সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বৌদ্ধ সাধনে যান মাহাত্ম্য

বৌদ্ধ সাধনে যান মাহাত্ম্য

কৌশিক সরকার

মে ১৬, ২০২২ ৮৮০ 5

আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর আগে এক রাজপুত্র মতান্তরে ধনাঢ্য ও সমাজে প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান জরা, মরণ ও দুঃখ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে তাঁর সম্পদ ও রাজসুখ ছেড়ে গৃহত্যাগী হয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন এবং দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনার পর গৃহ থেকে বহু দূরে অধুনা গয়ার কাছে বুদ্ধগয়ায় এক অশ্বত্থ বৃক্ষের নীচে বোধিজ্ঞান লাভ করে বুদ্ধ হলেন। এরপরে তাঁর পরিনির্বাণ পর্যন্ত আগামী পঁয়তাল্লিশ বছর বহুজনের হিত ও সুখের জন্য এই বোধিজ্ঞান তিনি তাঁর হাজার হাজার অনুগামী ও শিষ্যদের মধ্যে প্রচারের মাধ্যমে এক ধর্মীয়, দার্শনিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিপ্লবের সূচনা করে নিজেকে ভগবান রূপে প্রতিষ্ঠিত করলেন। এই পর্যন্ত প্রায় আমরা সকলেই জানি। কিন্তু সঙ্গত কারণেই মনে প্রশ্ন জাগে যাঁর ধর্মশিক্ষার মূল বিষয় ছিল চার আর্যসত্য ও অষ্টাঙ্গিক মার্গ তাঁর মহাপরিনির্বাণের পর তাঁর শিষ্যরা হীনযান, মহাযান ও তাদের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলেন কেন এবং তাঁদের মতবাদের মধ্যে এত বিভিন্নতা চলে এল কোথা থেকে? এখানে যান অর্থে কিন্তু যানবাহন নয়। এই যানের অর্থ পন্থ বা মত। আসুন ইতিহাস খুঁজে দেখি এই বিভিন্ন যানের উৎপত্তি কীভাবে হল।

আমাদের প্রথমেই জানতে হবে তথাগত বুদ্ধ যখন স্বয়ং এই জগতে উপস্থিত ছিলেন তখন কি কোন যান ছিল? অথবা তিনি নিজে কি কোন যানের কথা বলে গিয়েছেন? শুনতে আশ্চর্য লাগলেও তথাগত স্বয়ং দুটি যানের কথা বলে গিয়েছেন। শ্রাবকযান ও প্রত্যেকবুদ্ধযান। তথাগত বুদ্ধ যখন এই জগতে উপস্থিত থাকেন তখন যিনি সরাসরি তাঁর কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করে যথাক্রমে স্রোতাপন্ন,  সকৃদাগামী, অনাগামী ও অর্হৎ হয়ে নির্বাণ প্রাপ্ত হন ও নিজের উদ্ধার সম্পন্ন করেন তিনি শ্রাবক। এই পদ্ধতিকে বলে শ্রাবকযান। আবার বুদ্ধ যখন এই জগতে উপস্থিত থাকেন না তখন নিজের প্রচেষ্টায় নির্বাণ প্রাপ্ত হয়ে যিনি নিজের উদ্ধারকার্য সম্পন্ন করেন তিনি প্রত্যেকবুদ্ধ। এই পদ্ধতির নাম প্রত্যেকবুদ্ধযান। তথাগত বুদ্ধের জ্ঞাতিভ্রাতা দেবদত্তের যখন প্রয়াণ হয় তখন তথাগত বলেছিলেন, “দেবদত্ত তাঁর কৃতকর্মের জন্য কল্পকাল নরকযন্ত্রণা ভোগ করবেন এবং তারপর প্রত্যেকবুদ্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করে নির্বাণ প্রাপ্ত হবেন।” কিন্তু এই দুই যান এক সুরে বাঁধা। এদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই। শুধুমাত্র বুদ্ধ জগতে উপস্থিত থাকা অথবা না থাকার  উপর ভিত্তি করে স্বীয় উদ্ধারকার্যে সচেষ্ট কোন ব্যক্তি কোন পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হবেন তারই বর্ণনা মাত্র। কিন্তু হীনযান ও মহাযান সেরকম নয়। তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। আর এই মতপার্থক্যের বীজ কি তথাগতের জীবদ্দশাতেই কোথাও লুকিয়ে ছিল? চলুন দেখি ২৬০০ বছর আগের কুশিনারায় (অধুনা কুশিনগর), তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণ স্থলে।

ভগবান তথাগত বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের তিন মাস আগের ঘটনা। বৈশালীতে অবস্থানকালে তিন মাস পরে তিনি তাঁর পরিনির্বাণের দিন ঘোষণা করেছেন। আনন্দ ভগবানের কাছে জানতে চাইলেন তাঁর অবর্তমানে কে এই সংঘ পরিচালনা করবেন? ভগবান হেসে বললেন, “আনন্দ, ভিক্ষুগণ আমার কাছ থেকে আর কি প্রত্যাশা করে? যা শিক্ষা দেবার তা পূর্বেই দিয়েছি। আমাকে ভিক্ষুসংঘ পরিচালনা করতে হবে বা আমার পরে ভিক্ষুসংঘের কি হবে এরূপ চিন্তা বুদ্ধগণ করেন না।” অতএব হে আনন্দ-

