সেনাপতি ফাবিয়াস অধৈর্যভাবে মাথা নাড়েন। আলেক্সান্দারার-এর কথা বলতে পারলে এই হতচ্ছাড়া গ্রিকগুলো কাজের কথা ভুলে যায়, “আরে বাপু আলেক্সান্দার আর সাইরাসের কথা শোনার জন্য তোমাকে ডেকেছি নাকি? কাজের কথায় এস। এখানে গুহাগুলো অমন করে বানাল কারা?”

মাটির নিচে এই গর্তের মতো শহর বানিয়েছিল আমাদেরই কোনও পূর্বপুরুষ। তারা মানুষ ছিল নাকি দৈত্য, কেউ জানে না… দুলে দুলে বলতে থাকে ওকোমাহীসা, তার উটের লেজের মতো চুলে ভরা মাথাটা নড়তে থাকে কথার তালে তালে। কাশি সামলায়, আর কথা বলে…

“তারও আগে, অনেক কাল আগে, আমরা থাকতাম দুই পাহাড়ের মাঝখানে সবুজ এক রাজত্বে। আমাদের রাজা থাকত আমাদেরই সাথে কুঁড়েঘরে। তারা পুজো করত সূর্য-চন্দ্র আর পাহাড়কে। তারপর… তারপর একদিন ঘোড়ায় চড়ে বাইরে থেকে আসে এক দস্যু দল। আমাদের ছাগল আর ফসল লুটে নিল, আমাদের মেয়েদের জোর করে নিয়ে গেল তাদের ঘরে। সেই থেকে আমাদের আদি পুরুষরা হারিয়ে যায়, কেবল যেদিন পুরো চাঁদ ওঠে, সেদিন নিচু পাহাড়ের ওপার থেকে ভেসে আসে ঝরনার শব্দের মতো মিষ্টি গানের সুর। একবার সেই সুর কানে গেলে পথ হারায় জোয়ান ছেলেরা, পাহাড় পেরিয়ে চলে যায়, আর ফিরে আসে না।”

“নতুন-আসা মানুষগুলোর সঙ্গে ছিল যাদুকর আর দৈত্যদের দল। বড় বড় চুল্লি বানিয়ে তার মধ্যে পাথর সেদ্ধ করে তৈরি করত চকচকে বর্শা আর তিরের ফলা, কুড়ুল আর গদা। তৈরি করত চাকা আর চাকার ওপরে চলা ঘোড়ায়-টানা গাড়ি। সেই গাড়ি চড়ে যুদ্ধ করত তারা। যুদ্ধে হারলে তারা লুকিয়ে পড়ত মাটির তলার এই শহরে। অনেক অনেকগুলো শহর ছিল তখন, মাটির নিচ দিয়ে তারা চলে যেত এক শহর থেকে আরেক শহরে। আবার ওপরে উঠে এসে যাদু করে ছাগল বা কুঁজওয়ালা জন্তু সেজে সমস্ত ফসল তুলে আনত, শত্রুর দল চিনতেই পারত না তাদের। তারপরে একদিন সুযোগ বুঝে  মাটির ওপরেউঠে এসে ঘুমন্ত শত্রু সৈন্যদের মেরে ফেলত।”

“বছরের পর বছর চলে যেত। দস্যুরা ছাগল ভেড়া চরাত, আঙুর ফলাত ক্ষেতে, আর গান গাইত, হাসত… ঠিক সেই পুরোনো মানুষদের মতো। তারপর একদিন আবার আসত অন্য দস্যুর দল, আবার তারা লুটপাট করত, আর মেয়েদের ঘোড়ায় চাপিয়ে নিয়ে যেত তাদের ঘরে, পুরুষরা মারা পড়ত কিংবা পালিয়ে যেত সেই দূরে, আকাশ যেখানে মাটিতে ঠেকে। সেখানে বানাত নতুন ঘর, হয়তো বানাত মাটির নিচের নতুন শহর।“

