সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

রাজেন্দ্র চোলের নৌসেনা, বাণিজ্যযুদ্ধ, শ্রীবিজয় জয় ও অন্যান্য

রাজেন্দ্র চোলের নৌসেনা, বাণিজ্যযুদ্ধ, শ্রীবিজয় জয় ও অন্যান্য

নবাঙ্কুর মজুমদার

অক্টোবর ১৮, ২০২৫ ১৯০ 6

স্থান তাঞ্জাভুরের আরানমানাই-এর (রাজপ্রাসাদ) রানিবাসে পট্টমহিষী ত্রিভুবন মহাদেবীর শয়নকক্ষ। কাল যাবনিক বর্ষপঞ্জি মতে ১০২৫ সাধারণাব্দের শুরুর দিক। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে বহুক্ষণ। দুগ্ধধবল শয্যায় অর্ধশায়িত অবস্থায় রাজেন্দ্র বিশ্রাম নিচ্ছেন। পাশেই ব্যজনম হাতে উপস্থিত পরিপাটি সাজে সজ্জিতা স্বয়ং ত্রিভুবন মহাদেবী। কিঙ্করীরা এসে দীপদানের বাতিগুলি জ্বেলে দিয়ে গেছে। সহস্র কম্পমান দীপশিখার আলোয় ভাস্বর হয়ে উঠেছে রাজমহিষীর কক্ষ। অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় মগ্ন চোল কুলগৌরব রাজেন্দ্র ও ত্রিভুবন মহাদেবী। বিশ্রম্ভালাপের মাঝেই রাজকীয় পরিকল্পনা নিয়ে কিছু কথা আলোচিত হচ্ছে। ত্রিভুবন মহাদেবী জানতে চাইলেন নতুন রাজধানী গঙ্গাইকোন্ডচোলপুরমের কাজ কতদূর এগোলো। সুদূর বঙ্গদেশ থেকে ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল এনে পূর্ণ করা হয়েছে যে পুষ্করিণী তাতে অবগাহন স্নান করে মহেশ্বরের অর্চনা করা মহাদেবীর বহুদিনের সাধ। শুনে হাস্যোজ্জ্বল মুখে রাজেন্দ্র জবাব দিলেন, “আর কিছুদিন অপেক্ষা করো মহারানি। কাজ সম্পূর্ণ হলে গঙ্গাইকোন্ডচোলপুরম হবে ভারতভূমির শ্রেষ্ঠ নগরী। নগরীর মধ্যস্থলে থাকবে অনিন্দ্যসুন্দর সুবৃহৎ এক মন্দির। চোল কুলদেবতা দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দির হবে সেটি। বৃহদেশ্বর নাম দেব সে মন্দিরের। তখন তুমি মনের সুখে দ্রাবিড়ভূমিতে দাঁড়িয়েই গঙ্গাস্নান করে মহেশ্বরের অর্চনা করতে পারবে। কিন্তু গঙ্গাইকোন্ডচোলপুরম আমার এক বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশমাত্র। ভেঙ্গি হয়ে ওড্রদেশ থেকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত আমি এমনি এমনি অভিযান করিনি।  সমগ্র কিলাক্কু কাতালের (পূর্ব সমুদ্রের) অধিপতি হব আমি। মহাসমুদ্রকে চোলহ্রদে পরিণত করে তবে আমার শান্তি। সেটা করতে পারলে সসাগরা পৃথিবীর পূর্বদিকের সমুদ্রবাণিজ্যের একছত্র অধীশ্বর হবে চোল রাজসিংহাসন। একই স্বপ্ন আমার পিতা মহারাজেরও ছিল। আর সেজন্য তিনি প্রভূত পরিশ্রম করে চোল নৌবাহিনকে জম্বুদ্বীপের শ্রেষ্ঠ নৌবাহিনীরূপে তৈরি করেছিলেন। সেই নৌবহর আমি আরও সমৃদ্ধ করেছি। এ কারণে শ্রীলঙ্কা আর মালদ্বীপ দখলে আনতে এতটুকু বেগ পেতে হয়নি আমাদের। কিন্তু সুবর্ণভূমি যতক্ষণ না দখলে আসছে ততক্ষণ একচেটিয়া সমুদ্রবাণিজ্য হস্তগত হবে না চোল বণিকদের। তাই শ্রীবিজয় আমার চাই। তবে সেজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা আর উপযুক্ত সময়সন্ধান”।

