সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

গাইওয়ান

গাইওয়ান

কুন্তল রায়

জুন ১৪, ২০২৫ ৪০ 1

দার্জিলিং বা গ্যাংটকের চিনামাটির পাত্রের দোকানে গেলে ছবির এই পাত্রটি পেতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে এর নাম যদি জানতে চান তাহলে আপনাকে বলা হবে ‘মঙ্ক কটোরা’ বা ‘চায়না কাপ’। কিন্তু এগুলি আমাদের দেওয়া নাম, আসল চিনা নামটি হল গাইওয়ান। নাম শুনে যদি ভাবেন এর সঙ্গে তাইওয়ানের কোনও সম্পর্ক আছে, তবে তা একান্ত ভুল, কেবলই আনুপ্রাসিক সম্পর্ক। এটা চীনের মিং রাজবংশের আমলের চা সংক্রান্ত পাত্রের একটি এমন আবিষ্কার যা কিনা আজও ক্রেতার আকর্ষণের বিষয়বস্তু হয়ে আছে। এ কিন্তু কেবল চা খাওয়ার পাত্র নয়, এখানে সামান্য কয়েকটা পাতা ফেলে তাতে গরম জল ঢেলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা, তারপর তর্জনীকে ঢাকনার উপরে ও বৃদ্ধাঙ্গুলি আর মধ্যমাকে কাপের দুই প্রান্তে ধরে হালকা করে কেবল কাত করলেই চা পাতা থেকে শুষে নেওয়া খয়েরি বা সবুজ আভার গরম জল চুইয়ে পড়বে নীচের ছোটো বাটিতে আর তারপরেই… আহা!!

হাজার রকমের চায়ের মধ্যে সবটাই যে এই পাত্রে তৈরির উপযোগী, এমন নয়। ওলং, সাদা বা সবুজ চা, চিনা কালো চা আর পু-এরহ্‌ ইত্যাদি পাতার ক্ষেত্রে খুব ভালো ফ্লেবার বের হয় এই পাত্রে। ছাঁকনির ঝামেলা যে কেবল নেই তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাতা না ভাঙায় আবার তা ব্যবহার করা সম্ভব হয়।

ইউরোপে ঢাকনা দেওয়া এক ধরনের পাত্র রয়েছে যাকে বলা হয় তুরিন, (এর গল্প অন্য একদিন হতে পারে)। তুরিনের চিনা সংস্করণ হিসেবে গাইওয়ানকে ভাবা যেতে পারে। গাইনের তিনটে অংশ, উপরে একটা ঢাকনা, মাঝে পাত্রটি এবং নীচে একটি প্লেট। নীচে প্লেটটিকে মনে করা হয় ধরিত্রী, মাঝের পাত্রটিকে ব্যক্তি কল্পনা করা হয় আর ঢাকনাকে স্বর্গ। স্বর্গ, মর্ত্য ও মানুষের প্রচেষ্টায় তৈরি হয় এই অমৃত রস। তাই এই পাত্রের আরেক নাম ‘সানকাই কাপ’ – যার অর্থ তিন পর্যায়ের প্রতিভার সংমিশ্রণ, ধরিত্রী, স্বর্গ ও মানব।

চিত্র-১ তুরিন

কেবল ঢাকনা দেওয়া কাপের যে চেহারাটির সঙ্গে আমরা খানিকটা পরিচিত সেটিকেও গাইওয়ান বলা হত। কিং সাম্রাজ্যের আমলে এগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর হান রাজত্বের সময় থেকে চীনের চা তৈরির প্রায় প্রতি ধরনের পাত্রের সঙ্গে ঢাকনা জুড়ে দেওয়ার রীতি জনপ্রিয় হয়। চীনের পরবর্তী সমস্ত সাম্রাজ্যে ঢাকনাওয়ালা পাত্রে কোনও জিনিস রাখা বা খাদ্য প্রস্তুত করার রীতি প্রচলিত হয়। কেটলি বা এই ধরণের পাত্রে ঢাকনা দেওয়া শুরু হলে তাদের আকৃতিগত পরিবর্তন আসে। গাইওয়ানের আকৃতির মূল ভিত্তি এক থাকলেও পাত্রের উপাদান বা নকশাতে কেবল পরিবর্তন দেখা যায়নি, তাদের আকার ও ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অভিনবত্ব এসেছে। পাত্রটির সূচনা হয় একটি বাটির আকারের অংশ থেকে, তারপরে নীচে প্লেট আসে এবং শেষে ঢাকনাযুক্ত হয়ে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। চীনে সাধারণত একজনের চা পানের ক্ষেত্রে গাইওয়ান জনপ্রিয় আর একসঙ্গে অনেকের চা তৈরি হতে কেটলি বা তুরিনের ব্যবহার হয়।