কাশতে কাশতে বেদম হয়ে থামে ওকোমাহীসা। একগাদা মেয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে তার কথা শুনছিল দারিয়ানাসু। এসব গালগল্প তার তেমন ভাল লাগে না, কিন্তু তার ঠাকুদ্দা সর্দার দারিয়ানরিও-র হুকুম, এসব শুনলে নাকি নীচু পাহাড়ের ঝরনা খোঁজার কাজে সুবিধা হবে। উত্তরের ঝোরা থেকে জল আনার কাজটা বড্ড একঘেয়ে। বিদেশি সৈন্যগুলো সংখ্যায় অনেক, রাতের বেলা তিনজন মিলে জালা জালা জল আনল, তাঁবুর সামনে পাহারা দেওয়া লোকগুলোকে দিব্যি দেখতে পেল তারা, কিন্তু লোকগুলো তাদের দেখেও যেন দেখল না। অবশ্য গায়ে শুকনো গাছের ডালপালা জড়িয়ে হাঁটছিল তারা, দূর থেকে দেখে লোকে ভাববে যেন একটা গাছই হাঁটতে শুরু করেছে। সে ঠাকুদ্দাকে বলে-কয়ে পশ্চিমের ওই নীচুপাহাড়ের ঝরনা খোঁজার কাজ নিয়েছে, কাল থেকে শুরু হবে সেই কাজ।

কাশি সামলে ওকোমাহীসা বলে চলে… 

“দৈত্যদের দল নিচের এই শহরটা বানায় পাতালপুরীর মতো করে। নরম পাহাড় খুঁড়ে প্রথমে বানায় হাওয়া-চিমনি। লম্বা সোজা গর্ত, তার তলা দেখা যায় না। হাওয়া-চিমনির মাথাটা টুপির মতো ঢাকা থাকে ছোট্ট টিলার তলায়, কেউ দেখতে পায় না পাশ-দিয়ে বেরনো চিমনির খোলা গর্ত। তারপরে মাটির নিচে চিমনির পাশে খোঁড়ে ঘর, খোঁড়ে সুড়ঙ্গ। একের পর এক ঘর আর সুড়ঙ্গ সাজিয়ে তৈরি করে শহরের এক-একটা তলা। যত নিচের তলায় যাবে, সুড়ঙ্গ তত সরু, ঘরগুলো তত ছোট হবে।”

“তা এসব শহরের খোঁজ কোনোদিন পেত না শত্রুরা?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে এক কমবয়সী মেয়ে।

“খোঁজ যে কোনোদিন পায়নি এমন নয়। আমার বুড়িদাদিমা-র বুড়িদাদিমা গল্প করে গেছে সেই সময়ের কথা। এক রাজার সৈন্যরা ওপরে বসে নজর রাখছিল, ঠিক আজকের মতো। এক রাতে এক জোয়ান ছেলে দূর পাহাড়ের পেছন থেকে লুকনো আঙুর ক্ষেতের আঙুর নিয়ে আসছিল মাটির নিচের এই শহরে। চুপিচুপি তার পিছু নেয় সৈন্যরা। ওপরের দরজা খুলতেই তাকে মেরে একতলার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে তারা। টের পেয়ে সবাই একতলা ছেড়ে নিঃসাড়ে দোতলা আর তেতলায় জমা হয়। রাজার সৈন্যরা ঢুকে পড়ে দেখে, ছাগল, ঘোড়া আর উট বাঁধা রয়েছে, কেউ কোথাও নেই। জন্তুগুলো নিয়ে পালানোর সময় তারা টের পেয়ে নিচের তলায় যেতে চেষ্টা করে, নিচে নামার সুড়ঙ্গের দরজা খোলার চেষ্টা করে। তোরা দেখেছিস তো, দরজা বন্ধ করার গোল পাথরটা? ভেতর থেকে দুজন মাত্র জোয়ান লোক দরজার পাথর গড়িয়ে দরজা খুলতে ও বন্ধ করতে পারে। রাজার সৈন্যরা তা জানে না, বাইরে একগাদা সৈন্য যেই গায়ের জোরে দরজা খুলতে এগিয়ে গেছে, দরজার মাঝখানের ফুটো দিয়ে বর্শা চালিয়েছে আমাদের লোকেরা। মারা পড়েছে সব্বাই। ওদের মরেছিল তিন-চারশো, আমাদের চারজন মাত্র।”

