সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ঋগ্বেদের সময়কার ভারত

ঋগ্বেদের সময়কার ভারত

সৌভিক ঘোষাল

নভেম্বর ২৭, ২০২১ ১৭৭৮ 3

আর্যভাষীদের ভৌগোলিক এলাকা –

ঋগ্বেদের যুগে আর্য ভাষাভাষী মানুষেরা ভারতের কোথায় থাকত, তা দিয়েই শুরু করা যাক আমাদের আলোচনা।

ঋগ্বৈদিক যুগে ভারতের আর্য (ভাষাভাষী) মানুষের বসতির প্রথম কেন্দ্রস্থল উত্তর পশ্চিম অঞ্চল। ঋগ্বেদ সংহিতার উপাদান থেকে যে চিত্র পাওয়া যায়, তার ভৌগোলিক পরিসর হল আফগানিস্তান, পাঞ্জাব, সিন্ধুপ্রদেশ, রাজপুতানার অংশবিশেষ, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর এবং সরযূ নদী পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্বাঞ্চল। এই অঞ্চলের নদীগুলো হল রসা, কুভা (কাবুলে), কোরাম, গোমতী, সুবাস্তু (সোয়াত উপত্যকা), সিন্ধু, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী, বিপাশা, শতদ্রু, সরস্বতী, যমুনা, গঙ্গা প্রভৃতি।

বৈদিক সাহিত্যে মোট ৩১ টি নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রাচীনতম ঋগ্বেদেই রয়েছে ২৫ টি নদীর উল্লেখ। (দ্রষ্টব্য – নদীস্তুতি ১০.৭৫) এই নদীগুলির মধ্যে প্রধান ছিল সমুদ্রগামিনী সরস্বতী। বহুবার এই নদীটির উল্লেখ দেখা যায়। (এই নিয়ে যে বিতর্ক বর্তমান প্রবন্ধে সেখানে প্রবেশ করার সুযোগ আমাদের নেই। পরে স্বতন্ত্রভাবে এই নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে রইলো।) গঙ্গা তখনো প্রধান নদী হয়ে ওঠেনি। যমুনা নদীর কথা তিনবার উল্লিখিত হয়েছে।

ঋক্‌ পরবর্তী বৈদিক যুগে কতটা ছড়াল আর্যভাষীদের ভূগোল?

ঋগ্বেদোত্তর যুগে লোহার আয়ুধের আবিষ্কার বিকাশকে কেন্দ্র করে আর্য(ভাষী)দের দুর্বার অভিযানগুলি ঘটতে থাকে এবং ভারতে আর্যদের এলাকা বিস্তৃত হয়।

নর্মদার উত্তরে সারা ভারত জুড়ে আর্যরা ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যদেশ আগের তুলনায় প্রাধান্যলাভ করে। আর্য(ভাষী)দের মূল কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় কুরুক্ষেত্র। (মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্র ও বর্তমান দিল্লির আশেপাশের এলাকা।) এই কুরুক্ষেত্রের দক্ষিণে ছিল খাণ্ডব (এখানকার বনাঞ্চল দহন করে নগরী গড়ে তোলার কথা আছে মহাভারতে।) উত্তরে ছিল তূর্ঘন ও পশ্চিমে পরীণাহ।

ঋগ্বেদের পরবর্তী যুগে ভারত তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল। ব্রহ্মাবর্ত বা আর্যাবর্ত, মধ্যদেশ এবং দক্ষিণাপথ। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ পাঁচটি বিভাগের কথা বলেছে। ১) মধ্য দেশ ২) প্রাচী দেশ ৩) দক্ষিণা দেশ ৪) প্রতীচী দেশ ৫) উদীচী দেশ।

ঋগ্বৈদিক যুগের অর্থনীতি

ঋগ্বেদকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবেই দেখা হয়, আলোচনা করা হয়। সেটা খুব ভুল কিছু নয়। কিন্তু ঋগ্বেদ নিঃসন্দেহে সেকালের ভারতের জনজীবনেরও মূল্যবান দলিল। আরো নানাকিছুর মতো সেকালের ভারতের অর্থনৈতিক জীবনের অনেক সাক্ষ্য ঋগ্বেদ থেকে আমরা পেয়ে যাই।

ঋগ্বেদের ছত্রে ছত্রে কৃষিকাজের অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। কর্ষিত জমি হল ক্ষেত্র, কৃষি বলতে বোঝাত লাঙল চালানো। হল এবং তার অগ্রভাগ ফলা, জমিতে হলের দাগ সীতা, হল (হাল) টানা বলদকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ডাঙশের উল্লেখ আছে। সিন্ধু সভ্যতায় কূপের ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও কপিকলের সাহায্যে জল তোলার কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। ঋগ্বেদে কিন্তু কপিকল জাতীয় চাকার কথা বলা হয়েছে। কূপ থেকে পটি লাগানো কাঠের কেঁড়ে বা হাতলওয়ালা বালতির সাহায্যে জল তোলার প্রসঙ্গও এসেছে। কূপ থেকে জল তোলার কাজে কপিকলের দড়ি টানতে বলদকে ব্যবহার করা হত। সেই জল প্রশস্ত পরিখায় প্রবাহিত হত। জমিতে সেচের জন্য কূপের এমন ব্যবহারে নদীর তীর বরাবর প্লাবনভূমিতে ফসল ফলানোর বাধ্যতামূলক শর্ত থেকে কৃষির মুক্তি ঘটে। যেখানে ভূগর্ভে যথেষ্ট উত্তোলনযোগ্য জল আছে, সেখানে কৃষিকাজ প্রসারিত হতে পারল। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার সমতলভূমিতে স্বল্পমাত্রায় এক ধরনের কৃষিবিপ্লব ঘটে বৈদিক যুগে।

ঋগ্বেদে যে সব শস্যের উল্লেখ পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে যব, ধান/ ব্রীহি, গোধূম/গম। সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে কার্পাস ধারাবাহিকভাবে ভারতে উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু ঋগ্বেদে আশ্চর্যজনকভাবে এই শব্দটির উল্লেখ নেই। তবে কার্পাস উৎপাদিত হত না, এমন নয়। একে আকস্মিক অনুল্লেখ বলেই ধরতে হয়।

ঋগ্বৈদিক যুগে মানুষের অন্যতম প্রধান জীবিকা ছিল পশুপালন। সম্পদকে পশুকুলের সংখ্যার মাপকাঠিতে দেখা হয়েছে ঋগ্বেদে। ঘোড়া ও অন্যান্য প্রধান প্রধান গবাদি পশু – যেমন গরু, মোষ, উট, ভেড়ার প্রচুর উল্লেখ পাওয়া যায়।

স্পোক বা অর যুক্ত চাকার উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। চাকার প্রযুক্তিতে এটা ছিল একটা উল্লম্ফন। ভারি জিনিসের পরিবহন এর ফলে অনেক সহজ হয়ে যায়।

ঋগ্বেদে বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের বিকাশের প্রসঙ্গ রয়েছে। এর মধ্যে কামার, কুমোর, বয়নশিল্প ছাড়াও আরো কিছু জীবিকার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী সঠিকভাবেই আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন যে ঋগ্বৈদিক যুগের মতো যে সমাজের প্রধান ধন গো সম্পদ, সেখানে শিল্পী ও কারিগরদের বিকাশের সুযোগ খুব বেশি থাকে না। কারণ পশুচারণকারী জনগোষ্ঠী কৃষিজাত উদ্বৃত্ত উৎপাদনে সেরকম সক্ষম নন। আর ঐ উদ্বৃত্ত না থাকলে কোনও কারিগরি পেশায় সর্বক্ষণের জন্য নিযুক্ত থাকার সুযোগ সীমিত। ঋগ্বেদে মাঝে মাঝে কখনো সখনো কারিগরিবৃত্তির কথা এসেছে। তার অন্যতম দারুশিল্প। সমাজে কাঠের তৈরি আসবাব ও নানা তৈজসপত্রের ব্যবহার দারু শিল্পীর অস্তিত্ব ছাড়া সম্ভব ছিল না। ঋগ্বেদে কাঠের কারিগর তক্ষক নামে আখ্যাত। ঋগ্বেদে বৃক্ষচ্ছেদকদের উল্লেখ আছে (১-১৩০-৪)। তাদের কাটা গাছ থেকে প্রাপ্ত কাঠই ছিল তক্ষকদের নির্মাণের উপাদান। তক্ষকদের অন্যতম কাজ ছিল যানবাহন, বিশেষ করে রথের চাকা তৈরি করা। রথের নির্মাতাকে রথকার বলেও উল্লেখ করা হয়েছে ঋগ্বেদে। তাঁদের কারিগরী দক্ষতা সম্ভবত সাধারণ দারুশিল্পীদের চেয়ে বেশি ছিল।

ঋগ্বেদে চামড়ার কারিগরদের চর্ম্মমণা (৮-৫-৩৮) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চর্মকাররা চামড়ার থলে ছাড়াও রথ চালানোর জন্য ঘোড়া চালানোর জন্য বল্গা ও চাবুক তৈরি করত (৬-৭৫-১১), (১-১২১-৯), (৬-৪৭-২৬)।

বস্ত্রশিল্পও এই আমলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। পরিধেয় বস্ত্র সাধারণভাবে দু ধরনের ছিল। বাসস্‌ বা নিম্নাঙ্গের পোশাক ও অধিবাস বা ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাক। দৈনন্দিন ব্যবহারের পোশাক ছাড়াও বিশেষ ধরনের কিছু পোশাকের উল্লেখ ঋগ্বেদে আছে। ‘দ্রাপী’ নামের যে পোশাকটির উল্লেখ বেশ কয়েকবার পাওয়া গেছে তা সম্ভবত ছিল মাথার আচ্ছাদনসহ ঢিলেঢালা কোনও পোশাক। নর্তকীরা সূচের কাজ করা যে পোশাক পরতেন তাকে বলা হত ‘পেশস্‌’। বিয়ের সময় নববধূ যে পোশাক পরতেন তার নাম ছিল ‘বাধূয়’। পোশাক তৈরির উপকরণ কী ছিল, তার স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় না। কার্পাস বা সুতোর সরাসরি উল্লেখ ঋগ্বেদে নেই। রণবীর চক্রবর্তী তাঁর ‘প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে’ বইতে মনে করেছেন সুতিবস্ত্র ঋগ্বৈদিকযুগে বিশেষ তৈরি হত না। তিনি দেখিয়েছেন ঋগ্বেদের সবচেয়ে অর্বাচীন দশম মণ্ডলেও মেষলোম দিয়েই কাপড় তৈরির কথা বলা হয়েছে (১০-২৬-৬)। তবে তিনি এও মনে করিয়ে দিয়েছেন বস্ত্র বয়নের টানা সুতো ও পোড়েনের সুতোর উল্লেখ ঋগ্বেদে একটি রূপকাশ্রয়ী বর্ণনায় পাওয়া যাবে। অনেকে মনে করেছেন নগরাশ্রয়ী হরপ্পা সভ্যতায় যখন কার্পাস ও সুতিবস্ত্রের ব্যবহার জানা ছিল, তখন ঋগ্বেদের যুগে তা লুপ্ত হয়ে যাবার কথা নয়। অবশ্য হরপ্পা সভ্যতার লিখনের ব্যবহারের উত্তরাধিকার ঋগ্বৈদিক যুগে দেখা যায় না।

ঋগ্বেদে অলঙ্কারের ব্যবহারের বহু উল্লেখ আছে। কর্ণশোভন (৮-৭৮-৩), হিরণ্যকর্ণ (১-১২২-১৪), নববধূর কুরী (১০-৫৮-৮) ও ন্যোচনী (১০-৮৫-৬) নুপূর জাতীয় খাদি (১-১৬৬-৯) গলার হার জাতীয় নিষ্ক ও তাতে মণির সংযোজন (১-১২২-১৪) ইত্যাদির উল্লেখ থেকে বোঝা যায় অলঙ্কার শিল্প একটি কারিগরী শাখা হিসেবে বিকাশ লাভ করেছিল।

অলঙ্কার শিল্পে ধাতু হিসেবে সোনা ব্যবহৃত হলেও দৈনন্দিন জীবনে ধাতুর ব্যবহার ব্যাপক ছিল না। অয়স শব্দটির উল্লেখ ঋগ্বেদে আছে, কিন্তু তাকে লোহা হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভবত ঠিক হবে না। অয়স বা লোহিতায়স কথাটিকে অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী তামা বা কাঁসা অর্থে গ্রহণ করার পক্ষে মত দিয়েছেন, কারণ প্রাচীন ভারতে ৮৫০ খ্রিস্টপূর্বের আগে লোহা ব্যবহারের সন্দেহাতীত প্রমাণ পাওয়া যায় না। ঋগ্বেদের যুগে বৃক্ষচ্ছেদনের জন্য কুড়াল, কৃষির জন্য লাঙলের ফলা বা কাস্তে নির্মাণে সম্ভবত তামাই ব্যবহৃত হত। ঋগ্বেদে কর্মার (৯-১১২-২) সম্ভবত আধুনিক কামারের পূর্বসূরি, তবে আধুনিক কামারের মত তিনি লোহা ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন না।

ধনার্থী বণিক ব্যবসায়ের জন্য নানা অঞ্চলে পাড়ি দিচ্ছেন, এই জাতীয় বর্ণনা ঋগ্বেদে পাওয়া যাবে (১-৫৬-২)। দূর দেশে বাণিজ্যর সঙ্গে যে বিপদের আশঙ্কা জড়িত, তা দূর করার জন্য অনেকগুলি প্রার্থনামন্ত্র ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। তস্করকে তাড়ানোর উল্লেখ (১-৪২-২ ও ৩), বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সুখগম্য পথে যাতায়াতের বাসনা (১-৪২-৭) এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ঋগ্বেদে পণি বলতে সম্ভবত বণিকদেরই বোঝানো হয়েছে। তাঁদের বিত্তের উল্লেখও রয়েছে। তবে ঋগ্বেদের সূক্ত রচয়িতারা পণিদের প্রতি বেশ বিরূপ ছিলেন। তাঁদের অনেক সময়ে আর্যদের শত্রু, দাস বা দস্যুবর্ণের মানুষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এঁরা সম্ভবত প্রাক-বৈদিক আমল থেকেই ব্যবসা বাণিজ্য করতেন।

