সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

শতাব্দী পেরিয়ে টানা ভকতদের কথা

শতাব্দী পেরিয়ে টানা ভকতদের কথা

শান্তনু দত্ত চৌধুরী

নভেম্বর ৭, ২০২১ ৬৮৩ 7

রাজ্যের রাজধানী রাঁচির কাছেই গুমলা। পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা এই অঞ্চল আদিবাসীদের বাসভূমি। আদিবাসীদের মধ্যে ওঁরাও সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এই অঞ্চলের ‘চিংড়ি নাভাটোলি’ গ্রাম থেকে ওঁরাও সম্প্রদায়ের মধ্যে এক নব জাগরণ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। গ্রামের পঁচিশ বছরের তরতাজা যুবক ‘যাত্রা ওঁরাও’ ছিলেন এই জাগরণের হোতা। ১৯১৪ সালে যাত্রা ওঁরাও ঘোষণা করেন, তাঁদের দেবতা ‘ধর্মেশ’- এর কাছ থেকে তিনি ‘ওঁরাও’ রাজ প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ পেয়েছেন। যাত্রা বলেন ওঁরাওদের ধর্মের কলুষতা থেকে মুক্ত করতে হবে। মদ্যপান, পশুবলি, ভূত বা আত্মায় বিশ্বাস, অপদেবতা সন্দেহে নিধন বন্ধ। যাত্রা কৃচ্ছতাসাধন, নিরামিষ ভক্ষণ ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের জন‍্য আহবান জানান। এই আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। আর এই আন্দোলনের সঙ্গে অচিরেই যুক্ত হল জীবন ও জীবিকার প্রশ্নগুলি।

যাত্রা প্রশ্ন তুললেন ছোটনাগপুরের রাজার নিয়োগ করা জমিদার ও তালুকদারের তাঁরা কেন খাজনা দেবেন? হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান ব্যবসায়ী যারা আদিবাসীদের প্রতিনিয়ত প্রতারিত ও শোষণ করছে তাদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। ইংরেজ সরকার তথা রাষ্ট্রের খাজনা আদায়ের অধিকারকেও যাত্রা চ্যালেঞ্জ জানালেন। ওঁরাওরা ঘোষণা করলেন তারা আর জমিদারদের জমি চাষ করবেন না। অচিরেই এই আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী  আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। এই রূপান্তর কিছুটা মিশনারিদের বিরুদ্ধেও গেল। ওঁরাওরা তাঁদের চিরাচরিত পুরোহিত ও গ্রাম মোড়লদের কর্তৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলতে থাকে।

প্রকৃত শিক্ষা স্বর্গবাসী সেই মহান দেবতার কাছ থেকে আসে, তাই শিশুদের, যারা স্কুলে যেত তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। মিশনারিদের অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে গেল।

ছোটনাগপুর ও সাঁওতাল পরগনার বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী ব্রিটিশ শাসনে নিজেদের বঞ্চিত ও প্রতারিত বলে মনে করতো। এই আন্দোলনের কয়েক বছর আগেই বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ওই অঞ্চলেই মুন্ডাদের অভ্যুত্থান ঘটে গিয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়েই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কৃষক ও আদিবাসী সমাজের অসংখ্য বিদ্রোহ ঘটে। ছোটনাগপুর সংলগ্ন সাঁওতাল পরগনা ও দামিন-ই-কোহ এলাকায় (রাজমহল পাহাড়ের কোলে) ১৮৫৬ সালে সিধো ও কানহোর নেতৃত্বে ঘটে গিয়েছিল বিশাল সাঁওতাল বিদ্রোহ। এরকম সামাজিক পরিস্থিতিতেই ওঁরাও সম্প্রদায়ের মধ্যে এই জাগরণ আন্দোলন শুরু হয়। চড়া হারে খাজনা, অত্যল্প মজুরিতে ভূস্বামী ও মহাজনদের কাজে খাটতে বাধ্য হওয়া, নানা রকম কায়িক শ্ৰমের কাজে বাধ্যতামূলক নিয়োগ এইসব নিপীড়ন চলছিল। ওঁরাওদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়তেই থাকে। সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রারম্ভে যেমন হয়েছিল ঠিক তেমনই ওঁরাওরা বহিরাগত জমির মালিককে খাজনা দেওয়া বন্ধ করল। কোনও আইনসঙ্গত পথেই এই ভূমিপুত্ররা তাঁদের ক্ষোভ ও অভিযোগের সমাধান খুঁজে পায়নি। তাঁদের মধ্যে এই মনোভাব গড়ে উঠল যে বিদেশি সাহেব শাসকরা কোনও ভাবেই তাঁদের সুশাসন দিতে পারবে না। সামন্ত শাসকরা তাঁদের শোষণ চালিয়েই যাবে। বিকল্প পথের সন্ধানে বিরাট সংখ‍্যক ওঁরাও যাত্রার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। রাঁচি, পালামৌ, হাজারীবাগ, রামগড় সর্বত্র ওঁরাওদের মধ্যে একত্রিত হওয়ার বার্তা পৌঁছয়। অন্যান্য কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষও ওঁরাওদের সঙ্গে যোগ দেয় কেননা তাঁদের সমস্যার চরিত্রও ছিল একইরকম। 