“আমাদের গোল পাথরের গড়ানো দরজা আর সুড়ঙ্গপথ থাকতে কেউ কিছু করতে পারবে না,”. বলে ওঠে দারিয়ানাসু-র পাশে দাঁড়ানো তার সঙ্গী, অজান্তেই হাত দেয় তার পাশে দাঁড় করানো বর্শার ধারাল ফলাতে।

“তা বলিস না। বোকা ছিল ওই সৈন্যগুলো। যদি ওরা চুপ করে বসে থাকত মাটির ওপরে আমাদের শহরের মুখটাতে, যদি ওপরে উঠতে গেলেই মেরে ফেলত আমাদের মানুষগুলোকে? তাহলে খেতে না-পেয়েই আমাদের মরতে হত।”

বুড়িকে ঘিরে গোল হয়ে বসা-দাঁড়ানো সবার সর্দার দারিয়ানরিও-র কথাগুলো মনে পড়ে। জমায়েতের সবাইকে শাসানি দেয়, “কেউ যেন মাটির নিচে ঢোকার পথ না দেখায় শত্রুদের। কারোকে দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে দরজার গোল পাথরের পাল্লাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেবে। এ নিয়মের অন্যথা কেউ করলে তারও মৃত্যুদণ্ড।” শিউড়ে ওঠে মেয়ের দল। দারিয়ানাসু মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, এইসব গালগল্পে কী লাভ তার? গলা তুলে শুধোয় ওকোমাহীসাকে…

“বুড়িদাদি, মাটির নিচে শহরে জল আনল কেমন করে দৈত্যরা?”

“দৈত্য হোক বা মানুষ, এ শহর যারা তৈরি করেছিল তাদের সবাই যেমন কিছুদূর অন্তর একটা করে হাওয়া-চিমনি বানিয়েছিল যাতে দম আটকে না মরে কেউ, তেমনই তারা কয়েকটা জলের গর্ত বানিয়েছিল। ওপরের ঝরনা থেকে জল পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নামে যেখানে, সেখান থেকে পথ কেটেছিল, যাতে ঝরনার জল সেইসব গর্তে এসে জমে। আর যখন মানুষ মাটির ওপরে থাকত, তখন বন্ধ করে দিত কাটা-রাস্তা, জল বইত ওপর দিয়ে, নইলে জল জমে শহরটার নিচের তলাগুলো ডুবে যেত তো।”

লুসিয়াস বলেন, “একদিন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এলেন সূর্যদেব। চারিদিকে মাটি থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। বড় বড় পাহাড়ের মাথায় আগুন লেগে গেল। পাহাড়গুলোর মাথা থেকে বেরতে লাগল মাটি পোড়া ছাই, আর গরম পাথরগলা নদী। ছাইয়ে ভরে গেল চতুর্দিক। একসময় সূর্যের রাগ কমল, ঠাণ্ডা হল চারিদিক, আকাশে আবার জমল মেঘ, নামল বৃষ্টি। বৃষ্টির জল পথ কেটে নামল নদী হয়ে, পাহাড়ের পাশে বইতে শুরু করল ছোট-বড় নদী, ঝরনা। একসময় হল মহাসমুদ্র, তার নিচে অর্ধেক পৃথিবী ডুবে গেল।”

“মানুষরা তখন কোথায় গেল? তখন কি তারা মাটির মধ্যে গর্ত করে শহর বানিয়ে থাকতে শুরু করল? অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেন ফাবিয়াস।”

