সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ভরতনাট্যম

ভরতনাট্যম

লিপিকা ঘোষ

মার্চ ২০, ২০২১ ৪৩১৮ 5

জন্মলগ্ন থেকেই আমার দেশ বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণা। এ দেশে দুঃখের অনলে দগ্ধ হবার হোমযজ্ঞ যেমন আছে, তেমনই আনন্দ ধারায় শীতল স্নানের সপ্তনদী-সংস্কার আছে। এ মাটিতে যুদ্ধ হানাহানির ক্ষতবিক্ষত দাগ যেমন আছে, তেমনি এ মাটিতে সুপ্রাচীন কালের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সুনিপুণ পদচিহ্ন আছে। আর সেই প্রাচীন সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে রয়েছে ভারতীয় নৃত্য। ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন নৃত্যকলা হল ভরতনাট্যম নৃত্যকলা। কালক্রমে এই প্রাচীন নৃত্যকলা রূপে, রঙে পরিবর্তিত হলেও তার সুরের নদীতে বয়ে চলেছে বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতা। তবে এর ইতিহাস বলে শুধু আধ্যাত্মিকতাই নয়, এ নদীতে বয়ে চলেছে অধ্যবসায়, অশ্রুধারা, সামাজিক ব্যাধির দুর্গন্ধ আর সংগ্রাম।

ভরতনাট্যম শুধুমাত্র একটি নৃত্যধারা নয়, একটি মার্গও। ভরতনাট্যম একটি সাধনার নাম। ভারতীয় নৃত্যধারার পূর্ণাঙ্গ রূপের শ্রেষ্ঠতম অভিব্যক্তি হল ভরতনাট্যম। দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোর গ্রামে প্রথম প্রচলিত এই নৃত্যধারাকে অনেকে আঞ্চলিক নৃত্যধারা বলে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে ভরতনাট্যম আঞ্চলিক নৃত্যধারা নয়, এটি একটি সর্বভারতীয় পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্রীয় নৃত্যপদ্ধতি, যা অন্যান্য মার্গনৃত্যধারাতেও অনুসৃত হয়েছে। 

মূলত নটরাজের বন্দনা দিয়েই শুরু হয় ভরতনাট্যম নৃত্যানুষ্ঠান। তাই ভরতনাট্যম নৃত্যের আলোচনার প্রথমেই আসে এ প্রসঙ্গ। ভরতনাট্যম নৃত্যপদ্ধতির মূল ভাবধারা ধর্মভিত্তিক ও দেবনির্ভর। ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে মহাদেব শঙ্করকে নৃত্যের স্রষ্টা বলে স্বীকার করা হয়। ভারতীয় নৃত্যের দার্শনিক ব্যাখ্যার মূর্ত প্রতীক দক্ষিণভারতীয় নটরাজ মূর্তি। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতিতে নটরাজের(শিবের) কল্প-মূর্তি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শঙ্কর সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, তিরোভাব, ও অনুগ্রহ এই প্রতিক্রিয়ায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কল্পনা করা হয়েছে, তিনি রজোগুণের বিকাশে স্রষ্টা, সত্ত্বগুণের বিকাশে পালনকর্তা এবং তমোগুণের বিকাশে প্রলয়ঙ্কর। শিবের তাণ্ডব হল বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি শক্তির প্রকৃত রূপ।

নৃত্য শিল্পীর আরাধ্য দেবতা নটরাজের কল্প-মূর্তি চার হাত বিশিষ্ট হয়। ডানদিকের উপরের হাতে ডমরু থাকে যা সৃষ্টির প্রতীক, মহাকালের বুকে ছন্দ তাল ও লয় রক্ষা করে চলেছে। নটরাজের বাম দিকের উপরের হাত অর্ধমূদ্রা বিশিষ্ট হয়, তাতে প্রজ্বলিত অগ্নি, ধ্বংসের প্রতীক। ডানদিকের নীচের হাতে তিনি অভয় দান করেন। বাম দিকের নীচের হাতে ‘গজহস্তমুদ্রা’ রয়েছে, যার অর্থ, তাঁর চরণে আশ্রয় নিলে মুক্তি লাভ -এই হাতটি সর্ববিঘ্ন নাশের প্রতীক। পদতলে অপস্মর নামক মায়ারূপী দৈত্যকে দলিত করেছেন। এই দৈত্য পদ্মপীঠের উপর শুয়ে থাকেন। নটরাজের পিছনে চক্রাকারে অগ্নিগোলক বিশ্বের ও বিশ্ববাসীর প্রাণশক্তির পরিচয় দেয়। শিরে জটাজাল যা নৃত্যের ছন্দে শূন্যে উৎক্ষিপ্ত, তা গঙ্গা যমুনা ও গোমুখের কথা স্মরণ করায়। কপালের অর্ধচন্দ্রটি জ্ঞানের এবং মাথায় সাপটি প্রাণশক্তির প্রতীক। তাঁর এক কানে পুরুষ ও অন্য কানে নারীর অলঙ্কার একাধারে পুরুষ ও প্রকৃতির প্রতীক।

শিবের তাণ্ডব নৃত্য থেকেই সকল নৃত্যের উদ্ভব হয়েছে – এই বিশ্বাস থেকেই নটরাজ বন্দনা দিয়ে শুরু হয় এই নৃত্যসাধনা।

“আঙ্গিকম্ ভুবনম যস্য বাচিকম সব্বাঙ্গয়ম।

আহরয্যং চন্দ্রতারাদি তং নুমঃ সাত্ত্বিকম শিবম ।।”

– অর্থাৎ দেবাদিদেব শিবের অঙ্গ হল এই ভুবন। তাঁর আঙ্গিক অভিনয়সঞ্জাত। তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত ওঙ্কারধ্বনি সমগ্র জগতের শব্দসৃষ্টির মূল। এই শব্দ ও ধ্বনি তাঁর বাচিকঅভিনয়সম্ভূত। চন্দ্র, তারা ও জ্যোতির্মণ্ডল তাঁর অলঙ্কার।

নাট্যশাস্ত্র ও ভরতনাট্যম:

যেহেতু এই নৃত্য ভরতমুনির ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থকে অবলম্বন করে প্রস্ফুটিত হয়েছে সেহেতু ভরতনাট্যমের সঙ্গে ভরতমুনির ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থটির অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে। এই গ্রন্থটিকে ভরতনাট্যমের ব্যাকরণও বলা যেতে পারে।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে কোনো এক সময়ে ভরত মুনির ‘নাট্যশাস্ত্র’গ্রন্থটি রচিত হয়। কেউ কেউ মনে করেন, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকেই ভরতমুনি তাঁর অতি বিস্তৃত তথ্যপূর্ণ এই ‘নাট্যশাস্ত্র’ রচনা করেন। কারণ এই গ্রন্থটির উত্তরাধিকারী হিসেবে কোহল -এর নাম পাওয়া যায়। কেউ কেউ এও মনে করেন আচার্য কোহল নাট্যশাস্ত্রের শেষাংশ লিখেছেন। এই কোহল দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে বর্তমান ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থটি বত্রিশ লক্ষ শ্লোকসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ।  অভিনয়কলা সম্বন্ধে সর্বাধিক প্রামাণ্য গ্রন্থ হল এই ‘নাট্যশাস্ত্র’। এর সংক্ষিপ্তরূপ হল নন্দিকেশ্বরের ‘অভিনয় দর্পণ’। আচার্য  ভরতমুনি বলেছেন-ঋগ্বেদ থেকে পাঠ্য, সামবেদ থেকে গান, যজুর্বেদ থেকে অভিনয়, অথর্ব বেদ থেকে রস সংগ্রহ করে পঞ্চম বেদ বা নাট্যশাস্ত্র রচিত হয়। এই গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে নাট্য সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে নৃত্যের উল্লেখ করেছেন। অষ্টম ও দ্বাদশ অধ্যায়ে ভরতনাট্যম নৃত্যের অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, উপাঙ্গের ক্রিয়া সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা আছে। উনবিংশ অধ্যায়ে নৃত্যের লাস্যাঙ্গের বিবরণের সঙ্গে ভাব-রস, বেশ ভূষা, ছন্দ, ভাষা ও তার গুণাগুণ সম্বন্ধেও আলোচনা করেছেন।  

প্রাচীনতম নাট্যশাস্ত্রকার ভরতমুনির ‘নাট্যশাস্ত্র’ রচনাকালের আগে ভারতে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রচলন যে ছিল না তা নয়, বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থ, স্থাপত্য ও পুরাণ থেকে জানা যায় সুপ্রাচীন কাল থেকেই আমাদের দেশে শাস্ত্রীয়নৃত্যের  প্রচলন ছিল। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণে নৃত্যের উল্লেখ পাওয়া যায় । নৃত্যের উপকারিতার সম্পর্কে বেদ এ ও বলা আছে( ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে, আঠারো নম্বর সূক্তের তিন নম্বর ঋকে)

‘প্রাঞ্চো অগাম নৃত্যয়ে হসায় দ্রাঘীয়

আয়ু প্রতবং দবীনঃ।’

