সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

চা বনাম টী

চা বনাম টী

কাবেরী চ্যাটার্জী রায়

জুন ২৮, ২০২৫ ১১৭ 0

আপনি চা-খোর না টী-প্রেমী?

কি বললেন? চা এবং টী দুটো শব্দ একই জিনিস বোঝায়? মানে, টী-এর বাংলা চা আর চায়ের ইংরেজী টী?

চা, চায়, চাই, সাই, চায়ে, সায়ে—এই সব একই পানীয় দ্রব্য। তবুও চীন, তুরস্ক, ভারত, পর্তুগাল, রাশিয়া, জাপান, তিব্বত, অর্থাৎ এশিয়া আর ইউরোপের একগাদা দেশে, ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা হয়। কেন?

আর পর্তুগাল বা রাশিয়ার আশেপাশে ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে এই একই চা-কে বোঝাতে টী, থী, থ্যে, থিয়া এইসব শব্দ ব্যবহার হয়৷ কেন? যোগসূত্র আদৌ কিছু আছে? থাকলে সেটা কোথায়?

সেই যোগসূত্রের সন্ধানে যাবার আগে একটা কথা বলে রাখি—খোদ ইংরেজি ভাষায় এই পানীয়র প্রথম প্রবেশ কিন্তু চা নামে। পর্তুগিজদের হাত ধরে। পর্তুগালই প্রথম পাশ্চাত্য শক্তি যারা দূর প্রাচ্যের চীন দেশে নিজেদের বাণিজ্যিক ঘাঁটি গেড়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে, ক্যানটনে। এবং যেহেতু ক্যানটনের ভাষায় এই পানীয়ের নাম চা, তাই পর্তুগালও এই পানীয়কে চিনল চা নামে। আর সেইজন্যই নিজের দেশে বা তার আশেপাশে, মানে পাশ্চাত্যের যে যে দেশগুলোতে তারা প্রথম এই পানীয় বা এই পাতা নিয়ে গেল, তাকে পর্তুগিজরা চেনাল ওই চা নামেই।

কিন্তু তাহলে পাশ্চাত্যে টী এল কখন? এবং কীভাবে? ইংরেজরাই বা খামোখা চা থেকে টী-তে সরে গেল কেন?

চা আর টী নিয়ে আরও কথা বলার আগে আমাদের চীন নামের সেই বিশাল দেশটাতে, যেখানে বহু শতাব্দী আগে প্রথম এই গাছের চাষ শুরু হয়েছিল, সেই গাছের পাতাকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল, ঘরে ঘরে পাতা থেকে প্রস্তুত পানীয়ের সমাদর হয়েছিল, সেদিকে একটু নজর ঘোরাতে হবে। সেখানকার ভাষা আর লিখিত ইতিহাস বহু প্রাচীন। ভাষার অক্ষর মূলত লোগোগ্রাফিক অর্থাৎ চিত্রনির্ভর। লোগোগ্ৰাম হল শব্দ বা বাক্যাংশের প্রতিনিধিত্বকারী একটি চিহ্ন, যেমন শর্টহ্যান্ড এবং কিছু প্রাচীন লিপির, যেমন চৈনিক, পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়। স্বাভাবিকভাবেই লম্বা সময়ের উপর দিয়ে এই বিশাল ভৌগলিক অঞ্চল জুড়ে বয়ে চলতে চলতে ভাষা, তার শব্দ, তার অর্থ এই সব কিছুই বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। আমাদের দেশেও সময় আর ভৌগোলিক অঞ্চলের উপর দিয়ে ভাষার বদলে যাবার, শব্দের অর্থ এবং উচ্চারণ বদলে যাবার ভুরিভুরি উদাহরণ আছে।

চা নামক যে গাছ, যার পাতা, পাতা থেকে তৈরি পানীয় নিয়ে পৃথিবী জুড়ে আজ এত ঔৎসুক্য, মাতামাতি, তাকে বোঝাতে ঐ বিশাল চীন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শব্দ, লোগোগ্ৰাম, ব্যবহার হয়েছে—যেমন, টু (tu), কিয়া (kia), কু টু (Ku Tu ), মিঙ (Ming) ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই এই শব্দগুলোর লোগোগ্ৰাম ভিন্ন। কখনো যেন মিল আছে, কখনো একেবারেই আলাদা।

যে লোগোগ্ৰাম থেকে বর্তমান চা শব্দের উৎপত্তি, তার ব্যবহার, যত দূর জানা যায়, সপ্তম শতাব্দীতে প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। তার পরে, ৭৮০ সাধারণ অব্দে বিখ্যাত চীন দেশীয় লেখক লু ইয়ু (Lu Yu) তাঁর সেই ‘চা চিঙ’ বা Classic of Tea বইতে চা বোঝাতে ঐ লোগোগ্ৰামই ব্যবহার করেন। লু ইয়ু  চায়ের ব্যাপারে বিভিন্ন বিষয় গুছিয়ে নিয়ে প্রথম বইটি লেখেন, যে বই আজও সারা বিশ্বে মহা সমাদৃত। আজ অবধি চীন এই পানীয় বোঝাতে লু ইয়ুর দেখিয়ে দেওয়া লোগোগ্ৰাম মেনে চলেছে।