“অত্তদীপা বিহরত অত্তসরণা অনঞ্ঞসরণা,

ধম্মদীপা বিহরত ধম্মসরণা অনঞ্ঞসরণা।”

অর্থাৎ নিজের প্রদীপ নিজে হয়ে বিহার কর, আত্মশরণ হও। নিজের মুক্তির জন্য অন্যের ওপর নির্ভর কোরো না। ধর্মদীপ হয়ে বিহার কর, ধর্মের শরণাগত হও।

এরপর ভগবান ভিক্ষু পরিবৃত হয়ে বৈশালী থেকে তাঁর পরিনির্বাণ স্থান কুশিনগরের দিকে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে ভোগনগরে কিছুদিন অবস্থানকালে ভগবান ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করে বললেন, “হে ভিক্ষুগণ,  আমার অবর্তমানে যদি কখনও কোন ভিক্ষু, থের ভিক্ষু, বহুসংখ্যক থের ভিক্ষু বা সংঘের কাছ থেকে আমার নাম করে কিছু শোন, যদি তিনি বলেন যে আমি স্বয়ং ভগবানের মুখ থেকে শ্রবণ করেছি তাহলে তোমরা ওই ভিক্ষুর বাক্যের অভিনন্দন বা অগ্রাহ্য কোনটাই করবে না। অভিনন্দন বা অগ্রাহ্য না করে তোমরা সূত্র ও বিনয়ের সঙ্গে তার তুলনা করবে। সূত্র ও বিনয়ের সঙ্গে যদি সেই বাক্যের সামঞ্জস্য দৃষ্ট না হয় তাহলে বুঝবে তা আমার বাণী নয় এবং ওই ভিক্ষুই ভ্রান্ত। আর যদি সামঞ্জস্য দৃষ্ট হয় তবেই তা আমার বাণী বলে গ্রহণ করবে।”

তথাগত বুদ্ধের উপরিউক্ত দুইটি উপদেশ থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে ত্রিকালজ্ঞ যোগী আশঙ্কা করেছিলেন তাঁর পরিনির্বাণের পরে তাঁর বাণীর যথেচ্ছ ব্যাখ্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কালক্রমে তাঁর আশঙ্কাই সত্যি হল। কিন্তু একদিনে হয়নি। এর পরের ঘটনা কুশিনগরে। তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণ স্থলে। তখন তিনি সদ্য নিজেকে নির্বাপিত করেছেন বা বলা যায় তিনি সদ্য তাঁর জাগতিক স্থূল দেহ পরিত্যাগ করে নির্বাণ লাভ করেছেন। কিছু ভিক্ষু ক্রন্দনরত। কিছু ভিক্ষু বিলাপরত। কিছু ভিক্ষু শোকাভিভূত। যাঁদের প্রজ্ঞা আরো গভীর হয়েছে এমন কিছু ভিক্ষু তাঁদের শোক সংবরণ করে অধোমুখে তথাগতের দেহের সামনে উপবিষ্ট আছেন। উপস্থিত আছেন মহাস্থবির মহাকাশ্যপ। তিনি লক্ষ্য করলেন সুভদ্র নামক এক ভিক্ষু ক্রন্দনরত কিছু ভিক্ষুকে বলছেন, – “বন্ধুগণ, ভালই হয়েছে, তোমরা শোক ক’র না, বিলাপ ক’র না, আমরা এখন সেই মহাশ্রমণ হতে মুক্ত হয়েছি। এ তোমাদের উপযুক্ত, এ তোমাদের উপযুক্ত নয় ইত্যাদি বাক্যবাণে আমরা উপদ্রুত হতাম, এখন আমরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারব, যা ইচ্ছা নয় তাই করব না।” মহাকাশ্যপ দেখলেন সুভদ্রর মুখে শোকের চিহ্নমাত্র নেই। এই ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত ও চিন্তিত মহাকাশ্যপ মনে মনে সংকল্প করলেন তথাগতের সমস্ত সূত্র ও বিনয়ের বাণী সংকলিত করবেন। উল্লেখ্য যে এই ঘটনার আগে কোন বাণী লিপিবদ্ধ ছিল না। গুরু শিষ্য পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচারিত হত।

তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের তিন মাস পরে আনুমানিক ৫৪২ সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদ রাজগৃহের সপ্তপর্ণি গুহায় অজাতশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় ও মহাস্থবির মহাকাশ্যপের সভাপতিত্বে ত্রিপিটক সংকলনের কাজ শুরু হয়। এই ঘটনাকে ধর্ম সঙ্গীতি বলা হয়। মনে রাখার সুবিধার জন্য তথাগত বুদ্ধ তাঁর বাণী ও উপদেশ ছন্দের আকারে বলতেন। এই ছন্দবদ্ধ ধর্মীয় ভাষ্য নিয়ে যে আলোচনাসভা তাই ধর্ম সঙ্গীতি। আবার পাঁচ শত অর্হৎ ভিক্ষু ও মহাস্থবির মহাকাশ্যপের সভাপতিত্বে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে একে ‘পঞ্চশতিকা’ ও ‘কাশ্যপ-সঙ্গীতি’ নামেও অভিহিত করা হয়। সপ্তপর্ণি গুহায় অনুষ্ঠিত এই সঙ্গীতি ছিল বৌদ্ধ ইতিহাসের প্রথম সঙ্গীতি এবং এই সভায়  শুধুমাত্র বিনয়পিটক (ভিক্ষু ও ভিক্ষুনীগনের আচরণবিধি ও পালনীয় নিয়মের সংকলন) ও সুত্তপিটক (ধর্মীয় সূত্রের সংকলন) সংকলিত হয়েছিল। কিন্তু এত কিছু করেও মতভেদ আটকানো গেল না। এখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য যে, বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে আমরা জানতে পারি তথাগত বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই সঙ্ঘে মতভেদের মতন ঘটনা ঘটেছিল। কৌশাম্বিতে ধম্মধর ও বিনয়ধর ভিক্ষুদের মতবিরোধ এবং তথাগতের জ্ঞাতিভ্রাতা দেবদত্ত কর্তৃক সৃষ্ট মতবিরোধ প্রসিদ্ধ ঘটনা। দেবদত্ত সঙ্ঘে ভিক্ষুদের জন্য নতুন নিয়ম চালু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তথাগত বুদ্ধের গভীর ব্যক্তিত্বের কারণে কোন মতবিরোধই আর দানা বাঁধতে পারেনি। অচিরেই বিনষ্ট হয়েছিল।

প্রথম সঙ্গীতির ১০০ বছর পরের কথা, বৈশালীর বজ্জিপুত্ত ভিক্ষুগণ দেবদত্তের মতই ‘দশবত্থুনি’ নামে দশটি নতুন নিয়ম চালু করলেন বা বলা যেতে পারে পুরাতন দশটি নিয়মের পরিবর্তন করলেন। তথাগত বুদ্ধের অনুশাসন ছিল কঠোর। তাঁর তৈরি নিয়ম ছিল সূর্য মধ্যগগন থেকে পশ্চিমে হেলতে শুরু করলেই সেদিনের মতন আর খাদ্য গ্রহণ করা যাবে না। সঙ্গে কিছু সঞ্চয় করা যাবে না। বজ্জিপুত্ত ভিক্ষুগণ বললেন সূর্য দুই আঙ্গুল পরিমাণ পশ্চিমে হেললেও খাদ্য গ্রহণ করা যেতে পারে। সঙ্গে মোষের সিঙে সামান্য একটু নুন সঞ্চয় করে রাখা যেতেই পারে। এইরকম দশটি নিয়মের পরিবর্তন করে তাঁরা “দশবত্থুনি” চালু করলেন। এই মতভেদের মীমাংসা করার জন্য দ্বিতীয় সঙ্গীতির প্রয়োজন দেখা দিল। এই দ্বিতীয় ধর্ম সঙ্গীতি বৈশালীতে ৪৪২ সাধারণ পূর্বাব্দে সঙ্ঘটিত হয়েছিল। এই সম্মেলনে সাত শত অর্হৎ স্থবির সঙ্গীতির কার্য পরিচালনা করেছিলেন এবং এই সঙ্গীতির মূল উদ্দেশ্য বিনয় সংশোধন ছিল বলে একে “সপ্তশতিকা সঙ্গীতি” ও “বিনয় সঙ্গীতি” নামেও অভিহিত করা হয়। যাই হোক, আট মাস ধরে চলা এই সঙ্গীতিতে বজ্জিপুত্ত ভিক্ষুগণ নিন্দিত হলেন এবং সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে তাঁদের তৈরি “দশবত্থুনি” বিনয় বহির্ভূত বলে প্রত্যাখ্যান করা হল। আশ্চর্যের কথা, সামান্য মতভেদের মীমাংসা করার জন্য ভিক্ষুগণকে আট মাস ধরে আলোচনা করতে হয়েছিল! কিন্তু এত কিছু করেও মতভেদ আটকানো গেল না।

এই ঘটনার কিছুদিন পর দশ সহস্রাধীক ভিক্ষু কৌশাম্বী অঞ্চলে এক মহাসভায় মিলিত হলেন। এই সভায় বিনয় পিটকের কিছু নিয়ম পরিবর্তন করে নতুন করে সংকলিত করা হল। এছাড়াও সূত্র পিটকের কিছু বাক্যের অর্থ অন্য অর্থে আরোপ করে নতুন করে সংকলিত করা হল। যদিও এই সভাকে সঙ্গীতির মর্যাদা দেওয়া হয় না তবুও দেখা গেল এই সভায় উপস্থিত ভিক্ষুগণ দলে ভারী এবং তাঁরা নিজেদের ‘মহাসাংঘিক’ নামে অভিহিত করলেন। তাঁদের তুলনায় সংখ্যায় অল্প এবং এই সভা বর্জনকারী ভিক্ষুগণ ‘স্থবিরবাদী’ বা ‘থেরবাদী’ নামে অভিহিত হলেন। আশ্চর্যের বিষয় যে তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের মাত্র ১০০ বছর পরে এইভাবে ভিক্ষুগণ দুটি দলে ভাগ হয়ে গেলেন। মহাসাংঘিক ভিক্ষুগণ দলে ভারী হওয়ার কারণে প্রবল উৎসাহে তাঁদের মতবাদ প্রচার করতে আরম্ভ করলেন এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও নতুন নতুন দার্শনিক মতবাদ যুক্ত হতে থাকল। যদিও পরবর্তীকালে থেরবাদীগণ এগারোটি উপদলে ও মহাসাংঘিকগণ সাতটি উপদলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন।

