সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

মুঘল আমলে বঙ্গদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা: মিথ এবং বাস্তব

মুঘল আমলে বঙ্গদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা: মিথ এবং বাস্তব

শিবাশীষ বসু

জুন ২১, ২০২৫ ১১৪ 1

(এক)

সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে ভারতবর্ষ বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি ছিল—এমনটাই দাবি করেন কিছু উত্তর ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবী। তাঁদের আরও দাবি রত্নখচিত এই মুকুটের কোহিনূরটি ছিল আমাদের এই বাংলাদেশ। এই দাবির কতটা উচ্ছ্বাস, কতটা পাথুরে প্রমাণ; কতটাই বা মিথ, কতটা বাস্তব—আসুন সেই বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

বাংলাদেশে মুঘল শাসনের ভিত মোটামুটি সংহত হতে আরম্ভ করে সম্রাট আকবরের সময়ে থেকে। এই সময়েই টোডরমল প্রথমবার বাংলার রাজস্ব নির্ণয় করলেন। রমেশ চন্দ্র দত্ত তাঁর ‘দি ইকোনমিক হিস্ট্রি ইফ ইন্ডিয়া আন্ডার আর্লি ব্রিটিশ রুল’ গ্রন্থে জানিয়েছেন,

  • ১৫৮২ সালে টোডরমলের সময়ে সুবা বাংলার বার্ষিক রাজস্ব স্থির হয় ১ কোটি ৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকা।
  • ১৬৫৮ সালে শাহ সুজার সময়ে বাংলার আবারও ভূমি বন্দোবস্ত হয়েছিল—আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ ধার্য হয়েছিল ১ কোটি ৩১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। তাঁর সময়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্ষিক মাত্র তিন হাজার টাকা শুল্কের বিনিময়ে বঙ্গে অবাধ বাণিজ্যের অনুমতি লাভ করে।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে যাঁরা বাংলার সুবেদার হয়ে আসেন তাঁদের মধ্যে মীরজুমলা, শায়েস্তা খান, খান-ই-জাহান, ইব্রাহিম খান এবং আজিম-উশ-শানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৬৫৯ সালে মীর জুমলা বাংলার সুবেদার হয়ে এসে ক্রমাগত আসাম ও কোচবিহারের রাজার সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকেন। তাঁর দীর্ঘদিনের যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের উপর তিনি আরও রাজস্বের বোঝা চাপিয়ে দেন। এর ফলে জনজীবনে প্রবল অর্থাভাব দেখা দেয় এবং প্রচুর মানুষ অনাহারে মৃত্যুর শিকার হন। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতার জন্য খাদ্যদ্রব্য চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং অভ্যন্তরীণ শুল্কের কর্মকর্তাদের নির্মম অত্যাচার। ঐতিহাসিক শিহাবুদ্দীন তালিশ তাঁর ‘তারিখ-ই-আসাম’ গ্রন্থে জনজীবনের এই দুর্দশা সম্বন্ধে লিখেছেন—

‘Life appeared to be cheaper than bread, and bread was not to be found.’

মীর জুমলার পরে ১৬৬৪ সালে বাংলার শাসক হয়ে আসেন শায়েস্তা খান। তিনি সুযোগ্য শাসক ছিলেন। বঙ্গদেশের ইতিহাসে শায়েস্তা খানের সুখ্যাতির প্রধান কারণ হচ্ছে তাঁর সময়ের সস্তা দ্রব্যমূল্য—টাকায় আট মণ চাল বিক্রির মতো অবিশ্বাস্য ঘটনা তাঁর সময়েই প্রথম ঘটে। তবে তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন এবং অর্থলোভী ছিলেন। ইংরেজ ঔপনিবেশিক প্রশাসক ‘স্ট্রেইনশাম মাস্টার’, যিনি তৎকালীন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন অগ্রদূত ছিলেন, ২৮ অক্টোবর ১৬৭৬ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন—

‘Shaista Khan in his less than 13 years’ governorship of Bengal had got so great a treasure together as the like is seldom heard of now-a-days in the world, being computed by knowing persons at 38 crores of rupees, and his income is daily two lakh rupees, of which his expenses is about one half.’

