
কণাপদার্থবিদ্যার বিবর্তন (পর্ব – ৩)
ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনের গল্পটার শেষে আমরা বলেছিলাম তিনটি নতুন কণা আবিষ্কারের কথা। তার মধ্যে দুটির কথা আমরা গত পর্বে বলেছি। এবার এসে পড়েছি তৃতীয় এবং এই কথামালার অন্তিম কাহিনিতে। এর পরেও কণাপদার্থবিদ্যার গবেষণা অনেকদূর এগিয়েছে এবং এ কাহিনি এখনো গতিশীল, কিন্তু স্থান ও সময়ের অভাবে আমাদের আপাতত থামতে হবে নিউট্রিনোর কাহিনির পরেই, মোটামুটি ১৯৬২ সাল নাগাদ।
নিউট্রিনো নামক এই কণাটির কাহিনি জানার জন্য অবশ্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৩০ সালে।১ সে সময় বিজ্ঞানীরা চিন্তিত ছিলেন বীটা ক্ষয় (Beta decay) নামক নিউক্লীয় বিক্রিয়ার রহস্য নিয়ে। রহস্যটা কী এবং চিন্তাটা কেন, তা বলার আগে বরং বলে নেওয়া যাক বীটা ক্ষয় ব্যাপারটা কী।
বীটা ক্ষয় বিক্রিয়ায় কোনো তেজস্ক্রিয় মৌলের (ধরা যাক A) কেন্দ্রিন একটি ইলেকট্রন (e) ত্যাগ করে তুলনামূলক হালকা একটি কেন্দ্রিনে (ধরা যাক B) পরিণত হয়। বিক্রিয়ার আকারে লিখলে এটি দাঁড়াবে,
A → B + e
আধানের হিসাব করলে দেখা যাবে A-র তুলনায় B-র একটি ধনাত্মক আধান বেশি (বর্তমানে আমরা জানি, এই বিক্রিয়া হলো আসলে একটি নিউট্রনের [A-তে উপস্থিত] প্রোটনে [B-তে] রূপান্তর। কিন্তু এই নিবন্ধমালার প্রথম নিবন্ধটি খুলে দেখুন, ১৯৩০ সালে নিউট্রন আবিষ্কারই হয়নি)। সুতরাং উৎপন্ন মৌল B পর্যায়সারণীতে A –র পরে বসবে। এমন অনেক বীটাক্ষয় বিক্রিয়ার কথা জানা আছে, যেমন, পটাশিয়াম (K) হয়ে যায় ক্যালসিয়াম (40K19 → 40Ca20), তামা(Cu) হয় দস্তা (64Cu29 → 64Zn30), এরকম আর কি।
সমস্যা বা রহস্যটা দেখা দিল যখন এ ধরনের বিক্রিয়ার শক্তিমাত্রা নির্ণয়ের চেষ্টা করা হল। দেখা গেল, বিক্রিয়ার আগের ও পরের শক্তি বা সমীকরণের বাঁ-দিক ও ডানদিকের শক্তি সমান হচ্ছে না। কিন্তু শক্তির নিত্যতা সূত্র (Conservation of Energy) অনুসারে তা হওয়া উচিত। অন্য কথায় বীটা ক্ষয়ের সময় শক্তির একটা অংশ যেন হারিয়ে যাচ্ছে বা শক্তির নিত্যতা সূত্র লঙ্ঘিত হচ্ছে। পদার্থবিজ্ঞান গভীর সংকটের সম্মুখীন হল। এত বছর ধরে যে শক্তির নিত্যতা সূত্র কে অভ্রান্ত ধরে বিজ্ঞানীরা সব হিসাবনিকাশ করছিলেন এখন সেই নিত্যতা সূত্রের যথার্থতা নিয়েই প্রশ্ন উঠল।
নিলস বোর শক্তির নিত্যতা সূত্র পরিত্যাজ্য বলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। মজার ব্যাপার বোর এই প্রথমবার এমন কাণ্ড করছেন না, শেষবার ও নয়। ১৯২৪ সালের আগে তিনি আইনস্টাইনের আলোককণা তত্ত্বের সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন। তিনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মূল ভিত্তি যে শ্রয়েডিংগার সমীকরণ, তার বিরোধিতা করেছেন, শ্রয়েডিংগার সমীকরণের আপেক্ষিকতাতত্ত্ব ভিত্তিক সমাধান বা ডিরাক সমাধান, ডিরাকের আগেই অন্যরা (ক্লেইন ও গর্ডন) করেছেন বলে ভুল দাবি করেছেন, ইউকাওয়ার মেসন তত্ত্বকে ব্যঙ্গ করেছেন, এমনকি কণাবাদী বিদ্যুৎগতিবিদ্যা (Quantum Electrodynamics) বিষয়ে ফাইনম্যানের কাজকে তাচ্ছিল্য করেছেন। মহান বিজ্ঞানী হলেও সবাই সর্বদা অন্যের কাজের বিষয়ে সঠিক বিচার করতে পারেন না। তবে বোর সম্ভবত এ ব্যাপারে বিশ্বরেকর্ড করে বসে আছেন। একমাত্র কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বিষয়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে তর্কেই তিনি প্রথম থেকে ঠিক ছিলেন।