“তখন কোথাও মানুষ ছিল না। আপনি বললেন, একেবারে গোড়া থেকে বলতে, তাই গোড়া থেকেই বলছি। তবে পণ্ডিতেরা বলেন, কথাগুলো পুরো ফেলে দেবার মতো নয়। একটা ভূমিকম্প হয়তো হয়েছিল…

ফাবিয়াস নড়েচড়ে বসেন। তিনি ভূমিকম্প জানেন না এমন ভেবেছে নাকি ছোকরা? পম্পেই-এর ভূমিকম্প তিনি খুব ভাল করেই জানেন।

“একটা শহর ধ্বংস হয়ে গেছিল পম্পেই-এর ভূমিকম্পে। এটা কি ততবড় ভূমিকম্প?”  

“এই ভূমিকম্প ছিল তার চেয়ে হাজার-লক্ষগুণ বড়। আগ্নেয়গিরির ছাই ছড়িয়ে পড়ে এই দেশের সবর্ত্র, ছাইয়ের ওপর জমে আগ্নেয়গিরি থেকে আসা জ্বলন্ত লাভা। অনেক বছর পরে, বৃষ্টি নামে, আর উঁচু পাহাড়ের ওপরের জমা তুষার গলে জলে হয়ে পাহাড়ের গায়ে পথ কেটে নামতে থাকে, তৈরি হয় নদী, ঝরনা। আজ পর্যন্ত সেই উপত্যকাতেও সমস্ত আগ্নেয় ছাই-এর স্তর শেষ হয় নি, তবে লাভার স্তর ক্ষয়ে এসেছে।”..

“তখন কোনও মানুষ ছিল না, তাহলে এগুলো কী করে জানা গেল? তোমাদের গ্রিক পুরাণে লেখা আছে এসব?”

“আজ্ঞে না, তখন দেবতাদেরও জন্ম হয় নি। পবিত্র অলিম্পাস পর্বত নিজেই এমন এক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে তৈরি হয়েছিল, তার পরে দেবতারা সেখানে জন্ম নেন। কিন্তু এসব কথার প্রমাণ নেই কিছু।”

হতাশ ফেবিয়াস পাত্রের শেষটুকু একচুমুকে শেষ করেন। এই গ্রিকটা একটা হতচ্ছাড়া। অনেক জানে বটে, কিন্তু কাজের জিনিস কতটুকু জানে সন্দেহ।

“তুমি বলছ হিট্টাইটরাই এই পাতালপুরী তৈরি করেছিল। তার পর এখানে এল কারা? এখনই বা আছে কারা?”    

“রাগ করবেন না মহামহিম। সমস্ত কিছু জানা নেই কারও। হিট্টাইটদের আক্রমণ করেছিল পূর্বদিক থেকে আসা মিত্তানিরা। মিত্তানিরা অদ্ভুত এক জাতি, তারা যে কোথায় হারিয়ে গেল কেউ জানে না, আর আক্রমণ করেছিল সেই তাইগ্রিস ইউগ্রেতিস নদীর ধার থেকে আসা ক্যাসাইট-রা। তাদের কেউ কেউ এখানেই থেকে যায়। শোনা যায়, হিট্টাইটরা আসার আগেও এখানে কিছু বর্বরের বাস ছিল, তারাই আঙুরের আর কিছু শষ্যের চাষ শুরু করে। এই পাহাড়ি অঞ্চলে সেইসব বর্বরেরা আস্তে আস্তে মিশে যায় হিট্টাইট, ক্যাসাইট, আর মিত্তানিদের সাথে। তখনও রোমুলাস রোম নগরীর পত্তন করেন নি, আর হেলেন তাঁর ছোট্ট দেশেই আছেন।”

