সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

মন্মথনাথ ঘোষ ও যশোরের চিরুনি

মন্মথনাথ ঘোষ ও যশোরের চিরুনি

শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়

নভেম্বর ১, ২০২৫ ৬৬ 1

শুরুর কথা

বাঙালির বড়ো বিশেষণ, সে ‘আত্মবিস্মৃত জাতি’। এছাড়াও আছে তার নানা বিশেষণ—ঘরকুনো বাঙালি, ভ্রমণবিলাসী বাঙালি, ভোজনরসিক বাঙালি, ভেতো বাঙালি, কেরানি বাঙালি, আঁতেল বাঙালি! ব্যবসা বাণিজ্যে উদ্যোগী বাঙালির কথা তো  তেমন শোনা যায় না। দু’একজন ব্যতিক্রমী উদ্যোগী বাঙালির মধ্যে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বা স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জী—এদের কথাই আমরা জানি, শুনি। আবার অনেকে বলেন  ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থে বাঙালিকে হয় ‘বাবু’ নয় তো ‘কেরানি’ বানিয়েছে।

তবে  স্রোতের বিপরীতে চলার মতো মানুষেরাও চিরদিন ছিলেন, থাকবেনও নিশ্চয়ই। বাঁধা ছন্দের বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা। অনিশ্চিতের আশংকা আর ঝুঁকিকে উপেক্ষা করে পা বাড়াতেন অজানা ভবিষ্যতের পথে। উনিশ-বিশ শতকের এমনই এক বিরল বাঙালির কথা আজ বলা যাক। মন্মথনাথ ঘোষ (১০/৭/১৮৮২–২০/৩/১৯৪৪)।

জাপানে মন্মথনাথ ঘোষ

অবিভক্ত বাংলার এক উদ্যোগপতি যুবক মন্মথনাথ ঘোষ। মন্মথনাথের সুযোগ্য পুত্র কুমারেশ ঘোষ তাঁর পিতার সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেছেন, ‘আচার্যদেব যখন কোনো বাঙালী যুবককে ব্যবসায়ে নামতে দেখতেন অর্থাৎ চাকরির নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে কোনো বঙ্গ তরুণকে বাণিজ্যের মাধ্যমে চঞ্চলা লক্ষ্মীর কৃপালাভ করার চেষ্টা করতে দেখতেন তখন তিনি আনন্দে আত্মহারাই হতেন প্রায়। তার পিঠ চাপড়ে বলতেন  জিতে রহো বেটা’। আচার্যদেবের কাছ থেকে এমনতর উৎসাহ তৎকালীন বহু বঙ্গ তরুণই পেয়েছিলেন এবং আমার পিতৃদেব স্বর্গীয় মন্মথনাথ ঘোষ, ব্যবসায় মহলে যিনি এম এন ঘোষ নামেই পরিচিত—তাঁরই অন্যতম আশীর্বাদ-পুত বঙ্গ সন্তান।’

মন্মথনাথ ঘোষ জন্মেছিলেন ১৮৮২ সালের ১০ জুলাই যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহাকুমার অন্তর্গত মথুরাপুর গ্রামে। ছেলেবেলা থেকেই তিনি খেলাধূলা, পড়াশুনা দুটি বিষয়েই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। মাত্র আট বছর বয়সে প্রাথমিক পরীক্ষায় যশোর জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য রাঁচিতে মামার বাড়িতে চলে যান এবং রাঁচি জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সরকারি বৃত্তি লাভ করেন।

এফ.এ পাশ করে বি.এ পড়ার সময় মন্মথর মনে স্বদেশ প্রেমের চিন্তা এসেছিল। তিনি বুঝতে পারেন, ইংরেজরা উন্নত জাতি, প্রায় সারা পৃথিবী তারা শাসন করছে—এর মূলে রয়েছে তাদের শিল্প বাণিজ্য। তাঁর মনে হয়েছিল, শুধু বই পড়ে পাশ করে হয়তো নিজের জীবনের সামান্য উন্নতি ঘটানো সম্ভব কিন্তু তাতে দেশের এবং দরিদ্র দেশবাসীর অগ্রগতি ঘটানো সম্ভব নয়। এমন কোনো মৌলিক পথের সন্ধান করতে হবে যাতে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রগতির পথে হাঁটা যায়। মন্মথ স্থির করেন বিদেশে গিয়ে বিভিন্ন কারিগরি বিদ্যা শিখে দেশবাসীর কাছে সেই বিদ্যার সুফল পৌঁছে দিতে হবে। তিনি সেই সময়ে এশিয়ার মধ্যে শিল্পে বাণিজ্যে সর্বোন্নত দেশ জাপান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