পাউলি অবশ্য এ ব্যাপারে (বীটা ক্ষয় বিক্রিয়ার হারানো শক্তি) একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রস্তাব করলেন। তাঁর মতে ইলেকট্রনের সঙ্গে আরো একটি কণা নির্গত হয় যেটি ঐ ‘অতিরিক্ত শক্তি’ যার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না, সেটি বহন করে। এর ভর যৎসামান্য, প্রায় না থাকার মতো ও নিস্তড়িত (যে কারণে মেঘকক্ষে [cloud chamber] কোনো পথচিহ্ন [track] দেখা যায় না)। পাউলি এর নাম প্রস্তাব করলেন ‘নিউট্রন’ (বোর পাউলির এই নতুন প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেছিলেন)।
এ প্রস্তাব বিজ্ঞানীমহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো, কেউ কেউ (যেমন বোর) এটিকে মানতে চাইলেন না, অন্যরা এটিকে একটি সম্ভাব্য প্রকল্প (Hypothesis) রূপে গ্রহণ করলেন। ইতিমধ্যে চ্যাডউইক ১৯৩২ সালে ‘নিউট্রন’ নামটা তাঁর আবিষ্কৃত কণার জন্য ব্যবহারও করে ফেললেন। বীটা ক্ষয় সমস্যার সমাধান হল না। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৩ সালেই এনরিকো ফের্মি পাউলি কথিত কণার ধারণা ব্যবহার করে বীটা ক্ষয়ের এমন একটি তত্ত্ব উপস্থিত করলেন এবং সে তত্ত্ব এতো সুন্দরভাবে বীটাক্ষয়ের ব্যাখ্যা করলো যে পাউলি কথিত কণার বিষয়ে সবাই আগ্রহী হয়ে উঠলেন। ফের্মির তত্ত্ব থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে এই নতুন প্রস্তাবিত কণাটি নিশ্চয়ই খুব হালকা হবে। ফের্মি এর নাম দিলেন নিউট্রিনো (অর্থাৎ কিনা ছোটো নিস্তড়িত বা Little Neutral One)। যদিও বর্তমানে বোঝা গেছে যে এটি আসলে অ্যান্টিনিউট্রিনো। কী করে? কেন? এ প্রশ্ন দুটির উত্তর বোঝার জন্য আমাদের সামান্য কণাপদার্থবিদ্যার সাংকেতিক সমীকরণের সাহায্য নিতে হবে।
বীটা ক্ষয় বিক্রিয়াটিকে আমরা বর্তমানে লিখি এভাবে,
n → p+ + e– + ν̅
যেখানে n –> নিউট্রন, p+ -> প্রোটন, e– -> ইলেকট্রন এবং ν̅ -> অ্যান্টিনিউট্রিনো।
নিউট্রিনোকে ν চিহ্ন দিয়ে লেখা হয়, মাথার ওপরের ঐ মাত্রা বা বার (bar) ছাড়া।
কেন এখানে বীটা ক্ষয়ে অ্যান্টিনিউট্রিনো পাওয়া যায় তা আমরা একটু পরে দেখতে পাব। আপাতত আমরা যাই ১৯৪৭ সালের ঐ মূহুর্তটিতে যখন ব্রিস্টলে পাওয়েল ও তাঁর সঙ্গীরা পাই ও মিউ মেসন বা পাইওন ও মিউওন আবিষ্কার করছেন। সেসময় নিউক্লিয়ার ইমালসনের মধ্যে তেজস্ক্রিয় কণার পথ বা track এর যে ছবি তাঁরা তুলছেন সে ছবিতে দেখা গেছিল পাইওন কণার ক্ষয় থেকে উৎপন্ন মিউওন কণা পাইওনের গতিপথের সঙ্গে সমকোণে নির্গত হয়। এমনটা কেন হচ্ছে? ওখানে তো কোনো সংঘর্ষ হয়নি যে পাইওন ক্ষয় হয়ে মিউওন তৈরি হয়ে সমকোণে ঘুরে যাবে!!