-এর অর্থ, আমরা ভালোভাবে নৃত্য ও হাস্য করি তাই উৎকৃষ্ট ও অতি দীর্ঘ আয়ু পায়। সে যুগে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ নৃত্য গীতে অংশ নিত এমনকি শূদ্ররাও এতে অংশগ্রহণ করত, যৌথ সমাজজীবন বর্তমান ছিল এবং নৃত্যগীতের চর্চা একটি প্রধান অঙ্গ ছিল তার প্রমাণও পাওয়া যায়।

ভরতনাট্যম নৃত্যের নামকরণ নিয়ে মতপার্থক্য আছে। অনেকে মতে ভাব, রাগ, তাল এই তিন রকম রস নিয়ে সৃষ্টি হয় নৃত্য তাই ভাব, রাগ ও তাল এই তিনটি শব্দের প্রথম অক্ষর(ভ,র,ত,)নিয়েই ভরতনাট্যম কথাটি এসেছে। আবার অনেকে মনে করেন ‘ভরত মুনি’ প্রবর্তিত নৃত্য বলেই এই নৃত্যের নাম ভরতনাট্যম। ভরতমুনি প্রণীত ‘নাট্যশাস্ত্রে’র মূলসূত্র ধরেই এই নৃত্যের বিকাশ বলেই এই নৃত্যশাস্ত্রে উল্লিখিত ‘করণ’, ‘প্রকরণ’, ‘মুদ্রা’, ‘আঙ্গিক’, ‘অঙ্গাহার’ ও ব্যাকরণ একমাত্র ভরতনাট্যমেই দেখা যায়। তাই নামকরণের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত দুটো কারণই যুক্তিযুক্ত।

ভরতমুনির ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থে নৃত্য সম্পর্কে আলোচনা থাকলেও এই গ্রন্থে ‘ভরতনাট্যম’ শব্দটির কোনো উল্লেখ নেই। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যে রচিত তামিল কাব্যনাট্য ‘চিলাপ্পদিকরম’ এ ‘কুত’ শব্দটির সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়, যা নাচ অর্থে ব্যবহৃত হত। ‘কুত’ ও ‘শিলাম্বু’ শব্দ দুটি পরিবর্তিত হয়ে ‘ভরতনাট্যম’ নাম হয়। “নটনাদীবাদ্যরঞ্জনম” গ্রন্থেও ভরতনাট্যম নৃত্যধারা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। ভরতমুনির ‘নাট্যশাস্ত্র’ এর সংক্ষিপ্ত সংস্করণ নন্দিকেশ্বরের ‘অভিনয় দর্পণ’ গ্রন্থে ভরতনাট্যম নৃত্যসম্পর্কে সুনির্দিষ্ট আলোচনা রয়েছে।

এই ভরতনাট্যম নৃত্যেরই পূর্বে নাম ছিল সাদিরঅট্যম। ‘সাদির’ শব্দের অর্থ চার। চারটি বেদের উপকরণ থেকে এর জন্ম তাই এর নাম সাদিরঅট্যম। মন্দিরের দেবদাসীরা এই নৃত্য পরিবেশন করতেন তাই এর আরেক নাম দাসীঅট্যম। ভরতনাট্যম বলতে শুধু সাদির বা দাসী অট্যম নয়, সাদিরঅট্যম, ভগবতমেলা, কুরুভাঞ্জি ও কুচিপুড়ি- এই চার পদ্ধতি ভরতনাট্যমের অংশ ছিল। দাসীঅট্টম বলতে চিন্নমেলম, সাদিরনৃত্য ও তাঞ্জোরনৃত্য ইত্যাদিকে বোঝাত। পরবর্তীতে ঐ নৃত্যের নামকরণ করা হয় ভরতনাট্যম।

দক্ষিণ ভারতীয় রাজবংশের অবদান:

যুগ যুগ ধরে যাঁরা এই নৃত্যকলাকে সঞ্জীবিত রাখতে সবচেয়ে বেশি অনুগ্রহ সিঞ্চন করেছেন সেই দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজবংশের রাজাদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতকের কাঞ্চীপুরমের পল্লবরাজা, বিশেষ করে পল্লব রাজবংশের নরসিংহ বর্মা ও পল্লব-চোল-রাজ পরকেশরী বর্মা নৃত্য গীতে খুবই উৎসাহী ছিলেন। পরকেশরী বর্মা তো চিদাম্বরমে সোনার  নটনসভা নির্মাণ করে ফেললেন। একাদশ শতাব্দীর রাজরাজ ও তাঁর পুত্র রাজেন্দ্রও অত্যন্ত সঙ্গীত প্রিয় ছিলেন বলেও শোনা যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর কুলোথুঙ্গা (১,২), রাজরাজন, কুলোথুঙ্গার (৩) রাজত্বকালেও সঙ্গীতচর্চার প্রচলন ছিল। তাঞ্জরের মহারাজা স্বোয়াদি থিরুমল স্বয়ং সংস্কৃত ভাষায় ‘বিষ্ণু বন্দনা’ সঙ্গীত রচনা করেন।

উত্তর ভারতে বিদেশি আক্রমণ হলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এই বিশৃঙ্খল পরিবেশে সঙ্গীতশাস্ত্রকার শার্ঙ্গদেব দৌলতাবাদের রাজার কাছে আশ্রয় নেন, ‘সঙ্গীত রত্নাকর’ গ্রন্থটিও এখানে বসেই রচনা করেন।

আবার বিজয়নগর রাজবংশের পতনের পর বহু কবি, নৃত্যশিল্পী, ও সঙ্গীতজ্ঞরা তাঞ্জোর রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঞ্জোরের রাজা আজুথাপ্পা এঁদের আশ্রয় দেন। তিনি ‘মেলাটুর’ বলে একটি গ্রাম ব্রাহ্মণদের দান করেন। কয়েকশো ব্রাহ্মণ পরিবার সেখানে আশ্রয় পায়। এই রাজার উত্তর পুরুষ রঘুনাথ নায়ক, বিজয় রাঘভুলু নায়কের রাজত্বকালে (১৬১৪ – ১৬৭৩) অন্ধ্রপ্রদেশের বিশিষ্ট নাট্যগুরু তীর্থ নারায়ণ যতি ক্ষেত্রায়া রাজসভা অলঙ্কৃত করেন। তীর্থ নারায়ণনকে ভাগবতমেলা নাটকের স্রষ্টা বলা হয়।

নায়কদের পরে তাঞ্জোরের রাজা তুলযাজী সঙ্গীতে বিশেষ অনুরাগী ছিলেন বলেই বহু শিল্পীর সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর রাজসভায়। তিনি তিন্নিভেল্লী থেকে  ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী এবং গুরু মহাদেব অন্নাভিকে রাজসভায় আমন্ত্রণ করেন। তাঁরই নির্দেশে মহাদেব আন্নাভি, বনজাক্ষী ও মুথুমন্নর নামে দুজন শিষ্যকেও সঙ্গে আনেন। মহাদেব অন্নাভি নৃত্য পারদর্শিতার জন্য ‘ভরতনাট বিদ্বান’ বলে সম্মানিত হন। প্রতাপ সিংহ ও তুলযাজীর রাজত্বকালে ভেঙ্কটরাম শাস্ত্রীর আবির্ভাব হয়। এই তাঞ্জোরের রাজা তুলযাজীর সভাশিল্পী ছিলেন সুব্বারায়া নাট্টুবান (১৭৬৩ – ৮৩)। ইনি ভরতনাট্যম নৃত্যশাস্ত্রের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। একাধারে পণ্ডিত, বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী, নৃত্যগুরু ছিলেন। তাঞ্জোরের রাজা আজুথাপ্পা নায়ক, রঘুনাথ নায়ক, বিজয় রাঘব নায়কের রাজত্বকালকে (১৫৭২ – ১৬৭৩) ভরতনাট্যমের স্বর্ণযুগ বললেও অত্যুক্তি হয় না।

তুলযাজীর সভাশিল্পী সুব্বারায়ার চারপুত্রের অন্যতম শিবানন্দ তাঞ্জোরের রাজা সরফোজির রাজসভার সভাশিল্পী ছিলেন (১৭৯৮ – ১৮২৪)। বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী ও নাট্টুবান চিন্নাইয়ার নৃত্য দেখে তাঞ্জোরের রাজা এতই মুগ্ধ হন যে পুরুষদের এই নৃত্যে পারদর্শী করার জন্য বিশেষ উৎসাহ দিতে থাকেন  বর্তমানে যে অধিক সংখ্যক পুরুষ নৃত্যশিল্পী পাচ্ছি তার বীজ হয়ত তিনিই বুনেছিলেন। ভরতনাট্যমের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে তাঞ্জোরের রাজসভায়।

তাঞ্জোরের রাজা সারফোজী ও শিবাজীর রাজত্বকালে(1798-1865) নাট্টুবান সুব্বারায়ার চার পুত্র চিন্নাইয়া, পুন্নাইয়া, শিবানন্দ, ওয়ডিভেলুর আধুনিক ভরতনাট্যম নৃত্যের সংস্কারসাধন করেন। 

