সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

পাট্টাদাকাল

পাট্টাদাকাল

শান্তনু ভৌমিক

ডিসেম্বর ১২, ২০২০ ১০৭৭ 12

প্রাচীন এবং মধ্য যুগে দক্ষিণ ভারতে যে কয়েকটি পরাক্রমশালী রাজশক্তির উত্থান হয়েছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম হল চালুক্য রাজবংশ। সাধারণ অব্দের ষষ্ঠ শতক থেকে দ্বাদশ শতক, প্রায় ছয়’শ বছর এঁরা ছিলেন দক্ষিণ ভারতের এক প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। তবে এঁদের শাসনকাল যে নিরবচ্ছিন্ন ছিল এমনটা নয়। তিনটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কিন্তু স্বতন্ত্র শাখা ছিল এই রাজবংশের। এদের সবচেয়ে পুরনো শাখাকে বলা হয় বাদামি চালুক্য। বাদামি চালুক্য রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম জয়সিংহ। তবে সেই সময় তাঁরা ছিলেন বনবাসীর কদম্বদের করদ রাজা। কদম্বদের অধীনতা অস্বীকার করে স্বাধীন বাদামি চালুক্য রাজত্ব শুরু হয় ৫৪৩ সাধারণ অব্দে, এই বংশের তৃতীয় রাজা প্রথম পুলকেশী  (৫৪৩-৫৬৬ সাধারণ অব্দ) – এর সময়ে। এঁরা রাজধানী স্থাপন করেন বাতাপীতে যা বর্তমানে বাদামি নামে পরিচিত (বর্তমানে কর্ণাটকের বাগালকোট জেলার অন্তর্ভুক্ত)। যে কারণে এঁদেরকে বলা হয় বাদামি চালুক্য। বাদামি চালুক্যরা ক্ষমতার শিখরে পৌঁছান রাজা দ্বিতীয় পুলকেশীর সময় (৬১০-৬৪২ সাধারণ অব্দ)। ৬২৪ সাধারণ অব্দে দ্বিতীয় পুলকেশী বিষ্ণুকুন্দিয়ানদের পরাজিত করে ভেঙ্গি অঞ্চল (বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের গোদাবরী এবং কৃষ্ণা জেলা) অধিকার করে নেন এবং তাঁর ভাই কুব্জা বিষ্ণুবর্ধনকে এই অঞ্চলের শাসক হিসাবে নিযুক্ত করেন। দ্বিতীয় পুলকেশীর মৃত্যুর পর, কুব্জা  বিষ্ণুবর্ধনের বংশধরেরা বাদামি চালুক্যদের অধীনতা অস্বীকার করে স্বাধীনভাবে রাজ্যপাট শুরু করেন। এঁদেরকে বলা হয় পূর্বীয় চালুক্য। যেহেতু এঁদের রাজধানী ছিল ভেঙ্গি, তাই এঁদেরকে ভেঙ্গির চালুক্যও বলা হয়ে থাকে। বাদামি চালুক্যদের পতন হয় ৭৫৩ সাধারণ অব্দে রাষ্ট্রকূটদের হাতে, যাঁরা তার আগে ছিলেন বাদামি চালুক্যদেরই করদ রাজা। বাদামি চালুক্যদের পতন হলেও, ভেঙ্গির চালুক্যদের শাসন চলতে থাকে সাধারণ অব্দের একাদশ শতক পর্যন্ত। তবে এঁদের রাজত্ব সীমাবদ্ধ ছিল দাক্ষিণাত্যের উত্তর-পূর্ব ভাগে। এঁরা অধিকাংশ সময় দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য বড় রাজশক্তির সহায়ক রাজশক্তির ভূমিকা পালন করেই সন্তুষ্ট থেকেছিলেন এবং কখনোই, সেই অর্থে, দক্ষিণ ভারতের মূল রাজনৈতিক শক্তি জয়ে উঠতে পারেননি। সাধারণ অব্দের দশম শতকের একেবারে শেষের দিকে, বাদামি চালুক্যদের বংশধররা রাষ্ট্রকূটদের পরাজিত করে দাক্ষিণাত্যের উত্তর এবং পশ্চিম ভাগে আবার চালুক্য শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এঁদেরকে বলা হয় পশ্চিমি চালুক্য। এঁদের রাজধানী ছিল কল্যাণী (অধুনা কর্ণাটকের বিদার জেলার বাসবকল্যাণ)। সেই কারণে এদের কল্যাণী চালুক্যও বলা হয়ে থাকে। দ্বাদশ শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত এঁরা রাজত্ব করেন। এঁদের পর চালুক্য রাজত্বের পাকাপাকি অবসান ঘটে। উপরোক্ত তিনটি বংশশাখা ছাড়াও লতা (অধুনা গুজরাট)-এর চালুক্যরাও ছিলেন চালুক্যদের আর একটি শাখা।

বাদামি চালুক্যরা তাঁদের শাসনকালে প্রচুর হিন্দু মন্দির (অধিকাংশ শিবের মন্দির) নির্মাণ করেছিলেন। এই মন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছিল মূলত তাঁদের রাজধানী বাদামিতে এবং বাদামি সন্নিহিত মালপ্রভা নদীর অববাহিকার আইহোলে, পাট্টাদাকাল ও মহাকুটাতে এবং অধুনা তেলেঙ্গানার আলমপুরে।

