
অক্ষয়কুমার দত্তের উত্তরণের ইতিহাস
পূর্বকথা
অক্ষয়কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে একই বছরে জন্ম গ্রহণ করেছেন, তিনি ছিলেন এক একজন কৃতী মানুষ, তবে বাঙালি তাঁকে নিয়ে সেভাবে চর্চা করেনি। কারণটা অবশ্য বোঝা যায়। সারা পৃথিবীতে ভাববাদী দর্শনের পক্ষে কথা বলার মানুষ অনেক বেশি, যুক্তিবাদী বা বস্তুবাদী দর্শনের পক্ষে যাঁরা কথা বলেন তাঁরা সংখ্যালঘু। অক্ষয়কুমার এই সংখ্যালঘুদেরই একজন।
লোকায়ত দর্শনের ক্ষেত্রে যাঁর নাম ভারতবর্ষে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে, সেই দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমারের গুরুত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন—
‘অক্ষয় কুমার দত্ত ছিলেন বিজ্ঞান-পাগল মানুষ; আধুনিক বিজ্ঞান সম্বন্ধে একরোখা উৎসাহের মাশুল হিসাবে তাঁকে কার্যত একঘরে হতে হয়েছিল, হারাতে হয়েছিল চাকরি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে যাতে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে বেমানান বলে তাচ্ছিল্য করা না হয়, তার জন্য অক্ষয় কুমার তাঁর জীবনসায়াহ্নে ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার মূল খুঁজতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু অসুস্থতা ও অকাল প্রয়াণের ফলে সে অনুসন্ধান অসমাপ্ত থেকে যায়।’
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান ইতিহাসবিদ, অনুবাদ: আশীষ লাহিড়ী
অক্ষয়কুমারের জীবনে চলার পথে অনেক বাঁক আছে—আসলে কোনো মানুষই একদিনেই চর্চার যোগ্য হয়ে ওঠেন না। তাঁর জীবনের চলার পথও একেবারেই মসৃণ ছিল না। প্রথম জীবনে দারিদ্র্য, সংসারের ভার নেওয়ার কারণে প্রথাগত পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। অবশ্য তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন; পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেন। সেই কারণেই সম্ভব হয় দীর্ঘ ১২ বছর ধরে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করা। পরে অবশ্য দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে মতদ্বৈততা ও অসুস্থতাজনিত কারণে সম্পাদনার কাজ থেকে অব্যহতি নেন এবং অসুস্থ অবস্থায় নিজের উপলব্ধির জগতে মনের খোরাক খোঁজার ঐকান্তিক চেষ্টা করেন যার ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ের দুটি খণ্ড আমরা পাই ।
১
অক্ষয়কুমার জন্মেছিলেন অল্পশিক্ষিত কায়স্থ পরিবারে। অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগের পর অভিভাবকদের উদাসীনতায় অক্ষয়কুমারের জীবনের অনেকগুলি বছর নষ্ট হয়েছিল। ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে মাত্র আড়াই বছর পড়তে পেরেছিলেন। উনিশ বছর বয়সেই স্কুল ছেড়ে তাঁকে জীবিকার চেষ্টায় উদ্যোগী হতে হয়। তবে স্কুল ছাড়লেও লেখাপড়া ছাড়েননি অক্ষয়কুমার, বরং প্রবলতর উদ্যমে নিজস্ব সিলেবাসে সুশৃঙ্খলভাবে পড়তে লাগলেন নানা বিষয়ের, বিশেষত বিজ্ঞান বিষয়ক বই। চর্চা করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান আর ভূগোল, অধ্যয়ন করেছেন গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু, জার্মান ভাষা—সমস্তই নিজ উদ্যোগে। নিজেকে ক্রমাগত শিক্ষিত করে তোলার নিয়মিত প্রচেষ্টা কোনোদিনই বন্ধ হয়ে যায়নি।