এই চার ভাই ভরতনাট্যমের ‘নৃত্যে’র সঙ্গে ‘নৃত্তে’র অংশ যোগ করেন। এঁদের এক ভাই ওয়াডিভেল্লু কর্নাটকী সঙ্গীতে বেহালার প্রবর্তন করেন। উত্তর ভারতের কত্থক নৃত্যের ‘তারানা’র অনুকরণে ‘তিল্লানা’ অংশ সংযোজিত করেন। বর্তমানে যে ভরতনাট্যমের রূপ দেখা যায় তা এই চার ভাইয়ের সৃষ্টি। এই নাট্টুবান  পুন্নাইয়া র দৌহিত্র পুত্র ছিলেন বিশিষ্ট নাট্টুবান বা গুরু মীনাক্ষী সুন্দরম পিল্লাই।

ভারতনাট্যমের সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের বিখ্যাত কবি ও সঙ্গীতস্রষ্টা ঋষি ত্যাগরাজের তেলেগু ভাষায় রচিত অপূর্ব সঙ্গীতের রূপায়ণ করা হয়, বিশেষ করে ভরতনাট্যমের  নাট্যধর্মী  অংশে। এতে নৃত্য আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

দেবদাসীর অশ্রুসিক্ত দেবার্ঘ্য:

ভরতনাট্যমের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মন্দির ও দেবদাসী। এই নৃত্যকলায় দেবদাসীর ভূমিকা সর্বাধিক। যুগ যুগ ধরে এরাই ভরতনাট্যম নৃত্যকলাকে সঞ্জীবিত করে রেখেছিলেন। ভারতীয় নৃত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই ভরতনাট্যমের প্রকৃত ধারক ও বাহক তাঁরাই। তাঁরা মন্দিরের মধ্যে আবদ্ধ থেকে সাধিকার জীবন যাপন করে এই নৃত্যের চর্চা করেছেন। কখনো মন্দিরে, কখনো রাজদরবারের, কখনো গণিকালয়ে গিয়ে সমাজের গরল পান করে কলঙ্কিত হয়েছেন। তাই ভারতবর্ষের সংস্কৃতির ইতিহাসেও রয়েছে কলঙ্কের গন্ধ।

প্রাচীন কালে সাত থেকে বারো বছরের বালিকা দেবতার পাদপদ্মে নিবেদিত হত। সারাজীবন দেবতার চরণে নিজেকে উৎসর্গ করে নৃত্যচর্চা করতেন তাঁরা। সাধারণ জীবনযাপনে তাঁদের কোনও অধিকার থাকত না। মন্দিরের বিগ্রহের সঙ্গে তাদের বিবাহ দেওয়া হত। এঁরা মন্দিরের দেবতার সামনে নৃত্য-গীত পরিবেশন করতেন। নৃত্য-গীতকে দেবার্ঘ্য হিসাবেই নিবেদন করতেন। এঁদেরই দেবদাসী বলা হত। রাজার পক্ষ থেকে বা মন্দিরের পক্ষ থেকে এঁদের ব্যায়ভার বহন করা হত এবং দেবদাসীদের জমি ও অর্থ দান করা হত। প্রকৃতপক্ষে এঁরা ছিলেন সাধিকা। কঠিন নৃত্যচর্চার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত হত এঁদের। তবে এঁরা  ছিলেন দেবতার চরণে নিবেদিত দাসী, রাজার ভোগবিলাসিনী নয়।

দেবদাসীদের নৃত্য শিক্ষককে বলা হত নাট্টুবান। এই নাট্টুবানরা বংশ পরম্পরায় ছিল নাচের জগতের মানুষ। এঁদের পেশা সীমাবদ্ধ হয়ে যেত একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে। বিনা পারিশ্রমিকে এঁরা দেবদাসীদের শিক্ষাদান করতেন। বিনিময়ে দেবদাসীরা আজীবন তাঁদের উপার্জনের অর্ধাংশ দিতেন নাট্টুবানকে। নাট্টুবানরা তাঁদের মাটির মেঝেতে নৃত্যশিক্ষা দিতেন। নৃত্য শিক্ষা শুরু হত নির্দিষ্ট পূজার মাধ্যমে। নৃত্যের সময় একটি কাঠের উপর আর একটি ছোট কাঠের দণ্ড দিয়ে শব্দ করে তাল রক্ষা করা হত। একে বলে ‘তাট্টুকাঝি। নাট্টুবানের অনুমতি ছাড়া কোন অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারত না এই দেবদাসীরা। নাট্টুবানরা অত্যন্ত রক্ষণশীল হওয়ার কারণে এবং বংশপরম্পরায় তাঁদের নৃত্যশিক্ষা দানের অধিকার থাকার কারণে নৃত্যের নবরূপায়নে, প্রকৃত ও যথাযথ শিক্ষাদানে উৎসাহ ছিল না তাঁদের।

প্রাচীন কালের বহু গ্রন্থে এই দেবদাসীদের উল্লেখ আছে। পদ্মপুরাণ (চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে সংকলিত) থেকে, ‘ভবিষ্য পুরাণ’ থেকে সূর্যের উপাসনায় নৃত্য-গীত নিপুণা নারী উৎসর্গ করার রীতির উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘শিবপুরাণ’এ পাওয়া যায় শিব মন্দির নির্মাণ ও সংরক্ষণ প্রসঙ্গে অন্যান্য পূজা -অর্চনা নিয়মের সঙ্গে দেবসেবার জন্য নৃত্য-গীত কুশলী সুন্দরী নারী দেবমনোরঞ্জনের জন্য দান করা হত।

প্রখ্যাত চোলরাজা প্রথম রাজরাজ- এর রাজত্বকালে (৯৮৫-১০১৪ খ্রিঃ) তাঞ্জরের মন্দিরে চারশত দেবদাসীর অবস্থিতির কথা জানা যায়। ১০২৪ খ্রিঃ-এ গজনির সুলতান মামুদ যখন ভারতের ‘সোমনাথ’ মন্দির আক্রমণ করে তখন সেখানে প্রায় পাঁচ শত দেবদাসী ছিল বলে জানা যায়। তৃতীয় কোলাথুঙ্গার রাজত্বকালে তিরুভিদামারুবুর মন্দিরে দেবদাসী ছিল সবচেয়ে বেশি । তাঁদের ‘নট্টভনিলাই’ ও ‘নট্টু ভক্কনি’ নামে বৃত্তি দেওয়া হত। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিবাহবন্ধন আবদ্ধ হয়েছিল, সে অধিকার তাঁদের দেওয়া হয়েছিল।

শুধুমাত্র দক্ষিণ ভারতের নয় ভারতের বিভিন্ন স্থানে এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেবদাসীদের অবস্থানের কথা জানা যায়। দক্ষিণ ভারত ছাড়াও ওড়িশা, কর্ণাটক, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মণিপুরের মন্দিরে মন্দিরে  দেবদাসী দের নৃত্য-গীত প্রদর্শনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ওড়িশার দেবদাসীদের বলা হত ‘মাহারী’। এরা ‘ভিতর গণি’ ও ‘বাহার গণি’, ‘গীত গণি’, ‘গৌর গণি’ এমন বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। তামিলনাড়ুর দেবদাসীদের বলা হত ‘দেবাদিগালার’, অন্ধ্রপ্রদেশে বলা হত ‘বাসাভী’ এবং মহারাষ্ট্র ‘মুরলী’ বলা হত। মণিপুরের দেবদাসী দের ‘আমাইবা’ বা ‘আমাইবি’ বলা হত। রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায় ৭৬৫ খ্রিঃ এ পুণ্ড্রবর্ধন নগরে কাশ্মীর রাজ জয়াপীড় এসেছিলেন। সন্ধ্যা বেলায় তিনি ছদ্মবেশে নগরে প্রবেশ করেন এবং কার্তিকেয় মন্দিরে কমলা নামক দেবদাসীর নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন। এতে প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশেও সে সময় দেবদাসী নৃত্যের প্রচলন ছিল।

তবে বৈদেশিক আক্রমণের প্রভাবে ভারতবাসীর জীবন যখন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বিপর্যয় নেমে আসে তখনই এঁদের ভিতরে অনাচার প্রবেশ করে।  বিকল্প জীবিকা গ্রহণ  করতে বাধ্য হয়।

দেবদাসীরা কালের প্রবাহে তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় -দেবদাসী, রাজদাসী, স্বদাসী বা অলঙ্কার দাসী। দেবদাসীদের মন্দিরের বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল। বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বাইরের জনসাধারণ মন্দির প্রাঙ্গণে এসে এঁদের অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করতে পারত।

রাজদাসীরা রাজসভায় রাজাদের মনোরঞ্জনের জন্য নৃত্য পরিবেশন করতেন। সামাজিক জীবন যাপন ও বিবাহে এঁদের অধিকার ছিল।

স্বদাসীরা সামাজিক উৎসবে নৃত্য প্রদর্শন করতেন। এঁদের জন্য মন্দিরের বাইরে আলাদা ভাবে থাকার ব্যবস্থা ছিল।

একাদশ শতাব্দীতে মুসলমানরা সোমনাথ মন্দির অধিগ্রহণ করে বহু দেবদাসীকে  বন্দিনী ও ধর্মচ্যুত করে বিদেশে নিয়ে যায়। মুসলমান শাসকরা পরাজিত রাজাদের আশ্রিত দেবদাসীদের জোর করে সভানর্তকী বা রাজনর্তকীতে পরিণত করে।

