সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বিরিয়ানির উৎস সন্ধান: মোগলাই হেঁশেলে উঁকিঝুঁকি

বিরিয়ানির উৎস সন্ধান: মোগলাই হেঁশেলে উঁকিঝুঁকি

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

মে ১৭, ২০২৫ ৪৭ 0

ইদানীং ফেসবুকে ঘুরতে ঘুরতে নানা তরজা চোখে পড়ে। তার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় তরজার বিষয় হল বিরিয়ানি সত্যিই মোগলরা ভারতবর্ষে নিয়ে এসেছিল কি না! বিরিয়ানি নিয়ে বাঙালির আহ্লাদের অন্ত নেই। ক’বছর আগে পর্যন্ত কলকাতার বিরিয়ানিতে ইতিহাসের চর্চা বলতে ওয়াজিদ আলি শাহ পর্যন্তই ছিল। বরং কোন দোকানের বিরিয়ানি ভালো, সে ব্যাপারে বাঙালির উৎসাহ ছিল বেশি — সিরাজ, আমিনিয়া, আলিয়া, রয়্যাল, আরসালান ইত্যাদি। আইটি সূত্রে বাঙালি হায়দরাবাদে ঘনঘন যাওয়ায় প্যারাডাইসের হায়দরাবাদি বিরিয়ানিও আলোচনায় ঢুকে পড়ে। তবে পছন্দ যাই হোক না কেন, তাজমহল কিংবা ফতেপুর সিক্রির মতো বিরিয়ানিও যে মোগলাই অবদান, এ ব্যাপারে বাঙালি ছিল নিশ্চিন্ত। কিন্তু গোল বাধল বছর কয়েক আগে। দেশ জুড়ে মোগলদের বিরুদ্ধে প্রবল ‘আন্দোলন’ (বকলমে কুৎসা) শুরু হওয়ায় বিরিয়ানিকেও পরিচয়পত্র জোগাড়ে নামতে হল। তবে ভাগ্য ভালো, বিরিয়ানি মোগলাই খাবারের তালিকায় আছে বলে তাকে দেশছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়নি। বরং তাকে খাঁটি ভারতীয় খাবার বলে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস শুরু হল।

বিরিয়ানির অবশ্য ভারতীয় খাবার হতে আপত্তি আছে কি না, সে উত্তর কেউ চায়নি। তবে ভারতীয়ত্ব প্রমাণে তার নামটি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রাচীন ভারতই সব কিছুর উৎস, এইসব প্রমাণ করার বরাত পাওয়া কিছু লোক বলতে শুরু করেছেন, বিরিয়ানি আসলে প্রাচীন ভারতের পলান্ন।

পণ্ডিতেরা বলেছেন, আংশিক সত্য, অসত্যের চেয়েও ভয়ঙ্কর। বিরিয়ানিকে পলান্ন বলার ব্যাপারটিও তাই। ‘পলান্ন’ শব্দটিকে ভাঙলে দু’টি শব্দ পাওয়া যায়। পল্ এবং অন্ন—মাংস এবং ভাত। মাংস এবং ভাতের দাম্পত্যেই তৈরি হয় পলান্ন। সে দিক থেকে দেখলে, বিরিয়ানিকে পলান্ন বললে দোষ নেই। কিন্তু সমস্যা ভিন্ন জায়গায়। পলান্ন মানেই তা ভারতীয় এবং মোগলরা তা আত্মসাৎ করেছে, এ কথা বললে সত্যের অপলাপ হয়।

কেন? এর কারণ খুঁজতে গেলে দু’দিকে চোখ রাখা প্রয়োজন। এক, পলান্নের বিভিন্ন চরিত্র সন্ধান। দুই, বিরিয়ানির উৎস সন্ধান। শিরোনামে শুধু ‘বিরিয়ানির উৎস সন্ধান’ কথাটি লেখা হলেও পলান্নকে বাদ দিয়ে এই লেখার সম্পূর্ণতা প্রাপ্তি হবে না। বরং পোলাও এবং বিরিয়ানি, এই দুয়ের সমন্বয়েই আলোচ্য প্রবন্ধটি তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে এবং সেই লক্ষ্য খাদ্যের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের সন্ধান, যা নিখাদ জাতি, ধর্ম, বর্ণভিত্তিক রাজনীতির আখড়া থেকে বহু দূরে আমাদের অতীতের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্তকে তুলে ধরে।

