
প্রাগৈতিহাসিক মানুষের চোখে — অক্ষম বনাম বিশেষভাবে সক্ষম
“প্রতিবন্ধিত্ব আসলে উপলব্ধির বিষয়” — মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা
উপক্রমণিকা: ৩৪ হাজার থেকে ১২ হাজার বছর আগের কথা
কয়েক বছর আগে নৃতত্ত্ববিদ মার্গারেট মিড-কে একজন ছাত্র জিজ্ঞাসা করেছিল, তিনি সভ্যতার প্রথম চিহ্ন কী মনে করেন। মিড বলেন, একটা প্রাচীন সভ্যতার প্রথম চিহ্ন, একটা ঊর্বস্থি বা ফিমার হাড়—যা ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও সারিয়ে তোলা হয়েছিল। মিড ব্যাখ্যা করেছিলেন, প্রাণিজগতে আপনার যদি পা ভেঙে যায় তবে আপনি মারা যাবেন। একটা ভাঙা ঊর্বস্থি যা পরবর্তীকালে নিরাময় করা হয়েছে প্রমাণ করে, কেউ পড়ে থাকা ব্যক্তিকে সময় দিয়েছে, ক্ষতটি বেঁধে ব্যক্তিকে নিরাপদে রেখেছে এবং ব্যক্তির প্রতি যত্নবান থেকেছে। কষ্টের মধ্য দিয়ে কাউকে সাহায্য করাই সভ্যতার শুরু।১
মার্গারেট মিড সত্যি এই কথা বলেছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ভাঙা পা নিয়ে পড়ে থাকা ব্যক্তিকে নিয়মিত খাবার দিয়ে সুস্থ করে তোলার মধ্যে সত্যিই সভ্যতার ঊষালগ্ন লুকিয়ে আছে। প্রাগৈতিহাসিক মানুষ অসুস্থ ব্যক্তিকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে। তারা অন্য মানুষ কী ভাবছে তা বুঝতে পারত — অন্যের কষ্ট অনুভব করতে পারত বলে অসুস্থর প্রতি তাদের অনুকম্পা আসত, তাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করত।
যদিও এটা বেদনাদায়ক সত্য যে, নৃশংসতা এবং সহিংসতা মানবতার মতোই প্রাচীন, তবে মনে হয় অসুস্থ এবং প্রতিবন্ধীদের যত্ন নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ — চিরকালীন। অসুস্থ ব্যক্তিকে খাবার দিয়ে বাঁচতে সাহায্য করার বহু উদাহরণ আছে প্রাগিতিহাসে। তবে তার থেকে এক ধাপ উঁচুতে গিয়ে আরও একটু পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, এমনকি কিছু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রাগৈতিহাসিক যুগে বিশেষ সম্মান দেওয়া হত।
ইউরোপে শেষ প্রস্তর যুগের কবরে মানুষের দেহাবশেষের সঙ্গে কখনো কখনো থাকত ব্যক্তিগত অলংকার বা পশুর হাড় সহ অন্যান্য কবর সামগ্রী। শেষ প্রস্তর যুগ হল ৪০ হাজার থেকে ১০ হাজার বছর আগে পর্যন্ত সময়কাল—এই সময়ে পাথরের সঙ্গে হাড় এবং ম্যামথের দাঁতের ব্যবহার প্রচলিত হয়; তৈরি হয় ভেদ যন্ত্র, সুচ, বল্লম, তির ইত্যাদি।
৪০ হাজার বছর আগে থেকে সারা ইউরোপ জুড়ে একক, জোড়া ও তিনজনের কবর এবং তার সঙ্গে অসংখ্য ব্যবহারযোগ্য বস্তু ব্যাপক বিস্তারলাভ করে। বোঝা যায়, সেই সময়ে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে পরকালের এক যোগসূত্র তৈরি করার প্রচেষ্টা নেওয়া হত। তখনকার কয়েকটি কবরের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। রাশিয়াতে মস্কোর পূর্ব দিকে ভোলগার পাড়ে ‘সাংঘির’ সমাধিস্থল হল এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।২
‘সাংঘির’-এর রাজকীয় সমাধি
‘সাংঘির’ এলাকায় চারটি কবর পাওয়া গেছে—একজন বয়স্ক মানুষ এবং দুটি নাবালকের দেহাবশেষ বিশেষভাবে সংরক্ষিত ছিল। এই সময়কাল প্রায় ৩৪ হাজার বছর আগে। বিপুল সমাধি সামগ্রীর প্রকৃতি থেকে বোঝা যায়, তারা ছিল সমাজের উপরের স্তরের বিশেষ ব্যক্তিত্ব। এছাড়াও, পাওয়া গেছে একটা মানুষের মাথার খুলি এবং ফিমারের দুটি টুকরো।