১৮৩৯ থেকে ১৮৪১ বছর গুলি অক্ষয়কুমারের জীবনের প্রথম মোড়। এই সময়ে তাঁর পিতার অকালমৃত্যু। মায়ের অনুরোধে ওরিয়েন্টাল সেমিনারির প্রথাগত পড়া ছেড়ে দিয়ে তিনি ছাত্রদের অঙ্ক ও ইংরেজি শিখিয়ে স্বাধীন জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করতে থাকেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির লাইব্রেরিতে আনন্দকৃষ্ণ বসু, শ্রীনাথ ঘোষ ও অমৃতলাল মিত্রের সহায়তায় অক্ষয়কুমার ত্রিকোণমিতি, কনিক সেকশন ও ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেন; চর্চা করেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা ও প্রাকৃতিক ভুগোলের মতো বিষয়। সংস্কৃত চর্চাও করেছেন এই পরিসরে। এই সময়ের আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা—কবি ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের যোগাযোগ। প্রাথমিক ভাবে ঈশ্বর গুপ্ত অক্ষয়কুমারকে আইন ব্যবসায় যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ওকালতি, দারোগাগিরি, দালালি প্রভৃতি পেশায় যোগ দেওয়ার ইচ্ছা তাঁর ছিল না, সারাজীবন তিনি সারস্বত চর্চায় নিজেকে যুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। ঈশ্বর গুপ্তের মাধ্যমে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং তত্ত্ববোধিনী সভায় তিনি যোগদান করেন। ১৮৪০ এর জুন মাসে দেবেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন, অক্ষয়কুমার সেখানে ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮৪১ সালে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার জন্য অক্ষয়কুমার রচনা করেন ‘ভূগোল’ ও ‘পদার্থনীতি’ গ্রন্থ।
২
এর পরবর্তী ঘটনা অনেকের জানা, আসে অক্ষয়কুমারের জীবনের দ্বিতীয় বাঁক। তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা যখন হুগলির বাঁশবেড়িয়াতে স্থানান্তরিত হয় তখন অক্ষয়কুমার সেখানে যেতে অস্বীকার করেন ও শিক্ষকতা থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি কলকাতা কেন্দ্রিক জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকতে চেয়েছিলেন যা সুদূর (সেকালে সুদূরই ছিল) বাঁশবেড়িয়াতে গেলে ব্যাহত হবে।
এই সময়ে অক্ষয়কুমার ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন । ১৭৬৫ শকের ৭ পৌষ (২১ ডিসেম্বর, ১৮৪৩) দেবেন্দ্রনাথ কুড়ি জন বন্ধুসহ ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন। দেবেন্দ্রনাথের কথায়—
‘প্রথম শ্রীধর ভট্টাচার্য্য উঠিয়া বেদীর সম্মুখে প্রতিষ্ঠা পাঠ করিয়া ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করিলেন। পরে শ্যামা চরণ ভট্টাচার্য্য; পরে আমি, তাহার পরে, ব্রজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আনন্দচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, তারকনাথ ভট্টাচার্য্য, হরদেব চট্টোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, হরিশ্চন্দ্র নন্দী, লালা হাজারী লাল, শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়, ভবানীচরণ সেন, চন্দ্রনাথ রায়, রামনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, শশীভূষণ চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানচন্দ্র রায় , লোকনাথ রায় প্রমুখ ২১ জন ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করিলেন।’
অর্থাৎ সেই সময়ের সমাজের ভিন্ন চিন্তাভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু মানুষের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হলেন অক্ষয়কুমার।
দেবেন্দ্রনাথ ভাবলেন তত্ত্ববোধিনী সভার কর্মকাণ্ড ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও অন্যান্য মানুষের কাছে প্রচার হওয়া দরকার আর এই তাগিদ থেকেই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দেবেন্দ্রনাথ বেছে নিলেন অক্ষয়কুমারকে, কারণ তিনি দেখেছিলেন অক্ষয়কুমারের রচনা ‘অতিশয় হৃদয়গ্রাহী ও মধুর’। কিন্তু পত্রিকা সম্পাদনায় নিয়মিত হস্তক্ষেপ করতেন দেবেন্দ্রনাথ। দেবেন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন,
‘তিনি যাহা লিখিতেন, তাহাতে আমার মতবিরুদ্ধ কথা কাটিয়া দিতাম, এবং আমার মতে তাঁহাকে অনিতে চেষ্টা করিতাম; কিন্তু তাহা আমার পক্ষে বড় সহজ কাজ ছিল না। আমি কোথায় আর তিনি কোথায়। আমি খুঁজিতেছি ঈশ্বরের সহিত আমার কী সম্বন্ধ; আর তিনি খুঁজিতেছেন বাহ্য বস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির কী সম্বন্ধ; —আকাশ ও পাতাল প্রভেদ।’