বহুরূপে, সম্মুখে—পলান্ন

পলান্নের অর্থ যে মাংস এবং ভাত, তা আগেই বলা হয়েছে। তবে মাংসের ঝোলের সঙ্গে থালায় ভাত মেখে নিলেই তা পলান্ন হয় না। বরং পলান্ন বলতে বোঝায় মাংস এবং চাল মিশিয়ে একত্রে রান্না করা খাবার। পলান্ন রাঁধার কৌশল প্রাচীন ভারতে ছিল। বর্তমানে অবশ্য পোলাও বলতে এ দেশে নিরামিষ পদই বোঝায়। নামে পল্‌ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার আমিষত্ব আর নেই। তবে উচ্চারণ ভেদে এই পোলাও মধ্য এবং পশ্চিম এশিয়া জুড়েও পাওয়া যায়। সেখানে তার নাম, পিলাফ, পিলাভ, পিলাও ইত্যাদি। স্বাভাবিক ভাবেই সে সব পদে মাংস আবশ্যিক। উপরন্তু নানা ধরনের শুকনো এবং টাটকা ফল, মশলা ইত্যাদিও থাকে। তাই পলান্ন থেকে সরাসরি পোলাও এমন বলা মুশকিল — আমাদের কপিরাইটের জায়গা নেই।

তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে নামকরণের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য আছে এবং সেই সাদৃশ্য ভাষাতাত্ত্বিক মিল। কিন্তু যাঁরা পিলাফ এবং ভারতীয় পোলাও খেয়েছেন তাঁরা সহজেই বুঝবেন যে রন্ধনশৈলীগত মিল এবং অমিল—এতে দুইই বর্তমান। এ কথাও মেনে নিতেই হয় যে একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা যে সব পদ রেঁধে খাই তার মধ্যে কতটা খাঁটি ভারতীয়ত্ব আছে এবং কতটা তাতে বিদেশি সংস্কৃতির মিশ্রণ হয়েছে, তা বিচার করা মুশকিল। এ সব শুনে খাঁটি ভারতীয়ত্বের ঠিকাদারেরা খড়্গহস্ত হতে পারেন ঠিকই—কিন্তু তামাম উত্তর ভারতের নিরামিষ মেনুকার্ড জুড়ে রাজত্ব করা আলু-জিরা কিংবা মালাই পনিরের আলু এবং পনির কবে খাঁটি ভারতীয় হল, সে প্রশ্নও তো ওঠে। উত্তরও সহজ — বিদেশ থেকে আগত এই ধরনের খাদ্য উপাদান বছরের পর বছর ধরে রন্ধন সংস্কৃতিতে মিশেছে এবং স্থানীয় খাদ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। তাতে স্থানীয় খাবার বিদেশি তকমা পায়নি। বরং নতুন স্বাদের সন্ধান দিয়েছে। এই সূত্র ধরেই পলান্ন বা পোলাওয়ের বিচার করা সম্ভব।

বর্তমান সময়ে পোলাও বলতে আমরা সাধারণত যা খাই সেটি পলান্ন বা মাংসমিশ্রিত ভাত নয় — বরং নিরামিষ পদ। ভাত, ঘিয়ের পাশাপাশি মশলা এবং কাজু, কিসমিস-সহ নানা ধরনের শুকনো ফলের সমাহার। তা থেকে বোঝা সম্ভব যে বহু শতাব্দী আগে পলান্নের যে রন্ধনশৈলী এবং উপকরণ ছিল তা বদলে গিয়েছে। কোথাও কোথাও স্থানীয় সংস্কৃতিও মিশেছে। এই একই ধরনের পদ কিন্তু তামাম এশিয়া জুড়ে বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায়। মধ্য এবং পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ‘পিলাফ’ নামে একটি পদ পাওয়া যায়। সাধারণ চোখে দেখেই বোঝা সম্ভব, নাম এবং উপকরণে তারতম্য থাকলেও বিষয়টি আদতে পোলাওয়ের তুতো ভাই। পোলাও, পিলাফ, পলান্ন — শব্দগুলির মধ্যে ভাষাতাত্ত্বিক মিলও যথেষ্ট। তাই পোলাও আদতে একটি বিশেষ গোত্রের খাদ্য বলা চলে।

মোগল রান্নাঘরে কি বিরিয়ানি ছিল?