এ ঘটনার ব্যাখ্যা একভাবেই দেওয়া সম্ভব। নিশ্চয়ই ঐ বিন্দুতে যেখানে পাইওন থেকে মিউওন উৎপন্ন হচ্ছে (চিত্র-১ দেখুন, A বিন্দু) সেখানে আরো একটি কোনো কণা উৎপন্ন হয়েছে যেটি অত্যন্ত হালকা এবং নিস্তড়িত (যে কারণে ইমালসনের মধ্যে কোনো পদচিহ্ন [track] রেখে যাচ্ছে না)। সোজা কথায় পাইওন ক্ষয় হয়ে তৈরি হয়েছে মিউওন ও কোনো একটি অজানা কণা যেটি অত্যন্ত হালকা ও নিস্তড়িত। স্বাভাবিক কারণেই ভাবা হলো সম্ভবত এই অজানা কণাটিই ফের্মি ও পাউলি কথিত নিউট্রিনো।

চিত্র-১
বছর দুয়েক বাদে পাওয়েল ও তাঁর সঙ্গীরা আবার কয়েকটি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করলেন।২ যেখানে মিউওনের ক্ষয় থেকে ইলেকট্রন উৎপন্ন হতে দেখা গেল এবং সেখানেও দেখা গেল উৎপন্ন ইলেকট্রনের গতিপথ মিউওনের গতিপথের সঙ্গে সমকোণে। অর্থাৎ কিনা এখানেও মিউওন ক্ষয়ের সময়ে ইলেকট্রনের সঙ্গে ঐ অজানা কণাটি উৎপন্ন হয়। যদিও এক্ষেত্রে উৎপন্ন হয় দুটি নিউট্রিনো।

চিত্র-২
কি করে বোঝা গেল যে এক্ষেত্রে দুটি নিউট্রিনো আছে? খুব সহজে – পরীক্ষাটির বারংবার পুনরাবৃত্তি করা হয় এবং প্রতিবার ইলেকট্রনটির শক্তি মাপা হয়। যদি প্রতিবার একই ফল পাওয়া যায় তাহলে নিশ্চিত ওখানে দুটি মাত্র কণাই উপস্থিত। কিন্তু যদি প্রতিবার আলাদা ফল পাওয়া যায় তাহলে তিনটি বা তার বেশি কণা ঐ মিথস্ক্রিয়ায় জড়িত। শক্তি সংরক্ষণ সূত্র ছাড়াও কৌণিক ভরবেগ (Angular Momentum) সংরক্ষণ সূত্র ব্যবহার করেও নিখুঁতভাবে কণার সংখ্যা নির্ণয় করা যায়। কিন্তু সেসময় ইলেকট্রন স্পিন বা স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা বিষয়ে বিজ্ঞানীদের পরিষ্কার ধারণা ছিল না ফলে তাঁরা শক্তি সংরক্ষণ সূত্রের ওপরেই ভরসা করতেন বেশি।
১৯৪৯ সাল নাগাদ পরিষ্কার বোঝা গেল যে মিউওন ক্ষয়ের সময় ইলেকট্রনের শক্তি কখনই এক হয় না এবং দুটি নিউট্রিনোর উৎপত্তি মেনে নেওয়াই হল এ সমস্যার সমাধান। অন্যদিকে পাইওন ক্ষয়ের ফলে উৎপন্ন মিউওনের শক্তি সর্বদা ধ্রুবক যার থেকে নিশ্চিত বোঝা যায় যে এক্ষেত্রে উৎপন্ন কণার সংখ্যা দুটি। ১৯৫০ সালের মধ্যে নিউট্রিনোর উপস্থিতি সকলে তত্ত্বগতভাবে মেনে নিলেও আসল সমস্যাটা রয়েই গেল। নিউট্রিনোর কোনো প্রত্যক্ষ পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ নেই!