এই বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী মনে করতে শুরু করল সামনের নভেম্বর মাসে (১৯১৪ সাল) সমস্ত বিরোধী শক্তিকে পর্যুদস্ত করে নতুন যুগ আসবে। যুবকের দল এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য পবিত্র ‘টানা মন্ত্র’ উচ্চারণ করতে করতে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। গুজব রটল তাঁদের পরিত্রাতা রূপে ‘জার্মান বাবা’র অবির্ভাব হবে। তিনি সকল অবিশ্বাসীকে আকাশ থেকে আক্রমণ করে ধ্বংস করবেন। ইংরেজের সঙ্গে জার্মানদের লড়াইয়ে জার্মান জিতবে এবং তখন তারা এই দেশে আসবে। ওঁরাও রাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। জমিদার, মহাজন ও তাদের লোকজন আক্রান্ত হতে থাকলো। তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ওঁরাওরা গ্রামে গ্রামে নিজেদের মধ্যে সভা করতে শুরু করে। তাঁরা নিজেদের বাঁধা গান গাইতে শুরু করে।

‘টানা’ মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে তাঁরা ‘ভকত’ হল। ওঁরাওদের এই যৌথ আন্দোলন গুরু বা জ্ঞানী ব্যক্তির শিক্ষায় পরিচালিত হয়। প্রকৃত ধর্ম কী, এই শিক্ষা এল জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকে। ওঁরাওদের প্রধান দেবতা ‘ধর্মেশ বাবা’ বা ভগবান বাবা। পরে হিন্দু ধর্মের অনেক বাবা এসে এই তালিকায় যুক্ত হল। যথা ইন্দ্র বাবা, সুরজ বাবা, ব্রম্ভা বাবা প্রভৃতি। পরে এই তালিকায় যুক্ত হলেন ‘জার্মান বাবা’। আওয়াজ উঠল ‘আংরেজ কী ক্ষয়, জার্মান কী জয়’।

যাত্রা ওঁরাও ১৯১৪ সালের ২৩ এপ্রিল তাঁর কিছু অনুগামীর সঙ্গে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আদিবাসীদের মহাজন, জমিদার ও সরকারের জন্য কাজ না করতে প্ররোচিত করছেন। এর ফলে শান্তিভঙ্গ হচ্ছে। বিচারে তাঁদের কারাবাস হয়। ১১৯১৫ সালের জুন মাসে যাত্রা ওঁরাও জেল থেকে মুক্তি পান। দিন এগোতে লাগল।

গান্ধিজি ততদিনে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে এসেছেন। চম্পারণে বাধ্যতামূলক ভাবে নীলচাষ করানোর ‘তিনকাঠিয়া’ প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন সফল হয়েছে। অসহযোগ আন্দোলনের  প্রস্তুতি চলছে। এই খবর ছোটনাগপুরের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছে যায়। কীভাবে পৌঁছলো?

