সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বাংলার জৈন, বাঙালি জৈন কথা

বাংলার জৈন, বাঙালি জৈন কথা

নবাঙ্কুর মজুমদার

আগস্ট ২৮, ২০২০ ২১৪১ 25

মানভূম, মল্লভূম, বরাভূম – বাংলার এক উপেক্ষিত প্রান্তদেশ। পুরুলিয়া জেলার রুক্ষ লালমাটি আর শুষ্ক পাহাড় টিলা কতশত ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে যে আঁচল চাপা দিয়ে রেখেছে তার কোনো লেখাজোখা নেই। ভাদু-টুসু-ছৌ এর দেশ পুরুলিয়া, বৌদ্ধ-জৈন-লৌকিক ধর্মের বহু বিবর্তনের সাক্ষী সে। তবে আজ শুধু জৈন কথা।

বজ্জভূমির কৌমজন খ্রিষ্ট জন্মের ছয়’শ বছর আগে বর্ধমান মহাবীরকে নির্গ্রন্থী দেখে তাঁর পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়ে যে পাপ করেছিল, রাঢ় বাংলার এই ঊষর প্রান্তর সরাক নামের বাঙালি জৈন সম্প্রদায়কে সস্নেহে লালন করে আজও যেন সেই পাপস্খালন করে চলেছে। বাঙালি জৈন সম্প্রদায় – সরাক, এক বিস্মৃত-প্রায় জনগোষ্ঠী যা সংস্কৃত শ্রাবক শব্দের বিকৃত রূপ (শ্রাবক অর্থাৎ যারা তীর্থঙ্করদের উপদেশ শ্রবণ করেন)। কিন্তু বাংলায় জৈন ধর্মের শিকড়ের সন্ধান না করে শুধুমাত্র সরাকদের সম্বন্ধে আলোচনা কানু বিনে গীত হয়ে যাবে যে!

প্রাচীন বাংলায় বৈদিক ধর্মের বাড়বাড়ন্তকে রুখে দেবার পেছনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বহুল আলোচিত হলেও জৈন ধর্মও যে বাঙলায় এক পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছিল তার ভুরি ভুরি উদাহরণ মেলে দামোদর, কুমারী, সুবর্ণরেখা এমনকি কংসাবতী নদী উপত্যকার উদাসীন প্রত্নক্ষেত্রগুলিতে।

জৈনদের এক অতি পবিত্র তীর্থভূমি পরেশনাথ পাহাড়। জৈন বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে বাইশ জন তীর্থঙ্কর তপস্যা করেছিলেন। কাছাকাছি রাঢ় অঞ্চলে মহাবীর যখন ধর্ম প্রচারে এলেন তখন এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা ছিল নিষাদ সংস্কৃতির অনুসারী। আদিম সংস্কৃতির প্রকৃতিবাদের সাথে জৈন ধর্মের অহিংসা ও কৃচ্ছসাধনের কোনো নীতিগত বিরোধ না থাকায় মানভূম-বরাভূমে জৈন ধর্ম সহজেই বিস্তার লাভ করতে পেরেছিল। দ্বিতীয় লৌহাচার্য ভদ্রবাহু ছিলেন পুণ্ড্রবর্ধনের বাসিন্দা এবং সম্ভবত সরাক সম্প্রদায়ের মানুষ। ভদ্রবাহুর এক শিষ্য গোদাস ‘গোদাসগণ’ নামে এক জৈন সম্প্রদায় সৃষ্টি করেন। এদের স্থান ভেদে চারটি শাখা ছিল। তামলিত্তিঅ বা তাম্রলিপ্তক (তমলুক), কোডিবর্ষীঅ বা কোটিবর্ষীয় (দিনাজপুর), পংডবর্ধনিয়া বা পুণ্ড্রবর্ধনীয় (বগুড়া), আর দাসীখব্বডিঅ বা দাসী খর্বটিক (মানভূম, পুরুলিয়া)। বাংলায় জৈনধর্মের রমরমা কিন্তু এদের হাত ধরেই হয়েছিল। বোধিসত্ত্ববদন কল্পলতা অনুযায়ী চতুর্থ সাধারণ পূর্বাব্দে পুণ্ড্রবর্ধনের জনপ্রিয় ধর্মমত ছিল জৈন ধর্ম।। এমনকি সপ্তম সাধারণ অব্দে হিউয়েন সাং-ও পুণ্ড্রবর্ধনে এবং সমতটে অনেক দিগম্বর জৈনের দেখা পেয়েছিলেন। পাহাড়পুরে পঞ্চম সাধারণ অব্দের গুপ্ত তাম্রশাসনে (৪৭৯ সালের) বটগোহালি গ্রামের জৈন মঠে দানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরপর অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গদেবের(১০৭৮ সাধারণ অব্দ) দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গ দখলের পর এই অঞ্চলে জৈনদের প্রতিপত্তি অনেকটাই বাড়ে। চোড়গঙ্গদেব নিজে যেহেতু জৈন ছিলেন, রাজ পৃষ্ঠপোষণায় প্রচুর জৈন মন্দির এ সময় নির্মিত হতে থাকে।