সন্দেহবাদীরা বলতেই থাকলেন, এটা একটা কাল্পনিক কণা ছাড়া কিছুই না, যার একমাত্র কাজ হল সংরক্ষণ সূত্রগুলোকে ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করা। নিউট্রিনো কিছুই করে না! মেঘকক্ষে এর কোনো পথচিহ্ন দেখা যায় না, এর ক্ষয় হয়ে অন্য কোনো (শনাক্তযোগ্য) কণা উৎপন্ন হয় না, এ আদতে কিছুই করে না!!
এখন অবশ্য আমরা জানি (সে সময় বিজ্ঞানীরা সন্দেহও করেছিলেন) যে এর কারণ নিউট্রিনো পদার্থের সঙ্গে অতি মৃদু (প্রায় ধরা যায় না এমন) মিথস্ক্রিয়া করে। মোটামুটি মাঝারি শক্তিসম্পন্ন একটা নিউট্রিনো অনায়াসে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ বেধের সীসার ঘনক ভেদ করতে পারে। সূর্যের থেকে ছুটে আসা কোটি কোটি নিউট্রিনো সর্বক্ষণ আমাদের এফোঁড় ওফোঁড় করে যাচ্ছে, আমরা বুঝতেও পারছি না। আজ্ঞে হ্যাঁ, রাত্রিবেলাও সূর্যের থেকে আসা নিউট্রিনো পৃথিবী ভেদ করে মাটির তলা থেকে উঠে আমাদের ভেদ করে হারিয়ে যাচ্ছে মহাকাশে !!
এমন একটি কণার অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে জানার জন্য বা পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণের জন্য অত্যন্ত বেশি এবং শক্তিশালী নিউট্রিনো উৎসের প্রয়োজন। বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি দক্ষিণ ক্যারোলিনা রাজ্যের সাভানা রিভার নিউক্লিয় রিঅ্যাকটরে নিউট্রিনোর অস্তিত্বের নিশ্চিত পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ পাওয়া গেল।
এখানে কাওয়ান ও রেইনেস বিপরীত বীটা ক্ষয় পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সূত্রাকারে লিখলে ব্যাপারটি এরকম,
p+ + ν → n + e–
যেখানে n –> নিউট্রন, p+ -> প্রোটন, e– -> ইলেকট্রন এবং ν -> নিউট্রিনো।
ডিটেক্টরে অ্য্যান্টি নিউট্রিনোর উপস্থিতি তাত্ত্বিক গণনার মাধ্যমে তাঁরা পাচ্ছিলেন, প্রতি বর্গ সেমিতে, প্রতি সেকেণ্ডে ৫ X ১০১৩ টি। কিন্তু এমন বিপুল পরিমাণ কণার উপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁরা ঘণ্টায় দু-তিনটির বেশি বীটাক্ষয় দেখতে পাওয়ার আশা করেননি। যদিও বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন পজিট্রনগুলিকে চিহ্নিত করার জন্য তাঁরা একটি নতুন এবং নিশ্চিত পদ্ধতির (জটিলতা পরিহারের উদ্দেশ্যে এখানে গাণিতিক এবং প্রক্রিয়াগত বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হল না) উদ্ভাবন করেছিলেন। ফলস্বরূপ, তাঁদের পর্যবেক্ষণ নিশ্চিতভাবে নিউট্রিনোর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হল। অবশ্য এই কৃতিত্বের (গবেষণাপত্রটি৩ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে ফিজিক্যাল রিভিউ পত্রিকাতে) পুরষ্কার রেইনেস পেলেন বহু পরে ১৯৯৫ সালে নোবেল সম্মানের মাধ্যমে। দুঃখের বিষয় কাওয়ান তখন আর জীবিত নেই।
নিউট্রিনোর অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমাণ তো পাওয়া গেল কিন্তু এখনো কিছু সমস্যা রয়েই গেল। কি করে, কিসের ভিত্তিতে নিউট্রিনো এবং অ্যান্টিনিউট্রিনোকে আলাদা করা হচ্ছে? এদের তো কোনো তড়িৎ আধান নেই! তাহলে কি এরা একই কণা? যেমন পাইওন এবং অ্যান্টিপাইওন একই কণা। ১৯৫৯ সালে ডেভিস এবং হার্মার একটি পরীক্ষার মাধ্যমে এ প্রশ্নের সমাধান করতে চেষ্টা করলেন।৪ কীভাবে?
