
পৃথিবীর ইতিহাস – প্রাণের ইতিহাস
(গ্রন্থ নাম: ‘প্রাগিতিহাসের আগে’; লেখক: মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রকাশক: সাহিত্য সংসদ, জানুয়ারি, ২০২৫)
১
পৃথিবীতে কী রকম করে প্রাণ সৃষ্টি হল, সেই প্রাণ কীভাবে দীর্ঘ প্রতিকূল অবস্থাতেও বেঁচে থাকল এবং সর্বোপরি, আজকের দিনের দ্বিপদী মানুষ কীভাবে তৈরি হল! সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। এই ইতিহাস অবশ্য ঐতিহাসিকদের চর্চার বিষয় নয়, বরং এর অধিকাংশ অংশ চর্চা করেন ভূতত্ত্ববিদরা, পুরাজীববিজ্ঞানীরা (প্যালেওন্টোলজিস্ট)। এটি প্যালেওন্টোলজিস্ট-দের বিশেষ পছন্দের জায়গা। পুরাজীববিজ্ঞানীরা পাথরের মধ্যে থাকা প্রাচীন প্রাণীদের দেহাবশেষ—যাকে বলা হয় ফসিল বা জীবাশ্ম—সম্পর্কে গবেষণা করে প্রাণের বিবর্তনের এই ধারাবাহিক সময়পঞ্জি তুলে ধরেন। এবং এই বিষয়ের সূত্রপাত যিনি করেন, তার নাম মনে হয় আট থেকে আশি সকলেই কোনো-না-কোনোভাবে শুনেছেন—চার্লস ডারউইন।
বাংলা ভাষায় ফসিল এবং বিবর্তন নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লেখালেখি হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি গবেষণাধর্মী বইও আছে। মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘প্রাগিতিহাসের আগে’ এই গবেষণাধর্মী লেখার তালিকায় আরও একটি যুক্ত করার মতো নাম। এবং, সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে, আরও বিশ্লেষণাত্মক, অনেক আধুনিক তথ্যসম্পাদিত এই বইকে আমি তালিকার বেশ আগেই রাখব।
২
বইটি শুরু হয়েছে ‘জানার জগৎ, কল্পনার জগৎ’ অধ্যায় দিয়ে। লেখক বিভিন্ন সভ্যতার ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনী থেকে শুরু করে, ক্রমশ কীভাবে যুক্তিবাদের উৎপত্তি হয়েছে এবং প্রাচীন ধারণাগুলো বদলে গেছে, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ব্রহ্মাণ্ডের সীমানা সম্পর্কে কিছু ধারণা দিয়ে চলে এসেছেন প্রাণের সৃষ্টির প্রাক্কালে। এখানেও বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাস নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে।
বিজ্ঞানের আলোচনা অবশ্য গভীরতা পেয়েছে পরবর্তী অধ্যায় থেকে।
৩
দ্বিতীয় অধ্যায়ে (‘পৃথিবীর যাত্রা হল শুরু’ ) লেখক মহাকাশবিজ্ঞানের একটা ভূমিকা দিয়েছেন। নিউটনের বৈপ্লবিক মাধ্যাকর্ষণের গাণিতিক সূত্র ধরে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের সাবলীল বর্ণনার মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের নাম এবং তাদের আবিষ্কারের গল্প। এরপর নক্ষত্র এবং গ্রহ তৈরির কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য সহজ ভাষায় পরিবেশিত হয়েছে। নক্ষত্র-গ্রহ পেরিয়ে আমরা ক্রমশ চলে এসেছি পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্যে—কীভাবে প্ল্যানেটসিম্যাল থেকে আজকের পৃথিবীর জন্ম, থিয়ার মতো বিশাল এক গ্রহাণুর সংঘর্ষে তৈরি হল চাঁদ—সমস্ত কিছু মিলে জমজমাট বিবরণ। একই অধ্যায়ের অষ্টম পরিচ্ছেদ থেকে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তারপর পৃথিবীর বয়স, এবং সর্বোপরি ভূতাত্ত্বিক সময়পঞ্জির বিবরণ দিয়ে শেষ হয়েছে এই অধ্যায় ।