”গানহী বাবা কে? গানহী বাবা?’ বড়া গুণী আদমী। বৌকা বাওয়া আর রেবণগুণীর চাইতেও ‘নামী।’ সিরিদাস বাওয়ার চাইতেও বড়, নাহলে কী মাস্টার সাব চেলা হয়েছে। গানহী বাওয়া মাস – মছলী, নেশা – ভাঙ থেকে ‘পরহেজ’। সাদি বিয়া করেনি। নাঙ্গা থাকে বিলকুল।” (‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’- সতীনাথ ভাদুড়ী)

যাত্রা ওঁরাও গান্ধিজির ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা ‘টানা ভকত ‘ আন্দোলন বলে পরিচিত হল। যাত্রার পরে এই আন্দোলনে গুরুর ভূমিকায় আসেন এক নেত্রী। তাঁর নাম লিথো ওঁরাও। তিনিও কারারুদ্ধ হন। খুবই প্রণিধানযোগ্য, এই কারণে যে শতবর্ষ আগে একটি সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বে একজন নারীকে গ্রহণ করা হয়েছিল। এর পরে নেতৃত্ব দেন মঙ্গার ওঁরাও। তাঁরও একই পরিণতি হল। কিন্তু ‘টানা ভকত’ আন্দোলন ছোটনাগপুরের সর্বত্র এমনকী জীবিকার সন্ধানে যাঁরা তরাই ও ডুয়ার্স-এর চা বাগানে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল তাঁদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।

অসহযোগ আন্দোলন

১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকে শিবু ওঁরাও ও মায়া ওঁরাও ‘টানা ভকত’ আন্দোলনে খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই সময় ঘোষণা করা হয় টানা ভকতরা হিন্দু ও মুসলমানদের সঙ্গে সমান। টানা ভকত আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। ভকতদের কাছে নির্দেশ গেল খাদি পরিধান করার ও ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা বহন করার জন্য। গান্ধি মহারাজের নামে শপথ গ্ৰহণ করতে লাগল টানা ভকতরা। চরখা ও স্বরাজ নিয়ে কিংবদন্তি গড়ে উঠল। গান্ধি মহারাজ অচিরেই আংরেজ রাজের অবসান ঘটিয়ে ধর্মরাজ প্রতিষ্ঠা করবেন বলে ভকতরা প্রচার করতে লাগল। গান্ধি বাবা গুলিবন্দুক ও সিপাহী ছাড়াই এই কাজে সফল হবেন। এরপর ‘টানা ভকত’ আন্দোলন জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। মহাত্মা গান্ধি এঁদের আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ভাবে অবহিত ছিলেন। ১৯৪০ সালে গান্ধিজি রাঁচির কাছে রামগড় কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিতে আসেন। অধিবেশনের পর তিনদিন তিনি ‘টানা ভকত’দের গ্রামে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে অবস্থান করেন।

ডুয়ার্স ও তরাই- এ ‘টানা ভকত‘ আন্দোলন

জলপাইগুড়ি জেলার উত্তরে ভুটান সীমান্তবর্তী অঞ্চল হচ্ছে ডুয়ার্স। এই ডুয়ার্সে চা বাগানের পত্তন শুরু হয় ১৮৭৪ সালে। একই সময়ে দার্জিলিং জেলার তরাই – এও চা বাগান বসানো শুরু হয়। ডুয়ার্সের একদম পূবে অসম সীমান্তে কুমারগ্রাম থানা। আগে এই অঞ্চলকে বলা হত ‘ভলকা পরগনা’। এই পরগনার প্রথম চা বাগান পত্তন হয় ‘হাতিপোতা’ নামক গ্রামে। তরাই ,ডুয়ার্স, দূর আসাম পর্যন্ত শত শত চা বাগানের জন্য শ্রমিক জোগাড় করে হত রাঁচি, ছোটনাগপুর, লোহারডাগা, খুঁটি এলাকা থেকে। শ্ৰমিকরা সবাই আদিবাসী এবং তাঁদের মধ্যে এক বড় অংশ ওঁরাও সম্প্রদায়ের। আড়কাঠি লাগিয়ে, ভুলিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে এঁদের নিয়ে আসা হত এইসব চা বাগানের শ্ৰমিক করে। এখানে এলে আর ফেরার উপায় থাকত না। থেকেও গিয়েছিল এই হতভাগ্য শ্ৰমিকরা। তাঁদের বংশধররা এখনও থাকে। এই হাতিপোতা চা বাগানে আসা ওঁরাও শ্ৰমিকদের মধ্যে টানা ভকত আন্দোলনের ঢেউ এসে পৌঁছয়। এই সংস্কার আন্দোলন অচিরেই বাগানের চা-কর সাহেবদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে থাকে। ১৯১৬ সালে  হাতিপোতায় প্রথম শ্ৰমিক সমাবেশ হয়। এই  সমাবেশ থেকে সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানানো হয়। অচিরেই পুলিশের সাহায্যে এই আন্দোলন দমন করা হয়। ২৯ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয় ও বাগান থেকে ‘হাতাবাহার’ অর্থাৎ বহিষ্কারের নির্দেশ জারি করা হয়। ‘হাতা’ অর্থাৎ বাগানের এলাকা। তখনকার দিনে বাগান থেকে বহিষ্কারের অর্থ ছিল নিশ্চিত মৃত্যু। চারপাশে ছিল গভীর জঙ্গল। দেশে ফেরারও কোনও উপায় ছিল না। এঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন সুয়া ওঁরাও, জেহেরু ওঁরাও, দখন গোয়ালা, লালমোহন বেলি, জেটভুক্ত ,মাংরা ওঁরাও, গোবলু ওঁরাও, বৈজনাথ মাপলি, চারওয়া ওঁরাও, খেতু মুন্ডা, দেবী ওঁরাও, দোসরা ওঁরাও, সোমরা ওঁরাও, দোগরা ওঁরাও, গোয়েন্দা ওঁরাও প্ৰমুখ (সূত্র: District report of the general committee of the Doors Planter’s Association for 1917, page 426 – 427. জ্যোতির্ময় রায় লিখিত ‘ভলকা পরগণার ইতিহাস’ থেকে প্রাপ্ত)।