ছবিঃ শীতলনাথ

এবারে আসা যাক সরাক প্রসঙ্গে। যদি ভদ্রবাহু সরাক সম্প্রদায়ের মানুষ হন তবে তো এদের প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই থাকে না। কঠোর নিরামিষাশী সরাকরা বিভিন্ন তীর্থঙ্করদের নাম অনুসারে গোত্র ধারণ করলেও এরা মূলত পার্শ্বনাথকে পুজো করে। পুরুলিয়ার প্রাচীন বাসিন্দা সরাকগণ বহির্বঙ্গ থেকে এসে বরাকর ও দামোদর নদী উপত্যকায় শিখরভূম ও পঞ্চকোট নামে দুটি গণরাজ্য গড়ে তোলে। পরে একটিই রাজ্য হয় শিখরভূম, আর রাজধানী পঞ্চকোট। এরা প্রধানত ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে লোহা গলানো ও তামার ব্যবসা করতো। সেযুগে এ অঞ্চলে দুটো বিখ্যাত তামার খনি ছিল, তামাজুড়ি ও তামাখুন। এই দুই খনি থেকে যে আকরিক পাওয়া যেত তা নদী পথে তৈলকম্প (তেলকুপি) বন্দর হয়ে তাম্রলিপ্ত তে চলে যেত। এ ব্যবসা ছিল সরাকদের একচেটিয়া। ষষ্ঠ বা পঞ্চম সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে সপ্তম সাধারণ অব্দ পর্যন্ত হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এসব অঞ্চলে সরাকরা তাদের প্রাধান্য বজায় রাখতে পেরেছিল। সেকাল থেকে এ-পর্যন্ত এই আড়াই হাজার বছরের যাত্রাপথে বৌদ্ধ প্রভাব, ব্রাহ্মণ্য বিস্তার অথবা ইসলামী আধিপত্যের যুগে সরাক সম্প্রদায়ের একনিষ্ঠ সদ্ধর্মে এতোটুকু ছেদ পড়েনি। তাহলেও সবটাই যে খুব মসৃণ ছিল তাও কিন্তু নয়। বখতিয়ার খলজির আক্রমণের পরে এরা উত্তর ভারতের বাকি জৈনদের সাথে যোগাযোগ একেবারে হারিয়ে ফেলে। তারপর বহু শতাব্দী পার ক’রে অষ্টাদশ শতকে মারাঠারা জৈন ধর্মাবলম্বী মঞ্জু চৌধুরীকে কটকের শাসনকর্তা নিযুক্ত করলে বুন্দেলখণ্ড-এর দিগম্বর জৈনদের সাথে যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। তা হলেও বহু বছরের এই বিচ্ছিন্নতা দেশের বাকি অংশের জৈনদের থেকে সরাক জৈনদের সংস্কৃতিগতভাবে স্বতন্ত্র করে তোলে।