ঋগ্বেদের আমলে বণিকরা সমুদ্রযাত্রায় অংশ নিতেন কিনা এই নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। সমুদ্র কথাটি ঋগ্বেদে বহুবার এসেছে। শত দাঁড়যুক্ত জলযানের কথাও রয়েছে। ধনলাভেচ্ছু ব্যক্তি সমুদ্রে গমনের জন্য সমুদ্রকে স্তুতি করছে এমন উল্লেখও দেখা যায় (৪-৫০-৬)। আর্থার ব্যারিডেল কীথ মনে করেছেন যে ঋগ্বেদে ব্যবহৃত সমুদ্র কথাটি সিন্ধুর মোহনার বিশাল জলরাশিকে নির্দেশ করে। অন্যদিকে ম্যাক্সমূলার, লাসেন, জিমার প্রমুখরা কীথের মত মানেননি। তাঁরা সমুদ্র বাণিজ্যকে আক্ষরিকভাবেই গ্রহণ করেছেন। ঋগ্বেদে সরস্বতী ও সিন্ধুকে সমুদ্রগামী বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় নদী ও সমুদ্রের পার্থক্য নিয়ে তাদের ধারণা অস্পষ্ট ছিল না। তবে সমুদ্রর কথা জানা থাকলেও সমুদ্র বাণিজ্য হত কিনা, তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। শত দাঁড়যুক্ত জলযানের উল্লেখ থাকলেও হাল, মাস্তুল জাতীয় কোনও কিছুর উল্লেখ ঋগ্বেদে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া সে সময় সমুদ্র বাণিজ্যের উপযোগী এত পরিমাণ পণ্যদ্রব্য উৎপাদিত হত কিনা, সেটাও একটি বিবেচ্য বিষয়।

ঋগ্বেদে একটি বাজারের বর্ণনা আছে। বিক্রেতারা সেখানে ক্রেতাদের খুঁজছে। এই বাণিজ্য মূলত হত বিনিময় প্রথায়। বিনিময়ের মাধ্যম ছিল গো ধন। ‘নিষ্ক’ কথাটিকে এ ডি পুসলকার ধাতব মুদ্রা অর্থে গ্রহণ করেছেন। অনেক পরে ‘নিষ্ক’ স্বর্ণমুদ্রা হিসেবে প্রযুক্ত হত। কিন্তু ঋগ্বেদে এই অর্থে কথাটি সম্ভবত ব্যবহৃত হয় নি। ধাতব মুদ্রার মান, ওজন ইত্যাদির কথারও কোনও উল্লেখ নেই। ঋগ্বেদের যুগে গো ধন ছিল বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম, পশুচারণের অর্থনীতিই ছিল মুখ্য। এই যুগে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ধাতুর মুদ্রার ব্যবহারের কল্পনা করার পক্ষে জোরালো যুক্তি তেমন নেই।

ঋগ্বৈদিক যুগের পরিবার কাঠামো

এবার আসা যাক ঋগ্বেদের সমাজ সম্পর্কিত আলোচনায়। শুরু করা যাক ঋগ্বেদের যুগে পরিবার কেমন ছিল সেই খোঁজখবর দিয়ে।

পরিবার গড়ে উঠত গৃহকর্তা (গহপতি) ও তার স্ত্রী(দের)কে কেন্দ্র করে। ঋগ্বেদে পিতৃবৃত্ত (পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া সম্পত্তি) এবং পিতৃযান (পূর্বপুরুষদের প্রদর্শিত পথ) এর উল্লেখ থেকে বোঝা যায় পিতৃতান্ত্রিক আদর্শের ওপরেই পরিবার কাঠামোটি দাঁড়িয়েছিল।

বড় পরিবারই ছিল আরাধ্য। দশম মণ্ডলের ৮৫ নং সূক্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে পরিবারের মহোত্তম আরাধ্য ছিল দশটি পুত্র। কন্যাসন্তানের দাবি দেখা যায় না। প্রথম মণ্ডলের ১২৪ নং সূক্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে ভ্রাতৃবিহীন কন্যাদের অরক্ষিত মনে করা হত। স্বামীহীনার পক্ষে স্বামীর ভাইকে বিবাহ করা ছিল বেশ স্বাভাবিক ঘটনা।

বাল্যবিবাহের কোনও ইঙ্গিত মেলে না। বিবাহ পরবর্তী যৌন মিলনের উল্লেখ রয়েছে দশম মণ্ডলের ২৫ নং সূক্তে। এ থেকে বোঝা যায় যৌবন উদগমের পরে বিবাহের রীতি ছিল।

ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের ৫৫ নং সূক্তটি পরিবারের আয়তন সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়। রাত্রিকালে এক বালিকা সেখানে তার পিতামাতার সাথে রয়েছে। পুরুষেরা যাওয়া আসা করছে। নারীরা নিদ্রামগ্ন। দশম মণ্ডলের ৮৫ নং সূক্ত তে দেখা যায় নব পরিণীতা বধূ তার শ্বশুরালয়ে চলেছে। আশা করা হচ্ছে সে যেন শ্বশুরবাড়ির সকলের মন জিতে নিতে পারে। বেশ বড় পরিবারের ছবিই এই সূক্তগুলিতে ফুটে উঠেছে।

ঋগ্বৈদিক যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থা

ঋগ্বেদের যুগে পরিবারের বাইরে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্র রাজনীতির চেহারাটি কেমন ছিল এবার সেই সংক্রান্ত দিকগুলি খতিয়ে দেখা যাক।

ঋগ্বেদের সমাজ ছিল গোষ্ঠীভিত্তিক এবং গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন রাজা। রাজার নির্দিষ্ট শাসন এলাকা ছিল। ঋগ্বেদের চতুর্থ মণ্ডলে ৪২ নং সূক্তে আমরা বরুণের মুখে শুনি – “আমিই রাজকীয় শাসক, এ রাষ্ট্র আমার।” রাজারা বহুস্তম্ভবিশিষ্ট প্রাসাদে বাস করতেন এবং সাধারণত স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত থাকতেন। পুরোহিতদের মাধ্যমে তারা দেবতাদের গবাদি পশু, ঘোড়া, রথ, অলংকার এবং সোনা দান করতেন। রাজা তাঁর সভাসদ ও সেনাপ্রধানদের সঙ্গে নিয়ে আম জনতার দরবারে উপস্থিত হতেন। এরকম জন সমাবেশ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদে দুটি শব্দ পাওয়া যায়। সভা ও সমিতি। সভা ও সমিতির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার কোনও মূল্যবান সাহিত্যিক উপাদান আমাদের কাছে নেই।

রাজা ছাড়াও কোনও সম্মানীয় ব্যক্তির চারপাশেও এমন সমাবেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৭১ নং সূক্তে এর সাক্ষ্য রয়েছে। এমনকী ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৩৪ নং সূক্তে পাশার দানের বাজি রেখে জুয়াখেলার জন্য সভার সমাবেশের উল্লেখ পাওয়া যায়।

রাজা ও প্রধানদের উপাধি ছিল ক্ষত্রিয়। ক্ষত্র শব্দটি থেকে, যার অর্থ কর্তৃত্ব বা শাসন, এটি উদ্ভূত হয়েছে। ক্ষত্রিয় বলতে যোদ্ধা বা সেনানীদের বোঝানো হত না। তাদের জন্য ঋগ্বেদে যোধা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

ঘোড়ায় টানা রথের ব্যবহার ছিল সমাজের মর্যাদাবান ও সম্পদশালীদের জন্য সংরক্ষিত। তারা যখন রথে চড়ে যুদ্ধে যেত তাদের আশেপাশে পদাতিক সেনারা থাকত। প্রধান অস্ত্র ছিল তীর ধনুক (বান, বুণ্ডা, শারু), বল্লম (সৃকা), তলোয়ার (অসি), এবং কুঠার। তলোয়ার ও কুঠারে ব্রোঞ্জ ব্যবহৃত হত এবং সেই কারণে এই অস্ত্র দুটি ছিল মহার্ঘ।

প্রজারা (বিশ হিসেবে উল্লিখিত) রাজাকে রাজস্ব হিসেবে যে কর দিত তাকে বলা হত বলি। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৭৩ নং সূক্তে দেখা যাচ্ছে – “ইন্দ্র বিশকে (প্রজাকে) তোমার (রাজা) সামনে বলি (রাজস্ব) আনতে আদেশ করুন।”

রাজা তার সম্পদ বৃদ্ধির জন্য বা গবাদি পশুর জন্য অন্য রাজ্যের মধ্যে লুন্ঠন চালাতেন বা যুদ্ধ করতেন। সপ্তম মণ্ডলের ৬ নং সূক্ততে বলা হচ্ছে অগ্নি তাঁর বিজয়ী শক্তিতে “নহুষের গোষ্ঠীকে পদানত করে তাদের বলি আনতে বাধ্য করেন।” গবাদি পশুকে লুঠ করার জন্য হামলা চলত। তার থেকে পশুকে রক্ষা করার জন্য গো পায়া (পায়া অর্থে পাহারাদার) দের নিয়োগ করা হত। ঋগ্বেদে যত্রতত্র গবিষ্টি শব্দটি দেখা যায়। এর দ্বারা গবাদি পশুর জন্য যুদ্ধকে বোঝানো হয়েছে।

প্রাক ঋগ্বৈদিক ভারতীয় উপমহাদেশ

ঋগ্বেদের যুগে রাজনীতির আর একটি বড় দিক অনার্য ভাষীদের সঙ্গে আর্য ভাষীদের সম্পর্ক। এই সূত্রেই দাস, দস্যু ইত্যাদি শব্দগুলির অর্থ ঠিক কী, এই শব্দগুলি কাদের নির্দেশ করছে তা আলোচ্য। তবে সেই আলোচনায় প্রবেশের আগে ভারতে পরিযানের (মাইগ্রেশন) ইতিহাসটি দেখে নেওয়া দরকার। জেনে নেওয়া দরকার ঋগ্বৈদিক ভারতের আগের ইতিহাসের ধারাটি।

আউট অফ আফ্রিকা বা হোমো সেপিয়েন্স এর প্রথম সফল পরিযান শুরু হবার পর আজ থেকে মোটামুটি পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্স এর কয়েকটি দল ভারতে আসে, ছড়িয়ে পড়ে ও তাদের বংশবৃদ্ধি করার পর্বটা চলতে থাকে। প্রায় পঞ্চান্ন হাজার বছর ধরে আর সেরকম কোনও উল্লেখযোগ্য পরিযান এর মধ্যে ভারতে হয়নি। পরিযানের নতুন অধ্যায় শুরু হল আজ থেকে ন’ হাজার বছর আগে। খ্রিস্টপূর্ব সাত হাজার বছর আগে থেকে একটানা কয়েক হাজার বছর ধরে ইরানের জাগরোস অঞ্চল থেকে একটি পরিযান শুরু হয় দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। ভারতে প্রবেশ করে তারা অন্তত ৪৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তাদের বংশধারা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছিল বলে জিন গবেষকরা মনে করেছেন। এরা কৃষিকাজ জানতো। এদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের সংমিশ্রণে দ্রাবিড় জাতি তৈরি হয়েছে এবং তারাই সিন্ধু সভ্যতার পত্তনকারী – এরকম একটি অভিমত অনেকেই প্রকাশ করেছেন।

হরপ্পা অঞ্চলে জনবসতির প্রাথমিক বিকাশ ঘটছিল আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে। অবশ্য তাম্র ব্রোঞ্জ যুগের যে সিন্ধু সভ্যতার কথা আমরা জানি এটি সেই পর্যায়ের কথা নয়। এই পরিণত হরপ্পান সভ্যতা ২৬০০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ বিকশিত হয়েছিল এবং তা মোটামুটি ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ স্থায়ী ছিল। এর আগেই বর্তমান ভারতের অন্তর্গত কালিবঙ্গান ও রাখিগরি এবং পাকিস্তানের বানোয়ালি ও রহমান ডেহরিতে খানিকটা সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে ওঠার প্রমাণ ছিল। ক্রমশ নতুন নতুন শহরে সভ্যতার প্রসার ও বিকাশ ঘটে। ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়। উন্নত নগর পরিকল্পনা দেখা যায়। হরপ্পা সভ্যতার সবকটি অঞ্চল একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অধীনে আসে। একই ধরনের সিল, লিপি, চিহ্ন ও পরিমাপক সব জায়গায় ব্যবহৃত হতে থাকে।

হরপ্পা সভ্যতার প্রধান শহরগুলোর মধ্যে ছিল হরপ্পা, মহেনঞ্জোদাড়ো, কালিবঙ্গান, ধোলাবীরা, লোথাল, রাখিগরি, সুক্তাজেনদার, আলমগীরপুর, কোট ডিজি, চানহুদারো, সুরকোতদা প্রভৃতি। সিন্ধু এবং পাঞ্জাব এই সভ্যতার কেন্দ্রস্থল হলেও এর চারপাশে এই সভ্যতা ছড়িয়েছিল। সিন্ধু এবং তার শাখানদী উপনদীগুলো ছাড়াও ঘর্ঘর হরকার মতো নদী এই সভ্যতার বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।

হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক গড়ন প্রসঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ পুরাতত্ত্ববিদ শিরিন রত্নাগর জানিয়েছেন যে অপরিণত হলেও হরপ্পার সময়ে তর্কাতীতভাবেই রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহের অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন অংশে সুসংহত নকশায় একটার পর একটা বসতি গড়ে ওঠার যে প্রমাণ মিলেছে তা তখনই কেবল গড়ে ওঠা সম্ভব, যখন উন্মেষপর্বেই এর ধারণা ও নকশাটি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মর্টিমার হুইলার হরপ্পা সভ্যতার একাংশে সেনানিবাস বা ব্যারাকের অস্তিস্ত্ব ছিল বলে মনে করেছেন। তবে শিরিন রত্নাগরের মতে এটা খুবই ছোট একটা দলের থাকার মতো বসতি। পেশাদার বা স্থায়ী সৈন্যবাহিনী সেকালে ছিল না বলেই তাঁর অভিমত। মেসোপটেমিয়ার মতো বড় রাজার প্রাসাদ এখানে পাওয়া না গেলেও মহেঞ্জোদাড়োতে যে প্রতিরক্ষা দুর্গ পাওয়া গেছে তা প্রাসাদোপম একটি স্থাপত্য ছিল বলেই তিনি মনে করেছেন। হরপ্পা সভ্যতার বিশাল এলাকা জুড়ে ওজন মাপার ক্ষেত্রে এমন একটি সমরূপ পদ্ধতির জন্ম হয়েছিল, যা কিছুতেই ব্যাপক বাণিজ্যের আপন স্বকীয়তায় গড়ে উঠতে পারে না, যদি না কোনও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ তা বাধ্যতামূলকভাবে চালু করে। কেবল রাষ্ট্রীয় সংহতিই বাণিজ্যের বিনিময় মানদণ্ডকে এভাবে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে। মেসোপটেমিয়ার সমগ্র এলাকাটি উর রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে আসার আগে সেখানে অঞ্চলভেদে ওজন মাপার নানান পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, এটাও এই প্রসঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। তবে হরপ্পার রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে এটা মনে রাখা জরুরী এই কাঠামো একটি আদিম জনজীবনের ভিতের ওপর গড়ে উঠেছিল। হরপ্পা সভ্যতার সময়কালেও অনেক আদিম প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে টিকে ছিল। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী সম্ভবত তাদের গোত্র ও কুলের স্বাতন্ত্র্যকে তখন স্বীকৃতি দিত। সমাজে কর্মভিত্তিক শ্রেণি বিভাজন অবশ্যই ছিল। তবে শিরিন রত্নাগরের এই মন্তব্যটি বর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভবের ইতিহাস খোঁজার সময় আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, “মহেঞ্জোদাড়োতে বর্ণবিভাজনের চিহ্ন খুঁজে বেড়ানো সে যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন”। আমরা পরে দেখব ঋগ্বৈদিক কাল পর্যন্তও ভারতে বর্ণবাদের অস্তিত্ব ছিল না।

হরপ্পা সভ্যতার প্রায় সমসাময়িক আমুদরিয়া নদীর ধারে গড়ে ওঠা বিখ্যাত ব্যাকট্রিয়া – মার্জিয়ানা প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার সভ্যতা, যার সময়কাল ২৩০০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলে চিহ্নিত হয়েছে। হরপ্পা সভ্যতার সমসাময়িক এই প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার সঙ্গে হরপ্পার ব্যবসা বাণিজ্যর অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের নানা জায়গায় কৃষিকাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। পূর্ব রাজস্থান, দক্ষিণ ভারত, মধ্য ভারতের বিন্ধ্য অঞ্চল, পূর্ব ভারত এবং কাশ্মীরের সোয়াত উপত্যকায় কৃষিকাজ ছড়িয়ে পড়ার অনেক প্রমাণ আছে।

২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কাল জুড়ে কাজাখ তৃণভূমি অঞ্চল থেকে পশুপালকদের কয়েকটি দল মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান হয়ে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ায় চলে আসে। একই সময়ে কৃষ্ণসাগরের আশেপাশের তৃণভূমি অঞ্চল থেকেও শুরু হয় ধারাবাহিক পরিযান। তারাই ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাটি বয়ে নিয়ে আসে, যার প্রচলিত নাম আর্য ভাষা।

খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে যখন উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এই পরিযায়ীরা আসছিলেন সেই সময়েই চিনা উৎস থেকে জন্ম নেওয়া পরিযায়ীদের দুটি তরঙ্গ পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতে চলে আসে। এদের একটি ধারা নিয়ে আসে অস্ট্রো এশিয়াটিক ভাষাগুলির প্রত্নরূপ, বিশেষ কয়েক ধরনের গাছগাছালি ও ধানের এক নতুন প্রজাতি। এরা একধরনের কৃষিবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল এবং তার ফলে তাদের জনসংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। গোটা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জনবিন্যাস তারা অনেকটা বদলে দেয়।

উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব ভারতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে নানা উৎসের এই ধারাবাহিক পরিযানগুলি যখন চলছিল তখন হরপ্পা সভ্যতার অন্তিম পর্ব। যার শুরু ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে হরপ্পা সভ্যতা বিলুপ্ত হয়।

আর্য বিতর্ক প্রসঙ্গে

আর্যভাষীদের সমাজ ব্যবস্থা বা ঋগ্বৈদিক যুগের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে কথা শুরু করার সময় আমরা কয়েকটি শব্দের দিকে প্রথমে নজর দিতে চাইবো। শব্দগুলি আজকের সমাজ কাঠামোয় জাতিবাচক কোনও শব্দ নয়, কিন্তু ভারতের সমাজ ব্যবস্থায় গোত্র বিভাজনের আদি পর্ব বৈদিক যুগকে বুঝতে এই শব্দগুলি অপরিহার্য। আর্য, দাস, দস্যু, অসুর, নিষাদ, পণি এই শব্দগুলির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করা যাক।

প্রথমেই আসা যাক আর্য শব্দটি প্রসঙ্গে। আর্য শব্দ ও প্রসঙ্গটি নিয়ে যে প্রবল আলোড়ন সমাজ রাজনীতি ইতিহাসের জগতে হয়েছে, তার তুলনা কমই পাওয়া যাবে। এই শব্দটির তাৎপর্য, অর্থ, ব্যবহার নিয়ে তর্ক বিতর্ক, তাকে ঘিরে রাজনীতি বিশ শতকের তিন ও চারের দশকের ইউরোপে চরমে উঠেছিল। হিটলারের নাজিবাদ, তৃতীয় রাইখ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই শব্দটির ভূমিকার কথা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। ভারত ও ভারতবিদ্যা সম্পর্কিত চর্চাতেও এই শব্দটি নিয়ে অষ্টাদশ শতক থেকে আলোচনা কম হয় নি। বিশ একুশ শতকের সন্ধিলগ্ন থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে শব্দটি আবার নতুন করে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। জ্ঞানচর্চার জগতটিও রাজনীতি ও বিতর্ক নিরপেক্ষ নেই। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রচুর বইপত্র ও প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে এবং এই গবেষণা ও তার উপাত্তগুলিও প্রায়শই নিরপেক্ষ জ্ঞানচর্চার বদলে নির্দিষ্ট শিবিরের মতাদর্শের প্রতিফলন বলে ব্যাখ্যাত হচ্ছে।

আর্য ভাষা সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাতের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ তথা এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোন্স এর নামই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর আগেও কোনও কোনও বণিক ভারতীয় ও ইউরোপীয় ভাষার সম্পর্ক নিয়ে কিছু ইঙ্গিৎ করেছিলেন, কিন্তু জোন্স এর আগে বিষয়টি নিয়ে কেউ বিধিবদ্ধ আলোচনা করেন নি। এই বিধিবদ্ধ আলোচনা শুরু হয়, যখন জোন্স ১৭৮৬ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর তৃতীয় বার্ষিক বক্তৃতাটি প্রদান করেন (The Third Anniversary Discourse)। ঐ বক্তৃতায় তিনি প্রমাণাদিসহ দাবি করেন যে, ইউরোপীয় ভাষা এবং সংস্কৃতের তুলনামূলক আলোচনায় তিনি লক্ষ করেছেন যে, গ্রিক, ল্যাটিন, গথিক ও কেলটিক এবং সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষার উৎস একই। আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর পণ্ডিতগণ একমত হন যে, স্যার উইলিয়াম জোনস-এর ধারণা সঠিক। জোনস বিশ্ব ভাষাবিজ্ঞানের জনকের মর্যাদা লাভ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ও সাংস্কৃতিক ভাষাতত্ত্ব বা ফিললজির মতো বিষয়গুলি। ইংরেজদের ভারত শাসনের সূত্র ধরে ভারতবিদ্যা বা ইন্ডোলজির গুরুত্বও অপরিসীম হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে প্রচুর গবেষণা ও লেখালেখি প্রকাশিত হতে থাকে। বিভিন্ন ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারততত্ত্ব ও সংস্কৃত বিষয়ে গবেষণা অধ্যাপনার জন্য আকর্ষণীয় চেয়ার প্রফেসর পদ তৈরি হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এই চেয়ার অধ্যাপকের পদে বৃত হন জার্মান অধ্যাপক ম্যাক্সমুলার এবং তিনি ভাষাতত্ত্বের এলাকা ছাড়িয়ে একটি আর্য জাতির ধারণাকে সামনে নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে ম্যাক্সমুলার স্বয়ং আর্যদের কোনও নির্দিষ্ট জাতি নয়, একটি ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে সংশোধিত মত প্রকাশ করলেও আর্য জাতির ধারণাটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয় এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পণ্ডিত মহলে আর্য জাতির ধারণা অনেকদিন আগেই বাতিল হয়ে গেলেও সাধারণ জনসমাজে তো বটেই এমনকি বইপত্র বা প্রবন্ধ নিবন্ধে এই আর্যজাতির ধারণাটি এখনো অনেকাংশে বলবৎ আছে। আর্য শব্দটিকে জাতি হিসেবে নয়, ভাষাভাষী হিসেবে ব্যাখ্যা করেও অবশ্য অনেক বইপত্র লেখা হচ্ছে জনসমাজের জন্য, জনমনের দীর্ঘলালিত ভুলকে মোছার চেষ্টা হচ্ছে।

১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় এইচ. ডব্লু. বেইলির ‘ইরানিয়ান আর্য অ্যান্ড দহ’ নামের একটি প্রবন্ধ। সেখানে তিনি দেখান ঋগ্বেদের যে সব জায়গায় আর্য শব্দটির ব্যবহার হয়েছে, সেগুলো থেকে একই ধরনের জাতিগত অর্থ বের করা যায় না। ব্যুৎপত্তিগতভাবে শব্দটি অর্‌ ধাতু নিষ্পন্ন হতে পারে, যার অর্থ পাওয়া। ইরানীয় উল্লেখে আর্য শব্দটির অর্থ অভিজাত। বেদোত্তর সংস্কৃত এবং বৌদ্ধ ও জৈন রচনাতেও শব্দটি অভিজাত বা সভ্য অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। ঋগ্বেদে যে আর্যভাষী জনগোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে, তারা হয়তো একই নৃকুল ভুক্ত ছিলেন না, একটি জাতি ছিলেন না। তবে একই ভাষা ও জীবনযাত্রার ধরণ তাদের একটি নিজস্ব পরিচয় দিয়েছিল।

দাস ও দস্যু

এবার আসা যাক দাস ও দস্যু শব্দ দুটি প্রসঙ্গে। ঋগ্বেদে এই শব্দদুটি ঘুরে ফিরে এসেছে। কিন্তু এই শব্দদুটি সমার্থক নয় এবং একই ধরনের লোককে এই শব্দদুটি দ্বারা বোঝানো হয় নি। দাসরা অনার্য ভাষী ছিলেন না, কিন্তু দস্যুদের ভাষা ছিল আলাদা। আর্য হিসেবে যে অভিজাতরা উল্লিখিত হয়েছেন, তারা যেমন ‘বিশ’ নামের জনগোষ্ঠীতে সংঘবদ্ধ ছিলেন, দাসেরাও তাই ছিলেন। আর্য এবং দাসদের মধ্যেকার যে সব সংঘাতের কথা ঋগ্বেদে রয়েছে, তা সম্ভবত একই ভাষা ও জনগোষ্ঠীর দুই আলাদা দলের আভ্যন্তরীণ সংঘাত। আর্য গোষ্ঠীর প্রধান দেবতা ইন্দ্র দাস ও দস্যু উভয়ের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছেন। বিভিন্ন স্তোত্রে এইসব যুদ্ধের কথা রয়েছে। কিন্তু স্তোত্রগুলি দাস ও দস্যুদের সমান শত্রু হিসেবে দেখে নি। ঋগ্বেদের অনেক সূক্ত অথর্ববেদেও এসেছে। এই সমস্ত সূত্রগুলি থেকে মনে হয়, ইন্দ্র দাসদের বশ্যতা স্বীকার করিয়েছেন আর দস্যুদের সমস্ত গুণ কেড়ে নিয়েছেন। দাসদের চেয়ে দস্যুদের ধ্বংস করা ও বশ্যতা স্বীকার করানোর সংখ্যা ঋগ্বেদে বেশি। দস্যুহত্যার অন্তত বারোটি উল্লেখ ঋগ্বেদে রয়েছে কিন্তু দাসদের হত্যার কথা থাকলেও শব্দবন্ধ হিসেবে দাসহত্যা শব্দটির উল্লেখ কোথাও নেই বলে অধ্যাপক রামশরণ শর্মা তাঁর ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন (পৃ – ১০)। তাঁর মতে “দস্যুদের ক্ষেত্রে আর্যরা নির্মমভাবে বিলুপ্ত করে দেওয়ার নীতি মেনে চলতেন, কিন্তু দাসদের ক্ষেত্রে তাঁর আচরণ ছিল অনেকটা সংযত”। (এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য পাঠক দেখতে পারেন ‘প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথা’ – দেব রাজ চানানা। কে পি বাগচী প্রকাশনা।)