শ্রীবিজয় মানে? আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র সংগ্রাম বিজয়তুঙ্গের শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের কথা বলছেন? চোল সম্রাজ্ঞীর চোখেমুখে বিস্ময়!

এতক্ষণ মহারানির হাতের সুবর্ণকেয়ূর ধরে আনমনে নাড়াচাড়া করছিলেন রাজেন্দ্র। এবারে সোজা হয়ে উঠে বসলেন তিনি। বললেন, “যথার্থ তোমার অনুমান রানি। কিলাক্কু কাতাল অর্থাৎ পূর্ব সমুদ্র পার হয়ে যবদ্বীপ, শ্যাম, কম্বোজ, সুমাত্রা, মালয় উপদ্বীপ—সমুদ্রমেখলা এক বিরাট ভূভাগ নিয়ে শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য। পালেম্বং ওদের রাজধানী। আর শ্রীবিজয়ের সিংহাসনে আসীন বর্তমান সম্রাট হলেন সংগ্রাম বিজয়তুঙ্গবর্মণ। হ্যাঁ, ওরা এখনো আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র বটে, তবে কি জান, রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু বলে কেউ হয় না”।

মহারানি ত্রিভূবন মহাদেবী আরও অবাক হলেন। বললেন, “কিছুদিন আগেই তো মাবলি বনাধিরাজনে শ্রীবিজয়ের রাজপ্রতিনিধি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মিত্রতার নিদর্শন-স্বরূপ বিস্তর উপঢৌকন দিয়েছিলেন! সেই রাজ্য দখলের পরিকল্পনা করছেন আপনি!”

‘যুদ্ধমল্ল’ রাজেন্দ্র চোল হেসে উঠলেন। বললেন, “শুধু তাই নয়। নাগাপত্তিনমের কুড়ামনি বিহার সমেত চোল রাজ্যের অনেকগুলি মন্দির, বৌদ্ধ মঠ ও বিহারেও অর্থদান করেছেন শ্রীবিজয় সম্রাটরা। কিন্তু ওই যে বললাম, রাজনীতিতে নিজেদের স্বার্থ দেখতেই হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত শ্রীবিজয় অধিকৃত বাণিজ্যপথের উপর চোল নৌবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না আসছে, ততক্ষণ আমাদের বাণিজ্যিক উন্নতি আশানুরূপ হবে না। খুব শীঘ্রই আনাইমন্ডপমে এই নিয়ে আলোচনা করবো। সেদিন উপস্থিত থেকো, সব জানতে পারবে। যাইহোক, রাত হয়েছে, এখন চলি। আজ আমি মহাদেবী ভীরমাদেবীর কক্ষে রাত্রিযাপন করবো”।