কাকতীয় রাজ্যে গঙ্গাবংশীও রাজা প্রথম ভানুদেবের (১২৬২ – ১২৭৭) মৃত্যুর পর তাঁর নাবালকপুত্র রাজা হলে, রাজার অভিভাবক হয়ে আসেন বৈষ্ণব নরহরি তীর্থ। তিনি শ্রীকাকুলামে আসার সময় কয়েকজন দেবদাসীকেও সঙ্গে আনেন। তাঁরা জয়দেবের গীতগোবিন্দ নৃত্যের সহযোগে সঙ্গীত পরিবেশন করতে থাকেন। এই ভাবে দাক্ষিণাত্যে জয়দেবের গীতগোবিন্দের প্রচার ও প্রসার হয়। তখন থেকে দেবদাসীরা ভরতনাট্যমের সঙ্গে গীতগোবিন্দের শিক্ষা নিতে শুরু করেন।

চতুর্দশ শতকে বিজয়নগর রাজবংশের রাজা কৃষ্ণদেবের রাজত্বকালে পুনরায় সঙ্গীত ও নৃত্যচর্চা ব্যাপ্তি লাভ করে। তখনও দেবদাসীরা মন্দিরের মধ্যে নৃত্য পরিবেশন করতেন। জনসাধারণের সঙ্গে এই নৃত্যকলার কোনো যোগ ছিল না। কিছু নাট্টুবানরা মন্দিরের বাইরেও নৃত্য শিক্ষা দিতে শুরু করেন। এক শ্রেণীর ভক্তিবাদী নৃত্যনাট্য ও সঙ্গীত রচয়িতারা বিশেষ করে ব্রাহ্মণ ভাগবতাররা (যাঁরা ভাগবত গান করতেন তাঁদের ‘ভাগবতার’ বলা হত) ভক্তিমূলক নৃত্যনাট্য রচনা করে সমাজের শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির পাত্র হয়ে ওঠেন। 

এই নৃত্যকলার মধ্যে দেশী ও মার্গী সঙ্গীতের অপূর্ব সমাবেশ দেখা গেছে। সঙ্গীত ও নৃত্যে পবিত্রতা রক্ষা ও দেবদাসীদের শিল্পকলা রক্ষা করার বিষয়ে এঁরা তৎপর ছিলেন। এ সকল কারণে ভরতনাট্যমের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়। সেই কারণেই ভরতনাট্যমের মধ্যে কুচিপুড়ি, ভগবতমেলা, কুরুভাঞ্জির মত নৃত্যনাট্যকেও গণ্য করা হয়।

১৫৯২ খ্রিঃ মোঘলরা রামচন্দ্রদেবকে জগন্নাথ মন্দিরের শাসনকর্তা হিসাবে নিয়োগ করলে, মন্দিরের দেবদাসী ‘মাহারী’দের খুরদার সভানর্তকী করে, তারা ‘খুরদানির্যোগ’ বলে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে পুরীর রাজসভাতেও ‘মাহারী’দের সভানর্তকী করা হয়।

কিন্তু ভৌগলিক অবস্থানের সুবিধার কারণে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে কিছুটা অব্যাহতি পেয়েছিল বলে দক্ষিণ ভারতে ভরতনাট্যম নৃত্যচর্চা আরও কয়েক শতাব্দী প্রচলিত ছিল।

বার বার বিদেশিদের আক্রমণ ও শাসনের ফলে উত্তর ভারতের দেবদাসীদের নৃত্যচর্চা বাধাপ্রাপ্ত হলেও  মূল কারণ হল উত্তর ভারতে কথক নৃত্যের প্রচলন। মুসলমান শাসকদের রাজসভার কথক নৃত্যশিল্পীরা মূলত ছিল বিদেশ থেকে আসা কৃতদাসী। যার ফলে তাঁদের ভোগ-বিলাসের উপাদান হিসাবে ব্যবহার করত। যেহেতু কৃতদাসী ছিল তাই নৃত্যশিল্পীরা বাধ্য হত তাঁদের দরবারে থাকতে। তৎকালীন  অন্যান্য ছোট রাজা বা জমিদাররাও  একই উদ্দেশ্যে নৃত্য শিল্পীদের প্রাসাদে রাখতেন। এরপর দক্ষিণ ভারত ছাড়া ভারতের অন্যান্য রাজ্যে কথক নৃত্যের জনপ্রিয়তা বাড়লে ভরতনাট্যম নৃত্যচর্চা প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। তবু দক্ষিণ ভারতে দেবদাসী, রাজদাসী স্বদাসীরা নীরবে, নিভৃতে ভরতনাট্যম নৃত্যচর্চা করে গেছেন।

পরবর্তী কালে সমাজপতিদের চক্রান্তে এবং কিছু  নাট্টুবানদের অর্থ লালসায় দেবদাসীদের পবিত্র জীবন ক্রমশ ব্যাভিচার ও কলুষতায় পর্যবসিত হয়। পিতামাতার দারিদ্র ও ধর্মান্ধতার সুযোগ নিয়ে পুরোহিত ও নাট্টুবানদের চক্রান্তে দেবদাসী প্রথমে মন্দির, ও পরে গণিকালয়ে স্থান পেতে থাকে। সাত থেকে বারো বছরের বালিকাদের মন্দিরের বিগ্রহের সঙ্গে বিবাহ না দিয়ে, মন্দিরের প্রাঙ্গণে সকলের সামনে বর্ণনাতীত ঘৃণ্য প্রথায় ‘দেবদাসী’ (?) নামক নতুন জীবনে প্রবেশ করতে বাধ্য করা হয়। সমাজের কুচক্রীরা কিশোরীদের দেবদাসীর মোড়কে দেহপসারিনী হতে বাধ্য করে। সাধারণ জীবন যাপন ও বিবাহ তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ হয়। ধীরে ধীরে এই ব্যবসা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়। দেবদাসীর দেবার্ঘ্য নৃত্যশতদল কর্দমাক্ত হয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কালে ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চলে নৃত্যচর্চা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দক্ষিণ ভারতের দেবদাসীপ্রথার নামে দেহব্যবসাও চরমে ওঠে। ইংরেজ আমলে নৃত্যচর্চা পঙ্কিলময় আবর্তে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ইংরেজরা ‘দেবদাসী’দের ‘মন্দিরের গণিকা’, ‘নাচিয়ে মহিলা’ বলে অবহেলা করতে থাকে, যা দেশ ও জাতির পক্ষে চরম অবমাননাকর। শুধু দক্ষিণ ভারতের ভরতনাট্যম নয়, উত্তর ভারতের কথক নৃত্যশিল্পী দেরও সমাজ ঘৃণা ও অবহেলা করতে শুরু করে। অর্থাৎ ‘নৃত্য শিল্পী’র সঙ্গে ‘গণিকা’ শব্দটি জুড়ে যায়। সমাজ থেকে তাঁদের একমাত্র প্রাপ্তি হয় ঘৃণা।

হয়ত এঁদের কথা ভেবে কবি লিখেছেন,  

“ফুলের মত সুন্দরী এই

নর্তকীরা ভাগ্যহীনা-

নিঠুর হয়ে তোমরা ওগো

করো না কেউ এদের ঘৃণা।।”

শিল্পীর চোখে দেবদাসী

বিশিষ্ট সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল এই দেবদাসীদের জীবন কাহিনী নিয়ে দুটি উপন্যাস লেখেন- ‘সুতনুকা একটি দেবদাসীর নাম’ এবং ‘সুতনুকা কোনো দেবদাসীর নাম নয়।’

সাহিত্যে বা ইতিহাসে এঁদের উল্লেখ রইল কি না তাতে এঁদের কিবা যায় আসে! তাঁদের প্রয়োজন ছিল মুক্তির। সেটা ছিল না অতি সহজ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবীদের নেতৃত্বে দেবদাসীপ্রথা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ১৮৯২ খ্রিঃ গড়ে ওঠে ‘Anti-Dance Movement’। কিন্তু ততদিনে সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে এই প্রথা। এমন সামাজিক ব্যাধিকে নির্মূল করতে এগিয়ে এসেছিলেন একজন বিখ্যাত ডাক্তার। তিনি ভারতের প্রথম মহিলা বিধায়ক এবং বিশিষ্ট সমাজ সেবী ডঃ মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি। কয়েকজন সমাজসেবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আইনজীবী তাকে সাহায্য করেন। দেবদাসীদের চরম দুর্দশা দেখে এই প্রথা বন্ধ করার জন্য জনমত তৈরি করার চেষ্টা করেন। লোলুপ, স্বার্থান্বেষী, কুচক্রী দালালরা ধর্মের আশ্রয় নিয়ে এই প্রথা চালাতে সচেষ্ট হয়। ও পি রামস্বামী, ডঃ মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি প্রমুখের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নির্ভীক সাহসিকতার ফলে শেষ পর্যন্ত আইন পাশ করানো সম্ভব হয়। ডঃ মুথুলক্ষ্মী ১৯৩০ খ্রিঃ থেকে চেষ্টা করে ১৯৩৪ খ্রিঃ এ ‘বোম্বে দেবদাসী প্রথা রদ’ বিল পাশ করাতে সক্ষম হন। ভারত স্বাধীন হবার পরপরই আরও একটা আইন তৈরি হয়, তা হল ‘মাদ্রাজ দেবদাসী প্রথা রদ আইন (১৯৪৭)’। অন্ধ্রপ্রদেশ দেবদাসী প্রথা রদ আইন তৈরি হয় ১৯৫৬ খ্রিঃ এ। তবু অন্যান্য  রাজ্যে এই প্রথা বন্ধকরা সম্ভব হয় না, তাই পরপর দুটি বিল পাশ করান হয়। কর্নাটকী ও অন্ধ্রপ্রদেশ দেবদাসী প্রথা রদ আইন যথাক্রমে ১৯৮২ খ্রিঃ ও ১৯৮৮ খ্রিঃ চালু করে সারা ভারতে দেবদাসী প্রথা আইনত বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়। সংগ্রামটি ছিল বড় কঠিন ও দীর্ঘ। শেষ পর্যন্ত ভারতের সমস্ত রাজ্যে মেয়েদের জোর করে দেবদাসী করার প্রথা বন্ধ হয়। দেবদাসীদের বিবাহের অধিকার স্বীকৃত হয়। তবু এখনও অভিযোগ ওঠে আইনকে ফাঁকি দিয়ে দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে গোপনে দেবদাসী প্রথা চলছে বলে।