আকবরের আমলে মোগল হেঁশেলের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন আবুল ফজল। তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’-র পাতায় রান্নাঘরের আদবকায়দা, হিসাবনিকেশের পাশাপাশি নানা পদের নাম ও বিবরণও আছে। মোগলাই খানা হিসেবে বিরিয়ানির কদর থাকলেও আবুল ফজলের তালিকায় কিন্তু বিরিয়ানির উল্লেখ পাওয়া যায় না। প্রশ্ন ওঠে, বিরিয়ানির মতো কোনও পদের উল্লেখও নেই কেন? আবুল ফজলের বিবরণীতে মূলত তিন ধরনের খাবারের কথা বলা আছে। প্রথম, নিরামিষ পদ, বা যেখানে মাংস ব্যবহার হয় না, যাকে আবুল ফজল বলেছেন ‘চুফিয়ানা’ (উচ্চারণভেদে সুফিয়ানা)। দ্বিতীয়ত, মাংস এবং চাল দিয়ে রাঁধা পদ। তৃতীয়ত, মাংস এবং মশলা সহযোগে তৈরি পদ। চুফিয়ানা পদের মধ্যে চাল বা ভাতের পদও আছে। যেমন জর্দ বিরিঞ্জ, শিরবিরিঞ্জ, খুশকা ইত্যাদি। কেউ কেউ মনে করেন, এই ‘বিরিঞ্জ’ অর্থাৎ ফারসি ভাষায় যার অর্থ চাল, তা থেকেই বিরিয়ানি শব্দের উৎপত্তি। এই মত মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য খটকা লাগে আবুল ফজল বর্ণিত অন্য পদগুলির নাম দেখে।

মাংস এবং চালের তৈরির যে সব পদের কথা আকবরের সভাসদ লিখে গিয়েছেন, তার মধ্যে একটি পদের নামে চোখ আটকাতে বাধ্য। ওই গোত্রের খাদ্যের দু’নম্বরেই আছে, ‘দুজদবিরয়ান’ নামে একটি পদ। এই পদের উপকরণের বিবরণও দিয়েছেন আবুল ফজল—১০ সের চাল, ১০ সের মাংস, সাড়ে তিন সের ঘি এবং আধ সের লবণ লাগবে। মশলাপাতির অনুপুঙ্খ বিবরণ না দিলেও বিরিয়ানি বলে আমরা যে পদ খাই তার উপকরণের সঙ্গে বেশ মিল আছে এই ‘দুজদবিরয়ান’-র। কী ভাবে রাঁধতে হবে তা অবশ্য ‘আইন-ই-আকবরি’-তে লেখা নেই। কিমা পোলাও রান্নার ক্ষেত্রেও মোটামুটি একই বিবরণ দিয়েছেন এই বইয়ের লেখক। সঙ্গে অবশ্য আদা, পেঁয়াজ, মরিচের মতো উপকরণও যুক্ত করেছেন।