দস্যুদের জীবনযাত্রার ধরন আর্যদের চেয়ে অনেকটা আলাদা ছিল। আর্যরা যাগযজ্ঞের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন, কিন্তু যজ্ঞের সঙ্গে দস্যুদের কোনও সম্পর্কই ছিল না। ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের ৬ নং সূক্ততে দস্যুদের সম্পর্কে ‘অক্রতূন’, ‘অযজ্ঞান’ ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। অথর্ববেদে দস্যুদের ‘মায়াবান’ বা অশুভ জাদুর চর্চাকারী বলা হয়েছে। আর্যরা বিভিন্ন ব্রত মানত, কিন্তু দস্যুরা মানত না বলে তাদের ঋগ্বেদের ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূক্তে ‘অব্রত’, ‘অন্যব্রত’ ইত্যাদি বলা হয়েছে। দাসদের প্রতি কিন্তু এই ধরনের কোনও বিশেষণ প্রয়োগ করা হয় নি। আর্যদের সঙ্গে দস্যুদের গায়ের রঙের পার্থক্যের কথাও ঋগ্বেদে এসেছে। সপ্তম মণ্ডলের পঞ্চম সূক্ততে বলা হয়েছে আর্যরা অনেক সময় কালো মানুষদের বসতিতে আগুন লাগিয়ে দিতেন। কালোরা তাদের যাবতীয় সম্বল ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হতেন। নবম মণ্ডলের একচল্লিশ নং সূক্তে বলা হয়েছে আর্যদেবতা সোম হলেন কৃষ্ণচর্ম লোকেদের ঘাতক। দস্যুদের ই সম্ভবত কালো মানুষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদের চতুর্থ মণ্ডলের ১৬ নং সূক্তের ১৩ নং ঋকে ইন্দ্র কর্তৃক পঞ্চাশ হাজার  ‘কৃষ্ণ’ নিধনের কথা আছে।  ঋগ্বেদের অষ্টম মণ্ডলের ৯৬ নং সূক্তে কৃষ্ণ নামক জনৈক বীরের সঙ্গে ইন্দ্রের যুদ্ধের কথা রয়েছে। সূক্তটি বলেছে, কৃষ্ণ যখন অংশুমতি বা যমুনা নদীর তীরে দশ হাজার সৈন্য নিয়ে শিবির গড়েন, ইন্দ্র তখন আর্য বিশ বা গোষ্ঠীদের সংগঠিত করেন। সায়ণভাষ্য অনুযায়ী এই কৃষ্ণবর্ণ প্রতিপক্ষরা হলেন কালো রঙের অসুর (কৃষ্ণরূপাঃ অসুরসেনাঃ)।

দস্যুদের সম্পর্কে ‘অনাস’ বিশেষণটি প্রযুক্ত হয়েছে। একালের পণ্ডিতেরা মনে করেছেন এই শব্দটি দিয়ে খর্ব নাসা বোঝানো হয়েছে। ঋগ্বেদের বিভিন্ন জায়গায় ‘মৃধ্রবাক’ শব্দটি রয়েছে। দুটি জায়গায় (৫/২৯/১০; ও ৮/৬/৩ – মণ্ডল/সূক্ত/ঋক এই ক্রমে) শব্দটিকে দস্যুদের বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর্য ও দস্যুদের বাকরীতির পার্থক্যর কথা এখানে আছে বলে মনে হয়। আর্যদের সঙ্গে দস্যুদের লড়াইয়ের ছবি ঋগ্বেদ জুড়ে রয়েছে। দস্যুদের অনেক পুর বা পাঁচিল ঘেরা বসতি বা দুর্গ ছিল। বিভিন্ন সূক্ততে এই পুরের কথা এসেছে। যেমন প্রথম মণ্ডলের ১০৩ নং সূক্তের ৩ নং ঋক্‌, দ্বিতীয় মণ্ডলের ১৯ নং সূক্তের ৬ নং ঋক্‌, চতুর্থ মণ্ডলের ৩০ নং সূক্তের ২০ নং ঋক্‌, ষষ্ঠ মণ্ডলের ২০ নং সূক্তের ১০ নং ঋক্‌। যুদ্ধের সময় আর্যেরা এই দুর্গ আর পাঁচিল ঘেরা বসতি ভেঙে দিতেন। হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের সঙ্গে আর্যদের গণ সংঘর্ষের কোনও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। কারণ হরপ্পা সভ্যতার পতনের কয়েকশো বছর পরে হয়ত ভারতে তাদের আবির্ভাব। তবে হরপ্পা সভ্যতা যে জনগোষ্ঠীর সভ্যতা তারা পরে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েন এবং হরপ্পার মতো পুর বা পাঁচিল ঘেরা বসতি ও দুর্গ তাদেরও ছিল, এই অনুমান করা অসঙ্গত নয়।

আর্যভাষীদের মধ্যেকার নানা গোত্র প্রসঙ্গে

এটা মাথায় রাখা দরকার আর্যেরা প্রাক আর্য জনগোষ্ঠীর সাথে যেমন সংঘাতে জড়িয়েছিল, ঠিক তেমনি আর্যদের নিজেদের মধ্যেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অনেক প্রমাণ ঋগ্বেদে রয়েছে। ঋগ্বেদে আর্য শব্দটি মোট ৩৬ বার এসেছে, তার মধ্যে নয় জায়গায় আর্যদের নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ের উল্লেখ রয়েছে। আর্যদের অন্তর্দ্বন্দ্বে একাংশ দাসদের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন এবং দাস ও আর্যদের একাংশের মধ্যে পারস্পরিক মিলন প্রক্রিয়া এগিয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। ঋগ্বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলের ২২ নং সূক্তের ১০ নং ঋক্‌ এ বলা হয়েছে ইন্দ্র দাসদের আর্যে পরিণত করেছিলেন। পূর্বতন আধিবাসীদের অনেককে, বিশেষত তুলনায় অগ্রসর লোকেদের যে নতুন আর্য মিশ্র সমাজে অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া হয়েছিল এবং উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, এরকম অনুমান অনেকে করেছেন। আদি অধিবাসীদের অনগ্রসর অংশ, যারা আর্যদের আধিপত্য মেনে নিয়েছিল, তাদের সম্ভবত দাস হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। আর চরম বিরোধী, যাদের বশ্যতা স্বীকার করানো সম্ভব হয়নি, সেই প্রবলতর শত্রুরাই সম্ভবত গণ্য হয়েছিল দস্যু হিসেবে। অন্য একটি মত অনুসারে দাসরা সম্ভবত ছিলেন মিশ্র ইন্দো আর্যভাষাগোষ্ঠীর এক অগ্রবাহিনি। কাসাইটরা যখন ব্যাবিলোনিয়ায় আসেন, খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দ নাগাদ, সেই সময়েই তারা ভারতে আসেন। দাসরা ছিলেন ঋগ্বেদীয় মানবগোষ্ঠীর ভাষা ও অন্যান্য কিছু সাংস্কৃতিক উপাদানের অংশভাগ, তাই তাদের সঙ্গে যতদূর সম্ভব মানিয়ে চলাই ছিল ঋগ্বেদীয় মানবগোষ্ঠীর নীতি। দিবোদাস, বল্‌বূথ, তরুক্ষের মতো দাস অধিপতিদের তারা সহজেই নিজেদের সমাজের অঙ্গীভূত করে নিয়েছিলেন।

আর্যদের মধ্যেকার অন্তর্দ্বন্দ্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ রয়েছে ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের ৩৩ নং সূক্তে উল্লিখিত দশ রাজার যুদ্ধের ঘটনাটিতে। এটিকে একটি ঐতিহাসিক বিবরণ বলেই গ্রহণ করা হয়, যদিও এর সন তারিখ সুনির্দিষ্ট নয়। এই দশ রাজার যুদ্ধ মূলত ঋগ্বেদীয় আর্যদের দুটি প্রধান শাখা পুরু এবং ভারতের মধ্যে সংগ্রাম। অনার্যরাও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে সূক্তটি থেকে মনে হয়। ভারতের নেতা ছিলেন ঋগ্বেদের বিখ্যাত নায়ক সুদাস ও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন পুরোহিত বশিষ্ট। এদের বিপরীতে ছিলেন দশজন রাজা। অনু, দ্রুহ্যু, যদু, তুর্বুশ, পুরু – এই পাঁচ বিখ্যাত জনগোষ্ঠীর রাজাদের সঙ্গে এসে মিশেছিলেন অলিন, পক্‌থ, ভলান, শিব, বিষাণী নামক পাঁচ স্বল্পপরিচিত জনগোষ্ঠীর রাজারা। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পুরুরা আর সাহায্য করেছিলেন পুরোহিত বিশ্বামিত্র। এই যুদ্ধে সুদাসের নেতৃত্বে ভারতেরা পুরুর নেতৃত্বাধীন জনগোষ্ঠীগুলিকে পরাজিত করেন।

ঋগ্বেদে আর্যদেরই মধ্যেকার একাংশ সম্পর্কে নিন্দাবাদ রয়েছে। মিউঅর ঋগ্বেদ থেকে আটান্নটি অংশ উদ্ধৃত করে তার ব্যাখ্যায় বলেছেন যে যারা ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন ছিল, তাদের সেখানে নিন্দাবাদ করা হয়েছে। ধনী কৃপণ লোকেদের পণি বলে আখ্যাত করা হয়েছে এবং তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। ধনী হওয়া সত্ত্বেও দেবতাদের কিছু উৎসর্গ না করা বা পুরোহিতদের দক্ষিণা না দেওয়ার কারণেই এই বিরূপ মনোভাব এসেছিল।

রামশরণ শর্মা মনে করেছেন কালক্রমে আর্যদের অধিকাংশই অন – অভিজাত ও অর্ধ – দাসের পর্যায়ে পরিণত হয়েছিলেন, কিন্তু তা মূলত ঋক পরবর্তী বৈদিক যুগের পর্বের বিষয়। (‘‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’’ পৃ – ২৭)।

ঋগ্বেদের যুগে সামাজিক শ্রেণির গঠন

আর্য জনগোষ্ঠীদের নিজেদের মধ্যেকার নানা ধরনের দ্বন্দ্ব এবং বাইরের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাত ও আদান প্রদানের মধ্যে দিয়ে কীভাবে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি গড়ে উঠল – সেই আলোচনার দিকে এবার এগোনো যেতে পারে। ঋগ্বেদে ‘বর্ণ’ শব্দটি প্রয়োগ করা হলেও তা কোনও শ্রম বিভাজনের ইঙ্গিত দেয় না। পরবর্তীকালে সামাজিক শ্রেণি বিভাজনের ভিত্তি কিন্তু হয়ে ওঠে শ্রম বিভাজন।

ঋগ্বেদের যুগে পেশা বিভাজন অবশ্যই ছিল, মর্যাদাভেদও ছিল অনুমান করা যায়, কিন্তু তার ভিত্তিতে আলাদা আলাদা সামাজিক শ্রেণি তখন তৈরি হয়ে যায়নি। বায়ু পুরাণ (১/৮/৬০) বা দীঘ নিকায় এর সাক্ষ্য থেকে মনে হয় ত্রেতা যুগের আগে অবধি কোনও বর্ণাশ্রম ছিল না। তন্তুবায়, চর্মকার, সূত্রধর ও চিত্রকরের জন্য একই সাধারণ শব্দের ব্যবহার থেকে তাদের ইন্দো ইউরোপীয় উৎপত্তির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। (কার্ল ডারলিং – আ ডিকশনারি অব সিলেকটেড সিনোনিমস ইন দ্য প্রিন্সিপাল ইন্দো ইউরোপীয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস)। রথশিল্পী বা ধাতুশিল্পীরা সমাজে যথেষ্ট মর্যাদা পেতেন, আর্যগোষ্ঠী বিশ এর সদস্যরাই এই সব কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১০৫ নং সূক্তের ১৮ নং ঋক্‌-এ আমরা জনৈক সূত্রধরের কথা পাই, যিনি ‘পিঠে ব্যথা না হওয়া পর্যন্ত ঝুঁকে কাজ করেন’। সূত্রধরের কাজ কঠিন এটা বোঝানো হলেও কাজটি সম্পর্কে ঘৃণা বা এমনকি তাচ্ছিল্যেরও কোনও ভাব নেই। সূত্রধর সহ কারিগরেরা যে বৈদিক যুগে নিচু জাত বা আলাদা শ্রেণির লোক ছিলেন না, তা বোঝা যায়। ঋগ্বেদের সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় কামার, ছুতোর, মুচি, তাঁতি ইত্যাদি কারিগরি বৃত্তি ছিল যথেষ্ট মর্যাদার, আর্য সমাজ ‘বিশ’ এর সম্মানীয় সদস্যরাই তাতে যুক্ত থাকতেন। তাদের শূদ্রদের পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অনেক পরবর্তী সময়কালের ব্যাপার। চতুর্বর্ণের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রাচীনতম অনুমানটি আছে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পুরুষ সূক্তে। কিন্তু এটিকে প্রক্ষেপ বলেই মনে করা সঙ্গত। জনগোষ্ঠীমূলক সমাজ ভেঙে শ্রেণিসমাজে পরিণত হওয়ার সপক্ষে একটি যুক্তি হিসেবে পরবর্তীকালে এই প্রক্ষেপ হয়ে থাকবে। ঋগ্বেদের যুগে শ্রম বিভাজন অনেকদূর এগিয়েছিল কিন্তু একই পরিবারের লোকে কবি, চিকিৎসক, শস্য পেশাইকর ইত্যাদি নানারকম পেশায় নিযুক্ত থাকত এটা বোঝা যায় ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলের ১১২নং সূক্তের ৩ নং ঋক্‌ থেকে। [রামশরণ শর্মা – ‘‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’’ পৃ ৩০, ৩১]

১০

ঋগ্বেদের যুগের পরে সমাজ কাঠামোর বদল প্রসঙ্গে

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর লেখক দিওদেরাস তাঁর একটি লেখায় আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময়কার (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দ) জনৈক লেখকের একটি অংশ উদ্ধৃত করেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে আলেকজান্ডারকে রাজা পুরু জানাচ্ছেন যে গঙ্গারিডাই এর রাজার বিরুদ্ধে প্রজাদের অনেক ক্ষোভ এবং প্রজারা তাঁকে সম্মানও করে না, কারণ তিনি ‘চামারের সন্তান’। এই উল্লেখটি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সে সময় চামারবৃত্তিকে যথেষ্ট নিচু চোখে দেখা শুরু হয়েছিল। এই উদ্ধৃতির সঙ্গে ঋগ্বেদের অষ্টম মণ্ডলের পঞ্চম সূক্তের ৩৮ নং ঋক্‌টির যদি তুলনা করে দেখি, তাহলে দেখব সেখানে মুচির পেশাটিকে মর্যাদার চোখেই দেখা হচ্ছে। ঋগ্বৈদিক পরিস্থিতি থেকে সরে এসে আলেকজান্ডারের সময়কালের মাঝের হাজার বছরের মধ্যে এই পরিবর্তন কবে কীভাবে হতে থাকল, সেটি একটি জরুরী অনুসন্ধানের বিষয়।  