ভরতনাট্যমের নবরূপায়ন:

দেবদাসীর ভরতনাট্যম যখন কুচক্রীদের লালসায় কর্দমাক্ত তখন সেই কর্দমাক্ত শতদল তুলে নতুন করে আধুনিক ভারতের সরোবরে যাঁরা স্থাপন করলেন তাঁরা হলেন- গুরু মীনাক্ষী সুন্দরম পিল্লাই, শ্রী কৃষ্ণ আয়ার, বালা সরস্বতী, রুক্মিণী দেবী, যামিনী কৃষ্ণমূর্তি প্রমুখ।

সাদির আট্যম থেকে দাসী আট্টম হয়ে ভারতনাট্যম-এ পৌঁছানোর পথ ছিল বন্ধুর। প্রতিকূল পরিবেশকে উপেক্ষা করে কিছু দেবদাসী, নাট্টুবান বা শিক্ষক নিরলস ভরতনাট্যমের অধ্যবসায় করে গেছেন। এঁরাই প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত ভরতনাট্যমের নৃত্যধারাকে বয়ে নিয়ে এসেছেন।

দেবদাসীদের মুক্তির পথনির্দেশের পর ভরতনাট্যমকে তার প্রকৃত সম্মান ফিরিয়ে দেবার জন্য দেশের বিশিষ্ট নৃত্য শিল্পী, নৃত্য গুরু ও নৃত্যপ্রেমীরা কঠোর পরিশ্রম করে আধুনিক ভারতকে নব রূপে সজ্জিত ভরতনাট্যম উপহার দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে নৃত্য, নাটক, সঙ্গীত একাডেমী ও একাধিক কলা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে তাঁদেরই প্রচেষ্টায়। সাম্প্রতিক কালের বিশেষ উল্লেখযোগ্য গুরু হলেন মীনাক্ষী সুন্দরম পিল্লাই। তিনি একজন কুসংস্কারহীন, উদার মানসিকতার নৃত্যগুরু ছিলেন। তাঁর সুযোগ্য শিষ্য ও শিষ্যারা ভরতনাট্যম নৃত্যের গৌরবকে শতগুণে বর্ধিত করেছে। কান্ডাপ্পা পিল্লাই, করুথাপ্পা পিল্লাই প্রমুখ নৃত্যগুরুরা এই নৃত্যকলাকে পুনরুজ্জীবিত ও সমৃদ্ধ করার জন্য আত্মনিবেদন করেছেন।

এঁদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ আয়ারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শ্রীকৃষ্ণ আয়ার একজন আইনজীবী হয়েও অত্যন্ত নৃত্যানুরাগী ব্যক্তি ছিলেন। জনসাধারণের কাছে ভরতনাট্যমকে জনপ্রিয় করার জন্য নিজে স্ত্রীলোক সেজে নৃত্য পরিবেশন করতেন। বিংশশতাব্দীর প্রথম দিকে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির হিন্দু মন্দিরগুলিতে দেবদাসীপ্রথা এবং ভরতনাট্যম নৃত্য -চর্চা বন্ধ করা হলে সমস্ত দক্ষিণ ভারতে নৃত্য- বিরোধী জনমত সংগঠিত হয়। তখন শ্রীকৃষ্ণ আয়ার তার বিরোধিতা করেন এবং সংবাদপত্রের সহযোগিতায় ভরতনাট্যম নৃত্যকলার পুনরুজ্জীবন আন্দোলন শুরু করেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় শ্রীমতী বালা সরস্বতী বেনারসে ‘নিখিল ভারত সঙ্গীত মহা সম্মেলন’ এ ভরতনাট্যম নৃত্য প্রদর্শনের সুযোগ পান।

রুক্মিণী দেবী

ভরতনাট্যমকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য রুক্মিণী দেবীর অবদান অনস্বীকার্য। রুক্মিণী দেবী অরুণডেল শুধুমাত্র একজন ভরতনাট্যম নৃত্য শিল্পীই ছিলেন না, এই নৃত্যের উন্নতি ও জনসাধারণের কাছে নৃত্যকে জনপ্রিয় করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। তিনি শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক পরিবেশের আদলে নৃত্য শিক্ষা কেন্দ্র ‘কলাক্ষেত্র’ প্রতিষ্ঠা করেন। তামিলনাড়ুর গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রাচীন নাট্টুবান ও দেবদাসীদের খুঁজে বের করে তাঁদের কাছ থেকে নৃত্য শৈলী সংগ্রহ করে পুনরুদ্ধার করেন। তিনি নিজে একাধিক গুরুর কাছে নৃত্য শিক্ষা নেন। ভরতনাট্যম কে জনপ্রিয় করার জন্য অলঙ্কার ও পোশাক নিয়ে গবেষণা করেন। শ্রীমতী রুক্মিণী দেবীর নাম ভারতের নৃত্যকলার গবেষণা ও প্রসারের ইতিহাসে সর্বকালে বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তিনি কেবলমাত্র একজন কুশলী শিল্পী হওয়ার প্রয়াসেই আবদ্ধ থাকেননি। তৎকালীন সমাজের রক্ষণশীলতা ও বিধিনিষেধ তুচ্ছ করে নৃত্যকলাকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আত্মনিয়োগ করেন। আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংস্কারমুক্ত বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়াসে নৃত্যকলার চর্চা তিনিই প্রবর্তন করেন। তিনি ১৯৭২ খ্রিঃ বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি লাভ করেন। ১৯৮৪ খ্রিঃএ মধ্যপ্রদেশ সরকারের কাছ থেকে ‘কালিদাস’ সম্মান লাভ করেন।

বালা সরস্বতী ছিলেন আর একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বালা সরস্বতী নিজে দেবদাসী বংশোদ্ভূত ছিলেন। তাঁর প্রমাতামহী তাঞ্জোরের রাজসভার রাজদাসী ছিলেন। মাতা বীণা বাদিকা ছিলেন। দেবদাসী নৃত্যের সঠিক ধারাটি তিনিই বহন করে এনেছিলেন। শ্রীমতী বালা সরস্বতীর অভিনয় সমৃদ্ধ ‘পদম্’ এই নৃত্য ধারার নবযুগের সূচনা করেন। তিনি ভরতনাট্যম নৃত্যের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী। তিনি মাদ্রাজের ‘স্কুল অফ ডান্স’ এবং ‘মিউজিক একাডেমী’র ডিরেক্টর এর দায়িত্ব সামলান। ১৯৫৫ খ্রিঃ ‘সঙ্গীত নাটক একাডেমী’ পুরস্কার পান। 1957খ্রিঃ পদ্মভূষণ পুরস্কার পান। তাঁর জীবনী নিয়ে সত্যজিৎ রায় একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন।

মীনাক্ষী সুন্দরম পিল্লাই এর ছাত্রীদের মধ্যে শ্রীমতী শান্তারাও এর নাম নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। মোহিনীঅট্যম নৃত্যের পুনরুজ্জীবনে তাঁর গৌরবময় ভূমিকা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণীয়। বর্তমান কালের শিল্পীদের মধ্যে ইন্দ্রাণী রহমান, যামিনী কৃষ্ণ মূর্তি, কুমারী কমলা, ও চন্দ্রকলা প্রমুখের নামও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

নবরূপায়িত ভরতনাট্যম:

নাট্যশাস্ত্র থেকে জানা যায় ভরতনাট্যম নৃত্যকলা নৃত্ত, নৃত্য ও নাট্য -এই তিনের সমন্বয়ে গঠিত। ‘নৃত্য’ শব্দটির মূল ধাতু হল ‘নৃতি’, যার অর্থ গাত্র সঞ্চালন করা। সুদৃশ্য, ছন্দময়, সুনিয়ন্ত্রিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ গাত্র সঞ্চালন হল নৃত্য। নৃত্য মানুষের অন্তরের আকুতির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন ছাড়াও এতে অভিনয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। নৃত্য ভাবাশ্রয়ী। পদম, শ্লোকম, শব্দম্, জাভেরি হল নৃত্য পর্যায়ভুক্ত।

