
সম্পাদকীয়
মেশিনে বসে মজদুর মেয়ে
১ মে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। কিন্তু এটি তো শুধু একটি দিবস মাত্র নয়। মানবসভ্যতার ইতিহাস আসলে মানব শ্রমের ইতিহাস—সেই শ্রমজীবী মানুষের জন্য একটি ন্যায্য, মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের এক অনন্য প্রতীক মে দিবস। এটি শুধু শ্রমঘণ্টার দাবি নয়—এটি সামাজিক ন্যায়, লিঙ্গসমতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নেও এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
১
হ্যাঁ লিঙ্গসমতাও অতি প্রয়োজনীয় ! শ্রমিক বলতেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে বলিষ্ঠদেহী পেশিবহুল নগ্নগাত্র এক পুরুষের ছবি- যেন জন হেনরি। আমরা ভুলে যাই, এ কেবল অর্ধেক আকাশ! শ্রমজীবী মানুষের রক্ত ও ঘামে লেখা এই দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো অনামা নারী শ্রমিকের নীরব বেদনা ও সাহসী প্রতিরোধ। শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ১৯ শতকের ইউরোপ ও আমেরিকায়, নারীরা ব্যাপকহারে বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্র যেমন সেরামিক্স টেক্সটাইল ইত্যাদিতে যুক্ত হন, কিন্তু একই কাজ করেও পেতেন পুরুষের চেয়ে কম মজুরি, কাজের পরিবেশ হত বিপজ্জনক, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ছিলেন শ্রম আইনের নাগালের বাইরে। সেই থেকেই শুরু হয় নারী শ্রমিকদের ন্যায্যতার লড়াই—যা আজও নানা প্রেক্ষাপটে চলমান কারণ এই সংগ্রামের পশ্চাৎপটে ছায়ার মতো কাজ করে গেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি।
শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ নগণ্য, মাতৃত্বকালীন সুবিধা বা যৌন হয়রানির প্রতিকার—সবকিছুই রয়ে গেছে অর্ধেক পথে। উন্নত বিশ্বে শ্রম আইনের উন্নতি হলেও বিশ্বের মুখ্য উৎপাদক কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদনের কেন্দ্র এখন সরিয়ে এনেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। কারণটা সহজবোধ্য, এখানে শ্রমিক অধিকারের মান দুর্বল। এখানে নারী শ্রমিকদের জন্য মানবাধিকার ভাষণ যেন কেবল ‘দায় মেটানো’র উপায়, কার্যকর কোনো সমাধান নয়। যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নৈতিকতার বুলি আওড়ায় সেগুলোর অধিকাংশই পুষ্ট সেইসব কোম্পানির টাকায় যাদের উৎপাদন কেন্দ্র বা কারখানায় সবচেয়ে বেশি শোষিত হন নারী শ্রমিকেরা।
২
সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নারী শ্রমিকদের মধ্যে করা বিভিন্ন সমীক্ষাগুলো থেকে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। নারী শ্রমিকরা বেতন বৈষম্যের শিকার, কর্মস্থলে বা কর্মক্ষেত্রে যাবার পথে সহিংসতা বা যৌন হয়রানির শিকার, অধিকাংশ শ্রমিক মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না। অনেক শ্রমজীবী নারী তাদের কর্মজীবনের কোনো না কোনো সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ এই হয়রানির কথা জানিয়েছেন তবে ফললাভ বিশেষ হয়নি আবার অনেকে হয়রানির পরিবেশ থেকে বাঁচতে চাকরি ছেড়ে দেন। যৌন হয়রানি আর্থিক চাপ বাড়ায় এবং শ্রমজীবী নারীর কর্মজীবনের অর্জনকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করতে পারে।
অথচ বিশ্ববাজারের মুনাফাকেন্দ্রিক রাজনীতি যেভাবে শ্রমিকের ঘামকে পণ্যে রূপান্তর করে, তাতে নারীর শ্রম হয়ে ওঠে সবচেয়ে কমদামী অথচ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সম্পদ।
৩
গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা, সামাজিক ন্যায় ও সাম্যের মতো কথাগুলো কেবল ফাঁকা বুলি হয়েই থেকে যাবে যদি না আমরা বারংবার নিজেদের মনে করিয়ে দিই এগুলোর প্রয়োজনীয়তা এবং এই সত্য যে এগুলোর বাস্তব রূপায়ণ থেকে আমরা এখনও অনেকটা দূরে। যে কোনো সময়েই এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়, তবে মে দিবসের প্রাক্কালে যখন এ বিষয় উত্থাপিত হয় তখন তা আলাদা মাত্রা পায়। মে দিবস তাই আমাদের কেবল অতীতের দিকে তাকাতে শেখায় না, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতিও জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দেয়। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল প্রায় দেড়শো বছর আগে, তা আজ নতুন রূপে, নতুন বাস্তবতায় আবারও সামনে চলে এসেছে।
এই মে দিবসে, ইতিহাস চর্চার পাঠক হিসেবে আমাদের কর্তব্য—নারীর শ্রমকে ‘অদৃশ্য’ করে রাখা দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ জানানো। সময় এসেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সমতা ও ন্যায়ের কথা আরও জোরালোভাবে তোলার, এবং শ্রমের মূল্যায়নে নারীকে কেবল ‘সহায়ক’ নয়, একক নেতৃত্বের আসনে দেখার।