লুসিয়াস থামতে পানপাত্রে একটা বড় চুমুক দেন ফাবিয়াস।

“হিট্টাইটরা নাকি মাটির নিচে থাকতে পারত, আবার থাকত পাহাড়ের গুহায়। ছোট্ট গুহার মধ্যে ঢোকার সময় তারা নিজেদের শরীরটাকে গুটিয়ে ছোট করে নিত, যেন ছাগলছানা। বাইরে যুদ্ধ করার সময় তারা আবার দৈত্যের রূপ ধারণ করতে জানত। হিট্টাইটরা মাটির নিচে শহর বানাতে শুরু করে, তারপর যারা এখানে এসেছে তারাই এই শহর বড় করেছে। পুরোনো গ্রিস থেকে আসা মানুষেরা মাটির নিচে শহরকে বড় করে তোলে। এমন বড় যে সেখানে নাকি রোম শহরের আধখানা ঢুকে যেতে পারে, ঢুকে যেতে পারে এথন্সের গোটাটাই। একটা শহরের সঙ্গে দূরের শহর নাকি মাটির তলার সুড়ঙ্গ দিয়ে জোড়া। পণ্ডিতরা অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারেননি মাটির নিচে কেমন করে থাকা যায়। তবে এরা বেশিদিন নিচে থাকে না, সেখানে চাষ-আবাদ করা বা পশু চরানো সম্ভব নয়। অনেকে বলে, এরা মানুষ নয়, কোনো এক অপদেবতা। কিন্তু দৈত্য আর অপদেবতা মানুষকে দেখে পালাবে কেন?”

এদেশের আঙুরের মদে বেশ দ্রুত নেশা জমে উঠছে সেনাপতির, আগ্নেয়গিরি বা দৈত্য আর অপদেবতার কথা তেমন গালগল্প বলে আর মনে হচ্ছে না তাঁর। লুসিয়াসের কাছ থেকে আর কিছু কাজের কথা শোনার আশা কম, লুসিয়াসকে বিদায় জানান তিনি।

তারপর নিজের মনে তিনি আওড়াতে থাকেন, “শুধু একজন! শুধু একজন মাটির নিচের মানুষকে হাতে পাই! পাতালপুরীর দৈত্য হবার সাধ আমি শেষ করে দেব।”

একজন মানুষ তখন দ্রুতবেগে হাঁটছিল মাটির ওপর দিয়ে। পশ্চিমের ওই নীচুপাহাড়ের ঝরনা খুঁজে পেয়েছে সে। তিনদিন ধরে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে খুঁজেছে তারা। শেষমেশ আর কেউ পায়নি, দারিয়ানাসু পেয়েছে। তার পিঠে একটা শাবল আর কুঠার, তাই দিয়েই খুঁড়েছে সে পাথরে ঝরনার পায়ের ছাপ, কেটেছে কাঁটাঝোপ, ক্ষতবিক্ষত হয়ে অবশেষে সে পেয়েছে। বুড়িদাদি ওকোমাহীসা ভুল বলেনি, পাথরের আডালে লুকিয়ে পড়েছে ঝরনা, তবে গতিপথ তেমন বদলায়নি। কুঠার আর শাবল দিয়ে পাথর কেটে জলের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে দারিয়ানাসু। ক্ষীণ, কিন্তু সজীব জলের ধারা, আস্তে আস্তে জল জমবে এগারো তলার গর্তে। আবার জালাগুলো ভরে উঠবে ঠাণ্ডা জলে। আঃ, শান্তি শান্তি!

কিন্তু তার কি বড় দেরী হয়ে গেল? পূর্বের আকাশ লাল হয়ে এল নাকি? সে এখন পূর্বমুখ করে হাঁটবে, যাবে নিচের শহরের দরজার দিকে। সৈন্যরা কি বুঝে ফেলবে নড়াচড়া করা শুকনো গাছেটা আসলে তারই শরীর? এইমাত্র পেট ভরে জল খেয়ে নিয়েছে সে, তবুও গলাটা কেমন শুকিয়ে ওঠে।