এবার যে প্রসঙ্গে ছিলাম, সেই প্রসঙ্গে ফিরে যাই। বিরিয়ানি ব্যাপারটি এল কোথা থেকে? এই পর্বেই চোখ রাখতে হবে আবুল ফজল বর্ণিত তৃতীয় গোত্রের খাদ্য তালিকার দিকে। প্রথমেই সেখানে তিনি লিখেছেন, বিরয়ান নামে একটি খাবারের নাম। তা হলে কি এই বিরয়ান আমাদের বিরিয়ানি? কিন্তু আবুল ফজল তো প্রথমেই বলে দিয়েছেন যে তৃতীয় গোত্রের পদগুলি শুধুই মাংসের। সেখানে চালের বাড়বাড়ন্ত নেই। বিরয়ানের উপকরণ তালিকাতেও চাল নেই। বলা আছে, এই পদ রাঁধতে একটা গোটা দশমন্ডি ভেড়া লাগবে (সম্ভবত আফগানিস্তানের দশমন্ডি এলাকা থেকে আমদানি করা মোটাসোটা ভেড়া)। তার সঙ্গে দুই সের লবণ, এক সের ঘি এবং জাফরান, জিরা, মরিচ, লবঙ্গের মতো মশলা। তা হলে? ফারসি ভাষায় এই বিরয়ান শব্দের অর্থ ভাজা। অর্থাৎ বিশেষ কায়দায় ভাজা মাংসকেই বিরয়ান বলা হত। সেই কায়দাতেই মাংস এবং চাল মিশিয়ে তৈরি হত ‘দুজদবিরয়ান’। সেই পদ বলা যায়, এক ধরনের পোলাও কিন্তু রন্ধনশৈলী একেবারে মধ্য বা পশ্চিম এশিয়ার ঘরানায় তৈরি। ছাত্রজীবনের গোড়ায় ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী প্রেসিডেন্সি কলেজের পত্রিকায় মোগলাই খানা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে এই ‘দুজদবিরয়ান’-কে তিনি ‘বিরিয়ানি-পোলাও’ বলেই উল্লেখ করেছেন।

সরাসরি বিরিয়ানি শব্দ না পেলেও এ কথা আবুল ফজলের লেখা থেকে বোঝা যায় যে বিরয়ান এবং পোলাও ভিন্ন পদ হিসেবেই স্বীকৃত ছিল। আবুল ফজল অবশ্য বিস্তারিত বিবরণে যাননি। তবে পরবর্তী কালে আরেকটি আকর গ্রন্থ ‘নুশকা-ই-শাহজাহানি’-তেও বিরয়ান পাওয়া যায়। সেখানে অবশ্য ‘জেরবিরয়ান’ নিয়ে গোটা একটি পর্বই রচিত হয়েছে। এই পৃথক পর্বের অস্তিত্ব বুঝিয়ে দেয় যে ঠাকুর্দার (আকবর) আমল থেকে নাতির (শাহজাহান) আমলে পৌঁছতে পৌঁছতে ‘বিরিয়ানি-পোলাও’ মোগলাই রান্নাঘরে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। শাহজাহানের আমলে লেখা ওই বইয়ে বিভিন্ন ‘জেরবিরয়ান’-র কথা পাওয়া যায়। তার মধ্যে মাংসের পদ ছাড়াও পনিরের (জেরবিরয়ান-ই-পনির) এবং মাছের (জেরবিরয়ান-ই-মাহি) ‘জেরবিরয়ান’-র কথা পাওয়া যায়। এই শব্দবন্ধের দিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। ‘বিরয়ান-ই-মাহি’ বা ‘বিরয়ান-ই-পনির’ ইত্যাদি শব্দ ইঙ্গিত দেয় কীভাবে মোগলাই হেঁশেল থেকে বেরিয়ে আমাদের পাতে চলে এল বিরিয়ানি! এই হিসেবে আমাদের বিরিয়ানিকে বলা উচিত, ‘বিরয়ান-ই-মাটন’ বা ‘বিরিয়ান-ই-চিকেন’। একটু উল্টে নিয়ে আমরা যাকে সহজেই মাটন বা চিকেন বিরিয়ানি করে ফেলেছি।