ছবিঃ জৈন দেউল, পাকবিড়রা

অষ্টম ও নবম শতক ছিল বাংলায় জৈন ভাস্কর্য ও দেউল স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ। ওড়িশা রীতিতে নাগর শৈলীর মন্দির স্থাপত্য, বাংলা রীতিতে টেরাকোটার কাজ, কায়োৎসর্গ এবং সমপাদোত্থানক মুদ্রার অপূর্ব সব তীর্থঙ্কর ও শাসনদেবী মূর্তি তেলকুপি, দেউলঘাটা, পাকবিড়রা, বান্দা – প্রভৃতি রাঢ় বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল হাজার বছর ব্যাপী। পাকবিড়রা প্রত্নক্ষেত্রে শ’দেড়েক বছর আগে এক প্রত্ন উৎসাহী ব্যক্তি কোলার সাহেব অগুনতি ছড়ানো ছেটানো ভগ্নাবশিষ্ট দেখে অনুমান করেছিলেন সেখানে হয়তো জৈন ভাস্কর্যের এক বিরাট কর্মশালা ছিল। ২৪ জন তীর্থঙ্করের ২৪ টি মন্দিরের মধ্যে তিনি তখনো ২১ টি মন্দির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন।

আজ কি অবস্থায় আছে প্রত্নসম্পদে সমৃদ্ধ এসব অঞ্চল? নিশ্চয়ই উত্তর-আধুনিক বাঙালি সযত্নে আগলে রেখেছে তার অমূল্য সব উত্তরাধিকার? প্রায় তাইই বটে। আলোকপ্রাপ্ত বাঙালিকে আরো আলোকিত করার জন্য ১৯৫০ সালে DVC-র বানানো ড্যামে এ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ ও জৈন প্রত্নস্থল তেলকুপির বহু মন্দির, দেউল, স্থাপত্য তলিয়ে গেল! অষ্টম শতকের জৈন স্থাপত্য, নবম শতকের পালযুগের বৌদ্ধ মন্দির নির্বিচারে ডুবিয়ে দেওয়ার আগে তার কোনো তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনও বোধ করেননি উচ্চ শিক্ষিত আধিকারিকরা!! আর বাদবাকি অঞ্চল? উন্মুক্ত জাদুঘর হয়ে পড়ে থাকা গোটা জেলাটাই আজ চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য।

ছবিঃ আদিনাথ

তবে সুখের কথা, এই শত আক্ষেপের মাঝে আত্তীকরণের নিদর্শনেরও কিন্তু অভাব নেই। নদীর ধারে, গাছতলায়, খোলা মাঠে, ধর্মঠাকুরের থানে ছলনের হাতি ঘোড়ার পাশে ইতিউতি দণ্ডায়মান সিঁদুর লেপা অপূর্ব সব শাসনদেবী বা তীর্থঙ্কর মূর্তি। তাঁরা আজও ভক্তিভরে পুজো পাচ্ছেন, নামগুলোই শুধু পাল্টে গেছে এই যা! ভৈরব, কালভৈরব, বিষ্ণু, মনসা, ধর্মঠাকুর – নতুন পরিচয়ে প্রাচীন বাংলার জৈন সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে নিয়েছে আজকের লোকায়ত ধর্মসমাজ। তাইতো দেউলঘাটার জৈন মন্দিরের ভগ্ন অবশেষ আজ শৈবতীর্থ সিদ্ধেশ্বর ধাম, শীতলনাথের নতুন নাম কালভৈরব, শাসনদেবী অম্বিকা আজ দেবী দুর্গা রূপে দাক্ষিণ্য বিতরণ করে চলেছেন। দেবমন্দিরের চত্বরে জৈন অর্ঘ্যমন্দির, দেউল শীর্ষের খসে পড়া আমলকের পাশে বসে জপ-তপ করছেন নিষ্ঠাবান হিন্দু। পুরাতনের মাঝে নূতনের আহ্বান, এও একপ্রকার মেলবন্ধন বৈকি।

কালের স্রোতে বদলেছে সরাক সমাজও। হিন্দু জৈন উভয় ধর্মাচার পালনে আজ তাদের কোনো দ্বিধা নেই। পলমা গ্রামের সরাক জমিদার কেষ্ট মাজি আড়াইশো বছর আগে সন্তান কামনায় বাড়িতে যে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন, আজও তা সাড়ম্বরে হয়ে চলেছে। পাশাপাশি ‘মহাবীর জনম কল্যানক’ উৎসব পালনেও সরাক সমাজের উৎসাহের কোনো ঘাটতি নেই। পুরুলিয়া শহরের কাছেই আনাইজামবাদ গ্রামে একমাত্র সক্রিয় জৈন মন্দিরে ব্রাহ্মণ পুরোহিতবেশী সরাক পূজারীর কণ্ঠে নিত্যদিন প্রাকৃত ভাষায় ধ্বনিত হয় পবিত্রতম জৈন নমোকার মন্ত্র:

নমো অরিহন্তানম

নমো সিদ্ধানম

নমো আয়রিয়ানম

নমো উভজ্ঝায়ানম

নমো লোয়ে সব্ব সাহুনম…..

