সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

মে ১, ২০২৪

১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস

প্রতি মে দিবসের গানে গানে

নীল আকাশের তলে দূর

শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ

হেনরীর হাতুড়ির সুর

হো হো হো হো- হেনরীর হাতুড়ির সুর।।

ভারত, কিউবা এবং চীন সহ ৬০ টিরও বেশি দেশে প্রতি বছর ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস হিসেবে পালিত হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপ, রাশিয়া ও আমেরিকাতে শ্রমিক শ্রেণী দিনে ৮ ঘন্টা কাজের সময়ের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করেছে। তখন কাজের অবস্থা কতটা নিকৃষ্ট ও অস্বাস্থ্যকর ছিল, কতটা অনিরাপদ পরিস্থিতিতে তাদের ১০ থেকে ১৬ ঘন্টা কাজ করতে হতো তা সেই সময়ের বিভিন্ন উপন্যাস ও গল্প পড়লে বোঝা যায়। চার্লস ডিকেন্স-এর ‘অলিভার টুইস্ট’ লেখা হয়েছে ১৮২৮ সালে, ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ ১৮৫০ সালে এবং ‘হার্ড টাইমস’ ১৮৫৪-তে। আমেরিকাতে ১৮৫২ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’। এই সেই সময় যখন রুশ সাহিত্যের স্বর্ণ যুগ চলছে— ফিওদোর দস্তয়েভ্‌স্কি বা লেভ তলস্তয়ের বিভিন্ন উপন্যাসে সরাসরি না হলেও রুশ শ্রমিকের জীবনের কথা উঠে এসেছে। আর ১৮৬৮ সালে ভোলগা নদীতীরবর্তী নিজ্নি নোভ্গরদ শহরে জন্ম নিয়েছেন ভবিষ্যতের ‘মা’ উপন্যাসের লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি।

ইতিমধ্যে লন্ডন শহরে জার্মান ভাষায় রচিত হয়েছে ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে মানব শব্দভাণ্ডারে নতুন শব্দ সংযোজিত হলো— শ্রেণী দ্বন্দ্ব ও শ্রেণী সংগ্রাম।

১৮৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে, শ্রমজীবী মানুষ বেতন কাটা ও কর্মদিবস ছোটো করার জন্য আন্দোলন করছিলেন কিন্তু সংগঠিত শ্রম ৮-ঘন্টা কর্মদিবস ঘোষণা করার মতো যথেষ্ট শক্তি অর্জন করতে পারেননি।

১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরে সাধারণ শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়৷ এই ধর্মঘটের লক্ষ্য ছিল কাজের সময় দৈনিক ৮ ঘন্টায় সীমিত করা। ৪ঠা মে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বহু শ্রমিক নিহত ও আহত হন৷ ‘হে মার্কেট’ নামে খ্যাত এই আন্দোলন ঝিমিয়ে এলেও শ্রমিক ইউনিয়নের অধিকার আদায়ের নিরলস প্রচেষ্টা থেমে যায়নি৷ ‘হে মার্কেট’ স্কোয়ারে শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে শ্রমিকরা তাদের অধিকারের দাবিতে এবং উন্নত কাজের পরিবেশের জন্য লড়াই চালিয়ে যান।

১৮৮৯ সালে ‘হে মার্কেট’ দাঙ্গায় নিহত শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, প্যারিস-এ সমাজতন্ত্রী ও শ্রমিক পার্টি, পয়লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে৷ এর পরের বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মে দিবসে শ্রমিক ধর্মঘট ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়৷

ভারতে প্রথম শ্রম দিবস পালিত হয় ১লা মে, ১৯২৩ সালে, চেন্নাইতে। হিন্দুস্তান লেবার কিসান পার্টি প্রথম মে দিবস উদযাপনের আয়োজন করেছিল। দলের নেতা কমরেড মালয়পুরম সিঙ্গারাভেলু এই উপলক্ষে দুটি সভার আয়োজন করেন। সিঙ্গারাভেলু ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা— প্রাথমিকভাবে গান্ধীবাদী, পরে তিনি উদীয়মান কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯২৫ সালে, তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হয়ে ওঠেন এবং কানপুরের উদ্বোধনী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পালিত হয় এবং সংগঠিত শ্রমিক সেক্টরে ১লা মে ছুটি থাকে। তবে তা মুষ্টিমেয় সংগঠিত শ্রমিকদের জন্য। ভারতে অংসংগঠিত শ্রমিক হলো ৯৪ শতাংশ এবং তারা জিডিপির ৪৫ শতাংশ উৎপাদন করেন। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ অকৃষি অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং তারা জিডিপির ৩০ শতাংশ উৎপাদন করেন।

মাত্র ৬ শতাংশ শ্রমিক সংগঠিত খাতে কাজ করেন এবং জিডিপির ৫৫ শতাংশ উৎপাদন করেন।

শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং শোষণের হাত থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য বিশ্বজুড়ে শ্রম দিবস পালিত হয়। তবে আমাদের দেশে এই অসংগঠিত বিপুল শ্রমিক শ্রেণী এখনও দিনে ১০-১২ ঘন্টা কাজ করেন। গৃহ কর্মী, স্ব-নিযুক্ত কর্মী বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের মজুরি কর্মী তফসিল উল্লিখিত আইনগুলির কোনোটির আওতায় নেই। এই সব শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক শ্রেণীর জন্য কোনো সরকারী আইন ও বিধি প্রয়োগ করা হয় না। এই ধরনের একটি সেক্টরে প্রবেশ করা সহজ কারণ এখানে প্রবেশ করতে কোনো শংসাপত্রের প্রয়োজন নেই। চারিদিকে জোমোটো, সুইগি, ব্লিনকিট ও বিভিন্ন হোম ডেলিভারির কর্মীদের নিজেরাই দেখি প্রায় প্রাণ হাতে করে শহরে, নগরে সাইকেল, বাইক ইত্যাদিতে ‘মিনিটের মধ্যে’ ঘরে ঘরে পণ্য বস্তু পৌঁছে দিতে। মল ও দোকানে দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় ১২ ঘন্টা কাজ করেন একবিংশ শতকের নতুন ভারতের তরুণ তরুণীরা। অথবা ওলা ও উবের ক্যাব ড্রাইভার মালিকের গাড়িতে দিনে ১২ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য হন।

এদের কারোর চাকরিতে নেই সুরক্ষা।

তাঁদের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস কোনো বিশেষ অর্থ বহন করে না। অবশ্য—

অধিকার কে কাকে দেয়? অধিকার কেড়ে নিতে হয়, লড়ে নিতে হয়