বাদামি চালুক্যদের এই মন্দির নির্মাণের পিছনে মূল কারণ ছিল দু’টি। তার একটি হল রাজনৈতিক। বাদামি চালুক্যরা ছিলেন তৎকালীন দক্ষিণ ভারতের এক প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। এই মন্দিরগুলি ছিল সেই রাজনৈতিক ক্ষমতার অভিব্যক্তি। বাদামি চালুক্যদের প্রথমদিকের মন্দিরগুলির তুলনায় পরের দিকের মন্দিরগুলি ছিল আকারে অনেক বড় এবং অলংকরণের দিক দিয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ যা এই রাজনৈতিক শক্তির ক্রমন্নতির ধারণাকে আরও সুদৃঢ় করে। দ্বিতীয় কারণটি ছিল ধর্মীয়-সামাজিক। সাধারণ অব্দের ষষ্ঠ শতক থেকে নবম শতকে দক্ষিণ ভারতের ধর্মীয় পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। শিবভক্ত নায়ানার এবং বিষ্ণুভক্ত অলভারদের নেতৃত্বে পুরো দক্ষিণ ভারত জুড়ে শুরু হয় ভক্তি আন্দোলন। এই ভক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুধু যে বৈদিক/ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বিবর্তিত হচ্ছিল হিন্দুধর্মে, কেবল তাই নয়, বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্মকে প্রতিস্থাপিত করে হিন্দু ধর্ম উঠে আসে দক্ষিণ ভারতের প্রধান ধর্ম হিসাবে। ধর্মীয় পরিমণ্ডলের এই পরিবর্তনের প্রভাবে প্রভূত পরিমাণে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র এবং দর্শন রচনার সাথে সাথে প্রচুর হিন্দু মন্দির তৈরি হয় সারা দক্ষিণ ভারত জুড়ে। শুধু নতুন মন্দির নির্মাণ হওয়াই নয়, ভক্তি আন্দোলনের প্রভাবে অনেক বৈদিক দেবদেবীর মন্দির (যেমন- সূর্য মন্দির) রূপান্তরিত হয় শিব মন্দিরে।

বাদামি চালুক্যদের তৈরি করা এই মন্দিরগুলির ওপর পূর্বতন কদম্ব স্থাপত্যশৈলীর কিছুটা প্রভাব ছিল। কিন্তু তার সাথে সাথে অন্যান্য সমসাময়িক স্থাপত্যশৈলীর, বিশেষ করে উত্তর ভারতীয় গুপ্ত স্থাপত্যশৈলীরও বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ হয়েছিল বাদামি চালুক্যদের তৈরি করা এই মন্দিরগুলিতে। বস্তুত বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা মধ্যে দিয়ে উদ্ভূত হয় এক নতুন স্থাপত্যশৈলী, যাকে বলা হয় বাদামি চালুক্য স্থাপত্যশৈলী। এই স্থাপত্যশৈলীতে যেমন দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড়-বিমান (যে অংশে গর্ভগৃহ অবস্থিত) নির্মাণ প্রণালী মেনে মন্দির তৈরি হয়েছিল, তেমনি উত্তর ভারতীয় নাগর নির্মাণ প্রণালী মেনেও অনেক মন্দির তৈরি হয়েছিল।

মন্দির স্থাপত্যশৈলী নিয়ে এই পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল আইহোলে, ৪৫০ সাধারণ অব্দের সময় যখন বাদামি চালুক্যরা কদম্বদের করদ রাজা ছিলেন। স্বাধীন চালুক্যদের রাজধানী হওয়ার পর, আইহোলে শুরু হওয়া স্থাপত্যশৈলী আরো পরিশীলিত হয়ে ওঠে বাদামিতে। এই স্থাপত্যশৈলীর সর্বোত্তম বিকশিত রূপ দেখা যায় পাট্টাদাকালের মন্দিরগুলিতে, বিশেষত যে মন্দিরগুলি শেষ পর্যায়ে তৈরি হয়েছিল। বস্তুত আকারের বিশালতা এবং অলংকরণের চমৎকারিত্বের দিক থেকে পাট্টাদাকালের মন্দিরগুলির সমগোত্রীয় মন্দির, শুধু কাঞ্চিপুরম ছাড়া তৎকালীন ভারতবর্ষের আর কোথাও ছিলনা। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রকূটদের সময়ে নির্মিত ইলোরার বিখ্যাত কৈলাস মন্দিরের নির্মাণশৈলীর ওপরও পাট্টাদাকালের শেষ পর্যায়ে নির্মিত মন্দিরগুলির প্রভাব ছিল। পাট্টাদাকালের এই মন্দিরগুলিই এই লেখার আলোচ্য বিষয়।

পাট্টাদাকাল শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো রাজ্যাভিষেকের স্থান। পাট্টাদাকালের অন্য কয়েকটি নাম হলো ‘কিসুভোলাল’ যার মানে হল ‘লাল মাটির উপত্যকা’, ‘রক্তপুরা’ যার মানে হল ‘লাল শহর’ এবং ‘পট্টদা-কিসুভোলাল’ যার অর্থ হল ‘রাজ্যাভিষেকের জন্য লাল মাটির উপত্যকা’। বাদামি থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে মালপ্রভা নদীর তীরে এই পাট্টাদাকাল ছিল বাদামি চালুক্যদের রাজ্যাভিষেকের স্থান। পাট্টাদাকালকে বাদামি চালুক্যরা নিজেদের রাজ্যাভিষেকের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সম্ভবত এর স্থানমাহাত্ম্যের জন্য। এই পাট্টাদাকালে, মালপ্রভা নদী অভিমুখ পরিবর্তন করে উত্তরমুখী হয়। সেই জন্য পাট্টাদাকালকে একটি পুণ্য স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রসঙ্গত বাদামি চালুক্যদের কাছে মালপ্রভা নদীর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম (ঠিক যেমন বিজয়নগরের কাছে ছিল তুঙ্গভদ্রা নদী)।  

