সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

রঙের রূপকথা

রঙের রূপকথা

মানসপ্রতিম দাস

মে ৪, ২০২৫ ১১২ 1

একটা রঙ নিয়ে মাতামাতি চরমে। কিন্তু প্রাকৃতিক রূপে সহজে পাওয়া যাচ্ছে না সেটা। অতএব সন্ধান বিকল্পের। ফ্রান্সে জাতীয় শিল্পসমূহকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য তৈরি সোসাইটি ১৮২৪ সালে ঘোষণা করল ছ’ হাজার ফ্রাঁ পুরস্কারমূল্য। যে পারবে ওই রঙের কৃত্রিম রাসায়নিক সংস্করণ বের করতে সেই পাবে পুরস্কার। এমন পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে আগেও। ১৮১৭ সালে ইংল্যাণ্ড-এর রয়্যাল কলেজ অফ আর্টস ঘোষণা করেছিল এমন পুরস্কার তবে সেখানে অর্থমূল্য ছিল অনেক কম। যাই হোক, ফরাসি সংস্থার ঘোষণায় আকৃষ্ট হল সে যুগের সব ধরনের কারিগর। আবোলতাবোল দাবি করে উপার্জন করা ভুয়ো পণ্ডিত থেকে দক্ষ শিল্পী—সবাই ছিলেন প্রতিযোগীর দলে। অবশেষে তুলোঁ শহরের জঁ-ব্যাপতিস্ত গিমেত সাফল হলেন ব্যাপারটায়। প্যারিসে এসে তিনি রীতিমত ব্যবসা শুরু করলেন নিজের তৈরি কৃত্রিম রঞ্জক নিয়ে। প্রাকৃতিক রঞ্জকের দামের এক-দশমাংশ দামে তিনি বিক্রি করতে লাগলেন নিজের রাসায়নিক রঞ্জক। ১৮২৮ সালে তাঁকে দেওয়া হল পুরস্কার। কিন্তু তাঁর সাফল্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এক মাসের মধ্যে পাল্টা দাবি এল অন্য এক উৎস থেকে। ইউনিভার্সিটি অফ টুবিনজেন-এর জার্মান রসায়নবিদ ক্রিশ্চিয়ান মেলিন বললেন যে, সামান্য আলাদা একটা প্রক্রিয়া তিনি আবিষ্কার করেছেন ওই রঙের কৃত্রিম সংস্করণ বানাতে। আরও কথা কী, আবিষ্কারটা হয়ে গিয়েছে এক বছর আগেই, কোথাও প্রকাশ করা হয়নি বিষয়টা। শুরু হল লড়াই। গিমেত বললেন যে তাঁর পদ্ধতি তো আবিষ্কৃত হয়েছে ১৮২৬ সালে। সোসাইটিকে জানানোর আগে অবধি সেটা গোপন রেখেছিলেন তিনি। বেশ কয়েক বছর ধরে চলল এই সঙ্ঘাত। অবশেষে গিমেত-এর দাবিই গ্রহণ করল সোসাইটি। পুরস্কারমূল্য রইল তাঁর দখলেই।