১৮৪৩ সালের ১৬ আগস্ট তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। অক্ষয়কুমার ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৫ ১২ বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এই সময়কাল ছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সুবর্ণযুগ। তাঁকে কেউ কেউ বাংলার প্রথম বিশুদ্ধবাদী যুক্তিবাদী লেখক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন কিন্তু তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সমস্ত লেখা যুক্তিবাদী মতপ্রসারী এমনটা বলা যাবে না। অল্প বয়সে (মাত্র ২৩ বছর) তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার দায়িত্ব পেয়ে তিনি সেখানেই বিজ্ঞানচর্চা শুরু করেছিলেন। সৌরজগৎ, সিন্ধুঘোটক, বনমানুষ, পৃথিবী-চন্দ্র-সূর্য-গ্রহণ ইত্যাদির বিস্তারিত আলোচনা, ভারতবর্ষের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বাণিজ্য বিবরণ, পদার্থবিদ্যা প্রভৃতির পাশাপাশি ছিল বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার ইত্যাদি ছিল সেই সময়ের ধারাবাহিক প্রকাশনা। দেবেন্দ্রনাথ বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের জন্য তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশ করেননি, কিন্তু পত্রিকার জনপ্রিয়তার কথা ভেবে অক্ষয়কুমারের সঙ্গে আপোষ করেছিলেন, তেমন অক্ষয়কুমারও হয়তো বিজ্ঞান আলোচনার নানা নিবন্ধে পরমেশ্বরের অনির্বচনীয় উপস্থিতির কথা বলতে ভুল করেননি। এটা কি অক্ষয়কুমারের নিজের মতামত না বিজ্ঞান প্রচারের স্বার্থে নিজের সঙ্গে আপোষ! প্রশ্ন থেকেই যায়।
এই সুশৃঙ্খল বিজ্ঞানজগৎ ঈশ্বরের অস্তিত্বের সন্দেহহীন প্রমাণ এবং এই প্রকৃতির যাবতীয় নিয়ম, বিজ্ঞান যেসব নিয়ম আবিষ্কার করে এবং আবিষ্কার করার চেষ্টা করে—সবই ঈশ্বরসৃষ্ট। এইসব নিয়ম জানার মধ্য দিয়েই পরমেশ্বরকে জানা যায়—এই পর্যন্ত বলেই কিন্তু অক্ষয়কুমার থামেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বরের নিয়ম অমোঘ, যা ঈশ্বর নিজেও বদলাতে পারেন না। তাই জাগতিক প্রাপ্তির জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করা বৃথা। তাতে কোনো ঘটনা বদলাবে না। যেমন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষার বা রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করে কোনো লাভ নেই।
এরই ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই অক্ষয়কুমারের সেই বিখ্যাত সমীকরণ:
পরিশ্রম = শস্য
পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য
প্রার্থনা = ০
বেদ বা কোনো ধর্মগ্রন্থকেই অপৌরুষেয় বা ঈশ্বর প্রণীত বলে মানতে পারেননি অক্ষয়কুমার। বই মানুষেরই রচনা, কালক্রমে তা পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে, সুতরাং কোনো বইকে ধর্মের ভিত্তি করা ঠিক নয়—এমনটাই ভেবেছিলেন তিনি।
বেদ অভ্রান্ত বলে মানলেন না এবং দেবেন্দ্রনাথকে মেনে নিতে বাধ্য করলেন বেদ অপৌরুষেয় নয়। বেদ এবং বেদান্ত নিয়ে অক্ষয়কুমারের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের আলোচনা কয়েক বছর ধরে চলেছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ‘ গ্রন্থে সে কথা লিখেছেন—
‘ব্রাহ্মসমাজের ধর্ম অগ্রে বেদান্তধর্ম ছিল। ব্রাহ্মগণ বেদের অভ্রান্ততায় বিশ্বাস করিতেন। অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় এই উভয়ের (বেদ ও বেদান্ত) প্রতিবাদ করিয়া বিচার উপস্থিত করেন। প্রধানত তাঁহারই প্ররোচনাতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উভয় বিষয়ে গভীর চিন্তায় ও শাস্ত্রানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন। … ১৮৫০ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় বহু অনুসন্ধান ও চিন্তার পর অক্ষয়কুমার অবলম্বিত মত যুক্তিসিদ্ধ জানিয়া, বেদন্তবাদ ও বেদের অভ্রান্ততাবাদ পরিত্যাগ করিলেন।’