তবে পাট্টাদাকালের ইতিহাস সম্ভবত বাদামি চালুক্যদের ইতিহাসের থেকেও প্রাচীন। পাট্টাদাকালের উপরোক্ত জৈন বাসাদির প্রাঙ্গনে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্য চালিয়ে ইটের তৈরি একটি বড় মন্দির চত্বরের ধ্বংসাবশেষ এবং সমভঙ্গ অবস্থানে তীর্থঙ্করের একটি সুন্দর মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। মনে করা হয় যে এই মন্দির চত্বরটি বাদামি চালুক্যদের শাসনকালের একেবারে প্রথম দিকের বা তারও আগের। প্রাক-বাদামি চালুক্য ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান বাচিনাগুড্ডার অবস্থান পাট্টাদাকালের খুব কাছেই। Archaeological Survey of India এর মতে, শ্রীবিজয়ের বিবরণীতে পাট্টাদাকালের উল্লেখ আছে এবং টলেমি তার ভূগোলে পাট্টাদাকালকে “পেট্রিগ্যাল” বলে উল্লেখ করেছেন। বাদামি চালুক্যদের পতনের পর পাট্টাদাকাল রাষ্ট্রকূট শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। তারপর ক্রমানুসারে পাট্টাদাকাল পশ্চিমী চালুক্য, দিল্লি সুলতানি, বিজয়নগর সাম্রাজ্য, বিজাপুর সুলতানি, মুঘল সাম্রাজ্য, মারাঠা সাম্রাজ্য, এবং হায়দার আলী ও টিপু সুলতানের অধীনস্থ হয়। টিপু সুলতান ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর পাট্টাদাকাল ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাদামি চালুক্য রাজা – রাজা বিজয়াদিত্য (৬৯৬-৭৩৪ সাধারণ অব্দ), রাজা দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য (৭৩৪-৭৪৫ সাধারণ অব্দ) এবং রাজা দ্বিতীয় কীর্তিবর্মন (৭৪৫ -৭৫৫ সাধারণ অব্দ) -এর সময়ে পাট্টাদাকালে গড়ে ওঠে নয়টি মন্দির বিশিষ্ট এক মন্দির চত্বর। এই নয়টি মন্দিরের প্রত্যেকটিই ছিল শিবমন্দির। নয়’টি মন্দিরের চার’টি মন্দির তৈরি হয়েছিল দ্রাবিড়-বিমান নির্মাণ প্রণালী মেনে, চার’টি মন্দির তৈরি হয়েছিল নাগর নির্মাণ প্রণালী মেনে এবং একটি মন্দির (পাপনাথ মন্দির) তৈরি হয়েছিল এই দুই নির্মাণ প্রণালীর সংমিশ্রণে। পরবর্তীকালে, প্রায় একশত বছর পরে মূল মন্দির চত্বর থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে তৈরি হয় এক জৈন বাসাদি, রাষ্ট্রকূট রাজা দ্বিতীয় কৃষ্ণের পৃষ্ঠপোষকতায়। এই জৈন মন্দিরটি (বাসাদি) তৈরি হয়েছিল দ্রাবিড়-বিমান নির্মাণ প্রণালী মেনে। পাট্টাদাকালের এই মন্দিরগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিচে দেয়া হল।

কাদাসিদ্ধেশ্বর মন্দির

এই মন্দিরটি যখন তৈরি হয় তখনও বাদামি চালুক্য স্থাপত্যশৈলী সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে চলছিল। এই মন্দিরের গড়নে, বিশেষত মন্দিরের উপরিভাগে এই চলমান পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ সুস্পষ্ট। পূর্বমুখী এই মন্দিরটিতে আছে একটি বর্গাকৃতি গর্ভগৃহ এবং একটি আয়তাকার মণ্ডপ। গর্ভগৃহতে আছে পীঠের ওপর অধিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ। মন্দিরটি মাটির থেকে কিছুটা উঁচু স্তম্ভপাদপীঠের ওপর অধিষ্ঠিত। মন্দিরের স্তম্ভপাদপীঠ এবং মণ্ডপে দরজার দুপাশের দ্বারপালদের ওপরের দেওয়ালাগার দেখে মনে হয় যে এক সময় এই মন্দিরে মুখমণ্ডপ ছিল। মণ্ডপের দরজাটি পাঁচটি শাখা দিয়ে সাজানো যদিও শাখাগুলি এখন ক্ষয়ে গিয়েছে। মন্দিরের দেওয়ালে খুব একটা কারুকাজ নেই তবে দেওয়ালের উপরের দিকে মালা বহনকারীগণদের মূর্তি খোদাই করা আছে। মন্দিরের উপরিভাগ বক্ররেখা দ্বারা বেষ্টিত যা উত্তর ভারতীয় নাগর নির্মাণ প্রণালীর পরিচয় বহন করে। সুখনাসির গঠন বৈচিত্র্যহীন এবং পূর্বদিকে অভিক্ষিপ্ত। সুখনাসিটি ধনুকাকৃতি চৈত্যের ন্যায় ত্রিপত্র দিয়ে সাজানো যার ওপর নৃত্যরত শিব এবং পার্বতীর চিত্র খোদাই করা আছে। গর্ভগৃহের বাইরের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে আছে অর্ধনারীশ্বর (উত্তর দিকে), হরিহর (পশ্চিম দিকে) এবং শিবের (দক্ষিণ দিকে) মূর্তি। গর্ভগৃহের দরজার ওপরে যাচ্ছে আয়তাকার স্তম্ভ যা শাখা দিয়ে সাজানো। এই স্তম্ভের মাঝখানে আছে বসে থাকা শিব এবং পার্বতীর মূর্তি এবং দুই ধারে আছেন ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু। শাখার নিচে খোদাই করা আছে অনুচরদের প্রতিকৃতি।

গলগনাথ মন্দির

৭৫০ সাধারণ অব্দে এই মন্দিরটি যখন তৈরি হয় তখন বাদামি চালুক্য স্থাপত্যশৈলী তার বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। বস্তুত এই গলগনাথ মন্দিরটি নাগর নির্মাণ প্রণালীতে বাদামি চালুক্যদের নির্মিত মন্দিরগুলির মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ মন্দির। মন্দিরটি যখন তৈরি হয়েছিল তখন এতে ছিল গর্ভগৃহ, অন্তরাল, প্রদক্ষিণপথ, সভামণ্ডপ এবং মুখমণ্ডপ। প্রদক্ষিণপথটি ছিল গর্ভগৃহ এবং অন্তরালকে পরিবেষ্টন করে এবং চারিদিক দিয়ে ঢাকা। গর্ভগৃহতে ছিল শিবলিঙ্গ। এখন অবশ্য মণ্ডপগুলির শুধু মাত্র স্তম্ভপাদপীঠই টিকে আছে। প্রদক্ষিণপথের বাইরের দেওয়ালের বেশিরভাগটাই ভেঙ্গে গিয়েছে।