নীল রঙের কথা

এবার তো স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে, কোন রঙ নিয়ে হচ্ছে আলোচনাটা? উত্তর দিতে গেলে আনতে হয় চিত্রকলার কথা। সেখানে দরকার অজস্র রঙের সমাবেশ। এর মধ্যে একটা অবশ্যই নীল। কিন্তু ‘নীল’ বললেই তো আর হল না, রয়েছে অনেক রকমের নীল। এর মধ্যে সবথেকে নজরকাড়া যেটা তার নাম—আলট্রামেরিন। এরই কৃত্রিম সংস্করণ বের করার জন্য এত লড়াই। জানতে পেরে নির্ঘাৎ আরও অনুসন্ধানের দিকে ঝুঁকবে জিজ্ঞাসু মন। নাম শুনে একটা আন্দাজের চেষ্টা হবে। মেরিন মানে সামুদ্রিক, তাহলে নিশ্চয়ই সমুদ্রের নীল রঙের কথা বলা হচ্ছে। সেই রঙই যদি গাঢ় হয় তবে হয়তো তার নাম দাঁড়ায় আলট্রামেরিন। উঁহু, ডাহা ফেল। বুঝতে হলে ইউরোপের মানচিত্র থেকে চোখ সরিয়ে নজর নিবদ্ধ করতে হবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম কোণে—আফগানিস্থান। কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপের চিত্রকলা নির্ভর করেছে এই দেশের নীলাভ এক পাথরের উপর। জটিল রাসায়নিক যৌগ দিয়ে তৈরি এই পাথরের নাম লাপিস লাজুলি, আফগানিস্থান থেকে যখন পৌঁছত ইউরোপের কোনো দেশে, ধরা যাক ইতালিতে, তখন তো অবশ্যই পার হতে হত সমুদ্রের বিস্তার। তাই এই পাথর থেকে পাওয়া রঙের নাম আলট্রামেরিন। কিন্তু পাথর গুঁড়ো করলেই যে সেই অনবদ্য নীল রং হাতে ধরা দিত তা একদম না। গুঁড়ো পাথরের রঙ ম্যাড়ম্যাড়ে, ধূসর। তাহলে? মোম দিয়ে ওই খনিজকে মেখে বার বার জল দিয়ে ধুয়ে বের করতে হত আলট্রামেরিন। জলীয় দ্রবণে আত্মপ্রকাশ করত সেই অপূর্ব নীল। এত দূর থেকে বয়ে আনা আর তারপর এত কষ্ট করে নিষ্কাশন রঙ দামি তো হতেই হবে।

এবার একটা উলটপুরাণ। শিল্পী তাঁর ছবিতে কোন রঙ কেন ব্যবহার করেছেন তা শিল্পীর অনুপস্থিতিতে জন্ম দিতে পারে অসংখ্য কল্পনার। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন এই—রঙের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ওই—বা হয়তো অমুক তমুক ইত্যাদি প্রভৃতি। কিন্তু রঙের রাজপথ ধরে যদি এগোই তবে সম্পূর্ণ অন্য অর্থ তৈরি হতে পারে ক্যানভাসে নির্দিষ্ট কোনো রঙ ব্যবহারের। মধ্যযুগে আঁকা এবং ক্যাথিড্রালের কুঠুরি বা প্রাচীরে সংরক্ষিত মাতা মেরির ছবির দিকে তাকান। বহু ক্ষেত্রেই তাঁর বসনের রঙ নীল—আলট্রামেরিন। কেন? জল্পনা ছাড়ুন, সবথেকে দামি রঙটা যে যিশুর গর্ভধারিণীর জন্য রাখবেন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানরা তাতে আর আশ্চর্য কী! অতএব মাতা মেরির গাউন হল দৃষ্টিনন্দন নীল—আলট্রামেরিন। একটু বেশি কেঠো হয়ে গেল ব্যাখ্যাটা? এর থেকে ভালো শোনাত—নীলের অর্থ নম্রতা, গুণের সমাহার ইত্যাদি বললে।

সে আর কী করা যাবে, সত্য যে কল্পনার থেকেও আশ্চর্যের তা কি আর নতুন করে বলতে হবে!

তুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে জাতীয় গ্যালারিতে উইল্টন ডিপটিচ, কুমারী মেরি গাঢ় নীল রঙের বসনে জড়ানো। চিত্র ঋণ – Medievalists.net