গঠনের ইতিহাস

যেহেতু হান সাম্রাজ্যের (২০৬ পূর্বাব্দ – ২২০ অব্দ) আমলে চীনের চায়ের পাত্রের প্রত্ন-অস্তিত্ব পাওয়া যায় তাই বলতে পারি এই দেশে চা পানের অভ্যাস বহুদিনের পুরোনো। তবে পরবর্তীকালের তাং যুগের আগে খাবারের পাত্র আর পানের পাত্রের মধ্যে এমন কিছু পার্থক্য বিশেষ একটা ছিল না অর্থাৎ ধরে নেওয়া যেতে পারে খাওয়া ও পান একই পাত্রে চলত। হান যুগে চা সমাদৃত হয়, কিন্তু তা আজকের মতো মোড়ের মাথার দোকানে গেলেই পাওয়া যেত না। তাই চায়ের সরঞ্জাম ও পাত্র – এই দুইয়ের চাহিদা ছিল। কেবল একটু গরম জল জোটানো সম্ভব হলে যে কোনও পাত্র দিয়েই তা তৈরি সম্পন্ন করা হত। এই পাত্রগুলিও বিশেষ আহামরি দেখতে ছিল না।

তাং যুগ (৬১৮ অব্দ – ৯০৭ অব্দ)

তাং যুগ মানেই চীনের চা-এর ক্ষেত্রে এক সুবর্ণ সময়। কারণ এই সময়ে চা খাওয়াটা এক ধরনের প্রাত্যহিক কাজ কেবল নয়, একেবারে সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে শারীরিক সমস্যা – চা আছেন সব আসরেই। তাং যুগ থেকেই চায়ের এই দখলদারি আজও বর্তমান। আপনি নিজেই বাড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখুন তো, চায়ের জন্য যেমন নিজস্ব পাত্র রয়েছে এমন আর ক’টি নির্দিষ্ট খাবারের পাত্র আপনি বাড়িতে এনেছেন! এখন প্রশ্ন হল, চীনের সমাজে চা নিয়ে এমন আগ্রহ হল কেন? এর উত্তর খানিকটা পাওয়া যাবে অষ্টম শতকে রচিত ল্যু ইউ-এর চায়ের ইতিহাস বিষয়ক এবং সম্ভবত এই বিষয়ে প্রাপ্ত প্রথম গ্রন্থটি থেকে। বইটির কথায় প্রবেশ করার আগে লেখকের বিষয়ে দুই-একটা কথা বলে নেওয়া যাক। ল্যু ইউ-এর জীবন বড়ো বর্ণময়। তিনি শিশুকালে অনাথ ছিলেন, পালিত বাবার নির্দেশে বৌদ্ধ মঠে পড়াশোনার জন্য যেতে হয়। কিন্তু সেখান থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন ক্লাউনের জীবিকায়! এর মধ্যেই স্থানীয় এক শাসকের চোখে পড়েন তিনি। সে ব্যক্তির সৌজন্যে এক বিপুল গ্রন্থাগারে পড়াশোনার সুযোগ পান, সঙ্গ পেয়েছিলেন বিভিন্ন বন্ধুদের, তার মধ্যে কেউ বিখ্যাত কবি, কেউ দার্শনিক, কেউ ক্যালিওগ্রাফার প্রভৃতি। সে যাই হোক, আসল কথায় আসি, চা নিয়ে ল্যু ইউ-এর বইটা যে আকারে খুব বড়ো ছিল এমন নয়, তবুও চা-এর ইতিহাস গবেষকদের কাছে এটা অবশ্য-পাঠ্য। দশ অধ্যায়ের এই বইটির চতুর্থ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু ছিল চা তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে। সেখানে ল্যু ইউ প্রায় ২৮ রকমের নানান রকমারি প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা উল্লেখ করেছেন। এই তালিকায় প্রথম এই ধরনের পাত্রের কথা জানা যায়, তবে তা হাতে লেখা পরবর্তী সংস্করণে যুক্ত হয়েছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়।

কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, তাং বংশের এক রাজা ছিলেন দেজং নামে। তার শাসনকালের সময়ে অর্থাৎ ৭৮০ থেকে ৭৮৩ সাল নাগাদ এক ঘটনা ঘটে। তার এক সামরিক আধিকারিকের কুই নিং নামে একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটি চা পানে খুবই আগ্রহী হলেও পাত্র এত গরম হত যে তার নরম চামড়ায় খুব কষ্ট লাগত। তাই সে মৃৎশিল্পীদের কাছে একটা এমন ডিজাইনের বাটি প্রস্তুত করতে অনুরোধ জানায় যাতে গরম জিনিস ধরলেও হাত পুড়ে না যায়। সেই প্রথম কাপের নীচে পেয়ালা চালু হয়। প্লেট আসায় চায়ের পাত্র ধরার ক্ষেত্রেও কেবল সুবিধা হয়নি, প্লেটের কারুকার্য সমগ্র পাত্রটিকে একটা আলাদা সৌন্দর্য প্রদান করেছে। আমরা আজকে যে পেয়ালা বা পিরিচের ব্যবহার করি তার আদিরূপ তৈরি করিয়েছিলেন কুই নিং নামের ছোট্ট সেই মেয়েটি। তবে সে সময়ে চা খাওয়ার প্রয়োজনে পিরিচ ও পেয়ালা এলেও আজকের গাইওয়ানের মতো তা কিন্তু দেখতে ছিল না। মোট কথা, তাং যুগে এসে বাটির নীচে একটি পেয়ালা যুক্ত হয়। চা গবেষক ও সংগ্রাহক ব্লু ইউ তাং যুগের প্রায় ২০ ধরনের পাত্র সংগ্রহ করেছেন।

এত পুরোনো একটা পাত্র এতদিন রয়ে গেল কেন? এর উত্তর দেওয়া বেশ জটিল আর অনেক শব্দের খরচ-সাপেক্ষ। তবুও সংক্ষেপে বলা যায়, চা তাং যুগের আগেও প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই সময়ে একটি পার্থক্য তৈরি হয়। কেবল একটি সাধারণ পানীয় থেকে উচ্চ সমাজের সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে ক্রমশ। তাং যুগ থেকে চা অভিজাত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বৃত্তের একটি আবশ্যিক উপাদান হয়ে ওঠে অর্থাৎ চায়ের জনপ্রিয়তার প্রথম পর্যায়ে এটি ছিল এলিট শ্রেণির মানুষের ভোগ্যপণ্য। আর তাই পাত্রের চাকচিক্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এলিটদের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ মানসিকতায় পাত্রের আকৃতি প্রজন্মান্তরে বহমান হয়ে চলে।

সং যুগ (৯৬০ অব্দ – ১২৭৯ অব্দ)

তাং যুগের পর যখন সং যুগ আসে তখন চায়ের প্রতি আগ্রহ আরও একধাপ বৃদ্ধি পায় আর সেই সঙ্গে চা পাত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। চা তৈরির ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত বিভিন্নতা তৈরি হওয়ায় পাত্রের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এই যুগের শুরুতেই চা খাওয়ার জন্য ‘জিয়ান’ নামের একটি পাত্র খুব জনপ্রিয় হয়, যাকে আমরা বর্তমানের ‘কটোরা’-র সঙ্গে তুলনা করতে পারি। চায়ের পাত্র পরিবর্তনের একটি বড় লক্ষ ছিল গরম পানীয়কে কিভাবে নিরাপদে কোনও আওয়াজ না করেই ঠোঁটস্থ করা যায়। সং যুগের শুরুতেও চা পাত্রের দুটিই ভাগ ছিল, তখনও ঢাকনা যুক্ত হয়নি। ঢাকনা দেওয়া সেই যুগের অন্যান্য যে পাত্রগুলি আজও দেখা যায় তাতে সাধারণত খাবার রাখা হত। ঢাকনা না এলেও পাত্র তৈরিতে বেশ কিছু প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসে, যেমন আজকের চিনেমাটির পাত্রে যে চকচকে ভাব দেখতে পাই (আলাদা করে গ্লেজ করা এবং যা করতে প্রায় ১০২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ২৪ ঘণ্টার মতো পোড়াতে হয়) অর্থাৎ গ্লেজ বা পাত্রের উপরের দিকে যে সাদা ফেনার মতো কারুকার্য – এর সবটাই আবিষ্কৃত হয় সং যুগে। সার্বিকভাবে সং যুগে চায়ের কাপ-প্লেট তৈরিতে এক ধরনের নান্দনিকতা যুক্ত হয়, যা এই যুগের পাত্রকে অনন্য করে তোলে।