এবার আসি হীনযান ও মহাযান প্রসঙ্গে। হীনযান বলে প্রথমে কিছুই ছিল না। আগেই বলেছি প্রত্যেকবুদ্ধযান ও শ্রাবকযান নামে দুইটি যান ছিল। এই দুই যানের উদ্দেশ্যই ছিল নির্বাণের মাধ্যমে নিজের মুক্তির মার্গ নিশ্চিত করা। মহাসাংঘিকরা শুধুমাত্র নিজের মুক্তিতে সন্তুষ্ট রইলেন না। তাঁরা বুদ্ধের মতন হতে চাইলেন। অর্থাৎ তথাগত বুদ্ধ যেমন নিজের মুক্তির মার্গ নিশ্চিত করে জীব উদ্ধারে ব্রতী হয়েছিলেন ঠিক তেমনই মহাসাংঘিকরাও বললেন যতক্ষণ পর্যন্ত না সমস্ত জীবের মুক্তি হচ্ছে ততক্ষণ আমরা নির্বাণ প্রাপ্ত হব না। এই বিষয়ে বড়ই গোলযোগের সৃষ্টি হল। থেরবাদীগণ ঘোর আপত্তি করলেন। তাঁরা বললেন, “তথাগত বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের শুধু নিজের নির্বাণের শিক্ষা দিয়েছেন। জীব উদ্ধারের কথা কোথাও বলা নেই, এ বুদ্ধের শিক্ষার বিকৃতি।” থেরবাদীদের এই আপত্তি মহাসাংঘিকরা পাত্তাই দিলেন না। তাঁরা বললেন, “আমরাই ঠিক, তোমরা ভুল। বুদ্ধ ঠিকই শিক্ষা দিয়েছেন, তোমরা বুঝতে পারনি। বুদ্ধ নিজে যা করতেন তাই শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছেন। বুদ্ধের কথার তোমরা আক্ষরিক অর্থ করেছ, ভাবার্থ করতে পারনি। তোমরা শুধু নিজের নির্বাণের কথা চিন্তা করো। এ নিতান্তই স্বার্থপরতা। আমরা সকল জীবের কথা চিন্তা করি। আমরা মহান। তোমরা হীন।” এরপরেই কালক্রমে মহাসাংঘিকগণ মহাযানী ও থেরবাদীগণ হীনযানী নামে পরিচিত হলেন। কিন্তু কাহিনী এখানেই শেষ হল না।

যত সময় অতিবাহিত হতে থাকল ততই হীনযানীরা বিনয়কে বেশি করে আঁকড়ে ধরলেন। অন্যদিকে মহাযান সম্প্রদায় দিন দিন দার্শনিক তত্ত্বে  সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠলেন। আদি বৌদ্ধ মতবাদ ও হীনযানীদের কাছে বুদ্ধের যে মানুষী রূপ ছিল তাই লোকোত্তরবাদী মহাযানীদের কাছে পরিবর্তিত হয়ে বুদ্ধ একজন অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন স্বর্গবাসী হয়ে উঠলেন। আবার দার্শনিকতার সৌন্দর্য দেখুন, হীনযানীদের কাছে জগৎ মিথ্যা। কারণ এই জগতের সমস্ত কিছুই ক্ষণভঙ্গুর বা ক্ষণস্থায়ী। মহাযানীরা বললেন জগৎ যদি মিথ্যা হয় তাহলে দ্রষ্টা অর্থাৎ যিনি দেখছেন (তিনিও এই জগতের অঙ্গ) তিনিও মিথ্যা। সাধারণ দ্বিতীয় শতকে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও দার্শনিক নাগার্জুনের আবির্ভাব ও তাঁর শূন্যবাদ (বস্তুসারের বিপরীতে বস্তুশূন্যতা) দর্শনের ফলে মহাযান সম্প্রদায়ে এক গভীর বিপ্লবের সূচনা হল। নাগার্জুন রচিত ‘মাধ্যমকবৃত্তি’ মহাযানের প্রথম গ্রন্থ। যদিও কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন যে নাগার্জুনই মহাযান মত প্রবর্তন করেন কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয় বলেই মনে হয়। নাগার্জুনের দুই পুরুষ আগে অশ্বঘোষ ‘মহাযানশ্রদ্ধোৎপাদসূত্র’ নামক এক গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়াও অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ ও ‘সৌন্দরানন্দ’ এই দুই গ্রন্থে মহাযান মতের প্রভাব স্পষ্টই পরিলক্ষিত হয়। এর থেকে বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না যে অশ্বঘোষের আগেও মহাযান মতের উপস্থিতি ছিল।