লালের ক্ষেত্রেও এমন চমক অপেক্ষা করে আছে বৈকি। মধ্যযুগে অ্যালকেমির চর্চা বিস্তার লাভ করেছিল বিশ্বের বিভিন্ন কোণে। সে চর্চা অন্ধকার যুগের ইউরোপের তুলনায় তীব্রতা পেয়েছিল ইসলামের অন্যতম কেন্দ্র মধ্যপ্রাচ্যে। অ্যালকেমিতে সাধারণ ধাতু থেকে সোনা তৈরির লক্ষ্যই হয়তো প্রধান কিন্তু এর বিশেষজ্ঞরা সবসময় ওই ব্যাপারে মগ্ন থাকতেন এমন নয়। দু’ তিনটে রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে আশাতীত কোনো যৌগ তৈরি করাতে আনন্দ পেতেন তাঁরা। এভাবেই এক সময় পারদ আর গন্ধক মিশিয়ে তাঁরা হঠাৎই তৈরি করলেন মার্কারি সালফাইড। চেনা বাংলায় সিঁদুর, ইংরেজিতে ভারমিলিয়ন। উজ্জ্বল, টকটকে লাল সে পদার্থ। এমন উজ্জ্বল আবেদনকে অস্বীকার করেন কীভাবে চিত্রশিল্পীরা? মধ্যযুগে ধর্মচর্চার কেন্দ্রগুলো নিজেদের সন্ন্যাসী বা ভাড়া করা শিল্পীকে দিয়ে শাস্ত্রে কথিত ঘটনাগুলোকে জীবন্ত করে তুলতেন ক্যানভাসে। যাঁর নির্দেশে ছবি আঁকা হচ্ছে, যিনি আঁকছেন, যাঁরা দেখছেন—সবাই বিশ্বাস করতেন এমন ছবির একটা প্রতীকী মূল্য আছে।

ব্যাপারটা বোধহয় বোঝানো গেল না।

রঙ-রেখার বাইরে ছবির একটা মন্ত্রশক্তি আছে—এমনটাই বোধহয় বিশ্বাস করতেন সংশ্লিষ্ট মানুষরা। এমন ছবি খুব উজ্জ্বল হবে, সবথেকে বেশি আবেদনপূর্ণ হবে—এ দাবি থাকত স্বাভাবিকভাবে। উজ্জ্বল, লাল ভারমিলিয়ন যে এইসব ছবিতে ব্যবহার হবে এতে কোনো বিস্ময়ের অবকাশ নেই। এই একই যুক্তিতে মধ্যযুগের ছবিতে ব্যবহৃত হত উজ্জ্বল, স্বর্ণাভ হলুদ।

হলুদ বা লালের জন্য চিত্রকররা নির্ভর করেছেন বিষাক্ত এক ধাতুর উপর—সীসা। এই কাজটাও চিত্রকরদের জন্য করে দিতেন অ্যালকেমিস্টরা। ভিনিগারের বাষ্প এবং পশুদের মলের সংস্পর্শে সীসা পরিণত হয় লেড কার্বনেট-এ। উনবিংশ শতক পর্যন্ত আর্টিস্টদের কাছে এটাই ছিল বিশুদ্ধতম সাদা রঞ্জক। এই শ্বেতরঞ্জক ধীরে ধীরে উত্তপ্ত করলে তৈরি হয় লাল রঞ্জক—লেড টেট্রক্সাইড বা রেড লেড। ইতিহাসের কথা অনুসরণ করলে বলতে হয়, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে ব্যবহ্যত হচ্ছে এই লাল রং। মধ্যযুগের ল্যাটিন ভাষায় এই রংকে বলা হত ‘মিনিয়াম’। সেই সময়ের বহু পাণ্ডুলিপিতে ব্যবহৃত হত এই রঙ। এতে উজ্জ্বল দেখাত পাণ্ডুলিপি। মিনিয়াম ব্যবহৃত হত বলে এগুলোকে বলা হত ‘মিনিয়েচার’। আজ আমরা মিনিয়েচার শব্দের অর্থ যা জানি তা হল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। এটা কিন্তু মিনিয়েচার শব্দের গৌণ অর্থ। মিনিয়াম ব্যবহার করে তৈরি পাণ্ডুলিপি বা অক্ষর ছোটো আকারের হত। সেই ছোটো হওয়াটাই অর্থ হিসেবে পাকাপাকি জুড়ে গিয়েছে মিনিয়েচারের সঙ্গে।