তখনকার দিনে বিদেশে যাওয়া এখনকার মতো সহজ ছিল না। কালাপানি পার হতে লাগত মনের জোর আর সেই সঙ্গে অর্থের সংস্থান। ফিরে আসার পরও দরকার হত ধৈর্যের ও দৃঢ়তার। বিদেশি শাসকের অধীনে স্বাধীন ব্যবসা করা বা শিল্প কাঠামো তৈরি করা ছিল কল্পনাতীত। এই পরিস্থিতি মেনে নিয়েই মন্মথ বিলেতে না গিয়ে দু’তিনজন বন্ধুসহ দেশের শিল্পের উন্নতির আশায় গেলেন জাপানে। এ বিষয়ে উৎসাহ পেলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের কাছ থেকে, আর্থিক সাহায্য জুটলো কাশিমবাজার ও নলডাঙ্গার রাজাদের কাছ থেকে৷

১৯০৬ সালের ১ এপ্রিল মন্মথ ‘এম এম লঙ্কা’ জাহাজে জাপান যাত্রা করেন। ৫ এপ্রিল মন্মথ এবং তাঁর শিক্ষার্থী সহযাত্রীরা রেঙ্গুনে জাহাজ বদল করে ‘ওব্রা ‘ নামের জাহাজে চড়ে ৩০ এপ্রিল জাপানের ইয়াকোহামা বন্দরে পৌঁছান। ইয়াকোহামা থেকে তোকিও এবং সেখান থেকে বোতাম শিল্পের কারিগরি শিক্ষা লাভের জন্য মন্মথ এবং মহিমচন্দ্র সেন কোবে শহরে যাত্রা করেন। মন্মথ যখন জাপানে গিয়েছিলেন থাকেন বাংলায় বোতাম শিল্পের রমরমা। ঝিনুক, পশুর হাড়, ধাতু ইত্যাদি নানা দ্রব্য দিয়ে বোতাম তৈরি হলেও বোতাম তৈরিতে তখনও সেলুলয়েডের ব্যবহার শুরু হয়নি।

মন্মথ জাপান যাবার আগে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁকে সেলুলয়েড তৈরির কারিগরি কৌশল আয়ত্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু জাপানে পৌঁছে দেখলেন, নিজের পছন্দমতো বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা নেব বললেই, সেটা সম্ভব নয়। কোবে-তে কুছাকারি নামে এক ভারতপ্রেমী ইঞ্জিনিয়ারের আশ্রয়ে থেকে তাঁর সাহায্যে মন্মথ এবং মহিম একটি বোতাম ফ্যাক্টরিতে আধুনিক বোতাম তৈরির কারিগরি বিদ্যা অর্জনের সুযোগ পান। এখানেই মন্মথর সঙ্গে সেলুলয়েডের প্রথম পরিচয় ঘটে। তখনকার দিনে জাপানের কোনো ফ্যাক্টরিতে শিক্ষানবীশ হিসেবে সুযোগ পাওয়া দুজন ভারতীয় ছাত্রের কাছে মোটেই সহজ কাজ ছিল না। জাপানিরা স্বভাব-বিনয়ী হলেও সহজে বিদেশীদের বিশ্বাস করে না, বিদেশীদের তারা খানিকটা সন্দেহের চোখেই দেখত।