অথর্ববেদ পর্বের শেষ দিক থেকেই কর্ম বিভাজন ক্রমে সামাজিক স্তর বিভাজন হয়ে উঠতে থাকল, জনগোষ্ঠী ও পরিবারগোষ্ঠী ক্রমশ সামাজিক শ্রেণিতে বিভাজিত হয়ে গেল, এমন অনুমানের সঙ্গত কারণ রয়েছে। অথর্ববেদের উনিশতম কাণ্ডের ৬ নং সূক্তের ৬ নং ঋক্‌টি সেই পুরুষসূক্ত, যা সম্ভবত পরে ঋগ্বেদে প্রক্ষিপ্ত হয়। অথর্ববেদের উনিশ সংখ্যক কাণ্ডেই আরো দু জায়গায় চতুর্বর্ণের উল্লেখ রয়েছে। ৩২ নং সূক্তের ৮ নং ঋক্‌-এ ঘাসের কাছে প্রার্থনা জানানো হয়েছে যে তিনি যেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, আর্য (বৈশ্য ?) ও শূদ্রদের কাছে প্রিয় করে তোলেন। যদি মনে রাখি যে অথর্ববেদের উনিশ ও বিশ কাণ্ড দুটি মূল অথর্ববেদে পরে প্রক্ষিপ্ত, তবে এটিকে বৈদিক সংহিতা যুগের শেষতম পর্বর, খ্রিস্টপূর্ব দশম থেকে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের মধ্যবর্তী সময়কালের রচনা বলে ধরে নেওয়া যায়।

অধ্যাপক রামশরণ শর্মা তাঁর ‘‘‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’’’ বইতে বিভিন্ন প্রমাণ সহযোগে অনুমান করেছেন সামাজিক শ্রেণি হিসেবে অথর্ববেদের আদি পর্বটিতেও শূদ্রদের উপস্থিতি ছিল না। যেমন অথর্ববেদের পঞ্চম কাণ্ডের ১৭ নং সূক্তের ৯ নং ঋক্‌-এ ব্রাহ্মণ, রাজন্য ও বৈশ্যের কথা আছে কিন্তু শূদ্রের উল্লেখ নেই।

১১

শূদ্র প্রসঙ্গে

শূদ্ররা কি আর্যভাষী সমাজের ভেতর থেকে উদ্ভূত না তারা এই সমাজের বাইরের কোনও গোষ্ঠী ? খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে শূদ্র নামে যে একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। দিওদেরাস লিখেছেন আলেকজান্ডার সোদ্রাই নামের এক জনগোষ্ঠীকে আক্রমণ করেছিলেন। মহাভারতেও আভীরদের সঙ্গে যুক্তভাবে শূদ্রদের এক জনগোষ্ঠী হিসেবে বারবার অভিহিত করা হয়েছে। এতে শূদ্রকুল ও শূদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যও করা হয়েছে। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের কুলের সঙ্গে শূদ্রকুলের উল্লেখ করা হয়েছে আবার আভীর, দরদ, তুখার, পল্লব এইসব জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি শূদ্র জনগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে। ভেবার তাঁর বইতে মনে করেছিলেন যে শূদ্ররা আর্যভাষীদেরই বেদবাহী তরঙ্গের আগেকার এক তরঙ্গ। পরবর্তীকালে এই মতটি পরিত্যক্ত হয়েছে। ফিক, কিথ, লাসেন প্রমুখের গবেষণা (দ্রষ্টব্য রামশরণ শর্মার ‘‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’’, পৃষ্ঠা – ৩৫) প্রমাণ করেছে শূদ্ররা প্রাক আর্য জনগোষ্ঠীরই এক শাখা। তবে শূদ্ররা প্রায় সর্বত্র আভীরীদের সঙ্গে একযোগে উল্লিখিত হয়েছেন, যে আভীরীরা একটি আর্য উপভাষাতে কথা বলতেন। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে আভীরোক্তির উল্লেখ আছে। ব্রাহ্মণের যুগের বিভিন্ন সাহিত্য থেকে অনুমান করা যায় শূদ্ররা আর্যদের ভাষা বুঝতে পারতেন। সম্ভবত ভারতে শূদ্ররা আসেন খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের শেষদিকে। পরবর্তীকালে বৈদিক আর্যভাষীদের কাছে তারা পরাজিত হয়ে বর্ণে বিভক্ত বৈদিক সমাজের নিম্নতম অংশ হিসেবে আর্যভাষী সমাজে অন্তর্ভুক্ত হন। (‘‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’’ – রামশরণ শর্মা, পৃষ্ঠা – ৩৭)

ডক্টর বি. আর. আম্বেদকর অবশ্য এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর মতে দীর্ঘকাল ধরে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সংঘাতের ফলে ক্ষত্রিয়দের অবনমিত করা হয় শূদ্রদের পর্যায়ে। এমনকি ব্রাহ্মণেরা তাঁদের প্রতিপক্ষদের উপনয়নের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেন। আম্বেদকর এক্ষেত্রে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থিত করেছেন মহাভারতের শান্তিপর্বে উল্লিখিত রাজা পৈজিবনের কাহিনী। সেখানে তাঁকে শূদ্ররাজা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে ভারত জনগোষ্ঠীর প্রধান সুদাসের সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে ঋগ্বেদে উল্লিখিত দশরাজার যুদ্ধের এই বিখ্যাত নায়ক ছিলেন শূদ্র। (দ্রষ্টব্য – আম্বেদকর – হু ওয়্যার দ্য শূদ্রস ?) রামশরণ শর্মা অবশ্য মনে করেছেন বিভিন্ন আর্য জনগোষ্ঠীর মতো সূর্য জনগোষ্ঠীর অনেকে সামরিক ভূমিকা পালন করতেন। মহাভারতে অম্বষ্ঠ, শিবি, সূরসেন ইত্যাদিদের সঙ্গে শূদ্র সেনাবাহিনীরও উল্লেখ আছে। (মহাভারত ৭/৬/৬) শূদ্ররা উৎসগতভাবে বৈদিক সমাজের ভেতরের মানুষই হোন বা বাইরের, রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই থেকেই যে ভারতীয় সমাজের ভেতরের বর্ণবাদের উদ্ভব ও তাদের নিম্নতম বর্ণে রূপান্তরিত হওয়া, সেকথা আমরা বলতে পারি।

ঋগ্বেদীয় সমাজে পরিচয়ভিত্তিক কোনও শূদ্র বর্গ ছিল না। এই সমাজ ছিল মুখ্যত পশুপালক ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক। বৈদিক সমাজের পুরোহিত ও সমরনায়কদের পক্ষে এ কারণেই নিজেদের সমাজের ভেতর থেকে এত বেশি সম্ভব উদ্বৃত্ত উৎপন্ন ও শ্রম আদায় সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না, যাতে কোনও অংশের অবস্থান্তর ঘটিয়ে দাসের পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়। অবৈদিক জনগোষ্ঠীদের থেকে যুদ্ধ ও লুন্ঠনের মধ্যে দিয়ে যা কিছু সম্পদ আদায় করা হতো, বৈদিক সমাজের জ্ঞাতিদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হতো। সমাজপতিরা যে অশ্ব, রথ এবং দাসদের অধিকারী হতেন, তা তাঁদের পদমর্যাদার সঙ্গে যুক্ত ছিল, সামাজিক শ্রেণির সঙ্গে নয়। পরবর্তী বৈদিক যুগে, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী পর্বে, পশুপালন থেকে যখন চাষবাসের ও আধা যাযাবর বৃত্তির জায়গায় স্থায়ী বসতি স্থাপনের পর্ব এল, তখনই বৈদিক সমাজের ভেতরে সামাজিক শ্রেণি ভিত্তিক বর্ণ ব্যবস্থার আবির্ভাব হল।

বেদোত্তর কালে শূদ্র জাতিকে মূলত সেবক হিসেবেই দেখা যায়। কিন্তু ঋগ্বেদ পরবর্তী বৈদিক যুগে শূদ্রেরা যে স্বাধীনভাবে গো-ধনের অধিকারী ছিলেন, তেমন অনেক উল্লেখ আছে। মৈত্রয়ণী সংহিতাতে বলা হয়েছে (৪/২/৭ ও ৪/২/১০) শূদ্রদের গবাদি পশু ছিল এবং উচ্চবর্ণের লোকেরা যজ্ঞের জন্য সেগুলো নিয়ে যেতে পারতেন। পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে শূদ্ররা কোনও দেবতা বা যজ্ঞ ছাড়াই জন্মেছেন, কিন্তু তাঁদের অনেক পশু সম্পত্তি আছে। (৬/১১/১১)। কিন্তু সম্পত্তি থাকলেও তাদের অধস্তন ভূমিকা ও অবমানিত অবস্থানটি বেশ স্পষ্ট। জৈমিনি ব্রাহ্মণে বলা হচ্ছে (১/৬৮) কোনওরকম দেবতা ছাড়াই শূদ্রদের উৎপত্তি হয়েছিল প্রজাপতির পা থেকে, তাই গৃহস্বামীই তাদের দেবতা ও তাঁর পা ধুয়েই তাঁদের জীবিকা অর্জন করতে হবে। শ্রৌতসূত্রে বলা হয়েছে (২৬/ ১ – ৭) উচ্চবর্ণের শুশ্রূষা করেই তাঁদের বাঁচতে হবে। জৈমিনি ব্রাহ্মণ আমাদের জানিয়েছে অশ্বমেধের মধ্যে দিয়ে বৈশ্যদের ধনী হয়ে ওঠার কথা।

শূদ্ররা প্রভুর জমিতে ভূমিদাস হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁরা প্রভুর খেতে কাজ করে দিতেন। তবে তার নিজের জন্যও একটুকরো জমি থাকত। যতদিন তিনি ভূস্বামীর জমিতে কাজ করে দিতেন, ততদিন তিনি সেই জমি রাখতে পারতেন। পরবর্তী বৈদিক যুগ পর্যন্ত করযোগ্য ছোট ভূমি সম্পত্তি শূদ্রদের ছিল কিন্তু বেদোত্তর কালে তারা করপ্রদান ও সম্পত্তির আওতার বাইরে চলে যান।

শূদ্রদের সেবক ভূমিকার পাশাপাশি বিভিন্ন সূত্র শূদ্রদের শ্রমজীবী শক্তি হিসেবেও উল্লেখ করেছে। বাজসনেয়ি সংহিতা (৩০/৬/২১) ও তৈত্তরীয় ব্রাহ্মণে (৩/৪/২/১৭) নানারকম বৃত্তির উল্লেখ আছে, যেমন – রথকার, সূত্রধর, কুম্ভকার, কর্মকার, মণিকার, পশুপালক, পশুচারক, শৌণ্ডিক, ধীবর ও ব্যাধ। কৃষিতে কাজের কথাও রয়েছে।  মনে করা হতো শূদ্ররা হলেন কঠোর শ্রমের প্রতিভূ। নিষাদ, কিরাত, পর্ণক, পৌল্কস, বৈন্দ ইত্যাদি অবৈদিক অনার্য মানবগোষ্ঠীর কথাও এই প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। বেদিক ইনডেক্স নামক বিখ্যাত আকরগ্রন্থ ইঙ্গিত করেছে যে শূদ্র গোত্রের মধ্যে এরাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। হস্তশিল্পের সংখ্যা পরবর্তী বৈদিক যুগে অনেক বাড়ে কিন্তু বৈদিক সমাজের বিশ্‌ এর সদস্যরা সেইসব শ্রমসাধ্য কাজ যে আর করতেন না, তেমন ইঙ্গিত এখানে রয়েছে। সেই কাজ শূদ্ররা করতেন।

১২

বর্ণের ‘বিশুদ্ধতা’ ও মিশ্রণ প্রসঙ্গে

বর্ণ ব্যবস্থা থেকে জীবিকানির্ভর হাজারো বিভাজনভিত্তিক জটিল ভারতীয় জাত ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ আরো পরের ঘটনা, যে জাত ব্যবস্থার কাঠামো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলভেদে আবার অনেকখানি স্থানীয় পরিচিতি ও চরিত্র লাভ করল। সেই সংক্রান্ত কথাবার্তা এক পৃথক পর্যালোচনা দাবি করে।

জিনভিত্তিক গবেষণার সাহায্যে সাম্প্রতিককালে ভারতে জাতের অন্তর্গত বিবাহ ও জাতের শুদ্ধতা রক্ষার সময়ক্রম সম্পর্কে কিছু বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মিলেছে। তা জানাচ্ছে কবে থেকে বিভিন্ন বর্ণগুলির মধ্যে সামাজিক সংমিশ্রণ বন্ধ হয়ে গেল। ২০১৩ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের বিশ্বখ্যাত জিনতত্ত্ববিদ ডেভিড রাইখের তত্ত্বাবধানে প্রিয়া মুরজানী, কুমারস্বামী থঙ্গরাজ সহ অনেক বিজ্ঞানী এক যৌথ গবেষণা করেন। লক্ষ্য ছিল দেশীয় বিভিন্ন জাতের উৎস সন্ধানে।

এই গবেষণায় উপমহাদেশের ৭৩টি (৭১ ভারতীয় ও ২টি পাকিস্তানী) জাতিগত ও ভাষাগত ভিন্ন গোষ্ঠীর ৫৭১ জন মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতির মানুষ, আদিবাসী মানুষ, আন্দামানের বিভিন্ন আদিবাসী মানুষকে এই পরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল।

এই গবেষণার লক্ষ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জাতি ও ভাষা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে মিশ্রণগুলির সময়কাল নির্ণয় করা। দেখা গেছে, এই ৭৩টি গোষ্ঠীর মিশ্রণের সময়কাল আজ থেকে ৪২০০ থেকে ১৯০০ বছরের মধ্যে হয়েছে। এমনকি ভিল, চামার ও কল্লারের মতো প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীও এই মিশ্রণ থেকে রেহাই পায়নি। এদের সকলের মধ্যে পাওয়া গেছে ইন্দো-ইউরোপীয় জিন। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে এই মিশ্রণটি এতটাই বিস্তৃত ছিল যে ভারতের প্রায় প্রতিটি গোষ্ঠীই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।