রঙের রূপকথা

রঙের লভ্যতা বা সহজলভ্যতা কীভাবে চিত্রকলাকে প্রভাবিত করতে পারে তার একটা দারুণ উদাহরণ রয়েছে এই রঙের রূপকথাতেই। ব্যাখ্যাটা কতজনের কাছে গ্রহণযোগ্য তা জানা নেই তবে যাঁরা তৈরি করেছেন এটা তাঁরা খেয়ালখুশির বশে করেননি। গবেষণার ছাপ রয়েছে পূর্ণ মাত্রায়। ছবিতে কোনটা প্রধান, রেখা না রঙ? এ নিয়ে বিতর্ক চলছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। রেনেসাঁসের সময়ে বা তার কিছু আগেও এ বিতর্ক ছিল ইউরোপ জুড়ে। এদিকে হাতে রঙ না পেলে তো আর সেটা ক্যানভাসে চড়ানোর প্রশ্ন ওঠে না। ইতালির অন্যতম প্রধান বন্দরশহর হল ভেনিস। সেখানে সুদূর প্রাচ্যের মালমশলা এসে পৌঁছত নিয়মিতভাবে। এর মধ্যে যেমন থাকত খাবারদাবার, কাপড়চোপড় তেমনি থাকত রঙ। ভেনিস-এ বসবাসকারী শিল্পীদের কাছে রঙের সরবরাহ কোনো সমস্যার বিষয় হয়নি। এই সুবিধে কিন্তু ফ্লোরেন্স-এর ছিল না। ভেনিস-এর মতো ফ্লোরেন্সও ছিল রেনেসাঁসের অন্যতম কেন্দ্র। কিন্তু সেখানকার জগৎবিখ্যাত শিল্পীরা যেমন লেওনার্দো দা ভিঞ্চি বা মিকেলাঞ্জেলো রঙের প্রাচুর্য ভোগ করেননি। তাঁদের ছবিতে তাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে রেখা, রঙ নয়। ভেনিস-এর টিশিয়ান আর ফ্লোরেন্সের লেওনার্দোর ছবির মধ্যে ভিন্নতার মূলে যে রঙের সরবরাহের মতো একটা নিখাদ বস্তুময় বিষয় থাকতে পারে তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। যাই হোক, রঙ আর রেখার প্রাধান্য নিয়ে বিতর্ক সপ্তদশ শতকে সম্ভবত ঝুঁকে পড়ে রেখার দিকে। ফলে রঙ কিছুটা হলেও দুয়োরানি হয়ে পড়ে। উনবিংশ শতক পর্যন্ত চলেছিল এমনভাবেই।

রঙের ক্ষেত্রে লাল, নীলের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হল হলুদ। রেনেসাঁসের যুগে সীসা, টিন আর আন্টিমনির যৌগ ব্যবহার করা হত ক্যানভাসে হলুদ রং ফুটিয়ে তোলার জন্য। প্রত্যেকটা ধাতুই শরীরে বিষক্রিয়া তৈরি করতে পারে। কিন্তু হলুদের মধ্যে স্বর্ণ আভা ফুটিয়ে তোলার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এল যে যৌগ তার মূলে আরও বিষাক্ত এক ধাতু—আর্সেনিক। এমনিতে এই রঙ ছিল দুর্লভ, তার উপর বিষক্রিয়ার বিপদ। তাই সংশ্লিষ্ট মানুষজন বারবার সাবধান করতেন শিল্পীদের যে কোনোভাবে যেন এই আর্সেনিক সালফাইড বা ওর্পিমেন্ট (পীতক) মুখের সংস্পর্শে না আসে। কিন্তু এত ভালো রঙকে অস্বীকার করা কি সহজ! টিশিয়ান-এর আঁকা সুপরিচিত এক ছবি ‘বাক্কাস অ্যান্ড আরিয়াদনে’-র মধ্যে এই রঙের সমাবেশ ঘটেছে। আগেই বলেছি, খুব সুলভ ছিল না এই রঙ। তবে সে সময় ফার্মেসি চালানো এবং ছবি আঁকার কাজ একইসঙ্গে করতেন যাঁরা, তাঁদের কিছু সুবিধে ছিল। রঙের রসায়ন তাঁরা জানতেন। নিজেদের ফার্মেসিতে তৈরি করে ফেলতেন বেশ কিছু প্রয়োজনীয় রঙ। ব্যাপারটা বেশ মজার, ওষুধের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে ছবির রঙ। এমন সুবিধে ভোগ করেছিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে একজন শিল্পীর নাম লুকাস ক্রানাচ। রেনেসাঁস যুগের এই জার্মান শিল্পীকে অ্যালকেমিস্ট বললে ভুল হবে না। মজা হচ্ছে, ধরাবাঁধা বইতে বা ইন্টারনেটের পেজে লুকাস-এর এই পরিচয় তুলে ধরা হয় না।