তাঞ্জাভুরের রাজসভা আনাইমন্ডপমে রাজকীয় অধিবেশন বসেছে। সভা একেবারে পরিপূর্ণ। বিহঙ্গম কারুকার্যশোভিত আনাইমন্ডপমের কেন্দ্রস্থলে রাজসিংহাসন যা পেরারাসন বা চক্রবর্তী আসন নামে পরিচিত। তার ঠিক পেছনে একটু পৃথকভাবে রাজমাতা ও মহাদেবীদের জন্য মহিলা মণ্ডপ। রাজসিংহাসনের কাছেই যুবরাজ রাজাধিরাজা চোলের বসার জায়গা। সভার দুদিকে আমাইচার বা মন্ত্রীমণ্ডলমের আসন বিন্যাস। প্রথমেই একপাশে রয়েছে পেরুনদেভান বা প্রধানমন্ত্রীর আসন। অন্যপাশে ব্রাহ্মাধিরাজা বা রাজপুরোহিতের উপবেশন স্থল। এরপর একে একে পেরুনধারাইয়ার (রাজার প্রধান উপদেষ্টা), সিরুথোন্ডার (রাজস্ব ও অর্থমন্ত্রী), ওলাইনায়গম (বিদেশমন্ত্রী), দন্ডনায়গম (সমরমন্ত্রী), পাট্টায়াক্কুভামি (নথি ও মুদ্রা দেখভালকারী), ওলাইয়ালার (মন্ত্রীপরিষদের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ), আমাত্যার (আমাত্যবৃন্দ), মাদুভাজাহি (কিছু আঞ্চলিক শাসকগণ) প্রমুখের বসার ব্যবস্থা। আর রয়েছেন সেনাপথি (প্রধান সেনাপতি), কাদরম কাদ্দানায়গম বা কাড়ল নায়গম (নৌবাহিনীর প্রধান), কাভালার ও পারাইমুড়ালি (অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর প্রধান) প্রমুখ বিশিষ্ট সেনাপ্রধানগণ।

সকল সভাসদের পোশাক মোটামুটি একই ধরণের। পরনে সাদা বা হালকা রঙের কাছাবিহীন সুতির ধুতি। বেশিরভাগেরই ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ। রাজপরিবারের সদস্যবৃন্দ, রাজপুরোহিত ও কিছু বিশেষ ব্যক্তিবর্গ কেবল ঊর্ধ্বাঙ্গে অঙ্গবস্ত্রম বা উত্তরীয় জড়িয়ে রেখেছেন। মাথায় পাগড়ি, কপালে শৈব তিলক ও সামান্য কিছু অলঙ্কার শরীরের শোভা বর্ধন করছে। সেনাপ্রধানদের সঙ্গে অস্ত্র বহনের অনুমতি রয়েছে। তবে সকলেরই নগ্নপদ।

রানিদের পৃথক মণ্ডপে স্বচ্ছ অবরোধের পেছনে ত্রিভুবন মহাদেবী, পঞ্চবাণ মহাদেবী, মহাদেবী ভীরমাদেবী, মহারাজ্ঞী মুখতাবল্লভী এবং মহারাজ্ঞী ত্রিপুরামহাদেবী সকলেই আজ উপস্থিত। বোধহয় গুরুতর কোনো বিষয় আলোচনা হতে চলেছে। রানিদের পরনে জমকালো পুদভাই (শাড়ি জাতীয় পোশাক)। তারা সকলেই প্রভূত স্বর্ণালঙ্কার ও রত্ন আভূষণে সুসজ্জিতা।

চক্রবর্তী সম্রাট রাজেন্দ্র চোল তখনও সভায় উপস্থিত হননি। সভাসদরা নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কথাবার্তা বলছেন। তালবাদ্য, তন্ত্রীবাদ্য ও বায়ুবাদ্যের সংমিশ্রণে অপূর্ব সুরমূর্চ্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে আনাইমন্ডপম জুড়ে। তালবাদ্যের মধ্যে রয়েছে মৃদঙ্গম, উড়ুক্কাই, ইড়াক্কা, কুড়ম ইত্যাদি। তন্ত্রীবাদ্যের মধ্যে ইয়াজ, বীণা ও তন্তরি কিন্নরী বেজে চলেছে। সঙ্গে নাগস্বরম, সঙ্গু ও কুঝাল নামের বায়ুবাদ্যগুলি যোগ্য সঙ্গত করছে।

এমন সময় রাজভাটের উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা শোনা গেল। “ইরান্দাম পরকেসরি বর্মণ, যুদ্ধমল্ল, মুম্মুদি চোলান, গঙ্গাইকোন্ডন, জয়সিমহা কুলাকালান, চালুক্য চূড়ামণি, মান্নাইকোন্ড চোল, থেলগারামারি, রত্তপাদিকোন্ড চোল, চক্রবর্তী সম্রাট শ্রী রাজেন্দ্র চোল পৃথিবী কম্পিত করে আনাইমন্ডপমে প্রবেশ করছেন”।