এই অধ্যায়ে প্রচুর তথ্য এক সঙ্গে রয়েছে। তাই, যারা এই বিষয়ে নতুন, তাদের ধৈর্য ধরে পড়তে হবে। লেখক বেশ কিছু ইংরেজি শব্দের তর্জমা করেছেন, যেমন রেড শিফট হয়ে গেছে ‘লোহিত সরণ’, প্ল্যানেটসিম্যাল হয়ে গেছে ‘প্রাক-গ্রহ’। সম্ভবত এই বাংলা শব্দগুলোর সঙ্গে ইংরেজি শব্দ থাকলে ভালো হত, কারণ পরবর্তীকালে কেউ যদি বিস্তারিতভাবে জানতে চায় এবং ইংরেজিতে বই পড়তে চায়, তাহলে সে সহজেই দুটো শব্দের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পেত। বইয়ে ‘ভূত্বকের গভীরতা’ বিষয়ক একটি প্রিন্টিং ত্রুটি পরবর্তী সংস্করণে ঠিক করে নিলে ভালো হয়। যেহেতু আমার গবেষণার বিষয় ভূপদার্থবিজ্ঞান, তাই মনে হল এই অধ্যায়ের বেশ কিছু তথ্য আরও একটু বিস্তারিতভাবে দেওয়া যেত। সম্ভবত সমস্ত স্তরের পাঠকদের কথা মাথায় রেখেই যথাসাধ্য সহজবোধ্যভাবে লেখার চেষ্টা করেছেন লেখক।
৪
তৃতীয় অধ্যায়ে এসেছে প্রাণের উৎপত্তির কথা। প্রাচীন পৃথিবীর নরকের মতো পরিবেশে কী করে প্রাণের উৎপত্তি হল, সে এক আশ্চর্য বিস্ময়। প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ে জানতে তাই প্রথমেই পৃথিবীর সেই ভয়ঙ্কর সময় সম্পর্কে জানতে হবে। লেখক তাই শুরু করেছেন সেই প্রাচীন সময়ের বর্ণনা দিয়ে। পৃথিবীর কিছু পুরানো খনিজ—জার্কন এবং পাথর থেকে কীভাবে প্রাচীন বায়ুমণ্ডলের উপাদানগুলো জানা যায়, সেই সময়ের সমুদ্রের জল কেমন ছিল—ইত্যাদি বিষয়ের উপর এখানে প্রাথমিক আলোচনা করা হয়েছে। এই নারকীয় পরিবেশের মধ্যেই প্রথমবারের মতো কী প্রাণের সৃষ্টি হয়? এই প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক উত্তর খুঁজেছেন লেখক। ইউরি-মিলার-এর পরীক্ষা, ইউক্যারিওটিক থেকে প্রোক্যারিওটিক কোষের বিবর্তন, প্রাণ তৈরির বিশেষ উপাদান—ডিএনএ, আরএনএ, প্রোটিন, অ্যামাইনো অ্যাসিড, হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট থিওরি, গ্রেট অক্সিজেনেশন ইভেন্ট, লুকা এবং লেকা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে এই অধ্যায়ে।