‘বাক্কাস অ্যান্ড আরিয়াদনে’, চিত্র ঋণ – ColourLex, Science and Art

রঙের মাধ্যম

এবার রঙের মাধ্যমের বা মিডিয়াম-এর কথা একটু বলা যাক। গুঁড়ো রঙকে জলে বা তেলে গুলে ব্যবহার করেন শিল্পীরা, এটাই দেখতে অভ্যন্ত আমরা। প্রকৃতির অন্য কোনো বাইণ্ডিং মিডিয়ামের কথা সাধারণভাবে শুনি না আমরা। মধ্যযুগে একটা মাধ্যম কিন্তু ব্যবহৃত হত বহুল পরিমাণে। ডিম ফাটিয়ে তার হলুদ অংশ বের করে নিতেন শিল্পী বা তাঁর সহকারি। তার মধ্যে গোলা হত রঙ। এর একটা অসুবিধে ছিল এই যে রঙের মিশ্রণ শুকিয়ে যেত তাড়াতাড়ি। মধ্যযুগের পরে শিল্পীরা এই পথ ছেড়ে আঁকড়ে ধরলেন তেলকে। পার্থক্য কী হল? ডিমের ব্যবহার করে রঙকে দীর্ঘ সময় তরল রাখতে পারতেন না বলে শিল্পীরা তেমনভাবে হালকা শেড তৈরি করতে সক্ষম হতেন না, তেলে সেই সমস্যা না থাকায় রেনেসাঁসের শিল্পীরা একই রঙের অনেক হালকা শেড তৈরি করতেন ক্যানভাসে। পার্থক্যটা নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক।

তবে বাইণ্ডিং মিডিয়ামের গুরুত্ব বোঝাতে বিষয়টাকে আর একটু দীর্ঘায়িত করা যায়। বলা যায় বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের অন্যতম চিত্রকর ইভস ক্লেইন-এর (Yves Klein) কথা। নীল রঙ নিয়ে অদ্ভুত মাতামাতি তাঁর। বিংশ শতকের মাঝামাঝি ক্লেইন শুধুমাত্র নীল রঙ দিয়ে একগুচ্ছ ছবি এঁকে তাক লাগিয়ে দেন বিশ্বকে। ক্লেইনের নীল আর কিছুই নয়—আলট্রামেরিন। কিন্তু গুঁড়ো রঙে যে উজ্জ্বলতা সেটা জল বা তেলে গুলে তিনি পাননি। তাই অসন্তুষ্ট ছিলেন। খুঁজছিলেন এমন একটা মাধ্যম যার মধ্যে গুঁড়ো রঙের উজ্জ্বলতা বজায় থাকে। ১৯৫৫ সালে ক্লেইন খুঁজে পেলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত মাধ্যম। এটা একটা কৃত্রিম রজন জাতীয় পদার্থ, নাম ‘Rhodopas M60A’. এই মাধ্যমে আলট্রামেরিন মেশালে রঙের উজ্জ্বলতা বজায় থাকে। ১৯৬০ সালে এই রঙকে পেটেন্টও করে ফেলেন তিনি। শুধুমাত্র এই একটা রং নিয়ে আচ্ছন্ন থাকা তাঁর চিত্রকর জীবনের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। তাঁর নিজের নামটাও নীলের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে তৈরি হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্লেইন ব্লু। সে যাই হোক, এই ব্যতিক্রমী শিল্পীর কাছে বিশেষ বাইন্ডিং মিডিয়ামের গুরুত্ব বিপুল।