কাজ শেখার পাশাপাশি মন্মথ আয়ত্ত করলেন জাপানি ভাষা বলা ও লেখার দক্ষতা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নির্দেশ অনুযায়ী মন্মথর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেলুলয়েড উৎপাদনের কারিগরি বিদ্যা আয়ত্ত করা। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন সমগ্র জাপানের একমাত্র ওসাকা শহরে একটিমাত্র সেলুলয়েড উৎপাদনের কারখানা আছে। ওই উৎপাদন কারখানার মালিক উরাইয়ামা নিজে বিপুল অর্থ ব্যয় করে আমেরিকা থেকে সেলুলয়েড তৈরির কৌশল শিখে এসেছেন। তিনি সেলুলয়েড উৎপাদনের কৌশল শেখানো তো দূরের কথা, ঐ উৎপাদন কেন্দ্রের ত্রিসীমানায় কাউকে আসতে দেন না। অনেক কসরত করে মন্মথ ফ্যাক্টরিতে শিক্ষানবীশ হওয়ার সুযোগ পান। বলা বাহুল্য, মন্মথই ঐ কারখানার প্রথম বহিরাগত শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থী হিসেবে কারখানায় যোগ দেওয়ার পর মন্মথকে বিভিন্ন মেশিন মোছা, তেল দেওয়া ইত্যাদি কাজ শিখতে হয়েছিল। ফলে বিভিন্ন মেশিন সম্পর্কে তাঁর একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা তৈরি হয়। নির্দিষ্ট অনুপাতে কার্পাস তুলো এবং কর্পূরের মিশ্রণে নানা ধরনের রাসায়নিক যোগ করে তার উপর বাষ্পীয় তাপ প্রয়োগ করে কীভাবে সেলুলয়েড মণ্ড তৈরি করা হয় সেই পদ্ধতি শিখলেন।

উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পাশ্চাত্য দেশে সেলুলয়েড তৈরি হয় নাইট্রোসেলুলোজের সঙ্গে কর্পূর, অ্যালকোহল ইত্যাদি মিশিয়ে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে। কর্পূরের উপস্থিতির জন্য এই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আগুনের উপস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রঙিন সেলুলয়েড তৈরিতে ব্যবহার করা হত বিভিন্ন জৈব ও অজৈব রঞ্জক। সেলুলয়েডের মণ্ড থেকে বিভিন্ন ধরনের মেশিনে বিভিন্ন ধরনের সেলুলয়েড পাত (sheet) তৈরি হত। শিক্ষার্থী হিসেবে সেলুলয়েড কারখানার দুর্লভ শিক্ষা শেষ করে তিনি ওসাকার একটি চিরুনি উৎপাদন কারখানার থেকে চিরুনি উৎপাদনের কৌশল শিখেছিলেন। এছাড়াও কৃত্রিম চামড়া, অয়েল ক্লথ, ছাতা, ছাতার হাতল, মাদুর প্রভৃতি উৎপাদনের কৌশলও শিখেছিলেন। এইসব কাজ শিখতে তাঁর আট মাস সময় লেগেছিল। কিন্তু এর পর আরও কয়েক মাস তাঁকে ওসাকায় থেকে যেতে হয়। কারণ বিভিন্ন ঋতুতে উৎপাদিত সেলুলয়েডের মান নির্দিষ্ট রাখতে প্রস্তুত প্রণালীর কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটাতে হয়, এইটিও ছিল মন্মথর শিক্ষণীয় বিষয়। এরপর তিনি কর্পূরের প্রস্তুত প্রণালী শেখার জন্য কোবে-তে জাপানের ‘Camphor Bureau’ র সর্ববৃহৎ কারখানায় শিক্ষানবিশী শুরু করেন।

কঠোর পরিশ্রম, পড়াশুনা এবং শিক্ষক-সহকর্মীদের আন্তরিক সাহায্যে তিনি ১৯০৯ সালের শেষের দিকে, মাত্র এক বছরের মধ্যে কর্পূর তৈরির শিক্ষা সমাপ্ত করে দেশে ফেরেন। দেশে ফিরে মন্মথ প্রথমেই দেখা করলেন তাঁর গ্রামের জমিদার প্রমথভূষণ দেবরায়ের সঙ্গে। প্রমথভূষণ মন্মথর বিদেশ যাত্রার সময় তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। যশোর শহরে একটি চিরুনি ও বোতামের কারখানা স্থাপনের জন্য মন্মথ জমিদারবাবুর কাছে প্রস্তাব রাখলেন। তিনি কালবিলম্ব না করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কাশিমবাজারের মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব বাহাদুর বড়ো অংকের টাকার শেয়ার কিনে মন্মথকে কারখানা স্থাপনে সাহায্য করেন। যশোর রেল স্টেশনের কাছে কারখানাটি স্থাপিত হল, নাম Jessore Comb, Button and Mat Manufacturing Company Ltd.