শায়েস্তা খানের পর আওরঙ্গজেব খান-ই-জাহান-কে বাংলার সুবেদার করে পাঠান। তিনি ছিলেন অযোগ্য শাসক। এই কারণে এক বছর পরেই সম্রাট তাঁকে পদচ্যুত করে ইব্রাহিম খানকে নিয়োগ করেন। খান-ই-জাহান স্বল্পকাল রাজত্ব করা সত্ত্বেও দিল্লি প্রত্যাবর্তনের সময়ে দুই কোটি টাকা সঙ্গে নিয়ে যান।

১৭০০ সাল নাগাদ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব লক্ষ্য করেন, বিভিন্ন কারণে বাংলার রাজস্ব আদায় ক্রমে কমে আসছে। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য তিনি তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারী করতালাব খাঁ-কে (পরবর্তীকালে মুর্শিদকুলী খাঁ নামে বিখ্যাত) বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করলেন।

  • ১৭০০ সালে আদায় হল ১ কোটি ১৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
  • ১৭১৭ সালে সুবেদার নিযুক্ত হয়ে তিনি বাংলার জমি জরিপ করালেন। ১৭২২ সালে নতুন ভূমিব্যবস্থায় ১৩.৫ শতাংশ রাজস্ব বাড়িয়ে আদায় হল ১ কোটি ৪২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা।
  • ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলা আদায় করেছিলেন ১ কোটি ৪২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

বাংলার কৃষক শ্রমিক কারিগরদের রক্ত জল করা পরিশ্রম থেকে আদায় করা শুল্ক থেকে দিল্লির সম্রাটকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাঠানো হত। বাংলার অর্থনীতি সঙ্কটময় হয়ে উঠেছিল বাদশাহকে রাজস্ব দিতে গিয়ে। ‘অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপট’ প্রবন্ধে সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন—

‘শত শত চটের থলেতে করে রৌপমুদ্রা দিল্লিতে প্রেরণের পর দেশ এমন মুদ্রাসঙ্কটে পড়ে যেত যে টাকার সরবরাহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময়ে লাগতো ন্যুনপক্ষে ছয় মাস।’

সুবেদার থেকে আরম্ভ করে সকল স্তরের কর্মচারীরা যে অর্থ সঞ্চয় করতেন তার অধিকাংশই বাংলার বাইরে চলে যেত। ইংরেজ শাসনকালে বাংলার যে অবস্থা হয়েছিল এটা তারই পূর্বাভাষ। অবশ্য ঔপনিবেশিক শোষণের সঙ্গে মুঘল বা নবাবদের শোষণের পার্থক্য একটা আছে—ইংল্যান্ড-এ যে টাকাটা যেত সেটা ভারতের সংবহনের বাইরে চলে যেত, কিন্তু মুঘল সম্রাটের হাতে গেলে তা ভারতীয় অর্থনীতির মধ্যে থাকত। তবে এখানে একটা প্রশ্ন আছে, দিল্লিতে যাওয়া এই টাকা কি বাংলার মানুষের জন্য খরচ করা হত? অনেকে বলেন, মুঘল যুগে দেশের টাকা দেশে থাকত, তাঁদের মনে রাখতে হবে, সে যুগের ভারতবর্ষে আজকের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের শুল্ক ছত্রিশগড়ের আদিবাসী উন্নয়নে খরচ হত না। দিল্লির বাদশাহের ঘরে সেই রাজস্বের টাকা ঢোকার পর কানাকড়িও ফিরে আসত না। সেই শুল্ক বাদশাহ ও তাঁর প্রতিপালিতদের ফুর্তি আর বিলাসব্যসনে, বড়ো বড়ো ইমারত আর স্থাপত্য বানাতে এবং বিশাল মুঘল সেনার রক্ষণাবেক্ষণে খরচ করা হত।

বাংলাদেশের পণ্যমূল্য ছিল কম—একথা সঠিক। তবে এই বৃত্তান্তগুলিতে শুধুমাত্র পণ্যমূল্যের উল্লেখ থাকে, বাংলার জনগণের আয় ও মজুরি সম্পর্কে বিশেষ তথ্য থাকে না। দ্রব্যের মূল্য দেশের নির্দিষ্ট অঞ্চলের লোকের আয়ের সঙ্গে তুলনামূলক অনুমান না করে ভিন্ন অঞ্চলের মূল্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়।

বাংলা থেকে দিল্লিতে এই বিশাল অর্থ অপসারণের ফলে বাংলা ক্রমে দরিদ্র হয়ে পড়েছিল। দরিদ্র হলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, ক্রয়ক্ষমতা কমলে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পায়। বস্ত্রের মূল্য সস্তা হলে তাঁতির মজুরি বেশি হতে পারে না, কৃষিপণ্যের মূল্য সস্তা হলে কৃষি-শ্রমিকের মজুরিও স্বভাবতই কম হয়।

খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও ‘সোনার বাংলা’-র কিংবদন্তি তাঁত শিল্পের কারিগরদের কথা উল্লেখ করা যায়। মুঘল যুগে স্বর্ণশিখরে উঠেছিল বাংলার তাঁতশিল্প। সেই সময়ে কেমন ছিল এই শিল্পের চাষী ও কারিগরদের অবস্থা? ভালো ফসল হলে এক বিঘে জমিতে দু-মণ কার্পাস উৎপন্ন হত। চাষের খরচের দায়ে, পেটের দায়ে গরীব চাষীরা দালালের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিত এবং বাজার দরের চেয়ে কম দামে কার্পাস বিক্রি করতে বাধ্য হতেন। ‘ঢাকাই মসলিন’ গ্রন্থে আবদুল করিম লিখেছেন, চতুর দালালদের ফাঁদে পড়ে নিরক্ষর চাষীরা প্রায় সময়েই তাদের শ্রমের ন্যায্য মুল্য পেতেন না।

অ্যাডাম সাহেব বর্ণিত বঙ্গদেশের গ্রামেগঞ্জে অবস্থিত তথাকথিত এক লাখ পাঠশালা যাতে নাকি ‘খেটেখাওয়া মানুষ’রা ব্যবহারিক জীবনের শিক্ষা পেত, তা যে কতবড়ো মিথ, এই উদাহরণেই বোঝা যায়। গরিব কার্পাস চাষিরা যেমন দালাল ও পাইকারদের ফাঁদে পড়ে ঠকতে বাধ্য হতেন, একইভাবে তাঁতিদের ঠকাবার লোকেরও অভাব ছিল না।

‘যেসব তাঁতি মুঘল তাঁতখানায় কাজ করত, দারোগা-ই-মলবুস খাস ও তাঁতখানা তাদের ফাঁকি দিতেন এবং সময়ে সময়ে অত্যাচারও করতেন।’

আড়ং-এর সর্বাপেক্ষা নিপুণ তাঁতিরা মুঘলদের তাঁতখানায় বেঁচে থাকার মতো মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হতেন, কোনো তাঁতি অন্য কোনোখানে কাজ করতে গেলে তাকে ধরে এনে অত্যাচার করা দৈনন্দিন ব্যাপার ছিল। ফরাসি লেখক আবে রায়নাল বলেছেন—

‘বাংলায় দক্ষ তাঁতি হওয়া দুর্ভাগ্যের লক্ষণ ছিল, কারণ তাদের নগণ্য মজুরির বদলে কাজ করতে বাধ্য করা হত।’

আধুনিককালের ইতিহাসবিদরা বারংবার বাংলার তাঁতিদের প্রচণ্ড দারিদ্র্যের কথা বলেছেন; এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক কে. এন. চৌধুরীর মন্তব্য—

‘But the universal poverty of the weavers, repeated with such persistence throughout the seventeenth and eighteenth centuries, becomes difficult to explain in view of their equally well-recorded spatial and occupational mobility.’

প্রাক-ব্রিটিশ আমলে বাংলায় দাসপ্রথা চালু ছিল। সমাজে সকলেই যদি সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকে তাহলে সেখানে দাসপ্রথা চালু থাকতে পারে না।

সস্তা দ্রব্য এবং জীবনযাত্রার উচ্চমান পরস্পর সম্পর্কিত নয়।

(দুই)

‘সোনার বাংলা: কিংবদন্তি ও বাস্তব’ প্রবন্ধে আকবর আলি খান লিখেছেন,

‘বাংলায় লোকের আয়ের তুলনায় দ্রব্যমূল্য সস্তা ছিল না এ ধরনের ইঙ্গিত ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্তেই রয়েছে। প্রথমত ইবনে বতুতা লিখেছেন, বাংলায় করের হার খুব বেশি ছিল। পূর্ব বাংলা সফরের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘এখানকার প্রজারা মুসলমান রাজার বিধর্মী প্রজা। এদের ফসলের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ নিয়ে নেয়া হয়। তার উপরে তাদের কর দিতে হয়।’ যেহেতু আদায়কৃত কর জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হত না, বরং দিল্লিকে নজরানা প্রদান এবং যুদ্ধের জন্য ব্যয় করা হত, সেহেতু করের উচ্চহার জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বিশেষভাবে ত্রাস করে।’