আলট্রামেরিন-এর আকর্ষণ এবং পাশাপাশি তার দুষ্প্রাপ্যতা চিত্রশিল্পীদের কাছে সমস্যার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সমস্যাকে জাতীয় পর্যায়ের বলে মনে করেছিলেন ইউরোপের বহু প্রশাসক। এই বোধ বেশি লক্ষ্য করা গিয়েছে ফরাসিদের মধ্যে। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ফরাসি সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব আরওপ করলেন রঙের রসায়নকে বিকশিত করার উপর। এ কাজে নিয়োগ করা হল খ্যাতনামা রসায়নবিদদের। বিশেষ নজর দেওয়া হল আলট্রামেরিন-এর কৃত্রিম বিকল্প খুঁজে বের করার দিকে। সরকারের পক্ষ থেকে এই বিশেষ দায়িত্বটি দেওয়া হল লুই জ্যাকোয়েস থেনার্ডকে (Louis-Jacques Thénard). তিনি গবেষণা করতে গিয়ে দেখলেন যে কোবাল্ট ধাতু ব্যবহার করে একটা উজ্জ্বল নীল রং তৈরি করা যাচ্ছে। এর নাম দেওয়া হল কোবাল্ট ব্লু। এই শুরু হল কোবাল্টের জয়যাত্রা। ১৮৫০-এর দশকে, কোবাল্টে-এর এক যৌগ, শিল্পীদের জন্য এনে দিল হলুদ রঙ—অরিওলিন। সেটা ফ্রান্সে সহজলভ্য হল। এখানেও শেষ নয়, এল কোবাল্ট ভায়োলেট নামে বেগুনি রঙ। বস্তুতপক্ষে এটাই হল প্রথম বিশুদ্ধ বেগুনি রঞ্জক। কিছু কিছু শিল্পীদের কাছে প্রিয় হয়ে দাঁড়াল কোবাল্ট স্ট্যানেট—ঘন নীল এক রঞ্জক।

আবারও নীল, শুধু নীল   

ঘুরে-ফিরে এসেই যাচ্ছে নীল। ইংরেজি ভাষায় একটা শব্দ আছে অ্যাজিওর (azure)। গোটা ইউরোপ জুড়ে এই শব্দের ভাই-বোনেরা ছড়িয়ে আছে। ফরাসীতে azur, ইতালিয় ভাষায় azzuro, পোলিশ ভাষায় lazur, রোমানীয়তে azuriu, পর্তুগীজ এবং স্প্যানিশ ভাষায় arul ইত্যাদি। আদতে এটা পরিষ্কার আকাশের নীল রংকে নির্দেশ করে। কিন্তু azure আসলে যুক্ত হয়ে আছে lapis lazuli-র সঙ্গে। পাথরের জন্য ল্যাটিন শব্দ হল Lais। এদিকে পারসিক, আরবিক হয়ে মধ্যযুগের ল্যাটিন ভাষায় ঢুকে পড়েছিল lazuli শব্দটা। এটা দুটো অর্থ নির্দেশ করে। এক হল নীল রঙের পাথরটাকে আর অন্যটা হল সেই খনির জায়গা যেখানে লাপিস লাজুলি উত্তোলন করা হত। ইংরেজি ভাষায় azure শব্দটা ঢুকেছে সম্ভবত ফরাসি থেকে। ১৩৭৪ সালে প্রথম জিওফ্রে চসার তাঁর রচনায় (Troilus and Criseyde) এই শব্দের প্রয়োগ ঘটান রঙ নির্দেশ করতে।

Azure শব্দের ব্যবহার এক খনিজের রঙ বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়। এর নাম azurite। এটা তামার যৌগ। রঙটা আকর্ষণীয়, ঘন নীল। স্বাভাবিকভাবেই এটা স্থান পেয়েছে ক্যানভাসে। বহু প্রাচীন সময় থেকে ব্যবহাত হচ্ছে এটা। অন্যান্য নীলের পাশাপাশি মিশরীয় শিল্পীরা ব্যবহার করতেন এই রঞ্জক। এদিকে রেনেসাঁসের ইউরোপে তুলনায় সস্তা এই রঞ্জকের সঙ্গ ছাড়েননি শিল্পীরা। এখানে টিশিয়ান-এর আঁকা ‘বাক্কাস অ্যান্ড আরিয়াদনে’ ছবিটা আর একবার আলোচনা করা যায়।