অক্ষয়কুমার বিশ্বপ্রকৃতিকে ঈশ্বরের খোলা ধর্মগ্রন্থ মনে করতেন, জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়েই চাইতেন সেই গ্রন্থ পাঠ করতে। দুটি ছেলেমেয়ের বিবাহ দেওয়ার ব্যাপারে আজ থেকে দেড়’শ বছরেরও বেশি আগে তাঁর মতামত ছিল অত্যন্ত বাস্তববাদী, বলেছিলেন—
‘কন্যা ও পুত্রের পানিগ্রহণ সম্পন্ন হইবার পূর্বে পরস্পর সাক্ষাৎকার, সদালাপ উভয়ের স্বভাবগত ও মনোগত অভিপ্রায় নিরূপণ, সদসৎ চরিত্র পরীক্ষা ও প্রণয় সঞ্চার হওয়া আবশ্যক।’
৩
১৮৪৩ থেকে ১৮৫৫, এই বারো বছর অক্ষয়কুমার যে বাঁকের মধ্য দিয়ে চলেছেন, সেটাই তাঁর জীবনের পরম উপলব্ধির সময়—তখন তাঁর বয়স ২৩ থেকে ৩৫ বছর। এই সময় চিন্তাগত ক্ষেত্রে দেবেন্দ্রনাথ-অক্ষয়কুমারের যুক্তির সংঘাত ব্রাহ্মধর্মের অঙ্গনকে ছিন্নভিন্ন করেছে বারবার। ১৮৫৩ সালে (২৬ ফাল্গুন, ১৭৭৫ শক) রাজনারায়ণ বসুকে লেখা দেবেন্দ্রনাথের একটি চিঠি চিন্তাগত ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার-দেবেন্দ্রনাথের মতের বৈপরীত্যকে আরও প্রকট করে—
‘ক্রমাগত তোমার পত্র পাইয়া সন্তোষ লাভ করিতেছি। বিশেষত: গতবারের মেদিনীপুরের ব্রাহ্মসমাজের বক্তৃতা পাইয়া এবং আমার বান্ধবমণ্ডলীর মধ্যে তাহা পাঠ করিয়া পরম সুখী হইয়াছি। ইহার মধ্যে জ্ঞানের উজ্জ্বলতা, ভক্তির প্রগাঢ়তা, উৎসাহের প্রবণতা, ভাবের সরসতা দীপ্যমান রহিয়াছে। এ বক্তৃতা আমাদের বন্ধুদিগের মধ্যে যাঁহারা শুনিলেন তাঁহারাই পরিতৃপ্ত হইলেন, কিন্তু আশ্চর্য্য এই যে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে প্রকাশযোগ্য বোধ করিলেন না। কতকগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে; ইহাদিগকে এ পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে আর ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের সুবিধা নাই।‘
রাজনারায়ণ বসুর বক্তৃতাটি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশযোগ্য মনে করেননি—পত্রিকার পেপার কমিটি বা গ্রন্থাধ্যক্ষ সভার দুই সদস্য অক্ষয়কুমার দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এইসব ঘটনাপ্রেক্ষিতে অক্ষয়কুমার নিজেই তত্ত্ববোধিনী ছেড়ে দেন, না তাঁকে বহিষ্কার করা হয়, এ নিয়ে সংশয় আছে, কিন্তু এটা পরিষ্কার যে অক্ষয়কুমারের বিজ্ঞান চেতনার সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের ধর্মবোধের যে প্রবল দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল সেটা মেনে নিয়ে অক্ষয়কুমারের মতো একজন বেতনভুক কর্মচারীর পক্ষে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধ মতাদর্শ প্রচার করে তত্ত্ববোধিনী সম্পাদনা করা সম্ভব হয়নি। ১৮৫৫ সালে তাঁকে সম্পাদক পদ থেকে অব্যহতি নিতে হয়। অবশ্য এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরও একটি বিষয়—অক্ষয়কুমারের শারীরিক অসুস্থতা।
জীবনের প্রথম দিকে অক্ষয়কুমার যাঁদের লেখা পড়ে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন জর্জ কুম্ব (১৭৮৮-১৮৫৮) তাঁদের অন্যতম। ১৮২৮ সালে তাঁর বই ‘Constitution of Man in Relation to External Objects’ প্রকাশিত হয়। এই বইটি উনিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলির অন্যতম ছিল। ১৮২৮ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে ব্রিটেন ও আমেরিকা মিলিয়ে কুম্বের বইয়ের প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। ওই শতকেই ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ এবং ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত হয় কার্ল মার্ক্স্-এর ‘ক্যাপিটাল’-এর প্রথম খণ্ড।