রাজকীয় আগমনবার্তা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের তাল ও লয়ের দ্রুততার পরিবর্তন হল। প্রত্যেক সভাসদ অঞ্জলিমুদ্রায় দণ্ডায়মান।

শরীরের নিম্নাংশে জড়ানো স্বর্ণখচিত ভেস্তি (মসলিন বা রেশমের ধুতি), উজ্জ্বল সোনালি অঙ্গবস্ত্রম, মাথায় করুণমুড়ি বা কিরীটম (রাজমুকুট), গায়ে রত্নখচিত স্বর্ণালংকার—কোমরে কোমরবন্ধ, কানে কুণ্ডল, গলায় বিভিন্ন হার ও মালা, বাহুতে বাজুবন্ধ, হাতে কঙ্কণ, বালা আদি আভূষণের রাজকীয় সাজে সজ্জিত রাজেন্দ্র চোলের দরবারে আগমন ঘটলো। মুখে স্মিত হাসি ঝোলানো। ব্রাহ্মাধিরাজাকে ভানাক্কম (অভিবাদন/নমস্কার) জানিয়ে তিনি পেরারাসনের দিকে এগিয়ে গেলেন। এবারে রাজবন্দনার পালা।

রাজকীয় আড়ম্বর শেষ হওয়ার পর মূল রাজকার্য শুরু হল। প্রথমেই বণিকসভা আইননুররুভার বা আইহোলে-৫০০ এর প্রতিনিধিমণ্ডলী মহারাজাকে যথোচিত অভিবাদন সহকারে নিবেদন করলো, দক্ষিণ ভারতীয় বণিকদের সমুদ্র বাণিজ্যের প্রধান অন্তরায় জলদস্যুদের উপদ্রবের কথা। পূর্ব সমুদ্র ও পশ্চিম সমুদ্র দু’দিকেই এই আক্রমণ ঘটছে। পশ্চিম সমুদ্রে চুল্লিয়ান বা তুরুস্ক বণিকদের একাংশ এবং স্থানীয় কিছু বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী এসব জলদস্যুতার জন্য দায়ী। আইহোলে-৫০০র নিজস্ব সেনাবাহিনী এসব আক্রমণ প্রতিহত করে পশ্চিম সমুদ্রকে নিরুপদ্রব রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে চূধা কাড়াল (চোল সমুদ্র) পেরিয়ে সুবর্ণভূমি ও মহাচীনের সঙ্গে বাণিজ্যের বেলায়। বাণিজ্যিক নৌবহর যখন নাগাপত্তিনম বা কাঞ্চিপুরম থেকে সদ্যজয়ী বঙ্গদেশের তাম্রলিপ্ত বন্দর অথবা শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের অধীন কাদারাম বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে, তখন মালয় উপদ্বীপের কিছু স্বাধীন উপজাতি ও সামন্তশক্তি শ্রীবিজয়ের দুর্বল শাসনাধীন অঞ্চলে নিজেদের নৌবাহিনী গড়ে তুলে পুরো বাণিজ্যপথে লুটপাট চালাচ্ছে, জাহাজগুলোতেও যখনতখন হামলা করছে। তারা ছোটো নৌকা নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে পালিয়ে যায়। শ্রীবিজয়রাজের কাছে অভিযোগ জানিয়েও কোন সুরাহা হচ্ছে না।

গম্ভীর মুখে রাজেন্দ্র চোল বণিক প্রতিনিধিদের সব কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। এবারে তিনি পেরুনধারাইয়ারকে (প্রধান উপদেষ্টা) জিজ্ঞাসা করলেন, “শ্রীবিজয়ের সঙ্গে কি এমন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হয় যে কাদারাম বন্দর আমাদের বণিকদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ?”