দামি আলট্রামেরিন ব্যবহৃত হয়েছে আরিয়াদনের পোশাকে। পাশে যে সমুদ্র তার প্রত্যাশিত রং সবুজাভ নীল। ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী ব্যবহার করেছেন অ্যাজুরাইট। এই রঙের সংগ্রহ নিয়ে সমস্যা ছিল না ইউরোপে। ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, জার্মানি এবং স্পেনের বেশ কয়েকটা জায়গায় অ্যাজুরাইট-র খনি ছিল। সহজলভ্য এই রং ব্যবহার করার আরও একটা কারণ ছিল উত্তর ইউরোপে। সহজে আলট্রামেরিন পৌঁছচ্ছে না যেখানে সেখানকার শিল্পীরা কাজ চালাবেন কীভাবে! তাই অ্যাজুরাইট ভরসা ছিল তাঁদের। পণ্ডিতরা বলছেন, এই কারণেই রেনেসাঁসের যুগে জার্মান এবং ডাচ শিল্পীদের ছবিতে ছড়াছড়ি ছিল এই অ্যাজুরাইট-এর।

অথ আর্সেনিক প্রসঙ্গ

সীসা হল, কোবাল্ট হল, তামা হল, আর্সেনিকও হয়েছে। তবু আরেকবার ওই আর্সেনিক-এর প্রসঙ্গ না আনলেই নয়। অবশ্য রঙটা নীল নয়, সবুজ। ১৮১৪ সালে ইংল্যান্ডে আত্মপ্রকাশ করল এক নতুন রঞ্জক—এমারেল্ড গ্রিন। সেটা আর্সেনিক-এর যৌগ। এর আগে আর একজন নামী রসায়নবিদ আর্সেনিক আর তামার এক যৌগ সামনে এনেছিলেন যা ছিল সবুজ রঙের—সেটা কপার আর্সেনাইট। রসায়নবিদের নাম কার্ল ভীলহেল্ম শিলা। আঁতোয়া ল্যাভয়সিয়ের এবং যোসেফ প্রিস্টলের সঙ্গে অক্সিজেন মৌলটি আবিষ্কারের দাবিদার ছিলেন তিনিও। শিলাস গ্রিন হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিল এই সবুজ রঞ্জক। জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল, কারণ তার আগে এমন সবুজ ছিল না বাজারে। হলুদ আর নীল রঞ্জক উপযুক্ত অনুপাতে মিশিয়ে সবুজ রং বানিয়ে নিতেন অধিকাংশ শিল্পী। সমস্যা এটাই যে দীর্ঘ সময়ের পরে এই দুটো উপাদানের কোনো একটা ফিকে হয়ে যেত। ফলে সবুজ রঙ করা পোশাক বা মঠ হয়ে যেত নীলাভ বা হলদেটে। শিলাস গ্রিন এই সমস্যার সমাধান করেছিল দারুণভাবে। কিন্তু এমারেল্ড গ্রিন এসে টেক্কা দেয় সেটাকে। এখানে অবশ্য সমস্যা তৈরি হল অন্য একরকম। ক্যানভাসের বাইরেও ব্যবহৃত হল শিলাস গ্রিন এবং এমারেল্ড গ্রিন—কম খরচের কারণে। ঘরের দেওয়ালের রঙ হিসেবে এই দুটো সবুজ রঞ্জক ব্যবহাত হচ্ছিল বিপুলভাবে। কিন্তু আর্দ্রতা বেশি থাকলে এই আর্সেনিক যৌগগুলো ভেঙে গিয়ে আর্সিন নামে এক বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন করত। শোবার ঘরের দেওয়াল থেকে এমন গ্যাস বের হওয়ায় ১৮৬০-এর দশকে ইংল্যান্ডে মারা যাচ্ছিল বহু শিশু। কিন্তু কেউই ঠিক সেই সময়ে সম্ভবত মৃত্যুর কারণটা আন্দাজ করতে পারেননি। এমন মৃত্যুর আরও একটা ঐতিহাসিক মাত্রা পাওয়া যায়। হেলেনা দ্বীপে বন্দি থাকার সময় নেপোলিয়নের মৃত্যুর পিছনেও এই আর্সিনের প্রভাবের কথা আন্দাজ করেন বিশেষজ্ঞরা।