একসময় এই দক্ষিণপথের চার কোণে দেবকোষ্ঠ চন্দ্রাতপ ছিল যার মধ্যে এখন শুধু দক্ষিণদিকেরটাই এখন বর্তমান। এই চন্দ্রাতপটিতে আছে দুইটি বৃত্তাকার স্তম্ভ যেগুলির নিচের দিকটা দেখতে ফুলদানির মত আর ওপরের দিকটা দেখতে ঘটপাতার মত। এই চন্দ্রাতপে খোদাই করা আছে অন্ধকাসুরকে সংহার রত শিবের মূর্তি। অষ্টভুজ শিব গলায় মুণ্ডমালা এবং দেহে যজ্ঞোপবীত পরে ত্রিশূল দিয়ে অসুর নিধন করছেন। এই মূর্তির দুইদিকে আছে জালিকাযুক্ত জানালা।

স্তম্ভপাদপীঠের ভিত তিন ধাপ পাথর দিয়ে তৈরি। এই পাথরের ভিতের ওপর খোদাই করা আছে বামন এবং ধনুকাকৃতি চৈত্যের ছবি। পূর্বদিকে স্তম্ভপাদপীঠের ভিতের কিছু অংশ বাক্সের মত অভিক্ষিপ্ত। সেগুলোর ওপর খোদাই করা আছে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক ছবি। এইরকম একটি ছবিতে পঞ্চতন্ত্রের এক দুষ্ট বানর এবং আর একটি ছবিতে পঞ্চতন্ত্রেরই একটি দুই মুখওয়ালা পাখির গল্প বর্ণিত আছে। মন্দিরের উপরিভাগের উত্তরাংশ এখনও যথেষ্ট ভালো অবস্থায় আছে। শিখরের উপরিভাগে আছে অমালকা এবং কলস, যেগুলি এই মন্দিরের সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।

জম্বুলিঙ্গেশ্বর মন্দির

এই মন্দিরটি সম্ভবত তৈরি  হয়েছিল সাধারণ অব্দের সপ্তম শতকের মধ্যভাগে। পূর্বমুখী এই মন্দিরটি গর্ভগৃহ এবং মণ্ডপ নিয়ে গঠিত। গর্ভগৃহে, একটি পীঠের ওপর অধিষ্ঠিত আছে শিবলিঙ্গ। মন্দিরের পূর্বদিকে ছিল নন্দীমণ্ডপ, এখন শুধু যার ভিতের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এইখানে একসময় আগুয়মান নন্দীর একটি প্রতিচ্ছবি ছিল যা এখন ক্ষয়ে গিয়েছে। মন্দিরটি মাটির থেকে একটু উঁচু স্তম্ভপাদপীঠের ওপর অধিষ্ঠিত। স্তম্ভপাদপীঠের ভিত পাঁচ স্তর পাথর দিয়ে তৈরি। এর মধ্যে সবচেয়ে ওপরের স্তরটিতে খোদাই করা যাচ্ছে স্বল্পাকৃতির নর এবং পাখিদের ছবি। মন্দিরের দেওয়ালগুলির অলংকরণ করা হয়েছিল কারুকাজ করা আয়তাকার স্তম্ভ, জানালা এবং কুলুঙ্গি দিয়ে। গর্ভগৃহের দেওয়ালের ঠিক মাঝামাঝি যাচ্ছে কারুকাজ করা কুলুঙ্গি যার ঠিক ওপরে আছে খোদাই করা শিব (দক্ষিণ দিকে), সূর্য (পশ্চিম দিকে) এবং বিষ্ণুর (উত্তর দিকে) মূর্তি।

এই মন্দিরটিও নাগর নির্মাণ প্রণালী মেনে তৈরি হয়েছিল। এর শিখরের ওপরের একসময় ছিল অমালকা এবং কলস অবশ্য আজ আর সেগুলির অস্তিত্ব নেই। শিখর থেকে একটি ছোট সুখানসি সামনের দিকে অভিক্ষিপ্ত যা থেকে মনে করা হয় যে এই মন্দিরটি তৈরির সময়েও স্থাপত্যশৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত ছিল।     

চন্দ্রশেখর মন্দির

আনুমানিক ৭৫০ সাধারণ অব্দে নির্মিত এই মন্দিরটি গলগনাথ এবং সঙ্গমেশ্বর মন্দিরের মাঝখানে অবস্থিত। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট এবং প্রস্থ ১৭ ফুট। এই মন্দিরটি একটি ছোট গর্ভগৃহ এবং ঢাকা কক্ষ নিয়ে গঠিত। গর্ভগৃহের দুই দিকের দেওয়ালে আছে দেবকোষ্ঠ। দরজার বাজু শাখা দ্বারা সুসজ্জিত। গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারের দুই দিকে যাচ্ছে দ্বারপাল। এই মন্দিরের গর্ভগৃহের ওপর শিখর নেই।

সঙ্গমেশ্বর মন্দির

দ্রাবিড়-বিমান নির্মাণ প্রণালীতে তৈরি এই মন্দিরের তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ৭২০ সাধারণ অব্দে রাজা বিজয়াদিত্যের সময় (৬৮৬-৭৩৩ সাধারণ অব্দ)। তাঁর নামে এই মন্দিরের আদি নাম ছিল বিজয়শ্বর মন্দির। কিন্তু রাজা বিজয়াদিত্য এই মন্দিরের নির্মাণ শেষ করে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর মন্দিরের অসম্পূর্ণ কাজ পরবর্তীকালে ধাপে ধাপে শেষ করা হয়।