তথাগত বুদ্ধ যখন তাঁর সদ্ধর্মের প্রচার করেন তখন দলে দলে মানুষ এই ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হলেও তাঁর প্রচারিত সদ্ধর্ম ছিল মূলত সংঘ ভিত্তিক। সংসারত্যাগী ভিক্ষুগণ সংঘে যোগদান করে অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলন, শীল পালন ও সাধনার মাধ্যমে নিজের নির্বাণের মার্গ প্রশস্ত করতেন। বিনয়ের যা কিছু নিয়ম তার সবটাই ছিল ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের জন্য। এই ধর্মে গৃহী উপাসকদের করণীয় তেমন কিছুই প্রায় ছিল না। তাঁরা ত্রিশরণ (বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের শরণ) গ্রহণ করতে পারতেন, ভিক্ষুদের দান-দক্ষিণা দিতে পারতেন এবং স্তূপ ও চৈত্যে ফুল-বাতি প্রদান করে বন্দনা করতে পারতেন। এর বাইরে ধর্মীয় আচরণবিধি প্রায় কিছুই ছিল না। কিন্তু মহাযান দর্শনের বিকাশের ফলে সাধারণ ব্যক্তিরাও ধর্ম পালনে আচরণীয় আরও অনেক কিছু পেলেন। যেমন পারমিতা নামক দশটি আদর্শ, যা সাধারণ গৃহী ভক্তদের কাছে অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলনের থেকে সহজতর ছিল। এছাড়াও মহাযান দর্শনের বিকাশের ফলে সাধারণ গৃহী ভক্তগণ তথাগত বুদ্ধের পূজা করার সুযোগ পেলেন। যদিও স্মরণ রাখতে হবে যে বুদ্ধ স্বয়ং ব্যক্তি পূজার বিরোধী ছিলেন। তাঁর পরিনির্বাণ স্থলে এক শিষ্যের ভবিষ্যতে তাঁকে আর দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপের উত্তরে তথাগত বলেছিলেন, “যিনি দেহরূপী আমাকে দর্শন করছেন তিনি প্রকৃত আমাকে দর্শন করছেন না, যিনি ধর্মকে দর্শন করছেন তিনিই প্রকৃত আমাকে দর্শন করছেন।”

সময় প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে মহাযান মত ক্রমশ দার্শনিক মতবাদে সমৃদ্ধশালী হতে শুরু করল কিন্তু বুদ্ধের গুরুত্ব কমল। ত্রিশরণে যেখানে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ ছিল সেটাই মহাযান সম্প্রদায়ে ধর্ম, বুদ্ধ ও সংঘ হয়ে গেল। অর্থাৎ প্রথম স্থান থেকে অবনমিত হয়ে বুদ্ধ দ্বিতীয় স্থানে এলেন। শুধু তাই নয়, গৌতম বুদ্ধের গুরুত্ব আরও কমতে থাকল যখন একে একে পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধ পূজিত হতে আরম্ভ করলেন। যেমন পঞ্চতত্ত্ব জগৎকারণ রূপে বিবেচিত হয়, তেমনই শূন্য পাঁচ ভাগে বিভক্ত। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান। প্রতিটি ভাগ ‘স্কন্ধ’ নামে পরিচিত এবং এই পঞ্চস্কন্ধ শূন্যাত্মক স্বভাবযুক্ত। পঞ্চ স্কন্ধের প্রতীকরূপে কল্পিত এই পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধ হলেন অমিতাভ, অক্ষোভ্য, বৈরোচন, রত্নসম্ভব ও অমোঘসিদ্ধি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই পাঁচ ধ্যানীবুদ্ধের পুরোহিত হিসাবে ষষ্ঠ ধ্যানীবুদ্ধ বজ্রসত্ত্বের পুজো হতেও দেখা গেল। গৌতম বুদ্ধ নেমে এলেন সপ্তম স্থানে। মহাযানী বৌদ্ধরা বলতে শুরু করলেন গৌতম বুদ্ধ এই পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধের কলমচি মাত্র। অর্থাৎ এই পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধের মতকেই তিনি কলমবন্দী করে গেছেন। আবার এই পাঁচ ধ্যানীবুদ্ধের শক্তিরূপে সামনে এলেন বৌদ্ধদের পাঁচ দেবী মামকী, পান্ডরা, তারা, লোচনা ও বজ্রধাত্বীশ্বরী। ষষ্ঠ ধ্যানীবুদ্ধ বজ্রসত্ত্বের শক্তি হলেন বজ্রসত্ত্বাত্মিকা। শুধু তাই নয় পাঁচ ধ্যানীবুদ্ধের পাঁচজন বোধিসত্ত্বও খুব পূজিত হতে লাগলেন। এঁরা হলেন বজ্রপাণি, পদ্মপাণি, বিশ্বপাণি, সমন্তভদ্র ও রত্নপাণি। ষষ্ঠ ধ্যানীবুদ্ধের বোধিসত্ত্ব হলেন ঘন্টাপাণি।