এই ধরনের কর ব্যবস্থা চালু থাকলে দ্রব্যমূল্য কম হতে বাধ্য।

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ‘ফ্র‍ান্সিসকো পেলসার্ট’ নামে একজন ওলন্দাজ পর্যবেক্ষক তাঁর ‘Remonstrantie’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন,

‘সাধারণ মানুষ এমনই প্রচণ্ড দারিদ্রের মধ্যে বাস করে যে তাদের জীবনের ছবি বা নিখুঁত বিবরণ দিলে বলতে হয় এই জীবন শুধু এক তীব্র অভাব ও নিদারুণ দুঃখের বাসভূমি।’

কৃষকদের হিতের জন্য জমিদারদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। গবেষক বিপ্লব দাশগুপ্ত জানিয়েছেন—

‘একজন অত্যাচারী জমিদার ৭৫০টি কৃষক পরিবারকে ভূমিদাসের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলেন।’

ইরফান হাবিব, আবুল ফজলের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরী’ থেকে তথ্য তুলে দেখিয়েছেন,

‘বাংলায় নুন ছিল খুবই দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্যও। বাংলার কোনো কোনো অংশে এবং আসামে মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যবহার করত কলাগাছের গোড়া পুড়িয়ে এক ধরণের উৎকট বস্তু; এর মধ্যে অবশ্য কিছু পরিমাণে নুন আছে।’

হাবিব বাংলাদেশের স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে চাষীদের অতি স্বল্প দৈর্ঘ্যের কাপড় পরবার কথা জানিয়েছেন। তবে হাবিবের মতে গোটা সপ্তদশ শতক জুড়েই ভারতবর্ষের প্রধানত পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে একাধিক ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের কথা জানলেও বাংলাদেশ মোটামুটিভাবে দুর্ভিক্ষহীন ছিল। কেবলমাত্র শিহাবুদ্দিন তালিশ রচিত ‘ফাতিহা-ই-ইব্রিয়া’-তে পাওয়া গেছে—

‘বাংলা প্রদেশের ঢাকায় ১৬২২-২৩ সালে এক আঞ্চলিক দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে শুরু করে। খাদ্যশস্য রপ্তানির ওপর জোর করে সরকারী কর আদায় ও পথে নানারকম বাধার ফলে এই দুর্দশা আরও বেড়ে যায়।’

কৃষক নিপীড়নের ব্যাপারে মুঘল যুগ তার পরবর্তী যুগের চেয়ে পিছিয়ে ছিল না। জায়গীরের রাজস্ব থেকেই যেহেতু মনসবদারের সামরিক বাহিনীর ভরণপোষণ করতে হত, তাই তারা যথাসম্ভব চড়া হারে রাজস্ব আদায় করত—চাষীদের বেঁচে থাকবার জন্য একেবারে ন্যুনতম যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু বাদ দিয়ে বাকি সবটুকুই কড়ায়গণ্ডায় আদায় করে নেওয়া হত। এই উদ্বৃত্ত উৎপাদন আত্মসাৎ করেই মুঘল শাসকশ্রেণীর বিশাল সম্পদ গড়ে উঠেছিল। সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন—

‘যেকোন মানদণ্ডে মুঘল আমলে কৃষকের উপর খাজনার হার ছিল খুবই বেশি। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের পূর্বকালে খাজনার হার ছিল সমগ্র উৎপাদনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ আর আওরঙ্গজেবের সময়ে উক্ত হার আরও বৃদ্ধি পেয়ে হয় উৎপাদনের প্রায় অর্ধাংশ। মুর্শিদকুলী খানের সময়ে (১৭০৪-১৭২৭) খাজনার হার ফসলের অর্ধাংশ ধার্য করা হয়।’

কৃষকদের উপর রাজস্ব আদায়ের জন্য অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন পর্যটক মানুচ্চি—

‘তাদের গাছের সঙ্গে বাঁধা হত এবং তাদের ঘুষি ও কোড়া মারা হত। এক ইঞ্চি গভীর এবং এক ফ্যাদম লম্বা ষাঁড়ের ল্যাজের মতো পাকানো দড়ির নাম ‘কোড়া’। এর সাহায্যে তারা পাঁজরা ও হাড়ের বিভিন্ন অংশে ও পরে সারা শরীরে সর্বশক্তি দিয়ে মারত। বিভিন্ন জায়গায় প্রায় এক ইঞ্চি গভীর দাগ বসে যেত ও চামড়া ফেটে যেত।’