এই গবেষণা বলছে, আজ থেকে ৪,২০০ বছর আগে থেকে ১,৯০০ বছর আগে পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় পূর্ব পুরুষদের মধ্যে মিশ্রণ হয়েছে। কিন্তু তারপর এই মিশ্রণ আর সেভাবে দেখা যায় না। ১০০ সাধারণ অব্দর পর থেকে অন্তর্বিবাহ বা একই বর্ণের মধ্যে বিবাহ নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। মনুস্মৃতির রচনাকাল আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। মনুস্মৃতি আন্তর্বর্ণ বিবাহের পক্ষে জোরালো নিদান দিয়েছে। এই বৈজ্ঞানিক গবেষণাতেও দেখা যাচ্ছে এই সময় থেকেই বহির্বিবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মৌর্য শাসনের অবসানে শুঙ্গ শাসনের যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির ক্ষমতা দখলের সময়ের সঙ্গে এই সময়কাল মিলে যায়। অর্থাৎ তখন থেকে নিজের বর্ণের মধ্যে বিবাহ বাধ্যতামূলক হয়। কর্মভিত্তিক বর্ণপ্রথার উদ্ভব খ্রিস্টপূর্ব দশম থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে হয়ে থাকলেও বংশানুক্রমিক কঠোর বর্ণব্যবস্থা যে মৌর্যোত্তর যুগে গড়ে ওঠে তা বলাই যেতে পারে। মৌর্য সমাজ ব্যবস্থাটি শুঙ্গ যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ক্ষমতা দখলের মধ্যে দিয়ে ভেঙে যায় এবং কঠোর বর্ণব্যবস্থার জন্ম দেয়, এই অনুমানকে আধুনিক জিনভিত্তিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাও মান্যতা দিচ্ছে।

১৩

ঋগ্বৈদিক যুগের ধর্ম প্রসঙ্গে

ঋগ্বেদ মূলত একটি ধর্মগ্রন্থ। এবার সেই সংক্রান্ত আলোচনার দিকে আসা যাক।

বৈদিক ধর্মের স্বরূপ বোঝার জন্য প্রাক বৈদিক আদিবাসীদের ধর্ম বিশ্বাস এবং তার সঙ্গে বৈদিক ধর্মের পারস্পরিক লেনদেনের বিষয়টি বোঝা দরকার। আমরা সেটা দিয়েই শুরু করব।

প্রাক আর্য উপজাতিদের ধর্ম সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হল জগৎ ও জীবনের উৎস হিসেবে মাতৃকাদেবীর উপাসনা। মাটি, পাথর বা হাড়ের তৈরি যে সব প্রাচীন মাতৃকামূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলির গঠন দেখেই অনুমান করা যায় যে এগুলি মাতৃত্ব, গর্ভধারণ প্রভৃতির প্রতীক হিসেবে পূজিত হত। পরবর্তীকালে কৃষিজীবী সমাজে জীবনদায়িনী মাতা ও শস্যদায়িনী মাতা এক হয়ে গিয়েছিলেন। এ কারণেই স্ত্রীলিঙ্গ ও যোনি পূজা এবং কামাচারমূলক আচার অনুষ্ঠানের ব্যাপকতা আদিম কৃষিসমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল এবং আজও তান্ত্রিক যৌনাচারসমূহে সেগুলির নিদর্শন টিঁকে আছে।

উপজাতিদের বিভিন্ন দেবী পরবর্তীকালে বৈদিক ধর্মে গৃহীত হন। দেবীর বর্ণনাপ্রসঙ্গে হরিবংশে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে তিনি শবর, বর্বর ও পুলিন্দদের দ্বারা বিশেষভাবে আরাধ্যা। মহাভারতের দুর্গাস্তোত্রে দেবীকে বিন্ধ্যপর্বত নিবাসিনী বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি মদ, মাংস, পশুপ্রিয়া রূপে কল্পিত হয়েছেন। উপজাতীয় শিকারজীবী মানুষের ধ্যানধারণা এখানে দেবীর চরিত্র নির্ধারণে ছায়া ফেলেছে। দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গের নাম শাবরোৎসব বা শবরদের উৎসব, যা অনুষ্ঠিত হত বিজয়া দশমীর দিনে। জীমূতবাহনের কালবিবেক গ্রন্থে এই শাবরোৎসবের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। বাকপতির গৌড়বহো কাব্যের ২৮৫ থেকে ৩৪৭ নং শ্লোকে বিন্ধ্যবাসিনী দেবীকে কালী ও পার্বতীর সঙ্গে অভিন্ন ঘোষণা করে বলা হয়েছে, তিনি কোল ও শবরদের দ্বারা পূজিতা হন। যাকে সংস্কৃতকরণ বলা হয়, তা আসলে এক উভমুখী প্রক্রিয়া। প্রাক আর্য উপজাতির দেবীরা যেমন বৈদিক ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তেমনি উপজাতীয় দেবীরা আবার সংস্কৃত নাম ও পরিচয় পেয়েছেন। উপজাতিরা অনেক বৈদিক দেবীর উপাসনাও করে থাকেন।

উত্তরপ্রদেশের আহিরদের মাতৃদেবীর প্রেমিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন শিব। ওঁরাওদের ভূমি দেবী হয়েছেন ধর্মদেবের স্ত্রী। শিকারের দেবী হিসেবে তারা চণ্ডীর পূজা করে। আমাদের সুপরিচিত চণ্ডীমঙ্গলের কালকেতু ফুল্লরা আখ্যানের কথা আমরা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি। সিংভূম ও লোহারডাগার ভুঁইয়াদের ঠাকুরাণীরা বর্তমানে দুর্গা বা কালী নামে পরিচিতা। বেদিয়াদের মাতৃদেবী কালী, জ্বালামুখী নামে পূজিতা হন। আগারিয়াদের লোহাসুর দেবী কামারের চুল্লির অধিষ্ঠাত্রী। বিহার ও উত্তরপ্রদেশের শবরদের মধ্যে শীতলা মাই ও বনসূরী দেবী বেশ জনপ্রিয়। মুসাহারদের মধ্যে কালী ও বনস্পতির পূজা বহুল প্রচলিত। কালোয়াররা দুর্গা ও কালীর পূজা করে। মাল ও মাল পাহাড়িদের মধ্যে মনসার ব্যাপক প্রভাব আছে।

এইসকল উপজাতীয় ধর্মব্যবস্থায় দেবী প্রাধান্য থাকলেও পুরুষ দেবতার মধ্যে শিবের উপস্থিতি যথেষ্ট। অধিকাংশ দেবীর স্বামী রূপে শিবের নাম পাওয়া যায়।

বৈদিক ধর্মে হরপ্পা ও আদিবাসী সভ্যতার মাতৃদেবীর প্রভাব রয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার ঋগ্বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০) তা সেভাবে নেই। এই প্রভাব পাওয়া যাবে পরবর্তী বৈদিক যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ থেকে, ভারতে লোহা আবিষ্কার ব্যবহারের পর যার শুরু) সাম, যজুঃ ও অথর্ব বেদের সংহিতায় ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থাবলির মধ্যে। ঋগ্বেদে ইন্দ্রাণী, বরুণানী প্রভৃতি দেবীদের যে উল্লেখ পাওয়া যায়, তা নেহাতই সংশ্লিষ্ট দেবতাদের স্ত্রী লিঙ্গ, তাদের নিজস্ব স্বরূপের কোনও ছাপ সেখানে নেই।

ব্যতিক্রম হলেন ঊষা ও অদিতি। কিন্তু তাদের কল্পনার উৎস ভিন্নতর। তা প্রাক আর্য আদিবাসী সভ্যতা সংস্কৃতি থেকে আসেনি। পৃথিবীকেও ঋগ্বেদে দেবী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে, কিন্তু তিনি সেখানে কৃষি সভ্যতার ফলনের প্রতীক নন, আকাশের পত্নী রূপেই কেবল কল্পিতা।

ঋগ্বেদের যুগের একেবারে শেষ পর্যায় থেকে যখন পশুপালনের পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রসার হয়, তখন থেকে প্রাক বৈদিক মাতৃদেবী ও সংলগ্ন আচার অনুষ্ঠান বৈদিক সাহিত্যে প্রবেশ করতে শুরু করে।

ঋক পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মের খোঁজখবরের জন্য যেমন এদেশের অনার্য আদিবাসীদের ধর্ম বিশ্বাস বিষয়ে জানতে হয়, তেমনি ঋগ্বৈদিক যুগের ধর্মের সুলুক সন্ধানের জন্য দরকার ইরানীয় জেন্দ আবেস্তার সঙ্গে ঋগ্বেদের তুলনামূলক অধ্যয়ন।

ঋগ্বেদে আদিবাসীদের ধর্মবিশ্বাসের ছাপ এসে পড়েনি, ইন্দো ইরানীয়দের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারই কিছু অদল বদলের মধ্যে দিয়ে ধরা পড়েছে।

ঋগ্বেদের সমাজ ছিল ইন্দো ইরানীয় ও ভারতীয় আর্যভাষীদের পশুপালনমূলক অর্থনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ। পশুপালক অর্থনীতিতে পুরুষপ্রাধান্য থাকে, এর প্রভাব দেখা যায় ধর্মচেতনাতেও। ঋগ্বেদে তাই দেবীদের থেকে দেবতাদেরই প্রাধান্য।  ঋগ্বেদের দেবতারা মূলত তিন ভুবনের। দ্যুলোক বা স্বর্গের দেবতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মিত্র, পুষা, বিষ্ণু, ঊষা, আদিত্যগণ, অশ্বিনীদ্বয় ইত্যাদি। অন্তরীক্ষ বা আকাশের দেবতাদের মধ্যে ছিলেন ইন্দ্র, ত্রিত আপ্ত্য, মাতরিশ্বা, রুদ্র, মরুদগণ, বায়ু, পর্জন্য ইত্যাদি। ভূলোক বা পৃথিবীর দেবতাদের মধ্যে ছিলেন অগ্নি, পৃথিবী, সোম ইত্যাদি।

ঋগ্বেদের ধর্মের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল প্রাকৃতিক শক্তিগুলির ওপর মানবত্ব আরোপের প্রয়াস, যাকে ইংরাজিতে বলা হয় অ্যানাথ্রোপমরফিজম। যেমন ঊষা কল্পিত হয়েছেন একজন মোহময়ী যুবতী নারী হিসেবে, যিনি তাঁর প্রেমিকের কাছে নিজের বক্ষদেশ উন্মোচন করেন। অগ্নির দেহে পুরোহিতের পোশাক চাপানো হয়েছে এবং তাঁকে কল্পনা করা হয়েছে রক্তাভ কেশযুক্ত ব্রাহ্মণ হিসেবে।

অন্যান্য ইন্দো ইউরোপীয় সংস্কৃতির দেবতাদের সাথে ঋগ্বৈদিক দেবতাদের তুলনার বেশ কিছু জায়গা রয়েছে। দ্যুলোকের দেবতাদের মধ্যে দ্যৌঃ স্মরণ করিয়ে দেয় গ্রীক দেবতা জিউস এর কথা। সূর্যদেব মিত্র হিসেবে উল্লিখিত এবং প্রায় সর্বদা বরুণ দেবের সঙ্গে যুগ্মভাবে তিনি উল্লিখিত। এছাড়া সূর্য স্বনামেও ঋগ্বেদে দেবতা হিসেবে উল্লিখিত হয়েছেন। সবিতৃ, পুষণ এরাও হলেন ঋগ্বেদের সূর্যদেবতা। ইরানে এই মিত্র (মিথ্র হিসেবে উল্লিখিত) বা সূর্যদেবের মর্যাদা ছিল সবচেয়ে বেশি। আবেস্তায় তিনি দ্রুতগামী অশ্বের অধিকারী এবং অহুর মাজদার চোখ হিসেবে উল্লিখিত। ইরানীয় আবেস্তাতে বর্ষণের দেবতা, ঋতুসমূহের নিয়ন্ত্রক বরুণ হচ্ছেন দেবরাজ, তাঁর উপাধি অহুর মজদা।

ঋগ্বেদে বরুণের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন ইন্দ্র, তবে বরুণও বিশেষ গুরুত্বে উল্লিখিত হয়েছেন। ঋগ্বেদে আপঃ বা জলও দেবতা হিসেবে উল্লিখিত। আবেস্তায় আপো নামটি পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের সমগ্র নবম মণ্ডলটি সোমদেবের নামে উৎসর্গীকৃত। আবেস্তায় ইনি একজন অন্যতম প্রধান দেবতা। তিনি মৃতসঞ্জীবনী, অমৃতস্বরূপ, রোগের আরোগ্য করেন। তিনি মহৎ দ্রষ্টা, কবি। চিন্তা ও শ্লোক রচনার প্রেরণাদাতা।

ইরানীয় জেন্দ আবেস্তার অসুর নামটি আসিরীয় থেকে এসেছে। অন্যদিকে ভারতীয় বৈদিক ধর্ম দৈব নামে পরিচিত। পুরাণ কথিত দেবাসুরের সংগ্রাম আসলে দুটি দেশের প্রায় একই ধরনের ধর্মবিশ্বাসের জ্ঞাতিশত্রুতা। আর এও মনে রাখতে হয় যে পরবর্তীকালে অসুর শব্দটি ভারতে নিন্দাব্যঞ্জক হয়ে উঠলেও ঋগ্বেদের যুগে তা ছিল না।

ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে ধর্ম, অর্থ, কাম পেরিয়ে মোক্ষ অর্জনের পরম লক্ষ্যের কথা বারবার বলা হয়। কিন্তু ঋগ্বৈদিক সূক্তগুলিতে যে পার্থিব চাওয়া পাওয়াগুলিই মূলত ব্যক্ত হয়েছে, সে সম্পর্কে সংশয়ের তেমন কোনও অবকাশ নেই। আরো বেশি গবাদি পশু, শস্য, শস্য উত্পাদনের সহায়ক পরিবেশ বিভিন্ন সূক্তে বারবার চাওয়া হয়েছে সরাসরি, অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায়।

এই চাওয়া পাওয়াগুলি কেমন তা বোঝার জন্য ঋগ্বেদের চতুর্থ মণ্ডলের ৫৭ নং সূক্তের ঋকগুলির দিকে আমরা একবার চোখ রাখতে পারি –