কলকাতা বা ঢাকা শহরে নয়; নিজের দেশ যশোরে প্রতিষ্ঠা করলেন চিরুনি তৈরির কারখানা, যাতে সেখানকার লোকেরা কারখানায় কাজ শিখে অন্নসংস্থান করতে পারে। সারা বাংলাদেশ শুধু নয়, সারা ভারতবর্ষে উৎকৃষ্ট ‘যশোরের চিরুনি’ বিখ্যাত হয়ে গেল।

মন্মথ জাপান থেকে প্রয়োজনীয় মেশিনপত্র, নানা ধরনের যন্ত্রাংশ এবং বোতাম, চিরুনি তৈরির সামগ্রী জাহাজে করে আনিয়ে এবং শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের অর্জিত কারিগরি জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনামাফিক মেশিনপত্র যথাস্থানে স্থাপন করেন। ১৯১০ সালের মাঝামাঝি যশোরের কারখানায় সেলুলয়েডের চিরুনি উৎপাদন শুরু হয়। কয়েকমাস পর বোতাম তৈরির কাজও শুরু হয়। স্থানীয় যুবকদের চিরুনি, বোতাম তৈরির কাজ শিখিয়ে কারখানায় নিয়োগ করতে থাকলেন। দেখতে দেখতে যশোরের চিরুনি বাজারের অন্যান্য চিরুনিকে কোণঠাসা করে দিল—কারখানার সমস্ত কারিগরকে কেবলমাত্র চিরুনি উৎপাদনের কাজে লাগিয়েও বাজারের চাহিদা অনুযায়ী চিরুনি উৎপাদন করতে হিমসিম খেতে লাগলেন।

১৯১২ সাল নাগাদ তিনি যশোর জেলায় বসবাসকারী ব্যবসায়ে উৎসাহী আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সেলুলয়েডের এবং অন্যান্য দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদনের কারিগরি বিদ্যা শিখিয়ে, আর্থিক সাহায্য সহ যাবতীয় সহায়তা করে কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত করেন। সেইসময় যশোর ছাপ মারা যেসব সেলুলয়েডের বোতাম, চুলের বুরুশ, ছুরির হাতল, ছাতার হাতল, সাবান কেস, চুলের কাঁটা ইত্যাদি সারা বঙ্গের বাজারে পাওয়া যেত, তার সবকিছু যে মন্মথর কারখানায় তৈরি হত এমন নয়, এগুলো গড়ে উঠেছিল যশোরের কারখানায় অনুসারী শিল্প হিসেবে। কলেজে পড়ার সময় কলকাতা, হাওড়া এবং অন্যান্য জায়গার যেসব ছাত্রের সঙ্গে মন্মথর অন্তরঙ্গতা জন্মেছিল, তাঁরা ব্যবসা শেখার জন্য মন্মথর সঙ্গে যোগাযোগ করলে কখনও তাঁর উদারতা থেকে বঞ্চিত হয়নি। এভাবেই কলকাতা, হাওড়া এবং নানা শহরে গড়ে ওঠে

চশমার ফ্রেম, পাউডার কেস, সিগারেট কেস, কৃত্রিম দাঁত, আয়নার ফ্রেম, দাঁত মাজার ব্রাশ, পুতুলসহ নানা কারখানা। সেলুলয়েডে রঞ্জক ব্যবহার করে বস্তুসামগ্রীকে কিভাবে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায় তার কারিগরি শিক্ষা জাপানে মন্মথ আয়ত্ত করেছিলেন এবং এদেশের বহু মানুষকে শিখিয়েছিলেন।