অর্হন্তদের নমস্কার করি

সিদ্ধদের নমস্কার করি

আচার্যদের নমস্কার করি

উপাধ্যায়দের নমস্কার করি

বিশ্বের সমস্ত সাধকদের নমস্কার করি…..

ছবিঃ বান্দা জৈন মন্দির

এ যে ধর্ম নির্বিশেষে এক সর্বজনীন অভিব্যক্তি! যাবতীয় বিভেদকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে রাজনৈতিক মনান্তর থেকে শত আলোকবর্ষ দূরে ওপার বাংলার চট্টগ্রামের ক্ষীণধ্বনি বুদ্ধমন্ত্রের সাথে কখন যেন একাকার হয়ে যায় এপার বাংলার পুরুলিয়ার ক্ষীণতর নমোকার ধ্বনি। আর এই পূত ধ্বনি তরঙ্গে জেগে থাকে কেবল অপার বাংলা। ধর্মীয় বৈচিত্র্যের সাক্ষী হয়ে।

তথ্যসূত্র:

১) সরাক সংস্কৃতি ও পুরুলিয়ার পুরাকীর্তি – যুধিষ্ঠির মাজি

২) শ্রী তীর্থঙ্কর গীতাবলি ও শ্রাবকাচার – হরিশচন্দ্র সরাক

৩) Prabodh Chandra Bagchi, ‘Jainism’, Development of Religious Ideas, Dr R. C. Mazumdar (Ed.), History of Bengal, University of Dacca, 1943. p. 409-410

৪) বাঙালি হিন্দু জাতি পরিচয় – সন্তোষ কুমার কুণ্ডু (প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি, কলকাতা) P-273-275

৫) মানভূম জেলার ভূগোল ও ইতিবৃত্ত – বিমল প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

৬) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি – বিনয় ঘোষ (প্রকাশ ভবন, কলকাতা) P- 447-449

মন্তব্য তালিকা - “বাংলার জৈন, বাঙালি জৈন কথা”

  1. আমার খুব ভাল লেগেছে,এ বিষয়ে বিশেষ কিছু লেখা আগে পড়িনি।বিহারে জইন ধরম প্রবল আকারে থাকলেও এত কাছে বাংলাদেশে তার প্রভাব থাকা উচিত,কিন্তু সে রকম লেখা হয়নি।ধন্যবাদ।

  2. ১) সরাক সংস্কৃতি ও পুরুলিয়ার পুরাকীর্তি – যুধিষ্ঠির মাজি
    ২) শ্রী তীর্থঙ্কর গীতাবলি ও শ্রাবকাচার – হরিশচন্দ্র সরাক

    বইগুলো কি পাওয়া যায়?

    1. উত্তর দিতে একটু দেরি হয়ে গেল, দুঃখিত।
      নির্গ্রন্থি মানে বিবস্ত্র। আর বাঙালিরা যে মহাবীরের পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল তা সে যুগের অনেক লেখায় পাওয়া যায়।

  3. আপনার তথ্য সূত্রে উল্লেখিত বইগুলির মধ্যে শ্রী তীর্থ্যাংকর গিতাবলি ও শ্রাবাকাচার -হারিসচন্দ্র সরাক ও হিন্দু জাতি পরিচয়-সন্তোষ কুমার কুন্ডু -এই বই দুটি কোথায় পাওয়া যাবে। যদি আপনার কাছে থাকে তো একটা ফটোকপি দেবেন স্যার।

    1. হিন্দু জাতি পরিচয় বইটায় কিচ্ছু নেই৷ সরাকদের বিষয়ে স্রেফ চিরস্থির করা আছে৷ বইটার ফরোয়ার্ডিং যিনি লিখেছেন, তিনি স্পষ্টতঃই এই ধরণের table top work বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷ আর হরিশ্চন্দ্র সরাক নামে কোনো লেখক এ’বিষয়ে বই লিখেছেন বলে কখনো শুনি নি৷ পোস্ট লেখক এ’বিষয়ে আলোকপাত করবেন, এই আশা রাখি৷

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।