এই মন্দিরটি গর্ভগৃহ, একটি ছোট অন্তরাল, প্রদক্ষিণপথ এবং মণ্ডপ নিয়ে গঠিত। গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ অধিষ্ঠিত। অন্তরালের প্রত্যেক দেওয়ালে আছে অন্যান্য পূজ্য দেবতাদের খোদাই করা মূর্তি। প্রদক্ষিণপথটি ছিল গর্ভগৃহের তিন দিকে। প্রদক্ষিণপথে যাতে পর্যাপ্ত আলো থাকে তার জন্য এর উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিকে রয়েছে জানালা। মণ্ডপটি ছিল বিশাল বিশাল স্তম্ভ বিশিষ্ট। অনুমান করা হয় যে মণ্ডপের উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্ব দিকে ছিল মহামণ্ডপ। বর্তমানে মণ্ডপটির পশ্চিম দিকের দেওয়াল এবং দক্ষিণ দিকের দেওয়ালের কিছুটা অংশ বর্তমান।

মন্দিরটি মাটির থেকে কিছুটা উঁচুতে স্তম্ভপাদপীঠের ওপর অধিষ্ঠিত। মন্দিরের উপরের অংশটি দ্বি-স্তরীয়, যার একদম ওপরে রয়েছে চারদিকে বর্গাকৃতি পাথর দিয়ে তৈরি শিখর এবং কলস।

মন্দিরের মধ্যে একটি শিলালিপি রয়েছে যেইটি ১১৬৩ সাধারণ অব্দের। তাতে পশ্চিমী (কল্যাণী) চালুক্য রাজা তৃতীয় তায়ালা এবং তাঁর অধীনস্থ চন্দ্রভদ্রার নাম উল্লেখিত আছে।

বিরূপাক্ষ মন্দির

পাট্টাদাকাল মন্দির প্রাঙ্গণের সব থেকে বড় এবং সব থেকে কারুকার্য্যময় মন্দির হল বিরূপাক্ষ মন্দির। দ্রাবিড়-বিমান নির্মাণ প্রণালীতে নির্মিত এই মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল রাজা দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য (৭৩৩-৭৪৫ সাধারণ অব্দ)-এর পাটরানি লোকমহাদেবীর পৃষ্ঠপোষকতায়। সেই জন্য এই মন্দিরটির আদি নাম ছিল লোকেশ্বর মন্দির। তিনি এই মন্দিরটি রাজা দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের পল্লবদের রাজধানী কাঞ্চিপুরম বিজয় উপলক্ষে নির্মাণ করেছিলেন। এই মন্দিরের মূল নকশা কাঞ্চিপুরমের কৈলাসনাথ মন্দিরের নকশার অনুসারী।

পূর্বমুখী এই মন্দিরটি একটি বর্গাকার গর্ভগৃহ, প্রদক্ষিণপথ, একটি অন্তরাল এবং সভামণ্ডপ নিয়ে গঠিত। অন্তরালের সামনের দিকে আছে পরস্পরের মুখোমুখি গণেশ এবং মহিষাসুরমর্দিনীর ছোট মূর্তি। সভামণ্ডপের পূর্ব, উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে আছে সভামণ্ডপে প্রবেশ করার জন্য ছোট ঢাকা বারান্দা। মন্দিরের পূর্বদিকে যাচ্ছে আলাদা নন্দীমণ্ডপ।

এই মন্দির এবং নন্দীমণ্ডপ উঁচু প্রাকার দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। একসময় এই দেওয়ালের ভিতরের দিকে ছিল অন্যান্য আরাধ্য দেব-দেবীর ৩২টি মূর্তি। এখন তার অল্প কয়েকটি বর্তমান। এই প্রাকার দেওয়ালের পশ্চিম এবং পূর্ব দিকে রয়েছে সুসজ্জিত তোরণদ্বার। মন্দিরটি মাটির থেকে কিছুটা উঁচুতে স্তম্ভপাদপীঠের ওপর অধিষ্ঠিত। স্তম্ভপাদপীঠের ভিত পাথরের পাঁচটি স্তর দিয়ে তৈরি। মন্দিরের গর্ভগৃহের দেয়ালের বাইরের দিকের পাঁচটি অংশ অভিক্ষিপ্ত – কেন্দ্রীয় অক্ষের অংশ, দুই কোণ এবং কোণ ও কেন্দ্রীয় অক্ষের মধ্যবর্তী অংশ। উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিমদিকের বারান্দার দুই দিকের মণ্ডপের দেয়ালেও দুইটি অংশ অভিক্ষিপ্ত এবং দুইটি অংশ একটু ভিতরের দিকে ঢোকা। গর্ভগৃহের অভিক্ষিপ্ত অংশের ওপর রয়েছে কুলুঙ্গি। এই কুলুঙ্গিতে রয়েছে বিভিন্ন শৈব এবং বৈষ্ণব দেবতা, যেমন ভৈরব, নরসিংহ, হরি-হর ইত্যাদির খোদাই করা প্রতিচ্ছবি। দেয়ালের যে অংশগুলি একটু ভিতরের দিকে ঢোকা সেখানে রয়েছে ছিদ্রযুক্ত জানালা। মন্দিরের ওপরের অংশটি ত্রিস্তরীয়। এর শিখরটি বর্গাকৃতির। শিখরের ওপরে রয়েছে কলস।

এই মন্দিরের ভিতরের অংশের পুরোটাই খুব সুন্দর ভাস্কর্যের দ্বারা সুসজ্জিত। রামায়ণ (সীতা হরণ), মহাভারত (ভীষ্মের শরশয্যা), ভগবদ্গীতার (কৃষ্ণের গোবর্দ্ধন পাহাড় উত্তোলন) কাহিনী খোদাই করা আছে সভামণ্ডপের স্তম্ভগুলিতে। বস্তুত এই বিরূপাক্ষ মন্দিরকে মনে করা হয় বাদামি চালুক্য স্থাপত্যশৈলীর সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্করণ। এই মন্দিরের দুই মূল স্থপতি ছিলেন গুণ্ড-অনভ্যারিতাচারী এবং সর্বসিদ্ধি-আচারি।