রেইনেস ও কাওয়ানের পরীক্ষা থেকে বোঝাই গেছিল যে,
p+ + ν → n + e–
জাতীয় বিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক এবং হয়েই থাকে। ডেভিস এবং হার্মার বললেন, সেক্ষেত্রে যদি নিউট্রিনো এবং অ্যান্টিনিউট্রিনো একই কণা হয় তাহলে,
p+ + ν̅ → n + e–
জাতীয় বিক্রিয়াও মোটামুটি একই পরিমাণে দেখা যাবে। কিন্তু পরীক্ষায় এমন বিক্রিয়া দেখা গেল না। অর্থাৎ এমন বিক্রিয়া হয় না, এটি নিষিদ্ধ বিক্রিয়া। এর মানে হল, নিউট্রিনো এবং অ্যান্টিনিউট্রিনো দুটি আলাদা কণা (যদিও এই যুক্তি সম্পূর্ণ নিশ্ছিদ্র নয় কিন্তু এই তাত্ত্বিক সমস্যা ও তার সমাধান কণাপদার্থবিদ্যা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জটিল গাণিতিক আলোচনা বলে আমরা তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া থেকে বিরত রইলাম)।
তাহলে কিসের ভিত্তিতে নিউট্রিনো এবং অ্যান্টিনিউট্রিনো আলাদা? এর উত্তর পাওয়া গেল ১৯৫৩ সালেই প্রকাশিত কোনোপিনস্কি ও মাহমুদ এর একটি পবেষণাপত্র৫ থেকে। এখানে তাঁরা একটি সরল নিয়ম প্রস্তাব করেছিলেন, অসংখ্য নিউক্লিয় বিক্রিয়ার মধ্যে কোনগুলি সম্ভব ও কোনগুলি অসম্ভব তা বোঝার জন্য। তাঁরা লেপটন সংখ্যা (L দ্বারা প্রকাশিত) নামে একটি নতুন রাশির অবতারণা করলেন প্রতিটি কণার জন্য। এর মান +1 বা -1 হতে পারে। ইলেকট্রন, মিউওন, নিউট্রিনো এদের জন্য L=+1 আর পজিট্রন, পজিটিভ মিউওন, অ্যান্টিনিউট্রিনো এদের জন্য L=-1।
ডেভিস এবং হার্মারের পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ আদতে কোপিনস্কি ও মাহমুদের প্রস্তাবিত প্রকল্প বা নিয়মকেই সমর্থন জোগাল। সুতরাং নিউট্রিনো এবং অ্যান্টিনিউট্রিনোর মধ্যে পার্থক্য হল, তাদের লেপটন সংখ্যা আলাদা। এবং এর সঙ্গেই আসে লেপটন সংখ্যা সংরক্ষণ সূত্র (অনেকটা ভর, শক্তি, ভরবেগ সংরক্ষণ সূত্রের মতোই) যা বলে, যে কোনো নিউক্লিয় কণা ঘটিত বিক্রিয়ার উভয়দিকে অর্থাৎ বিক্রিয়ার পূর্বে উপস্থিত কণাগুলির মোট লেপটন সংখ্যা, বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন কণাগুলির মোট লেপটন সংখ্যার সমান হবে। অতএব এতোক্ষণ আমরা যে কটি নিউক্লিয় বিক্রিয়ার উল্লেখ করেছি সেগুলির দুইদিকের লেপটন সংখ্যা হিসাব করে দেখুন, নিষিদ্ধ বিক্রিয়াগুলির ক্ষেত্রে লেপটন সংখ্যা সংরক্ষিত হবে না।
নিউট্রিনোর কাহিনি শেষ করার আগে বলে নেওয়া প্রয়োজন এ বিষয়ের অন্তিম সমস্যা ও আবিষ্কারের কথা। কিছু কিছু বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছিল যে সমস্ত সংরক্ষণ সূত্রগুলো (লেপটন সংখ্যা সংরক্ষণ সূত্রসহ) পালিত হলেও সেই বিক্রিয়াগুলি নিষিদ্ধ বিক্রিয়া অর্থাৎ সেগুলো হতে দেখা যায় না; এমনটা কেন?