‘সাংঘির’-এর ১ ও ২ নম্বর কবর ইউরোপের সবচেয়ে দর্শনীয় প্রত্নতাত্ত্বিক দেহাবশেষ বলে মনে করা হয়।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে কবর দেওয়া হয়েছিল ১ নম্বর কবরে। কবর ২-এ দুটি নাবালক ও নাবালিকাকে পরস্পরের মাথাতে মাথা ঠেকিয়ে লম্বালম্বি রাখা হয়েছিল। কেন পাশাপাশি না রেখে দুজনের দেহ লম্বা করে পরপর রাখা হয়েছিল তা এক প্রশ্ন। তবে লম্বালম্বি মাথা ঠেকানো কবর আরও পাওয়া গেছে। কবরে তিনজনকেই প্রচুর সামগ্রী দিয়ে সাজানো হয়েছিল—ছিল ম্যামথের দাঁতের পুঁতির গয়না, পোশাক এবং বর্শা। এখানে তিনটি কবর থেকে ১৩ হাজারের বেশি হাতির দাঁতের পুঁতি পাওয়া গেছে যা উত্পাদন করতে অন্তত ১০ হাজার ঘন্টা সময় লাগিয়েছিল—একজন মানুষের প্রায় ৪১৭ দিন।৩
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষটির গলায় কোনো অস্ত্র দিয়ে তীক্ষ্ণ আঘাত করা হয়েছিল। পুরুষটির সারা গায়ে ছিল লাল গিরিমাটি, তখন সমাধির সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ আচার অনুষ্ঠানের একটা উপাদান ছিল লাল গিরিমাটি। ছিল ৩ হাজার ম্যামথের দাঁতের পুঁতি, ফুটো করা শেয়ালের দাঁত এবং এক চমকপ্রদ ম্যামথের দাঁতের তাগা। আর ছিল ম্যামথের দাঁতের বর্শা, একই উপাদানের চাকতি, হরিণের শিং ইত্যাদি রাজকীয় জিনিসপত্র। বোঝা যায়, এই সমস্ত উপাদান পোশাকে আটকানো ছিল—তারপর সময়ের চাকা অনেকখানি গড়িয়েছে। পোশাক ও মাংস ধূলি হয়ে গেছে—গায়ে লেগে আছে পুঁতিগুলি।
এর নিচে পাওয়া গেছে দুই নাবালকের দেহাবশেষ—একটা ১০ বছর ও অপরটি ১২ বছরের। এই দুটি দেহাবশেষ সবচেয়ে বেশি সাজানো ছিল। জীবিত অবস্থায় শারীরিকভাবে এই নাবালক (১১–১৩ বছর বয়স, ‘সাংঘির ২’) ও নাবালিকা (৯–১০ বছর বয়স, ‘সাংঘির ৩’) পুরো স্বাভাবিক ছিল না। তাদের একজনের ফিমার (ঊর্বস্থি) অদ্ভুতভাবে বাঁকানো। অন্য নাবালকটির পেটে অস্বাভাবিকতা ছিল। দাঁতের ক্ষয় ছিল অস্বাভাবিক। কেন তারা মারা গিয়েছিল তা অবশ্য জানা যায় না—হতে পারে তাদের অস্বাভাবিকতার জন্য।
এখানেও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষটির মতো লাল গিরিমাটি দিয়ে দেহাবশেষ দুটোর মাথা ও বুক ঢাকা ছিল। কবর দেওয়ার আগে এই মাটি সম্ভবত ছিল তাদের গায়ে ও মাথায়। এদের শরীরে ছিল যথাক্রমে ৫,০০০ ও ৫,৪০০ ম্যামথের দাঁতের পুঁতি। দ্বিতীয় দেহের মাথায় ও কোমরে ছিল শেয়ালের দাঁতের মালা ও বেল্ট। দুজনেরই বাহুতে ছিল ম্যামথের দাঁতের তাগা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ১৬টি ম্যামথের দাঁতের বর্শা যার মধ্যে ৫টির ছিল জোড়া ফলা।
দুই নাবালক ও নাবালিকার সঙ্গে কবরে আরেকটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ফিমার শ্যাফ্ট (উরুর হাড়ের লম্বা অংশ) পাওয়া গেছে, কবরের কাছে অন্য একটা ঊর্বস্থি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলি কিন্তু কবর ১ এর প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নয়। এই সব ঊর্বস্থি থেকে বোঝা যায় যে চতুর্থ একটা দেহ কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই কবরগুলির কাছে পরিত্যক্ত হয়েছিল।৪
বোঝা যায়, সেই সময়ে বিভিন্ন ধরনের সমাধি দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। মৃত ব্যক্তির সঙ্গে কীভাবে আচরণ করা উচিত তা নিয়ে সমাজে সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস ও রীতি ছিল। স্থানটিতে কয়েকটি জমকালো সমাধি যেমন পাওয়া গেছে তেমনই আছে বিচ্ছিন্ন কঙ্কাল—তাদের কবরের উপাদানগুলির মধ্যে প্রভেদ থেকে বোঝা যায়, জীবদ্দশায় এই ব্যক্তিদের মধ্যে সামাজিক পার্থক্য ছিল যা তাদের মৃত্যুর পরেও প্রতিফলিত হয়েছে।