প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বে ঋণ শোধে অসমর্থ কৃষকদের কীভাবে সাজা দেওয়া হত, শুনিয়েছেন বিপ্লব দাশগুপ্ত—

‘কাউকে চাবুক মারা হত, কাউকে শিঙ্গি মাছে ভরা কুয়োয় নামিয়ে দেওয়া হত, কারো নাকে-কানে শুকনো লঙ্কা গুঁজে দেওয়া হত বা সাঁড়াশি দিয়ে নাক-কান ছিঁড়ে দেওয়া হত। এভাবে, জমিদাররা তাদের প্রজাদের কাছ থেকে জোর করে রাজস্ব আদায় করতেন।’

শায়েস্তা খান, চিত্র ঋণ-ব্রিটিশ মিউজিয়াম, পাবলিক ডোমেইন।

সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন, মুর্শিদকুলী খাঁর সময়ে কর সংগ্রাহকগণ প্রজাদের উপর ব্যাপক অত্যাচার করত।

‘সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে একবার অভিযোগ গিয়েছিল, ইজারাদাররা দরিদ্র প্রজা ও কৃষকদের উপর অত্যাচার করে। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সেই সঙ্গে কৃষকদের সর্বনাশ।’

বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন,

‘মুঘল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীর কোনো স্থান ছিল না। কারণ সে ব্যবস্থা অনুযায়ী সরকার প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে মাতব্বরের সহায়তায় কৃষকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করতো। এজন্য মুঘল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা কোনো বংশানুক্রমিক জমিদারী স্বত্বের জন্ম দেয়নি এবং জমির ওপর দখলী স্বত্বের ভিত্তিতে মুঘল আমলে কোন অভিজাত শ্রেণী গড়ে ওঠারও কোন ব্যবস্থা ছিলো না।’

কৃষক এবং রাষ্ট্রের মাঝখানে কোনো জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগী ছিল না—প্রশ্ন ওঠে, তাহলে উপরোক্ত আলোচনায় প্রাপ্ত ক্রোরি কানুনগো, ইজারাদার, জমিদার ইত্যাদি পদগুলির কাজ কী ছিল? ইব্রাহিম খান অথবা শায়েস্তা খানের মতো মধ্যস্তত্বভোগীদের কথা ইতিহাসে অনন্য।

(তিন)

আলোচনাকে গুটিয়ে আনা যাক। ‘সোনার বাংলা: কিংবদন্তি ও বাস্তব’ প্রবন্ধের লেখক আকবর আলি খানের মতে—

‘প্রাপ্ত তথ্য থেকে মনে হয় যে, প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় মজুরির হার ছিল খুবই কম। তাঁতিদের দারিদ্র সম্পর্কে যেসব পরিমাণগত ও বর্ণনামূলক বিবরণ পাওয়া যায় সেসব এ অনুমানই সমর্থন করে। তবে নিম্নহারে মজুরি শুধু তাঁতিদের মধ্যেই চালু ছিল না। সম্ভবত এ ধরনের অর্থনীতি, যেখানে জীবনধারণের সর্বনিম্ন পর্যায়ের আয় ছিল, সেখানে সকল শ্রমিকেরই মজুরি ছিল কম। এর অর্থ হল, বাংলার জাঁকালো বহির্বাণিজ্যের সুফল ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। … মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা ও বিদেশী বণিকরাই প্রধানত বাংলার বহির্বাণিজ্যের মুনাফা লুটেছে। তারা কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের বিনিময়ে সোনা-রূপা আমদানি করতো । বেশিরভাগ আমদানিকৃত সোনা-রূপা দিল্লিতে রাজস্ব হিসেবে পাঠানো হতো, অবশিষ্ট গোপনে মজুদ করা হত। প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার বহির্বাণিজ্য তাই প্রবৃদ্ধির যন্ত্র ছিল না, এ বাণিজ্যই ছিল সম্পদপাচারের মাধ্যম।’