অক্ষয়কুমার কুম্বের বইটিতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন—এই বইয়ের সূত্র ধরেই লিখলেন বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার (প্রথম ভাগ ১৮৫১, দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৩)। এই বইখানি অনেকাংশেই কুম্বের Constitution of Man-এর ভাবানুবাদ। বইটি সেই সময়কার শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত তরুণ মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। শুধু চিন্তাজগৎকেই নয়, সরাসরি জীবনযাত্রাকেই প্রভাবিত করেছিল—বিশেষত বিবাহ ও নারীপুরুষ সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলি ছিল যথার্থই বৈপ্লবিক।
৪
অক্ষয়কুমারের জীবনের শেষ বাঁকটি ছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনা থেকে অব্যহতি নিয়ে স্বাধীন চিন্তায় নিজেকে নিয়োজিত করা—যার ফলশ্রুতি ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থটির দুটি খণ্ড (প্রথমটি ১৮৭০ এবং দ্বিতীয়টি ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত) প্রকাশ। প্রথম খণ্ডে আলোচ্য বিষয় ছিল তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের ইতিহাস, যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধিতা। দ্বিতীয় খণ্ডে বেকনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি ভারতীয় দর্শনের মৌলিক আলোচনা/সমালোচনা, গ্রিক ও ভারতীয় দর্শন ও বিজ্ঞানের তুলনা, ভারতীয় চিন্তায় অনিশ্বরতা ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রাধান্য, রামমোহন রায়ের বিজ্ঞান চিন্তা।
এর প্রাসঙ্গিকতা খুঁজতে আমাদের আবার পিছিয়ে যেতে হবে কুম্বের প্রসঙ্গে। অক্ষয়কুমার কুম্বে আকৃষ্ট হলেন কেন? কুম্ব তাঁর সময়ে প্রতিষ্ঠিত খ্রিস্টধর্ম আশ্রিত নৈতিকতার বিপরীতে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ বিজ্ঞানভিত্তিক মতাদর্শের আশ্রয় খুঁজছিলেন। চাইছিলেন সেই আশ্রয়ের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে এমন এক উদারনৈতিক সামাজিক কাঠামো গড়তে যেখানে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সঙ্গে মানুষের মূল্যবোধের কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না।
প্রায় একই সমান্তরাল দ্বন্দ্ব এবং সমান্তরাল সমাধান খোঁজার প্রক্রিয়ায় মেতেছিলেন অক্ষয়কুমার। তবে এক্ষেত্রে একাদিকে ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ এবং অন্যদিকে তথাকথিত ভারতীয় ঐতিহ্য—এই পরিস্থিতিতে যোগ করেছিল অন্য এক অপ্রত্যাশিত মাত্রা। অক্ষয়কুমার ব্রাহ্ম মত বলতে এমন একটা কিছু বুঝতেন যা আধুনিক (সে যুগের প্রেক্ষিতে) বিজ্ঞানের বিকা শধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং যা জ্ঞান আহরণের পথে বাধা সৃষ্টিকারী যে কোনো সংস্কার বা কুসংস্কারের পরিপন্থী। তবে তখনও তিনি পরমেশ্বরের ধারণায় বিশ্বাসী। ব্রাহ্ম সমাজ ছিল তাঁর আশ্রয়স্থল। ১৮৫৩ সালে ভবানীপুর ব্রাহ্মসমাজের এক বক্তৃতায় অক্ষয়কুমার স্পষ্টভাবেই ব্রাহ্ম ধর্মের উদারতা ও বিজ্ঞানমনষ্কতার এই বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন—
‘আমরা ব্রাহ্মসমাজী, ভারতবর্ষীয় প্রাচীন সম্প্রদায়ের ন্যায় ইংলন্ডিয় ভাষা শিক্ষা করিতে ভীত হই না এবং ইয়ুরোপীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ন্যায় অভিনব বিদ্যার প্রচার দেখিয়াও কম্পিত হই না। আমরা অবনিমণ্ডল সচল শুনিয়াও শঙ্কিত হই না এবং তদর্থে ক্রুদ্ধ হইয়া পিসা নগরীর প্রসিদ্ধ পণ্ডিতকে নিগ্রহ করিতেও প্রবৃত্ত হই না। আমরা ইতিপূর্বে ভূতত্ত্ববিদ্যার উৎপত্তি শুনিয়াও সচকিত হই না, এবং অধুনা জর্জ কুম্ব প্রণীত পুস্তক-প্রচার বিষয়েও প্রতিকূল হই নাই। আখিল সংসারই আমাদের ধর্মশাস্ত্র। বিশুদ্ধ জ্ঞানই আমাদের আচার্য।’
৫