আমি নিজে আজ থেকে তিন দশক আগে তরাই-এর (শিলিগুড়ির কাছে) বিজয়নগর চা বাগানে গিয়েছিলাম ও শ্রমিক মহল্লায় দুটি টানা ভকত পরিবার দেখেছিলাম। আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রমিক নেতা নকুল বাগোয়ার। তিনি ওঁরাও সম্প্রদায়ের মানুষ। আমাদের অনুরোধে তিনি মোহরগাঁও গুলমা চা বাগান থেকে ওঁরাও চা শ্ৰমিকদের  একটি লোক নৃত্যগীতের দল নিয়ে আসেন ও শিলিগুড়ি দীনবন্ধু মঞ্চে অনুষ্ঠান করেন। আমার মনে আছে তাঁরা একটি গান গেয়েছিলেন। সেটি হচ্ছে :-

গানহি বাবা কানুন সে লড়ে,

বড়ে বড়ে সিপাহী বন্দুক সে লড়ে,

লেকিন গানহি বাবা কানুন সে লড়ে।

অর্থাৎ রাষ্ট্র শক্তি অস্ত্রের জোরে লড়ে, কিন্তু গান্ধিজি নীতির ভিত্তিতে লড়েন। মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার আগে গোটা দেশেই চা বাগানগুলিতে কোনও রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ছিল না। কিন্তু গান্ধিজির বিস্ময়কর প্রভাব দূরতম বাগান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।

কেমন আছেন টানা ভকত সম্প্রদায়

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাত দশকের বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। ‘টানা ভকত’দের স্বপ্নের ধর্ম রাজ্য আজও স্থাপিত হয়নি। গান্ধিজীর স্বপ্নের রাম রাজত্ব এখনও স্বপ্নই মাত্র। কিন্তু টানা ভকতদের কি হল? তাঁরা কোথায়? আশ্চর্যের বিষয়, তাঁরা এখনও আছেন, হয়তো ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রামে বা অসম, ডুয়ার্স, তরাই-এর কোনও চা বাগানে। তাঁরা খাদি বস্ত্র পরিধান করেন, অহিংসায় বিশ্বাসী ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন। তাঁরা অনেকেই হয়তো দুবেলা খেতে পাননা কিন্তু এই জীবনচর্যা তাঁরা ত্যাগ করেননি। টানা ভকতরা কৃষিজীবী, কিন্তু তাঁদের হাতে জমির পরিমাণ খুবই সামান্য।

সাম্প্রতিক কোভিড সংক্রমণের সময় গোটা দেশের সঙ্গে ঝাড়খন্ড রাজ্যেও পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। অনেকে আক্রান্ত (সরকারি তথ্য প্রায় ৪ লক্ষ) হয়, অনেকের মৃত্যু (৫ হাজারের মতন) হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই সম্প্রদায়ের একজন মানুষও কোভিড আক্রান্ত হননি। স্বভাবতই একজনেরও মৃত্যু হয়নি। এর কারণ এঁরা লোকালয় থেকে দূরে অত্যন্ত পরিষ্কার পরিছন্ন পরিবেশে বাস করেন। প্রতিদিনের পড়া জামাকাপড় কেচে ফেলেন। বাড়ি থেকে দূরে  কোথাও গেলে শুকনো খাবার নিয়ে যান, বাইরের রান্না করা খাবার খান না। ঝাড়খন্ড সরকার অবশ্য বিষয়টি জানবার পর তাঁদের দ্রুত টিকা দেবার ব্যবস্থা করবে বলেছে।