মহাযান দর্শনের প্রধান বিষয় ছিল বোধিচিত্তের জাগরণ বা উন্নতি। বোধিচিত্ত হল চিত্তের এমন এক অবস্থা যা বোধি বা সম্যক জ্ঞানলাভে সহায়ক। শূন্যতা ও করুণা এই দুই প্রকার চিত্তের সমার্থক রূপ বোধিচিত্ত। কিন্তু এই মতে নির্বাণ লাভ করা খুবই কঠিন কাজ। কত জন্ম ধরে সাধনা করে সাধনার ভিন্ন ভিন্ন স্তরে কত কত লোকভূমি পেরিয়ে শূন্যের উপর শূন্য, তার উপর শূন্য পার করে তবেই নির্বাণ প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব। তাহলে বিষয়টিকে সহজ করা যায় কি করে? এই চিন্তা থেকে অষ্টম শতকে পাল সাম্রাজ্যের সময়ে পূর্ব ভারতে বিশেষ করে বাংলা ও তার আশপাশের অঞ্চলে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম এবং বজ্রযান, সহজযান, মন্ত্রযান নামে বেশ কয়েকটি যানের উদ্ভব হয়। যদিও অষ্টম শতকে এই যানগুলির প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি পায় তবুও অনেকে অসঙ্গকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রধান প্রচারক বলে মনে করেন। অসঙ্গের আবির্ভাব ৩৫০ সাধারণ অব্দ নাগাদ। তিনি বৌদ্ধধর্মের বিজ্ঞানবাদের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু অসঙ্গের সময়কাল বা তার আগের আগমশাস্ত্রে তন্ত্রের কিছু কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়।

বজ্রযান, সহজযান ও মন্ত্রযান এই তিন যানের মধ্যে পার্থক্য অতি সামান্যই। দেব-দেবীর পূজা, তন্ত্র-মন্ত্র, যন্ত্র (যন্ত্র দেবতার প্রতীক। ধাতব পাত বা ভূর্জপত্রে যন্ত্র আঁকা হয়), মণ্ডল (রহস্যময় নকশা) ও বিভিন্ন অদ্ভুত রহস্যময় আচার-অনুষ্ঠান এই যানগুলিতে মোক্ষ লাভের উপায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। শুধু তাই নয় ডাকিনী, যোগিনী, ভৈরব, ভৈরবী, যক্ষিণী, পিশাচী এরাও এই মতের বৌদ্ধগণের উপাস্য হতে শুরু করে। সাধনমালায় উড্ডিয়ান, কামাখ্যা, সিরিহট্ট (শ্রীহট্ট) ও পূর্ণগিরি নামক চারটি স্থানকে তন্ত্রের পীঠস্থান বলে উল্লেখ আছে। এই চারটি স্থানের প্রত্যেকটিতেই বজ্রযোগিনীর পূজা হত। যদিও বর্তমানে তিনটি স্থানের সন্ধান পাওয়া গেলেও উড্ডিয়ানের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন অধুনা বাংলাদেশের ঢাকার নিকটে আমাদের বিখ্যাত বাঙালী অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী নামক স্থানটি প্রাচীন কালের উড্ডিয়ান।

বজ্রযানে শূন্যকে বজ্র নামে অভিহিত করা হয়। কারণ শূন্য বজ্রের ন্যায় দৃঢ়, সারবান, অচ্ছেদ্য, অভেদ্য ও অবিনাশী। যোগরত্নমালায় বলা আছে –

দৃঢ়ং সারমশৌষীর্য্যমচ্ছেদ্যাভেদ্যলক্ষণম্।

অদাহী অবিনাশী চ শূন্যতা বজ্র উচ্যতে।।

অর্থাৎ শূন্যতাই বজ্র। একে ছেদ করা যায় না, ভেদ করা যায় না, দগ্ধ করা যায় না, বিনাশ করা যায় না, ইহা অতি দৃঢ় ও সারবান।

বজ্রযানীরা এই শূন্যের পূজারি। যে পন্থায় শূন্যের সঙ্গে মিলিত হওয়া যায়, তাই বজ্রযান বা শূন্যযান। বজ্রযানে দেব পূজা ও দেব দর্শনের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। এই মতের উপাসকদের চিন্তাধারা ছিল বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণের দাক্ষিণ্য ও সাহচর্যে মুক্তিলাভ সহজতর হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হল মোহিনী অতীন্দ্রিয়বাদ। অর্থাৎ মোহিনী শক্তি করায়ত্ত করে ইহজগৎ থেকে মুক্তিলাভ করে শূন্যে বিলীন হওয়ার প্রচেষ্টা। মোহিনী শক্তি বিষয়ে বজ্রযানে মারণ (মৃত্যু ঘটানো), মোহন (উচ্চারণ করা), স্তম্ভন (অবশ করা), বিদ্বেষণ (বিদ্বেষবশত ক্ষতি করা), উচাটন (তাড়ানো) এবং বশীকরণ (বশ করা) – এই ছয় প্রকার ‘অভিচার’ নামক তান্ত্রিক আচারের কথা জানা যায়। পরবর্তীকালে এই বজ্রযানীরা নিজেদের একটি আলাদা বৌদ্ধ সম্প্রদায় রূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। এই যানের এক বিশেষত্ব হচ্ছে লামাবাদ। কালচক্রযান নামক আরও একটি যান (মত বা পন্থা) এই বজ্রযান থেকে উদ্ভূত। কালচক্রের অর্থ হল ধ্বংসের চক্র। কালচক্র বা ধ্বংসের চক্র থেকে যা রক্ষা করে তাই কালচক্রযান। এই কালচক্রযান পালরাজবংশের সময়ে বাংলায় প্রসারলাভ করে এবং একাদশ শতকে কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে তিব্বতে প্রবেশ করে।