তবে শেষ জীবনে ব্রাহ্ম ধর্মের নিরাপদ (?) আশ্রয় থেকে অক্ষয়কুমারের উত্তরণ ঘটেছে নাস্তিকতায়। দেবেন্দ্রনাথ তো ইতোমধ্যেই তাঁকে ‘নাস্তিক’ অভিধায় অভিহিত করেছেন পূর্বে উল্লিখিত দেবেন্দ্রনাথ-রাজনারায়ণ পত্রালাপ)। রাজনারায়ণ বসু এক জায়গায় মার্জিতভাবে বলেছেন, ‘The Babu long ago abjured his belief in Brahmoism and turned an agnostic ‘ …., অন্যত্র অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে বলেছেন, ‘He abjured Brahmoism long ago, but he was tenaciously fond of appropriating to himself the sole glory of having introduced certain reforms in the Samaj.’ দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারের মৃত্যুর পর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার একটি নিবন্ধে লিখলেন—
‘অক্ষয়বাবুর যখন ব্রাহ্মসমাজের সহিত সংযোগ, তখন হইতেই তাঁহার ভাবে ও কার্য্যে তিনি ইংরাজিতে যাহাকে বলে সংশয়বাদী তাহাই ছিলেন। … এইরূপ ভাব ও সংশয়বাদ যখন তাঁহার নেতা, তখন তাঁহার দ্বারা ব্রাহ্মসমাজের আধ্যাত্মিক সংস্কার স্বীকার করা বা মনে করা আমরা মহাপাপ বিবেচনা করি। তিনি যে ভাব লইয়া ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করিয়াছিলেন, তাহা ধর্মের প্রতিপন্থী।’
জীবনের কর্মময় বছরগুলি যিনি ব্রাহ্ম সমাজের উন্নয়নকল্পে ব্যয় করেছিলেন এ মন্তব্য তাঁর পক্ষে অত্যন্ত অসম্মানজনক।
রামমোহন রায়ের বিজ্ঞানচিন্তার প্রতি প্রভূত আস্থাবান ছিলেন অক্ষয়কুমার—বিদ্যাসাগর ছিলেন তাঁর পরম বন্ধু। এছাড়াও পরিণত বয়সে ফ্রান্সিস বেকন-এর প্রত্যক্ষবাদ ও আরোহী তর্কবিদ্যা তাঁর উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। অক্ষয়কুমারকে নিরীশ্বরবাদের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বেকন। বেকনের আরও একটু ভাবনা অক্ষয়কুমারকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল, সেইটি হল, বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার সর্বাঙ্গীন উন্নতি। ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের ইতিহাসচর্চা করতে গিয়ে অক্ষয়কুমারের বারবার মনে হয়েছে এদেশে একটি বেকনের দরকার ছিল—
‘(ভারতবর্ষীয়) দার্শনিক গ্রন্থাকারেরা অনেকেই সতেজ বুদ্ধির সুপুষ্ট বীজ লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। যদিও তত্ত্বানুসন্ধনের প্রকৃত পথাবলম্বন পূর্বক বিশুদ্ধ বিজ্ঞান মর্গে বিচরণ করিতে পারিতেন, তবে বহুকাল পূর্বে ভারত ভূমিও ইয়ুরোপ-ভূমির ন্যায় এ অংশে ভূস্বর্গ-পদে অধিরূঢ় হইতেন, তাহার সন্দেহ নাই। তাঁহারা বিশ্বের যথার্থ প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতিসিদ্ধ নিয়মাবলী নির্ধারণ পূর্বক কর্তব্যাকর্তব্য-নিরূপণের নিশ্চিত উপায় চিন্তা না করিয়া কেবল আপনাদের অনুধ্যান বলে দুই একটি প্রকৃত মতের সহিত অনেকগুলি মন:কল্পিত মত উদ্ভাবন করিয়া গিয়েছেন। তাঁহাদের একটি পথ প্রদর্শকের অভাব ছিল। একটি বেকন-একটি বেকন-একটি বেকন—তাঁহাদের আবশ্যক হইয়াছিল।’
‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’, ২য় খণ্ড
প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্যবিস্তার নামে অক্ষয়কুমারের লেখা একটি পুস্তিকা তাঁর পুত্র রজনীনাথ দত্তের (কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পিতা) উদ্যোগে ১৯০১ সালে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি পুরোপুরি বস্তুবাদী, লিখেছেন, ভারতবর্ষের প্রাচীন পণ্ডিত চিন্তাশীল মানুষের মনে এমন ধারণা হয়েছিল যে ইহজগত মায়া প্রপঞ্চময়, মরীচিকার মতো। পার্থিব কার্যকলাপ এই ক্ষণ ভঙ্গুর অস্থায়ী জীবনে সমৃদ্ধি আনতে পারে ঠিকই কিন্তু যা স্থায়ী নয় তার জন্য কাজ করা বৃথা। বরং পরলোকই নিশ্চিত, অতএব দেহান্তে যাতে সুখলাভ হয় তাই করণীয়। এর ফলে—