মল্লিকার্জুন মন্দির

দ্রাবিড়-বিমান নির্মাণ প্রণালীর এই মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল রানী লোকমহাদেবীর বোন এবং রাজা দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের কনিষ্ঠা পত্নী রানী ত্রিলোকমহাদেবীর পৃষ্ঠপোষকতায়। ত্রিলোকমহাদেবীর পুত্র দ্বিতীয় কীর্তিবর্মন ছিলেন বাদামি চালুক্যদের শেষ রাজা। এই মন্দিরে পাওয়া একটি লিপিতে এই মন্দিরকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘ত্রিলোকেশ্বর মহা শৈল প্রাসাদ’ বলে। এই মন্দিরটি তৈরির উপলক্ষও ছিল রাজা দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের পল্লবদের কাঞ্চিপুরম বিজয়। শুধুমাত্র উপলক্ষের দিক থেকেই নয়, এমনকি গঠনরীতির দিক থেকেও বিরূপাক্ষ মন্দিরের সাথে এই মন্দিরের প্রচুর মিল আছে। সম্ভবত একই কারিগররা বিরূপাক্ষ মন্দির এবং মল্লিকার্জুন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

এই মন্দিরটিও অধিষ্ঠিত মাটি থেকে বেশ কিছুটা উঁচু স্তম্ভপাদপীঠের ওপর। মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল একটি গর্ভগৃহ, প্রদক্ষিণপথ, অন্তরাল, সভামণ্ডপ এবং আলাদা নন্দীমণ্ডপ নিয়ে। অন্তরালের প্রবেশদ্বারের দুপাশে একসময় ছিল গণেশ এবং মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি। সভামণ্ডপে প্রবেশের জন্য উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্বদিকে ছিল ছোট বারান্দা। নন্দীমণ্ডপটি মূল মন্দিরের পূর্বদিকে।

গঠনের দিক দিয়ে এই মন্দিরের সাথে বিরূপাক্ষ মন্দিরের প্রচুর মিল থাকলেও, এক-দু’টো গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যও ছিল। একটি পার্থক্য হচ্ছে মল্লিকার্জুন মন্দিরের উপরিভাগের সর্বোচ্চ স্তরে ‘হার’ উপাদান যেমন কুট, সল এগুলির অনুপস্থিতি যা বাদামি চালুক্য স্থাপত্যশৈলীর বিবর্তনের পরিচায়ক। আর একটি পার্থক্য হল যে মল্লিকার্জুন মন্দিরের শিখর অর্ধগোলাকার, যেখানে বিরূপাক্ষ মন্দিরের শিখর বর্গাকার।

কাশীবিশ্বেশ্বর মন্দির

সাধারণ অব্দের অষ্টম শতকের মধ্যভাগে তৈরি হওয়া এই মন্দিরটি সম্ভবত পাট্টাদাকালে বাদামি চালুক্যদের তৈরি করা শেষ মন্দির। মাটি থেকে বেশ কিছুটা উঁচু স্তম্ভপাদপীঠের ওপর অধিষ্ঠিত এই মন্দিরটি একটি গর্ভগৃহ, একটি অন্তরাল এবং একটি মণ্ডপের সমন্বয়ে তৈরি। গর্ভগৃহের ভিতর একটি বর্গাকার পীঠের ওপর শিবলিঙ্গটি অধিষ্ঠিত। গর্ভগৃহের উত্তর অংশে আছে প্রনালা। মণ্ডপের পূর্ব দিকে আছে একটি ছোট মুখমণ্ডপের স্তম্ভপাদপীঠ এবং তারও পূর্বদিকে আছে নন্দীমণ্ডপের বাঁধানো ভিত। এখন নন্দীমণ্ডপে দু’টি বর্গাকার স্তম্ভ এবং এগিয়ে আসা নন্দীমূর্তি টিকে আছে।

মণ্ডপে ঢোকার দরজাটি পাঁচ’টি শাখা দ্বারা সুসজ্জিত। শাখার নিচ্ছে নদনদীর দেবীর প্রতিচ্ছবি খোদিত। চৌকাঠের ললাটবিম্বতে আছে সাপ হাতে গরুড়ের প্রতিচ্ছবি। মণ্ডপের স্তম্ভের দেওয়ালে খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভাগবত এবং শিবপুরাণের বিভিন্ন কাহিনী। ছাদে খোদাই করা আছে শিব, কার্তিক এবং গণেশকে নিয়ে পার্বতীর এবং অষ্টদিকপালদের নিয়ে নন্দীর সুদৃশ্য প্রতিচ্ছবি।  মণ্ডপের উত্তর দেওয়ালের  কুলুঙ্গিতে আছে অর্ধনারীশ্বর এবং কালভৈরবের খোদাই করা প্রতিচ্ছবি। মণ্ডপের পূর্বদিকের দেওয়ালে দু’টি দেওয়ালাগার দেখে মনে করা হয় যে একসময় এখানে আচ্ছাদিত বারান্দা ছিল। অন্তরালের প্রবেশদ্বারও মণ্ডপের প্রবেশদ্বারের মত।অন্তরালের প্রবেশদ্বারের দুপাশে আছে শৈব দ্বারপালের খোদিত প্রতিচ্ছবি।

মন্দিরের উপরিভাগ পরিপূর্ণ বিকশিত নাগর নির্মাণ প্রণালী মেনে তৈরি। শিখরটি পাঁচস্তরীয় যদিও বর্তমানে অমালকা এবং কলস আর নেই। শিখরের উপরিতল জালি নকশা দিয়ে ঢাকা। সম্পূর্ণ বিকশিত সুখানসিতে নৃত্যরত উমামহেশ্বরের সুন্দর প্রতিচ্ছবি খোদিত আছে।