‘নৃত্ত’ হল তাল, লয় সমন্বিত ভাব বর্জিত অঙ্গ বিক্ষেপ। ধনঞ্জয়ের মতে অভিনয় বর্জিত, তালাশ্রিত, লয়াশ্রিত অঙ্গ বিক্ষেপ হল নৃত্ত। নৃত্ত তাল, লয়াশ্রয়ী। আল্লারিপু, যতিস্বরম, ও তিল্লানা হল নৃত্ত পর্যায় ভুক্ত। 

‘নাট্য’ গীত ও সংলাপের সঙ্গে নৃত্ত ও নৃত্য যুক্ত হয়ে হয় নাট্য। অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিক্ষেপহীন যে অভিনয় তাই নাটক। নাট্য রসাশ্রয়ী। বর্ণম্ হল এই নাট্যপর্যায় ভুক্ত।

ভরতনাট্যম নৃত্যের পোশাক বেশ আকর্ষণীয় হয়। এ নিয়ে নাট্যশাস্ত্রে বিশেষ কোনো নির্দেশ নেই। বর্তমানে ভরতনাট্যম নৃত্য পরিবেশন করার সময় কোঁচা যুক্ত শাড়ি সেলাই করে সামনে আঁচল দিয়ে বিশেষ ভাবে বানানো পোশাক পরা হয়। একটি আলাদা ছোট জীর বসানো বস্ত্র কোমরের পিছন থেকে বাঁধা হয়। এই নতুন ধরনের পোশাক রুক্মিণীদেবী অরুণডেল প্রবর্তন করেন।

প্রাচীন কালে কী পোশাক পরা হত তার কোনো নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। মন্দিরের গায়ে, বা পাথরের গায়ে যেসমস্ত নৃত্যরতা দেবদাসীর মূর্তি দেখা যায় তাতে পোশাক আছে অতি স্বল্প। সেই পোশাক মন্দিরে ও সমাজে কতটা গ্রহণযোগ্য ছিল তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে কিছুদিন আগেও নয় গজের শাড়ি পরার প্রচলন ছিল। স্বয়ং রুক্মিণী দেবী অরুণডেল প্রথমদিকে  নয় গজের শাড়ি পরে নৃত্য পরিবেশন করেছেন। তারও আগে উজ্জ্বল বর্ণের শাড়ির সঙ্গে জরির কাজ করা ব্লাউজ পরা হত। তখন এই উজ্জ্বল সোনালী রঙের শাড়ি শিল্পীকে তাঁর যোগ্যতার দ্বারা অর্জন করতে হত। সোনার কাজ করা শাড়িতে থাকত উজ্জ্বল রঙের পাড়। তবে বর্তমানে এর প্রচলন অনেকখানি কমে গেছে। এখন উজ্জ্বল রঙের পোশাকই ব্যবহার করা হয়।

একজন ভরতনাট্যম শিল্পী কমপক্ষে ১০ রকম গয়না ব্যবহার করেন। ঝুমকো সহ কানপাশা, হার, বাজুবন্ধ, চূড়, রত্নহার, চন্দ্রকলা, কোমরবন্ধ, নতুন, আংটি, প্রভৃতি। মাথায় ব্যবহার করা হয় ৩ ধরনের অলঙ্কার। চুট্টি নামক লকেট যুক্ত সিঁথি, ব্রোচ জাতীয় অলঙ্কার ‘চন্দ্র’ ও ‘সূর্য’ ব্যবহার করা হয়। লম্বা বেণী, সাদা ও কমলা ফুল দিয়ে সাজানো হয়। মাথার পিছনে ‘রাকুডি’ থাকে। বেণীর শেষ দিকে থাকে তিন প্রস্থের ঝুমকো। প্রত্যেক পায়ে ব্যবহৃত হয় বেগুনি রঙের দড়িতে ৫০ টি ঘুঙুর, যা তালের সঙ্গে ঝঙ্কার তোলে। প্রাচীনকালে দেবদাসীদের অলঙ্কারে রঙ বেরঙের দামি পাথর ব্যবহার করা হত। মন্দিরের প্রদীপের আলোয় তা উজ্জ্বল হয়ে মোহনীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করত।

শিল্পীর মুখ অত্যন্ত উজ্জ্বল রঙে রাঙান  থাকে। সূক্ষ্ম ভাবে কাজল পড়া হয়, ঘন কালো চোখ আঁকা হয়। উজ্জ্বলরঙের ওষ্ঠোরঞ্জনী লাগান  হয় ও কপালে বড় লাল সিঁদুরের টিপ পরা হয়।

ভরতনাট্যম নৃত্যকলার অন্যতম প্রধান অঙ্গ সঙ্গীত। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একজন সুকণ্ঠী শিল্পীর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আবহ সঙ্গীতে বীণা, তম্বুরা, বাঁশি, নফরি, সারঙ্গী, বুদবুদিকা, মৃদঙ্গম, করতাল, বেহালা, সুর শৃঙ্গার, নাগেশ্বরম ও মন্দিরা ব্যবহার করা হয়।

প্রাচীন কালে কর্নাটকী সঙ্গীতে ও ভরতনাট্যমে মোট ১০৮টি তাল ছিল বলে জানা যায়। একে ‘অষ্টোত্তরশত তালম’ বলা হত। পরে বেশির ভাগ অবলুপ্ত হয়ে ৫৬টি তাল অবশিষ্ট থাকে। একে ‘অপূর্ব তালিম’ বলা হত। অবশেষে অন্যান্য তাল অবলুপ্ত হয়ে বর্তমানে৭টি তাল অবশিষ্ট রয়েছে। একে ‘সপ্ততালম’ বলে। সাধারনভাবে ভরতনাট্যম নৃত্যে ধ্রুবম (ধ্রুব), মতম (মাট্টি), রূপকম (রূপক), ঝম্পক (ঝম্প), ত্রিপুট (ত্রিপজ), অঠ (আড়া), ও একম (একতাল) – এই সাতটি তালের ব্যবহার হয়।

পাঁচটি জাতির দ্বারা এই সাতটি তাল ব্যবহৃত হয়। পাঁচটি জাতির নাম সাধুশ্রম বা চতুশ্রম (চার মাত্রা), তিশ্রম (তিন মাত্রা), মিশ্রম (সাত মাত্রা), খণ্ডম্ (পাঁচ মাত্রা) ও সঙ্গিরণম বা সংকীর্ণম (নয় মাত্রা)। তালগুলি বিভিন্ন মাত্রা ও যতি সহযোগে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে।

ভরতনাট্যমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সৌন্দর্য সৃষ্টিকারী বিষয় হল এর মুদ্রা। মুদ্রা হল- ‘মুদম্ আনন্দং রাতি দদাতি’ অর্থাৎ যা আনন্দ দান করে তাই মুদ্রা। নৃত্যে আঙ্গিকাভিনয়ের জন্য বিভিন্ন হস্তমুদ্রা, ভাব ও রস পরিবেশিত হয়। এখানে শিল্পীর হাতের মুদ্রায় স্বর্গের ফুল ফোটে, দেহভঙ্গিমার বিচিত্রতায় যেন সাগরের ঢেউ ওঠে। গলার ভঙ্গিতে গর্ব ও নিবেদন বিচিত্র রঙ্গে মূর্ত হয়, চোখের ভঙ্গিতে (উন্মোচন ও পাতনে) ফুটে ওঠে প্রেম, প্রতীক্ষা, সংশয়, শোক, ক্রোধ ।

নাট্যশাস্ত্র এবং অভিনয় দর্পণ অনুসারে অসংযুক্ত ও সংযুক্ত এই দুই রকম মুদ্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে নাট্যশাস্ত্র এবং অভিনয় দর্পণের মুদ্রার সংখ্যা ও প্রয়োগে কিছু পার্থক্য আছে।

নাট্যশাস্ত্রের মতে – ২৮ টি অসংযুক্তমুদ্রা। এগুলি হল- পতাকা, কপিত্থ, চতুর, ত্রিপতাক, কটকামুখ, ভ্রমর, অর্ধ পতাকা, ময়ূর, মুষ্টি কর্তরীমুখ, সূচী, হংসাস্য,অর্ধচন্দ্র, পদ্মকোশ, হংসপক্ষ, অরাল,  সর্পশীর্ষ, সন্দংশ, শুকতুণ্ড, মৃগশীর্ষ, মুকুল, মুষ্টি, কাঙ্গুল, উর্ণনাভ, শিখর, অলপদ্ম, তাম্রচূড়।

সংযুক্ত মুদ্রা হল ২৩টি। এগুলি হল- অঞ্জলি, কপোট, কর্কট, স্বস্তিক, ডোলহস্ত, পুষ্পপুট, উৎসঙ্গ, শিবলিঙ্গ, কটকাবর্ধণ, কর্ত্তরীস্বস্তিক, শক্তি, শঙ্খচূড়, সম্পূট, পাশ, কীলক, মৎস, কুর্ম্ম, বরাহ, গরুর, নাগবন্ধ, ভেরুন্ডা, খট্টা।