অধ্যাপক এস নারায়ণ দীর্ঘদিন ধরে ‘বেত্রো’ ব্লক ও সন্নিহিত অঞ্চলে ‘টানা ভকত’দের ওপর গবেষণা করছেন। এই সব জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চলে মাওবাদীদের সাংগঠনিক তৎপরতা আছে। মাওবাদীরা টানা ভকতদের গ্রামগুলিতে আসে। অতীতে তাদের দলে নেবার জন্য মারধর বা কখনও হত্যাও করেছে। কিন্তু টানা ভক্তরা কখনও কোনও বাধা দেয়নি। কেননা তাঁরা অহিংসায় বিশ্বাসী। এরকম ঘটনায় ব্যথিত হয়ে কোনও কোনও মাওবাদী ‘টানা ভকত’ হয়ে গিয়েছে। তাদের হৃদয় পরিবর্তন হয়েছে। ওই সব গ্রামে মাওবাদীরা অত্যাচার বন্ধ করেছে। অধ্যাপক নারায়ণ বলেছেন ‘টানা ভকত’রা সারা পৃথিবীর মধ্যে গান্ধিপন্থায় বিশ্বাসী এক বিস্ময়কর সম্প্রদায়। অনুমান ঝাড়খন্ড রাজ্যে এই সম্প্রদায়ের ৪৫ হাজারের মতন মানুষ আছেন। তাঁদের নিজস্ব নির্বাচন ব্যবস্থা ও প্রতিনিধিমণ্ডলী আছে। সম্পূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক, দলহীন ও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপমুক্ত।

টানা ভকতদের ওপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের Centre for Historical Studies-এর সঙ্গীতা দাশগুপ্ত (Reading Adibasi Histories: Tana Bhagats in Colonial and Postcolonial Times দ্রষ্টব্য)।

টানা ভকত আন্দোলন শতবর্ষ অতিক্রম করেছে। দেশ, রাষ্ট্র, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট সবাই তাঁদের কথা ভুলেছে। তাঁরা তাতে বিচলিত নন। কিন্তু বাংলার পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের কথা মনে রেখেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘টানা ভকতের প্রার্থনা ‘ কবিতা থেকে কয়েকটি  ছত্র উদ্ধৃত করে নিবন্ধটি শেষ করবো।

টানা ভকতের প্রার্থনা

মাটির পেট থেকে সব কথা

আজও বার করা যায়নি।

আরো কত পাথরের হাতিয়ার ,

হারের অলঙ্কার আর মাটির তৈজস ,

মুখের আরো কত কথা।

খোদাই করা আর কত অক্ষর

অন্ধকার থেকে আলোয় আসার অপেক্ষায়…

ছুঁচে সুতো পরাতে পারি না 

তা আমি অত দূরেরটা

কেমন করে দেখব ?

গুরুজনেরা বন্দেমাতরম বলে 

কপালে হাত ঠেকিয়ে 

তিনটে রং

কলাপাতায় সিঁদুর চন্দন বুলিয়ে

আমাদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন

আগুনের তাপে

তিনকে এক করে আমরা পেলাম

টকটকে লাল —–

আমাদের ধমনীতে বহমান যে রক্ত

তার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে 

সেই রঙে আমরা ছুপিয়ে নিয়েছিলাম

আসমুদ্র হিমাচলের আকাশে তোলা

আমাদের নিশান।

ভাই ও ভাই।

তোমরা কি সেসব ভুলে গিয়েছ ?

তিনকে এক করেছিল যে রংরেজ

তাকে যে চক্রান্তকারীরা

পাহাড়ের চূড়া থেকে খাদের মধ্যে 

ঠেলে দিয়েছিল

নব কলেবরে আবার সে

উঠে আসবে

ভাই, ও ভাই।

তোমরা কি সেসব ভুলে গিয়েছ ?