১) আমাদের গবাদি পশু আর ঘোড়াদের পুষ্ট করুন। তিনি আমাদের মঙ্গল করুন।

২) গাভী আমাদের জন্য যেমন দুধ উৎপাদন করেন, তেমনি বিনামূল্যে আমাদের জন্য স্রোতধারা ঢেলে দিন। প্রভুগণ আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন।

৩) আমাদের জন্য এ লতাগুল্ম মধুময় হোক। স্বর্গ, জল এবং আকাশের মধ্যাঞ্চল আমাদের জন্য মধুরিমায় পূর্ণ হোক। ক্ষেতগুলি আমাদের জন্য পূর্ণ হয়ে উঠুক।

৪) আমাদের ষাঁড়েরা আনন্দের সঙ্গে কাজ করুক। লাঙল আনন্দে সীতার রেখা টেনে নিয়ে যাক।

৫) লাঙল আর কর্ষক এই প্রশস্তি তোমাদের জন্য। তোমরা আমাদের পৃথিবীকে স্বর্গে প্রস্তুত দুধের মতো সিক্ত কর।

৬) পবিত্র হলরেখা (সীতা) তোমাকে শ্রদ্ধা করি এবং পূজা করি। তুমি আমাদের আশীর্বাদ কর। সমৃদ্ধি দান কর এবং অপর্যাপ্ত ফলন দাও।

৭) (বৃষ্টির দেবতা) ইন্দ্র লাঙলের রেখাকে নীচে নামিয়ে আনবেন, সূর্যদেব একে সঠিক পথে পরিচালিত করবেন।

৮) লাঙলের ফলা কর্ষিত ক্ষেত্রকে উপড়ে ফেলুক। কৃষকেরা ষাঁড়েদের আনন্দে চালনা করুন। সুরা আর দুধে পরঞ্জয় (মেঘ বৃষ্টির দেবতা) আমাদের সুখী করুন। হল আর হলধর আমাদের সমৃদ্ধি দান করুন।

১৪

বেদের ভাষা প্রসঙ্গে

এবার আসা যাক ঋগ্বেদের ভাষা সংক্রান্ত আলোচনায়। বৈদিক ভাষার উৎস ইন্দো – ইউরোপীয় বা ইন্দো হিত্তীয় ভাষাবংশ। এই ভাষাবংশের মূল ভাষাটির কোনও লিখিত রূপ পাওয়া যায়নি, এটিকে ভাষাবিজ্ঞানীরা পরে পুনর্নির্মাণ করেছেন। ৩০০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২৫০০ খ্রিস্টপূর্ব অব্দ পর্যন্ত সময়কালটিকে ইন্দো-হিত্তীয় ভাষার কাল বলে গণ্য করা হয়। সেখান থেকে হিত্তীয় ও ইন্দো ইউরোপীয় শাখাদুটি আলাদা হয়ে গেল। আগে হিত্তীয়কে ইন্দো ইউরোপীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত করে ভাবা হত, এখন সেই ভাবনায় খানিক বদল এসেছে এবং মনে করা হচ্ছে ইন্দো হিত্তীয় নামক কোনও একটি প্রাচীনতম উৎস থেকে এ দুটি আলাদা হয়েছে। ২৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্ব অব্দ অবধি এই সময়কালটি ইন্দ-ইউরোপীয় ভাষার কাল। এরপর এই ভাষাবংশের মানুষেরা নানাদিকে ছড়িয়ে যায় ও গ্রীক, কেলটিক, ইতালিক, জার্মানিক, আর্মেনীয়, আলবেনীয়, বালতো স্লাবিক, তোখারীয়, ইন্দো ইরানীয় প্রভৃতি আলাদা আলাদা শাখার জন্ম হয়। ইন্দো ইরানীয় শাখাটি থেকে ইরানীয় ও ভারতীয় আর্য শাখার জন্ম হয়। ইন্দো ইরানীয় ভাষার সময়কালটি ২০০০ – ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এবং ইরানীয় ও ভারতীয় আর্যের প্রত্ন পর্যায়ের সময়কাল ১৭৫০ – ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলে মনে করা হয়। প্রত্ন পর্যায় পেরিয়ে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ভারতীয় আর্যের চেহারাটি ঋগ্বেদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে। কেউ কেউ মনে করেছেন ১২০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ভাষার বৈশিষ্ট্য ঋগ্বেদের বিভিন্ন স্তরের সংকলনগুলির মধ্যে ধরা আছে।

বেদের যে ভাষা তা কি সংস্কৃত ভাষা ? বেদের ভাষা অর্থাৎ বৈদিক ভাষা ও সংস্কৃত ভাষার মধ্যে মিল কী আর অমিলই বা কী?

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের যে পর্বটিকে আমরা সংস্কৃত সাহিত্য বলে জানি তাকে ভাষার ভিত্তিতে দুটি মূল ভাগে ভাগ করা জরুরী। পাণিনির সংস্কারের আগে প্রচলিত বৈদিক ভাষা এবং পাণিনি ও অন্যান্যদের দ্বারা তার লোকায়ত রূপটির সংস্কারের পর সংস্কৃত ভাষা। সংস্কৃত নামটি লেখালেখি ও আলোচনায় ব্যাপক পরিচিত হয়ে ওঠার জন্য পাণিনি প্রমুখদের দ্বারা ঘষামাজা করা ভাষাটিকে বৈদিক সংস্কৃতের (সঠিকভাবে বললে বৈদিকের) থেকে পৃথক করার জন্য বলা হয় ক্লাসিক্যাল সংস্কৃত। বৈদিক সংস্কৃত কথাটি অনেকেই ব্যবহার করেন। আসলে একে বলা উচিত বৈদিক বা প্রাচীন ভারতীয় আর্য। বৈদিক বা বৈদিক সংস্কৃত ও ক্লাসিক্যাল সংস্কৃত বেশ কাছাকাছি, তবে বেশ কিছু ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক পার্থক্য রয়েছে। এর কয়েকটি উল্লেখ করা যেতে পারে। বিস্তারিত আলোচনা ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রভূক্ত।

১) বৈদিক ভাষার মূল অবলম্বন ছিল প্রাচীন ভারতীয় আর্যের উত্তর পশ্চিমী শাখাটি। কারণ বেদ রচনাপর্বে আর্যদের মূল অংশটি সেই অঞ্চলেই থাকতেন। পরবর্তীকালে আর্যরা আরো পূর্ব ও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়েন। পাণিনির সংস্কারকালে মধ্যভারত হয়ে উঠেছে ভারতের রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। পাণিনি নিজে পশ্চিম ভারতের লোক হলেও সংস্কৃত ভাষার বিধি রচনার সময় তার মধ্যদেশীয় ডায়ালেক্টটিকেই মূলত অবলম্বন করেছিলেন। তবে তার সাথে সাথে উত্তর পশ্চিমা ডায়ালেক্টের অল্পস্বল্প প্রভাব রয়েছে।

২) বৈদিক ভাষার অনেক ধ্বনি আর সংস্কৃতে পাওয়া যায় না। যেমন ৯, কেবল ব্যতিক্রম ক৯প্‌।

৩) বৈদিক ভাষায় মূর্ধন্য ধ্বনির ব্যবহার বেশ কম ছিল, ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে তার ব্যবহার খুবই বেশি।

৪) বৈদিক ভাষায় স্বরাঘাতের প্রভাব ছিল অনেক বেশি এবং স্বরাঘাতের স্থান বদলের সাথে সাথে অর্থও বদলে যেত। কিন্তু ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে এই বৈশিষ্ট্য নেই।

৫) বৈদিকে সন্ধি অপরিহার্য ছিল না। যেমন – মনীষা অগ্নি এই প্রয়োগ ছিল। ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে সন্ধি প্রায় বাধ্যতামূলক। মনীষাগ্নি ছাড়া অন্য প্রয়োগ দেখা যাবে না।

৬) শব্দরূপ বৈদিকে অনেক বেশি ছিল। ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে তা অনেক কমে এসেছে।

৭) বৈদিক ভাষায় সমাসের জটিল রূপ তেমন ছিল না। তিনটির বেশি পদের সমাস তেমন দেখা যেত না। ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে বহু পদ মিলে সমাসের এক অত্যন্ত জটিল রূপ প্রায়শই দেখা যায়, যার উদাহরণ পাওয়া যাবে বাণভট্টের কাদম্বরীতে।

৮) বৈদিকে মোট আটটি কারক ছিল, সম্বন্ধ পদ ও সম্বোধন পদ সমেত। কিন্তু ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে ক্রিয়ান্বয়ী কারকম এই সূত্র মেনে এই দুটিকে কারক বলে ধরা হয়নি।

৯) বৈদিকে প্রাক আর্য ভাষার শব্দ ও ধাতু তেমন দেখা যায় না। ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে বিভিন্ন প্রাক আর্য ভাষার ধাতু ও শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

১০) বৈদিকে ক্রিয়ার কাল পাঁচটি। লট (বর্তমান বোঝতে), লৃট্‌ (ভবিষ্যৎ বোঝাতে), লঙ (অসম্পন্ন অতীত বোঝাতে), লিট (সম্পন্ন অতীত বোঝাতে) এবং লুঙ্‌(সদ্য সমাপ্ত অতীত বোঝাতে)। তার মধ্যে শেষ তিনটি ছিল অতীত কালের জন্য। ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে ক্রিয়ার কালের ব্যবহার বেড়েছে এবং তা সূক্ষ্মতর হয়েছে। অতীতে লঙ, লিট এবং লুঙ্‌ এর ব্যবহার ছাড়াও লৃঙ্‌ (সম্ভাব্য অতীত বোঝাতে) ও লুট্‌ (বহুভাষিত ভবিষ্যৎ বোঝাতে) ব্যবহৃত হত।

১৫

বৈদিক সাহিত্য প্রসঙ্গে

প্রত্ন ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের (এই ভাষাটিকে বিভিন্ন সূত্রের সাহায্যে পুর্নিনির্মাণ করা হয়েছে, কিন্তু এর কোনও দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় নি) বাসস্থান ছিল রাশিয়ার উরাল অঞ্চল ও ইউক্রেনের মাঝামাঝি এলাকায়। এখান থেকে খ্রিস্টজন্মের প্রায় চার হাজার বছর আগে একটি দল রওনা দেয় দানিয়ুব অঞ্চলের দিকে। সেখান থেকে আনাতোলিয়া – তুরস্ক হয়ে তারা আসে ইরানে। ইরান থেকে আফগানিস্থান হয়ে খাইবার পাস হয়ে তাদের প্রথম দলটি ভারতে প্রবেশ করে খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার অব্দ নাগাদ। ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর বিভিন্ন দল প্রায় হাজার বছর সময়কাল ধরে একের পর এক ভারতে ঢুকতে থাকে।

প্রথম যে দলটি ভারতে আসে তারা প্রাক আর্যদের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে মিশে যায়। ইরানে থাকার সময় তারা কাসাইটদের সাথে সহাবস্থান করেছিল এবং তাদের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এরা খাইবার পাস দিয়ে ভারতে ঢোকে এবং কাবুল অঞ্চলে থাকতে শুরু করে। এর পর আরেকটি দল হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে বালখ উপত্যকায় প্রবেশ করে। পরবর্তী দলটি খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ অব্দ নাগাদ ভারতে প্রবেশ করে। ইরানে থাকার সময় এদের সাথে ইরানীয়দের প্রবল মতান্তর হয় এবং তারা দক্ষিণ পূর্ব দিকে সরতে সরতে ভারতে আসে। ঋগ্বেদ এদেরই রচনা।

প্রাক আর্য সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা বস্তুগত সংস্কৃতিতে হয়ত বৈদিক আর্যদের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিলেন, কিন্তু বেদের মতো কোনও সাহিত্য কীর্তি তাঁরা রচনা করে যান নি। অন্তত তার কোনও প্রমাণ আমাদের কাছে নেই।

খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ পর্যন্ত সময়ের যে সাহিত্য তাকে আমরা বলতে পারি বৈদিক সংস্কৃত বা শুদ্ধ বিচারে বৈদিক আর্য পর্বের ভারতীয় সাহিত্য। আর তার পরের যে সাহিত্য তাকে আমরা বলতে পারি ক্লাসিক্যাল সংস্কৃত পর্যায়ের লেখালেখি। কালের দিক থেকে পালি সাহিত্য ও প্রাকৃত সাহিত্য এবং ক্লাসিকাল সংস্কৃত সাহিত্য সমসাময়িক। এই সময় থেকেই আবার দক্ষিণ ভারতে প্রাচীন তামিল সাহিত্য তথা সঙ্গম সাহিত্য আমরা পেতে শুরু করি।

এই যে বৈদিক সাহিত্যর কথা আমরা বলি, কি কি তার উপাদান ? কবে লেখা হয়েছিল সেগুলি ?