ভরতনাট্যমের রস বিশেষ উল্লেখযোগ্য। নৃত্য পরিবেশন করে রসসৃষ্টি করাই শিল্পীর মূল উদ্দেশ্য। এই রস সম্পর্কে নাট্যশাস্ত্র বলা আছে-

“আস্যেনালম্বয়েদ গীতং হস্তেনাথং প্রদর্শয়েৎ ।

চক্ষুভাং দর্শয়েদ্ভাবং পাদাভ্যাঅং তালমাদিসেৎ।।

যতো হস্তস্ততো দৃষ্টিষতো দৃষ্টিষতো মনঃ।

যতো মনস্ততো ভাব যতো ভাবস্ততো রসঃ।।”

 অর্থাৎ, মুখ দিয়ে গানকে অবলম্বন করে, হাত দিয়ে গানের অর্থ প্রদর্শন করে, চক্ষু দিয়ে ভাব প্রদর্শন করে, পদদ্বয়ে তাল রক্ষা করা উচিত। যেখানে হাত সেখানে দৃষ্টি থাকবে, যেখানে দৃষ্টি সেখানেই মনের গতি থাকবে, যেখানে মনের গতি সেখানেই ভাব থাকবে, আর তখনই রসের উৎপত্তি হবে। রসোৎপত্তি হলে নৃত্য আস্বাদন যোগ্য হবে। ভরতনাট্যম নৃত্যে রসের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। নাট্যশাস্ত্রে চার প্রকার রসের উল্লেখ রয়েছে। অদ্ভুত রস, শান্তরস, শৃঙ্গার রস ও ভয়ানক রস। তবে এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ রস হল শৃঙ্গার রস। শৃঙ্গার রসকে ভরতনাট্যমের মূল রসও বলা হয়ে থাকে। এই নৃত্যের মধ্যে তাণ্ডব এবং লাস্য দুই ধরনের শৃঙ্গার রস নিহিত আছে। নাট্যশাস্ত্র অনুযায়ী তাণ্ডব নৃত্যে স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েরই অধিকার আছে। শৃঙ্গার রস থেকে উদ্ভূত বলে তাণ্ডবের প্রয়োগেও সৌকুমার্য ও লীলায়িত গতি আছে এবং এতে স্ত্রী – পুরুষের সমান অধিকার আছে। তবে পরবর্তী কালে রক্ষণশীল নাট্টুবানরা ভেদাভেদ সৃষ্টি করে দেন। তাণ্ডবকে পুরুষের এবং লাস্যকে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেন। ‘নটনাদী বাদ্যরঞ্জনম’- গ্রন্থে আমরা মোট দ্বাদশ তাণ্ডবের উল্লেখ পাই-

১। আনন্দ তাণ্ডবম (সন্ময় যতিনাট্যম)

২। সান্ধ্য তাণ্ডবম (গীত নাট্যম)

৩। ঊর্ধ্ব তাণ্ডবম (চিত্র নাট্যম)

৪। শৃঙ্গার তাণ্ডবম (ভরত নাট্যম)

৫। ত্রিপুরা তাণ্ডবম (পেরানি নাট্যম)

৬। মুনি তাণ্ডবম (লাস্য বা লয় নাট্যম)

৭। সংহার তাণ্ডবম (সিমহলা নাট্যম)

৮। উগ্র তাণ্ডবম (রাজ নাট্যম)

৯। ভূত তাণ্ডবম (পট্টসা নাট্যম)

১০। প্রলয় তাণ্ডবম (পাবই নাট্যম)

১১। ভুজঙ্গ তাণ্ডবম (পিথা তাণ্ডবম)

১২। শুদ্ধ তাণ্ডবম (পদশ্রী নাট্যম)

করন ও অঙ্গহার হল ভরতনাট্যম  নৃত্যের সৌন্দর্যের মূল উৎস। নাট্যশাস্ত্রের তাণ্ডবলক্ষণ অধ্যায়ে একশত আটটি করনের (আডাও) উল্লেখ আছে। হাত এবং পা এর পারস্পরিক সহযোগিতায় করণের রুপকে প্রকাশ করতে হয়। আবার কয়েকটি করন একত্রে মিলিত হয়ে অঙ্গহার সৃষ্টি করে। দক্ষিণ ভারতের চিদাম্বরমের নটরাজ মন্দিরে খোদিত ভরতনাট্যম নৃত্যে প্রযুক্ত একশো আটটি করণের প্রমাণ পাওয়া যায়।  

নাট্টুবান চিন্নাইয়া, পুন্নাইয়া, শিবানন্দ, ও ওয়াডিভেল্লু এই চার ভাই মিলে ভরতনাট্যমের যে পরিবর্তন এনেছেন তাতে এর অনুক্রমণিকা হল যথাক্রমে- মেলা প্রাপ্তি, আলারিপু, যতিস্বরম, শব্দম, বর্ণম, তিল্লানা, শ্লোকম। বর্তমানে এতে প্রাচীনকালের কিছু অনুক্রমণিকা যোগ করা হয় যেমন-কৌস্তুভ, তোডয়ম, মঙ্গলময়, কীর্তনম ইত্যাদি। তবে সাদির আট্যম বা ভরতনাট্যম নৃত্যধারার অনুক্রমণিকা বা পর্যায় মূলত সাতটি, যথাক্রমে- আল্লারিপু, যতিস্বরম, শব্দম, বর্ণম, পদম্, শ্লোকম্ ও তিল্লানা।

এটি ভরতনাট্যম নৃত্যকলার প্রথম নৃত্য পর্যায় হল আল্লারিপু। তেলেগু শব্দ ‘আল্লারিম্পু’ থেকে এই আল্লারিপু শব্দটি এসেছে। এর অর্থ হল পুষ্পিত বা প্রস্ফুটিত হওয়া। এই পর্যায়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বিশুদ্ধ নৃত্যের জন্য দেহভঙ্গির সুষম সৌন্দর্যে পুষ্পিত ও প্রস্ফুটিত করা হয়। শিল্পী মাথার ওপর দুটি হাত নমস্কারের ভঙ্গীতে রেখে বোলের সঙ্গে চোখ ও গলার ভঙ্গিমার দ্বারা নৃত্য শুরু করেন। এটি বন্দনা সূচক পর্যায়। নাচের মাধ্যমে শিল্পী দেবতা, দর্শক, সঙ্গীত শিল্পী সকলের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।

আল্লারিপুর পরবর্তী পর্যায় হল যতিস্বরম। যতির সঙ্গে স্বরগমের গ্রন্থন হয় বলে এর নাম যতিস্বরম। এই পর্যায়ে নৃত্যের সৌন্দর্য বর্ধনকারী নৃত্য প্রধান অংশ। দেহভঙ্গির সঙ্গীতে সুষম সৌন্দর্য সৃষ্টি করাই এই পর্যায়ে প্রধান লক্ষ্য। এই নৃত্য সংগঠনে সাধারণভাবে পাঁচ থেকে সাতটি জটিল যতি রাগাশ্রয়ী সরগম ও তালের মিলিত রূপ মৃদঙ্গ ও মন্দিরার সাহায্যে পরিবেশিত হয়। এই পর্যায়ে চোখের , গলার , হাতের ও পায়ের কাজ প্রধান এবং কোন বিশেষ ভাব প্রকাশ করতে হয়না। মৃদঙ্গ মন্দিরার সাহায্যে এই নৃত্য পরিবেশিত হয়।

যতিস্বরমের পরের পর্যায় হল শব্দম। এই পর্যায়ের মূল লক্ষ্য হল ভক্তিমূলক সঙ্গীতকে অভিনয়ের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা। ভক্তিমূলক সঙ্গীতগুলি মূলত তেলেগু ভাষার হয়ে থাকে। সঙ্গীতের মাধ্যমে দেবতা অথবা রাজার শৌর্য, বীর্য, কীর্তি বা মহত্ত্ব বর্ণনা করা হয় এবং সঙ্গীতের শেষে অভিবন্দনা করে নৃত্য সমাপ্ত করা হয়। সংস্কৃতে এই ধরনের সঙ্গীতকে ‘যশোগীতি’ বলা হয়।

শব্দমের পরের পর্যায় হয় বর্ণম। বর্ণম ভরতনাট্যমের সর্বাপেক্ষা জটিল ও আকর্ষণীয় পর্যায়। এতে নাচ এবং নাটকের এক আশ্চর্য মেলবন্ধন দেখা যায়। ভাব, রাগ ও তালযুক্ত এই অনুষ্ঠান প্রায় একঘণ্টা ব্যাপী হয়ে থাকে। আবহসঙ্গীত প্রণয়ের অভিব্যক্তিতে রচিত হয়। যতিগুলি অত্যন্ত জটিল ও দ্রুত হয়ে থাকে, একে ‘থিরমনম’ বলে। এর চরণমগুলি অত্যন্ত সুন্দর হয়ে থাকে। সঙ্গীতের মধ্যে কল্যাণী, নবরত্নমালিকা প্রভৃতি অপ্রচলিত রাগের প্রয়োগ দেখা যায়। এই সঙ্গীত ভাবোচ্ছল ও ভক্তিমূলক। নৃত্ত,নৃত্য ও নাট্যের মেল বন্ধন হয় এই পর্যায়ে।