এর উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হল ১৯৬০ সাল অবধি যখন রাশিয়ান পদার্থবিদ ব্রুনো পন্তেকোর্ভো প্রস্তাব দিলেন৬ যে হয়তো নিউট্রিনো আদতে দু রকম। এক রকম থাকে ইলেকট্রনের সঙ্গে (যাকে লেখা হবে νe দ্বারা) এবং অন্যটি থাকে মিউওনের সঙ্গে (লেখা হবে νµ দ্বারা)। সুতরাং একটি নতুন রাশি মিউওন সংখ্যা (প্রকাশিত Lµ দ্বারা) প্রস্তাবিত হল যার মান লেপটন সংখ্যার মতোই +1 বা -1। ঋণাত্মক মিউওন (µ–) ও মিউ-নিউট্রিনোর (νµ) ক্ষেত্রে Lµ = +1 আর ধনাত্মক মিউওন(µ+) ও অ্যান্টি মিউ-নিউট্রিনোর (ν̅µ) ক্ষেত্রে Lµ = -1। অনুরূপে আরেকটি প্রস্তাবিত রাশি হল, ‘ইলেকট্রন সংখ্যা’ (Le দ্বারা প্রকাশিত) যার মান ইলেকট্রন (e–) ও ইলেকট্রন-নিউট্রিনোর (νe) ক্ষেত্রে +১ এবং পজিট্রন ও ও অ্যান্টি ইলেকট্রন -নিউট্রিনোর (ν̅e) ক্ষেত্রে -1। সুতরাং লেপটন সংখ্যার মতো এই রাশিগুলির ক্ষেত্রেও অনুরূপ সংরক্ষণ সূত্র প্রস্তাবিত হল।
দুই প্রকারের নিউট্রিনো ও দুটি নতুন রাশির (ইলেকট্রন ও মিউওন সংখ্যা) সংরক্ষণ সূত্রের প্রথম পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া গেল ১৯৬২ সালে ব্রুকহ্যাভেন-এ৭ যখন লেডারম্যান, সোয়ার্জ, স্টেইনবার্গার ও তাঁদের সঙ্গীরা পাইওন ক্ষয় থেকে অ্যান্টিনিউট্রিনোর উদ্ভব সংক্রান্ত বিক্রিয়াগুলি পর্যবেক্ষণ করে (তাঁরা ১০১৪ টির মত বিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেছিলেন) দেখালেন যে উপরোক্ত সংরক্ষণ সূত্র নির্ধারিত বিক্রিয়াই কেবল হচ্ছে, যা নিম্নরূপ,
ν̅µ + p+ → µ+ + n
কিন্তু নিষিদ্ধ বিক্রিয়া (নিচের মতো, যা অন্যান্য সংরক্ষণ সূত্রে নিষিদ্ধ নয়) একটিও হচ্ছে না।
ν̅µ + p+ → e+ + n
যদি নিউট্রিনো কেবল একরকমের হত তাহলে এই দ্বিতীয় বিক্রিয়াটিও প্রথমটির মতোই সমপরিমাণে দেখা যেত। এর অনুপস্থিতি প্রমাণ করে দুরকমের নিউট্রিনোর উপস্থিতি এবং পন্তেকোর্ভোর প্রস্তাব সমর্থিত হয়।
এই ঘটনার সঙ্গেই যবনিকাপাত হল কণাপদার্থবিদ্যার মধ্যযুগের। লেপটন পরিবারের সদস্য সংখ্যা এখন আট। ইলেকট্রন, মিউওন, তাদের সংযোগী দুটি নিউট্রিনো এবং প্রতিটির বিপ্রতীপ কণা বা অ্যান্টিপার্টিকল। এই গোষ্ঠীর কণাদের মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল, এরা সবল মিথস্ক্রিয়া বা Strong Interaction এ অংশগ্রহণ করে না। এদের বিষয়ে আলোচনা থামিয়ে এবার আমরা যেতে পারি মেসন ও ব্যারিয়নদের কাহিনিতে, প্রবেশ করতে পারি কণাপদার্থবিদ্যার আধুনিক যুগে। জানতে পারি, আশ্চর্য কণা, কোয়ার্ক, অষ্টাঙ্গিক মার্গ ও ভেক্টর বোসনদের সম্পর্কে। তবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও গণিত অধ্যুষিত কণাপদার্থবিদ্যার সে গভীর অরণ্যে আমরা প্রবেশ করব যদি পাঠকেরা চান, নইলে এ কাহিনির এখানেই ইতি।