সহজযানীরা মনে করতেন কাঠ-পাথরের দেব-দেবী পুজো করে কোন লাভ নেই। এই যানে প্রধান ভূমিকা হল গুরুর। এই গুরুদের সিদ্ধ বা সিদ্ধাচার্য বলা হত। তিব্বত দেশে সংরক্ষিত আমাদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস থেকে সর্বমোট চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। যাঁদের মধ্যে লুইপাদ ছিলেন সবথেকে প্রাচীন এবং তিব্বতি সাহিত্যে তাঁকে বাংলার মানুষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সিদ্ধাচার্যেরা মাথায় বড় বড় চুল রাখতেন কিন্তু দাড়িগোঁফ কামাতেন। আলখাল্লা পড়তেন। খানিকটা বাংলার আউল বাউলদের মতন এদের বেশভূষা ছিল। সিদ্ধাচার্যরা সন্ধ্যাভাষায় গান লিখতেন, পদ রচনা করতেন। সন্ধ্যাভাষার অর্থ হচ্ছে আলো-আঁধারি ভাষা। যা কানে শুনতে এক, কিন্তু এর গভীর অর্থ আরেক। সহজযান বা তান্ত্রিক সহজিয়া বৌদ্ধধর্মে শূন্যতা হল প্রকৃতি ও করুণা হল পুরুষ। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনে জগৎ সৃষ্টি। আবার এই পুরুষ (করুণা) ও প্রকৃতির (শূন্যতা) মিলনে উৎপন্ন হয় বোধিচিত্তের, যা এক অনির্বচনীয় মহাসুখকর অবস্থা। এই যানে মূলত যৌনাচারযুক্ত যোগসাধনার মাধ্যমে বোধিচিত্ত লাভ করা হয়। এই দর্শন সম্পূর্ণরূপে দেহতাত্ত্বিক। এই প্রসঙ্গে দারিকপাদ বলেছেন –

কিন্তো মন্তে কিন্তো তন্তে কিন্তো রে ঝাণবখানে।

অপইঠানমহাসুহলীণে দুলখ পরমনিবাণেঁ।।

দুঃখেঁ সুখেঁ একু করিআ ভুঞ্জই ইন্দিজানী

স্বপরাপর ন চেবই দারিক সঅলানুত্তরমাণী।।

অর্থাৎ, আরে বালযোগি, তোর মন্ত্রেই বা কী? তন্ত্রেই বা কী? ধ্যানেই বা কী? ব্যাখ্যানেই বা কী? তোমার যখন মহাসুখলীলায় প্রতিষ্ঠা নাই, তখন নির্বাণ তোমার পক্ষে দুর্লভ। তুমি গুরুকে জিজ্ঞেস করে পরমার্থ সত্যের সঙ্গে মহাসূখলীলাকে এক করে পঞ্চকাম উপভোগ করো। দারিক এই উপায়েই পরমপদ প্রাপ্ত হয়ে সংসারে বিচরণ করছেন। তাঁর আত্মপর বোধ নেই।

কিন্তু পঞ্চকাম উপভোগ তো সব মানুষই করে, তাহলে সাধনমার্গে এর বিশেষত্ব কী? আমরা সাধারণ মানুষেরা পঞ্চকাম উপভোগ করে পাপকর্মে লিপ্ত হই। কিন্তু গুরুর উপদেশে যখন শূন্যতার অনুভব হয় বা শূন্যতার বোধ হয়, তখন পঞ্চকাম উপভোগে আর পাপকর্ম সঞ্চিত হয় না।