একটি চমৎকার কথা বলেছেন দেবাশিস ভট্টাচার্য তাঁর একটি প্রবন্ধে—

‘ইউরোপ যখন একের পর এক বানিয়ে চলেছে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিচিত্র বিষয়ের ছাপা বই, জটিল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, ঘড়ি, পাম্প, ইঞ্জিন—তখন কিন্তু এ দেশীয় ধনীশ্রেষ্ঠ বণিকেরা ইউরোপীয় বণিকদের কাছ থেকে সে সব মোটেই দাবি করছেন না! সে সব বস্তু যে আদৌ আছে এই ধরাধামে, এবং সেগুলো হাতে থাকা এবং না থাকার মধ্যে যে পার্থক্য বিস্তর, এই বোধটাই তাঁদের ছিল না। আদিম হাতিয়ার এবং বংশানুক্রমিক দক্ষতামাত্র সম্বল করে দেশীয় কারিগরবর্গ যে অনুপম হস্তশিল্প বানাতেন (মূলত সুতিবস্ত্র), যৎসামান্য মূল্যে তা কারিগরের কাছ থেকে হস্তগত করে, এবং তার উন্নতিসাধন কীভাবে হবে সে নিয়ে একটুও মাথা না ঘামিয়েই, সোনারুপোর বিনিময়ে তা বিদেশি বণিকের কাছে বেচে ফুলেফেঁপে উঠতে পারলেই তাঁদের সুখ।’

‘ফ্র‍ান্সিসকো পেলসার্ট’ যথার্থই লিখেছেন—

‘মাত্রাতিরিক্ত ধনীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের চুড়ান্ত অধীনতা ও দারিদ্র্যের যে বিরাট ফারাক মুঘল আমলে দেখা যায়, তেমন বোধহয় ভারতের ইতিহাসে খুব বেশি দেখা যায় নি।’ এই সমস্ত লুঠ এবং শোষণের প্রতি উত্তর ঔপনিবেশিক ধারার বুদ্ধিজীবীদের নজর পড়ে না কেন, তা কিছুতেই বুঝতে পারিনা। বস্তুতঃ মুঘল আমলে ভারতবর্ষের উচ্চ জিডিপির বোধহয় এটাই রহস্য!

তথ্যসূত্র

  • রমেশ দত্ত, দি ইকোনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া ইন আর্লি ব্রিটিশ রুল (কিগান পল ট্রেঞ্চ ট্রাবনার অ্যান্ড কো, ১৯০৮)
  • মুহম্মদ আবদুল জলিল, বঙ্গে মগ-ফিরিঙ্গি ও বর্গীর অত্যাচার (বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩)
  • যদুনাথ সরকার, দি হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল দ্বিতীয় খণ্ড: মুসলিম পিরিয়ড (বি আর পাবলিশিং, ২০০৩)
  • রমেশ চন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ড: মধ্যযুগ (জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স, ১৯৮৭)
  • সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, প্রাক-পলাশী বাংলা: সামাজিক ও আর্থিক জীবন ১৭০০-১৭৫৭ (কে পি বাগচী আন্ড কোম্পানী, ১৯৫৮)
  • সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত, বাংলাদেশের ইতিহাস: ১৭০৪-১৯৭১ দ্বিতীয় খণ্ড, (মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, ১৯৯৩)
  • অনিল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মধ্যযুগে বাংলা ও বাঙালী (কে পি বাগচী আন্ড কোম্পানী, ১৯৫২)
  • আবদুল করিম, ঢাকাই মসলিন, (সাহিত্যিকা, ২০১৬)
  • কে এন চৌধুরী, দি ট্রেডিং ওয়ার্ল্ড অফ এশিয়া অ্যান্ড দি ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: ১৬৬০-১৭৬০, (কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৬)
  • ইরফান হাবিব, মুঘল ভারতের কৃষি ব্যবস্থা, (কে পি বাগচী আন্ড কোম্পানী, ১৯৫৮)
  • বিপ্লব দাশগুপ্ত, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা: প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্ব, (অরুণা প্রকাশন, ২০০০)
  • গৌতম ভদ্র, মুঘলযুগে কৃষি-অর্থনীতি ও কৃষক-বিদ্রোহ, (সুবর্ণরেখা, ১৯৬৩)
  • সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, বাংলার ‍আর্থিক ইতিহাস: অষ্টাদশ শতাব্দী, (কে পি বাগচী আন্ড কোম্পানী, ১৯৫২)
  • বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক, (মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯২)
  • দেবাশিস ভট্টাচার্য, জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগরের ‘পুনর্নির্মাণ: যুক্তিবিরোধী, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, অসুস্থ ইতিহাসচর্চার নব দৃষ্টান্ত, (চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ২০২১)

মন্তব্য তালিকা - “মুঘল আমলে বঙ্গদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা: মিথ এবং বাস্তব”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।