সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

নীল চাষঃ আমেরিকা থেকে বাংলায়

নীল চাষঃ আমেরিকা থেকে বাংলায়

সুমিতা দাস

নভেম্বর ৩০, ২০২২ ৬৮৩ 2

নীল চাষ বা নীল বিদ্রোহ শুধু আমাদের দেশের ইতিহাসের অঙ্গ নয়, বিশ্ব ইতিহাসের অঙ্গ। আমাদের দেশে নীলকর সাহেবদের আগমন আবার জড়িত আমেরিকার ইতিহাসের সঙ্গে। কেমন করে? সে কথাই বলব।

ব্রিটিশরা এদেশে আসার আগেও এদেশে নীল চাষ হত এবং নীল দিয়ে আমাদের দেশের বস্ত্র রঞ্জিত হত। অনেকেই মনে করেন, নীলের জন্ম এদেশেই। ১৮৮২ সালে ইউরোপে রাসায়নিক পদ্ধতিতে নীল উৎপাদন শুরুর আগে পর্যন্ত এশিয়ার নীল বা এশিয়ান ইন্ডিগো ছিল বস্ত্রকে নীল রঙে রঞ্জিত করার প্রধান উপায়। বস্ত্রশিল্পে রঞ্জক হিসেবে নীল বা ইন্ডিগোর ভালো চাহিদা ছিল।

সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয়রা আমেরিকার দখল করা অংশে নীল চাষ শুরু করে। ইংরেজরা ভার্জিনিয়ার জেমস টাউনে বসতি গড়ার পরপর সেখানে নীল চাষ করার চেষ্টা করে। আজকের নিউ ইয়র্ক আগে ছিল ডাচদের হাতে- নাম ছিল নিউ আরমস্টারডম- ডাচরা সেখানে নীল চাষ শুরু করে। ফরাসিরা লুইসিয়ানাতে (অষ্টদশ শতক পর্যন্ত লুইসিয়ানা ছিল ফরাসি অধিকারে) নীল চাষ শুরু করে, কিছুটা সাফল্যও পায়। কিন্তু বলার মত সফল্য কেউই পায়নি।

সে সাফল্য এলো অষ্টাদশ খ্রিস্টাব্দে। ১৭৩০ সালে ষোড়শী এলিজা লুকাস সাউথ ক্যারোলিনার একটি প্ল্যান্টেশন দেখাশুনার দায়িত্ব পান। তাঁর বাবা ক্যারিবিয়ানের আন্টিগুয়া (অনেক দিন পর্যন্ত আমেরিকায় ইউরোপের সাম্রাজ্যের মূল কেন্দ্র ছিল ক্যারিবিয়ান) থেকে নানা ফসলের বীজ পাঠিয়ে দিলেন। এর মধ্যে ইন্ডিগো চাষ ব্যাপারটা এলিজার পছন্দ হল। বিয়ে করে তারা স্বামী-স্ত্রী তাদের বাগিচায় ইন্ডিগো চাষ শুরু করল। পরে তাদের কাছ থেকে বীজ নিয়ে আশপাশের বাগিচাগুলিও নীল চাষ শুরু করে দিল। আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে দক্ষিণের ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে নীলচাষ বাড়তে লাগল।

নীল তৈরি হচ্ছে, ফরাসী ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ১৬৬৭

এদিকে ব্যাপার হল, কী করে নীল চাষ করতে হয়, তাঁর থেকে নীল প্রস্তুত করতে হয়- এসব কিন্তু এলিজা বা তাঁর স্বামী বা তাঁর প্রতিবেশী বাগিচা-মালিকরা জানতেন না। সেটা জানতেন তাদের ক্রীতদাসরা। তাঁরা আফ্রিকার মানুষ। নীল চাষ করা ও তা দিয়ে বস্ত্র রঞ্জিত করার বিদ্যা ছিল তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জ্ঞানভাণ্ডারের অংশ। তাতে অবশ্য তাঁরা কোনও কৃতিত্ব পাননি, লাভের বখরাও নয়। শুধু অন্য চাষের বদলে নীল চাষে তাদের ঘাম ঝরেছে, মালিকের ইচ্ছানুসারে। শুধু এলিজা নয়, তখন আমেরিকার দক্ষিণের সব বাগিচায়ই আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস এনেছেন। তাদের শ্রমের পাশাপাশি তাদের কৃষি-জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকার দক্ষিণের কলোনিগুলিতে এলো নীল চাষের জোয়ার ও তাঁর থেকে পাওয়া মুনাফার বন্যা- ইন্ডিগো বুম। তাই বলা যায়, আমেরিকায় নীল চাষ হয়েছে সম্পূর্ণত ক্রীতদাসদের ওপর ভিত্তি করে। শুধু শ্রমের ক্ষেত্রে নয়, জ্ঞানের ক্ষেত্রেও।