‘কিরূপে শিল্প বানিজ্যাদির উন্নতি সাধন করিয়া ইহ জীবনের সুখসম্মৃদ্ধ লাভ হইবে, তাহা চিন্তা না করিয়া কি প্রকারে পারলৌকিক সুখভোগের পথ প্রশস্ত হইবে লোকে তাহারই চিন্তায় মগ্ন হইল।’
১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয় ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’। এদেশে সেই বই পৌঁছতে কতদিন লেগেছিল আমাদের কাছে সঠিক তথ্য এই মুহূর্তে নেই। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে অক্ষয়কুমার সেই বই পড়েছিলেন এবং আত্তীকরণ করেছিলেন। ১৮৮৩ সালে যখন ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় তখন কপিলের সাংখ্যদর্শন সম্পর্কে পাদটীকায় অক্ষয়কুমার লিখলেন—
‘আধুনিক বিজ্ঞানবিদ সর্বপ্রধান ইয়ুরোপীয় পণ্ডিত-সম্প্রদায়ের মত The Theory of Evolution কিয়দংশ কি এই সাংখ্য-মতের অনুরূপ মনে হয় না? তাঁহারা বলেন যেমন শুককীট রূপান্তরিত হইয়া প্রজাপতি উৎপন্ন হয়, সেইরূপ এক বস্তু ও এক প্রাণী পরিণত হইয়া অন্য বস্তু ও প্রাণী উৎপন্ন হইয়া আসিয়াছে। কপিল ঋষি তাঁহাদের ঐ মতের একটি সংকুচিত অঙ্কুর রোপণ করিয়া গিয়েছেন একথা বলিলে কি বলা যায় না?’
অক্ষয়কুমারের বয়স যত বেড়েছে, ততই তিনি ধর্ম থেকে, ঈশ্বরভাবনা থেকেই দূরে সরে গিয়ে যুক্তিবাদী হয়ে ওঠেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের হানাহানির বিরুদ্ধে ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ের প্রথম খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা আছে। দ্বিতীয় খণ্ডে লিখলেন—
‘ভূমন্ডলে স্বমত-পক্ষপাতী ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকের বিদ্বেষ প্রভাবে অতীব ভয়ঙ্কর নৃশংস কান্দা সমুদায়, এমন কি সহস্র সহস্র ও লক্ষ লক্ষ নরবধ পর্য্যন্ত ঘাটিয়া গিয়াছে।’
জীবনের শেষ পর্বে বেকনের আরোহী যুক্তিপ্রণালী, নিউটনীয় পদার্থবিদ্যা এবং ডারউইনের বিবর্তন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব তাঁকে এক নিখাদ বৈজ্ঞানিক বিশ্বদর্শনের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধকে তিনি তাঁর জীবনের অঙ্গ করে নিয়েছিলেন।
অক্ষয়কুমার তাঁর জীবনের সেরা সময়টি ব্যয় করেছেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনায় (১৮৪৩-১৮৫৫)। এর পাশাপাশি চলছিল ব্রাহ্মধর্ম সংস্কারের নানা কাজ এবং দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে মতাদর্শগত নিরন্তর সংঘাত। অক্ষয়কুমারের পরে তত্ত্ববোধিনীর সম্পাদক হন যথাক্রমে নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অযোধ্যা নাথ পাকড়াশী। ১৮৮৪ সালে সম্পাদক হন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা অক্ষয়কুমারের সম্পাদনায় যে উদার নীতি নিয়েছিল, পরবর্তীকালে তা নিছক ধর্মীয় মুখপত্রের সংকীর্ণতায় নেমে আসে। ‘বর্তমান শতাব্দীর বাঙ্গালাসাহিত্য‘ প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আক্ষেপ করে লিখেছেন—
‘শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয় কুমার দত্ত এই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনা করিয়া আপনাকে চিরস্মরণীয় করিয়াছেন ও দেশের বহুবিধ মঙ্গলসাধন করিয়াছেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা তখন এখনকার মতো একটিমাত্র সভার কাগজ হয় নাই, উহা তখন সমস্ত বাঙ্গালার ইউরোপীয় ভাবপ্রচারের মিসনরি ছিল, …।’
দেবেন্দ্রনাথকেও স্বীকার করতে হয়েছিল—
‘অক্ষয় কুমার দত্ত যদি সে সময় পত্রিকা সম্পাদন না করিতেন, তাহা হইলে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার এরূপ উন্নতি হইতে কখনই পারিত না।’
এসব সত্ত্বেও অক্ষয়কুমারের মৃত্যুর পর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় দ্বিজেন্দ্রনাথের মূল্যায়ন আমাদের ব্যথিত করে।