সং যুগের আর একটি সংযোজনের কথা উল্লেখ করতেই হয়। এই সময় বিখ্যাত শিল্পী বা জ্ঞানী-পণ্ডিতদের সমাবেশে চা অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা আড্ডাস্থলে চা নিয়ে বসতেন অথবা তাদের আড্ডায় একেবারে চায়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। এখানে চায়ের গুণ, চা প্রস্তুতকারীর দক্ষতা এবং চা-পাত্রের সৌন্দর্য – এই সবকিছুরই মূল্যায়ন করা হত।

মিং যুগ (১৩৬৮ অব্দ – ১৬৪৪ অব্দ)

মিং রাজবংশের আমলে চায়ের সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তন ছিল গুঁড়ো চায়ের প্রচলন থেকে পাতা চায়ে আগ্রহ। স্বাভাবিক কারণেই এই পরিবর্তনের ফলে চা প্রস্তুতির পদ্ধতি ও সরঞ্জামে পরিবর্তন আসে। আর এই সময় আমাদের গাইওয়ান-ও তার বর্তমান চেহারা লাভ করে। যেহেতু পাতা চা তাই এই রকমের পাত্রে খুব ভালো লিকার হত। এর বাটির জলে অনেকক্ষণ পাতা ভিজে থাকায় তার থেকে খুব সুন্দরভাবে ক্যাফিন নির্গত হয়। আবার কাপে হাত রাখলেই জলের তাপ বুঝে নেওয়া সম্ভব ছিল। একে স্বাভাবিক ছাঁকনি হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। এই কারণে গাইওয়ান এতটা জনপ্রিয়তা লাভ করে।

কোথায় তৈরি হয় এই পাত্র? চীনের মাটির পুতুলের স্বর্গরাজ্য হল জিয়েংদুয়োজেন নামের একটি প্রদেশ (এদেশে যেমন দিল্লির কাছে খুরজা অঞ্চলটি)। চীন দেশকে আমরা বাকি বিশ্ব যত ক্ষেত্রে শ্রদ্ধার আসনে বসাই তার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল এই জিয়েংদুয়োজেন প্রদেশটি। কারণ চিনামাটির পাত্রের সূচনা ও প্রসার, এমনকি প্রযুক্তিগত উন্নতি বা শিল্পের নৈপুণ্য – সবই এখানকার কারিগরদের উদ্ভাবনের ফসল। ধরুন, পোর্সিলিনের পাত্রে চীনের যে ঐতিহ্যবাহী নীল রঙের নকশা বা চিনামাটির উপর পাঁচ রঙের ছাপা (উচাই) – এই সবই এখান থেকেই শুরু হয়েছে বলে জানা যায়। সবচেয়ে বড়ো কথা, প্রতি আলাদা যুগে চীনের মৃৎপাত্রের আকৃতি ও উপরের নকশাতে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন মিং আমলের ছবির বৈশিষ্ট্য হল সারল্য, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং স্বাভাবিক সৌন্দর্য – যা এই পাত্রের অলংকরণের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। খুব কম তুলির টানে এবং জটিলতাবিহীন স্ট্রোক বা ডিজাইনে গভীর ভাব তৈরি করেছিল। প্রতি যুগের চিনামাটির পাত্রের ছবি বা নকশার প্রকৃতি সেই যুগের চিত্রশিল্পের চরিত্রকে বহন করায় গাইওয়ান আর কেবল একটি চা-পাত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না, তাদের দেশের চিত্রশিল্প ও তার দর্শনের এক প্রতীক হয়ে বেঁচে রইল।

চিং যুগ (১৬৪৪ অব্দ – ১৯১২ অব্দ)