শেষ পাতে

গোড়াতেই বলেছিলাম, পলান্ন নিয়ে অনেকের প্রবল আবেগের কথা, যে আবেগের বশে মোগল বাদশারা তো বটেই, তাঁদের নিতান্ত নিরীহ বাবুর্চিদের কীর্তিকলাপও গালিগালাজের হাত থেকে রেহাই পান না। এ কথাও ইদানীং সোশাল মিডিয়ায় চোখে পড়ে যে আমাদের পলান্ন বা পোলাও হাতিয়েই নাকি মোগল বাদশারা নিজেদের বিরিয়ানি বলে চালিয়েছিলেন। মোগল আমলে তামাম হিন্দুস্তানের বাদশাকে অন্যের রেসিপি চুরি করে বিরিয়ানি তৈরি করে বিক্রি করতে হত কিনা, সেই কূটপ্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তবে যে কথা বলা যায় তা হল বিরিয়ানি বিষয়টি এক ধরনের পোলাও বটে। এর বিশেষত্ব নির্দিষ্ট অনুপাতে চাল, মাংস, মশলা মিশিয়ে নির্দিষ্ট শৈলীতে রান্না। কিন্তু সেই রান্নার পদ্ধতিও কি বদলায়নি? বিরয়ান শব্দের আদি উৎস যেখানে ভাজা, সেখানে ‘নুশকা-ই-শাহজাহানি’ ‘জেরবিরয়ান’ রান্নায় আটা দিয়ে মুখবন্ধ করা পাত্রে রান্নার কথা বলেছে। এই পদ্ধতিও অবশ্য মোগল বাবুর্চিদের অজানা ছিল না। আবুল ফজল বর্ণিত শুধু মাংসের পদতালিকায় অন্যতম উল্লেখ ‘দমপুখত’-এর। মাংস এবং আনাজ মশলায় মাখিয়ে নিভু নিভু আঁচে মুখবন্ধ পাত্রে রান্না করা অন্যতম সুস্বাদু পদ—পরে যা ‘জেরবিরয়ান’ রান্নার কৌশল হিসেবে কাজে লেগে গিয়েছিল। মনে রাখতে হবে, রন্ধনশৈলী আদতে একটি শিল্প। স্থবিরতা শিল্পের ক্ষেত্রে থাকে না। রন্ধনশৈলীর ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। লখনউ বেড়াতে গিয়ে যাঁরা বিরিয়ানি খেয়েছেন, তাঁরা জানেন কলকাতার বিরিয়ানি থেকে তা কত আলাদা। বস্তুত, কলকাতার বিরিয়ানি ভিন্ন একটি পদ এবং শৈলীর তকমাও পেয়েছে। মাংস, মশলা, চালের সঙ্গে প্রথমে জুড়েছিল আলু। তারপরে ডিম সেদ্ধও জুড়েছে। কলকাতার বিরিয়ানিতে আলু কীভাবে এল, তা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। সে বিতর্ক ভিন্ন কিন্তু এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে নদীর মতোই রন্ধনশৈলীও এলাকা ভেদে নিজস্ব গতিপথ খুঁজে নেয়। একই পদ ভিন্ন ভিন্ন রূপে সামনে এসে হাজির হয়। সে ভাবেই পোলাওয়ের গোত্র থেকে উদ্ভুত ‘দুজদবিরয়ান’ নিজের রূপ বদলাতে বদলাতে শেষমেষ আমাদের পাতে বিরিয়ানি রূপে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমান কলকাত্তাইয়া বা লখনইয়ের রেস্তোরাঁর সৃষ্ট পদের সঙ্গে খাঁটি ‘দুজদবিরয়ান’ বা ‘জেরবিরয়ান’-র সাদৃশ্য কতদূর, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে আমাদের প্রিয় এই অনির্বচনীয় স্বাদের খাবারের শিকড় কিন্তু মোগলাই হেঁশেলেই আছে।

নির্বাচিত গ্রন্থতালিকা

১. Abul Fazl Allam,(Translated by H. Blochmann), Ain-i-Akbari Vol.1; Asiatic Society of Bengal, 1873.

২. Abdul Rahman Ansari, “Nuskha-i-Shah jahani: A Confluence of Indo-Persian Food Culture” inNasir Raza Khaned. Art and Architectural Traditions of India and Iran: Commonality and Diversity; Routledge, 2022.

৩. তপন রায়চৌধুরী, “মোগল আমলের খানাপিনা”, ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’; আনন্দ, ২০২২৷

৪. Krishnendu Ray and Tulasi Srinivas (eds.), Curried Culture: Globalization, Food, and South Asia, University of California Press, 2012.

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।