রং ও চিত্রকলার ইতিহাস  

এমনই বৈচিত্র্যময় রঙের রূপকথা। সেখানে নানা কাহিনি, নানা দুৰ্ঘটনার শিলালিপি খুঁজে পাওয়া যাবে। আসলে রঞ্জক এবং ক্যানভাসে তার প্রয়োগকে কেবলমাত্র শৈল্পিক-চেতনার সঙ্গে না-জুড়ে বোধহয় যুক্ত করা উচিত আরও অনেক বিষয়ের সঙ্গে যা বস্তুময়। এর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অবশ্যই একটা। তা যদি করা হয় তবে ছবি অর্থাৎ চিত্রকলার ইতিহাস নতুন চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হবে আগ্রহী পাঠক বা দর্শকের সামনে। ভিন্ন দৃষ্টিতে সৃষ্টির নিদর্শনগুলোকে বিচার করা তখন অনেক সহজ হয়ে যাবে। এমন প্রচেষ্টা বিশ্বের কোথাও কোথাও হয় বটে। আবার কখনো সে সবের উল্লেখ করা যাবে বিচক্ষণ পাঠকের জন্য।

শীর্ষক চিত্র পরিচিতি: – আলট্রামেরিন রঞ্জক, চিত্র ঋণ – উইকিপিডিয়া

তথ্যসূত্র

১। ফিলিপ বল, ব্রাইট আর্থঃ দ্য ইনভেনশন অফ কালার, (ভিন্টেজ বুকস, ২০০১)৷

২। তানিথ হিণ্ডলে, আর্টিস্টস পিগমেন্টসঃ আ হিস্ট্রি অফ আল্ট্রামেরিন ব্লু, (ব্রমিজ আর্ট সাপ্লাইজ, ইন্টারনেট, জানুয়ারি ২৫, ২০২৩)৷

৩। লুকাস ক্রানাচ দ্য এল্ডার অ্যাণ্ড হিজ ওয়ার্কশপ, (ফ্রিডরিশ-আলেকজাণ্ডার-ইউনিভার্সিটাট (FAU), ইন্টারনেট, মার্চ ২৭, ২০১৮)৷

৪। এ বেকার, কমন মিডিয়াভাল পিগমেন্টস, (ইউনিভার্সিটি অফ পিট্‌সবার্গ, ইন্টারনেট (২০০৪)৷

বিজ্ঞানের ইতিহাস ও জনপ্রিয় বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি ও সম্প্রচারের কাজে তিন দশক ধরে যুক্ত আছেন। স্নাতক থেকে পিএইচডি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আকাশবাণীর অনুষ্ঠান আধিকারিক হওয়ার পাশাপাশি একজন স্বাধীন গবেষক। প্রকাশিত বই: ন্যানোটেকনোলজি, নক্ষত্রের নকশিকাঁথা, শতাব্দীর বিশ্বমারী, জলবায়ু বিতর্ক, একুশ শতকের নোবেলজয়ী চিকিৎসাবিজ্ঞান, সুস্থায়ী উন্নয়নের নীল নকশা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু: একটি জীবনকথা।

মন্তব্য তালিকা - “রঙের রূপকথা”

  1. মান্যবরেষু
    নীলের ওপর লেখা আপনার কবিতাটি পড়া এইমাত্র শেষ করে মন্তব্য লিখছি।
    দীর্ঘায়ু ও বিস্তৃত হোক আপনার জীবন্ত লেখনী।
    নমস্কার নেবেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।