সম্পাদকীয়

‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’
ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের প্রথম জনগণনার সময় থেকে এই শেষ জনগণনা পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যগুলি উনিশ ও বিশ শতকের ভারতে বর্ণ ও জাতিগুলির সামাজিক পরিস্থিতি ও অবনত বর্গের স্বরূপ সম্পর্কে যথেষ্ট স্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করেছে। পরাধীন ভারতের শেষ জনগণনা হয়েছিল ১৯৩১ সালে। ভারতের স্বাধীনতার পর এযাবৎ যে জনগণনাগুলি হয়েছে তাতে তপশিলি জাতি ও তপশিলি জনজাতি ছাড়া বাকি অবনত বর্গের জাতিগত তথ্য নথিবদ্ধ করা হয়নি। এই বছর, ২০২৫ সালে, ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগামী জনগণনায় জাতিগত তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এই তথ্য প্রকাশিত হলে স্বাধীনতার পর ব্যাপক নগরায়ণের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অবনত বর্গের আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বিগত এক শতকে কতটা পরিবর্তন হয়েছে, তার চেহারাটা পরিষ্কার হবে। জাতিগত জনগণনা থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বিদ্বানদের ভারতে ক্ষমতার ভারকেন্দ্রের পরিবর্তন সম্পর্কে বিশ্লেষণে সহায়ক হবে।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন যুগ থেকে শাসকদের সংরক্ষণে গড়ে ওঠা জাতি ও বর্ণপ্রথা মানবিকতার পরিপন্থী এক সামাজিক কাঠামো, এই প্রথার সঙ্গে যুক্ত অস্পৃশ্যতা স্বাধীনতার পর আইনত নিষিদ্ধ হলেও আজও দূরীকরণ সম্পূর্ণ হয়নি। তা সত্ত্বেও, দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা উচ্চাবচ জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথার যে বর্তমান ভারতে কোনও যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা নেই সে বিষয়ে জনমানসে কোনও মতবিরোধ নেই বলেই ধরে নেওয়া হয়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারি বিদ্যালয়ের জন্য সমাজ বিজ্ঞানের নতুন পাঠ্যপুস্তক কিন্তু আমাদের সেই অনুমানকে একটি বড়ো ধাক্কা দিয়েছে।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে এনসিইআরটি ২০২০ সালে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করার উদ্দেশে সপ্তম শ্রেণির সমাজ বিজ্ঞানের নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছে। ‘এক্সপ্লোরিং সোসাইটি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড বিয়ন্ড’ নামের এই বইটির প্রথম ভাগ এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। ইতিহাস, ভূগোল ও সমাজ সম্পর্কে যুক্তিসম্মত ধারণার অবসান ঘটিয়ে এই পাঠ্যপুস্তকে পবিত্র ভূখণ্ডের ধারণা ব্যাখ্যা করে একটি অধ্যায় সংযুক্ত হয়েছে। কিন্তু, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বোধহয় বর্ণ ও জাতিপ্রথা সম্পর্কে লেখা নতুন অংশটি। এই বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ের একটি অংশের শীর্ষক ‘দ্য বর্ণ-জাতি সিস্টেম’। এখানে বলা হয়েছে, এই জটিল বর্ণ-জাতি প্রথা ভারতীয় সমাজের অর্থনীতি সমেত সমস্ত কার্যকলাপকে সংগঠিত করে সমাজকে কিছুটা স্থিতিশীলতা দিয়েছিল। এখানে আরও বলা হয়েছে, বর্ণ ও জাতিপ্রথা নাকি সময়ের সাথে সাথে অধিক অনমনীয় হয়েছে এবং তার পরিণামে নিম্নজাতির প্রতি বৈষম্য ও কিছু জনগোষ্ঠীকে বর্ণ ও জাতিব্যবস্থা থেকে বহিষ্কৃত করার মতো কাজ হয়েছে। ঐতিহাসিক সত্যকে অগ্রাহ্য করে বর্ণ ও জাতিভেদ প্রতি এই ধরনের সহানুভূতিশীল ধারণা শিশুপাঠ্য পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য মহৎ নয় বলেই মনে হয়।
নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিশু ও কিশোরদের মনে যে সব ভ্রান্ত ধারণার অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে, তার প্রতিরোধ করা ভারতের ইতিহাস সচেতন মানুষের দায়িত্ব। বিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয়ের চত্বরের বাইরে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার ব্যাপকতার মাধ্যমে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে তাদের মতো করে ইতিহাস সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত তথ্য পৌঁছে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। ইতিহাস তথ্য ও তর্ক গোষ্ঠী এই কাজ প্রথম দিন থেকে করে চলেছে।