অবশ্য সাংঘির-এর প্রমাণগুলি থেকে বোঝা যায়, সেখানে কবর দেওয়া ব্যক্তিরা তাদের কর্মের মাধ্যমে মৃত্যুর পরে (এবং জীবিতাবস্থায়) এই বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেনি। অন্য কিছু বিষয়, সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের অবস্থান নির্ধারণ করতে সাহায্য করেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের মৃত্যুতে সেই অবস্থানের প্রতিফলন হয়েছে। বর্শা তৈরি করতে সময় লাগত, তাদের কার্যকারিতা ছিল—ভালো দাম ছিল। এই অল্পবয়সী ব্যক্তিদের পক্ষে তাদের জীবদ্দশায় এই ধরনের মূল্যবান বস্তুর সঙ্গে সমাধিস্থ হবার মতো যথেষ্ট মর্যাদা সঞ্চয় করার সম্ভাবনা কম।

চিত্র-১
‘সাংঘির’–কে ইউরোপের প্রাচীনতম মানুষের সমাধিস্থল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে যেখানে এমন এক সামাজিক কাঠামোর প্রমাণ রয়েছে যা শুধুমাত্র মানুষের স্ব–অর্জিত কাজের উপর নির্ভর করে না। ওই দুই নাবালক উভয়ই অন্যদের কাছে দৃশ্যমান শারীরিক অস্বাভাবিকতায় ভুগেছে।৫ সম্ভবত, শারীরিক পার্থক্য সমাজে তাদের একটা বিশেষ অবস্থান দিয়েছিল এবং তার ফলেই তাদের এত অতিরিক্ত জিনিসপত্র সহ কবর দেওয়া হয়েছিল।৬
আমাদের সমাজেও একসময়ে শারীরিকভাবে অস্বাভাবিক বাচ্চাদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হত। পরিচালক উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘দেবশিশু’ সিনেমাটি মনে আছে? তিনি ১৯৮৫ সালে আমাদের দেশের মানুষের ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে এই সিনেমা তৈরি করেছিলেন।
‘সাংঘির’-এর এই দুই নাবালকও কি দেবশিশুর মর্যাদা পেয়েছিল?
মানুষের মৃত্যু এবং তার পরে তাদের শেষকৃত্যর মধ্যে পার্থক্য করার প্রচেষ্টা হল আমাদের পূর্বসূরিদের সামাজিক জটিলতার শক্তিশালী প্রমাণ। ঠাকুরদাস মুখুয্যের বর্ষীয়সী স্ত্রী সাতদিনের জ্বরে মারা গেলে কাঠের মধ্যে চন্দনের টুকরো, ঘি, মধু, ধূপ, ধুনা দিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়। তবে দুলের মেয়ে, ছোটো জাতের কাঙালীর মা’র মুখে একটু নুড়ো জ্বেলে দিয়ে নদীর ছড়ায় মাটি দিতে হয়।
ইজরায়েল-এর প্রতিবন্ধী নারী
অনেকটা পরে, লেভান্ত অঞ্চলে কবরে ১২ হাজার বছর আগের একাধিক দেহাবশেষ পাওয়া গেছে।
দক্ষিণ লেভান্ত-এর নাটুফিয়ানরা আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। যাযাবর বৃত্তি থেকে এরা একটা অঞ্চলে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার সূচনা করেছিল। তাদের পেশার পরিবর্তন হয় এবং ধীরে ধীরে তারা পশুপালন ও কৃষিকাজ শুরু করে। ১২ হাজার বছরের পুরানো ইজরায়েল-এর নাটুফিয়ান গুহা ‘হিলজন ট্যাকটেট’ (Hilazon Tachtit)-এ খনন করা একটা কবরে এই আর্থ–সামাজিক পরিবর্তনগুলির সঙ্গে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বোঝবার একটা বিরল সুযোগ পাওয়া গেছে।
কবরটি বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল একজন ছোট্টোখাট্টো, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী নারীর জন্য। দেহটি কবরের মধ্যে ব্যতিক্রমী ধরনের অর্ঘের সঙ্গে ছিল। কবরে ৫০টি গোটা কচ্ছপের খোসা, একটা বুনো শুয়োর, একটা ঈগল, একটা গরু, একটা চিতাবাঘ, দুটি বেজি জাতীয় প্রাণী, সেই সঙ্গে একটা মানুষের পায়ের অংশ ছিল।
কবর নির্মাণ এবং সিল করার জন্য ব্যবহৃত আচার–অনুষ্ঠান ও পদ্ধতি থেকে বোঝা যায়, এটি একটা শামানের কবর। প্রাগৈতিহাসিক এবং বর্তমান শিকারি-সংগ্রাহক সমাজের বাস্তব জগৎ ও আধ্যাত্মিক জগতের মধ্যে মধ্যস্থতাকারিকে শামান বলা যায়। এই সমাধির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য পরবর্তীতে বিভিন্ন অঞ্চলের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে।৭