পেরুনধারাইয়ার জবাব দিলেন, “ভারতীয়, চৈনিক আর তুরুস্ক বণিকেরা কাদারাম সহ শ্রীবিজয়ের আরো কয়েকটি সমুদ্র বন্দরে পরস্পরের জিনিসপত্র আদান প্রদান করে এবং জাহাজ মেরামতি, বিশ্রাম ইত্যাদিও ওখানেই হয়। চোল ভূমি থেকে রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে মূলত বিভিন্ন বস্ত্র, নানারকম মসলাপাতি, হাতির দাঁত, চন্দনকাঠ, বিভিন্ন ধাতু, মূল্যবান রত্ন ইত্যাদি রয়েছে। আর শ্রীবিজয় ও চীনদেশ থেকে আমদানি করা হয় দামী রেশম বস্ত্র, হরেক রকমের মশলা, চিনামাটির জিনিসপত্র, ধাতব মুদ্রা ইত্যাদি। এতে মহান চোল সম্রাটের প্রচুর রাজস্ব উপার্জন হয়। কিন্তু শ্রীবিজয়রাজ ইদানিং চড়া হারে রাজস্ব আদায় শুরু করায় চোল দেশের বণিকদের লভ্যাংশে ভাটা পড়ছে, সঙ্গে রয়েছে জলদস্যুদের উৎপাত”।

রাজেন্দ্র চোল সমস্ত শুনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বণিকদলকে বিদায় করলেন। তারপরে ওলাইনায়গমকে(বিদেশমন্ত্রী) জিজ্ঞাসা করলেন, “শ্রীবিজয় নরেশ আমাদের বণিকদের উপর কেন এত চড়া হারে শুল্ক আরোপ করছেন”?

ওলাইনায়গম বললেন, “শ্রীবিজয়ের ভূতপূর্ব সম্রাট শ্রীমারা বিজয়তুঙ্গবর্মণ ও বর্তমান সম্রাট সংগ্রাম বিজয়তুঙ্গবর্মণ শক্তিশালী নৌবাহিনী তৈরি করে চূধা কাড়াল থেকে পীত সমুদ্র যাবার একমাত্র রাস্তা মালাক্কা প্রণালীর উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে রেখেছেন। সমস্ত বাণিজ্যপোতগুলিকে শ্রীবিজয়রাজকে চড়া হারে শুল্ক দিতে হয়, তবে এ পথে প্রবেশাধিকার মেলে। আমরা যদি এই বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তবে পশ্চিমদেশ থেকে পূর্বদেশের যাবতীয় বাণিজ্য আমাদের হস্তগত হতে পারে। অন্যদিকে শ্রীবিজয় সম্রাটরা নাস্তিক বৌদ্ধ, তায় মহাযানী সম্প্রদায়, আমাদের উচিত নাস্তিক শ্রীবিজয়দের দমন করে তামিল সংস্কৃতি ও দর্শন সুবর্ণভূমিতে প্রচার প্রসার ঘটানো। এখন সম্রাটের যা অভিরুচি”।

চোল সম্রাট খানিকক্ষণ চিন্তা করে এবারে কাদরম কাদ্দানায়গমকে(নৌবাহিনীর প্রধান) ডেকে কারাইপ্পাড়ায়িইলার বা চোল নৌবহরের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে জানতে চাইলেন।