যদিও সহজযানের সঙ্গে মন্ত্রযানের পার্থক্য অতি সামান্যই তবুও মন্ত্রযান একটি আলাদা মত বা পন্থা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মন্ত্রের দ্বারা সুরক্ষা ও মুক্তির যে মার্গ তাই মন্ত্রযান। এই যানে মন্ত্রই প্রধান। কোন সাংকেতিক শব্দ, অক্ষর, চিহ্ন বা এদের সমষ্টি এক একজন দেব-দেবী বা কোন বিশেষ মন্ত্রের বীজমন্ত্র। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রজ্ঞাপারমিতা মন্ত্রের বীজমন্ত্র ‘প্রং’। রত্নসম্ভবের ‘র’, অক্ষোভ্যের ‘য়’, অমিতাভের ‘ব’। ‘হেবজ্রতন্ত্রে’ তথাগতের যে বীজমন্ত্র উল্লেখ আছে তা হল ‘ওম্ আঃ হুম্ ফট্ স্বাহা’। মন্ত্রযানে মন্ত্রের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত হয়েছে মুদ্রা। হাতের আঙ্গুলের বা দেহের বিশেষ বিশেষ ভঙ্গিমা বা চিহ্নের সাহায্যে এই মুদ্রাগুলি প্রদর্শন করা হয়। এই বিষয়ে অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে স্বয়ং তথাগত গৌতম বুদ্ধও কিছু বিশেষ মুদ্রায় উপবিষ্ট হয়ে উপদেশ প্রদান করতেন। উদাহরণ স্বরূপ ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রার (পদ্মাসনে বসে দুই হাত বুকের কাছে এনে আঙ্গুলের বিশেষ মুদ্রা) কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি আশীর্বাদ করতেন দুটি বিশেষ মুদ্রায়। অভয় মুদ্রা ও চৈতন্য মুদ্রা। এছাড়াও তাঁর অভিবাদন মুদ্রা (দুই হাত বুকের কাছে এনে নমস্কারের ভঙ্গি) বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মুদ্রা আমরা প্রায় সকলেই কম বেশি অনুসরণ করি। অনেকে ধারণা করেন স্বয়ং তথাগত বুদ্ধই তাঁর উচ্চমননশীল শিষ্যদের জন্যে এই মুদ্রাগুলির মাধ্যমে ইশারায় তন্ত্রের সূচনা করে গিয়েছিলেন। যদিও এই ধারণা সত্য নয় বলেই মনে হয়।

অতি সংক্ষেপে এতক্ষণ বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিকাশ ও ভিন্ন ভিন্ন যান সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করলাম। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে প্রতিটি যানের মধ্যে আচার-অনুষ্ঠান ও মতাদর্শের পার্থক্য থাকলেও প্রত্যেকেই তথাগত বুদ্ধের মূলদর্শন নির্বাণের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে অনেক যান তথাগতের দেখানো নির্বাণকে গ্রহণ করেছে ঠিকই কিন্তু নির্বাণের পথকে পরিহার করে নতুন পথ গ্রহণ করেছে। তথাগত তাঁর প্রচারিত সদ্ধর্মে নির্বাণ লাভের পথ হিসেবে শীল, সদাচার ও অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথ গ্রহণ করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি শিষ্যদের যে কোন চরমপন্থা পরিত্যাগ করে মজ্ঝিম পতিপদা বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে বলেছিলেন। অর্থাৎ শরীরকে অধিক কষ্ট দেওয়া বা অধিক ভোগবিলাসে লিপ্ত হওয়া এই দুইয়ের বর্জন করতে বলেছিলেন। তাঁর সময়ে নারী ও পুরুষ এক বিহারে অবস্থান করতে পারতেন না এবং ভিক্ষুণীসংঘ প্রতিষ্ঠার পর তথাগত বিভিন্ন কঠোর নিয়মের প্রবর্তন করেন। অথচ কালের প্রভাবে তাঁর দেখানো সেই নির্বাণ লাভ করতে গিয়ে কিছু যান ঠিক উল্টো পথে হেঁটে অবাধ যৌনতা, যথেচ্ছাচার ও মন্ত্র-তন্ত্রকে নির্বাণের মার্গ হিসেবে গ্রহণ করল। এটি একটি মহান ধর্মের অবমাননা বলেই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এখন ধর্মের এই অসংখ্য গলিপথের মধ্যে সঠিক রাস্তা দেখাবেন কে? বুদ্ধ কি আবারও আমাদের সঠিক মার্গ প্রদর্শন করতে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন? হয়তো বা, মৈত্রেয় রূপে।

তথ্যসূত্র:-

১৷ মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন – ভিক্ষু শীলাচার শাস্ত্রী – মহাবোধি বুক এজেন্সি – দ্বিতীয় সংশোধিত সংস্করণ: ২০১৬।

২৷ বৌদ্ধ দর্শন – রাহুল সাংকৃত্যায়ন – চিরায়ত প্রকাশন – পঞ্চম মুদ্রণ, জুলাই ২০১৮।

৩৷ বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস – ডঃ মণিকুন্তলা হালদার (দে) – মহাবোধি বুক এজেন্সি – পঞ্চম মুদ্রণ ২০২১।

৪৷ বৌদ্ধদের দেবদেবী – ডঃ বিনয়তোষ ভট্টাচার্য – চিরায়ত প্রকাশন – চতুর্থ মুদ্রণ, জুলাই ২০১৫।

৫৷ বৌদ্ধবিদ্যা – ডঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী – মহাবোধি বুক এজেন্সি – দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১০।

৬| ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস – নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য – জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স – তৃতীয় মুদ্রণ ২০১৪।

ছেলেবেলায় বীরভূম আর বর্তমানে কৃষ্ণনগরের স্থায়ী বাসিন্দা কৌশিক সরকারের লেখালেখির বাইরে আগ্রহের মূল বিষয় ডাকটিকিট সংগ্রহ, গান শোনা, বেড়ানো ও বই পড়া। বুদ্ধের জীবন ও বাণী বিষয়ে তার গ্রন্থ ‘নমো তস্স’ বিশেষভাবে প্রশংসিত।

মন্তব্য তালিকা - “বৌদ্ধ সাধনে যান মাহাত্ম্য”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।