চিত্র-২
সমাজে শামানদের বিশেষ সুবিধা পাওয়া ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তারা তাই তাদের গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের থেকে আলাদা ধরনের পরকাল উপভোগ করে, কবরের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাদের মর্যাদার পার্থক্য বোঝায়। এই কবরটি সমাধিস্থ ব্যক্তির বিশেষ মর্যাদা এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে তার উঁচু অবস্থান নিশ্চিত করে।
তাছাড়া, শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের, কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ আধ্যাত্মিক ক্ষমতার উদাহরণ হয়তো এই কবর। এই প্রসঙ্গে রাশিয়ার সাংঘির-এর দুটি বালকের কবরের কথা মনে করা যেতে পারে।
কবরের সঙ্গে থাকা জিনিসগুলিও শামানের কবরের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে। কচ্ছপ, গরুর লেজ, ঈগলের ডানা এবং পশম আবৃত প্রাণী বিশ্বব্যাপী মানব সংস্কৃতির আধ্যাত্মিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী এবং শামানবাদী ভূমিকা পালন করেছে। কচ্ছপ নৃত্য আন্দামানের আদিবাসী উপজাতিদের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। আবার মুন্ডা সৃষ্টিতত্ত্বে কচ্ছপের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ।
মালয়েশিয়ার এক প্রাগৈতিহাসিক প্রতিবন্ধী
মালয়েশিয়ার লেংগং উপত্যকায় একজন ব্যক্তির ১১,০০০ বছরের পুরানো দেহাবশেষ পাওয়া গেছে।৮ তার বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল। তার কনুই বাঁকানো ছিল, কব্জি ছিল প্রসারিত এবং তার বাম মধ্যমা আঙুল ছিল অস্বাভাবিক। তার স্কোলিওসিস হয়েছিল—স্কোলিওসিস হল মেরুদণ্ডের পার্শ্বীয় বক্রতা, এই রোগে মেরুদণ্ড স্বাভাবিক সোজা না থেকে S বা C আকৃতির হয়ে যায়। আবার এই ব্যক্তির বাম নিম্ন অঙ্গটি ছোটো ছিল। সে সম্ভবত খুঁড়িয়ে হাঁটত। ৪০ থেকে ৪৫ বছর সে বয়সে মারা গিয়েছিল, যা তার সময়ের আয়ুষ্কালের থেকে অনেকটা বেশি। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ইঙ্গিত দেয় যে তাকে উপজাতির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সম্ভবত একজন শামান হিসেবে সমাহিত করা হয়েছিল। তার অস্বাভাবিকতার কারণে, সে সম্ভবত কার্যকরভাবে শিকার করতে অক্ষম ছিল, তবুও স্পষ্টতই তাকে আরও উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে দেওয়া হয়েছিল। একজন সম্মানিত ব্যক্তির মতো সে দীর্ঘ জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়েছিল, তাকে পূর্ণ সম্মানের সঙ্গে সমাহিত করা হয়েছিল।
সেই প্রাগৈতিহাসিক সমাজে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তার অনন্য ক্ষমতা ব্যবহার করে সমাজে অবদান রাখতে এবং একটা সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারত।

চিত্র-৩
প্রতিবন্ধিত্ব ও সামাজিক আচরণের বিবর্তন
শারীরিক এবং মানসিক কারণে আজকের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রায়ই সামাজিক মর্যাদা অর্জনে অসুবিধা হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সঙ্গে তার অক্ষমতার কারণে দুর্ব্যবহার করা হয়। তাকে ল্যাংড়া, কানা বলে ভেংচানো হয়। প্রতিবন্ধী শিশুরা বিশেষ করে নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকে। এই নির্যাতন তাদের সামগ্রিক সুস্থতার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বাধা হতে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