দক্ষণ ক্যারোলিনাতে যখন নীল চাষের বন্যা, জর্জিয়াতে তখনও ক্রীতদাস প্রথা আইনসিদ্ধ নয়। জর্জিয়ার ব্রিটিশ গভর্নর স্থির করলেন নীল চাষ করতে হবে, ফলে জর্জিয়াতেও ক্রীতদাস প্রথা চালু করতে হবে। ১৭৫১ সালে জর্জিয়াতে ক্রীতদাস প্রথা আইনসিদ্ধ হল।

অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে আমেরিকার ব্রিটিশ কলোনিগুলি ব্রিটিশদের থেকে আলাদা হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করল- ১৭৭৫ থেকে ব্রিটিশ রাষ্ট্র ও আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির মধ্যে যুদ্ধ চলে, আর ১৭৮৪ সালে স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৈরি হয়। মার্কিন নীল চাষের ওপর ব্রিটিশ কর্তৃত্ব শেষ হল। কিন্তু ততদিনে পলাশির যুদ্ধ হয়ে গেছে, ব্রিটিশরা বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি পেয়েছে। ব্রিটিশরা এবার ভারতে নীল চাষের ওপর নজর দিল। আমেরিকায় নীল চাষের ধূম কমে এলো। দাস শ্রম দিয়ে অন্যান্য অর্থকরী ফসল চাষ করতে লাগল তারা। সে অন্য ইতিহাস।

বাংলায় নীল চাষ

১৭৭৭ সালে বাংলায় ব্রিটিশদের হাতে নীল চাষ শুরু হল। স্বাভাবিক চাষ নয়, গা-জোয়ারি চাষ। বেশি মুনাফার জন্য বাংলার চাষিদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার শুরু হল। বাংলার গ্রামে গ্রামে তৈরি হল নীল কুঠি। চাষিদের বলা হল, পেটের ভাত নয়, নীল চাষ করতে হবে- তাদের নিজেদের জমিতে, নিজেদের শ্রম দিয়ে। কিন্তু দাম ঠিক করবে নীলকর সাহেবরা। চাষিদের পেটে ভাত জুটল কিনা সেটা তাদের দেখার দরকার নেই।

বাংলার শিক্ষিত সমাজের একাংশও এই অত্যাচারের বিরোধিতা করতে থাকে। বিশেষ করে হরিশ মুখার্জী তাঁর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ সংবাদপত্রে নীলকর সাহেবদের হাতে বাংলার চাষিদের দুরবস্থার কথা প্রকাশ করতে থাকেন। ১৮৬০ সালে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার নিয়ে প্রকাশিত হল দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক।

অবশ্য তার ঠিক আগেই, ১৮৫৯ সালে, ঘটে গেছে নীল বিদ্রোহ। বাংলার হাজার হাজার চাষি নীলকর সাহেবদের জন্য নীল চাষ করতে অস্বীকার করল। নদিয়া জেলা থেকে শুরু হয়ে এই বিদ্রোহ বাংলার জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। অনেক জায়গায় নীল কুঠি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তখন চাষিদের শান্ত করার উদ্দেশ্যে নীল চাষের সংস্কার করার জন্য ‘ইন্ডিগো কমিশন’ গড়া হল।

এ অবস্থা চলল একশ বছর ধরে। শেষে ১৮৮২ সালে রাসায়নিকভাবে নীল উৎপাদন সম্ভব হওয়ার পর ভারতে নীলকর সাহেবদের হার থেকে মুক্তি পেল।

নীল অবশ্য এখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ রঞ্জক। বিশেষ করে জিনস তৈরিতে এর ব্যবহার খুব বেশি। সে ইতিহাস আরেক দিন বলা যাবে।

তথ্যসূত্র

1.’Indigo in the Fabric of Early South Carolina’, Nic Butler, www.ccpl.org

2. ‘The Dark History of Indigo, Slavery’s Other Cash Crop’, Jesslyn Shields, history.howstuffworks.com

3. Subhas Bhattacharya, ‘The Indigo Revolt of Bengal’, Social Scientist, 1977

মন্তব্য তালিকা - “নীল চাষঃ আমেরিকা থেকে বাংলায়”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।