গাইওয়ানের সেরা সময় যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে অবশ্যই তা চীনের শেষ রাজবংশের আমল অর্থাৎ চিং যুগ। তার কারণ দুটো – প্রথমত, এই সময়ে দেশের চিনামাটির পাত্রের ব্যাপক প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসে। দ্বিতীয়ত, চীনের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য এই পাত্রটির বিক্রি অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। আসলে এই দুই কারণে চেয়েও তৃতীয় একটি কারণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল, যা খুব একটা উল্লিখিত হয় না। চীনে এই সময় ক্রমশ মধ্যবিত্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই সম্প্রদায়ের মধ্যেই চায়ের প্রতি আগ্রহ সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল। মধ্যবিত্তদের মূল মানসিকতাই ছিল সস্তা অথচ কারুকার্যের শিল্পদ্রব্য কেনা। তাই জিয়েংদুয়াজেন প্রদেশে চিনামাটির দামি পাত্রের চেয়েও সস্তা, রঙচঙে পাত্র বিক্রি হত বেশি আর তাতে মুনাফাও হতে লাগলো। কারণ মধ্যবিত্ত ক্রেতার আর্থিক সঙ্গতি ক্রমশ উন্নত হচ্ছিল। এই সঙ্গতি-বৃদ্ধির কারণে চিং যুগের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এই সুযোগে সাধারণের মধ্যে চা উপকারী পানীয় হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি হয়। চা গ্রহণের ক্ষেত্রেও আসে নানা ফিউশন, অন্যান্য গাছগাছড়া, শেকড়-বাকল মিলিয়ে দেহের প্রয়োজনীয় পানীয় হিসেবে চা-কে উপস্থাপিত করে চীনের বৈদ্যরা (চীনের ‘তাই চি’ পদ্ধতির চিকিৎসায় চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে)।

সারা দেশের বহুলাংশে চা জনপ্রিয় হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই গাইওয়ানের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এই কারণে বিরাট এই দেশে গাইওয়ান তৈরির আলাদা বেশ কয়েকটি কেন্দ্র স্থাপিত হতে দেখা যায় এবং এদের কিছু কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গিয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী জিয়েংদুয়াজেন-এর পাত্রে পাতলা পোর্সিলিনের উপর সূক্ষ্ম ও জটিল এনামেলের কারুকার্য লক্ষ করা যায়। আবার গুয়াংদুং-এর উজ্জ্বল এবং মূল্যবান গুয়াংচাএ নকশাতেও গাইওয়ান তৈরি হয়েছিল। (অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ করা যেতে পারে, গুয়াংচাএ (Guangcai) হল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিনামাটির নকশার কাজ। এর বৈশিষ্ট্য হল, কোনও পাত্রের উপরের ছবি পুরোটাই হাতে আঁকা ও নানান রঙ দিয়ে তৈরি হত। আমাদের দেশে সিরামিকের উপর এই ধরনের হাতে আঁকা কাজ বর্তমানে খুব জনপ্রিয় হচ্ছে; তবে তা গুণমানে চীনের শিল্পীদের থেকে অনেক পিছিয়ে।)

চিত্র–২ গুয়াংচাএ নকশা

মিং রাজবংশের আমল থেকেই প্রায় গাইওয়ানের প্রয়োজনীয়তা বা ব্যবহারিক গুরুত্ব যেমন বৃদ্ধি পায় সেই সঙ্গে সুদৃশ্য ও দামি গাইওয়ান সাজিয়ে রাখাও এক ধরনের আভিজাত্য ছিল (কলকাতার কিছু পুরোনো চিনা ইটিং হাউজ বা পাও চ্যাং-এর অধিকাংশ দোকানে গেলে এই ঐতিহ্য আজও দেখা যায়)। মিং যুগের শেষের দিকে এই পাত্রটি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি হতে থাকে, কারণ চা-ও এই সময় সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