নোংরা হাতের টানাটানিতে

আর ক্রমাগত

হাত বদলের ঠেলায় —-

রক্তের সঙ্গে মিলিয়ে , দেখো 

বাজে রঙের মেশালে আর সাত নকলে

আমাদের সে নিশানের

সে রং আর নেই।

ফিকে তো বটেই, তা ছাড়া কী জান ?

রোদে একটু পুড়লে

জলে একটু ভিজলেই উঠে যাচ্ছে।

মাটি থেকে তুলে তিনটে রং

গনগনে আঁচে জ্বাল দিলেই

টকটকে লাল হবে।

ভাই, ও ভাই।

যখন হাঁটবে ——

খুব পা টিপেটিপে

এখানে পেছল হয়ে আছে

ওখানটাতে গর্ত —–

যখন হাঁটবে

খুব পা টিপে টিপে

পা টিপে টিপে।

সময় পড়েছে বড় খারাপ

কালো চশমা  দিয়ে চোখ

বাঁদুরে টুপিতে কান 

যে পারছে সেই ঢেকে রাখছে।

হাত নাড়াতে নাড়াতে ডানা দুটো

খসিয়ে ফেললেও কেউ দেখে না,

চেঁচাতে চেঁচাতে গলা ফাটিয়ে ফেললেও

কেউ শোনে না।  

নিজের কথা কী আর বলব

দাড়ি কামাই , চুল আঁচড়াই ,

চোখের কোনে কালি মুছি —–

সমস্তই বিনা আয়নায়।

এখন আর আমাকে তাই নিজের মুখদর্শন

করতে হয় না।

সরতে সরতে আজ আমি সব কিছুর বাইরে।

সন্ধের পর শহরময় আলো নিভে গেলে,

অন্ধকারের কালো পর্দায় 

তবু আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে

জবাকুসুমসঙ্কাশং সেই মহাদ‍্যুতিকে খুঁজি,

শক্তিকে যে বেঁধে রেখেছে

অঙ্গারের মধ্যে।

আমি কান খাড়া করে রেখেছি —-

শিখরভূম থেকে কখন ভেসে আসে 

টানা ভকতদের প্রার্থনা

টান বাবা টান। কাঁধে চড়া ভূতেদের

ঠ্যাং ধরে টান। টান টোন টান

টান বাবা টান। চোখ – ট‍্যারা ভূতেদের

চুল ধরে টান। টান টোন টান

টান বাবা টান। কেটে – পড়া ভূতেদের

নড়া ধরে আন। টান টোন টান

তোমরা কি শুনতে  পাচ্ছ ?

ভাই ও ভাই।”

সহায়ক পাঠঃ

১. সতীনাথ ভাদুড়ী, ঢোঁড়াই চরিত মানস।

২. District report of the general committee of the Doors Planter’s Association for 1917, page 426 – 427.

৩. জ্যোতির্ময় রায়, ভলকা পরগণার ইতিহাস।

৪. Sangeeta DasGupta, Reading Adibasi Histories: Tana Bhagats in Colonial and Postcolonial Times.

লেখক শান্তনু দত্ত চৌধুরী কর্মজীবনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের উপ তথ্য অধিকর্তা ছিলেন। বর্তমানে 'সপ্তাহ' পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।

মন্তব্য তালিকা - “শতাব্দী পেরিয়ে টানা ভকতদের কথা”

  1. মনোগ্রাহী ও তথ্যসমৃদ্ধ লেখা l এক অজানা ইতিহাস জানলাম l ওই এলাকাটি দেখার ইচ্ছা রাখি l অনেক ধন্যবাদ l অপেক্ষায় রইলাম আগামী লেখার l নমস্কার

  2. অসাধারণ একটি নিবন্ধ।।কত সাধারণ মানুষদের ব্রিটিশবিরোধী এই আন্দোলনের কথা নেতানির্ভর ইতিহাসে উহ্য রয়ে গেছে। টানা ভগতরা তেমনই এক গোষ্ঠী।
    লক্ষ্যণীয়, এরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে অহিংস পথে, সেই ১৯১৪ সালে। গান্ধীজি ভারতে ফিরেছেন তার এক বছর পর।
    হয়তো অহিংস অসহযোগের ধারণা তিনি এদের থেকেই নিয়েছিলেন।

  3. সমৃদ্ধ হলাম।লেখার তথ্যগত দিক আর লেখন ‌‌শৈলির প্রশংসা না করলে অন্যায় হবে।
    একেবারে জানা ছিল না।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।