পাপনাথ মন্দির

উত্তর ভারতীয় নাগর এবং দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড়-বিমান নির্মাণ প্রণালীর সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া এই মন্দিরটি বাদামি চালুক্য শাসনের শেষের দিকের মন্দির। এই মন্দিরের নির্মাণকার্য সম্ভবত শেষ হয়েছিল ৭৪০ সাধারণ অব্দে। মন্দিরে পাওয়া লিপি অনুযায়ী এই মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়েছিল মুক্তেশ্বরের প্রতি। এই মন্দিরটির গঠন দেখে মনে হয় যে নির্মাণ চলাকালীন মন্দিরটির গঠন পরিকল্পনায় বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছিল। মন্দিরের প্রদক্ষিণপথটি অত্যন্ত সরু এবং প্রদক্ষিণপথের মেঝের পাথরের চাঙড় গর্ভগৃহের বাইরের দেয়ালের ঢালাইকে অনেকটা ঢেকে রেখেছে। এছাড়া গর্ভগৃহের উত্তর এবং দক্ষিণদিকের দেওয়াল থেকে একটা অংশ উলম্বের মত অভিক্ষিপ্ত হয়েছে অর্ধমণ্ডপে। সেই সময়ে বাদামি চালুক্যদের তৈরি করা অন্যান্য মন্দিরে এইসব গঠনগত বৈশিষ্ট্যগুলি সচরাচর দেখা যায়না। 

পূর্বমুখী এই মন্দিরটিতে আছে একটি গর্ভগৃহ, গর্ভগৃহকে ঘিরে থাকা প্রদক্ষিণপথ, অর্ধমণ্ডপ, সভামণ্ডপ এবং মুখমণ্ডপ। লক্ষণীয়ভাবে এই মন্দিরে কোন নন্দীমণ্ডপ নেই। তবে সভামণ্ডপের পূর্বভাগে নন্দীর একটি সুসজ্জিত প্রতিচ্ছবি আছে। মন্দিরটি মাটি থেকে উঁচু স্তম্ভপাদপীঠের ওপর অধিষ্ঠিত। স্তম্ভপাদপীঠের ভিত পাঁচস্তরীয় পাথর দিয়ে তৈরি যার বাইরের আবরণের ওপর খোদাই করা আছে বিভিন্ন পশুপাখি এবং ফুলের প্রতিচ্ছবি। মন্দিরের দেওয়ালের ওপর খোদাই করা আছে বিভিন্ন শৈব এবং বৈষ্ণব দেবদেবীর প্রতিচ্ছবি এবং রামায়ণের গল্প। কুলুঙ্গির ওপর আছে বিভিন্ন নকশার ধনুকাকৃতি চৈত্য। চৈত্যগুলির মাঝখানে আছে জালিকা যুক্ত জানালা। এই মন্দিরের একটি বৈশিষ্ট্য হলো পরিপূর্ণ বিকশিত নাগর নির্মাণ প্রণালীতে তৈরি শিখর। সুখানসির সামনের দিকে আছে নটরাজ মূর্তি এবং সূক্ষ্ম কাজ করা ধনুকাকৃতি চৈত্য। তবে মন্দিরের অমালকা এবং কলস এখন আর নেই।

লিপিযুক্ত একশিলাস্তম্ভ

মল্লিকার্জুন মন্দিরের সামনে পাথরের একটি অষ্টকোণী স্তম্ভের ওপর সাধারণ অব্দের অষ্টম শতকের একটি লিপি পাওয়া গিয়েছে যা সিদ্ধমাতৃকা এবং সাধারণ অব্দের অষ্টম শতকের কন্নড়-তেলেগু হরফে লেখা। এই লিপির শুরু হয়েছে শিব এবং হরগৌরীর স্তোত্র দিয়ে। এই লিপিতে জনৈক জ্ঞানশিবাচার্যের , যিনি গঙ্গার উত্তর পাড়ের এক গ্রাম মৃগথানিকাহারা-বিশ্ব থেকে এসেছিলেন এবং বিজয়েশ্বর মন্দিরে (বর্তমানে সঙ্গমেশ্বর মন্দির) কিছুদিন ছিলেন, তার দ্বারা একটি ত্রিশূল স্তম্ভ (‘ত্রিশূল-মুদ্রাঙ্কিত শৈল-স্তম্ভ) স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এই ত্রিশূলটি স্থাপন করা হয়েছিল লোকেশ্বর মন্দিরের (বর্তমানে বিরূপাক্ষ মন্দির) দক্ষিণে এবং ত্রিলোকেশ্বর মন্দিরের (বর্তমানে মল্লিকার্জুন মন্দির) পশ্চিমদিকে। এই লিপি অনুযায়ী জ্ঞানশিবাচার্য জনৈক আর্যভট্টর কাছ থেকে আরাপুনিস গ্রামে ৩০ নবরত্ন জমি কিনে তা বিজয়েশ্বর মন্দিরের (বর্তমানে সঙ্গমেশ্বর মন্দির) সেবার জন্য দান করেছিলেন। আর্যভট্ট এই জমিটি পেয়েছিলেন বিজয়াদিত্যের কাছ থেকে। এই জমিদানের ঘটনাটি ঘটেছিল সম্ভবত দ্বিতীয় কীর্তিবর্মনের সময়ে।

জৈন মন্দির (বাসাদি)

মূল মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে আছে এই জৈন মন্দিরটি। এই মন্দিরটিকে স্থানীয় অধিবাসীরা বলে থাকেন ‘জৈন নারায়ণ’-এর মন্দির। এই মন্দিরটি সম্ভবত তৈরি হয়েছিল সাধারণ অব্দের নবম শতকে, রাষ্ট্রকূট রাজা দ্বিতীয় কৃষ্ণের সময়ে (৮৮০-৯১৫ সাধারণ অব্দ)।