এবার একটা অন্য বিতর্কের কথায় প্রবেশ করি। যদি বলেন, ইতিহাস কী, তাহলে বলব আমরা অতীতকে যেভাবে দেখতে চাই, তাই হল ইতিহাস। ধরুন আমাদের ইচ্ছে হল, এমন একটা ধারণা থেকে গাইওয়ানের অতীতকে দেখা যে – এটি একটি অনেক প্রাচীন পাত্র। সেক্ষেত্রে মিং যুগ কেন, তার বহু বহু বছর আগে থেকে সমধরনের পাত্রের মধ্যে বিবর্তনের পরম্পরা উল্লেখ করে গাইওয়ানের ইতিহাস তৈরি করা যায়। এই পাত্রটির খুব নির্দিষ্ট এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার অতীত খুঁড়ে বের করতে থাকলে তৈরি হবে পাত্রের বিবর্তন-কেন্দ্রিক ইতিহাস। এর পাশাপাশি দ্বিতীয় একটি ধারণা রয়েছে যে গাইওয়ান একেবারেই মিং আমলে শুরু হওয়া একটি পাত্র। এই মতের সমর্থন পাই জোসেফ ওয়েসলি উল-এর রচিত ‘The Art and Craft of Tea: An Enthusiast’s Guide to Selecting, Brewing, and Serving Exquisite Tea’ গ্রন্থে, এখানে তিনি মিং যুগকে (১৩৬৮ – ১৬৪৪) সূচনাকাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ২০১০ সালে প্রথম প্রকাশিত সিন্থিয়া গোল্ড-এর লেখা ‘Culinary Tea: More Than 150 Recipes Steeped in Tradition from Around the World’ নামক গ্রন্থে একই সময়কালের কথা উল্লেখ রয়েছে। এঁদের মত অনুযায়ী গাইওয়ান মিং যুগ থেকে পরবর্তী প্রায় ৫০০ বছর ধরে পৃথিবীতে ক্রমশ জনপ্রিয়তা বাড়িয়েই চলেছে।

শেষে সামান্য চমক দেওয়ার চেষ্টায় কয়েকটা কথা যুক্ত করে যাই। আছে নাকি এমন পাত্র আমাদের এই পোড়া বাংলায়? কি করেই বা থাকবে, আমরা তো আর বহু আগে থেকে চা খাওয়া শুরু করিনি। তবে একটা কথা, কিছুদিন আগে সংগ্রাহক নীল পাল মহাশয় একটি গ্লাসের ছবি দিয়েছিলেন, যার তিনটে অংশ, ঢাকনা, গ্লাস ও তার নীচে মিষ্টি বা পান দেওয়ার জন্য ছোট্ট একটা লুকোনো বাটি। একে সম্ভবত ‘মুখমিষ্টি গ্লাস’ বা ‘জামাই ঠকানো গ্লাস’ বলে। একে গাইওয়ানের ‘বাংলা ভাই’ বলা যেতে পারে? আপনাদের সংগ্রহে এমন কিছু থাকলে তার সন্ধান দিন না।

চিত্র–৩ মুখমিষ্টি গ্লাস (চিত্রঋণ – নীল পাল)

তথ্যসূত্র:

১. https://www.seriouseats.com/tea-technique-gaiwan-brewing

২. https://lapsangstore.com/blogs/what-is/what-is-gaiwan-the-past-and-present?srsltid=AfmBOooSmpXjvdEMJbHbXBgI_VsUJps9eNhycWfgfGe0uOWnQYlQEK9X

৩. https://zen-brew.com/blogs/teaware-appreciation/the-origin-and-history-of-gaiwan?srsltid=AfmBOopINiurGXM_MFcCCINz0Bz7i835-Fnxz2gw0JFKLWHess0S__Aj

৪. https://teasoul.store/en/a-guide-to-the-gaiwan-history-how-to-use-etc/?srsltid=AfmBOopR2l9KGCaF31ltZojBmAFRQlcTixvka_27KDUqs3rIWFFgv-w9

৫.  https://chitracollection.com/the-gaiwan-a-coveted-covered-cup/

৬. https://ooika.co/learn/what-is-a-gaiwan?srsltid=AfmBOor_38_qZ5QzUjieVNrqOMIXXGDCK-rFFC4uVONTNDl9smlzggH0

৭. https://teteriabarcelona.com/taller-de-te-tea-workshop/gaiwan-su-historia-y-evolucion-durante-casi-700-anos/?lang=en

৮. https://teaphile.com/blogs/tea-talk/%E7%9B%96%E7%A2%97-gaiwan-part-1

মন্তব্য তালিকা - “গাইওয়ান”

  1. চমৎকার ইতিহাস লেখা। একটানে পড়ে ফেললাম। দিনে যদিও বড় জোর দুকাপ চা পান করি, তবে ৩৫ বছর এই কফি পান করা দেডে থেকেও সকালে এককাপ চা আমার এখনো চাই। বোধকরি এতে আমি বেশ গর্বই অনুভব করি। এজন্যই লেখাটি আরো সুখময় লেগেছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।