শেষ প্রস্তর যুগে, প্রাগৈতিহাসিক কালে, শুধু এই দুই-চার জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নয় যাদের এই সময়ে সমাধিস্থ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এই সময়ে উল্লেখযোগ্য বিকাশগত বা অবক্ষয়জনিত অস্বাভাবিকতাযুক্ত ব্যক্তিদের সমাধি রেকর্ডে তুলনামূলকভাবে বেশ বেশি, যা পর্যাপ্তভাবে সংরক্ষিত ব্যক্তিদের কবরের এক-তৃতীয়াংশ—গবেষকরা গবেষণায় বলেছেন।৯ সম্ভবত এদের একটা অংশ ছিল শামান। তবে তাছাড়াও যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিশেষ সম্মান পেত তার প্রমাণ সাংঘির।
বর্তমান সমাজ প্রাগিতিহাস থেকে ভাবতে এবং শিখতে পারে। এই সমাজ যদি প্রতিবন্ধীদের তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনে সহায়তা করতে পারে তবে সকলেই উপকৃত হবে।
চিত্র পরিচিতি
শীর্ষক চিত্র: সাংঘির সমাধির অসাধারণ নিদর্শন। ১০ বছর ও ১২ বছর বয়সী দুটি বালক-বালিকা যাদের পোশাক এবং অন্যান্য অলঙ্কারে সুসজ্জিতভাবে সাজানো হয়েছে। ছিদ্রযুক্ত একটি চাকতি এখানে একটি কাঠের বর্শার উপরে দেখানো হয়েছে। শিল্পী: লিবোর বালাক।
চিত্র ১ –‘সাংঘির ১’-এর শরীর, তার লাল গিরিমাটি যুক্ত মাথার খুলি দেখা যাচ্ছে। ছবি: কে. গ্যাভ্রিলভ।
চিত্র ২–কবরে উপস্থিত প্রাণীদের শরীরের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ। প্রতিনিধিত্ব করা শরীরের অংশের অবস্থান একটা বিন্দু দিয়ে প্রাণীর চিত্রে নির্দেশিত হয়েছে। চিত্র ঋণ – ছবি তুলেছেন জি হার্টম্যান নৃবিজ্ঞান বিভাগ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়; এঁকেছেন পি. গ্রোজম্যান।
চিত্র ৩ – শামান।
তথ্যসূত্র
১. Remy Blumenfeld, How A 15,000-Year-Old Human Bone Could Help You Through the Coronacrisis. Forbes, (Updated 2021).
২. Laura Gegge, This Ancient Society Buried Disabled Children Like Kings. LiveScience (2018).
৩. Erik Trinkaus et al., Diversity and differential disposal of the dead at Sunghir. Antiquity 92(361), 7-21 (2018).
৪. M. Dobrovolskaya, P Richards, E. Trinkaus, “Direct radiocarbon dates for the Mid Upper Paleolithic (eastern Gravettian) burials from Sunghir, Russia”; Bulletins et mémoires de la Société d’anthropologie de Paris. 24(1–2), 96–102 (2011).
৫. Erik Trinkaus and Alexandra P. Buzhilova, Diversity and differential disposal of the dead at Sunghir. Antiquity 92(361), 7-21 (2018).
৬. Lea Surugue, Why This Paleolithic Burial Site Is So Strange (and So Important). Sapiens.org, (2018).
৭. Leore Grosman et al., A 12,000-year-old Shaman burial from the southern Levant (Israel). PNAS 105(46) 17665-17669 (2008).
৮. Izzati Razak et al, People with disabilities: An ancient society got it right, but can we?. International Journal on Disability and Human Development 17(4), 445-449 (2018).
৯. Laura Gegge, This Ancient Society Buried Disabled Children Like Kings. LiveScience (2018).
প্রতিবন্ধীদের যে সম্মান বা সহানুভূতির সঙ্গে দেখা হতো, এই বিষয়টি আমাকে আলোড়িত করলো সব থেকে বেশি। অন্যান্য বিদ্ধৃত বিষয়গুলি বিশেষ রকম মহার্ঘ্য। লেখিকাকে অভিনন্দন।