মহেন্দ্রনাথ রায় (বিদ্যানিধি) অক্ষয়কুমারের জীবদ্দশাতেই তাঁর একটি জীবনী রচনার উদ্যোগ নেন এবং স্বয়ং অক্ষয়কুমারের সঙ্গেও এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। মহেন্দ্রনাথের লেখা ‘বাবু অক্ষয় কুমার দত্তের জীবনবৃত্তান্ত‘ প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে। এই জীবনবৃত্তান্তের অনেক কথা দেবেন্দ্র অনুরাগীদের উষ্মার কারণ হয়। ১৮৮৬ সালে অক্ষয়কুমারের মৃত্যু হয়। দেবেন্দ্র অনুরাগীরা ইতিহাস বদলে দেওয়ার ব্যাপারে এতটাই সক্রিয় ছিলেন যে তাঁরা উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের মতো করে নকুড়চন্দ্র বিশ্বাসকে দিয়ে ‘অক্ষয় চরিত’ নামে আরেকটি জীবনী লেখান। সেটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালে।
অক্ষয়কুমারের জীবনের সেরা কাজ দু’ খণ্ডে ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ প্রণয়ন। উপাসক সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় খণ্ডের উপক্রমণিকার শেষ অংশে অক্ষয়কুমার তাঁর অন্যান্য গবেষণার ফল ‘যদি কখনও তৃতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়’ তবে তাতে সংকলন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। অক্ষয়কুমারের সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। ১৮৮৩ সালে ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’-র দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশের পর অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় বছর তিনেক বেঁচে ছিলেন। এই সময়কালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় কিছু সম্প্রদায়ের বিবরণ প্রকাশিত হয় যা পরবর্তীকালে বারিদবরণ ঘোষ সম্পাদিত ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’-র দ্বিতীয় খণ্ডে ‘তৃতীয় ভাগ’ নামে পরিশিষ্টে সংকলিত হয়।
শেষকথা
বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় কুমার একই সময়ের মানুষ। উনিশ শতকের সামাজিক বাস্তবতার কারণে বিদ্যাসাগরকে আমরা ভুলতে পারিনি। কিন্তু এটাও ঠিক যে তাঁর আদর্শ আপামর বাঙালি জীবনে গ্রহণ করেনি।
অক্ষয় কুমারকে বাঙালি ভুলে গেছে সহজে। তার অবশ্য কয়েকটি কারণ আছে। সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেরই কাছের লোক ছিলেন না অক্ষায়কুমার। তাঁর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি ছিল না। তাঁর যা কিছু শিক্ষা, মনন, চিন্তন, ব্যুৎপত্তি সবই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তিনি অর্জন করেছিলেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যই ছিল তাঁর স্বভাবের শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য। তাঁর যুক্তি, তথ্য, বিজ্ঞান মানসিকতা ও সর্বোপরি তাঁর চিন্তাধারা সেকালের আপামর বাঙালি মননের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না, ছিল যুগের থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে।
অক্ষয়কুমারকে ভুলে যাওয়ার এটাও আর একটা কারণ বৈকি!
তথ্যসূত্র
১. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মজীবনী, সাহিত্যবিহার, কলকাতা, (২০১৩)৷
২. প্রিয়নাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলী, অলকানন্দা পাবলিশার্স, কলকাতা, (২০১৪)৷
৩. অক্ষয় কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় (দ্বিতীয় ভাগ), করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, (১৪২০ বঙ্গাব্দ)৷
৪. আশীষ লাহিড়ী, অক্ষয় কুমার দত্ত : আঁধার রাতে একলা পথিক, দে ‘ জ পাবলিশিং, কলকাতা, (২০০৭)
৫. কোরক সাহিত্য পত্রিকা, বইমেলা, সম্পা: তাপস ভৌমিক (২০২০)।
বর্তমানের জন্য প্রাসঙ্গিক, শুধুমাত্র এইটুকু লিখলে অন্যায় করা হবে। আগামী প্রজন্মের জন্যও আপনার এই তথ্যভিত্তিক প্রচেষ্টা মাইলফলকের ভুমিকায় অগ্রজের দাবীদার হয়ে থাকবে।
নমস্কার নেবেন