কাদরম কাদ্দানায়গম অভিবাদন জানিয়ে উত্তর দিলেন, “চোল নৌবাহিনীর হাতে এই মুহূর্তে পাঁচ ধরণের জাহাজ রয়েছে। কালাম বা বড়ো আকারের যুদ্ধজাহাজ, যা সৈন্য ও অস্ত্র বহনে সক্ষম। থোনি বা ধোনি—যার আকার মাঝারি (বর্তমান হিসাবে ৭০ ফুট লম্বা, ২০ ফুট চওড়া ও ১২ ফুট গভীর) কিন্তু এগুলি খুব দ্রুতগামী, সেজন্য শত্রুভূমিতে সৈন্য সঞ্চালনের কাজে ব্যবহার হয়। পাড়াভু—হালকা কাঠের জাহাজ যা নদী ও উপকূল প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত হয়। কাপ্পাল—সাধারণ যুদ্ধ ও পরিবহণ জাহাজ এবং মারাক্কালাম বা বাণিজ্যিক ও নৌ অভিযানে ব্যবহৃত বড়ো কাঠের জাহাজ (যা আকারে পাড়াভু থেকে অন্তত চারগুণ বড়ো)। শিসম, টিক ও কাঁঠাল কাঠ আর লোহা ব্যবহার করে মজবুত ও টেঁকসই জাহাজগুলি তৈরি। আমাদের কারাই পাড়াই বা সমুদ্রসেনারা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত; ধনুর্বাণ, বর্শা, তলোয়ার, গদা, অগ্নিবাণ, যান্ত্রিক নিক্ষেপক সহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। আপনি আদেশ করলে যেকোন সময় আমরা শত্রুদের সমুদ্রপথ অবরোধ করতে, শত্রুভূমিতে সৈন্য পরিবহন করে আক্রমণ চালাতে বা হালকা ও দ্রুতগামী জাহাজ দিয়ে গেরিলা আক্রমণ করে তাৎক্ষণিক সৈন্য প্রত্যাহারেও সক্ষম। আপনার পিতা স্বর্গত মহারাজ রাজরাজ চোল এবং স্বয়ং আপনার রাজছত্রের নিচে আমরা লঙ্কা বিজয়, মালদ্বীপ, লাক্ষাদ্বীপ এবং মানাক্কাভারম (বর্তমান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ) জয় করে আমাদের রণকৌশলের পরিচয় দিয়েছি”।

সব শুনে বেশ সন্তুষ্টচিত্তে রাজেন্দ্র চোল দন্ডনায়গম, সেনাপথি, কাভালার, পারাইমুড়ালিকে কাদরম কাদ্দানায়গমের সঙ্গে সমন্বয় করে যুদ্ধপ্রস্তুতি চূড়ান্ত করতে বললেন। সিরুথোন্ডারের প্রতি আদেশ হল রাজকোষের অবস্থা নিরীক্ষণ করে প্রয়োজনে মাদুভাজহি-দের সাহায্য নিয়ে রাজকোষকে আসন্ন যুদ্ধের উপযোগী করে গড়ে তোলার। মন্ত্রীমণ্ডলমের মতামত জেনে নিয়ে রাজন রাজেন্দ্র শ্রীবিজয়ে নৌ-আক্রমণের চূড়ান্ত আদেশ জারি করলেন।

বেশ কয়েকমাস অতিক্রান্ত। চোল আক্রমণে শ্রীবিজয়ের বিধ্বস্ত রাজধানী পালেম্বং থেকে দূরবর্তী সুমাত্রার কোনো এক বৌদ্ধ মহাবিহার। বালসূর্যের কিরণ সবে বিহারশীর্ষে পতিত হয়েছে। মহাবিহারের সুবৃহৎ পাঠাগার কক্ষে চীনাংশুক পরিহিত লোলচর্ম এক অতিবৃদ্ধ শ্রমণ অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। বয়স অনুপাতে মেরুদণ্ড যথেষ্ট ঋজু। সদ্যস্নাত দেহ হলেও শ্রমণের মনের কোন আজ মেঘমলিন। সমগ্র সুবর্ণদ্বীপের গুরুশ্রেষ্ঠ তিনি। জগতবাসী তাঁকে আচার্য ধর্মকীর্তি নামে চেনে। ভগবান তথাগতের কর্মভূমি ভারতবর্ষের পূর্ব অংশ বঙ্গদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বিগত বারোটি বছর ধরে তাঁর কাছ থেকে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের পাঠ নিয়েছেন। অধ্যয়ন, অধ্যাপন, আলোচনা, বিতর্ক, কূটতর্ক সবেতেই পারঙ্গম দুই মহাপণ্ডিত জ্ঞানসমুদ্রে যেন নিত্য অবগাহন করতেন। কিন্তু হঠাৎ সুবর্ণভূমির আকাশে রাজনৈতিক দুর্যোগের ঘনঘটার সংবাদ পেয়ে অতীশ দীপঙ্কর দ্রুত দেশে ফিরতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। পরিস্থিতি বিচার করে আচার্য ধর্মকীর্তি বাধা দেননি তাঁকে। অতীশ ফিরে গিয়েছেন নিজের মাতৃভূমিতে। কিন্তু তার পরপরই সমুদ্র ঝঞ্ঝায় উপকূল অঞ্চল যেমন বিধ্বস্ত হয়ে যায়, তেমনই চোল আক্রমণে তছনছ হয়ে গেছে শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য। রাজা সংগ্রাম বিজয়তুঙ্গবর্মণ প্রস্তুত ছিলেন না এই ঝটিতি আক্রমণের জন্য। তবু তিনি তার শক্তিশালী নৌবাহিনী দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন চোল আক্রমণ ঠেকানোর। কিন্তু অত্যন্ত রণনিপুণ ও অভিজ্ঞ চোল নৌবহরের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া উপায় ছিল না তাঁর। পালেম্বং, কাদারাম (কেদাহ) সহ যবদ্বীপ, সুমাত্রা ও মালয়ের বহু গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের দখল চলে গেছে চোলদের হাতে। স্বয়ং শ্রীবিজয়রাজ বন্দী হয়েছেন।