ইংরেজের গোয়েন্দা বিভাগ কিন্তু মন্মথর জাপান যাত্রা ভাল চোখে দেখেনি, তাঁর ফিরে আসাও দেখেছিল সন্দেহের চোখে, ফলে মন্মথর কার্যকলাপের প্রতি দৈনন্দিন লক্ষ্য রাখা তাদের অন্যতম কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ নানারকম বিরক্তিকর ও অস্বস্তিকর প্রশ্নবাণে যখন-তখন অসুবিধায় ফেলতে লাগল। অবশেষে তৎকালীন লাট বাহাদুর লর্ড রোনাল্ডস যশোরের চিরুনি কারখানা পরিদর্শন করে প্রসংশা করায় গোয়েন্দা বিভাগ নিশ্চিন্ত হয়—মন্মথ আর যাই হোক জাপান থেকে বোমা-বন্দুক তৈরি শিখে আসেনি।

যশোরের চিরুনির খ্যাতি দিনে দিনে চারিদিকে প্রসারিত হতে থাকে। এই সুন্দর, কার্যকরী, টেকসই চিরুনির চাহিদা বাংলা থেকে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন ওয়ার্কশপ তৈরি করে, সর্বাধুনিক মেশিন বসিয়ে এবং বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যুবকদের কারখানায় চাকরি দিয়েও চাহিদামতো চিরুনি উৎপাদন অসম্ভব হয়ে ওঠে। বছর কয়েকের মধ্যে মন্মথর কিছু আত্মীয় ও কারখানার কর্মচারি তাঁর কাছ থেকে কাজ শিখে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় চিরুনি তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন, তবে যশোরের ছাপ দেওয়া চিরুনির কদর ছিল আলাদা। যশোরের চিরুনিকে অনেকে হাতির দাঁতের চিরুনি মনে করতেন। এমনকি এদেশের ইংরেজরা বিদেশ থেকে আমদানি করা চিরুনি ছেড়ে যশোরের চিরুনির প্রেমে পড়ে যায়।

প্রায় দশ বছর সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করার পর ১৯১৯ সালে মন্মথ যশোরের চিরুনি কারখানার ভার এবং ব্যবসার যাবতীয় দায়িত্ব তাঁর সেজো ভাই ফণিভূষণের হাতে তুলে দিয়ে সপরিবারে কলকাতার গড়পারে চলে আসেন এবং মিশন রো-তে (অধুনা আর এন মুখার্জী রোড) ‘ওরিয়েন্টাল মেশিনারি সাপ্লাইং এজেন্সি লিমিটেড’ নাম দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুসামগ্রী উৎপাদনের জন্য নানা ধরনের মেশিনে ও ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি আমদানি ও বিক্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন।

সে এক ভিন্ন অধ্যায়।

শেষের কথা 

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলতেন, ঝাঁকে ঝাঁকে এম.এ পাশ করলেই দেশের উন্নতি হয় না। আবার বিদেশে গিয়ে বড়ো ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে এসে আমাদের ছেলেরা এখানে নিজেরা কিছুই করতে পরে না—কোনো বড়ো ফার্মে চাকরি নিতে হয়। আমাদের দরিদ্র দেশের আদর্শ হওয়া দরকার জাপান। সেখানকার মতো কুটির শিল্পের মাধ্যমেই আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব।

মন্মথ প্রফুল্ল চন্দ্রের কথা মাথায় রেখেই তাঁর স্বপ্নকে সার্থক করার চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, এবং সফল হয়েছিলেন বৈকি।

সাহায্যকারী সূত্র:

১. কুমারেশ ঘোষ, প্রফুল্লচন্দ্র ও বাঙলার শিল্প, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র জন্ম শতবর্ষ পূর্তি স্মারক গ্রন্থ, খুলনা সম্মিলনী (১৯৬১)৷

২. জিতেন্দ্রনাথ রায়, পশ্চিমবঙ্গের কারিগরি বিদ্যার ইতিহাস, চিরুনি শিল্প, নন্দন (২০০৬)৷

বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী ও বিজ্ঞান লেখক। উল্লেখযোগ্য সম্পাদিত বই: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ সংগ্রহ, স্মৃতি - সত্তায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র রায় : একটি সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা, বিজ্ঞান বিস্ময়, নানা চোখে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রবাসীর প্রফুল্লচন্দ্র ইত্যাদি

মন্তব্য তালিকা - “মন্মথনাথ ঘোষ ও যশোরের চিরুনি”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।