চিত্র পরিচিতি
শীর্ষক চিত্র – CERN Large Hadron Collider, GENEVA (হলুড বৃত্ত LHC সুড়ঙ্গটিকে দেখাচ্ছে) পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কণাত্বরণ যন্ত্র ও গবেষণাগার। পেছনে মঁব্লা পর্বতমালা দেখা যাচ্ছে।
চিত্র-১ – পাইওন ক্ষয় হয়ে মিউওন উৎপন্ন হওয়ার ফটো, (The study of elementary particles by the photographic method – C.F. Powell (1959) থেকে গৃহীত, অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত)। তীরচিহ্ন লেখকের সংযোজন।
চিত্র-২ – মিউওন ক্ষয় হয়ে ইলেকট্রন উৎপন্ন হওয়ার ফটো, (The study of elementary particles by the photographic method – C.F. Powell (1959) থেকে গৃহীত, অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত)। তীরচিহ্ন লেখকের সংযোজন।
টীকা
যেসব বই বা গবেষণাপত্রের সাহায্য নিয়েছি সেগুলোর কথা এখানে সূত্রতালিকা আকারে দেওয়া হলো।
১. J. Bernstein, ‘The Elusive Neutrino’; AEC Publications.
২. C. F. Powell, P. H. Fowler, and D. H. Perkins, ‘The Study of Elementary Particles by the Photographic Method’; New York: Pergamon, 1959. First published in ‘Nature’ 163, 82, 1949.
৩. F. Reines and C. L. Cowan, Jr., ‘Phys. Rev. 92, 8301’; 1953; C. L. Cowan et al., ‘Science 124, 103’; 1956.
৪. R. Davis and D. S. Harmer, Bull. ‘Am. Phys. Soc. 4, 217’; 1959. See also C. L. Cowan, Jr., and F. Raines, ‘Phys. Rev. 106, 825’; 1957.
৫. E. J. Konopinski and H. M. Mahmoud, ‘Phys. Rev. 92, 1045’; 1953.
৬. B. Pontecorvo, ‘Soviet Physics JETP 37, 1236’; 1960 [translated from 37, 1751 ( 1959)]; T. D. Lee, ‘Rochester Conference 1960’; p. 567.
৭. G. Danby et al., ‘Phys. Rev. Left. 9, 36’; 1962. See also L. Lederman, ‘Scientific American (March 1963)’.
গ্রন্থপঞ্জি
কণাপদার্থবিদ্যা বিষয়ে এই দুটি বইয়ের জুড়ি নেই। ইতিহাস ও গণিত সমন্বিত বিজ্ঞান যে এত সুন্দরভাবে একই সঙ্গে বলা যায় তা এগুলো না পড়লে জানতেই পারতাম না।
১. Abraham Pais, ‘Subtle is the Lord’; Oxford University Press, 1982.
২. Abraham Pais, ‘Inward Bound’; Oxford: Clarendon Press, 1986.
পর্ব – ১ সংযোগশৃঙ্খল
পর্ব – ২ সংযোগশৃঙ্খল