আচার্য ধর্মকীর্তি তাঁর জ্ঞানচক্ষুতে যেন দেখতে পাচ্ছেন এদেশের অন্ধকার ভবিষ্যৎ। শ্রীবিজয়ের ভাগ্যশ্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। এবারে গুরুতরভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে এই রাজ্য। নৌশক্তি বিনষ্ট হওয়ায় সমগ্র বাণিজ্যপথে শ্রীবিজয়ের একছত্র আধিপত্যের দিন অতিক্রান্ত। এবারে হয়তো জাভার কেদিরি রাজবংশ বা অন্য কোন ছোটো শক্তি শ্রীবিজয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করবে। ধীরে ধীরে জাভার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে এই প্রবল প্রতাপশালী রাজ্য। মালয় উপদ্বীপের তাম্ব্রালিঙ্গ, পাত্তানি-র মত ছোটো রাজ্য শীঘ্রই স্বাধীন হয়ে যাবে। এতদিন শ্রীবিজয় চীনের প্রধান বাণিজ্য সহযোগী ছিল, কিন্তু আঞ্চলিক আধিপত্য হারালে চীনও শ্রীবিজয়কে উপেক্ষা করে অন্যান্য রাজশক্তিগুলির সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে মন দেবে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মাজাপাহিত রাজ্য এতদঞ্চলে এক বৃহৎ সাম্রাজ্যরূপে আত্মপ্রকাশ করবে। কিন্তু পশ্চিমদেশের তুরুস্ক বণিকদের ভাবগতিও সুবিধের নয়। তারা ভালমানুষ সেজে বাণিজ্য করতে আসে, আবার সুযোগমত জলদস্যুতা করতে পিছপা হয় না। চোল-শ্রীবিজয় দ্বন্দ্বে দূরভবিষ্যতে হয়তো তুরুস্ক জাতিই বেশি লাভবান হবে, কে বলতে পারে!