বর্ণমের পরবর্তী পর্যায় হল পদম। বর্ণম পর্যায়ের পর শিল্পীর বিশ্রামের জন্য এই পর্যায়ে প্রেমগীতিমূলক পদ অভিনয়ের মাধ্যমে পরিবেশিত হয়। তাতে আগের পর্যায়ের পরিশ্রম কিছুটা লঘু হয়। সঙ্গীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় কবি জয়দেব, পুরন্দর দাস, ক্ষেত্রায়া রচিত মধুর পদাবলী পরিবেশিত হয়।

এই পর্যায় তালহীন। একক রাগ বা রাগমালিকাতে নৃত্যাভিনয়ের মাধ্যমে পরিবেশিত হয়। সাধারণত শ্লোকম সংস্কৃত ভাষাতে হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরণের শ্লোক এই পর্যায়ে অভিনয় করে পরিবেশন করা হয়।

অনুষ্ঠানের সবশেষ পর্যায় হল তিল্লানা। ভরতনাট্যম নৃত্যধারার ছন্দ, লাস্য, মাধুর্য ও গভীরতার সমন্বয়ে সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ এই পর্যায়ে ছন্দিত হয়। এই নৃত্যে প্রত্যেকটি যতি বিলম্বিত, মধ্য ও দ্রুত লয়ে পরিবেশিত হয়। এই পর্যায়ে শিল্পী মাঝে মাঝে ক্ষিপ্রচটুল পদ বিন্যাসে ও বিভিন্ন মুদ্রা প্রয়োগে বিভিন্ন ভাবব্যঞ্জনা মূর্ত করেন।

‘জানো মম মন তোমারে চাই’:

পার্বত্য ঝর্না যেমন দুর্গম পথ অতিক্রম করে পাহাড়, মালভূমি, সমতলের সমস্ত আবর্জনা বহন করে সাগরে মিশেছে, তেমনি ভরতনাট্যম কালের স্রোতে সমাজের সকল লোভ, লালসা, কলঙ্ক, অপমান বুকে নিয়ে আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে নতুন আঙ্গিকে মিশেছে। কঠিনপথ অতিক্রম করে আজও ভরতনাট্যম স্ব -মহিমায় জগতের শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্প হিসাবে প্রবহমান।ভারতের শ্রেষ্ঠনৃত্যকলা এই ভরতনাট্যমের মধ্যে মহৎ শিল্পের সবকটি গুণই নিহিত আছে। কাব্য, সঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয়ের মিশ্রণে তৈরি হয় চতুরঙ্গ। শিল্পী মানসের প্রকাশ-উন্মুক্ত রূপ ভাবনা, ললিত ছন্দে ও ভাবাভিনয়ের উৎকর্ষে দর্শকমন হয়ে ওঠে সহৃদয়। কাব্য, সঙ্গীত, নৃত্যে ও ছন্দের বিশিষ্ট বিভঙ্গে লীলায়িত একটি অনন্য রূপ- ভাবনা দর্শককে রসমার্গে উন্নীত করে।

ভরতনাট্যম নৃত্যের ব্যাকরণ অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত হওয়ার ফলে, এই নৃত্যচর্চা শারীরিক সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু দান করে থাকে। শুধু তাই নয় এই নৃত্যের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার যোগ থাকায় নৃত্যচর্চার ফলে শরীর, মনের সুস্থতার সঙ্গে আত্মারও পরিশুদ্ধি ঘটে। নটরাজ বন্দনা দিয়ে নৃত্য চর্চা শুরু হলেও এই নৃত্য কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই নৃত্যচর্চার ক্ষেত্রে কোনো ধর্মীয় বিধি নিষেধও নেই, এক্ষেত্রে থাকতে হবে পরমেশ্বরের প্রতি পরম শ্রদ্ধা, নৃত্যশিক্ষার প্রতি একাগ্রতা ও নিষ্ঠা। বিশেষ করে কৈশোরের শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতাকে কাটিয়ে স্থিরতা আনতে, সুশৃঙ্খল অভ্যাস গড়ে তুলতে এই নৃত্যাভ্যাসের জুড়ি মেলা ভার। কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রবাদক, নৃত্যগুরু এবং নৃত্যশিল্পীর সমবেত প্রচেষ্টায় সমগ্র নৃত্যানুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এর ফলে একই সঙ্গে নৃত্যগুরু ও সহশিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদনের আন্তরিকতারও অভ্যাস গড়ে ওঠে। শিশু-কিশোরের বৌদ্ধিক, শারীরিক, মানসিক ও প্রাক্ষোভিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিদ্যাচর্চা, শরীরচর্চার যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভরতনাট্যম নৃত্যচর্চার গুরুত্ব তার কিছু কম নয়। বর্তমানে নৃত্যশিক্ষাকেন্দ্রে যে পাঠক্রম রয়েছে তাতে নৃতচর্চার পাশাপাশি নৃত্যের সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেবার জন্য এর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, ঐতিহাসিক গুরুত্ব, সামাজিক প্রভাব এ সবেরই পাঠদান করা হয়। এর ফলে প্রথম থেকেই নৃত্যচর্চার পাশাপাশি দেশ ও সমাজকে জানতে পারে। ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়। এ শিক্ষা দেশপ্রেমকে জাগ্রত করায়, সামাজিক দায়বদ্ধতা স্মরণ করায়, সুস্থ সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করায়। ভবিষ্যতের সুনাগরিক গড়ে তুলতেও যথেষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে এই নৃত্য চর্চা।

বিশ্ব জুড়ে রয়েছে ভরতনাট্যমের জনপ্রিয়তার প্রবল ঢেউ, স্থাপিত হয়েছে অসংখ্য শিক্ষাকেন্দ্র। ভারতীয় শিল্পীরা আজ বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানিত। ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রীয় নৃত্য ভরতনাট্যম প্রদর্শন করার পর উচ্চ রসমার্গে উন্নীত হয়ে যখন সারাবিশ্ব মোহিতনেত্র উন্মোচন করে তখন কবির ভাষা অন্তরে জেগে ওঠে-

“ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায়,

তবু জানো মন তোমারে চাই।

——–

সব সুখে দুখে ভুলে থাকায়

জানো মম মন তোমারে চাই।।”

তথ্যসূত্রঃ

1) Concise History of South India-Noburu kawashima…oxford University press.

2) সাংস্কৃতিকী – ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়

3) A short History of the Muslim rule in India.lswsriprosad.

4) নৃত্যে-ভারত – ডঃ মঞ্জুলিকা রায় চৌধুরী

5) নৃত্য-বিতান – অনুপ শঙ্কর অধিকারী।

6) প্রশ্নোত্তরে ভরতনাট্যম – আদিত্য মিত্র।

7) প্রশনোত্তোরী ভরতনাট্যম – নিখিল পাল।

8) ভারতের সংস্কৃতি – শ্রী ক্ষিতিশচন্দ্র মোহন সেন।

9) পৃথিবীর ইতিহাস – দুর্গাদাস লাহিড়ী।

10) ডঃ মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি – উইকিপিডিয়া

11) Dance of Siva – A. K. Kumarswami.

12) Natyasasta-translatade – Monomohon Ghosh.

মন্তব্য তালিকা - “ভরতনাট্যম”

  1. অত্যন্ত সুন্দর এবং তথ্যসমৃদ্ধ রচনা। ভারতের সংস্কৃতি অর্থাৎ বিভিন্ন শাস্ত্রীয় নৃত্য ও গীত বিষয়ে আমার উৎসাহ জেগেছিল শ্রী নারায়ণ সান্যাল রচিত একটি লেখা “দুর্লভ দুর্লভ ” (মার্দঙ্গিক শ্রী দুর্লভচন্দ্রের জীবনী) পড়েই। ভারতনাট্যম ও দেবদাসী প্রথার সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়েও কিছু  পড়াশোনা করেছিলাম। এই লেখাটি সেই পড়া এবং তথ্যের মধ্যে যে অসম্পূর্ণতা ছিল তা পূরণ করে আরো অনেক কিছু  নতুন তথ্য ও তত্ত্বের আলোকে উদ্ভাসিত করলো আমায়। লেখিকাকে ধন্যবাদ এমন একটি লেখা উপহার দেবার জন্য।

  2. খুব ভালো,
    বিভিন্ন মুদ্রা গুলো নিয়ে পদ, হস্ত, নেত্র ও অন্যান্য বিভাগ করে অন্য একটি রচনা সংযুক্ত করুন।

  3. অসাধারণ বৈদগ্ধ পূর্ণ লেখা ‘ ভারতনাট্যম।’ ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় নৃত্য নিয়ে লেখিকা লিপিকা ঘোষের অগাধ জ্ঞান ও পড়াশোনা যা লেখাটির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। লেখাটি অন্যত্রও দিলাম। আজ পবিত্র অক্ষয় তৃতীয়া দিবসে লেখিকার প্রতি শ্রদ্ধা,শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানাই। আজ এই পুত পবিত্র অক্ষয় তৃতীয়া দিবসে।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।