তিনতলা বিশিষ্ট এই মন্দিরের নিচের তলাটি গঠিত একটি বর্গাকার গর্ভগৃহ, গর্ভগৃহকে ঘিরে থাকা প্রদক্ষিণপথ, অন্তরাল, মণ্ডপ এবং মুখমণ্ডপ নিয়ে। প্রদক্ষিণপথের দেওয়ালগুলি এখন ভেঙ্গে গিয়েছে। মন্দিরটির দেওয়ালের মাঝের অংশটি অভিক্ষিপ্ত। দেওয়ালগুলি একাধিক স্থাপত্য উপাদান যেমন কুট (বর্গক্ষেত্র), সল (আয়তক্ষেত্র) এবং পিঞ্জরা (দেবদেবীর ছোট মূর্তি) দ্বারা সুসজ্জিত। মণ্ডপের প্রবেশদ্বারের দেহলী ছ’টি শাখা দ্বারা সুসজ্জিত। মণ্ডপ এবং অন্তরাল বিশালাকার স্তম্ভ বিশিষ্ট। গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বার পাঁচ’টি শাখা দ্বারা সুসজ্জিত।

মন্দিরের দ্বিতীয় তলাটিরও গঠন নিচের তোলার মত তবে আকারে ছোট। এর অন্তরালের সামনের দিকটি সুখনাসির তলদেশ দিয়ে ঢাকা। বাকি তিন দিকে উন্নত বিপ্রের ওপর রয়েছে কর্ণকূট এবং সল। তৃতীয় তলাটি আরও কম চওড়া। তৃতীয় তলার সামনের দিক ছাড়া বাকি সব দিকের দেওয়াল কারুকার্যবিশিষ্ট।

বাদামি চালুক্যদের সময় উত্তর ভারতীয় রেখানাগর এবং দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড়-বিমান নির্মাণ প্রণালীর মধ্যে যে আদান-প্রদান এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়, পাট্টাদাকালের মন্দিরগুলি তারই সাক্ষ্য বহন করে। পঞ্চম শতকে আইহোলে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধাত্রীগৃহ হিসাবে কাজ করে। আইহোলেতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যে স্থাপত্যশৈলী উদ্ভূত হয়, তা আরও পরিশীলিত হয় বাদামিতে সাধারণ অব্দের ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে এবং সাধারণ অব্দের অষ্টম শতকে সেই স্থাপত্যশৈলী সম্পূর্ণ বিকশিত হয় পাট্টাদাকালে যা UNESO’র ভাষায়  “the apogee of an eclectic art which, in the 7th and 8th centuries, achieved a harmonious blend of architectural forms from the north and south of India”

তথ্যসূত্রঃ

১) Karnataka’s Rich Heritage, Art and Architecture, From Prehistoric Times to the Hoysala Period by Lalit Chugh (Notion Press, 2016)

২) The Illustrated History of South India, From Prehistoric Times to the Fall of Vijaynagar by K.A.Nilkanta Sastri (Oxford University Press, 2009)

৩) India A History: From the Earliest Civilisation to the Boom of the Twenty-First Century by John Keay (Harper Collins, 2010)

৪) A concise history of South India – Issues & Interpretation: Edited by Noboru Karashima (Oxford University Press, 2014)

৫) The Penguin History of Early India, From Origins to AD 1300 by Romila Thapar (Kindle Edition)

৬) ASI Boards at site

৭) https://en.wikipedia.org/wiki/Vengi#:~:text=Vengi%20%20is%20a,Andhra%centuries.

8) https://en.wikipedia.org/wiki/Pattadakal

৯) Field Study by the Author

লেখক মুম্বাইতে স্বনিযুক্ত শান্তনু কারিগরিবিদ্যায় স্নাতক এবং ফিনান্স'এ এম.বি.এ। পেশার বাইরে শান্তনু'র শখ হলো নতুন জায়গা ঘুরে দেখা এবং ইতিহাসচর্চাকরা।

মন্তব্য তালিকা - “পাট্টাদাকাল”

  1. ভালো লাগলো । বর্তমান কর্ণাটকে প্রাচীন শৈবমন্দিরগুলির স্থাপত্য নিয়ে এখানে সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ মনোজ্ঞ আলোচনা সমৃদ্ধ করলো । তবে যে প্রেক্ষিতে এই মন্দিরগুলো নির্মিত হয়েছিল , অর্থাৎ সনাতন হিন্দুধর্মের অভ্যুত্থান ও বৈদিক ধর্মের ভিত্তির উপর ভক্তিবাদের অভ্যুত্থান সে সম্পর্কে শুধু উল্লেখ আছে । একটু বিশদে জানার আগ্রহ রইলো লেখকের কাছে ।

    1. হিন্দু ধর্মের উত্থান নিয়ে লিখতে গেলে দক্ষিণ ভারতের ভক্তি আন্দোলন নিয়ে লিখতে হবে| ভবিষ্যতে চেষ্টা করব|

  2. ভালোই লিখেছেন। আমরা বারদুয়েক ওদিকে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেসব নিয়ে লিখেছিলাম “বেলুড় থেকে বাদামি”। পাট্টাডাকল দারুণ লেগেছিল আমাদের।

  3. পড়ে খুব ভালো লাগলো। বিজয়নগরের এবং হামপির সম্বন্ধে জানতে পারলে ভালো লাগবে। শাক্ত এবং বৈষ্ণবদের উত্থান সম্বন্ধে একটু বিস্তারিত জানার ইচ্ছে রইলো।

  4. খুব ভাল লাগল।অনেক কিছুই জানলাম।
    তবে আমার খুব জানার ইচ্ছে দক্ষিণ ভারতে সব মন্দিরের সামনে একটি লম্বা পিলার দক্ষ যায়। সেটা কিসের জন্যে যদি জানতে পারি খুব ভালো হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।