এই অধ্যায়ের ‘পৃথিবীর প্রাচীন শিলা ৪৪০ কোটি বছর পুরনো’—এই তথ্যটা একটু সংশোধন করা যেতে পারে। ৪৪০ কোটি বছর পুরনো বস্তুটি একটা জার্কন—একটা খনিজের কণা। ভূতাত্ত্বিকভাবে জার্কন এবং পাথর বিস্তর আলাদা। এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো পাথর কানাডার অ্যাকাস্টা নাইস, যার বয়স ৪০০ কোটি বছর। ‘গ্রানাইট শিলা গলে গিয়ে জলের সংস্পর্শে আসলে তাতে জার্কন তৈরি হয়’—তথ্যটা সম্পূর্ণ নয়। গ্রানাইট ভূপৃষ্ঠের অনেক নিচে জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে যায়; এখানে জার্কন তৈরি হয় কিছু বিশেষ পার্শিয়াল মেল্টিং-এর কারণে।
অবশ্য সেই বিষয়ে আলোচনা করা এখানে শক্ত। সর্বোপরি, তথ্যগুলো আরও সময়ানুবর্তী ক্রমে সাজালে হয়তো নতুন পাঠকদের কাছে বিষয়টি আরও প্রাঞ্জল হয়ে উঠত।
৫
ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি, পৃথিবীর জন্ম, প্রাণের উৎপত্তির ভূমিকার পর চতুর্থ অধ্যায়ে বহুকোষী প্রাণের বিবর্তন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রথমেই আছে ডারউইনের কথা—আমার মতে, এটি ভূবিজ্ঞানের ইতিহাসের একটা পাইভটাল সময়। এডিয়াকারান ফসিল দিল ডারউইনের অজানা জীবজগতের খোঁজ। ক্রমশ তাদের চোখ, স্নায়ুতন্ত্র তৈরি হল, আত্মরক্ষার বর্ম তৈরি হল। একসময় এডিয়াকারান যুগের প্রাণীরা বিলুপ্ত হল এবং পৃথিবীর বুকে নেমে এল বায়োলজিক্যাল বিগ ব্যাং। প্রায় ৫৪ কোটি বছর আগে ক্যামব্রিয়ান যুগে পৃথিবী ছেয়ে গেল প্রাণের প্রাচুর্যে।
৬
পঞ্চম অধ্যায়ের আলোচ্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর উদ্ভব। এখানে লেখক ‘ট্রি অফ লাইফ’—বিবর্তনের বিভিন্ন ধারাবাহিকতাকে দেখিয়েছেন। বিভিন্ন ফসিল নিয়ে পর্যালোচনা করে ক্রমশ ‘পাখনা থেকে পা’-এর উদ্ভব কাহিনী গল্পচ্ছলে লেখা হয়েছে। এই সময়েই প্রথমবার জল থেকে প্রাণীরা স্থলের দিকে আসতে থাকে—সেই প্রথম প্রাণীর নাম ‘টিকট্যালিক’। এর সাথে আলোচনা করা হয়েছে বিভিন্ন গণবিলুপ্তির কথা।
৭
প্রাণীরা স্থলভাগে আসার পর শুরু হল বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়—উদ্ভিদের আগমন। ষষ্ঠ অধ্যায়ের মূল বিষয়গুলো উদ্ভিদের বিবর্তনকে কেন্দ্র করে। কার্বোনিফেরাস যুগের এই জঙ্গল থেকেই আজকের দিনের কয়লা তৈরি হয়েছে। আর জঙ্গল যখন আছে, সেখানে পোকামাকড়ও থাকবে। পৃথিবী যখন পরিপূর্ণ—গাছপালা, জলজঙ্গল, পোকামাকড়ে—তখন পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে দানবের অপেক্ষায়।
৮
সপ্তম অধ্যায় তাই সেই দানবদের নিয়ে—ডাইনোসর। সময়সরণির পথে চলে এসেছি মেসোজোয়িক যুগে। ডাইনোসর এবং সঙ্গে সামুদ্রিক প্রাণীদের বিবর্তন—সব মিলে মেসোজোয়িক দেখেছিল ‘দাঁত আর নখের বিপ্লব’। এই ভয়ঙ্কর মেসোজোয়িক যুগের সমাপ্তি ঘটে নাটকীয় উল্কাপাত, ডাইনোসরের বিলুপ্তি এবং ভারতীয় পাতের সঙ্গে ইউরোপীয় পাতের ধাক্কা লাগার প্রাক্কালে। এই সমস্ত বিষয়েই বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে শতধাবিভক্ত। কোনো একটি হাইপোথিসিস নিয়ে সমস্ত ভূতাত্ত্বিক বিবর্তনকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। যেহেতু এগুলো চলমান গবেষণার বিষয়, তাই তথ্য ও তত্ত্ব প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে। লেখক বেশ দক্ষতার সাথে জনপ্রিয় তথ্যগুলো তুলে ধরেছেন কাব্যিকভাবে—যাতে সর্বসাধারণের মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে।