চীনা ভাষায় চা শব্দের লোগোগ্ৰাফ, ৭৮০ সাধারণ অব্দ থেকে ব্যবহৃত।

বলে রাখা ভালো, স্বয়ং লু ইয়ু তাঁর লেখায় সমসময়ে ব্যবহৃত পাঁচটি বিভিন্ন শব্দ লিপিবদ্ধ করে গেছেন এই পানীয়র নাম বোঝাতে—চা, কিয়া, সে, মিঙ, চুয়েন। কিন্তু ব্যাপারটা হল, যে পানীয়কে চীনদেশের ক্যান্টনীজ ভাষায় ‘চা’ বলা হত, সেই একই পানীয়কে ঐ একই দেশের আ্যময় আর তার চারপাশের অঞ্চলে টী বা থে বলে মানুষ জানত।

আর এখান থেকেই শুরু সারা পৃথিবী জুড়ে একই পানীয়ের আলাদা নামের ।

ইতিহাস বলছে চীন দেশের এই পানীয় বা পণ্যটির বিদেশ ভ্রমণ শুরু উত্তর চীনের পাহাড়ি পথে—পঞ্চম শতাব্দীতে স্থলপথে তুরস্কের কাফেলা বা ক্যারাভানগুলোর হাত ধরে। ততদিনে চীন দেশের মানুষ চা পাতাকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে দিয়েছে। আর সেই সূত্রেই চীন দেশের উত্তর সীমান্ত বরাবর পাড়ি দিল চা। উত্তর চীনের সেই সব অঞ্চলের ভাষায় এই পাতাকে বলা হত ‘চা ইয়ে’ অর্থাৎ চা পাতা। ফলে তুরস্ক এই পাতা এবং তার থেকে প্রস্তুত পানীয়কে চেনে ‘চায়’ নামে।

পরবর্তীতে আরবরা চীনের চা পেতে শুরু করল উজবেক তাতারদের কাছ থেকে। ৮৫৫ সালের আরব ট্রাভেলারদের লেখায় তাই উঁকি ঝুঁকি মারে চা, যার আরবি নাম আজ অব্দি সায়। আজও আরবে বা তুরস্কে আপনি পাবেন সায় বা চায়ে—ক্যান্টনীজ চা-ইয়ের (চা পাতা) উত্তরসূরি।

ইতিমধ্যে অষ্টম শতাব্দীতে বৌদ্ধ শ্রমণদের মাধ্যমে জাপানে পৌঁছে গেছে চা এবং চীন দেশীয় পদ্ধতিতে চা সেরিমনি।

ধীরে ধীরে দেখা গেল পারস্য চা খেতে শুরু করে দিয়েছে। বেশ কিছুদিন পরে ১৬৩৩ সাধারণ অব্দের লেখায় আমরা দেখছি যে, পারস্যের মানুষ চা বড়ো ভালোবাসে এবং তারা চা পায় উজবেক তাতারদের কাছ থেকে। আজও পারস্য অর্থাৎ বর্তমানকালের ইরান এই পাতা এবং পাতা থেকে প্রস্তুত পানীয়কে চেনে চা নামে।

চীন থেকে রাশিয়ার ভৌগলিক দূরত্ব বেশি না হওয়া সত্ত্বেও সেখানে চা পৌঁছায় বেশ একটু দেরিতে—সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। কিন্তু ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো জলপথে নয়, রাশিয়াতে চা এসে পৌঁছাতো স্থলপথে—কাফেলার হাত ধরে। ফলে রাশিয়ায় এই পানীয়র নাম চায়।

রাশিয়া ছাড়া পর্তুগাল একমাত্র ইওরোপীয় দেশ যে এই পানীয়কে চা বলে চেনে—শুরুতেই বলেছি, ক্যান্টনের ভাষা অনুযায়ী।

পর্তুগিজদের কিছুদিন পরেই ডাচেরা হদিশ পেল—আ্যময়ের চীন দেশীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে, আ্যময়ের ভাষা অনুযায়ী টে নামে এই পানীয়র। তারা এবার পান করতে শুরু করল টে (tay) বা থী (thee) ।

ইওরোপীয় দেশগুলো এরপর তাদের সরবরাহ পেতে থাকলো মূলত ডাচেদের কাছ থেকেই। আর তাই আ্যময়ের ভাষা আর উচ্চারণের ছায়া রয়ে গেল ইওরোপীয়দের চায়ের, থুড়ি টী-য়ের, কাপে ।

তথ্যসূত্র   

  • William Ukers, All about Tea, Volume1, (Legar Street Press, 2023).
  • https://www.worldhistory.org/image/14112/movement-of-tea–cha-around-the-globe/

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে কলকাতা বন্দরে কর্মরত। ভালোবাসেন ইতিহাস, কবিতা এবং চা। এছাড়াও নিয়মিত গল্প-টী-খাসা নামে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে এক কাপ চায়ের সঙ্গে, বাংলা গল্প পাঠ করে শোনান।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।