বিভিন্ন এলোমেলো চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন আচার্য ধর্মকীর্তি। মনকে শান্ত করতে ধ্যানে ডুবে যেতে চাইলেন তিনি, কিন্তু ধ্যানে যে মন বসানো যাচ্ছে না। মহাযান বৌদ্ধ মতের শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান এই সুবর্ণভূমি। ভারতভূমিতেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ক্ষীণতর, যেটুকু টিকে আছে তা তন্ত্রযান ও বজ্রযানী মতবাদ। শ্রীবিজয় ও পাল সম্রাটদের মধ্যে কত সৌহার্দ্যের সম্পর্ক ছিল একসময়। পাল সাম্রাজ্যের সুদিনে শ্রীবিজয়ের সম্রাটরা সেখানে যে কতগুলি বৌদ্ধ মঠ, চৈত্য নির্মাণ করেন তার ইয়ত্তা নেই। ভারতের মহাবিহারগুলিতে অধ্যয়ন করতে হলে চীন বা দূরপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আগে শ্রীবিজয়ে এসে শাস্ত্রীয় আচার আচরণ আয়ত্ত করে তবে ভারতভূমে পা রাখতে হত। ইৎ সিংও এখানে এসে বৌদ্ধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। অপরদিকে ভারতবর্ষ থেকে চীন দেশে যাবার পথে বজ্রবোধি সমেত বহু পণ্ডিত শ্রীবিজয়ে অবস্থান করে চৈনিক আচার আচরণ ও ভাষা আয়ত্ত করে তবে সেদেশে প্রবেশ করেছেন। আর আজ? কালের পরিহাসে হয়তো বৌদ্ধ ধর্মের গৌরবরবি শ্রীবিজয় থেকে চিরতরে অস্তাচলে যেতে বসেছে। সময় যে পরিবর্তনশীল! চক্রবৎ পরিবর্তন্তে! সবই তথাগতের ইচ্ছা।

হঠাৎ ধর্মকীর্তির মনে হল, বৌদ্ধ শ্রমণ তিনি। রাজনীতি নিরপেক্ষ থেকে শাস্ত্রচর্চাই তাঁর কাজ। সেই তিনিই স্বধর্ম ভুলে এসব অযথা চিন্তায় সময়ক্ষেপ করছেন! হা বুদ্ধ! সেই মুহূর্তে মনের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে ভেসে ওঠে শাক্যমুনির সেই অমোঘ বাণীঃ

“বয়ধম্মা সঙ্খরা, আপ্পমাদেন সম্পাদেথা”।

–জগতের সবকিছুই নশ্বর, তাই সতর্ক ও পরিশ্রমী হয়ে পরিপূর্ণতা লাভে সচেষ্ট হও।

বুদ্ধবাণী মননে প্রশান্তিতে ভরে ওঠে তাঁর মুখমণ্ডল। উদ্বেগমুক্ত হন তিনি। ধীরে ধীরে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়েন আচার্য ধর্মকীর্তি।

তথ্যসূত্র:

  1. Nagapattinam to Suvarnadwipa reflections on the Chola Naval Expeditions to Southeast Asia. Editors: Hermann Kulke, K. Kesavapany, Vijay Sakhuja: ISEAS Singapore
  2. K. A. Nilakanta Sastri, The Colas, University of Madras, 1955
  3. George Woolley Spencer, The Politics of Expansion: The Chola conquest of Sri Lanka and Sri Vijaya, New Era, 1983
  4. Atisa and Tibet: Life and Works of Dipamkara Srijnana in Relation to the History and Religion of Tibet with Tibetan sources; Translated by Alaka Chattopadhyaya under the guidance of Prof. Lama Chimpa; Motilal Banarsidass Publishing House (MLBD)

মন্তব্য তালিকা - “রাজেন্দ্র চোলের নৌসেনা, বাণিজ্যযুদ্ধ, শ্রীবিজয় জয় ও অন্যান্য”

    1. পড়ার জন্য ধন্যবাদ। দ্রুত শেষ হওয়ার কারণ হল, এই যুদ্ধটা সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না।

    1. বৌদ্ধধর্মের তাতক্ষণিক ক্ষতি হয়নি, মাজাপাহিত সাম্রাজ্যের হাত ধরে তা টিকে ছিল।
      পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

  1. বাহ। বেশ ভালো লেখা। অবশ্য হঠাৎই শেষ হয়েছে। বেশ ভালো চরিত্র রাজেন্দ্র চোল।
    তাঁর তিরুমালাই গিরিলিপি সহ, বঙ্গ অভিযানের আলাদা একটি প্রবন্ধ দরকার।
    ধন্যবাদ।

  2. পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। হঠাৎ শেষ হবার কারণ হলো, চোল শ্রীবিজয় যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না, ফলে ইতিহাসের সীমারেখা অতিক্রম না করে কাহিনীর বিস্তার অসম্ভব।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।