দৌড়তে শুরু করে দারিয়ানাসু। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, একসাথে দ্রুত এগিয়ে আসছে। পারবে না, দারিয়ানাসু-র সঙ্গে ওরা দৌড়ে পারবে না। কোমরে বাঁধা গাছের ডালটাকে ছুঁড়ে ফেলে সে। দৌড়োও, দারিয়ানাসু, আরও জোরে, যেমনটি তুমি ছাড়া আর কেউ পারে না! কিন্তু একি! ঘোড়ায় চড়ে দূর থেকে এগিয়ে আসছে আরেক দল। ঘোড়াগুলো ক্রমে পায়ে-চলা সৈন্যদের পেরিয়ে এগিয়ে আসে আরও কাছে। শাবল আর কুঠার কি ছুঁড়ে ফেলবে সে? না, ফেলা চলবে না, ওগুলো খুব কাজের জিনিস, আর এগারোতলাটা এখনও খোঁড়া বাকি তাদের। দৌড়োও দারিয়ানাসু, দৌড়োও, তুমি এসে গেছ, তুমি দেখতে পাচ্ছ মাটির নিচে যাবার দরজাটা। শেষ বাঁকটা নিলেই তুমি চলে যাবে ঘোড়সোয়ার দলের চোখের আড়ালে। তারা দেখতে পারবে না তুমি হঠাৎ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলে। তাঁবুতে ফিরে আজগুবি দৈত্য আর অপদেবতার গল্প ফাঁদবে —তুমি জিতে গেছ, দারিয়ানাসু, তুমি জিতে গেছ।

ঘড়ঘড়ঘড়…

ফাবিয়াস তাঁর মাংসল কাঁধে হাত বোলান, হাত বোলান মণিবন্ধে। তাঁর সামনে দাঁড়ানো রোমান সৈন্যরা উল্লাস করছে, লুসিয়াস নানা ভাষায় আর নানা অঙ্গভঙ্গি করে বারবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে ছেলেটিকে, এসব দৃশ্য ফাবিয়াসের কাছে হঠাত কেমন অবাস্তব মনে হয়। কাল রাত্রের ইচ্ছেটা এত তাড়াতাড়ি পূরণ হওয়াতে খুব খুশি হওয়া উচিৎ ছিল তাঁর, কিন্তু কেন জানি তাঁর আজ কিছু ভাল লাগছে না।

ক্রুশে বিদ্ধ ছেলেটির কাঁধ থেকে রক্ত গড়িয়ে জমাট বেঁধে আছে, মণিবন্ধ আর পায়ের গোছ থেকে রক্ত এখনও টপ টপ করে ঝরছে। তেজি ঘোড়ার মতো তার পেশিবহুল উরু দুটি, মুখ তুলে রেখেছে সে, দৃষ্টি স্বচ্ছ, যেন সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোর মতো সেও একজন দর্শকমাত্র। গজালগুলির যেন অন্য কারও দেহে। ক্রুশটি খাড়া করে দাঁড় করানো আছে। ছেলেটির চুলের ফাঁকে খেলে যাচ্ছে সকালের সূর্যের আলো, তার প্রশান্ত মুখে সামান্য দাড়ির আভাস।

লুসিয়াস জিজ্ঞেস করছেন, “আহা, তোমার কষ্ট হচ্ছে বুঝি? বলছেন, তোমাকে আমরা এখনই নামিয়ে আনব। আরে, তুমি তো বললে না কোথায় তোমার ঘর, কেমন করে সেখানে যাব আমরা?” একই কথা নানারকম ভাষায় বলছেন লুসিয়াস, ছেলেটি নির্বিকার।

দারিয়ানাসু

না, ঠিক নির্বিকার নয়, যতবার লুসিয়াস বলছেন, কেমন করে যাব তোমার বাড়ি, তার মুখে খেলা করে যাচ্ছে এক বিচিত্র হাসি; জিতে গেছ তুমি, দারিয়ানাসু, তুমি জিতে গেছ।

তথ্যসূত্র

  1. Göreme National Park and the Rock Sites of Cappadocia, World Heritage Convention, UNESCO
  2. Cappadociahistory.com
লেখক চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য-আন্দোলনের কর্মী, প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য তালিকা - “ক্যাপাডোসিয়ার যিশু”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।