৯
অষ্টম অধ্যায় খুব স্বাভাবিকভাবেই স্তন্যপায়ীদের নিয়ে। পৃথিবী বিশাল সরীসৃপমুক্ত, অগ্নুৎপাত ও উল্কায় বিধ্বস্ত—এই ধ্বংসস্তূপ ফুঁড়ে বিবর্তিত হচ্ছে স্তন্যপায়ীরা। অন্যান্য অধ্যায়ের মতো এখানেও স্তন্যপায়ীদের শ্রেণীবিভাগ নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন লেখিকা। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের তুলনায় ভারতীয় উপমহাদেশ তখন এক দারুণ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৫.৫ কোটি বছর আগে, অর্থাৎ ডাইনোসর ধ্বংস হবার পর থেকে, ক্রমশ ইউরেশিয়ার পাতের দিকে এগিয়েছে ভারতীয় পাত। ৫.৫ কোটি বছর আগে সম্ভবত প্রথম ধাক্কা শুরু হয় এবং হিমালয়ের জন্মলগ্ন এখন থেকেই।
লেখক এই ভূতাত্ত্বিক ঘটনার চিত্রকল্প দিয়ে অধ্যায় শেষ করেছেন।
১০
শেষ দুই অধ্যায় অধিকাংশই আধুনিক মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে। লেখক মানুষের জেনেটিক বিবর্তন-সংক্রান্ত বিষয়ে আগে আরও একটি গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন। এখানে আরও কিছু নতুন তথ্য ও ছবি সহকারে মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
বইয়ের শেষ অধ্যায় শেষ করেছেন সেই চিরাচরিত প্রশ্ন নিয়ে—‘কোথায় পাবো তারে?’ পৃথিবীর বাইরে কি কোথাও পাওয়া যাবে প্রাণের সন্ধান? সেই নিয়ে বিজ্ঞানমহলের কাজ চলছে, এবং আগামী প্রজন্ম হয়তো খুঁজে নেবে এর উত্তর।
১১
সর্বোপরি, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মিলেমিশে একটি কঠিন কাজ করে ফেলেছেন মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ কয়েকটা সেমেস্টারের পাঠ্যবিষয় এক সঙ্গে একটা দুই মলাটের বইয়ের মধ্যে তুলে ধরা সহজ নয়। বইটি পড়ে যদি কেউ ভূতত্ত্ব ও পুরাজীববিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহিত হয়—বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে যদি নতুন প্রশ্ন জেগে ওঠে—তাহলে এই বিশাল কাজ আরও বেশি সার্থক হয়ে উঠবে।
বেশ ভালো লাগলো আপনার লেখা পড়ে ।দু একটা কথা আরেকটু বিশদে বললে, ভালো হোতো মনে হয়।
আগের বইটি পড়েছি, চমৎকার লেগেছে। এটাও পড়ব অবশ্যই।
ধন্যবাদ, পড়ে বলবেন কেমন লাগলো।
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র নই। তাই শিক্ষা দেবার মতো জ্ঞান নেই। তবুও ‘দৈনিক গণশক্তি’তে এই বইয়ের আলোচনা করেছিলাম ভয়ে ভয়ে। এই পোর্টালের কেউ কী পড়েছেন!
আপনার লেখা সাবলীল, তাই ভালো লাগে।