বেদ বা বৈদিক সাহিত্যের চারটি পর্যায় রয়েছে। আমরা বেদ বলতে যে চারটি বেদকে সাধারণভাবে বুঝে থাকি, সেটা হল বৈদিক সাহিত্যের প্রথম পর্যায়। তার নাম সংহিতা। বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীনতম অংশ হল সংহিতা। ঋক, সাম ও যজুঃ বেদ সংহিতাই প্রথমে প্রচলিত ছিল। পরে অথর্ববেদও সংহিতা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে সংহিতাগুলির মূল অংশ রচিত হয়। ঋগ্বেদের দশটি মণ্ডল আছে। দ্বিতীয় মণ্ডল থেকে সপ্তম মণ্ডল এর মধ্যে প্রাচীনতম। ঋগ্বেদের এই প্রাচীন অংশটি ১৫০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ও অন্যান্য অংশ ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত হয়ে থাকবে। ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সামবেদের চূড়ান্ত সংকলন, কৃষ্ণ যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ রচিত হয়ে যায় এবং ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে শুক্ল যজুর্বেদ এবং রচিত হয় বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন।

সংহিতা সাহিত্যের পরবর্তী অংশ হল ব্রাহ্মণ সাহিত্য। ঋগ্বেদের সঙ্গে অন্বিত ব্রাহ্মণ দুটি হল – ১) ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও (২)সাংখ্যায়ন ব্রাহ্মণ। যজুর্বেদের দুটি ভাগ। কৃষ্ণ যজুর্বেদ ও শুক্ল যজুর্বেদ। কৃষ্ণ যজুর্বেদের সাথে সংশ্লিষ্ট ৩) তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ এবং শুক্ল যজুর্বেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৪) শতপথ ব্রাহ্মণ। সামবেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হল ৫) তাণ্ড্য বা পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ ৬) তবলাকার বা জৈমিনীয় বা ষড়বিংশ ব্রাহ্মণ। অথর্ববেদের ব্রাহ্মণ হল ৭) গোপথ ব্রাহ্মণ। খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ থেকে ৮০০-র মধ্যে প্রাচীন ব্রাহ্মণগুলি এবং ৮০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে নবীন ব্রাহ্মণগুলি রচিত হয়।

ব্রাহ্মণ সাহিত্যের পরবর্তী পর্যায়ের বৈদিক সাহিত্য হল আরণ্যক সাহিত্য। প্রধান চারটি আরণ্যক হল ১) ঐতরেয় আরণ্যক ২) সাংখ্যায়ন আরণ্যক ৩) তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৪) বৃহদারণ্যক আরণ্যক।

আরণ্যকের পরবর্তী পর্যায় হল উপনিষদ। বৈদিক সাহিত্যের এই অংশটির সাথেই আমাদের পরিচয় সবচেয়ে বেশি। এগুলির মধ্যে আছে ঋগ্বেদের সঙ্গে অন্বিত ১) ঐতরেয় ২) কৌষিতকি। সামবেদের সঙ্গে অন্বিত ৩) ছান্দোগ্য ৪) কেন। কৃষ্ণ যজুর্বেদের সঙ্গে অন্বিত ৫) তৈত্তিরীয় ৬) কঠ ৭) নাগামৈত্রায়ণীয় ৮) শ্বেতাশ্বতর। শুক্ল যজুর্বেদের সঙ্গে অন্বিত ৯) বৃহদারণ্যক ১০) ঈশা। অথর্ববেদের সঙ্গে অন্বিত ১১) প্রশ্ন ১২) মণ্ডুক ১৩) মাণ্ডূক্য উপনিষদ।

খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ থেকে ৭০০-র মধ্যে আরণ্যক ও প্রাচীন উপনিষদগুলি এবং ৭০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে নবীন উপনিষদগুলি রচিত হয়।

বেদ কর্ম ও জ্ঞানকাণ্ডের আকর। ব্রাহ্মণ মূলত কর্মকাণ্ডের আলোচনা। উপনিষদ মূলত জ্ঞানকাণ্ডের আলোচনা। আরণ্যক কর্মকাণ্ড থেকে জ্ঞানকাণ্ডের দিকে যাত্রাপথ।

বেদাঙ্গ, পুরাণ, তন্ত্র এগুলি কী? বেদ এর সাথে এগুলির সম্পর্কই বা কী ?

বৈদিক সাহিত্যকে বিভিন্ন দিক থেকে আলোচনার আকর বেদাঙ্গ সাহিত্য। বেদ পঠন পাঠনের অঙ্গ বেদাঙ্গর ছটি শাখা। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ এবং জ্যোতিষ।

শিক্ষা বৈদিক সাহিত্যের উচ্চারণ নিয়ে আলোচনা করে। এটি আজকের ভাষাতত্ত্বের শাখা ধ্বনিতত্ত্ব বা ফোনেটিকস এর মতো।

কল্প আলোচনা করে যাগযজ্ঞপ্রণালী ও জীবন যাপনের বর্ণনা নিয়ে। তিন ধরনের কল্পসূত্র আছে। ১) শ্রৌত সূত্র ২) গৃহ্যসূত্র ৩) ধর্মসূত্র।

ব্যাকরণ আলোচনা করে বেদের ভাষা নিয়ে। পাণিনির গ্রন্থে প্রাচীন বৈয়াকরণদের সম্পর্কে আলোচনা আছে। পৃথিবীর মধ্যে ভারতেই ব্যাকরণ চর্চা প্রথম শুরু হয় বেদের ভাষাকে কেন্দ্র করে এবং তা সর্বোচ্চ মানে পৌঁছয় পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’তে। পাণিনির পরে কাত্যায়ন, ভর্তিহরি সহ অনেকেই ব্যাকরণ চর্চায় বিশিষ্ট অবদান রাখেন। ভারতীয় ব্যাকরণ চর্চার ইতিহাস নিয়ে পরে স্বতন্ত্র বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে রইলো।

নিরুক্ত আলোচনা ও বিশ্লেষণ করে বৈদিক শব্দের অর্থ নিয়ে। প্রাচীনতম বৈদিক শব্দকোষ হল নিঘন্টু। এই নিঘন্টুর ভাষ্য লেখেন যাষ্ক। একেই বিশ্বের প্রথম অভিধান হিসেবে অনেকে গণ্য করতে চান।

ছন্দ আলোচনা করেছে বৈদিক সাহিত্যের ছন্দ নিয়ে। বৈদিক সাহিত্যের প্রধান সাতটি ছন্দ হল গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুভ, বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুভ, জগতী। জ্যোতিষে রয়েছে বছর, মাস, দিন সহ সময়ের বিভাগ ও গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান নিয়ে আলোচনা। আজকের জ্যোতিষশাস্ত্রের পাথর তাবিজ কবজের সাথে বেদাঙ্গর জ্যোতিষকে মিলিয়ে না ফেলাই ভালো।

বৈদিক দর্শনের ছটি ধারা। সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা বা বেদান্ত। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যেই এই ধারাগুলি পাশাপাশি বিকশিত হয়েছিল। এর পর জৈন, বৌদ্ধর মত অবৈদিক দর্শনের ধারাগুলি জনপ্রিয় হয়। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন জৈন বা বৌদ্ধ দর্শনের আগেই বিকশিত হয়ে থাকবে, যদিও তার কোনও পূর্ণাঙ্গ টেক্সট একালের হাতে এসে পৌঁছয়নি।

বৈদিক সাহিত্য ও ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যর (যার প্রথম উল্লেখযোগ্য রচনা প্রথম শতাব্দীতে লেখা অশ্বঘোষ এর বুদ্ধচরিত) মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মহাকাব্যের যুগ। এই যুগেই রচিত হয়েছিল রামায়ণ ও মহাভারত। সাল তারিখ সংক্রান্ত বিতর্ক মাথায় রেখেও বলা যায় সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় দশকের মধ্যে মহাকাব্য দু’টি কয়েকটি স্তরে নির্মিত হয়। তবে যে ঘটনাকালের কথা আছে তা নিঃসন্দেহে এর বেশ কয়েক শতাব্দী আগের।

বৈদিক সাহিত্যের কাল শেষ হবার প্রায় হাজার বছর পরে গুপ্তযুগে বেশীরভাগ পুরাণগুলি রচিত হয়েছিল। তবে কোনও কোনও পুরাণ খ্রিস্টপূর্ব কালেও রচিত হয় বলে অনেকে মনে করেন। প্রধান আঠারোটি পুরাণের মধ্যে আছে ১) ব্রহ্ম ২) পদ্ম ৩) বিষ্ণু ৪) শিব ৫) ভাগবত ৬) নারদীয় ৭) মার্কণ্ডেয় ৮) অগ্নি ৯) ভবিষ্য ১০) ব্রহ্মবৈবর্ত ১১) লিঙ্গ ১২) বরাহ ১৩) স্কন্দ ১৪) বামন ১৫) কুর্ম ১৬) মৎস ১৭) গরুড় ১৮) ব্রহ্মাণ্ড। যে সমস্ত পুরাণ বিষ্ণুকে মহিমান্বিত করে সেগুলিকে সাত্ত্বিক পুরাণ, যেগুলি ব্রহ্মাকে মহিমাণ্বিত করে সেগুলিকে রাজস পুরাণ, যেগুলি শিবকে মহিমাণ্বিত করে সেগুলিকে তামস পুরাণ বলে।

গুপ্তযুগের শেষ দিক বা পঞ্চম শতাব্দী থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মসাহিত্যগুলি আত্মপ্রকাশ করতে আরম্ভ করে। সাধারণভাবে এগুলি তন্ত্রসাহিত্য নামে পরিচিত। তবে সুনির্দিষ্টভাবে শাক্তদের ধর্মসাহিত্যকেই বলা হয় তন্ত্র। শৈবদের ধর্মসাহিত্য আগম ও নিগম নামে এবং বৈষ্ণবদের ধর্মসাহিত্য সংহিতা নামে পরিচিত।

আকর –

১) ঋগ্বেদ – অনুবাদ ও টীকা রমেশচন্দ্র দত্ত – হরফ প্রকাশনী

২) ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ) 

৩) ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস – সুকুমারী ভট্টাচার্য (ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়াইন)

৪) সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস – গৌরীনাথ শাস্ত্রী (সারস্বত লাইব্রেরী)

৫) সংস্কৃত ভাষাতত্ত্ব – সত্যরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার)

৬) সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ – পরেশচন্দ্র মজুমদার (দে’জ)

৭) ভারতীয় আর্য সাহিত্যের ইতিহাস – সুকুমার সেন (দে’জ)

৮) ভারত ইতিহাস চর্চার ভূমিকা – ডি ডি কোশাম্বি (ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়াইন)

৯) ভারতবর্ষের ইতিহাস – রোমিলা থাপার (ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়াইন)

১০) ভারতের প্রাচীন অতীত – রামশরণ শর্মা (ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়াইন)

১১) প্রাচীন ভারতে শূদ্র – রামশরণ শর্মা (ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়াইন)

১২) প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথা – দেবরাজ চানানা (ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়াইন)

১৩) প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস – রামশরণ শর্মা (ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়াইন)

১৪) প্রাচীন ভারতে বস্তুগত সংস্কৃতি ও সমাজ গঠন – রামশরণ শর্মা (ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়াইন)

১৫) ভারত ইতিহাসের আদিপর্ব – রণবীর চক্রবর্তী (ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়াইন)

১৬) প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে – রণবীর চক্রবর্তী (আনন্দ পাবলিশার্স)

১৭) বৈদিক যুগ – ইরফান হাবিব ও বিজয়কুমার ঠাকুর (ন্যাশানাল বুক এজেন্সি)

১৮) ধর্ম ও সংস্কৃতি – প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট – নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (আনন্দ পাবলিশার্স)

১৯) প্রাচীন ভারতীয় সমাজ – নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ)

২০) ইতিহাস নির্মাণ ও আর্য সমস্যা – সমীর কর্মকার ও সুনন্দনকুমার সেন (আনন্দ পাবলিশার্স)

মন্তব্য তালিকা - “ঋগ্বেদের সময়কার ভারত”

  1. অসাধারণ সুন্দর একটি প্রবন্ধ। সমগ্র বৈদিক সংস্কৃতি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলির একটি সম্পূর্ণ চিত্র ফুটে উঠেছে। সংগ্রহে রাখার মতো একটি প্রবন্ধ।

  2. এটি খুব সুন্দর করে লেখা,জেতা আমাদের মত নভিস দের কাছে খুব মূল্যবান। অনেক কিছু খজার দরকার হয়েনা। তবে এই আলোচনার শেষ হবেনা। কারণ অনেক নতুন তথ্ব বারিয়ে আসছে।

  3. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সমৃদ্ধ আলোচনা । কয়েকটি প্রশ্ন আছে । নর্ডিক আর্যদের আগে যে সব জন গোষ্ঠী ভারত উপমহাদেশে এসেছিল তাদের মধ্যে নেগ্রিটোদের কথা বাদ দিলেও দ্রাবিড়রা ছাড়াও আদি অস্ট্রাল (প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে এরাই কি ‘নিষাদ’ জাতি নামে সম্বোধিত?), আলপিয়ান আর্য ( বৈদিক সাহিত্যে যাদের ‘অসুর’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে), মঙ্গলয়েডদের (বেদে যাদের ‘কিরাত’ নামে বর্ণনা করা হয়েছে) আগমনকে কীভাবে দেখা হবে ? আলবেরুণীর মতে চতুর্বেদের মধ্যে প্রাচীনতম ঋগ্বেদ সহ বাকিগুলির লেখ্য রূপ প্রথম লিখিত রূপ পাওয়ার সময় খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী । এর আগেকার শ্রুতি ও স্মৃতি লিখিত রূপে আসার পর্যায়ে লেখক বা লেখকগনের আরোপণের বা প্রক্ষেপণের সম্ভাবনাকে কী ভাবে দেখা হবে ? ভাষার সুত্র সন্ধানের পথ ধরে গেলে এই সব জনজাতিগুলির সমাজচিত্রের একটি অস্পষ্ট ছবি নিশ্চয়ই পাওয়া যায় । বর্তমান লেখক ভারতীয় ইতিহাস ও ভাষাবিদদের যে আকর গ্রন্থগুলি নির্ভর করেছেন তা খুবই যুক্তিযুক্ত হয়েছে । এর আলোচনা এক বিশাল পরিধি ও গভীরতায় প্রবেশের অবকাশ রাখে । সুকুমার সেন সংস্কার পূর্ব বৈদিক ভাষাকে ছান্দস নামকরণ করেছিলেন । পাণিনি কর্তৃক সংস্কার থেকেই সংস্কৃত । ইরফান হাবিবের লেখাতেই ঋক বেদের কাল নির্ধারণে লোহার ব্যবহারের অনুপস্থিতিকে গ্রহণ করা হয়েছে । বৈদিক ও পুরাণ যুগে নারীদের অবস্থান নিয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্যের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা আমাদের সমৃদ্ধ করে । বর্তমান লেখককে ধন্যবাদ ঋকবেদের ( যা থেকে ঐতিহাসিক উপাদান সংশ্লেষ করা গভীর পড়াশোনা ও শ্রমসাধ্য কাজ) মত একটি গ্রন্থ যা এমন একটি প্রাক-সংস্কার বৈদিক সাহিত্য – যাতে কোন নির্দিষ্ট আখ্যান পাওয়া দুরূহ – যা থেকে অস্পষ্ট হলেও ভারতীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্ব পূর্ণ পর্বকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন । এটি আরও চর্চার অবকাশ সৃষ্টি করেছে ।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।